নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আঁচলের ঘ্রাণে বিমোহিত হতে মনে প্রেম থাকা লাগে। চুলের গন্ধ নিতে দুহাত বাড়িয়ে দেয়া লাগে। হাহাকার থাকা লাগে। দুনিয়া ছারখার হওয়া লাগে। সবাই আত্মা স্পর্শ করতে পারে না।আমার সমস্ত হাহাকার ছারখারে তুমি মিশে আছো।

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার

এক জন নিভৃতচারী

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার › বিস্তারিত পোস্টঃ

গনহত্যা-১৯৭১

০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১০:২৮

পচিশে মার্চ, ১৯৭১। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কালো রাতের একটি। এই রাতেই পাকিস্থানী জেনারেলরা তাদের নিজ দেশ বলে দাবীদার তত্কালীন পূর্ব পাকিস্থানের জনগনের উপর বর্বরতম গনহত্যা চালিয়েছিল। শুরু করেছিল বিশ শতকের ইতিহাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম এথনিক ক্লিনজিং( জাতিসত্বা র্নিমূল অভিযান)।দীর্ঘ নমাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের পর লাল সবুজের পতাকায় সদর্পে আত্মপরিচয় ঘোষনাদানকারী এই দেশটি হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে তিরিশ লক্ষ মানুষের আত্মদান আর চারলক্ষ নারীর সম্ভমের বিনিময়ে জন্ম লাভ করে পৃথিবীর একমাত্র ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ নামে।


প্রারম্ভিকতাঃ
১৯৭১ সালের মার্চ মাস। বাঙ্গালী জাতি তার দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অতীত মুছে ফেলে আত্মপরিচয়ের উত্সমুখের সন্ধানে তখন ব্যাকুল। ঐক্যবদ্ধ। একটু অতীত যাই। আইয়ুব শাহীর পতনের পর জনতার দাবীর মুখে ১৯৭০ সালের যে নির্বাচনটা হয় জান্তা সরকারের সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে ফেরার প্রতিশ্রুতি থেকে সেখানে পাকিস্থানী প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর ব্যাপক তত্পরতা সত্বেও অভূতপূর্ব নির্বাচনী ফলাফল চলে আসে। আইএসআই চাইছিল পূর্ব পশ্চিম মিলিয়ে একটি ঝুলন্ত সরকার। যাতে সেনাবাহিনী খুব দ্রুতই রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায়। স্বভাবতই তখন কদিন পর পলিটিশিয়ানদের পাছায় লাত্থি মেরে তাড়িয়ে দিয়ে আবার পছন্দসই জেনারেলদের নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসা যাবে। কিন্তু স্বাধিকারের প্রশ্নে ছয় দফার ভিত্তিতে জেগে উঠা পূর্ববাংলার মানুষ তাদের আত্মপরিচয়ের সন্ধানদানকারী প্রিয় নেতা মুজিবের নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামীলীগকে একক সংখ্যাগরিষ্টতার দাবীদার করে দেয়।
নির্বাচন শেষ হল। পাকিস্থানের এস্টাবলিশম্যান্টকে থমকে দেয়া আওয়ামীলীগের বিজয়কে সহজে মেনে নিতে পারলনা পাকিস্থানী সেনা, রাজনীতিক ও সুশীল এলিট গোষ্টি। জনতার রায়কে তারা সরাসরি অস্বীকার করতে না পারলেও শুরু হল ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে লুকোচুরি। পাকিস্থানি সেনাবাহিনী তাদের ভাষায় পুবের কূল জাত বংশহীন নেতা মুজিবের হাতে দেশের শাসনভার তুলে দেয়ার বিপক্ষে কঠিন অবস্থান নেয়। তারা সামনে নিয়ে আসে পাকিস্থান পিপলস পার্টির নেতা সামরিক দানব আইয়ুব খানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী অপেক্ষাকৃতভাবে তাদের অধিক ঘনিষ্ট পিপিপি’র জুলফিকার আলী ভূট্টোকে।

ষড়যন্ত্রের শুরুঃ
পূবে তখন আনন্দ আর উচ্ছাসের জয়ধ্বনি। স্বাধিকারের প্রশ্নে বাঙ্গালী জাতি ছয়দফার প্রতি নিরংকুশ সমর্থন দিয়েছে। কেন্দ্রের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক প্রধান পদে বাঙ্গালীর নেতা মুজিবের অধিষ্টান বঞ্চনার অতীত মুছে ফেলার আগামীর শুভ সুচনা মনে করছিল সবাই। মুজিব তখন পাকিস্থানের সংখ্যাগরিষ্ট রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে তার ইমেজকে সর্বপাকিস্থানের নেতা হিসাবে প্রতিষ্টার কৌশলী প্রয়াস পেলেন। স্পষ্টত তখনই দৃষ্টিগোচর হল শাসন ক্ষমতায় পশ্চিম পাকিস্তান বাঙ্গালীর নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তারা পূবের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্টতার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। শংকিত হয় আওয়ামীলীগ। ইয়াহিয়া খান ঘোষিত আইনগত কাঠামো আদেশে(লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক ওর্ডার) ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান প্রনয়নের সময়সীমা নির্ধারন করা ছিল। আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব এই সময়কে যথেষ্ট মনে করে দাবী জানায় অবিলম্বে নতুন সংবিধান নিয়ে আলোচনার, দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের।
এরই মধ্যে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন। সংবাদ মাধ্যমে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে পাকিস্থানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী, সংখ্যাগরিষ্টদলের নেতা ইত্যাদি বিশেষনে আখ্যায়িত করলে মুজিবের প্রতি নমনীয় হয়ে পড়ছেন ভেবে পাকিস্থানী আর্মির কোর গ্রুপ তাকে উচ্চেদের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন গুজব উঠে আর্মির সিওএস জেনারেল হামিদ সামরিক জান্তার নতুন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। এর প্রেক্ষিতে বিবিসির সাংবাদিক ইয়াহিয়াকে প্রশ্ন করলে তিনি তাকে বলেন- আমি এখনো ক্ষমতায় আছি।(হাউ পাকিস্থান গট ডিভাইড- মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী)
ঢাকা থেকে ফিরে ১৭ জানুয়ারি ইয়াহিয়া লারকানায় ভুট্টোর বাসভবনে যান। সাথে যান জেনারেল হামিদ আর ন্যাশনাল সিকিউরিটির প্রধান জেনারেল ওমর। সেদিনের সভার পরামর্শ অনুযায়ী ভুট্টো ২৭ শে জানুয়ারী ঢাকা সফরে আসেন ছয় দফার দাবী বাতিল করে পূর্ব পশ্চিমে একটি যৌথ সরকার গঠনের প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু মুজিব তাতে রাজি হননি। তিনি ষড়যন্ত্রে গন্ধ পেলেন। যে ছয়দফার জন্য বাংলার মানুষ তাকে নিরংকুশ রায় দিয়েছে তিনি এর বিরুদ্ধে গিয়ে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে ইতিহাসে নাম লেখাতে চাননি। অতএব ভুট্টো ফিরে যান করাচি।

সেনা অভিযানের পরিকল্পনা শুরুঃ
৬ ফেব্রুয়ারি সি এম এল এ এইচ কিউ এর বিগ্রেডিয়ার ইস্কান্দার-উল-করিম রাও ঢাকায় মেজর জেনারেল ফরমান আলীকে বার্তা পাঠান। যেখানে বলা হয় প্রেসিডেন্ট মুজিবকে ইসলামাবাদে যেতে বলেছেন। কিন্তু মুজিব জনতার চাপে পিন্ডি যেতে অনীহা প্রকাশ করলেন বরং পাল্টা দাবী জানালেন ১৪,১৫,১৬ ফেব্রুয়ারী আওয়ামীলীগের কার্যনির্বাহী কমিটি খসরা সংবিধান বিবেচনার জন্য সভা আয়োজন করেছে। প্রেসিডেন্টের উচিত ২১ শে ফ্রেবুয়ারির মধ্যে ঢাকা আসা, যাতে তিনি তাকে আলোচনার সারসংক্ষেপ জানাতে পারেন। যাই হোক মুজিবকে ইসলামাবাদে ডেকে পাঠানোর এ বার্তাটি আওয়ামীলীগের অভ্যন্তরে মারাত্বক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। নেতারা ধারনা করেন মুজিবকে ইসলামাবাদে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হবে যে ভাবে আইএসআই বৈরুতে সোহরাওয়ার্দীকে হত্যা করেছিল।তারা তাদের মুজিব ভাইকে শপথ গ্রহনের পূর্বে ইসলামাবাদে যেতে নিষেধ করেন। (হাউ পাকিস্থান গট ডিভাইড- মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী)

বঙ্গবন্ধুর প্রতিউত্তর জেনে জেনারেলরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। তারা অবাধ্য মুজিবকে উচিত শিক্ষা দেবার সুযোগ হাতছাড়া হওয়াটাকে মানতে পারলেন না। লারকানায় এরপর তাদের সফরের বন্যা বয়ে গেল। সাথে সাথে তারা মুজিবকে ইসলামাবাদে যাবার জন্য চাপ প্রয়োগও অব্যাহত রাখেন। কদিন পর মুজিব জানালেন তিনি ২০শে ফেব্রুয়ারি ইসলামাবাদ যাবেন। কিন্তু জেনারেলদের তোষামদে আপ্লুত ভুট্টো তার আগেই হুংকার দিলেন মুজিব হোস্টেজ হবার ভয়ে ইসলামাবাদ আসেন নি ঢাকায় গেলে তার এমএনএদের মুজিব ডাবল হোস্টেজ বানাবেন। অতএব তিনি ঢাকা অধিবেশনে যাবেন না। আর যারা ঢাকা যাবে তাদের পা কেটে ফেলা হবে। ঢাকা থেকে এর কড়া প্রতিবাদ হল। ব্যস জেনারেলরা তাদের তুরুপের তাস পেয়ে গেলেন।মুলত এরপরই শুরু হয় সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা। জন্ম নেয় অপারেশন সার্চলাইট নামে বিশ শতকের ইতিহাসে সবচেয়ে কলংকিত সামরিক অভিযানের ছক। ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সিওএস জেনারেল হামিদ টেলিফোন করে পূবে ডেপ্লয় করা একমাত্র ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাকে অপারেশনের পরিকল্পনা করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ১৮ তারিখ সকালে ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি কার্যালয়ে বসে জেনারেল রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি অপারেশনের প্রাথমিক পরিকল্পনা তৈরি করেন। পরিকল্পনাটি জেনারেল ফরমান নিজ হাতে হালকা নীল রঙের একটি অফিস প্যাডের ৫ পাতা জুড়ে লিড পেন্সিল দিয়ে লিখে নেন। ১৮ তারিখেই রাও ফরমান আলী সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা চুড়ান্ত করতে ২২ তারিখে হেডকোয়ার্টারের আহুত জেনারেলদের সভায় যোগ দিতে ঢাকা ছাড়েন । ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি এবং জেনারেল পীরজাদা প্রেসিডেন্টের অফিসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে সাক্ষাত করলে তাদের বসার সাথে সাথেই প্রেসিডেন্ট চিত্কার করে বলেন-আমি ঐ বাষ্টার্ডটাকে শায়েস্থা করতে যাচ্ছি। সেই সভাতেই পূর্ব পাকিস্থানে কঠিন মিলিটারি এ্যাকশ্যানে যাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ইয়াহিয়া।(হাউ পাকিস্থান গট ডিভাইড- মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী)

২২ ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ এ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে ইয়াহিয়া বলেন “Kill three million of them, and the rest will eat out of our hands.” (Robert Payne, Massacre [1972], p. 50.) এরপরই জেনারেলরা দীর্ঘ মিটিংয়ে বসে অপারেশনাল প্লান নিয়ে হিসাব নিকাশ শুরু করেন। রাও ফরমান আলীর ভাষায় জেনারেলরা জানতেন একবার একটি বুলেট চালানো মাত্রই পূর্ব পাকিস্থান অতীত হয়ে যাবে। কিন্তু ভারত ফ্যাক্টরকে চীন দিয়ে সামলে নেবার ব্যাপারে আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন তারা। তাই দীর্ঘ হিসাবনিকাশের পর তারা সিদ্ধান্তে পৌছেন আওয়ামীলীগ একটা বুজোর্য়া দল। এই দল গেরিলা যুদ্ধ চালাতে পারবে না। সুতরাং পূর্ব পাকিস্থানে কোন সহিংস সংঘাত ঘটবে না।(হাউ পাকিস্থান গট ডিভাইড- মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী)লে জেনারেল টিক্কা বলেন, ১০ এপ্রিলের পর আর কোন বাধা বিপত্তি থাকবে না। (Pakistan Defence Journal, 1977, Vol 2, p2-3)। পাকিস্থানী সেনাবাহিনী তাই মুজিবকে নির্বাচিত করে পূবের জনসাধারন যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে তার জবাব অস্ত্রের ভাষায় দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সামনে তখন উদাহরন ছিলো বেলুচিস্থান। জেনারেল টিক্কা খান তার ঠেঙ্গুরে বাহিনী দিয়ে গণহত্যা আর নির্যাতন চালিয়ে মাত্র কদিন আগে স্তব্ধ করেছিলেন বেলুচিস্তানের জনগনের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। এবার তাকে মিশন দিয়ে পাঠানো হল ঢাকায়।

সেনা অভিযানের প্রস্তুতিঃ
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা হতে ১৬তম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং খরিয়ান থেকে ১৯তম ডিভিশনকে মার্চের মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার আদেশ দেয়া হয়। সে অনুযায়ী পিআইএর করাচী-ঢাকা বানিজ্যিক, বিমান বাহিনীর ৬টি সি ১৩০ হারকিউলিস বিমানের সামরিক ফ্লাইটে বেসামরিক পোষাকে ধীরে ধীরে সেনারা ঢাকায় আসতে শুরু করলো। মার্চের ১ম সপ্তাহের মধ্যে ১৩ এফএফ এবং ২২ বালুচ রেজিমেন্ট ঢাকায় পৌঁছে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ভিড়ে ৯০০০ টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এমভি সোয়াত নামের একটি জাহাজ। (Major Rafiqul Islam, A Tale of Millions, p57) পাকিস্থান নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ গুলো করাচি ছেড়ে চালনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ভয়াবহ হিংস্রতা নিয়ে তৈরী হতে থাকে দানবেরা নিজের দেশ বলে দাবীদার হয়ে সেদেশের নাগরিকদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানোর জন্য।

সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি হিসাবে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পারিক বিরোধিতাকে পুজি করে পাকিস্থানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১লা মার্চ রেডিও ভাষনে পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষনা দেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়া হিসাবে যা ঘটে তা ছিল জেনারেলদের সকল প্রেডিকসনের অতীত। ঢাকায় রাস্তায় রাস্তায় জনগন নেমে আসে। বাংলাদেশের সকল মানুষ এককন্ঠে এর প্রতিবাদ জানায়। রাজপথে দাবী আদায়ের লড়াইয়ে নামা জনগন শেখ মুজিবকে স্বাধিকার নয় স্বাধীনতার ডাক দিতে আহবান জানায় তখন। তারা স্লোগান দেয় পদ্মা মেঘনা যমুনা/তোমার আমার ঠিকানা। তোমার দেশ আমার দেশ/বাংলাদেশ বাংলাদেশ। বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর/বাংলাদেশ স্বাধীন কর।শেখ মুজিবের পথ ধর বাংলাদেশ কায়েম কর, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মার বাংলাদেশ কায়েম কর।’ সেদিন বিকেলে গুলিস্তানের সামনে, বিবি মরিয়মের [কামান] কাছে দাঁড়িয়ে তৎকালীন ন্যাপ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী সব বাঙালীর মনের কথা তুলে ধরেছিলেন এক বক্তৃতায়। তিনি বলেছিলেন, ‘আজ আর কোন দল নয়, কোন মত নয়, নেই কোন ভেদাভেদ। শেখ সাহেব, আপনার কাছে আমাদের আবেদন, আপনি সিদ্ধান্ত নিন। বাংলার প্রতিটি মানুষ আপনার সে সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে আপনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে।’ স্বাধীনতার পর, বিএনপির স্থপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান লিখেছিলেন তার, “ ১লা মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে শুরু হলো ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন।”
৩ মার্চ, আগের রাতের শহীদদের নিয়ে মিছিল বের হয়। বঙ্গবন্ধু বলেন, “বাংলার মানুষ খাজনা দেয়, ট্যাক্স দেয় রাষ্ট্র চালানোর জন্য, গুলি খাওয়ার জন্য নয়। গরিব বাঙালীর টাকায় কেনা বুলেটের ঘায়ে কাপরুষের মতো গণহত্যার বদলে অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিন।... ২৩ বছর রক্ত দিয়ে আসছি। প্রয়োজনে আবার বুকের রক্ত দেব। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বীর শদীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করব না।” বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, “ভায়েরা আবার আমি বলছি, আমি থাকি আর না নাকি আমার সহকর্মীরা আছেন। তারাই এই নেতৃত্ব দেবেন। আর যদি কেউ না থাকে তবু আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালীকে নেতা হয়ে নির্ভয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।” পল্টনের জনসভায় তিনি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তাঁর হাতে তুলে দেয়া হয় বাংলাদেশের পতাকা। চারদিক থেকে গগনবিদারী গর্জন শোনা যায়। ‘জয় বাংলা জয় বাংলা।’
এরই প্রেক্ষিতে আসে ৭ই মার্চ। (হেড কোয়ার্টার অব চীফ মার্শাল ল এ্যাডমিনিষ্টেটর) এইচ কিউ সিএমএলএ ভয় পেল জনতার চাপে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষনা করতে পারেন। ৬ তারিখে শেখ মুজিবের বাসায় ১৪ ডিভিশনের জিওসি জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাকে তারা পাঠাল এই হুমকি দিয়ে যদি মুজিব স্বাধীনতা ঘোষনা করেন তবে সেই জনসভাতেই পাকিস্থানী আর্মি এ্যাকশনে যাবে। শুধু হুমকিই নয় জেনারেল রাজা রমনায় সেদিন দুই ব্যাটালিয়ান সশস্ত্র সেনা এবং ট্যাংক মোতায়েন করেন। সতর্ক অবস্থায় রাখেন বাংলাদেশের সব অবস্থানে থাকা সকল সেনা, বিমান আর নৌসেনা ইউনিটকে। এয়ার পোর্টে উড়ার প্রস্তুতি নিয়ে তৈরী থাকে যুদ্ধবিমান। স্বভাবতই মুজিব পাকিস্থানি সেনা বিন্যাস সম্পর্কে জানতেন। জানতেন তার একটি হঠকারী ঘোষনা লাখো মানুষের অকারন রক্তক্ষয়ের কারন হবে। তাতে না দেশ স্বাধীন হবে, না জনগন এই গোলামীর জিঞ্জির ছিড়ে মুক্তি পাবে। তাই শেখ মুজিব কৌশলী হলেন। পল্টনের ভরা জনসমুদ্রে তিনি দৃপ্ত কন্ঠে পাকিস্থানী সেনাদের প্রতিরোধের জন্য বাঙ্গালীকে ঘরে ঘরে দুর্গ ঘরে তোলার আহ্বান জানালেন। তিনি ঘোষনার সুরে আবৃত্তি করলেন শতাব্দির শ্রেষ্ট কবিতা, এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

