নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তোমরা মানুষ, আমরা মানুষ, তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়

যাযাবর চিল

i agree to disagree...

যাযাবর চিল › বিস্তারিত পোস্টঃ

হুমায়ূন আহমেদের শেষ লেখা III

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:২৩


আরব পেনিনসুয়েলা। বিশাল মরুভূমি। যেন আফ্রিকার সাহারা। পশ্চিমে লোহিত সাগর, উত্তরে ভারত মহাসাগর, পূর্বে পার্শিয়ান গালফ। দক্ষিণে প্যালেস্টাইন এবং সিরিয়ার নগ্ন পর্বতমালা। সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন একটি অঞ্চল। এখানে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা বলে কিছু নেই। সারা বৎসরই মরুর আবহাওয়া। দিনে সূর্যের প্রখর উত্তাপ সব জ্বালিয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। সারা দিন ধরে বইছে মরুর শুষ্ক হাওয়া। হাওয়ার সঙ্গে উড়ে আসছে তীক্ষ্ণ বালুকণা। কোথাও সবুজের চিহ্ন নেই। পানি নেই। তারপরেও দক্ষিণের পর্বতমালায় বৃষ্টির কিছু পানি কীভাবে যেন চলে আসে মরুভূমিতে। হঠাৎ খানিকটা সবুজ অঞ্চল হয়ে ওঠে। বালি খুঁড়লে কাদা মেশানো পানি পাওয়া যায়। তৃষ্ণার্ত বেদুঈনের দল ছুটে যায় সেখানে। তাদের উটগুলির চোখ চকচক করে ওঠে। তারা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কাঁটাভর্তি গুল্ম চিবায়। তাদের ঠোঁট কেটে রক্ত পড়তে থাকে। তারা নির্বিকার। মরুর জীবন তাদের কাছেও কঠিন। অতি দ্রুত পানি শেষ হয়। কাঁটাভর্তি গুল্ম শেষ হয়।
বেদুঈনের দলকেও আবারো পানির সন্ধানে বের হতে হয়। তাদের থেমে থাকার উপায় নেই। সব সময় চলতে হবে। এর মাঝেই যুদ্ধ। এক গোত্রের সঙ্গে আরেক গোত্রের হামলা। পবিত্র কোরান শরীফে সূরা তাকবীরে জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যা বিষয়ে আয়াত নাজেল হলো। কেয়ামতের বর্ণনা দিতে দিতে পরম করুণাময় বললেন-
‘সূর্য যখন তার প্রভা হারাবে, যখন নক্ষত্র খসে পড়বে, পর্বতমালা অপসারিত হবে। যখন পূর্ণগর্ভা উষ্ঠী উৎক্ষেপিত হবে, যখন বন্যপশুরা একত্রিত হবে, যখন সমুদ্র স্ফীত হবে, দেহে আত্মা পুনঃসংযোজিত হবে, তখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে- কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?’
যে মহামানব করুণাময়ের এই বাণী আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন, আমি এক অকৃতী তাঁর জীবনী আপনাদের জন্য লেখার বাসনা করেছি। সব মানুষের পিতৃঋণ-মাতৃঋণ থাকে। নবীজির কাছেও আমাদের ঋণ আছে। সেই বিপুল ঋণ শোধের অতি অক্ষম চেষ্টা।
ভুলভ্রান্তি যদি কিছু করে ফেলি তাঁর জন্য ক্ষমা চাচ্ছি পরম করুণাময়ের কাছে। তিনি তো ক্ষমা করার জন্যই আছেন। ক্ষমা প্রার্থনা করছি নবীজির কাছেও। তাঁর কাছেও আছে ক্ষমার অথৈ সাগর।
##
তখন মধ্যাহ্ন।
আকাশে গনগনে সূর্য। পায়ের নিচে বালি তেতে আছে। ঘাসের তৈরি ভারী স্যান্ডেল ভেদ করে উত্তাপ পায়ে লাগছে। তাঁবুর ভেতর থেকে বের হওয়ার জন্য সময়টা ভালো না। আউজ তাঁবু থেকে বের হয়েছে। তাকে অস্থির লাগছে। তার ডান হাতে চারটা খেজুর। সে খেজুর হাত বদল করছে। কখনো ডান হাতে কখনও বাম হাতে।
আউজ মনের অস্থিরতা কমানোর জন্যে দেবতা হাবলকে স্মরণ করল। হাবল কা’বা শরিফে রাখা এক দেবতা যার চেহারা মানুষের মতো। একটা হাত ভেঙ্গে গিয়েছিল বলে কা’বা ঘরের রক্ষক কোরেশরা সেই হাত সোনা দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে। দেবতা হাবলের কথা মনে হলেই সোনার তৈরি হাত চোখে চকচক করে।
দেবতা হাবলকে স্মরণ করায় তার লাভ হলো। মনের অস্থিরতা কিছুটা কমল। সে ডাকল, শামা শামা। তাঁবুর ভেতর থেকে শামা বের হয়ে এল। শামা আউজের একমাত্র কন্যা। বয়স ছয়। তার মুখ গোলাকার। চুল তামাটে। মেয়েটি তার বাবাকে অসম্ভব পছন্দ করে। বাবা একবার তার নাম ধরে ডাকলেই সে ঝাঁপ দিয়ে এসে তার বাবার গায়ে পড়বে।
শামার মা অনেক বকাঝকা করেও মেয়ের এ অভ্যাস দূর করতে পারেন নি। আজও নিয়মের ব্যতিক্রম হলো না। শামা এসে ঝাঁপ দিয়ে বাবার গায়ে পড়ল। সে হাঁটতে পারছে না। তার বাঁ পায়ে খেজুরের কাঁটা ফুটেছে। পা ফুলে আছে। রাতে সামান্য জ্বরও এসেছে।
