নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আঁচলের ঘ্রাণে বিমোহিত হতে মনে প্রেম থাকা লাগে। চুলের গন্ধ নিতে দুহাত বাড়িয়ে দেয়া লাগে। হাহাকার থাকা লাগে। দুনিয়া ছারখার হওয়া লাগে। সবাই আত্মা স্পর্শ করতে পারে না।আমার সমস্ত হাহাকার ছারখারে তুমি মিশে আছো।

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার

এক জন নিভৃতচারী

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফিরে দেখা সিরাজ শিকদার প্রসঙ্গে

০৯ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:৩১


সিরাজ শিকদার ও তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে সবার মধ্যেই কমবেশি একধরনের বিভ্রান্তি আছে। আমার মধ্যেও যে বিভ্রান্তি ছিল না- তা নয়। তখন আমি বাংলাদেশে। বন্ধুদের নিয়ে বিভিন্ন লাইব্রেরিতে ঘুরে ঘুরে বঙ্গবন্ধু ও ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সম্পর্কিত বইগুলো কিনছি। এক বিকেলে কবি কামরুল আলম সিদ্দিকীকে নিয়ে বাংলাবাজারের এক লাইব্রেরিতে সেসব বইয়ের সন্ধান করতে গেলে, লাইব্রেরির মালিক প্রথমে আগ্রহ দেখালেও পরক্ষণ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখছি শোনে অনেকটা কটাক্ষের সুরেই বলেন, ‘... হ, শেখ মুজিবকে নিয়ে লিখতাছেন ভালা কথা, সিরাজ শিকদারের কথাটাও টাইনেন!’... সেই ভদ্রলোক নিজেও বেশ লেখালেখি করেন!...
তালপাতার পুথির প্রথম খণ্ডে পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির লিডার সিরাজ শিকদারের প্রসঙ্গ বিচ্ছিন্নভাবে উঠে এলেও দ্বিতীয় খণ্ডের সাত নম্বর চ্যাপ্টারে তাঁর প্রসঙ্গ পূর্ণাঙ্গউঠে এসেছে।
প্রিয় বন্ধুরা, এই চ্যাপ্টারটা লিখতে গিয়ে সঠিক তথ্যসন্ধানে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে। সুদূর নিউজিল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে গিয়ে সেই কাজগুলো করা অত সহজ ছিল না। তারপরও আপনাদের যদি লেখাটা ভালো লাগে, কারো বিভ্রান্তি যদি খানিকটা দূর হয়, আমি কৃতার্থ হবো।
শেখ ফজলুল হক মণি চলে যাবার পর বঙ্গবন্ধু দুটো কাজ খুব তাড়াতাড়ি করলেন, প্রথমে তিনি তাঁর সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হককে ফোন দিলেন, তারপর ফোন দিলেন নতুন ডি.এফ.আই. প্রধান কর্নেল জামিল আহমেদকে। ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হকের সাথে তিনি ফোনেই কথা সেরে ফেলেছেন। কিন্তু কর্নেল জামিল আহমেদকে তিনি তাঁর অফিসে ডেকে পাঠিয়েছেন।
এখন বঙ্গবন্ধু কর্নেল জামিল আহমেদের অপেক্ষায় বসে আছেন। কর্নেল জামিল আহমেদ এলেই তিনি কথা শেষ করে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি তাঁর অফিসে এসে উপস্থিত হবেন।
বঙ্গবন্ধু ভাবলেন, কর্নেল জামিল আহমেদের সাথে তাঁর কথা বলাটা খুব জরুরী। ইচ্ছে করলে তিনি ফোনেই আলাপটা সেরে নিতে পারতেন। কিন্তু সব আলাপ টেলিফোনে সারা যায় না! ব্যাপারটা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বোমা বিস্ফোরণের মতো একটা বিষয়ই নয়। আগামীকাল তিনি প্রায় কয়েক ডজন মন্ত্রী, এম.পি, রাজনৈতিক নেতা এবং বিশিষ্ট মানুষজন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাবেন। ওখানে থাকবে হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক এবং জনতা। ওই সময় যদি নতুন করে বোমা বিস্ফোরণের মতো কোনো ঘটনা ঘটে?... গোয়েন্দা বিভাগকে আজ রাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আরও কড়া নজর রাখতে হবে। কাল সকাল থেকে গোয়েন্দা তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে। এছাড়া আভ্যন্তরীণ সিকিউরিটির ব্যাপারস্যাপার নিয়েও তিনি আলাপ করবেন।...