এদিকে ৭ ই মার্চের আগে পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত ঘোষনা করার পর উদ্ভুদ পরিস্থিতিতে হেডকোয়ার্টার ইসলামাবাদে রাও ফরমান আলীকে ডেকে পাঠায়। ৫ই মার্চ সকাল ১১টায় যখন তিনি প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে যান তখন প্রেসিডেন্ট তার অফিসে ছিলেন না। পরিবর্তে তার বাসভবনের পেছনের বারান্দায় বসে ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন জেনারেল হামিদ এবং জনাব ভূট্টো। রাও ফরমান আলী আমাদের জানাচ্ছেন তারা তিনজনই তখন মদ পান করছিলেন। ইয়াহিয়া খালি পায়ে ছিলেন, তিনি তার পা দুটিকে সামনের টেবিলে তুলে দিয়েছিলেন। সেখানে ব্যাপক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় জনরোষকে দমাতে এবং সামনের পরিস্থিতি (সামরিক অভিযান) সম্পর্কে পূর্ব বাংলার মানুষকে ভূল ধারনা দিতে ইয়াহিয়া ২৫ শে মার্চ অধিবেশন আহ্বানের ঘোষনা করবেন। ৬ মার্চ সে ভাষন রেডিও টিভিতে প্রচার করা হয়।

কিন্তু পূর্ববাংলার জনগন তখন বিদ্রোহী মনোভাবের তুঙ্গে। ৭ই মার্চের পর পুলিশ প্রধান তার বাহিনীসহ কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ ত্যাগ করলেন। ইপিআর বিদ্রোহী হয়ে উঠল। তারা সরাসরি মুজিবের কাছে নির্দেশ চাইল। প্রশাসন, বিচার বিভাগ সবক্ষেত্রেই তখন প্রাধান্য হারিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সব কিছুই তাদের প্রতিকূলে। অনেক বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তা প্রতিনিয়ত সেনানিবাসের অভ্যন্তরের নানা খবর পৌছাতে লাগলেন আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে। স্বভাবতই ছয় দফার তত্ত্ব তখন অচল হয়ে গেছে। রাজনৈতিক সমাধান হিসাবে তখন আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে মুজিব গর্ভনর টিক্কা খানকে প্রেসিডেন্টের নিকট পূর্ব পশ্চিম পাকিস্থানের কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব জানাতে বললেন। তিনি চিঠি লিখলেন জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের কাছে। লিখলেন পাকিস্থানের জান্তা সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে সাড়ে সাতকোটি বাঙ্গালীর মানাবধিকার অস্বীকার করে দমন পীড়ন চালাচ্ছে। নিরীহ জনতার উপর গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করছে। সাতই মার্চের ঘোষণার পর সারাদেশে ডামি রাইফেল নিয়ে কুচকাওয়াচ শুরু হয়ে গেল। শান্তিপূর্ণ অসহযোগ চলছে। প্রতিদিন সভা। মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ছে, কিন্তু সবই চলছে শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে। ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানী পর্যন্ত ঘোষণা করলেন “ইয়াহিয়া খান, তোমার যদি পশ্চিম পাকিস্তানের পাঁচ কোটি মানুষের জন্যও দরদ থাকে তাহলেও তুমি পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন ঘোষণা করো। এতে করে দুই পাকিস্তানে ভালবাসা থাকবে, বন্ধুত্ব থাকবে, কিন্তু এক পাকিস্তান আর থাকবে না, থাকবে না; রাখব না, রাখব না।” অহিংস অসহযোগ আন্দোলন প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘আমি অহিংস নীতিতে বিশ্বাস করি না, অহিংসার কথা বাদ দাও , এটা অবাস্তব। আমার নবী বলতেন, প্রথমে আক্রমণ করো না; কিন্তু কেউ যদি আক্রমণ করে তার তেরোটা কেন চৌদ্দটা বাজিয়ে দাও।”
বঙ্গবন্ধু আইনী আন্দোলনে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু বিকল্পও রেখেছিলেন এবং সেটি ৭ মার্চের জনসভায় তা বলেছিলেনও।
১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। ৫২ বছরে পা রাখলেন। মাত্র ৫২ বছর । বিদেশী সাংবাদিকরা শুভেচ্ছা জানালে তিনি বললেন, “ ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ আমার জন্মদিন। আমি জীবনে কখনও আমার জন্মদিন পালন করিনি। আপনারা আমার দেশের মানুষের অবস্থা জানেন, তাদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। যখন কেউ ভাবতেও পারে না মরার কথা তখনও তারা মরে। যখন কেউ ইচ্ছা করে তখনও তাদের মরতে হয়। আমার আবার জন্মদিন কি, মৃত্যু দিনই বা কী? আমার জীবনই বা কি? মৃত্যু দিন আর জন্মদিন অতি গৌণভাবে এখানে অতিবাহিত হয়। আমার জনগণই আমার জীবন। ...সাত কোটি মানুষ যখন পাহাড়ের মতো আমার এবং আমার দলের পশ্চাতে একতাবদ্ধ হয়েছে, তখন আমার চেয়ে সুখী মানুষ আর কে হতে পারে?”


প্রতারনা আর শঠতার কালক্ষেপনের আলোচনাঃ
আওয়ামীলীগ ঘোষিত অসহযোগ কার্যত তখন পশ্চিম পাকিস্থান থেকে পূর্বকে বিচ্চিন্ন করে দিয়েছে। ৩৬টি প্রশাসনিক নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশের সকল নিয়ন্ত্রন শেখ মুজিব নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। এই অবনতিশীল অবস্থায় ভেতরে ভেতরে চুড়ান্ত সেনা অভিযানের ব্যাপক প্রস্ততি নিয়ে বাইরে লোকদেখানো কনফেডারেশনের প্রস্তাব এবং নতুন অধিবেশনে প্রস্তাবিত সংবিধানে তা সংযুক্তি সংক্তান্ত প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা আসেন।
তখন প্রেসিডেন্ট হাউজ জনতা দখলে নিয়েছিল। মুজিব তাদের সেখান থেকে সরে যেতে নির্দেশ দিয়ে বললেন প্রেসিডেন্টকে আমরা আমাদের মেহমান হিসেবে গ্রহন করব, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়। ১৬ তারিখ সন্ধ্যায় ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউজে এক সভা অনুষ্টিত হয় যাতে প্রায় সকল পশ্চিম পাকিস্থানী সিনিয়র অফিসার যোগ দেন। সেখানে একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট কনফেডারেশনের ব্যাপারেও উদার মনোভাব দেখান। তিনি বলেন জাতির পিতাও দুই পাকিস্থানের ধারনার বিরোধী ছিলেন না। তেমন ধারনার বিরোধিতা করার আমি কে? এর পর শুরু হল প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিবের মধ্যে পর্যায়ক্রমিক আলোচনা। প্রেসিডেন্টের সাথে জেনারেল পীরজাদা, বিচারপতি কর্ণেলিয়াস, এমএম আহমদ, এবং কর্ণেল হাসান। আর বঙ্গবন্ধুর দলে ছিলেন কামাল হোসেন, তাজউদ্দিন আহমদ, ও খন্দকার মোশতাক আহমদ। আলোচনায় অগ্রগতির খবর প্রতিদিনই জানান দু পক্ষ। এর মধ্যে ১৯ শে মার্চ জয়দেবপুরে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পরিদর্শনে বিগ্রেড কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার আরবাব যান। তার সেখানে যাওয়ার খবরে রব উঠে আরবাব বাঙ্গালী সেনাদের নিরস্ত্র করতে সেখানে গেছেন। খবর শুনে ক্ষুদ্ধ ১০ হাজারের ও বেশি মুক্তিকামী জনতা লাঠিসোটা হাতে জড়ো হয়ে জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রায় ১৫০ টির মত ব্যারিকেড দিয়ে আরবাবের ঢাকা ফেরার পথ আটকে দেয়। ব্যারিকেডের জন্য ঢাকার দিকে এগোতে না পেরে জনতার উপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন আরবাব। তার সঙ্গী পাঞ্জাবী সেনারা নির্বিচার গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করে সেদিন। শহীদ হন কিশোর নিয়ামত ও মনু খলিফা। চান্দনা-চৌরাস্তায় প্রতিরোধকালে হুরমত আলী নামে এক যুবক একজন পাকিস্তানী সৈন্যের রাইফেল কেড়ে নিয়ে গুলি করতে চেষ্টা করেন। সে সময় অপর একজন পাকিস্তানী সৈন্যের গুলিতে হুরমত আলী শহীদ হন। এ ছাড়া গুলিতে আহত হন ইউসুফ, সন্তোষ ও শাহজাহানসহ আরও অনেকে। শেখ মুজিব এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। এ ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করতে প্রেসিডেন্টের প্রতি দাবী জানান তিনি।

রাও ফরমান আলীর ভাষ্যমতে এই ১৯ তারিখেই দুই পক্ষ একটি সমঝোতার দ্বারপ্রান্তে পৌছায়। ফেডারেশনের আওতায় কেন্দ্রীয় সরকারের রপরেখাটি ছিল পশ্চিম থেকে হবেন প্রেসিডেন্ট, সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা শেখ মুজিব হবেন প্রধানমন্ত্রী, পূর্ব থেকে পাচজন, পশ্চিম থেকে পাচজন মোট দশজন হবেন মন্ত্রী। ইয়াহিয়া বৃহত্তর সমঝোতার স্বার্থে এ বিষয়ে ভুট্টোর অনুমোদনের প্রস্তাব তুললেন। মুজিব তাতে আপত্তি করলেন না। সেই অনুযায়ী ২১ শে মার্চ ঢাকা আসলেন ভুট্টো। সেনানায়ক ও পশ্চিমের এলিটদের খুশি করতে তিনি এই সমঝোতাকে পশ্চিমের প্রতি মারাত্মক বিশ্বাসঘাতকতা বলে বর্ণনা করেন। তিনি জাতীয় অধিবেশনে এ নিয়ে আলোচনা করার প্রস্তাব দিলেন। আলোচনা জটিল হয়ে উঠল।

২৩ মে মার্চ ছিল পাকিস্থানে পতাকা দিবস। ঐদিন শুধু সেনানিবাসগুলো ছাড়া সারা দেশে জনতা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। সেদিন সকালে মুজিব তার ৩২ নম্বরের বাসভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন হাজার হাজার জনতার সামনে। নিজের গাড়ির উপর বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়ে প্রেসিডেন্ট হাউজে এলেন তিনি। দৃশ্যত বাংলাদেশের দাবী নিয়ে জনতার আগ্রাসী মনোভাব মনে রেখে ঐদিন আওয়ামীলীগ প্রতিনিধি দল আলোচনায় চুড়ান্ত প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তাজউদ্দিন দাবী মেনে নেবার জন্যে প্রেসিডেন্টকে ৪৮ ঘন্টা সময় প্রদান করে বলেন তারা আর কোন আলোচনায় যাবেন না।(হাউ পাকিস্থান গট ডিভাইড- মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী) বিপর্যয় আর রক্তপাতের আশংকায় পশ্চিম পাকিস্থানের অন্যান্য নেতারা ঢাকা ত্যাগ করতে শুরু করলেন। রাজনৈতিক মীমাংসার সকল আশা দৃশ্যত অপসৃত হয়ে গিয়েছিল।

সারা দেশে তখন বিষ্ফোরক অবস্থা। সেনাদের নিকট কোনকিছু বিক্রয় করতে অস্বীকার করেছে জনতা। সারা দেশের সব সেনানিবাস অথবা সেনা স্থাপনার কাছের পরিবেশ থমথমে হয়ে উঠেছে। হাট বাজারগুলোতে নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল কিনতে জনগনের চরম বিরোধিতার সম্মুখীন হয় সেনারা। দেশের প্রায় সকল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সেনাবহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বাঙ্গালী সদস্যদের দ্বারা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্র ও স্বেচ্ছাসেবকেরা সামরিক প্রশিক্ষন নেয়া শুরু করে। ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র থেকে শুরু করে নানা দেশীয় অস্ত্র জোগাড় করে প্রতিরোধের প্রস্ততি নিতে শুরু করে জনতা। এ যেন উদয় লগ্নের রক্তিম আলোর বেলা। সারা দেশে পাকিস্থানি সেনারা হত্যা করছিল প্রতিবাদি সাধারন মানুষদের। সংখ্যাটা বাড়ছিল প্রতিদিন। তবু যেন আত্মাহুতির পালায় যোগ দেয়া মানুষের সংখ্যাই কেবল বাড়ছিলো। নানা গুজব রটছিলো প্রতিদিন।

সেনা অবস্থানঃ
২২ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাকিস্থান সেনাবহিনীর ডেপ্লয় করা ডিভিশনের সংখ্যা ছিলো একটি। সেটি হলো মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার কমান্ডের অধীন ১৪ পদাতিক ডিভিশন।যেখানে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ি তিনটে ব্রিগেড থাকার কথা, সেখানে এই ডিভিশনে চারটি পদাতিক ব্রিগেড ছিল।( ASM Shamsul Arefin, Standing of History,- - War of Liberation, p340 -p341) ৫৭তম পদাতিক বাহিনীকে(পশ্চিম পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার জাহানবাজ আরবাব এর অধীনে) ঢাকায়, ৫৩তম পদাতিক বাহিনীকে(পশ্চিম পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির অধীনে) কুমিল্লায়, ২৩তম ব্রিগেডকে(পশ্চিম পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ খান মালিকের অধীনে) রংপুরে এবং ১০৭তম ব্রিগেডকে(পশ্চিম পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার এআর দুররানির অধীনে) যশোরে পাঠানো হয়। ব্রিগেডিয়ার এম এইচ মজুমদার নামের এক বাঙালি ব্রিগেডিয়ার ছিলেন চট্টগ্রামের কমান্ডে। সাধারণ ভাবে প্রতি ব্রিগেডে ৩ থেকে ৪টি পদাতিক ব্যটেলিয়ন ও একটি ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট এবং আরো কিছু সাহায্যকারী অংশ থাকে।এই চারটি ব্রিগেডে মোট ১২টি পদাতিক ব্যাটেলিয়ন ছিল(প্রতি রেজিমেন্টে সাধারণত ৯১৫ জন সৈন্য থাকে) যেগুলোর সব গুলোতে ছিল শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা(প্রধানত পাঞ্জাব, বালুচ, পাঠান এবং সিন্ধিদেরই প্রাধান্য দেয়া হয়)। (Maj Gen Hakeem Qureshi, The 1971 Indo-Pak War, p20) এই সেনাদের ২৫ মার্চের আগেই পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসা হয়। এই ডিভিশনের আরো ছিল ৫টি ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট, একটি হালকা এন্টি এয়ারক্রাফট রেজিমেন্ট, একটি কমান্ডো ব্যটেলিয়ন(৩য়), যেগুলোর সবগুলোতেই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রাধান্য। রংপুরে অবস্থানরত ২৯তম অশ্বারোহী রেজিমেন্টই ছিল পুর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত একমাত্র স্বশস্ত্র মিশ্র(যেখানে বাঙালি সৈন্য ছিল) রেজিমেন্ট। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এর প্রায় ২০% সৈন্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের, যেখানে বিভিন্ন ইউনিট এবং সেনানিবাসের সাহায্যকারী সৈন্যরা ছিল মিশ্র জাতীয়তার। বেশিরভাগ ইউনিটের ইউনিট কমান্ডার এবং উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাগণ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী(Major Nasir Uddin, Judhay Judjay Shadhinota, p103)

