নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আঁচলের ঘ্রাণে বিমোহিত হতে মনে প্রেম থাকা লাগে। চুলের গন্ধ নিতে দুহাত বাড়িয়ে দেয়া লাগে। হাহাকার থাকা লাগে। দুনিয়া ছারখার হওয়া লাগে। সবাই আত্মা স্পর্শ করতে পারে না।আমার সমস্ত হাহাকার ছারখারে তুমি মিশে আছো।

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার

এক জন নিভৃতচারী

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার › বিস্তারিত পোস্টঃ

মার্চে মন্টু খানের ‘হায়েনার খাঁচায় অদম্য জীবন’ থেকে নির্যাতনের বিচিত্র কৌশল

০৫ ই মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৭


পূর্বের জায়গায় আবার পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় বসলাম। এক ফাঁকে সাথী বন্দীদের একজনকে দিয়ে প্যান্টের বোতামগুলো লাগিয়ে নিলাম। পরে জেনেছিলাম যে জায়গাটা সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় (কলেজ অব মিউজিক), সেগুন বাগিচা। এবং যে ঘরে আমরা ছিলাম, সেটা ছিল প্রিন্সিপালের ঘর। এই কলেজকে, একটা এম.পি ক্যাম্প হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। এখানে শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক ধরে এনে কয়েকদিন আটকে রেখে, জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে, শেষে অন্য কোথায় জানি পাঠিয়ে দিতো। লোক ধরে এনে প্রথমে দোতলার একটা ঘরে দরজা বন্ধ করে আটকে রাখা হতো। তারপর একজন একজন করে ভেতরের দিকে অন্য আর একটা ঘরে নিয়ে যেয়ে তাদের ওপর চালানো হতো শারীরিক নির্যাতন। এবং সে নির্যাতন হচ্ছে বেপরোয়া মারপিট এবং যত উপায়ে একজন মানুষকে কষ্ট দেয়া সম্ভব, মনে হয় তার সবই প্রয়োগ করা হতো।
সে সময়ে শরীরের কোনো অংশে কোনো কাপড় থাকতো না। সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে পেটানো হতো। আমরা, অন্যেরা এই পামের ঘর থেকে শুনতাম করুণ আর্তনাদ। আর বয়ে ভয়ে সময় গুণতাম, এরপর আসে কার পালা। সেই অত্যাচারের বর্ণনা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অনুভব করতে পারি মাত্র। মারের চোটে সমস্ত শরীরর কালো হয়ে যেত। শরীরে বিভিন্ন অংশ কেটে গিয়ে ঝরতো রক্ত। এরপরে একে একে কোথায় পাঠিয়ে দিত কে জানে। আবার এসে ভর্তি হতো নতুন লোক। একমাত্র পানি আর পিটুনি ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না এখানে। একদিন আমাদের খেতে দিল আগের দিনের কিছু বাসি রুটি, বোধ হয় ওদের উচ্ছিষ্ট। একটা সেপাই গোটা চারেক রুটি এনে ছিঁড়ে ছিঁড়ে সেগুলো আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিল। তখন আমরা ওখানে প্রায় কুড়ি-পঁচিশজন মানুষ বন্দী ছিলাম। আমাদের মধ্যে রুটির টুকরোগুলো এমনভাবে ছুঁড়ে দিল, যেমনভাবে সাধঅরণতঃ কুকুর-বিড়ালকে খাবার দেয়া হয়- ঠিক তেমনিভাবে। সবাই দু’এক টুকরো রুটি কুড়িয়ে নিয়ে খায়। কিন্তু আমি তো জানালার সাথে বাঁধা। নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। আমি ফ্যালফ্যাল করে সে দিকে চেয়ে রইলাম। সাথী বন্ধী একজন দয়া পরবশ হয়ে একটা টুকরো তুলে নিয়ে আমার মুখে পুরে দিল। দুই দিনের মধ্যে এই প্রথম খাবার জুটলো কপালে।