কর্নেল জামিল আহমেদের আগমনের অপেক্ষা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটির কথা ভাবতে ভাবতে বঙ্গবন্ধু দৃষ্টি উঠানামা করলেন। ক্লান্তি ও অবসাদ তাঁর শরীরে। তিনি পাইপ এবং দিয়াশলাইর বক্সটা হাত বাড়িয়ে নিলেন। দুই-দুইবার তিনি অফিসকক্ষের দরজার দিকেও তাকালেন।
শরীরটা সম্পূর্ণভাবে চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে তিনি ফস্‌ করে দিয়াশলাইর কাঠি ধরালেন। পাইপের মুখে জ্বলন্ত দিয়াশলাইর কাঠি ধরে তামাক ধরানোর জন্য তিনি পাইপটাকে পর পর কয়েকবার জোরে জোরে টান দিলেন। পাইপ ধরে গেল তৎক্ষণাৎ। তিনি কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া ছাড়লেন।
আজকাল বঙ্গবন্ধু খুব বেশি পাইপ টানছেন। সাথে সাথে চা-ও খাওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত। ডাঃ নুরুল ইসলাম বেশ আগেই নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন। গল্ডব্লাডার অপারেশানের পর তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা রেণুও তাঁর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়গুলো নিয়ে বেশ সজাগ থাকেন। কিন্তু সজাগ থাকতে পারেন না তিনি নিজে। আজকাল হয়তো মাঝেমধ্যে ভাবেন, কাজ-টাজ কমিয়ে দিয়ে শরীরের একটু যত্ন নিবেন।– পাইপ কম টানবেন, চা নিয়ম বেঁধে সারাদিনে দুই-তিন কাপ খাবেন, খাওয়া-দাওয়া সময়মতো করবেন!... কিন্তু চারিদিকে কাজের এত চাপ, সবসময় কত কী দুশ্চিন্তা এসে ভিড় করে- এতে তাঁর কোনো নিয়মই মানা হয় না!... একবার গভর্নররা ক্ষমতা বোঝে পাক, ওদিকে তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লব সার্থক হোক, দেশটা আরেকটু স্থিতিতে আসুক!...
বঙ্গবন্ধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলেন, হ্যাঁ, দেশটা অবশ্যই স্থিতিতে আসবে, মানুষজন স্বস্তি ফিরে পাবে, সমাজ থেকে সমস্ত পঙ্কিলতা দূর হবে, তাহলেই তিনি তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারবেন!...
কিন্তু বঙ্গবন্ধু ভেবে পেলেন না, এই সোনার বাংলা গড়ে তোলার সংগ্রামে এত বৈরিতা কেন? ওরা কী চায়?- ওরা যে দেশটাকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে, এই দেশটা কি ওদের নয়?- হাজার হাজার মানুষ ওরা যে অকারণে হত্যা করছে, ওই মানুষগুলো কি ওদের কেউ নয়?- নাশকতা, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, খুন, রাহাজানি- এত কিছু কেন?- জাসদ, জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, জাসদের গণবাহিনী ও চরমপন্থি দল পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি- ওরা কী চায়?... কর্নেল তাহের, কর্নেল জিয়াউদ্দীন, মেজর জলিল এবং আরো কিছু মানুষ?