১৯৭১ এর মার্চে ৬টি নিয়মিত বাঙালি পদাতিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে উপস্থিত ছিল। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (ইবিআর) যশোরে ১০৭তম ব্রিগেডের সাথে যুক্ত ছিল। ২য় ইবিআর ঢাকার দক্ষিণে জয়দেবপুরে ৫৭তম ব্রিগেডের সাথে যুক্ত ছিল। ৩য় ইবিআর ২৩তম ব্রিগেডের সাথে সৈয়দপুরে ছিল। এবং ৪র্থ ইবিআর ৫৩তম ব্রিগেডের সাথে কুমিল্লায় ছিল। ৮ম ইবিআর পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং প্রায় ৭৫% সৈন্য ছিল চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে ২০০০ বাঙালি সৈন্য অবস্থান করছিল, যাদের মধ্যে নতুনভাবে তৈরি করা ৯ম ইবিআর ও অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১০ম ইবিআর ছিল একটি প্রশিক্ষন ইউনিট, যেটি ঢাকায় ১৪তম ডিভিশনের সাথে সংযুক্ত ছিল। বাঙালি অফিসাররা ১ম, ২য় এবং ১০ম ইবিআর এর নেতৃত্বে ছিলেন এবং বাদবাকিগুলোর দায়িত্বে ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসাররা(ASM Shamsul Arefin, Standing of History,- - War of Liberation, p5-p14)

অপারেশনে নামার আগেই যাতে সংশ্লিষ্ট সব পাকিস্তানী ইউনিট কমান্ডার তাদের দায়িত্ব বুঝে নিতে পারে সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনাকারীদের। আর এই কাজটি করা দরকার ছিল সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের একত্রিত করা, অস্ত্রশস্ত্রের যোগান, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত সৈনিক পূর্ব পাকিস্তানে আনা, আঞ্চলিক সেনানায়কদের কার্যবিবরণী প্রদান- এই সব কিছুই করা প্রয়োজন ছিল কোন সন্দেহের উদ্রেক না ঘটিয়ে।

পাকিস্তানীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সফলতা নিশ্চিত করতে ২৫ মার্চের আগেই পশ্চিম থেকে পুরো একটি ব্রিগেড পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো। ধীরে ধীরে সৈন্য ও রসদপত্র পাঠানোটা সেই মহাপরিকল্পনারই অংশ ছিল। (Lt. Gen A.A.K Niazi, The Betrayal of East Pakistan, p76) পূর্বে আসা নতুন সৈনিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অনেক নতুন নতুন ব্যবস্থা করতে হয়েছিল, সাপ্লাই ইউনিট এর বাঙালি সদস্যরা এটা বুঝতে পেরেছিল আগেই। অবশ্য এই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে খুব বেশি অসুবিধা হয় নি, এটা অপারেশনের কোন ক্ষতিও করেনি। ব্রিগেডিয়ার হ্যারিসন রসদপত্র ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন, পশ্চিমে কার্যক্রম সামাল দিতে ফিরে গিয়েছিলেন জেনারেল মির্জা।( Maj. Gen. K.M. Shafiullah,, Bangladesh at War, p98)

অপারেশন সার্চলাইট এর বাস্তবায়ন শুরুঃ
হেডকোয়ার্টার মিলিটারি এ্যাকশনে মেজর জেনারেল রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সাথে দায়িত্ব নেয়ার জন্য মেজর জেনারেল ওমর এবং মেজর জেনারেল খুদা দাদকে ঢাকা পাঠায়। ২৫শে মার্চ সকালে কোর কমান্ডার জেনারেল টিক্কা খানের সংগে সাক্ষাত করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া টিক্কাখানের বাসভবনে আসেন। তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্থান সেনাবাহিনীর সিনিয়ার অফিসাররা। জেনারেল হামিদ, জেনারেল মিঠা, জেনারেল ইফতিকার, জেনারেল খুদাদাদ ও জেনারেল ওমর। ঠিক হয় ২৫শে মার্চ রাতে ইয়াহিয়া করাচির আকাশ সীমায় পৌছে যাবার পরপর মিলিটারি এ্যাকশন শুরু হবে। সারা পূর্ববাংলাকে তারা কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে দায়িত্ব ভাগ করে দেন। পরিকল্পনা হয় অভিযান শুরুর সাথে সাথে আওয়ামীলীগের সব নেতাদের গ্রেফতার ও খুন করা হবে। ঢাকায় অভিযান পরিচালনা করতে দায়িত্ব দেয়া হল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে। তার তত্বাবধানে বিগ্রেড কমান্ড করার দায়িত্বে ছিলেন বিগ্রেডিয়ার আরবাব। নেতাদের বাড়ি চিহ্নিত করে রাখার উদ্দেশ্যে দিনের বেলা সাদা পোষাকে ব্যাটালিয়ান কমান্ডাররা গিয়ে রেকি করে আসেন।

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি কর্তৃক প্রণীত ঢাকা আক্রমণের পাকিস্তানী পরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপঃ
১। ১৩তম সীমান্তবর্তি সৈন্যদল সেনানিবাসে সংরক্ষিত শক্তি হিসাবে থাকবে এবং নিরাপত্তা প্রদান করবে।
২। ৪৩তম হালকা বিমানবিধ্বংসী বাহিনী তেজগাঁও বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে।
৩। ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ইপিআর বাহিনীকে নিরস্ত্র করবে এবং ইপিআর সদর দফতরের ওয়্যারলেস ব্যবস্থা দখলে নেবে।
৪। ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে নিস্ক্রিয় করবে।
৫। ১৮তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দায়িত্ব ছিল পুরান ঢাকা এবং নবাবপুরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
৬। ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্ট মোহাম্মদপুর এবং মিরপুরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল।
৭। 3 SSG এর একটি প্লাটুন মুজিবকে ধরার দায়িত্বে ছিল।
৮। ২২তম বালুচ এবং ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্রোহীদের নিস্ক্রিয় করার দায়িত্বে ছিল।
৯। ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট এরপর পিলখানার শক্তি বৃদ্ধি করবে।

চট্ট্রগ্রামের রেজিমেন্টাল কমান্ডার ছিলেন বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার মজুমদার।ব্রিগেডিয়ার মজুমদার নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গুলি বর্ষণে ইবিআর এর সেনারা অস্বীকৃতি জানিয়ে এমভি সোয়াত এর মালামাল খালাসের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করলে তাকে ২৪ মার্চ তার পদ থেকে অব্যাহতি দেন জেনারেল খাদিম। তাকে এই বলে অব্যাহতি দেয়া হয়ে যে তার এখন জয়দেবপুরে গিয়ে ২ ইবিআর এর কাছে রিপোর্ট করতে হবে, তার বদলে ব্রিগেডিয়ার এম এইচ আনসারি চট্টগ্রাম এলাকার দায়িত্ব পান। (Siddiq Salik,, Witness To Surrender, p69) যেহেতু সেখানের বেশীরভাগ ট্রুপসও ছিলো বাঙ্গালী, বেশী ঝুকিপূর্ণ বিবেচনায় তাই সেখানের দায়িত্বে যান জেনারেল খাদিম স্বয়ং। হেলিকপ্টারে করে যশোরের বিগ্রেড কমান্ডারকে ব্রিফ করে আসেন জেনারেল ফরমান, সিওসি কোর এর বিগ্রেডিয়ার আলী আল-এদরুল ও জিএস কোর এর কর্ণেল সাদউল্লাকে পাঠানো হয় সিলেট,রংপুর ও বগুড়ার ট্রুপসদের ব্রিফ করতে।

২৫শে মার্চ সূর্যাস্থের পর পরই ট্রুপসের চলাচল শুরু হয়। কিন্তু তাদের শহরে ঢুকতে না দিয়ে অপেক্ষায় রাখা হয়। প্রেসিডেন্টের কাযর্ক্রমও তারা গোপন রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু এতে করে বিষয়টি নিয়ে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরে। সারাদিন মিছিল করে ক্লান্ত জনতা বাড়ি না ফিরে সন্ধ্যার সাথে সাথে সারা শহরে সড়কে সড়কে অসংখ্য ব্যারিকেড তৈরী করে। ব্যারিকেডের আশে পাশে দুনলা বন্ধুক, দেশীয় অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে হাজার হাজার মানুষ অবস্থান নেয়। সড়কের মাঝে মাঝে কয়লা আর টায়ার আগুন দিয়ে পুড়ানো হয়।


মার্চের প্রথম থেকেই আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব প্রতিরোধের পরিকল্পনা করছিল। সাবেক বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তারা পরামর্শ দেন পাকিস্থানী সেনার চলাচল নিয়ন্ত্রন করতে সড়ক গুলোতে অসংখ্য ব্যারিকেড তৈরী করে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে। তাই করা হয়েছিল। মার্চের প্রথম থেকেই অসংখ্য ব্যারিকেড তৈরী করা হয় ঢাকা সহ সব শহর, সড়ক ও মহাসড়কে। ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল সারা দেশ থেকে। নেতারা পূর্ব বাংলায় পাকিস্থান আর্মির ডেপ্লয় করা বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত বাঙ্গালী অফিসারদের মতিগতি বুঝার চেষ্টায় ছিলেন। তারা সেনাকর্মকর্তাদের পক্ষত্যাগ করে একটা যুদ্ধ পরিকল্পনা ঠিক করতে উত্সাহিত করছিলেন। কিন্তু কতিপয় ব্যাতিক্রম বাদে বেশিরভাগ সেনা কর্মকর্তারা এতে আগ্রহী হলেন না। তারা সাবধানী পদক্ষেপ গ্রহন করলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাঙ্গালী অফিসারদের বাহিনীতে ঠিকে থাকার স্বার্থে আরও বেশী করে পাকিস্থানী করে তুলেছিল। তারা তাদের কমান্ডের বিরুদ্ধে গিয়ে কোর্টমার্শালের মুখোমুখি হতে চাননি। এরই সাথে তারা ভাবতেও পারেননি পাকিস্থানি কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করতে গনহত্যার নীতি বেছে নেবে। এমনকি তাদেরকেও অবিশ্বস্থ আখ্যা দিয়ে কৌশলে নিরস্থ করে পাইকারীভাবে হত্যা করবে। তাই তারা অপেক্ষা করছিলেন রাজনৈতিক সমাধানের। ১৭ মার্চ থেকে চলমান আলোচনা তাদের আশ্বস্থ করেছিল। বাঙ্গালী যে দুএকজন কর্মকর্তা পুরা ট্রুপস কমান্ড করতে পারতেন তারাও মুজিবের প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য দেখাননি। জুনিয়র অফিসাররা তাদের সিনিয়ারদের কে ফলো করছিলেন। বিমান বাহিনীর একে খন্দকার সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন আওয়ামীলীগ হাই কমান্ডের সাথে। কিন্তু সেনাবহিনীর বিগ্রেডিয়ার মজুমদারের এতটা উত্সাহ ছিল না। এমনকি তিনি মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেননি। আওয়ামীলীগ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ভারতমুখীনতার একটা অভিযোগ তখনও ছিলো এখন যেমন আছে। পাকিস্থানী সেনা কর্মকর্তাদের ট্রেনিং এর সকল অংশই ছিলো ভারতকে মোকাবিলার উদ্দেশ্যে। তাদেরকে প্রতি মূহুর্তে শেখানো হতো ভারত আমাদের একমাত্র শত্রু । সুতরাং ভারতমুখীন আওয়ামী নেতৃত্বের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন ভারতের সুবিধা করে দেবে ভেবে অনেকেই এতে যোগ দিতে উত্সাহ পাননি। অনেকে চাকুরীর সুযোগ সুবিধা ছেড়ে অনিশ্চিত জীবনের পথে যাত্রা করতে চাননি। অনেকে ভেবেছিলেন পাকিস্থানী আর্মি দমন চালিয়ে সব ঠান্ডা করে দেবে। তাই তারা এতে অংশ নিয়ে নিজেদের জীবন ঝুকিপূর্ণ করতে চাননি। তাই আমরা দেখি অনেক সেনা কর্মকর্তা অগাষ্ট-সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পরিস্থিতি বোঝার জন্যে অপেক্ষা করেছেন। তারপর বাংলাদেশর স্বাধীনতা সময়ের ব্যাপার তখন তারা যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। আমাদের মুক্তিযদ্ধকালীন সকল সেনানায়কদের লেখা বই বা তাদের আত্মজীবিনী বা পত্রিকায় প্রকাশিত তাদের সাক্ষাতকার দেখলে দেখতে পাই দেশে অবস্থানরত সেনা ইউনিটগুলোর সদস্যরা মূলত ২৫ মার্চের ক্র্যাক ডাউনের পর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। অপারেশন সার্চলাইটের অংশ হিসেবে জিরো আওয়ারে তাদের বেশীরভাগকেই নিরস্ত্র করতে গিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্থানী সেনা কর্তৃপক্ষ। তারা কৌশলে অনেক বাঙ্গালী অফিসার এবং সেনাদের বন্দী করে নিযার্তন চালিয়ে তখন হত্যা করে। আত্মরক্ষার্থে যারা সেখান থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। সেনা কমান্ডের প্রতি আনুগত্য এবং তাদের প্রতি ভূল ধারনার কারনে সেনানিবাসগুলোতে ২৬, ২৭, ২৮ মার্চ তারিখে অপ্রস্তুত বাঙ্গালী সেনাদের ক্যাজুয়ালিটির সংখ্যাও ছিলো অনেক বেশী। দশম বেঙ্গল নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল পুরোপুরি। অবশ্য যুদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্থানী অফিসাররা বাঙ্গালী অফিসার এবং ট্রুপসরা যাতে সেনানিবাস দখল করতে না পারে সেজন্য যেখানে সংখ্যাগরিষ্ট বাঙ্গালী সেনা ও অফিসার ছিলো সেখানে তারা কৌশলে কিছু অফিসারদের ট্রুপস সহ কোন না কোন বাহানায় দুরে পাঠিয়ে দিয়ে সেনানিবাসে বাঙ্গালীসেনাদের সংখ্যালঘু বানিয়ে তাদের উপর হামলা চালায় এবং পাইকারিভাবে খুন করে। কিছু ঘটনা উল্লেখ করি।
ফার্ষ্ট বেঙ্গলের ব্যাটালিয়ান কমান্ডার লেঃ কর্ণেল রেজাউল জলিলকে স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির নেতারা বিদ্রোহের আহবান জানানো সত্বেও তার নির্দেশে বেঙ্গল রেজিমেন্ট যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রত্যাবর্তন করে। যদিও ২৫ শে মার্চের পর হতেই তারা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে বাইরে অবস্থান করছিল। ৩১ শে মার্চ যখন তাদের নিরস্ত্র করার পদক্ষেপ নেয়া হয় তখনই তারা বিদ্রোহ করেন এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হন। পরে ২২৫ জনের মতো সেনা জীবিত বের হতে পারে এবং তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
সেকেন্ড বেঙ্গল জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ২৮ তারিখে ট্যাকটিক্যালি ময়মনসিংহ সীমান্তের দিকে চলে যায়। এর আগে তারা গাজীপুর অস্ত্রাগার আক্রমন করে দখল ও অস্ত্রশস্ত্র লুট করে। পরে পাকিস্থানীদের বিরুদ্ধে আরও কটি আক্রমন চালিয়ে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে অধিনায়ক শফিউল্লাহ তার ট্রুপস সহ ভারত সীমান্তে চলে আসেন।
থার্ড বেঙ্গলের কমান্ডার, বিগ্রেড কমান্ডার সবাই ছিলো পাঞ্জাবী। ২৮ শে মার্চ ক্যাপ্টেন আশরাফ, ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও লেঃ সালাম সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট দখল করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ৩১ শে মার্চ রাত আড়াইটায় ২৬ এফ এফ ব্যাটালিয়ান ও ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের গোলন্দাজ বাহিনী তাদের আক্রমন করলে প্লান ভেস্তে যায়। অফিসারগন ট্রুপস সহ ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে সৈয়দপুরের বদরগঞ্জের ফুলবাড়িতে ডিফেন্স নেন। এপ্রিলের ১১ তারিখ পর্যন্ত ফুলবাড়িতে তারা ডিফেন্স ধরে রাখেন। পরে আর্মস ও অ্যামুনেশনের শর্টেজে এবং পাকিস্থানীদের স্থল ও বিমান হামলায় ঠিকতে না পেরে তারা পিছু হটেন। ২০ শে এপ্রিল রনক্লান্ত সেনাদল ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে।
কুমিল্লায় ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে বাঙ্গালী সেনাদের আধিপত্য ছিলো। সেখানে ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে ট্রুপস সহ ২৫শে মার্চের আগেই অল্প কিছু আর্মস অ্যামু দিয়ে ট্রেনিং এর নামে বের করে দেয়া হয়। মার্চের ২২ তারিখ ঢাকায় অবস্থানরত ৫৭তম ব্রিগেড এর ব্রিগেড মেজর, মেজর খালেদ মোশাররফ কে বদলি করে কুমিল্লায় ৪র্থ ইবিআর এর টুআইসি হিসেবে পাঠানো হয়। (Major Rafiqul Islam, PSC (ret), Muktijuddher Itihas, p185)। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় শমসের নগর এয়ার ফিল্ডে কল্পিত দুষ্কৃতিকারীদের প্রতিরোধে। তেলিয়াপাড়া নামক স্থানে তাকে এ্যামবুশের অপেক্ষায় থাকে পাঞ্জাবী সেনাদল। তিনি অল্পের জন্য ট্রুপসসহ প্রানে বেচে যান। মেজর শাফায়াত জামিলকে পাঠানো হয়েছিল ফিল্ড ট্রেনিং এর নামে ব্রাহ্মনবাড়িয়ায়। তারা দুজনেই আওয়ামীলীগ নেতৃত্বের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখতেন। ফলে যুদ্ধের শুরুতেই তারা বড় ধরনের বিপর্যয় এড়িয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। ২৭ মার্চ পরিকল্পিত ভাবে শাফায়ত জামিল ব্যাটালিয়ান কমান্ডার লেঃ কর্ণেল খিজির হায়াত, লেঃ কর্ণেল সাইদ এবং মেজর সাদেককে গ্রেফতার করে বিদ্রোহ করেন এবং বন্দীদের সহ ভারতে চলে আসেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে বাঙ্গালী অফিসাররা সতর্ক থাকার পরও বড় ধরনের ক্যাজুয়ালিটি এড়াতে সক্ষম হননি।
২৭শে মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পুরোপুরি বিধ্বস্থ দশম বেঙ্গলের অল্পকিছু সেনা সহ পালিয়ে আসেন লেঃ আনোয়ার। ড্রাম ফ্যাক্টরির কাছে তিনি মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেন।