পরদিন ভাগ্য বোধ হয় কিছুটা প্রসন্ন ছিল। সেদিন পেলাম পুরো অর্ধেকটা রুটি। দুই হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে কোনো রকমে সেটা খেয়ে পরম তৃপ্তির সাথে এক গ্লাস পানি খেলাম। দিনটা ছিল আমার কাছে বেশ শুভ। কারণ সকালবেলায় এক বুড়ো ঝাড়ুদার এলো ঘরটা পরিস্কার করতে। সে আমার দিকে বারবার তাকিয়ে দেখছে। দেখে আমি তাকে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম সে আমাকে চেনে কি না। জবাবে লোকটা বললো, চেনে এবং আমার বাসাটাও চেনে। তাকে বলে দিলাম বাসায় একটু খবর দিতে যে, আমি এখানে আছি। অন্য কিছু বলা আর সম্ভব হলো না। তখন মনে হয়েছিল ওটুকু খবরই যথেষ্ট সে সময়। কারণ বেঁচে আছি এখনও বাসায় এটুকু অন্তত জানবে।
পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় আছি। সহ বন্দীদের দেখি কোনো কথা বলতে পারি না। মুখে আসে না, পেছন ফিরে বাইরের দিকে ভালোভাবে তাকিয়েও কিছু দেখতে পারি না। প্রতিদিন সন্ধ্যায় একবার করে মাত্র প্রস্রাবের জন্য নিচে নিয়ে যায়। সেই সময় একটু চেষ্টা করি বাইরের পৃথিবীটাকে দেখতে। এইভাবে একই নিয়মে দিন কাটে। তবে মাঝে মাঝে আসে মিলিটারি সেপাইদের এক একটা দল। আসে আর তারা আমার শরীরের ওপর যা ইচ্ছা তাই করে যায়। যেন আমি তাদের ‘পিটুনি ট্রেনিংয়ের ডামি।’ এভাবে কাটলো পাঁচটি দিন। একদিন ভোরে সম্ভবত কিছুটা দয়া পরবশ হয়েই ওদের একজন নিয়ে এলো একটা গামলায় করে কিছু পান্তা ভাত। সেই সাথে একটা থালা দিয়ে আমাকেও কিছু ভাত দিতে বললো। বন্দীদের একজন এসে আমাকে ভাত তুলে তুলে খাইয়ে দিল। পান্তাভাত, তাও লবণ ছাড়া এবং পরিমাণে খুবই কম। কিন্তু তবুও মনে হরো যেন অমৃত। তারপরে খেলাম এক গ্লাস পানি।
এখানে যাদের দেখা পেয়েছিলাম তাদের সবার পরিচয় জানতে পারিনি। যে ক’জনের সাথে আলাপ হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল- জায়েদুল ইসলাম নামে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের একটি ছাত্র। তার পিতা মরহুম অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। তিনি ছিলেন বরিশাল জেলার বামপন্থী আন্দোলনের একজন প্রথম সারির নেতা। আরও ছিলেন কালাচাঁদ নামের এক রিকশাওয়ালা, ঢাকার টি এন্ড টি কলেজের কয়েকজন অধ্যাপক, নবাবপুর হাইস্কুলের এক শিক্ষক, নারায়ণগঞ্জের এক পাগল, কমলাপুর স্টেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের একজন সুপারভাইজার, ১২/১৪ বছরের একটি ছেলে (যে কোনো এক দপ্তরীখানায় কাজ করতো), দু’জন পুলিশের সেপাই প্রভৃতি। এদের অনেকের সাথেই পরে আবার জয়দেবপুর সেনানিবাসে দেখা হয়েছিল। সেদিন সকালে পান্তা ভাত খাওয়ার পরে পেছনে দু’হাত বাঁধা থাকা সত্ত্বেও বেশ একটু তৃপ্তি অনুভব করে ভবিষ্যৎ চিন্তা করছিলাম। এর মধ্যে এলো সেই এম.পি. হাবিলদার মার দেওয়ার ব্যাপার যার ‘মাস্টার ডিগ্রি’ আছে বরে মনে করতাম। যার চেহারা দেখলেই বুকের মধ্যে টিপটিপানি শুরু হয়ে যেত। তার সঙ্গে এলো আরও কয়েক ব্যক্তি। আমাকে চিনিয়ে দিল সে তাদেরকে। দেখে মনে হলো এবার আমার পালা। আর আমার বেলায় একটু নতুন ব্যবস্থা হবে, তাই বোধ হয় নতুন লোক এসেছে।