আর সিরাজ শিকদার?- সে এখন বেঁচে নেই। কিন্তু সে-ই বা কী চাইতো?
কর্নেল জিয়াউদ্দীন এখন কোথায়, বঙ্গবন্ধু তা জানেন না। তিনি শুনেছেন, সে নাকি সুন্দরবনের কাছাকাছি কোথাও আত্মগোপন করে খুলনা ও ওইসব এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ি, পার্টি অফিস, সরকারি অফিস, গ্রামগঞ্জে আতর্কিত হামলা আক্রমণ করে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। কর্নেল জিয়াউদ্দীনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ছিল চরমপন্থি দল পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির সিরাজ শিকদারের।
বঙ্গবন্ধু সিরাজ শিকদারের কথা ভাবতে বসলেন। দেশ স্বাধীনের পর সিরাজ শিকদারের মতো এমন একজন মুক্তিযোদ্ধা, বিপ্লবী নেতা দেশ গড়ার বদলে খুন, রাহাজানী, ছিনতাই ও ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করবে- তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি! প্রথম দিকে তার ওইসব ব্যাপার-স্যাপারগুলো তিনি তেমন একটা আমলে নেননি। ভেবেছিলেন, অল্পবয়স, নতুন ভগ্নপ্রায় দেশ, সবকিছু ভেবে হয়তো দিশেহারা!... কিন্তু সিরাজ শিকদারের ওই দিশেহারা ভাব যে অন্য কোথাও তা তাঁর জানতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল। ততদিনে সে এতোই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে, সে এই দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়েই টানাটানি শুরু করে দিয়েছিল!...
বঙ্গবন্ধু একটা ব্যাপার বুঝতে পারেন না, যে সিরাজ শিকদার প্রকৌশল কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিল। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র-রাজনীতিবিদ হিসেবে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি এবং পরবর্তীতে মাও সেতুঙ্গের ভাবধারায় একটা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করে উনিশশো আটষট্টি সাল থেকে পূর্ব বাংলায় শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই সিরাজ শিকদার কীভাবে দেশ স্বাধীনের পর হাজার হাজার নিরীহ মানুষ খুন করতে পারে? সে কীভাবে একটা সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতে পারে?
...সত্তুর সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যখন অংশগ্রহণ করে এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তখন মাওলানা ভাসানী সহ সব বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছিল। এরমধ্যে সিরাজ শিকদারের দলও ছিল। সে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাকে একেবারেই সমর্থন করেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায়, তখন ঠিকই সে বোল পাল্টে বঙ্গবন্ধুর কাছে চিঠি পাঠায়।
সিরাজ শিকদারের চিঠির একাংশে লেখা ছিল এমন, “...আপনার ও আপনার পার্টির ছয় দফা সংগ্রামের রক্তাক্ত ইতিহাস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, ছয় দফার অর্থনৈতিক দাবীসমূহ বাস্তবায়ন সম্ভব সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে। পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্ত ও স্বাধীন করে!... আমি ও আমার দল এই ব্যাপারে আপানার ও আপনার সংগ্রামের সাথে আছি”...
সে চিঠিতে আরও লিখে, “...আপনাকে ও আপনার পার্টিকে পূর্ব বাংলার সাত কোটি জনসাধারণ ভোট প্রদান করেছে পূর্ব বাংলার উপরস্থ পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকগোষ্ঠীর উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের অবসান করে স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র কায়েমের জন্য। পূর্ব বাংলার জনগণের এই আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য আমার ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’ আপনার প্রতি ও আওয়ামী লীগের প্রতি পূর্ণ সমর্থন আছে!”...