চট্টগ্রাম ছিলো অষ্টম বেঙ্গলের আস্তানা। চট্টগ্রাম গ্যরিসনে বাঙ্গালী সৈন্যরা প্রচুর পরিমাণে ছিল, যা পাকিস্তানী পরিকল্পনাকারীদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ই পি আর এবং ই বি আর এর বাঙালি অফিসাররা পাকিস্তানী বাহিনীর উপর আগে থেকেই একটি আত্মরক্ষামূলক আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করছিলেন, কিন্তু সিনিয়র বাঙালি অফিসাররা (ই বি আর সি এর প্রধান প্রশিক্ষক লে কর্নেল এম আর চৌধুরী, এবং মেজর জিয়াউর রহমান) এই বিশ্বাস থেকে ক্যাপ্টেন রফিককে (ই পি আর সেক্টর অ্যাডজুটেন্ট) বিদ্রোহ করা থেকে নিরুৎসাহিত করেন যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বেসামরিক জনগনের বিরুদ্ধে কোন আক্রমণ চালাবে না, কিন্তু তারা এটা নিশ্চিত করেন যে পাকিস্তানী যে কোন আক্রমণের ঘটনায় তারা অবশ্যই বিদ্রোহ করবেন। এম ভি সোয়াত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সেনানিবাসে নিয়ে যাবার প্রচেষ্টা ২০-২৫ মার্চের মধ্যে সাধারণ প্রতিবাদকারীদের বাধার কারণে সাময়িক ভাবে ব্যর্থ হয় এবং সে সকল প্রতিবাদকারীদের অনেকেই সেনাসদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত ও গুলিবিদ্ধ হয়। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার অস্ত্র খালাস করতে না পারার ব্যর্থতার কারণে তার পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপরই সেখানে ট্রুপস সরিয়ে বাঙ্গালীদের দুর্বল করে সেনানিবাসের দখল হাতে রাখা হয়। কিছুদিনের মধ্যে অষ্টম বেঙ্গলের পশ্চিম পাকিস্থানে বদলি হবার কথা ছিল। তাই তাদের কাছ থেকে বেশ অস্ত্র সস্ত্র জমা নিয়ে নেয়া হয়েছিল। কর্ণেল অলি জানান ট্রেনিং এর জন্য মাত্র বারটি এলএমজি এবং ৩০০টি ত্রিনটত্রি দেয়া হয়েছিল। যেগুলো যুদ্ধে ব্যবহারের অনুপযোগী ছিলো। ২৫ তারিখ রাত এগারোটায় মেজর জিয়াকে তার কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্ণেল জানজুয়া ব্যারিকেড পরিস্কার করে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের অর্ডার দিয়ে নিজে একটা নৌবাহিনীর ট্রাকে তুলে বন্দরের দিকে পাঠিয়ে দেন। পরে মেজর জিয়া লেঃ কর্ণেল জানজুয়াকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মেজর জিয়ার জবানিতে, রাত একটায় আমার কমান্ডিং অফিসার আমাকে নির্দেশ দিল, নৌবাহিনীর ট্রাকে করে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে জেনারেল আনসারীর কাছে রিপোর্ট করতে। আমার সঙ্গে নৌবাহিনীর (পাকিস্তানি) প্রহরী থাকবে, তা-ও জানানো হলো। আমি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে তিনজন লোক নিয়ে যেতে পারি। তবে আমার সঙ্গে আমারই ব্যাটালিয়নের একজন পাকিস্তানি অফিসারও থাকবে। অবশ্য কমান্ডিং অফিসারের মতে, সে যাবে আমাকে গার্ড দিতেই।
এই আদেশ পালন করা আমার পক্ষে ছিল অসম্ভব। আমি বন্দরে যাচ্ছি কি না, তা দেখার জন্য একজন লোক ছিল। আর বন্দরে প্রতীক্ষায় ছিল জেনারেল আনসারী। হয়তো বা আমাকে চিরকালের মতোই স্বাগত জানাতে। আমরা বন্দরের পথে বেরোলাম। আগ্রাবাদ আমাদের থামতে হলো। পথে ছিল ব্যারিকেড। এই সময়ে সেখানে এল মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী। ক্যাপ্টেন অলি আহমদের কাছ থেকে এক বার্তা এসেছে। আমি রাস্তায় হাঁটছিলাম। খালেক আমাকে একটু দূরে নিয়ে গেল। কানে কানে বলল, তারা ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে। বহু বাঙালিকে ওরা হত্যা করেছে।
এটা ছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত সময়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি বললাম, আমরা বিদ্রোহ করলাম। তুমি ষোলশহর বাজারে যাও। পাকিস্তানি অফিসারদের গ্রেপ্তার করো। অলি আহমদকে বলো ব্যাটালিয়ন তৈরি রাখতে, আমি আসছি।
আমি নৌবাহিনীর ট্রাকের কাছে ফিরে গেলাম। পাকিস্তানি অফিসার, নৌবাহিনীর চিফ পোস্ট অফিসার ও ড্রাইভারকে জানালাম যে আমাদের আর বন্দরে যাওয়ার দরকার নেই।
ব্যাটালিয়নে ফিরে দেখলাম, সমস্ত পাকিস্তানি অফিসারকে বন্দী করে একটা ঘরে রাখা হয়েছে। আমি অফিসে গেলাম। চেষ্টা করলাম লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরীর সঙ্গে আর মেজর রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু পারলাম না। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। তারপর রিং করলাম বেসামরিক বিভাগের টেলিফোন অপারেটরকে। তাকে অনুরোধ জানালাম ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট, কমিশনের ডিআইজি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে তারা। (দৈনিক বাংলা, ১৯৭২ (একটি জাতির জন্ম) এবং সেক্টর কমান্ডাররা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় ঘটনা, সম্পাদনা শাহরিয়ার কবির, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা ১৯৯২।) মেজর রফিক তার ইপিআর সেনাদল নিয়ে ২৫শে মার্চেই বিদ্রোহ করেন। তিনি তার সহকারিদের নিয়ে আকষ্মিক হামলা চালিয়ে পাঞ্জাবী অফিসার ও সেনাদের বন্দী করে ফেলে রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে রেলওয়ে হিলের সদর দপ্তরে পৌঁছান। ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সংগঠিত সেনাদলের বিরুদ্ধে মেজর রফিকের এক কোম্পানী সৈন্য সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে ঠিকে থাকে। কিন্তু ইবিআরসির অধিকাংশ সৈন্য অফিসারদের প্রস্তুতিহীনতার কারনে বালুচ রেজিমেন্টের আক্রমনে নিহত হয়। এক কোম্পানী সৈন্য সহ মেজর মীর শওকত, ক্যাপ্টেন সাদেক, লেঃ মাহফুজ প্রমুখ মেজর রফিকের সাথে পরে যোগ দেন। পাকিস্থানী আমি একপর্যায়ে কোনটাসা হয়ে পড়ে চট্টগ্রামে। ২৬ শে মার্চ এবং ২৭ মার্চ রিইনফোর্সমেন্টের ফলে আবার তাদের শক্তি বেড়ে যায় ফলে বাঙ্গালী কমান্ডারদের নেতৃত্বে যুদ্ধরত সেনাদল পিছু হঠে আসে। যুদ্ধের খবর পেয়ে জিয়া আর চট্টগ্রামে না ফিরে শ দুয়েক সেনা সহ কালুরঘাটে চলে আসেন। তিনি সেখানে শক্ত নিরাপত্তা অবস্থান নেন। ২৭ তারিখে কালুরঘাটে স্থাপিত অস্থায়ী স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তার কালজয়ী ঘোষনা পাঠ করেন। যেটি ঐ সময়ে তখন পর্যন্ত যে সকল বাঙ্গালী সেনা বিদ্রোহ করেননি তাদের অনেককে বিদ্রোহ করাতে ভূমিকা রেখেছিল।

প্রতিরোধের পরিকল্পনা
সুতরাং দেখা যাচ্ছে সেনাদের সময়মতো বিদ্রোহ না করার কারনে ২৫ শে মার্চ তারিখে ধারনার অতীত বিপর্যয়ের শিকার হয় বাংলাদেশ। আমাদের মনে রাখা দরকার আওয়ামীলীগ সেনামুখী বা বিপ্লবী কোন দল নয় বরং একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। বড় বড় জন সমাবেশ, মিছিল, মিটিং করে জনগনের ঐক্য তৈরী করে সরকারকে রাজপথে মোকাবেলা করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাদের আছে, কিন্তু পাইকারী হত্যার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়া খুনী কোন সেনাদলকে মোকাবেলা করার কোন অতীত অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। ফলশ্রুতিতে একটি নিয়মিত বাহিনী যদি একটি জনগোষ্টিকে দলনের নিমিত্তে গনহত্যার উদ্দেশ্যে তার সকল শক্তি নিয়ে নেমে পড়ে তাহলে কিভাবে তাদের মোকাবেলা করা যায় সে প্লানে তাদের যথেষ্ট ত্রুটি থাকতেই পারে বা ছিল। ভয়াবহ রক্তপাত ঘটিয়ে আন্দোলনরত বাঙ্গালীদের দমাতে সংকল্পবদ্ধ সেনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী গেরিলাযুদ্ধের ভাবনাই হয়তো তাদের মাথায় কাজ করছিল বেশী। অন্তত রেফারেন্স বইপত্র দৃষ্টে তাই চোখে পড়ে। তারা পাকিস্থানী সেনাদের সারা পূর্ববাংলায় ছড়িয়ে পড়ার পর গেরিলা যুদ্ধে তাদের পর্যদুস্থ করার বিষয়টিকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলেই অনুমান করা যায়। কারন তাদের সামনে তখন উদাহরন ছিলো ভিয়েতনাম। শক্তিশালী মার্কিন সেনাবাহিনীকে ভিয়েতনামিরা গেরিলা যুদ্ধে সবে গোহারা হারিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে দুর্বল অথনীতির দেশ পাকিস্থানের হাজার মাইল দুরের প্রতিকূল ভূখন্ডে লড়াই করার সক্ষমতা, গোলাবারুদ সংগ্রহ করার সামর্থ্য, সেনা সংখ্যা ইত্যাদি অবশ্যই তাদের ভাবনায় ছিলো। সমরবিদ না হয়েও তারা বুঝতে পেরেছিলেন যুদ্ধের মাটে বাঙ্গালীরা যতই অসম হোক না কেন সেনা শক্তিতে, চুড়ান্ত বিচারে জয় তাদেরই হবে। ২২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রাক্তন বাঙালী সৈনিকদের সঙ্গে বৈঠকে কর্নেল ওসমানী সাহেব বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডু ইউ থিংক দ্যাট টুমরো উইল বি এ ক্রুসিয়াল ডে?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন, ‘নো, আই থিংক, ইট উইল বি টুয়েন্টি ফিফথ্।’ তখন ওসমানী সাহেব পুনরায় তীক্ষ্ণ স্বরে তাঁর কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘কাল তো তেইশে মার্চ। পাকিস্তান দিবস। সে উপলক্ষে ওরা কী কিছু করতে চাইবে না?’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ওরা যে কোন মুহূর্তে যে কোন কিছু করতে পারে। তার জন্য কোন দিবসের প্রয়োজন হয় না। আসলে আমরা যতটা এগিয়ে গিয়েছি এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে শঙ্কাও বোধ করছি। সে কারণে ওরাও কম শঙ্কিত নয়। ওরা জানে এডভান্স কিছু করার অর্থই সব শেষ করে দেয়া।’ নথিপত্র দৃষ্টে বোঝা যায় ২৩ শে মার্চের পর থমথমে পরিস্থিতিতে আওয়ামী নেতৃত্ব প্রাথমিক প্রতিরোধের পরিকল্পনা সমাপ্ত করেন। ৭ই মার্চের পর সারাদেশে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে উঠেছিল। বিপ্লবের প্রয়োজনে তারা প্রতিরোধের পরিকল্পনা এসকল সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন সারা দেশ জুড়ে। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বের নির্দেশ অনুযায়ী ছাত্রলীগের নেতারা তাদের অনুসারীদের নিয়ে পাকিস্থানী আর্মির সাথে মুখোমুখি সংর্ঘষের জন্য তৈরী হতে লাগলেন। তারা জানতেন প্রাথমিক প্রতিরোধই শেষ নয়, ভবিষ্যতের যুদ্ধটা তাদেরই লড়তে হবে। তাই তারা যার যার মতো করে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিলেন। কমান্ড কাঠামো ঠিক হলো। ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র, বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুট করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করছিলেন তারা। যুদ্ধের জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন হবে সেজন্য সরকারী কর্মকর্তাদের সহায়তায় ব্যাংক লুট করে যুদ্ধ তহবিল বানিয়ে তাতে অর্থ জড়ো করা পর্যন্ত হচ্ছিল। ট্রেনিং এর ব্যাপারে তারা আওয়ামীলীগের সদস্য সাবেক বাঙ্গালী সেনাদের নিয়ে টিম করছিলেন। জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে একটা দল কোথায় কোথায় ক্যাম্প করে লুকিয়ে থাকা যায়, কারা ভেতরে থেকে কাজ করবে ইত্যাকার একটা অগোছালো পরিকল্পনাও তৈরী করেছিলো। এমনকি প্রয়োজনে দেশ ছাড়ার প্রস্ততিও তাদের ছিলো। যে কারনে আমরা দেখতে পাই ২৫ মার্চে পাকিস্থানী সেনাদের চুড়ান্ত হামলার পর পরই সারা দেশে এই জনযোদ্ধারাই প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং প্রাথমিক প্রতিরোধের পরই সবাই যার যার কমান্ডের সাথে যোগাযোগ করে নির্ধারিত ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে চলে যায়। আর এর কদিন পরই তারা সংঘটিত ও পরিকল্পিত গেরিলা হামলা শুরু করে পাকিস্থান আর্মির নাভিশ্বাস ছুটিয়ে দেয়।