মনে মনে আল্লার নাম স্মরণ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছু আগে আমাদের ওপর ব্যবহারের জন্য কিছু চেয়ার-বেঞ্চের ভাড়া পায়া যোগাড় করে আনা হয়েছিল। মনে হলো ওগুলোর প্রথম পর্বটা আমার ওপর দিয়েই হয়তো শুরু হবে। কিন্তু না। আমাকে নিয়ে ওরা নিচে নেমে এলো। উঠালো একটা গাড়িতে। অবশ্য এর মধ্যে স্থানীয় সেপাইরা অল্প-বিস্তর কিছু শেষ বিদায়ের দাওয়াই আমাকে দিয়ে নিয়েছে। শুধুমাত্র শালা চল এটুকু ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কথা কেউ বললো না। গাড়িতে বসা ছিল একজন অফিসার। কোথায় যাচ্ছি চিন্তাও করতে পারলাম না। অনর্থক সে চেষ্টাও আর করলাম না। জীবনটার যেন আর কোনো অর্থ নেই। বর্তমান টুকুই হয়ে দাঁড়িয়েছে সবটা। গাড়ি বিমানবন্দর পার হয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে চললো। কিছুটা যেয়ে একটা কোয়ার্টারের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। অফিসারটি গাড়ি থেকে নেমে গেটের সেপাইকে কিছু জিজ্ঞেস করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে ঢোকানো হলো একটা গ্যারেজের মধ্যে। আরও চার-পাঁচজন লোক জড়ো হলো সেখানটায়। ওদের কথাবার্তায় বোঝা গেল সাহেব বাসায় নেই, অন্য কোথাও গেছেন এবং আমার সাথের অফিসারটি ফোন করছেন। অনুমান করলাম কোয়ার্টারটা সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কোনো অফিসারের হবে।
জড়ো হওয়া লোকগুলো আমাকে কিছু প্রশ্ন করলো, সেই একই ধরনের। ওরা নিচের শ্রেণীর সেপাই বা চাকর-বাকর জাতীয় হবে। কিন্তু তাতে কি আসে যায়। এখন ওরা সবাই এক একজন সম্রাট। প্রশ্নের সাথে সাথে দু’চারটে চড়-চাপড়-কিল-ঘুসি তো আছেই। অবশ্য সে সময় আমার কাছে ওগুলো খুবই মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন জিজ্ঞেস করলো, আবে শালে তু মুসলমান হো?
বললাম, হ্যাঁ মুসলমান।
বললো, ঝুট। পাতলুন উতারো।
খুললাম পাতলুন। একেবারে উলঙ্গ করে ভালো করে পরীক্ষা করতে শুরু করলো সকলে মিলে, সত্যিই আমি মুসলমান কি না। পুরুষাঙ্গ ধরে টানাটানি করলো কিছুক্ষণ। এর মধ্যে একজন এসে হঠাৎ দেশলাইয়ের একটা কাঠি জ্বালিয়ে যৌন কেশগুলোতে দিল আগুন লাগিয়ে। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে লাগলাম। আমি যন্ত্রণায় যতই লাফাই, ওরা ততই উল্লাসে ফেটে পড়ে। বলা বাহুল্য যে এ সময়ে আমার দুই হাতে হাতকড়া লাগানো ছিল না। শুধুমাত্র ডান হাতেই হাতকড়া ছিল। আর আমার ভাগ্যও ভালো বলতে হবে, কারণ ঠিক সেই সময়ে ফোন করা শেষ করে অফিসারটি আমার খোঁজ করছিল। নইলে হয়তো আমার কপালে সেদিন আরো দুঃখ ছিল।
অফিসারের হাঁক শুনেই ওরা আমাকে নির্দেশ দিল তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নিতে। আর শাসালো যে, এখানকার এসব কথা যদি কাউকে বরি তাহলে ভীষণ বিপদ হবে আমার, না বললে ওরা আমার তাড়াতাড়ি ছাড়ার ব্যবস্থা করবে ইত্যাদি।