সিরাজ শিকদারের ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’-ই পরবর্তীতে নতুন নাম নেয়- ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’।
সিরাজ শিকদারের চিঠি পেয়ে বঙ্গবন্ধু যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। সেটা ছিল একাত্তর সালের মার্চ মাস। তারিখটা বঙ্গবন্ধুর এখনও মনে আছে, মার্চের দুই তারিখ। তখন শুধু সিরাজ শিকদারই নয়, তিনি আরও অনেক বৈপ্লবিক সংগঠনেরই চিঠি পেয়েছিলেন ওই সময়ের কাছাকাছি। যার কারণে একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে এবং সাতই মার্চের ভাষণে স্বায়ত্ব শাসনের চিন্তা পরিহার করে তিনি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণায় সবাইকে যুদ্ধে নেমে যেতে আহ্বান করেছিলেন!
সিরাজ শিকদার একজন খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা ছিল, এতে কোনো খুঁত নেই!... সে তার নিজস্ব গেরিলাদের সাথে নিয়ে বরিশালের কীর্তিনাশা নদীতে এক সম্মুখ যুদ্ধে ছাব্বিশজন পাকসেনাকে মেরে পাকিস্তানের একটা সেনা ইউনিট তছনছ করে দিয়েছিল। তার বাহিনী কতৃক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা ইউনিটের ওই বিপর্যস্থের খবর আকাশবাণী বেতার ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বেশ ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় তার আরও কিছু বীরত্বের কাহিনী ছিল সর্বজনবিধিত।
কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর সিরাজ শিকদার ওইসব কী করতে শুরু করেছিল?... তার ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’ প্রথমদিন থেকেই কোনো কারণ ছাড়া দেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে অবজ্ঞা করেছিল। এমন কী প্রথম সপ্তাহ যেতে না যেতেই সে বলতে শুরু করে, দেশটা নাকি এখনও পরাধীনতার শেকলে বন্দী!... সে নিজের পার্টির নাম থেকে ‘পূর্ব বাংলা’ শব্দটা পর্যন্ত বাদ দিতে অবজ্ঞা করে। দেশ স্বাধীনের পনেরো দিনের মাথায় সে এবং তার দল ঢাকা শহরে প্রচারপত্র বিলি করে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়, ...পূর্ব বাংলা নাকি স্বাধীন হয়নি। এইজন্য তারা দেশের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে!... আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ করবে!...
অথচ বঙ্গবন্ধু তখনও পাকিস্তান কারাগারে। দেশ চালাচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এবং কোলকাতা থেকে ফেরত প্রবাসী মুজিবনগর সরকার।
বাহাত্তর সালের সতেরোই মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাংলাদেশ সফরে আসেন। বাংলাদেশের জনগণের মনে তখন কী স্বতঃস্ফুর্ত উৎসাহ!... স্বাধীন বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সাহায্যকারী দেশ ভারত। সেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আগমন!...
ঠিক সেই সময়টায় সিরাজ শিকদারের ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’ আবারও বিব্রতকর একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ওরা প্রচারপত্র, পোষ্টার ও চিকা মেরে ঢাকা শহরের সর্বত্র ছেয়ে দেয়, যার প্রধান শিরোনাম ছিল- ‘ইন্দিরা গান্ধী জবাব দিবেন কি?’... এই শিরোনামের প্রচারপত্রে সিরাজ শিকদার ও তার দল কয়েকটি লিখিত বড় বড় বিষয় নিয়ে সমালোচনা করেছিল। যা ছিল ভিত্তিহীন ও ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়ক। যেমন- নাগা, মিজো, কাশ্মীর ও শিখদের মুক্তি সংগ্রামকে ভারত সরকার কীভাবে দমন করছে!... ভারতের ‘গরিবি হটাও’ বুলি আজ কোথায়!... ভারতে ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে কী হচ্ছে!...
পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির সেই প্রচারপত্রে না ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা, না ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে ভারতের অবদানের কোনো উল্লেখ। এমন কী সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ এবং সহযোগিতাকারী দেশ ভারতের প্রতি না ছিল বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা!...