২৫শে মার্চ ১৯৭১ঃ
পঁচিশে মার্চ সকাল থেকে ৩২ নম্বরে সারাদিন একের পর এক মিছিল আসতে থাকে। মিছিলকারীদের উদ্দেশে ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে সতর্ক থেকে সকলের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু একই কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। অচিরেই আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক এক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হতে পারে এবং সেই যুদ্ধ আজ থেকে শুরু হলে অবাক হওয়ার কিছুই নাই। জনতার দাবিকে শক্তির দাপটে দাবিয়ে রাখার জন্য যদি কেউ রক্তচক্ষু প্রদর্শন করে আমরা তা বরদাস্ত করব না। যে কোন ধরনের ষড়যন্ত্র আমরা নিশ্চিহ্ন করে দেব।’ ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যার পর ইয়াহিয়া খান ছোট্ট একটা গাড়িতে করে পাহারা ছাড়াই ঢাকা এয়ার পোর্টে আসেন। সিনিয়র অফিসাররা তাকে বিদায় জানান। কিন্তু তারা জানতেন না পাকিস্থান এয়ার ফোর্সের উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার টারমাকে তাকে বিদায় দেবার জন্যে দাড়িয়ে আছেন। প্রেসিডেন্টের বিদায় নেবার খবর তিনিই এর পরপর শেখ মুজিবকে জানিয়ে দেন। প্রেসিডেন্টের বিদায়ের খবরে শংকিত হয়ে উঠেন শেখ মুজিব। তিনি সহকর্মীদের নিয়ে তত্ক্ষনাত জরুরী সভায় বসেন। সেদিন সকাল ৯টা থেকে তোফায়েল আহমেদ আর শেখ মনি বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছিলেন। তোফায়েল জানাচ্ছেন সেদিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এএইচএম কামারুজ্জামান, শেখ আব্দুল আজিজ, আব্দুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, গাজী গোলাম মোস্তফা, খাজা আহমদ, মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, আব্দুস সামাদ আজাদ, মতিউর রহমান, মশিউর রহমান, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখনসহ আরো অনেকে। আক্রান্ত হলে কি ভাবে কি করতে হবে তা নিয়ে অনেকদিন ধরে তৈরী হওয়া পরিকল্পনাগুলোর চুড়ান্ত অনুমোদন হয় সে বৈঠকে। ছাত্রনেতাদের সড়কে সড়কে ব্যারিকেড তৈরী করে পাকিস্থানী সেনাদের অগ্রযাত্রা আটকে দিতে নির্দেশ দেন তিনি। যাতে গোলাগুলি শুরু হলে মানুষ নিরাপদ আশ্রয় নেবার পর্যাপ্ত সময় পায়। এমএনএ ও এমপিএ ও দলের সিনিয়র নেতাদের আত্মগোপনের নির্দেশ দেন, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে রাখার মাধ্যমে লড়াইয়ের জন্য দিকনির্দেশনা দেন তিনি। সেনা বাহিনীতে কর্মরত বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হল। কিন্তু বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তারা সংগ্রাম কমিটিগুলোর সাথে যোগাযোগ না রাখায় এর আগেই পাকিস্থানি সেনা কর্তৃপক্ষ অভিযানের পরিকল্পনার অংশ হিসাবে তাদের ডিটাচ করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। ২৫ মার্চে এবং এর আগের সময়গুলোতে বাঙালি ইউনিটগুলোকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছিল। তাদেরকে সেনানিবাসের বাইরে পাঠানো হয় বিভিন্ন কাজ দেখিয়ে, এক অংশ থেকে আরেক অংশকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় এবং সবগুলো অংশকেই রেডিও এবং তারহীন যোগাযোগের গ্রিড থেকে যত সম্ভব দূরে রাখা হয়। বাঙালি কর্মকর্তাদের হয় ছুটিতে পাঠিয়ে দেয়া হয় নয়তো নেতৃত্বের কেন্দ্র বা সরাসরি অপারেশনে নিয়োজিত ইউনিটগুলো থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মকর্তারা বাঙালি ইউনিট পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। বাঙালি সৈনিকদের অনেককে ছুটিতে পাঠানো হয়, অনেককে নিরস্ত্র করা হয়, তবে এমনভাবে কাজগুলো করা যাতে কারও মধ্যে কোন সন্দেহের উদ্রেক না হয়।(The Rape of Bangladesh", Anthony Mascarnehas, Viks Press, Delhi, 1983) সাধারণ সময়ের তুলনায় তখন প্রথম ইবিআর এর শক্তি ছিল অর্ধেক, এই ইবিআর কেই শীতকালীন প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্তবর্তী চৌগাছায় পাঠানো হয়, ২৯ মার্চ পর্যন্ত তারা এখানেই ছিল। দ্বিতীয় ইবিআর এর কোম্পানিগুলোকে ঢাকার আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকেজো রাখা হয়। ৩য় ইবিআর এর কোম্পানিগুলোকে ছড়িয়ে দেয়া হয় সৈয়দপুর সেনানিবাসের বাইরে গোড়াঘাট ও পার্বতীপুর এলাকার আশেপাশে। ৪র্থ ইবিআর ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও শমসেরনগর এর মাঝামাঝি এলাকায়। একমাত্র চট্টগ্রামেই নিয়মিত বাঙালি ইউনিটগুলোকে তাদের স্বাভাবিক এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়নি।

পশ্চিম পাকিস্তানের ইপিআর বাহিনীর কোম্পানিগুলোকে শহরগুলোর যেখানেই পারা গেছে সেখানেই মোতায়েন করা হয়েছে। অপরদিকে বাঙালি ইপিআর বাহিনীকে পাঠানো হয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকায়। অধিকাংশ ইপিআর ইউনিট তাদের মূল অ্যাকশন এর অঞ্চল থেকে অনেক দূরে ছিল এবং নিজ অবস্থান থেকে বড় শহরগুলোতে পৌঁছতে তাদের অন্তত ১ দিন লাগতো। ২৪ অথবা ২৫ মার্চ রাতে ইপিআর এর বেতার যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়।

বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তাদের সাথে আওয়ামীলীগের হাই কমান্ডের নিয়মিত যোগাযোগ না থাকায় বিপদগ্রস্থ হল জাতি। বিপদগ্রস্থ হলেন তারা। যারা কন্ট্রাকে আসলেন তারাও পাকিস্থানী সৈন্যরা ভয়ংকর কিছু করবে তা ভাবতে পারেন নি। তারা ভাবলেন সামান্য কিছু নেতা গ্রেফতার হতে পারেন, তাদের বাড়িঘরে হামলা হতে পারে। সাধারনত মিলিটারি ক্যু হলে যা হয় তাই হবে হয়তো। রাষ্ট্রের ঐকের স্বার্থে পাকিস্থানীরা চরম কিছু করবে না। ফলে তারাও বিরত হলেন। কেবল রাজারবাগে পুলিশ হেডকোয়ার্টার আক্রান্ত হলে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিল তাদের সামান্য যা গোলাবারুদ আছে তাই নিয়ে। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসল আওয়ামীলীগের স্বেচ্চা সেবকেরা, সাধারন জনগন এবং ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্ররা। সভা চলাকালীন সময়েই বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রতিবেশী মোশারফ হোসেন এবং নঈম গওহরের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সংগ্রাম কমিটির অন্যতম নেতা এম আর সিদ্দিকীর টেলিফোন যোগাযোগ হয়। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন “আলোচনা ব্যর্থ হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী, ইপি আর আর পুলিশকে অস্ত্র সমর্পণ না করতে বলুন এবং এবং জনগনকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বলুন। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।”

জরুরী সভা শেষে পাকিস্থানীদের সশস্ত্র মোকাবেলার জন্য সহযোদ্ধাদের সিদ্ধান্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাড়ি থেকে সবাইকে বিদায় করে দেন। সহকর্মীদের শত অনুরোধেও তিনি বাড়ি ছাড়লেন না। বললেনঃ‘আমাকে না পেলে ওরা গোটা ঢাকা শহরের প্রতিটি বাড়িতে খুঁজবে। জ্বালিয়ে দেবে সব, নিরীহদের হত্যা করবে।’এ বক্তব্যের সমর্থন মেলে সেরাতে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অপারেশনের দায়িত্বে থাকা জেনারেল টিক্কা খানের কাছ থেকে। ১৯৭৬ সালে মুসা সাদিককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে টিক্কা বলেছিলেন :

I knew very well that a leader of his stature would never go away leaving behind his countrymen. I would have made a thorough search in every house and road in Dhaka to find out Sheikh Mujib. I had no intention to arrest leaders like Tajuddin and others. That is why they could leave Dhaka so easily.” Then Tikka Khan said more in a very firm voice, “in case we failed to arrest Sheik Mujib on that very night, my force would have inflicted a mortal blow at each home in Dhaka and elsewhere in Bangladesh. We probably would have killed crores of Bangalees in revenge on that night alone.


নিজের জীবন বাচাতে গিয়ে তাই কোটি বাঙ্গালীর জীবনে বিপদের মুখে টেলে দিতে চাননি তিনি। বরং সাহসের সাথে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়াটাই শ্রেয় মনে করলেন। তার স্ত্রীকে সন্তানদের সহ পার্শ্ববর্তী বাড়িতে আশ্রয় নিতে পাঠিয়ে দিয়ে ৩২ নম্বরের বাড়িতে একা হায়েনাদের আগমন প্রতিক্ষায় থাকেন। জাতিকে তিনি ঐক্য এনে দিয়েছেন। স্বাধিনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। মুক্তির পথে হাটতে শিখিয়েছেন। সকল সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এবার স্বাধীনতার জন্য সহযোদ্ধাদের তৈরী করে নিজে প্রথম প্রহরে আত্মদানের জন্য প্রস্তুত হলেন। সব সহকর্মীদের বিদায় দিয়ে সবশেষে বিশেষ নির্দেশনা দিয়ে ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে বিদায় দেন বঙ্গবন্ধু। রাত সাড়ে ১১টায় যখন তোফায়েল আহমেদ এবং শেখ মনি বঙ্গবন্ধুর কাছে যান তখন তিনি বাসার বারান্দায় একা পায়চারী করছেন। তোফায়েল আহমেদ এবং শেখ মনিকে দেখে তিনি তাদের বুকে টেনে নিলেন, আদর করে বললেন, ‘তোমরা আবার এসেছ।’ তোফায়েল আহমেদ তার স্মৃতিচারনায় লিখেন-'হাতে ৫ হাজার টাকা দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি, যাও।’ কোথায় গেলে কি পাব সে সব সংক্ষেপে বলে আমাদের কপালে চুমু দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের দোয়া করি। আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে। তোমাদের আমি যে দায়িত্ব দিয়েছি তা যথাযথভাবে পালন কর।’

গনহত্যার শুরুঃ
রাত ১১.৩০ মিনিটে শহরে আর্মি নামল। সে রাতের এক খুনী মেজর সিদ্দিক সালিকের ভাষায়, অপারেশন সার্চলাইট মনিটর করার জন্য ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের হেড কোয়ার্টার্স লনে জেনারেল আবদুল হামিদসহ সব উচ্চপদস্থ অফিসার সোফা এবং আরামকেদারা ফেলে প্রস্তুত হন সারারাত জেগে কাটানোর উদ্দেশ্যে। ‘আকাশে তারার মেলা। শহর গভীর ঘুমে নিমগ্ন। ঢাকার বসন্তের রাত যেমন চমৎকার হয়, তেমনি ছিল রাতটি। একমাত্র হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ সাধন ছাড়া অন্য সবকিছুর জন্যই পরিবেশটি ছিল চমৎকার’ (দ্র. সিদ্দিক সালিক, নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃ. ৮৪)।

পাকিস্থানী সেনাদের অগ্রযাত্রা টেকাতে হাতের কাছে যা ছিল তাই দিয়ে যে ভাবে পারা গেছে সেভাবেই আটকানো হয়েছে রাজপথ। রাস্তার পাশের গাছ কেটে দেয়া হয়েছে ব্যারিকেড। কোথাও রাস্তা খোড়া হয়েছে। কোথাও কোথাও ট্রাক ও নানা ধরণের যানবাহন উল্টিয়ে আটকানো হয়েছে রাস্তা। কোথাও কংক্রিটের পাইপ ফেলে রাখা হয়েছে, আবার কোথাও তিনফুট উচু ও চার ফিট পুরু করে ইট দিয়ে রোডব্লক বানানো হয়েছে। প্রতিটা সড়কের প্রত্যেকটা ব্যারিকেডে দেশীয় অস্ত্র শস্ত্র, দা, লাঠি, সড়কি, গাদা বন্দুক, একনলা, দুনলা ব্যাক্তিগত রাইফেল, ত্রিনট ত্রি আর হাতে করে বানানো কিছু মলোটভ ককটেল নিয়ে প্রতিরোধের জন্য তৈরী ছিল ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্রজনতারা। পাকিস্থানী বাহিনী ফার্মগেটের সামনে এলেই ব্যারিকেডের দ্বারা প্রথম বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ব্যারিকেড ঘিরে থাকা জয়বাংলা স্লোগানে মুখর ছাত্রজনতাকে হটানোর জন্য জিরো আওয়ারের অপেক্ষা না করেই রাত ১১.৩০ মিনিটে গোলাগুলি শুরু করে দেয়। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শুরু হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। যতটা সম্ভব প্রতিরোধের চেষ্টা করল ছাত্রজনতা। কিন্তু ৭৫ টি এম-২৪ শ্যাফে ট্যাংক, ২৫০ টি ভারি কামান, অসংখ্য মর্টার, অগুন্তি ভেহিকেলস সহ অত্যাধুনিক অস্ত্রে ২৩০০০ সজ্জ্বিত আর্মি তাদের কোন সুযোগ দিল না। ট্রেসার ফায়ার করে চারধার আলোকিত করে পাইকারি গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করা শুরু হল। প্রতিটা ব্যারিকেডের পাশের এই সব টুকটাক প্রতিরোধ দিয়ে শুরু হল হাজার বছর ধরে পরাধীন বাঙ্গালির মহান মুক্তির জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম। পুরো শহর গোলাগুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠল। কাউকে পালাতে দিচ্ছিল না ট্রেসারের আলো আর মেশিনগানের বুলেটের যুগল বন্দি। পাকিস্থানীদের সামান্য কিছু ক্ষয় ক্ষতি হলেও ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় প্রতিরোধের প্রথম প্রহরের সৈনিকদের লাশের পাহাড় জমতে লাগল। স্বাধীনতার বিপ্লবী যোদ্ধাদের রক্তের বন্যায় ভেসে যেতে লাগল ঢাকার রাজপথ। প্রতিরোধের আগুনে জ্বলে উঠল রাজারবাগ।

স্বাধীনতা ঘোষনাঃ
এ সময়েই মগবাজার হাই ফ্রিকোয়েন্সি ওয়ারলেস অফিসে শেখ মুজিবের স্বাক্ষর করা একটি কাগজ আসে। ওয়ারলেস অপারেটরকে দেয়া ঐ কাগজটিতে লেখা ছিলো,

This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until last soldier of Pakistani occupation army is expelled from the soil of Bangladesh final victory is achieved. Sheikh Mujibur Rahman.


ম্যাসেজটি ছড়িয়ে পড়ে ইথারে ইথারে সারা বাংলাদেশে। চট্টগ্রামে ফৌজদারহাট ওয়ারলেস অফিসের সুপারভাইজার মোঃ নুরুল আমিন ম্যাসেজটি রিসিভ করেন। এর পর পরই তিনি তার ছোট ভাই চট্টগ্রাম টিএন্ডটির সংগ্রাম পরিষদের মহাসচিব সে রাতে নন্দনকানন ওয়ারলেস অফিসে অপারেটরের ডিউটিরত মাহতাব উদ্দিনকে ম্যাসেজটি পাঠান। মাহতাবউদ্দিন ম্যাসেজটি সারা দেশের তত্কালীন ১৯ টি ডিষ্ট্রিক ওয়ারলেস অফিসে পাঠিয়ে দেন। যা সমগ্র দেশে প্রচারিত হয়। এরপর মগবাজার ওয়ারলেস থেকে ভোররাতে বঙ্গবন্ধুর নামে আরও একটি ওয়ারলেস ম্যাসেজ প্রচারিত হয়। নোয়াখালীর তত্কালীন ডিসি মনযুর উল করীম লিখেছেন, ভোর রাতে বেজে উঠল ফোন। একচেঞ্জ থেকে একই কথা ধ্বনিত হল রাতের মতো, স্যার WHR ম্যাসেজ এসেছে। তাড়াতাড়ি লিখে নিন। মনযুর উল করীম লিখলেন,

Pakistani occupation soldiers have attacked Rajarbagh Police Headquarters and Pilkana EPR Headquarters. They are killing thousands of innocent Bengalis on the streets of Dhaka. Every Bengali will resist the Pakistani soldiers at all cost with whatever he has. I appeal in the name of the peoples of Bangladesh to the people of world to come their rescue. Sheikh Mujibur Rahman.