আবার এসে উঠলাম গাড়িতে। এবার এলাম সেই পুরনো জায়গা- এফ.আই.ইউ. অফিসে। আমাকে জিপের মধ্যে রেখেই অফিসারটি নেমে গেল ভেতরে। হাতে ছিল একটা ফাইল, কি মনে করে সেটা তার সিটের ওপরই রেখে গেল। কৌতুহল হলো খুব। কিসের ফাইল এটা? একটু ঘাড় কাত করতেই উপরের নামটা পড়া গেল। নামটা দেখেই আমার চক্ষু স্থির। রীতিমতো ভয়ই পেয়ে গেলাম আবার। বুঝলাম এবার আর আমার নিস্তার নেই। এতদিন তবুও মনে মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল- হয়তো ছাড়া পেলেও যেতে পারি। কিন্তু ফাইলের নামটা দেখেই আমার সে ক্ষীণ আশাটুকুও কর্পূরের মতো উবে গেল। এই ফাইল যখন এদের হাতে পড়েছে, তখন আর বাঁচার আশা করা বৃথা। ফাইলটা হচ্ছে সদাশয় আই.বি বিভাগের। উপরে যে নামটি লেখা, একমাত্র সেই বিভাগ ছাড়া অন্য কোথাও তার কোনো অস্তিত্ব নেই। সেই ফাইলের নামটি হলোÑ ‘নুরুদ্দীন আহমদ।’
এ নামের ছোট্ট একটা ইতিহাস আছে। সেটা বোধয় ১৯৫৪/৫৫ সাল হবে, আমি যখন গ্রেফতার হই। তখন জেরার সময় আমার নাম জিজ্ঞেস করা হলো, নাম বললাম। কিন্তু অন্য কোনো ভালো নাম জানতে চায় আই.বি বিভাগ। জানতে চায় আমার অন্য আর কি কি নাম আছে। বলি আমার আর অন্য কোনো নাম তো আমার জানা নেই। কিন্তু বামপন্থী রাজনীতি করি, সুতরাং অন্য আরও নামতো আমার থাকতেই হবে। আর কোনো নাম নেই? অবিশ্বাস্য। আমার আরো অনেক কথার মতো একথাটাও তারা বিশ্বাস করতে রাজি নয়, যাহোক বহু চেষ্টা করেও যখন আমার দ্বিতীয় কোনো নাম তারা আমার কাছ থেকে আদায় করতে পারলো না, তখন নিজেরাই একটা নাম ঠিক করে আমার ওপর চাপিয়ে দিল। সুতরাং আই.বি বিভাগের খাতায় আমার নাম হলো ‘নুরুদ্দী আহমদ ওরফে মন্টু খান’।. আমি বারবার এর প্রতিবাদ করলেও তা ধোপে টেকেনি। তাই সেই আই.বি বিভাগের দেয়া নামসহ ফাইলটা আর্মি অফিসারের কাছে দেখে আমি চমকে উঠলাম। তাহলে আমার রাজনৈতিক জীবনের পুরনো সব ইতিহসাই আর্মি পেয়ে গেছে। মনে পড়লো ধরা পড়ার কয়েকদিন আগে পথে দেখা হওয়া এক পরিচিত আই.বি অফিসারের। সাবধান বাণীÑ মন্টু ভাই, অনেকেরই ফাইল আমরা নষ্ট করে ফেলেছি কিন্তু এক শালা মাউড়ার জন্য আপনার ফাইলটার কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি। আপনি একটু সাবধানে থাকবেন।
কিন্তু তখন তার কথা গ্রাহ্য করিনি, একটু হেসেছিলাম মাত্র। অবশ্য গ্রাহ্য করলেই বা কতটুকু লাভ হতো বলতে পারি না।
যা হোক, একটু পরেই অফিসারটি ফিরে এসে ফাইলটা নিয়ে গেল, আর সেই সাথে আমাকেও যেন কোথায় নিয়ে যাবার নির্দেশ দিল। গাড়ি থেকে আমাকে নামিয়ে ওরা নিয়ে গেল আর্টিলারি ইউনিটে। অবশ্য নামটা পরে জেনেছিলাম। সেই ব্যবস্থা আগর মতোই। সেন্ট্রি ঘর। সামনে দুটো বড় বড় তাঁবু। সেখানে থাকে নায়েক ও ল্যান্স নায়েকরা। দু’পাশে অস্ত্র শাস্ত্রের দু’টা গুদাম।
এবার যেন ব্যবহারে একটু পরিবর্তন বোধ হলো।