বাহাত্তর সালের ষোলই ডিসেম্বর, বাংলাদেশের প্রথম মহান বিজয় দিবস!... এই মহান বিজয় দিবসকে খুব বিকৃতভাবে বিরোধিতা করে সিরাজ শিকদার ও তার দল নতুন আরেকটা প্রচারপত্র সারা ঢাকা শহরে বিলি করে। সেই প্রচারপত্রের সারমর্ম ছিল, ...বাংলাদেশের ‘বিজয় দিবস’ নাকি ভারতের সম্প্রসারণ দিবস!... একই দিনে ওরা বিজয় দিবসের বদলে সারাদেশে ‘কালো দিবস’ পালন করে!...
তিয়াত্তর সালে ওদের ত্রাসের কর্মসূচীর তৎপরতা শুধু ঢাকা শহরেই নয়, সারা দেশ ব্যাপি ব্যাপক বিস্তার ঘটে।– গুপ্তহত্যা, টেলিফোন একচেঞ্জ ও বন অফিসে হামলা, লঞ্চ ও ট্রেনে ডাকাতি, হাটবাজারে লুট, থানা লুণ্ঠন, ইউনিয়ন অফিসের চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক নেতাকর্মী সহ অতি সাধারণ জনগণকে খুন, এমন কী ওদের নিজস্ব অনেক নেতাকর্মী পর্যন্ত চরমপন্থি কাজকর্মে বিরোধিতা করায় অন্যায় ও নৃশংসভাবে খুন হতে হয়!
কিন্তু এই বছরের শুরুতেই জানুয়ারির এক তারিখ চট্টগ্রামের হালির শহরে দলের গোপন বৈঠক করতে এসে সিরাজ শিকদার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। গ্রেফতার হওয়ার পর পুলিশবাহিনীর একটি বড় ফোর্স ফকার বিমানে তাকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে এস.বি. অফিস এবং রাতে তাকে এস.বি. অফিস থেকে বঙ্গবন্ধুর আদেশে গণভবনে তাঁর সামনে আনা হয়!...
সিরাজ শিকদারকে গণভবনে আনার পেছনে বঙ্গবন্ধুর একটাই উদ্দেশ্য ছিল, তাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে সঠিক পথে টেনে আনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা দেখিয়ে দেওয়া। ...সে একজন মুক্তিযোদ্ধা- এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর দেশ গড়ার বদলে কেন এবং কার প্ররোচনায় সে এমন চরমপন্থি ধ্বংসাত্বক কাজ বেছে নিয়েছিল?...
সেই রাতটা বঙ্গবন্ধুর চোখে মাঝে মাঝেই ভেসে উঠে। আজ, এখনও তা ভেসে উঠল। সিরাজ শিকদারের পরনে ছিল ঘিয়ে রঙের প্যান্ট, ট্রেটনের সাদা ফুলশার্ট। একটা কালো সানগ্লাস ছিল। সানগ্লাসটা শার্টের পকেটে রাখা ছিল।...
