নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আঁচলের ঘ্রাণে বিমোহিত হতে মনে প্রেম থাকা লাগে। চুলের গন্ধ নিতে দুহাত বাড়িয়ে দেয়া লাগে। হাহাকার থাকা লাগে। দুনিয়া ছারখার হওয়া লাগে। সবাই আত্মা স্পর্শ করতে পারে না।আমার সমস্ত হাহাকার ছারখারে তুমি মিশে আছো।

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার

এক জন নিভৃতচারী

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঐতিহাসিক ১৭ ই এপ্রিল

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১:০৪

বিস্মৃতির মহাকাব্য অনেক বিষয় নিয়ে লেখা সম্ভব হলেও মুজিবনগর দিবস নিয়ে লেখা সম্ভব নয়। যেই দিনটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য আনুষ্ঠানিকভাবে উদিত হয়েছিল, সেই দিনটি বিস্মৃতির অন্তরালে যাবে এটা কখনো সম্ভব নয়। বিশেষ করে যারা অত্যাচার-নিপীড়নের নাগপাশ থেকে মুক্তির স্বপ্নে, দেশমাতৃকার স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন, যারা দখলদার হানাদারদের পবিত্র মাতৃভূমির মাটি থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন, তাদের কাছে ওই দিনের ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাই এমন মহার্ঘরূপে আবির্ভূত হয়েছিল যে, তা বিস্মৃত হওয়া কল্পনাতীত একটি বিষয়ই বটে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তার ঠিক ২১৪ বছর পরে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজিবনগরের আরেক আম্রকাননে বাংলার সেই অস্তমিত স্বাধীনতার সূর্য আবারও উদিত হয়ে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটিকে স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে দিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির সেনাবাহিনী ফ্রান্স দখল করে নিলে জেনারেল দ্য গলে লন্ডনে যেভাবে ফ্রান্সের প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন, অনেকটা সেভাবেই বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার আদর্শের উত্তরসূরিরা কলকাতায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন। এই সরকারের সঙ্গে কম্বোডিয়ার প্রিন্স নরোদম সিহানুকের সরকার তুলনীয়। যার সঙ্গে পলপটের খেমাররুজ যুক্ত ছিল। এদের সদর দফতর দীর্ঘকাল চীনের বেইজিংয়ে ছিল। কোনো কোনো সময় থাইল্যান্ডেও ছিল। সিহানুকের স্বাধীন কম্বোডিয়া সরকার একদিকে প্রবাসী ছিলেন অন্যদিকে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাদের দখলে ছিল, যেখানে তারা সরকার পরিচালনা করতেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বহুলাংশে এ সরকারের সঙ্গে তুলনীয়। সে যাই হোক, প্রবাসী সরকার ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করে সেখানে সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সনদ ঘোষণার ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের গোপন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিশ্ববাসীকে দেখাতে চেয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে ভারতের মাটিতে বসে। ইয়াহিয়ার এ প্রচার মিথ্যা প্রমাণ করতেই বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, যে কোনো ভাবেই হোক খবরটি পৌঁছে যায় পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে। এ জন্য ১৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বিমান থেকে বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণ করে ওরা। ফলে শপথ অনুষ্ঠান পিছিয়ে যায়। এবার খুবই সতর্কতার সঙ্গে শপথ অনুষ্ঠানের তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করেন তাজউদ্দীন আহমদসহ বিশ্বস্ত কয়েকজন।
পাকবাহিনীর বিমান হামলার কথা বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের মানচিত্র দেখে সর্বোত্তম নিরাপদ একটি স্থান হিসেবে মেহেরপুরকে শপথ অনুষ্ঠানের স্থান হিসেবে তারা নির্ধারণ করেছিলেন। ভৌগোলিক সুবিধার জন্য সেখান থেকে স্বল্প সময়ে ভারতে প্রবেশ করা যাবে এবং ভারত থেকে শত্রুদের ওপর আঘাত হানাও সহজতর হবে, এ চিন্তাই এক্ষেত্রে কাজ করেছে। ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে বাংলাদেশের সরকারের অফিসের কেউ জানত না, কলকাতা থেকে শত শত মাইল দূরে বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাসের এক স্বর্ণালি অধ্যায় রচিত হতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এতই কঠিন গোপনীয়তা অবলম্ব্বন করেছেন যে, মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যও তা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর হুকুমে ১৭ এপ্রিলের সকালে দমদম এয়ারপোর্টে গোপনে সজ্জিত হয়েছিল ভারতীয় যুদ্ধ বিমান বহর। মেহেরপুর সীমান্তে ভারতীয় ভূখণ্ডে অবস্থান করছিল ভারতের সামরিক বাহিনী। মেহেরপুর আম্রকাননের দূর-দূরান্তে ঘাস-পাতা বিছানো জালের ছাউনিতে ভারতীয় বাহিনীর অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান মেহেরপুরের আকাশ নিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়ে দিয়েছিল।