কেউ বিশেষ কিছু বলে না। এক হাতে হাতকড়া। অন্য হাতটা খোলা শিখলটাও লশ্বা। একটু নড়াচড়া করা যায়। কিন্তু তা হলে কি হবে, আমার মনে একই চিন্তা এখন? কি ধরনের প্রশ্ন আসবে এবার? আমার পুরনো রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে যখন জেনেছে, তখন রেহাই যে পাবো, সে আশা করা যায় না। মনে হলো রাজনৈতিক কর্মী কাউকেই এরা বিশ্বাস করে না- তা সে যে দলেরই হোক না কেন, বাঙালি হলেই সে গার্দার। এক একবার মনে হয় চিন্তা করে আর কি হবে! যা হবার তাতো হবেই, আমি যতই চিন্তা করি না কেন! এই বলে যতই ডেল কার্নেগীর বিশ্বনন্দিত দুশ্চিন্তামুকত হবার পথ অনুসরণ করি, মনটাকে শক্ত করার চেষ্টা করি, ততই ভুলে যাই।
এইভাবে বসে বসে নানান রকম চিন্তা ও দুশ্চিন্তা করছি মন মরা হয়ে। এমন সময় গার্ড কমান্ডার এসে বললো ‘এই মন্টু, তু গোসল কারেগা’? বুঝতে পারছিলাম না সত্যি বলছে, না ঠাট্টা করছে। ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘নেহি, ঠিক হায়।’ জবাবে লোকটা বলরো, ‘কেয়া, এতনা গরমিমে গোসল নেহি করেগা? ফের টাট্টি ভিতো যানা হ্যা! ঠিক হ্যায়। ম্যায় আভি আ রাহা, গোসল কারায়েগা। ডরো মৎ। কুচ নেহি হোগা। এতে দিনের মধ্যে এই প্রথম একটু আশ্বাস বাণী পেলাম। মিথ্য হলেও তা তখন আমার কাছে ভারি ভালো লাগলো। মনেও যেন জোর পেলাম অনেকটা। চিন্তাভাবনায় যখন কোনো লাভ নেই, দেখি যা হয় হবে, গোসল করলে তো একটু তাজা হতে পারবো। তাছাড়া প্রকৃতির ডাকেও তো সাড়া দেয়া প্রয়োজন। এ কাজটা আবার যখন তখন করা যাবে না। মিলিটারি ব্যাপার। সবকিছুই নিয়মমাফিক করতে হবে। প্র্রস্রাব করতাম দুই অস্ত্র গুদামের পাশে একটু আড়াল জায়গায়। তাও দিনে রাতে দুই বার। আর দুপুরের পরে গোসলের সময় পায়খানা-প্রস্রাব।
কিছু সময় বাদে গার্ড-কমান্ডার এসে গোসলের তাগিদ দিল। উঠে দাঁড়ালাম। ও এসে তালা খুলে শিকলটা হাতে নিল। চললাম গোসল করতে। গার্ড-কমান্ডার সামনে, আর পেছনে আরও দু’জন রাইফেলধারী। তখন বুঝতেও পারিনি এত পাহারার কি প্রয়োজন। কিছুদূরে একই সাথে গোসলখানা ও পায়খানা। কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ প্রথমবারের কথা মনে হলো। গার্ড-কমান্ডারকে বললাম, গোসল যে করবো, আমার কাছে তো অতিরিক্ত কোনো কাপড় নেই!
কথাটা শুনে ওরা তিনজনই বেশ খানিকটা হাসলো। তারপর গার্ড-কমান্ডার জবাব দিল- বায়েনচোৎ! এটাও জানিস না! গোসলখানায় ঢুকে কাপড় খুলে ফেলে গোসল করবি। পরে আবার কাপড় পরে নিবি। আর দেখ, তুই যা বেকুব। গোসলখানার ভেতরেই যেন পায়খানা করবি না- তার জায়গা আলাদা আছে, আগে পায়খানা করে পরে গোসল করবি।
ঢুকলাম গোসলখানার ভেতর। দু’দিকের দুই গেটে দাঁড়ালো সশস্ত্র প্রহরী। গোসল করে বেশ তরতাজা হয়ে বের হলাম। অনেকদিন পর যেন একটু আরাম উপভোগ করলাম। গোসলখানায় ঢোকার সময় পুরোপুরি খুলেই দিয়েছিল হাতকড়া। বের হতেই আবার তা হাতে উঠলো। পাহারাদারদের সাথে নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। আবার শিকল বাঁধা হয়ে বসেও, বেশ আরাম অনুভব করছিলাম। মনে পড়লো গোপাল ভাঁরের গল্প- একদিন রাজসভায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোপাল ভাঁড়কে বললেন, গোপাল আর একটা ছেলে হয়েছে এ সংবাদ শুনে তোমার কেমন আনন্দ হচ্ছে?