শামা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাবার কাছে আসতেই তার বাবা এক হাত বাড়িয়ে তাকে ধরল। এক হাতে বিচিত্র ভঙ্গিতে শূন্যে ঝুলিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। শামা খিলখিল করে হাসছে। তার বাবা যেভাবে তাকে কোলে তোলেন অন্য কোনো বাবা তা পারে না।
আউজ বলল, মা খেজুর খাও।
শামা একটা খেজুর মুখে নিল। সাধারণ খেজুর এটা না। যেমন মিষ্টি স্বাদ তেমনই গন্ধ। এই খেজুরের নাম মরিয়ম।
আউজ মেয়েকে ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। রওনা হয়েছে উত্তর দিকে। শামার খুব মজা লাগছে। কাজকর্ম না থাকলে বাবা তাকে ঘাড়ে নিয়ে বেড়াতে বের হন। তবে এমন কড়া রোদে বেড়াতে কখনও না। আউজ বলল, রোদে কষ্ট হচ্ছেরে মা?
শামা বলল, না।
তার কষ্ট হচ্ছিল। সে না বলল শুধু বাবাকে খুশি করার জন্যে।
বাবা!
হুঁ।
আমরা কোথায় যাচ্ছি?
তোমাকে অদ্ভূত একটা জিনিস দেখাব।
সেটা কী?
আগে বললে তো মজা থাকবে না।
তাও ঠিক। বাবা, অদ্ভূত জিনিসটা শুধু আমি একা দেখব? আমার মা দেখবে না?
বড়রা এই জিনিস দেখে মজা পায় না।
আউজ ঘাড় থেকে নামাল। সে সামান্য ক্লান্ত। তার কাছে আজ শামাকে অন্যদিনের চেয়েও ভারী লাগছে। পিতা এবং কন্যা একটা গর্তের পাশে এসে দাঁড়াল। কূয়ার মতো গর্ত, তবে তত গভীর না।
আউজ বলল, অদ্ভূত জিনিসটা এই গর্তের ভেতর আছে। দেখো ভালো করে। শামা আগ্রহ এবং উত্তেজিত হয়ে দেখছে। আউজ মেয়ের পিঠে হাত রাখল।
তার ইচ্ছা করছে না মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলতে। কিন্তু তাকে ফেলতে হবে। তাদের গোত্র বনি হাকসা আরবের অতি উচ্চ গোত্রের একটি। এই গোত্র মেয়ে শিশু রাখে না। তাদের গোত্রের মেয়েদের অন্য গোত্রের পুরুষ বিবাহ করবে? এত অসম্মান?
ছোট্ট শামা বলল, বাবা, কিছুতো দেখি না।
আউজ চোখ বন্ধ করে দেবতা হাবলের কাছে মানসিক শক্তির প্রার্থনা করে শামার পিঠে ধাক্কা দিল।
মেয়েটি ‘বাবা’ ‘বাবা’ করে চিৎকার করছে। তার চিৎকারের শব্দ মাথার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। আউজকে দ্রুত কাজ সারতে হবে। গর্তে বালি ফেলতে হবে। দেরি করা যাবে না। এক মুহূর্ত দেরি করা যাবে না। শামা ছোট্ট হাত বাড়িয়ে ভীত গলায় বলছে, বাবা, ভয় পাচ্ছি। আমি ভয় পাচ্ছি।
আউজ পা দিয়ে বালির একটা স্তুপ ফেলল। শামা আতঙ্কিত গলায় ডাকল, মা! মাগো!
তখন আউজ মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, উঠে এসো।
আউজ মাথা নিচু করে তাঁবুর দিকে ফিরে চলেছে। তার মাথায় পা ঝুলিয়ে আতঙ্কিত মুখ করে ছোট্ট শামা বসে আছে। আউজ জানে সে মস্ত বড় ভুল করেছে। গোত্রের নিয়ম ভঙ্গ করেছে। তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। তাকে অবশ্যই গোত্র থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। এই অকরুণ মরুভূমিতে সে শুধুমাত্র তার স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে বাঁচতে পারবে না। জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে হলে তাকে গোত্রের সাহায্য নিতেই হবে। গোত্র টিকে থাকলে সে টিকবে।
বেঁচে থাকার সংগ্রামের জন্যে গোত্রকে সাহায্য করতেই হবে। গোত্র বড় করতে হবে। পুরুষশিশুরা গোত্রকে বড় করবে। একসময় যুদ্ধ করবে। মেয়েশিশুরা কিছুই করবে না। গোত্রের জন্যে অসম্মান নিয়ে আসবে। তাদের নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে যাওয়াও কষ্টকর। আউজ আবার গর্তের দিকে ফিরে যাচ্ছে। ছোট্ট শামা ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। মরুভূমিতে দিকচিহ্ন বলে কিছু নেই। সবই এক। আজ থেকে সতেরো শ’ বছর আগে।

সূত্রঃ https://goo.gl/4y4YvT

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৩৬

আবু তালেব শেখ বলেছেন: ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ করুন।
ভালো লেগেছে

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:৪৯

যাযাবর চিল বলেছেন: এখানেই শেষ।

২| ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১৩

নিভৃতচারীর ডায়েরী বলেছেন: ভালো লেগেছে ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.