মেহেরপুরের অখ্যাত ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলায় সাদামাটা পরিবেশে একটি আমবাগানে শপথ নিয়েছিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার। শপথের দিনটি ছিল শনিবার। আমবাগানের চারদিকে রাইফেল হাতে কড়া প্রহরায় ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সকাল ৯টা থেকেই সেখানে নেতৃবৃন্দ ও আমন্ত্রিত অতিথিদের আগমন শুরু হয়ে গিয়েছিল। দেশি-বিদেশি প্রায় জনা পঞ্চাশেক সাংবাদিক ওই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। আম্রকানন লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা শেষ মুহূর্তে খবর পেয়ে যে যেখানে ছিলেন পঙ্গপালের মতো যেন উড়ে আসতে থাকেন। আনন্দ-আবেগে উদ্বেলিত শত শত কণ্ঠের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, গগনবিদারী স্লোগানে স্লোগানে আম্রকাননের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছিল সেদিন। চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছিল শপথ মঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজানো ছয়টি চেয়ার। আশপাশের বাড়ি থেকে চৌকি, চেয়ার ও বাঁশ আনা হয়েছিল সেদিন। উপরে শামিয়ানাও লাগানো সম্ভব হয়নি। ফলে খোলা আকাশেই মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল।
বেলা ১১টায় শুরু হয়েছিল শপথ অনুষ্ঠান। মঞ্চে উঠে এলেন তাজউদ্দীন আহমদ, তার পেছনে ক্যাপ্টেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও জেনারেল এমএজি ওসমানী। তাদের গার্ড অব অনার দিয়েছিলেন তৎকালীন মেহেরপুরের এসডিপিও এসপি মাহবুব উদ্দিন বীরবিক্রম। অনুষ্ঠানের শুরুতেই বাংলাদেশকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রূপে ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম একে একে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুর্নবাসনমন্ত্রী এম কামরুজ্জামান, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর নতুন রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে কর্নেল এম এ জি ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম ঘোষণা করেন। এরপর সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটিই হলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান আইনি দলিল যা আমাদের সংবিধান এবং সরকার গঠনের মূল ভিত্তি। একটি সত্য কথন হলো যে, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার একজন ছিলেন বিতর্কিত। তিনি খন্দকার মোশতাক আহমেদ। জ্যেষ্ঠতার কারণে মুজিবনগর সরকারের প্রধান তারই হওয়া উচিত বলে মনে করতেন তিনি। এবং সুযোগ বুঝে তিনি পাকিস্তান ও সিআইয়ের হয়ে কনফেডারেশন গঠন করতে চেয়েছিলেন। খন্দকার মোশতাক কত বড় মীরজাফর আমরা জাতির জনকের হত্যার মধ্যদিয়েই তা আরও স্পষ্ট বুঝতে পারি। সে যাই হোক, সেই শপথ অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
শপথ গ্রহণ শেষে তাজউদ্দীন আহমদ তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমরা যা করছি সবই মুজিবের নির্দেশে’। তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এ নতুন শিশুরাষ্ট্রকে লালিত-পালিত করছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ এক বাস্তব সত্য।’ তার বক্তব্যে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের তরে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই শপথ অনুষ্ঠানে নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুজনই বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন। এই শপথ অনুষ্ঠানটি বাঙালিদের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন জুগিয়েছিল। শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াইয়ে উজ্জীবিত হয়েছিল আমাদের বীর সৈনিকরা।
মুজিবনগর সরকার আত্মপ্রকাশের পরপরই হানাদার বাহিনী মেহেরপুর মহকুমা এলাকা দখল নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। বেশ কয়েকবার তারা ইপিআর ক্যাম্প দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অতিরিক্ত ঝুঁকির কারণে মুজিবনগর প্রশাসন সুবিধামতো মুক্তাঞ্চলে চলে যায়। পরে নিরাপত্তাজনিত কারণে ভারতের কলকাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে প্রবাসী সরকার। এই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রতীক। এই প্রবাসী সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, কূটনৈতিক প্রচার বিশ্ব জনমত গঠন এবং এক কোটি উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেছিলেন। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে মুজিবনগর সরকার যে দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও প্রশাসন পরিচালনা করেছিল, তা যে কোনো সরকারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অনুসরণীয়। তীব্র প্রতিকূলতার মধ্যে এই সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব, এক কোটির ওপর শরণার্থীর জন্য ত্রাণ ব্যবস্থা, দেশের অভ্যন্তর থেকে লাখ লাখ মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতা যুবাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানিদের মাঝে ত্রাসের সৃষ্টি, স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ রাখা এবং বিশ্বজনমত গঠনসহ বিভিন্ন অবিস্মরণীয় কীর্তি সম্পন্ন করে যা সমকালীন ইতিহাসের বিচারে অতুলনীয়।