আভূমি নত হয়ে রসিক রাজ গোপাল ভাঁড় যে জবাব দিয়েছিল, তাতে মহারাজা রুষ্ট হলেও পরে পরিস্থিতির বিপাকে তাঁকে গোপালের সাথে একমত হতেই হয়েছিল। আর, আমি সেদিন মনে-প্রাণে কথাটার তাৎপর্য উপলব্ধি করেছিলাম। এরপর থেকে প্রতিদিন বিকেলে গোসল করাতে শুরু করলো নিয়মিত, কোনো কোনেদিন আবার হাতকড়া খুলে এমনিই নিয়ে যায়। দুই, একজন মন্তব্য করে বন্দীকে সম্পূর্ণ মুক্ত অবস্থায় এমনভাবে নিয়ে যাওয়া কি ঠিক? জবাবে গার্ড কমান্ডার বলেছে, মন্টু আমাদের আপনা আদমি হয়ে গেছে, কোনো ভয় নেই! ও ভাগবে না।
গার্ড-কমান্ডার ডিউটি বদলি হলে, নতুন যে এসেছে তাকে আমার কথা সব ভালো করে বলে গিয়েছে। তাছাড়া ওখানকার কমান্ডিং অফিসার সেই আগের ভদ্রলোকটিই অভ্যস্ত হয়েই গিয়েছিলাম। এই সময়টুকু ছিল জল্লাদের কারাগারের বন্দী জীবনে আমার কিচু শান্তির দিন।
একদিন বিকেলে গোসল করতে গেছি যথারীতি। সাথে আছে গার্ড-কমান্ডার ও আর একটা সেপাই। প্রথম গেটে গার্ড-কমান্ডার, অন্যদিকে সেপাইটা। সাধারণতঃ গোসল সেরে আমি নিজেই হেঁটে চলে আসি, গার্ড-কমান্ডার আর প্রহরীরা পেছন পেছন আসে। সেদিন আমার মতো আমি গোসল করে বের হয়ে এসেছি ঠিকমতো। কিন্তু অন্যদিকে যে সেপাইটা পাহারায় ছিল, সে ছিল অন্যমনস্ক। আমি কখন বের হয়েছি তা খেয়াল করেনি। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে একটু মজা করার জন্যই হোক, বা অন্য কোনো কারণেই হোক গার্ড-কমান্ডার আমাকে লুকিয়ে ফেললো। তারপর সেপাইটাকে ডেকে বললো, গোসলখানায় আমি কেন এত দেরি করছি তার খোঁজ নিতে। সেপাই বাবাজীর তো আমাকে গোসলখানায় না পেয়ে আক্কেলগুড়ুম। বের হয়ে এসে বললো, ‘ওস্তাদ, উতো আন্দরমে নেহি হ্যায়!’ ওস্তাদ, অর্থাৎ গার্ড-কমান্ডার (অফিসার নয় কিন্তু সমকক্ষ বা উপরস্থ কোনো ব্যক্তিকে সম্মান দেখাবার জন্য পাকবাহিনীতে ওস্তাদ বলে সম্বোধন করার রেওয়াজ দেখেছি) এক ধমক দিয়ে বললো, ‘ নেহি হ্যা তো গ্যায়া কি ধার? দেখ ঠিকসে! ভাগ তো গায়া নেহি তোমহারা তরফসে? আগার না মিলেতো তোমহারা কোর্ট-মার্শাল হোগা, ইয়াদ রাকক্ষো।’
বেচারার তো অবস্থা কাহিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে শেষ পর্যন্ত কাঁদো-কাঁদো হয়ে পড়লো। আমি একটু দূরে থেকে সবাই দেখেছিলাম। আড়ালে ছিলাম ঠিকই, তবে সেটা তেমন কোনো আড়াল নয়, ঘটনাস্থলের পাশেই জনা দশ-বারো লোক মিলে কিছু কাজ করছিল গার্ড-কমান্ডার আমাকে তাদের সাথেই মিশিয়ে দিয়েছিল। একটু ভালো করে চারদিকে দেখলে সেপাইটাও আমাকে দেখতে পেতো। কিন্তু তার কল্পনায় তখন আমি পালিয়েছি। সুতরাং কাছাকাছি একেবারে সামনে আমাকে পাবে তা সে আশাও করেনি, দেখতেও পায়নি। খুব