এর পরদিন ঢাকাস্থঃ মার্কিন কনস্যুলেট অফিস ওয়াশিংটনে শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষনা সংক্রান্ত টেলেক্স বার্তা পাঠায়।


রক্তস্রোত আর আর্তনাদের শহরেঃ
যখন ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ২৫ মার্চ সকালের সময়ে পিলখানার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে নিল তখন বাঙালি ইপিআর অফিসারদের পাকিস্তানী অফিসাররা পিলখানায় ব্যস্ত রেখেছিল এবং সৈন্যদের প্রায় সবাইকে কাজ বন্ধ রেখে বিশ্রামে পাঠানো হয়। তারা বুঝতে পেরেছিলেন তাদের উপর আক্রমন আসছে। কিন্তু তারপরও শক্ত কোন প্রতিরক্ষা মূলক ব্যবস্থা গ্রহন তারা করতে পারেননি। ২৫ মার্চ রাত ১.৩০ মিনিটে ইপিআর এ হামলা চালায় ২২ বালুচ। কেন্দ্রীয় কোয়ার্টারে গার্ডে ১৮ জন বাঙালি জওয়ান থাকলেও তারা পাল্টা আক্রমণের সুযোগ পাননি। ২৫০০ ইপিআর সদস্যের বেশিরভাগ নিরস্ত্র এবং অসংগঠিত অবস্থায় ছিলেন। সৈন্যরা আক্রমণ করার পর তারা সারা রাত যুদ্ধ করে হার মানেন। নিহত হন অনেকেই।

রাত ১.৩০টায় আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ল রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। রাজারবাগে অবস্থানরত পুলিশেরা প্রথম পর্যায়ে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হন। পুলিশের বাঙালি সদস্যরা সেই প্রথম প্রহরের দুর্দান্ত সামরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তাদের সামান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনেক ক্ষতি স্বীকার করে পিছিয়ে গিয়ে ট্যাংক, মর্টার, ভারি অস্ত্র, মেশিনগান নিয়ে পালটা আক্রমণ করে শেষ পর্যন্ত রাজারবাগ পুলিশ লাইনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ট্যাংক আর কামানের গোলার বিরুদ্ধে সামান্য ত্রি নট ত্রি রাইফেলের লড়াইয়ে ধীরে ধীরে পুলিশের বীর যোদ্ধারা হার মানেন। চারপাশে জমে উঠে মুক্তির প্রথম প্রহরের সেনাদের গুলিবিদ্ধ লাশের মিছিল। যারা বেঁচে ছিলেন তাদের বেশিরভাগ ধরা পড়েন। অনেকে এদিক সেদিক পালিয়ে যান। কামান দেগে ধ্বংশ করে দেয়া হয় প্রতিটা ভবন। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় পুরো সদর দফতর।

১০ম বাঙালি রেজিমেন্টকে সেনানিবাসে সহজেই নিরস্ত্র এবং পরে প্রায় সবাইকে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করা হয়।পাকিস্তানি বর্বর সেনারা বাংলাদেশকে সশস্ত্র উপায়ে স্বাধীন করার উদ্যোক্তাদের অন্যতম কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্টকে ঢাকার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ন এলাকা এবং শহরের উত্তরাংশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়।

লে.কর্নেল জেড এ খান এবং মেজর বেলালের সাথে নিযুক্ত কমান্ডো বাহিনী অপারেশনের শুরুতেই রাত ১.০৫ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি ঘেরাও করে। তাদের সঙ্গী ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের দল পাশের একটি বাসায় ঢুকে দেয়াল টপকে নামলো মুজিবের আঙ্গিনায়। এসময় গোলাগুলিতে নিহত হয় একজন। বাড়ির বাইরে পুর্ব পাকিস্তান পুলিশের সদস্যরা গুলি করতে করতে তাদের ১৮০ পাউন্ড ওজনের তাবুতে ঢোকে, একপর্যায়ে সেগুলো খুটিসহ তুলে নিয়ে ঝাপ দেয় ধানমণ্ডির লেকে। সংলগ্ন এলাকার নিরাপদ দখল শেষ। ঘন কালো আধার চারদিকে। মুজিব ও তার প্রতিবেশী কারো বাসাতেই বাতি নেই।তল্লাশী চালানোর জন্য এরপর একটি দল ঢুকলো। গেটের সামনের প্রহরীদের গুলি করে মেরে ফেলা হল। জীবিত একজনকে বলা হলো রাস্তা দেখাতে। কিছুদূর যাওয়ার পর তার পাশে থাকা সৈন্যকে দা দিয়ে আক্রমণ করতে গিয়েছিলো সে, কিন্তু জানতো না তার উপর নজর রাখা হচ্ছে। তাকে গুলি করে আহত করা হয়। এরপর সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠলো সার্চপার্টি। একের পর এক দরজা খুলে কাউকে পাওয়া গেলো না। একটা রুম ভেতর থেকে আটকানো ছিলো।

এরপর গ্রেনেড বিস্ফোরন ও তার সাথে সাব-মেশিনগানের ব্রাশফায়ার। নিচে থেকে অফিসাররা ভেবেছিল কেউ হয়তো শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে। বাধা দেয়ার আগেই বারান্দার যেদিক থেকে গুলি এসেছিলো সেদিকে গ্রেনেড ছোড়ে একজন সৈনিক। এরপর সাবমেশিনগান চালায়। গ্রেনেডের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির আওয়াজে বদ্ধ সে রুমের ভেতর থেকে চিৎকার করে সাড়া দেন শেখ মুজিব। দুতলার একটি ঘর থেকে তারা বাঙ্গালীর স্বাধীনতার স্থপতি, অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। রাতভর গোলাগুলির মাঝে আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক তাজউদ্দিন, কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহ বেশিরভাগ বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা কৌশলে গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন এবং ২৯ মার্চের ভেতর শহর ত্যাগ করেন।

পাকিস্তানী বাহিনী কোন বাধা ছাড়াই সহজে মিরপুরে অবস্থানরত ইপিআর বাহিনীকে গ্রেফতার এবং রাষ্ট্রপতি ভবন ও গভর্নর হাউস দখল করে নিতে সক্ষম হয়, কিন্তু অনেকে পালাতে সক্ষম হয় এবং অনেকে মারা পড়ে।

এরপর তারা এগিয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। ১৮তম ও ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অনিয়মিত বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আক্রমণ চালায়, ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাসেবীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিরোধ প্রচেষ্টাকে ট্রেসার ফায়ার আর মেশিনগানের নির্বিচার গুলিতে উড়য়ে দিয়ে রাত বারটার পর ইউওটিসি এর দিকের দেয়াল ভেঙ্গে পাকবাহিনী ট্যাংক নিয়ে জগন্নাথ হলের মধ্যে প্রবেশ করে এবং প্রথমেই মর্টার ছোড়ে উত্তর বাড়ির দিকে। সাথে সাথে অজস্র গুলিবর্ষণ শুরু হয়। তারা ঢুকে পড়ে জগন্নাথ হলে। উত্তর ও দক্ষিন দিকে বাড়ির প্রতিটি কক্ষ অনুসন্ধান করে ছাত্রদের নির্বিচারে গুলি করে। সে রাতে জগন্নাথ হলে ৩৪ জন ছাত্র শহীদ হয়। জগন্নাথ হলের কিছু ছাত্র তখন রমনার কালী বাড়িতে থাকত। ফলে, প্রায় ৫/৬ জন ছাত্র সে রাতে সেখানে নিহত হয়। এদের মধ্যে শুধু অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র রমনীমোহন ভট্টাচার্য ব্যতীত অন্যদের নাম জানা যায় না। এছাড়া বহু সংখ্যাক অতিথিও নিহত হয় এদের মধ্যে ভৈরব কলেজের হেলাল, বাজিতপুর কলেজের বাবুল পাল, জগন্নাথ কলেজের বদরুদ্দোজা, নেত্রকোনার জীবন সরকার, মোস্তাক, বাচ্চু ও অমরের নাম জানা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষককেও হত্যা করা হয় সে রাতে। প্রথম আক্রমন হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ নং নীলক্ষেত আবাসিকের বাড়িতে। সেখানে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফজলুর রহমানকে তার দুই আত্মীয় সহ হত্যা করা হয়। মিসেস ফজলুর রহমান দেশে না থাকায় প্রানে বেচে যান। পাক বাহিনী অধ্যাপক আনোয়ার পাশা (বাংলা) ও অধ্যাপক রাশিদুল হাসানের (ইংরেজী) বাড়িতেও প্রবেশ করে। উভয় পরিবার খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলেন। ঘরে ঢুকে টর্চের আলো ফেলে তাদের কাউকে না দেখে হানাদাররা চলে যায়। যাবার সময় বলতে শোনা যায়, “বাঙালি কুত্তা ভাগ গিয়া”। উভয় অধ্যাপক সে রাত্রে বেচে গেলেও, মুক্তিযুদ্ধের শেষে তারা আলবদর বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে পারেননি, বাড়ি পরিবর্তন করেও। ২৪ নং বাড়িতে থাকতেন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম (নজরুল গবেষক ও বাংলা একাডেমীর সাবেক পরিচালক)। সেই বাড়ির নিচে দুপায়ে গুলিবিদ্ধ দুই মা তাদের শিশু সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। সিড়ি ভেসে যাচ্ছিল তাদের রক্তে। পাক পশুরা ভেবেছিল, অন্য কোন দল হয়ত অপারেশন শেষ করে গেছে তাই তারা আর ঐ বাড়িতে ঢোকেনি। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তখন প্রানে বেচে যান। ঐ বাড়িরই নিচ তালায় থাকতেন, এক অবাঙালি অধ্যাপক। পঁচিশে মার্চের আগেই সেই ব্যক্তি কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার সব অবাঙালি পরিবার তাই করেছিলেন।


ফুলার রোডের ১২ নং বাড়িতে হানা দিয়ে হানাদাররা নামিয়ে নিয়ে যায় অধ্যাপক সৈয়দ আলী নকিকে (সমাজ বিজ্ঞান)। তাকে গুলি করতে গিয়েও, পরে তাকে ছেড়ে দেয় এবং উপরের তলার ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ মুকতাদিরকে গুলি করে নিষ্টুর ভাবে হত্যা করে। ২৭ মার্চ অধ্যাপক মুকতাদিরের লাশ পাওয়া যায় ইকবাল হলে (বর্তমান জহুরুল হক হল), তাকে পরে পল্টনে এক আত্মীয়ের বাড়িতে দাফন করা হয়। সলিমুল্লাহ হল এবং ঢাকা হলে (বর্তমান শহীদুল্লাহ্‌ হল) হানা দিয়ে সলিমুল্লাহ হলের হাউস টিউটর ইংরেজীর অধ্যাপক কে এম মুনিমকে তারা প্রহার করে এবং ঢাকা হলে হত্যা করে গণিতের অধ্যাপক এ আর খান খাদিম আর অধ্যাপক শরাফত আলীকে। জগন্নাথ হলের মাঠের শেষ প্রান্তে অধ্যাপকদের বাংলোতে ঢুকে তারা অর্থনীতির অধ্যাপক মীর্জা হুদা এবং শহীদ মিনার এলাকায় ইতিহাসের অধ্যাপক মফিজুল্লাহ কবীরের বাড়িতে ঢুকে তাদের নাজেহাল করে।

জগন্নাথ হলে হামলা করার সময় আক্রান্ত হয় হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবের বাস ভবন। পাক হানাদাররা হত্যা করে অধ্যাপক দেব এবং তার পালিত মুসলমান কন্যা রোকেয়ার স্বামীকে। পরে জগন্নাথ হল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টার, সেখানে হত্যা করা হয় পরিসংখ্যানের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান তার পুত্র ও আত্মীয়সহ। পাকিস্থানিদের আক্রমনে মারাত্বক আহত হন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। পরে তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী চিৎবালী ও জনৈকা রাজকুমারী দেবী তথ্য প্রদান করেন যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা চিনতে পেরে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে মর্গের কাছে গাছের নিচে খুব অল্প পরিসরে চিরদিনের জন্য শুইয়ে রেখেছেন। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান ও অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে পাশাপাশি দাড় করিয়ে গুলি করা হয়। জগন্নাথ হলে আরো নিহত হন হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য।

৩৪ নং বাড়িতে অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের লাশের পাশে মোট পাঁচটি দেহ পড়েছিল। এরই মাঝে একজন হিন্দু অধ্যাপক কাতরাচ্ছিলেন। বেগম মনিরুজ্জামান তার মুখে চামচ দিয়ে পানি দেন। বেগম মনিরুজ্জামান পর্দানশীল মহিলা ছিলেন, কখনো অন্য পুরুষের সামনে যেতেন না। কিন্তু, মৃতপ্রায় সেই হিন্দু অধ্যাপকের মুখে পানি দিতে দ্বিধা করেননি। ঠিক সেই সময়, দেখতে পারেন তার নিজ ছেলেটি তাকাচ্ছে এখনও। মাকে দেখে তার চোখ দুটো একটু বড় হল শুধু। তারপরেই সে চোখ বন্ধ করল আর তা খোলেনি কখনো। বেগম মনিরুজ্জামান তাড়াতাড়ি এক চামচ পানি দিয়েছিলেন ছেলের মুখে; কিন্তু খেতে পারেননি। যে হিন্দু অধ্যাপক তখনও বেচেছিলেন, বেগম মনিরুজ্জামান তার ফ্লাটের কপাটে ধাক্কা দিয়ে তার স্ত্রীকে বলেন, “দিদি বের হন। আপনার সাহেবকে ঘরে নিন। আমার সাহেব মারা গেছেন। আপনার সাহেব বেঁচে আছেন”। এ তথ্য পাওয়া যায় শহীদ বুদ্ধিজীবী বাংলার অধ্যাপক আনোয়ার পাশার মার্চ থেকে ডিসেম্বর নাগাদ লেখা আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ গ্রন্থে।


১৯৭১ সালের মার্চে ঢাকার মার্কিন কনসাল আর্চার কে ব্লাডের লেখা গ্রন্থ, “দি ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ” থেকে জানা যায় সে রাতে রোকেয়া হলে আগুন ধরানো হয়েছিল এবং ছাত্রীরা হল থেকে দৌড়ে বের হবার সময় মেশিন গান দিয়ে গুলি করা হয়। সে রাতেই রোকেয়া হলের মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হলো ক্যান্টনমেন্টে। আর ফিরেনি তারা। কামানের গোলা ফেলা হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে। উড়িয়ে দেয়া হলো শহীদ মিনার। পথের পাশের বস্তিবাসীও রক্ষা পেল না গণহত্যা থেকে।ফ্লেম থ্রোয়ার দিয়ে যত্রতত্র ধরিয়ে দেওয়া হলো আগুন।বস্তির পর বস্তি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো।

ইকবাল হল (জহুরুল হক হল) আক্রমনকারী বাহিনী ব্রিটিশ কাউন্সিল প্রহরারত ইপিআর সদস্যদের পৈশাচিকভাবে হত্যা করে। তারা শিক্ষকদের ক্লাব লাউঞ্জে আশ্রয়গ্রহণকারী ক্লাব কর্মচারী সিরাজুল হক, আলী হোসেন, সোহরাব আলি গাজী এবং আবদুল মজিদকে হত্যা করে। টিএসসিতে নিহত কর্মচারীরা ছিলেন আবদুস সামাদ, আবদুস শহীদ, লাড্ডু লাল। রোকেয়া হল চত্তরে নিহত হন আহমদ আলী, আবদুল খালেক, নমী, মো: সোলায়মান খান, মোঃ নুরুল ইসলাম্, মোঃ হাফিজউদ্দিন, মোঃ চুন্নু মিয়া এবং তাদের পরিবার পরিজন।

যে বাহিনী শহীদ মিনার ও বাংলা একাডেমী আক্রমন করে তারাই ঢাকা হল (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) সংলগ্ন শিক্ষকদের আবাসে ও মধুসূদন দে’র বাড়িতে হামলা চালায়। সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ নং বাড়ির বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেককে হত্যা করে। ২৩ নং নীলক্ষেত আবাসের ছাদে আশ্রয়গ্রহণকারী নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি পুলিশ কর্মচারী, প্রেসিডেন্ট হাউস (পুরাতন গনভবন) প্রহরারত বাঙালি ইপিআর সদস্য এবং নীলক্ষেত রেল সড়ক বস্তি থেকে আগত প্রায় ৫০ জনকে সৈন্যরা হত্যা করে লাশ ফেলে যায়। ২৫ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে তিনটি ধর্মস্থান ধ্বংস ও ঐ সব স্থানে হত্যা যজ্ঞ চালায়। তিনটি স্থান ছিল, কলা ভবন সংলগ্ন শিখ গুরুদ্বার, রমনার মাঠে দুটি কালি মন্দির এবং শহীদ মিনারের বিপরীত দিকে অবস্থিত শিব মন্দির। সে রাতে আরো নিহত হয় দর্শন বিভাগের কর্মচারী খগেন দে, তার পুত্র মতিলাল দে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সুশীল চন্দ্র দে, বোধিরাম, দাক্ষুরাম, ভীমরায়, মনিরাম, জহরলালা রাজভর, মনভরন রায়, মিস্ত্রি রাজভর, শংকর কুরী।( ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর – অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা আক্রমণ পরিচালনা করেছিল, তাদের সঙ্গে হেডকোয়ার্টারের ওয়্যারলেসে কী কথপোকথন হয়েছিল, সেটা একটু জানিয়ে দেওয়া যাক।

৮৮ শীর্ষক সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত ইউনিটকে কন্ট্রোলরুম বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিকার হলো কত? চোখে যা দেখেছ, তাতে কত আন্দাজ হয়? কত খতম, জখম বা বন্দী? ওভার।’
‘মনে হয় শ তিনেক। ওভার।’
‘বাহ! বেশ! তিন শ খতম? না বন্দী? জখম? ওভার।’
এবার শীতল কণ্ঠে জবাব আসে, ‘না, না, একেবারে সাফ। খতম। ওভার।’
‘খাসা। খাসা। খুব ভালো কাজ। চালিয়ে যাও, কোনো পরোয়া কোরো না। তোমার কাছে কৈফিয়ত চাইবার কেউ নেই। আবারও বলছি, যা করছ—জবাব নেই। সাবাস। বড় খোশ খবর। ওভার।’
পরিকল্পিতভাবে চালানো এই অপারেশনের নির্মমতা এই কথোপকথন থেকে আন্দাজ করা যায়।

২৬ মার্চ ভোরের দিকে ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট হিন্দু এলাকা শাঁখারী বাজারসহ এবং পুরান ঢাকা আক্রমণ করে। দাউ দাউ আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল নয়া বাজার। সাঁজোয়া গাড়ি হামলা চালাল পুরান ঢাকার অলিতেগলিতে। মানুষের আর্ত আহাজারি আর গুলির শব্দে উচ্চকিত হয়ে উঠল আকাশ। লাশের সারিতে জমে উঠল সড়কের আনাচে কানাচ।