বাংলা, বাঙালী, মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবনগর যেন অভিন্ন নাম। স্বাধীনতা অর্জনের পথে ১৭ এপ্রিল এক ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত দিন। বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারের শপথ নেবার দিন, স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের দিন। বাঙালী জাতি সুদীর্ঘ দুই শতাব্দীরও অধিককাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানের শাসনে শৃঙ্খলিত ছিল। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল বাঙালীর সেই স্বাধীনতার সূর্য আবারও উদিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে।

এপ্রিল ভারতের মাটিতে সরকার গঠন করলেও বৈধতার প্রশ্নে দেশের মাটিতে শপথ গ্রহণ করার জন্য প্রথমে আখাউড়া পরে চুয়াডাঙ্গা শেষে নিরাপত্তার জন্য বেছে নেয়া হয় মেহেরপুর সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথ তলার আমবাগান। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সকালবেলা তদানীন্তন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নাম বদলে গিয়ে নতুন নাম হলো মুজিবনগর। আম্রকাননে আত্মপ্রকাশ করল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী বিপ্লবী সরকার। নিশ্চিত হলো স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়। তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেখানে আবেগপ্রবণ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন পলাশীর আম্রকাননে ১৭৫৭ সালে বাংলাদেশের যে স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গিয়েছিল আজ তার নিকটবর্তী আরেক আম্রকাননে সেই স্বাধীনতার সূর্য পুনরায় উদিত হলো। প্রকাশ্যে বাংলাদেশের মুজিবনগর মুক্তাঙ্গনে শতাধিক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, প্রেস ফটোগ্রাফার, বেতার ও টিভি প্রতিনিধিদের সামনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার এসডিও ছিলেন তৌফিক-ই-এলাহী। তিনি জানতে পারলেন ১৭ এপ্রিল ভবেরপাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথের আমবাগানে হাইকমান্ডের একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। সে মোতাবেক মঞ্চ সজ্জাসহ সার্বিক ব্যবস্থা করেন তিনি। নেতাদের জন্য আশপাশের গ্রাম থেকে চেয়ার-টেবিল আনা হলো। চেয়ারগুলো ছিল হাতলবিহীন।
বর্তমানে চেয়ার-টেবিলগুলো ঢাকা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত। সকাল ৮টার দিকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী, পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীসহ নেতারা মুজিবনগর পেঁৗছলেন। কলকাতার প্রেসক্লাব থেকে সাংবাদিকদের গাড়ির মিছিল নিয়ে মুজিবনগর পেঁৗছতে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লেগেছিল ঐতিহাসিক আমবাগানে পেঁৗছতে। আমবাগানের মাঝামাঝি পশ্চিম প্রান্তে বর্তমানে যেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। ঠিক তার মাঝখানে সভামঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। যে ভিতের ওপর সেদিন বাংলাদেশের পতাকা উঠানো হয়েছিল ঠিক সেখানে একটি স্তম্ভ তৈরি করা হয়েছিল। আর ঐ স্তম্ভটিকে স্মৃতিসৌধের মাঝখানে রেখে বর্তমান স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথমে সাদা টুপি, চেক লুঙ্গি ও সাদা শার্ট পরে স্থানীয় যুবক বর্তমানে মুজিবনগর ডিগ্রি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক বাকের আলী পবিত্র কোরআন শরিফ থেকে তেলাওয়াত করে সভার উদ্বোধন করেন। নতুন রাষ্ট্র সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন প্রয়াত প্রভাষক আসাদুল ইসলামসহ স্থানীয় মিশনারির শিল্পীরা। জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও নবগঠিত স্থানীয় ১২ জন আনসার বাহিনীর একটি দলের গার্ড অব অনার গ্রহণের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভামঞ্চে প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করেন। নেতাদের সবার পরনে ছিল সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবি। একমাত্র পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পরনে ছিল গাঁঢ় রংয়ের লম্বা কোট-প্যান্ট এবং টুপি। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মান্নান এমএনএ। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তথ্য, প্রচার ও বেতারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন। অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী (সাবেক মন্ত্রী) বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তবে তার অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন তাজউদ্দীন আহমেদ, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী, খন্দকার মোস্তাক আহমেদ পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রীর অস্থায়ী দায়িত্ব পেলেন। শপথ গ্রহণের পর প্রথমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। এভাবে অন্যান্য নেতার বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ৮ পৃষ্ঠার এক বিবৃতি পাঠ করলেন এবং বৈদ্যনাথ তলার নাম রাখলেন মুজিবনগর। বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করলেন ইয়াহিয়া খান গণহত্যা চালিয়ে নিজেই পাকিস্তানের কবর খুঁড়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শেষে বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে নাম লেখা হলো ভবেরপাড়ার বৈদ্যনাথতলা থেকে মুজিবনগরের। গঠিত হলো মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাজধানী ও মুক্তিযুদ্ধের সুতিকাগার।

কারন
বাঙালী জাতি সুদীর্ঘ দুই শতাব্দীরও অধিককাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানের শাসনে শৃঙ্খলিত ছিল। ২৫০ বছর আগে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সেই স্বাধীনতার সূর্য আবারও উদিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে। বাঙালীর দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষার পর তৎকালীন নদীয়ার আরেক অংশ মেহেরপুর মুজিবনগরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে রচিত হয়েছিল আরেকটি ইতিহাস। একাত্তরের অগ্নিঝরা এদিনেই বাঙালীর হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভিত্তিমূল রচিত হয়।

কৃতজ্ঞতা-বাহালুল মজনুন চুন্নু
সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাবেক সাধারন সম্পাদক,বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১:২১

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: আপনি কি অন্যদের পোস্টে কখনও যান? মন্তব্য করেন?

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৭

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার বলেছেন: জ্বী অবশ্যই দেখি,মন্তব্যটা অবশ্য কম করা হয়

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.