হয়রান হয়ে আমাকে না পেয়ে সে গার্ড-কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করলো, এখন উপায়? ওস্তাদ তখন আমাকে ডেকে বললো চলে আসতে। এতক্ষণ সবাই মিলে মজা উপভোগ করছিল। এবার তারা সকলে একসাথে লোকটাকে নিয়ে হাসি-তামাশা শুরু করে দিল। সেপাইটার করুণ অবস্থা দেখে তখন আমারইও মায়া হচ্ছিল খুব। মনে হচ্ছিল আ-হা বেচারা! আমার জন্যেই আজ তার এই দুর্দশা! কিন্তু ঘটনার নায়ক আমি হলেও, আমার কোনো বক্তব্য নেই।
ফিরে এলাম স্বস্থানে। এখানেও বেচারাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা। বেচারা নিজেকে খুব একটা অপরাধী এবং অপমানিত বোধ করে চলে গেল। যাবার সময় আমার দিকে ভালো করে একবার চেয়ে দেখলো। তখন আমি তার এই দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারিনি। রাতে আবার সেপাইটা এলো আমার কাছে। জিজ্ঞেস করলো, কেন আমি তখন তাকে এইভাবে হয়রানি করলাম? তার সে সময়ের চোখ মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, যেন তক্ষুণি সে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, আমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো। ঠিক সে সময়েই এসে হাজির হলো সেই লোকটি, যে ছিল আমার সত্যিকার সৃহৃদ এবং যে আমাকে তিনবেলা খাবার এনে দিতো। একদিন সকালে ও ছিল না। একটু দেরি করেই এসেছিল ইউনিটে। এসেই খোঁজ করলো, আমার চা খাওয়া হয়েছে কি না। চা দেয়া হয়নি শুনে অন্যদেরকে বকাবকি করলো খুব। বললো, লজ্জা করে না। একজনকে রেখে সবাই তোমরা খেয়ে নিলে! আরও অনেক সব পাঞ্জাবি ভাষায় কিছুক্ষণ বকার পর মগ নিয়ে চললো চা আনতে। এই লোকটা আমার ব্যবহারের জন্য তার নিজের প্লেট আর মগ দিয়েছিল। সিগারেটও খাওয়াতো। কখনও দুইটা এক সাথে জ্বালিয়ে একটা নিজে খেতো আর একটা দিতো আমাকে। কখনও বা একটা জ্বালাতো, অর্ধেকটা খেয়ে বাকিটা আমাকে দিতো। এ লোকটিও ছিল একজন ল্যান্স নায়ক।
সেই মুহুর্তে সেই লোকটি সিগারেট জ্বালিয়ে একটা আমাকে দেয়ার জন্য হাজির হলো, সেপাইটাকে আমার সামনে এই অবস্থায় দেখে যেন ক্ষেপে গেল সে। জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে। সেপাইটা জবাবে যা বললো বোঝা গেল না। দু’জন পাঞ্জাবি ভাষায় তুমুল বাকযুদ্ধে লিপ্ত হলো। গরম-গরম কথা বিনিময় হতে হতে শেষ পর্যন্ত সেটা প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে উপনীত হলো। আর এদিকে আমি মনে মনে আল্লাহর নাম জপ করতে শুরু করেছি। কি জানি ব্যাপারটা আবার কি রূপ নিয়ে আমার ঘাড়ে চেপে বসে! অবশ্য আমার বিপদ কেটে গেল গার্ড-কমান্ডারের হস্তক্ষেপে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.