রাতব্যাপী চলা এই অপারেশনের সময় পাকিস্তানী সেনারা যথেচ্ছ ভাবে কামান এবং সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে। বিভিন্ন এলাকাতে যথেচ্ছ হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ করে চলে তারা। সারা শহরে হত্যা করে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে। রিকশাওয়ালা, ভিখারি, শিশু, ফুটপাতবাসী কেউই তাদের ভয়াল থাবা থেকে রেহাই পায়নি। প্রাণভয়ে পলায়নপর আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে ব্রাশফায়ারে পাখির মতো হত্যা করা হয়। ২৬ মার্চের ভোরের মধ্যে পূর্বাঞ্চলের সাবেক রাজধানী সদ্য ঘোষিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান শহর ঢাকা পরিণত হল মৃত মানুষের শহরে। পাকিস্থানীসেনাদের দখলে চলে গেল শহর এবং শহরব্যাপি কারফিউ জারি করা হয়। বেঁচে যাওয়া আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী, স্বেচ্চাসেবী, অজস্র সাধারন মানুষ, পুলিশ আর ইপিআর সেনারা শহর ছেড়ে পালিযে যায়, কেউ কেউ বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে জিঞ্জিরায় জমায়েত হয়। ২৬ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকায় তারপরও অনিয়মিত আক্রমণ চলতে থাকে। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের নেতাদের গ্রেফতার করতে না পারা ছাড়া সার্বিক অপারেশনের অন্যান্য সব লক্ষ্য অর্জিত হয়। এছাড়া পাকিস্তানী সেনারা শহীদ মিনার, দৈনিক ইত্তেফাক কার্যালয়, ডেইলি পিপল কার্যালয় এবং রমনার কালী মন্দির ধ্বংস করে দেয়। মিরপুর, মোহাম্মদপুরের বিহারিরা নিজেদের বাঙালি প্রতিবেশীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো হিংস্র উল্লাসে। ২৬ মার্চের সূর্য উঠলে দেখা গেল ঢাকা শহরজুড়ে নিরীহ মানুষের লাশ ও ভস্মীভূত ঘরবাড়ি।

২৭শে মার্চ কারফিউ উঠে যাবার পর পাকিস্থানি সেনারা শহর পরিস্কার করার জন্য ঢাকা পৌরসভার সুইপার আর ডোমদের ধরে নিয়ে আসে। ১৯৭৭ সালে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের প্রকাশের কাজ শুরু হলে তখন মুসা সাদিক তাদের সাক্ষাতকার গ্রহন করেন। ডোমরা জানায় অকল্পনীয় সে বর্বরতার কিছু চিত্র।

চুন্ন ডোম : "১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ সকালে ঢাকার পৌরসভার সুইপার ইন্সপেক্টর ইদ্রিস সাহেব রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ উঠাবার জন্য আমাকে ডেকে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে দেখি, বদলু ডোম, রঞ্জিত ডোম (লাল বাহাদুর), গণেশ ডোম ও কানাই ডোম আগে থেকে সেখানে আছে। আমাদের একটি ট্রাকে করে প্রথমে শাঁখারী বাজারের কোর্টের প্রবেশ পথের সামনে নামিয়ে দেয়। ঢাকা জজ কোর্টের দক্ষিণ দিকে ঢোকার মুখে যে পথ শাঁখারী বাজারের দিকে চলে গেছে সেখানে গিয়ে পথের দু'ধারে ড্রেনের পাশে যুবক-যুবতীর, নারী-পুরুষের, শিশু-কিশোরের বহু পচা লাশ দেখতে পেলাম। তার মধ্যে বহু লাশ পচে, ফুলে বীভৎস হয়ে গেছে। দেখলাম শাঁখারী বাজারের দু'দিকের ঘরবাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। অনেক লোকের অর্ধপোড়া লাশ চারদিকে পড়ে আছে দেখলাম। কাছাকাছি সশস্ত্র পাঞ্জাবী সৈন্যদের পাহারায় মোতায়েন দেখলাম। প্রত্যেক ঘরে দেখলাম মৃত নর-নারী-শিশু জ্বলছে, আসবাবপত্র জ্বলছে। একটি ঘরে প্রবেশ করে একজন মেয়ে, একজন শিশুসহ বারজন যুবকের দগ্ধ লাশ উঠিয়েছে। সেই অবস্থার মধ্যে আমরা সবাই মিলে শাঁখারী বাজারের প্রতিটি ঘর থেকে যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা, শিশু-কিশোর ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধার লাশ তুলেছি। পাঞ্জাবী সৈনিকরা সেখানে থাকা অবস্থায় সেই সব অসংখ্য লাশের উপর বিহারীদের আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে লুট করতে দেখলাম। প্রতি ঘর থেকে বিহারীরা মূল্যবান সামগ্রী, সোনাদানা সবকিছু লুট করে নিয়ে যাচ্ছে দেখলাম।"
চুন্ন ডোম এখানে মর্মস্পর্শী ঘটনার মুখোমুখি হয়। সে কথা উল্লেখ করে বলেন : "শাঁখারী বাজারে সারাদিন ধরে অসংখ্য লাশ উঠাতে উঠাতে হঠাৎ এক ঘরে প্রবেশ করে এক আহত অসহায় বৃদ্ধাকে দেখলাম। বৃদ্ধা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে 'পানি পানি' বলে চিৎকার করছিল। তাকে আমি পানি দিতে চেয়েও দিতে পারিনি। আমি পানি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের পিছনে সশস্ত্র পাঞ্জাবী সেনা পাহারায় থাকায় সেই বৃদ্ধাকে পানি দিয়ে সাহায্য করতে পারিনি।"

এই সব লাশ নিয়ে তারা কি করেছে জানতে চাইলে চুন্ন ডোম বলেন: "আমরা নির্দেশ মত ২৮ মার্চ শাঁখারী বাজার থেকে প্রতিবার এক/ দেড়শ' লাশ উঠিয়ে তিনবার ট্রাক বোঝাই করে তিনশ' লাশ ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ সকাল থেকে আমরা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ ঘর ও প্রবেশ পথের দু'পাশ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা কালীবাড়ী, শিববাড়ী, রোকেয়া হল, মুসলিম হল, ঢাকা হল থেকে শত শত লাশ উঠিয়েছি।" মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে লাশ তোলার লোমহর্ষক ও হৃদয় বিদারক দৃশ্য তুলে ধরে চুন্ন ডোম বলে: "২৯ মার্চ আমাদের ট্রাক প্রথম ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে যায়। আমরা উক্ত পাঁচজন ডোম মিলে হাসপাতালের প্রবেশ পথে নেমে কয়েকজন বাঙালি যুবক ও যুবতীর পচা, ফোলা, বিকৃত লাশ দেখতে পেলাম। গলে যাওয়ায় লোহার কাঁটার সঙ্গে গেঁথে লাশ ট্রাকে তুলতে হয়েছে। ইন্সপেক্টর সাহেব পঞ্চম আমাদের সঙ্গে ছিলেন। সেখান থেকে আমরা লাশ ঘরে প্রবেশ করে বহু যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কিশোর ও শিশুর স্তূপীকৃত লাশ দেখলাম। সে যেন লাশের পাহাড়। আমি এবং বদলু ডোম লাশ ঘর থেকে লাশের পা ধরে টেনে ট্রাকের সামনে জমা করেছি। আর রঞ্জিত (লাল বাহাদুর), কানাই ও গণেশ ডোম কাঁটা দিয়ে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে পচা, গলিত লাশ ট্রাকে তুলেছে। সেখানকার প্রতিটি লাশ শত শত গুলিতে ঝাঁঝরা অবস্থায় পেয়েছি। মেয়েদের লাশের কারও স্তন পাইনি। মেয়েদের লাশের যোনিপথ ক্ষত-বিক্ষত এবং পিছনের মাংস কেটে নেয়া অবস্থায় দেখেছি। মেয়েদের লাশ দেখে মনে হয়েছে, হত্যা করার আগে তাদের স্তন ধারালো ছোরা দিয়ে কেটে তুলে নেয়া হয়েছে। মেয়েদের যোনিপথে লোহার রড কিংবা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। যুবতী মেয়েদের যোনিপথের এবং পিছনের মাংস যেন ধারালো চাকু দিয়ে কেটে এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি যুবতী মেয়ের মাথায় খোঁপা চুল দেখলাম। তাদের সুন্দর মুখগুলো দেখে খুব কষ্ট পেলাম বুকে। এই সুন্দর সুন্দর মেয়েদের বাবা-মা কোনদিন এদের মুখ আর দেখতে পাবে না মনে করে খুব কষ্ট হলো। মিটফোর্ড থেকে আমরা প্রতিবার এক/ দেড়শ' লাশ নিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি।"

পরদেশী ডোম বলল: "১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সকালে রাজধানী ঢাকায় পাক সেনাদের গণহত্যার পর ঢাকা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মেজর সালামত আলি খান শুর, প্রশাসনিক অফিসার ইদ্রিস আরও কয়েকজন অফিসার সঙ্গে নিয়ে একটি ট্রাকে করে পশু হাসপাতালের গেটে এসে চিৎকার করে আমার নাম 'পরদেশী, পরদেশী' বলে ডাকাডাকি করতে থাকে। আমি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আমার পশু হাসপাতাল কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে আসি। ইদ্রিস সাহেব খুব ক্ষেপা স্বরে বলতে থাকেন, "তোমরা সব ডোম ও সুইপার বের হও। যদি বাঁচতে চাও এক্ষুণি সবাই মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্তূপীকৃত লাশ উঠিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলে দাও। নইলে কেউ বাঁচতে পারবে না। পাক আর্মির হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না।"

পৌরসভার ওই লোকগুলো ছিল আর্মির লোক, একথা বলে পরদেশী ডোম বলল: "পৌরসভার সেই ট্রাকে আগে থেকে সুইপার লাডু, কিষণ ও ভরত বসা ছিল। তার নির্দেশ অমান্য করার কোন উপায় না দেখে ট্রাকে উঠে বসলাম। সেই ট্রাকে করে ঢাকা পৌরসভা অফিসে গিয়ে আমাদের প্রায় আঠার জন সুইপার ও ডোমকে একত্রিত করা হল। সেখানে ছয়জনের সঙ্গে দু'জন করে সুইপার ইন্সপেক্টরকে আমাদের সুপারভাইজার নিয়োগ করে তিন ট্রাকে ভাগ করে তিন দলকে মিটফোর্ড, বাংলাবাজার ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রেরণ করা হয়। আমি মিটফোর্ডগামী ট্রাকে ছিলাম।"

"আমাদের ট্রাক সকাল ন'টার সময় মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ ঘরের সামনে উপস্থিত হলে আমরা ট্রাক থেকে নেমে লাশ ঘরে ঢুকি। লাশ ঘরে লাশের উপর লাশের পাহাড় দেখে ভড়কে যাই। সব লাশের বুক এবং পিঠ মেশিন গানের গুলিতে ঝাঁঝরা। প্রায় এক/ দেড়শ' যুবক-যুবতী ও ছাত্র-ছাত্রীর বীভৎস লাশ দেখে গা ছমছম করে উঠল। আমার সুপারভাইজারের নির্দেশে আমি লাশ ঘরের ভিতরে গিয়ে প্রতি লাশের পা ধরে টেনে বের করে আনতে পারলাম। বাইরে দাঁড়ানো অন্যান্য সুইপার লাশগুলো দাঁড়ানো ট্রাকে উঠিয়েছে। আমি ও আমার সঙ্গীরা দেখলাম যে, প্রতি লাশের বুক ও পিঠ মেশিন গানের শত শত গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। বহু মা, বোন ও শিশুর লাশ এভাবে তোলার পর একটি উলঙ্গ লাশ তুলতে গিয়ে কেঁদে ফেললাম।"

"পরের দিন ২৯ মার্চ সকালে আবার পৌরসভা অফিসে ডিউটিতে গেলাম। আমাকে ট্রাক দিয়ে লাশ তোলার জন্য আরও কয়েকজন সুইপারের সঙ্গে যেতে বলা হল শাঁখারী বাজারে। জজ কোর্টের সামনে আগুনের শিখা তখনও দাউ দাউ করে জ্বলছিল। তার চারদিকে পাক সেনারা টহলে মোতায়েন ছিল। সে জন্য ট্রাক নিয়ে সে পথ দিয়ে শাঁখারী বাজারে যেতে পারিনি। পাটুয়াটুলী ঘুরে আমরা শাঁখারী বাজারের পশ্চিম দিক দিয়ে পাটুয়াটুলী পুলিশ ফাঁড়ি পার হয়ে শাঁখারী বাজারের ভিতরে যেতে পারি। সেখানে ট্রাক থেকে নেমে আমরা শাঁখারী বাজারের ঘরে ঘরে গেলাম। প্রতিটি ঘরে দেখলাম মানুষের লাশ। নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বালক-বালিকা, শিশু-কিশোরের গুলীবিদ্ধ বীভৎস পচা লাশ। মেয়েদের অধিকাংশ লাশ সম্পূর্ণ উলঙ্গ পড়ে আছে দেখলাম। অন্যান্য স্থানের মত এখানেও দেখলাম তাদের বুক থেকে স্তন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে তুলে নেয়া। আমরা উলঙ্গ সুন্দরী তরুণীদের পাছার ও উরুর মাংসও খাবলা খাবলা করে কেটে নেয়া অবস্থায় দেখলাম। ফুলের মত সুন্দরী কিশোরী ও তরুণীদের মুখ ও ঠোঁট পশুর মত দাঁত দিয়ে কামড়ানো দেখলাম। কারও কারও যোনিপথে লাঠি ঢুকানো দেখলাম। বহু পোড়া, ভস্ম লাশ সেখানে দেখলাম। বাইরে সড়কে পাঞ্জাবী সেনারা পাগলা কুকুরের মত লাফাতে লাফাতে গুলিবর্ষণ করছিল। বিহারীরা দলে দলে শাঁখারী বাজারের ঘরে ঘরে প্রবেশ করে মূল্যবান আসবাবপত্র, সোনাদানা লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল। অবিরাম গুলীবর্ষণের মুখে আমরা সকলে প্রাণের ভয়ে দুই ট্রাক লাশ তোলার পর লাশ তোলার জন্য সেদিন আর শাঁখারী বাজারে যেতে সাহস পাইনি।"

সরকারী পশু হাসপাতালের সুইপার পরদেশী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে লাশ তোলার বিষয়ে তার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বললেন, "আমি যেদিন (সম্ভবত ২৭ মার্চ) কালীবাড়ী থেকে লাশ তুলেছি, সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের পিছনের স্টাফ কোয়ার্টার থেকে এবং রোকেয়া হলের পশ্চিম দিকে জনৈক প্রফেসরের বাসা থেকে কয়েকটি লাশ তুলেছি। আমার মনে আছে যে, রোকেয়া হলের পিছনের স্টাফ কোয়ার্টারের ভিতর দিয়ে গিয়ে পুরুষ, নারী ও শিশুর মোট নয়টি লাশ তুলেছি। আর প্রফেসরের বাসা থেকে সিঁড়ির সামনে লেপের ভিতর প্যাঁচানো অবস্থায় এক প্রফেসরের দুই হাত কব্জি থেকে কাটা লাশ আমি তুলে নিয়ে গেছি।"

গণহত্যার লক্ষ্যঃ
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত সেই গণহত্যার লক্ষ্য ছিল কারা? মূলত পাঁচ ধরনের মানুষকে গণহত্যার মূল লক্ষ্য বানিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তাঁরা হলেন:
ক) ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী ও বাঙালিদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা।
খ) সামরিক বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক ও কর্মকর্তা, আধা সামরিক বাহিনী ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) বাঙালি সৈনিক, আনসার বাহিনী ও পুলিশের বাঙালি চাকুরেরা।
গ) হিন্দুধর্মাবলম্বী বাঙালিরা।
ঘ) স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কিশোর ও তরুণেরা, যারা বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ শিক্ষিত প্রজন্ম এবং সর্বোপরি
ঙ) বাঙালি জাতির শিক্ষিত ও নেতৃত্বস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা, যাঁরা মননে ও চিন্তায় বাঙালি জাতির পথপ্রদর্শক ও বিবেক হিসেবে সুপরিচিত। পাকিস্তানিরা জানত, এই পাঁচ শ্রেণীকে নিশ্চিহ্ন করতে পারলেই আগামী কয়েকটি প্রজন্মের জন্য বাঙালিকে পঙ্গু করে দেওয়া সম্ভব। (সূত্র: অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের দ্য রেপ অব বাংলাদেশ )।


বিদেশীদের সাক্ষ্যঃ
বিদেশী যে সকল সাংবাদিক ছিলেন তাদের সবাইকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে(হোটেল শেরাটন/রুপসী বাংলা)আটকে দেয়া হয়েছিল। হোটেলের জানালা দিয়ে তারা দেখলেন সে রাতের বিভীষিকা।

২৮ শে মার্চ ১৯৭১ নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখল সে কালো রাতের গল্প। সামরিক অভিযান শুরু। ১০ হাজার মানুষ নিহত। ২৯ তারিখে দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড লিখল পূর্ব পাকিস্থানে সেনা অভিযানে ১০০০০ থেকে ১,০০,০০০ মানুষ হত। কিন্তু নমাস ব্যাপী চলা বিশ শতকের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম গনহত্যার সেটা ছিল শুরু মাত্র।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের হত্যাযজ্ঞের সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমানে শেরাটন) এ ছিলেন নিউয়র্ক টাইমস এর সাংবাদিক সিডনি শনবার্গ। ডেটলাইন বাংলাদেশ নাইন্টিন সেভেন্টি ওয়ান নামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি বর্ণনা দিলেন সে রাতের কিছু চিত্রঃ

ঘরে ঘরে অগ্নিসংযোগ

সামরিক ট্রাকের বহরে কঠোর পাহারায় বিমানবন্দরের দিকে যেতে যেতে সাংবাদিকরা দেখেছিলেন সৈন্যরা গরীব বাঙ্গালীদের আবাস রাস্তার ধারের বস্তিগুলোতে আগুন জ্বালাচ্ছিল। স্বশাসনের আন্দোলনের দৃঢ় সমর্থকদের মধ্যে রয়েছে এই বস্তিবাসী বাঙ্গালি।
বৃহস্পতিবার রাতে সামরিক অভিযানের শুরু থেকে সৈন্যরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় “জিন্দাবাদ” ধ্বনি দিয়ে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, মেশিনগান ও রিকয়েলেস রাইফেলে প্রথমে দালানকোঠায় গোলাগুলি ছোঁড়ে ওপরে গোটা অঞ্চলে আগুন লাগিয়ে দেয়।
বিদেশি সাংবাদিকরা সকলেই অবস্থান করছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। কী ঘটছে বোঝার জন্য বাইরে যেতে চাইলে ব্যাপকভাবে মোতায়নকৃত সেনাবাহিনী তাদের জোর করে ভেতরে ঠেলে দেয় এবং বলে ভবনের বাইরে পা বাড়ানোর চেষ্টা নিলে তাঁদের গুলি করা হবে।
হোটেলের আশেপাশে গোলাগুলি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রাত একটার দিকে গোটা শহরেই গুলি বর্ষণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।
১ টা ২৫ মিনিটে বাইরের মিলিটারি গার্ডদের হুকুমে হোটেলের টেলিফোন লাইন কেটে দেওয়া হয়। একই সময়ে টেলিগ্রাফ টাওয়ারের বাতি নিভে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভারি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে।

বাজার আক্রমণ

রাত ২-১৫ মিনিটে মেশিনগান বসানো একটি জিপগাড়ি হোটেলের সামনে দিয়ে ময়মনসিংহ রোডে ওঠে এবং শপিং সেন্টারের সামনে থেমে দোতলায় জানালার দিকে নিশানা করে। এক ডজন সৈন্য পায়ে হেটে জিপের পিছু পিছু অবস্থান নেয়। তাদের কারো কারো কাঁধে রকেট জাতীয় অস্ত্র।
দোতলা থেকে চিত্কার ভেসে আসে, “বীর বাঙ্গালি এক হও” এবং সৈন্যরা ঝাঁকে ঝাঁকে মেশিনগানের এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণে ভবনটি বিধ্বস্থ হয়ে যায়। এরপর সৈন্যরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে শপিং সেন্টারের পাশের গলিতে ঢোকে এবং পথ-আটকে-রাখা গাড়িগুলো উলটে ফেলে দেয়। সৈন্যদের হাতের টর্চের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিল এইসব দৃশ্য এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনালের একাদশ-তলা থেকে দর্শনরত সাংবাদিকদের কাছে এসব ছিল এক অবিশ্বাস্য নাটক।

সৈনিকরা যখন গলির ভেতরে গুলি ছুঁড়ছিল তখন প্রায় ২০০ গজ দূরে থেকে ১৫-২০ জন বাংগালি তরুণের একটি দল তাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। তারা সৈন্যদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল, তবে মনে হচ্ছিল তারা নিরস্ত্র, তাদের কারো হাতে কিছু নেই।

জিপের ওপরের মেশিনগানের নিশানা ঘুরে গেল তাদের দিকে এবং শুরু হলো একটানা গুলিবর্ষণ। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সজ্জিত সৈন্যরাও যোগ দিল সাথে। দুইপাশের ছায়াময় অন্ধকারে সটকে পড়লো বাঙ্গালী তরুণেরা। কেউ আহত নিহত হলো কিনা এখান থেকে তা ঠাহর করা অসম্ভব।
এরপর সৈন্যরা আবার গলির দিকে দৃষ্টি ফেরালো। একটি গ্যারেজে আগুন লাগিয়ে এগিয়ে গেল। দৃশ্যত তাদের মূল লক্ষ্য, সেনাবাহিনীকে কটাক্ষকারী শেখ মুজিবের কড়া সমর্থক ইংরেজি পত্রিকা দি পিপল এর দপ্তর ও ছাপাখানা।

পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাষা উর্দুতে চিত্কার করে তারা ভেতরের লোকদের আত্মসমর্পণ নয়তো হত্যার হুমকি দিল। কোন জবাব মিললো না, ভেতর থেকে কেউ বের হয়েও এলো না। এরপর সৈন্যরা ভবনের দিকে তাক করে রকেট ছুঁড়ে মারলো এবং মেশিনগান ও হালকা অস্ত্রদিয়ে গোলাগুলি শুরু করলো। তারপর প্রেস ও যন্ত্রপাতি ভাংচুর করে ভবনে আগুন লাগিয়ে দিল।
আবার ভেতরে এগিয়ে গিয়ে গলিতে যে সব দোকান আর ঝুপড়ি ছিল তাতে অগ্নিসংযোগ করলো তারা এবং দ্রুতই আগুনের শিখা দোতলা ভবনের মাথা ছাপিয়ে উঠলো।

রাত চারটার পর আর্তচিত্কার কিছুটা থিতিয়ে পড়লো, তবে কামান ও মেশিনগানের গোলাগুলি বর্ষণের বিক্ষিপ্ত আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। অনেক দূর থেকে ছোড়া ট্রেসার বুলেট হোটেলের পাশ দিয়ে সরে যাচ্ছিল।
৪-৪৫ মিনিটে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর হেড কোয়ার্টারের দিকে আরেকটি বড় অগ্নিকান্ড দেখা গেল।
৫-৪৫ এর দিকে সকালের ধূসর আলোয় ছটি চীনা টি-৫১ ট্যাঙ্কে সওয়ারি সৈন্যরা ঘর্ঘর করে শহরের দিকে এগিয়ে গিয়ে রাস্তায় রাস্তায় টহল শুরু করলো।
গতকাল সারাদিন এবং আজ সকালে সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্থান থেকে বহিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত থেকে থেকে অগ্নিসংযোগ আর গোলাবর্ষণ চলছিল।
গতকাল সকালে মাথার উপরে হেলিকপ্টার চক্কর দিয়েছে, নিশ্চিতই তদারকির কাজে। গত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণকাজের জন্য সৌদি আরব থেকে যে চারটি হেলিকাপ্টার পাকিস্তানকে দিয়েছিল, এই সামরিক অভিযানে সেগুলো ব্যবহৃত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে

সেনাবাহিনীর দখলকৃত ঢাকা বেতার থেকে সকাল সাতটার ঘোষণা করা হয় প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে এসেছেন এবং রাত আটটায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন।
সকাল আটটার অল্পকাল পরে আগুপিছু জিপ ও ট্রাকে মোতায়ন সশস্ত্র প্রহরায় একটি ১৯৬১ মডেলের শেভ্রলেট গাড়ি হোটেলের সামনে এসে থামে। এই গাড়ি বহর জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার সঙ্গীসাথীদের এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে।
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান নেতা জনাব ভূট্টো পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জনে শেখ মুজিবের বিরোধিতা করেছিলেন। সাধারণভাবে এটা মনে করা হয় যে, সেনাবাহিনী ও পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ীমহল সমর্থিত বা সৃষ্ট এই বিরোধিতাই সাম্প্রতিক সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে। বাঙ্গালীরা যে তাদের বর্তমান দুর্গতির জন্য তাঁকেই মূলত দোষারোপ করে এ সম্পর্কে সচেতন ভূট্টো লবিতে এলেন সাদা পোশাকধারী স্বয়ংক্রিয় সামরিক প্রহরীর বেষ্টিত হয়ে। তাকে ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল এবং সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের জবান এড়িয়ে গেলেন এই বলে, “আমার মন্তব্য করার কিছু নেই”।
দশটার সময় বেতারে নতুন সামরিক আইন জারির কথা ঘোষিত হলো।
হোটেলে সাংবাদিকরা যতই খবরাখবর জানতে চেয়েছেন তাঁদের নিরাশ করা হয়েছে। কূটনীতিক মিশনগুলোতে যোগাযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা ব্যার্থ হয়েছে।
একবার তর্ক-বিতর্ককালে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে আসা সাংবাদিকদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো ক্যাপ্টেন। তাদেরকে ভেতরে ফিরে যেতে বলা হলো। পিছন থেকে চিত্কার করে বলতে লাগল, "তোমাদের কিভাবে সামাল দিতে হয় জানা আছে আমার। আমি যদি নিজের লোকজনদের খুন করতে পারি তবে তোমাদেরকেও পারবো"।


১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান করছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার প্রচ্ছন্ন হুমকির মুখেও তিনি হোটেল ছাড়তে রাজি ছিলেন না। গা ঢাকা দিয়েছিলেন হোটেলের ছাদে। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ তুলে নেওয়ার পর সায়মন লুকিয়ে বেরিয়ে পড়েন ঢাকার রাস্তায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ফরাসি আলোকচিত্রী মিশেল লরা। তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত ২৫ মার্চ রাতের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেন শহরজুড়ে। ৩০ রিল ছবি তুলেছিলেন মিশেল। তাঁর টুকে নেওয়া নোট কোমরের বেল্টে আর মোজার ভেতরে গুঁজে নিয়েছিলেন সায়মন। তারপর চেপে বসেন পশ্চিম পাকিস্তানগামী বিমানে। করাচি থেকে তিনি বিমানে চলে যান ব্যাংকক। ঢাকা থেকে ফিরে মার্চের ৩০ তারিখে ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট’ শিরোনামে সাইমন ড্রিং লিখলেন,

মধ্যরাতের পর একসারি সেনাদল আমেরিকান এম-২৪ ট্যাংকের সাপোর্ট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর বৃটিশ কাউন্সিলের দখল নিয়ে সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা লক্ষ্য করে গোলা নিক্ষেপ করতে লাগল। ইকবাল হল, যে টি ছিল সরকার বিরোধি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের হেডকোয়ার্টার সেখান থেকে ২০০ ছাত্রকে ধরে মেরে ফেলা হল। দুদিন পরও তাদের দেহগুলো পড়ে ছিল পুড়ে যাওয়া কক্ষগুলোতে। এর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী আরও বহু লাশ সরিয়ে ফেলেছিল। একটি হলে ছাত্রদের মেরে দ্রুত কবর খুঁড়ে মাটি চাপা দেওয়া হয়। তারপর ওপর দিয়ে ট্যাংক চালিয়ে সমান করে দেওয়া হয় মাটি। অনেকের দেহ ভাসছিল পাশের লেকে। একজন শিল্পকলার ছাত্র মরে পড়েছিল তার ইজেলের উপর..পার্শ্ববর্তী বাজারের দোকান মালিকেরা তখনও তাদের বিছানায় শুয়ে আছে মৃত, দুদিন আগে যেভাবে তারা শেষবারের মতো শুয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকার বস্তিঘরের বাসিন্দারাও রেহাই পায়নি নৃশংসতার হাত থেকে। রেললাইন বরাবর ২০০ গজ এলাকার বস্তিঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

পুরান ঢাকায় কিভাবে নিরস্ত্র জনতার উপর হামলা হয়েছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন সাইমন ড্রিং,
সেনাদের একটা ইউনিট গ্যাসোলিনের ক্যান হাতে করে যাচ্ছিল। পথের পাশে যা পাচ্ছিল তাতেই আগুন দিচ্ছিল তারা। জলন্ত বাড়িঘর থেকে মানুষ যারা বের হতে চাইল গুলি করে মারা হল তাদের। যারা বেরুতে পারল না... জীয়ন্ত পুড়ে মরল তারা। ৭০০ উপর নারী, পুরুষ, শিশুদের হত্যা করা হয়েছে এখানে।

...পুরান ঢাকার হিন্দু এলাকাগুলো থেকে পালাচ্ছিল লোকজন। সেনারা সড়কের পাশে অবস্থান নিয়ে ক্রমাগত গুলি করে যাচ্ছিল। কেউ পালাতে পারেনি।

২৬ শে মার্চ রাত এগারোটা পর্যন্ত সেনারা পুরান ঢাকায় অবস্থান করে। তাদের সাথে ছিল বাঙ্গালী দালালেরা। সেনারা ফ্লেয়ার ফায়ার করছিল আর ফ্লেয়ারের আলোতে দালালেরা দেখিয়ে দিচ্ছিল কোন বাড়িগুলা আওয়ামীলীগের সমর্থকেরদের। সাথে সাথে ট্যাংক থেকে সে বাড়িটার দিকে গোলা বর্ষিত হল, গুলি করা হতে লাগল রিকোয়াললেস রাইফেল দিয়ে ক্রমাগত, শেষে গ্যাসেলিন দিয়ে জ্বালিয়ে সব ধ্বংশ করে দেয়া হল।

মাত্র একদিনে ১৫,০০০ নিরস্ত্র নাগরিককে হত্যা করে আত্মম্বরি হয়ে উঠল সেনারা। তারা সাইমন ড্রিং এর কাছে বড়াই করছিল। এক পাঞ্জাবি লেফট্যানান্ট বলছিলঃ এই ছোটলোক গুলো আমাদের কিছুই করতে পারবে না।

অপরজন বলছিলঃ সবকিছু এখন অনেক ভাল লাগছে। কোন মিছিল নেই স্লোগান নেই। আবার যদি এরা এসব করতে চায় আমরা এদের সবাইকে খুন করব। অনেক স্লোগান দিয়েছে এরা, অনেক মিছিল করেছে। এই সব বিশ্বাসঘাতকদের শিক্ষা দিতে আমরা আল্লার নামে এবং পাকিস্থানকে এক রাখার উদ্দেশ্যে লড়ছি।

আল্লাহর নাম নিয়ে এক পাকিস্থানের লক্ষ্যে শুরু হল বিশ শতকের ইতিহাসের নৃশংসতম গনহত্যা।

সুত্রঃ
১। Siddiq Salik, Witness to Surrender,
২। Maj. Gen. K.M. Shafiullah, Bangladesh at War,
৩। Major Rafiqul Islam, A Tale of Millions,
৪। Maj. Gen. Kakeem Arshad Qureshi, The 1971 Indo-Pak War: A Soldier’s Narrative, Oxford University Press
৫। Hamdoor Rahman Commission Report, Chapter IV, paragraph II
৬। শর্মিলা বোস Anatomy of Violence: Analysis of Civil War in East Pakistan in 1971: Military Action: Operation Searchlight Economic and Political Weekly বিশেষ নিবন্ধ, অক্টোবর ৮, ২০০৫
৭। Pakistan Defence Journal, 1977, Vol 2,
৮। Maj. Gen Rao Farman Ali, How Pakistan got Divided
৯। ASM Shamsul Arefin, Standing of History,- - War of Liberation,
১০। Major Nasir Uddin, Judhay Judjay Shadhinota,
১১। Maj. Gen. Sukhwant Singh, The Liberation of Bangladesh Vol.1,
১২। Commando Khalilur Rahman Rahman, Muktijudday Nou Abhijan,
১৩। ডেটলাইন বাংলাদেশ নাইন্টিন সেভেন্টি ওয়ান, সিডনি শনবার্গ
১৪। দৈনিক বাংলা, ১৯৭২ (একটি জাতির জন্ম) এবং সেক্টর কমান্ডাররা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় ঘটনা, সম্পাদনা শাহরিয়ার কবির, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা ১৯৯২।
১৫। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ, দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড
১৬। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ, দলিলপত্র, নবম খণ্ড
১৭। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর – অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
১৮। দৈনিক সংবাদ। ২৬মে মার্চ ২০১২, স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১০:৪৫

নকীব কম্পিউটার বলেছেন: স্বাধীনতা, তোমাকে পেতে কত প্রাণ গেলো।

০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:৪২

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার বলেছেন: কত অশ্রুজলে মিশে আছে এই দেশটা

২| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:০৫

চাঁদগাজী বলেছেন:


সংক্ষেপ করুন

০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:৪৪

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার বলেছেন: ভাই এটাতো আমার লেখা কোন গল্প নয় যে সংক্ষেপ করব,মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস,সত্যের আলাপ কি কখনও সংক্ষেপ হতে পারে?

৩| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:১৪

বিজন রয় বলেছেন: পোস্ট এত বড় করে না দেয়া ভাল। এটি ৪চি পর্ব হতে পারত।

আমাদের ইতিহাস আমাদের গর্ব।

০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:৪৫

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার বলেছেন: আপনার সাজেশনের জন্যে ধন্যবাদ

৪| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৮

মনসুর-উল-হাকিম বলেছেন: মাশা-আল্লাহ, চমৎকার সুন্দর লিখেছেন শুভেচ্ছান্তে ধন্যবাদ, . . . . !!

০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১:৩০

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার বলেছেন: আপনাকেও

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.