...সিরাজ শিকদারকে চট্টগ্রাম থেকে বন্দী করা এতোটা সহজ হতো না যদি তার দ্বিতীয় স্ত্রী জাহানারা হাকিম পুলিশবাহিনীকে সহযোগিতা না করত। এছাড়া এর আগে বেশ কয়েকমাস ধরে তারই কিছু রাজনৈতিক সহকর্মী তার দলমতহীন চরমপন্থি কাজকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে গোপনে বিরোধিতা করে আসছিল। ওরাও পুলিশবাহিনীকে সহযোগিতা করে।
সিরাজ শিকদার চট্টগ্রামের হালিশহরে একটা গোপন আস্তানায় দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিল। ওদের বৈঠক খুব একটা দীর্ঘ সময়ের ছিল না। বৈঠককালীন সময়ে ওরা টের পায়, ওদের নেতৃস্থানীয় একজন বাইরে যাওয়ার নাম করে আর ফিরে আসছে না। ব্যাপারটা ওদের খুব চিন্তিত করে। এরিমধ্যে জাহানারা হাকিমের মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ পূর্বে থেকেই চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ওঁত পেতে থাকে। পুলিশ জানত সিরাজ শিকদার চট্টগ্রামে, কিন্তু তারা তার গোপন আস্তানার খবর জানত না। পরে ওদের বৈঠককালীন সময় তার সেই সহকর্মীর মাধ্যমে আস্তানার হদিশ মিললেও পুলিশ যখন ওখানে হানা দেয়, ততক্ষণে পার্টির সবাই লাপাত্তা।
গোপন আস্তানা থেকে সবার আগেই বের হয়েছিল সিরাজ শিকদার। তার এক সহকর্মী মহসীনকে নিয়ে অলিগলি ধরে অনেকদূর হেঁটে গিয়ে একটা মোড় থেকে একটা বেবিট্যাক্সি ভাড়া নেয়। বেবিট্যাক্সিতে উঠার সময় একজন অপরিচিত লোক অনুনয়-বিনয় করে বেবিট্যাক্সির অপ্রতুলতার দোহাই দিয়ে তার কাছে লিফট চায়। সে গন্তব্য জানতে চাইলে অপরিচিতজন নিউমার্কেটে নেমে যাবে বলে উল্লেখ করে।
বেবিট্যাক্সি চট্টগ্রাম নিউমার্কেটের কাছে এলে সিরাজ শিকদার সেই অপরিচিতজনকে নেমে যেতে বলে। কিন্তু সেই অপরিচিতজন বেবিট্যাক্সি থেকে না নেমে তার দিকে পিস্তল উঁচিয়ে ধরে। সাথে সাথে পিস্তল হাতে ছয়জন সাদা পোষাকের পুলিশ বেবিট্যাক্সিটাকে ঘেরাও করে ফেলে এবং মহসিন সহ তাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর মহসিন সহ তাকে ডবল মুলিং থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওখান থেকে ফকার বিমানে ঢাকা।
... পুলিশের একটা বড় ফোর্স সিরাজ শিকদারকে যখন গণভবনে নিয়ে আসে, তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা ছিল। বঙ্গবন্ধু তার অপেক্ষায় তখনও গণভবনে। বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেব এবং গণভবনের স্টাফ। এছাড়া ছিল শেখ কামাল এবং শেখ ফজলুল হক মণি।
সিরাজ শিকদারকে যখন হ্যান্ডক্যাপ পরিয়ে অফিসকক্ষে আনা হয়, ঠিক সেই সময়টায় বঙ্গবন্ধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী সাহেবের সাথে তার গ্রেফতার হওয়া এবং পরবর্তী করণীয় কী- ওইসব বিষয় নিয়ে আলাপে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি কথায় ব্যস্ত ছিলেন বলে সিরাজ শিকদারের দিকে পুরোপুরি দৃষ্টি দেননি। সিরাজ শিকদার তখনও দাঁড়িয়ে। ওদিকে অফিসকক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী বাদে অন্যরা সবাই দাঁড়িয়ে ছিল। তাই তার দাঁড়িয়ে থাকাটাকে তিনি স্বাভাবিক ভাবে নেন, তাকে বসতে বলেননি।
সিরাজ শিকদার এতে বেশ ক্ষেপে যায়। ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠে, আপনি রাষ্ট্র চালান!... কী রাষ্ট্র চালান?...
বঙ্গবন্ধু কথা থামিয়ে হাঁ হয়ে তাকান। সিরাজ শিকাদারের এভাবে ক্ষেপে যাওয়া এবং হঠাৎ এমন অবান্তর প্রশ্নের কারণ বুঝতে পারেন না। এদিকে সামনেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বসা। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে গণভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ও পুলিশ ফোর্স। ছেলে শেখ কামাল ও ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি তো আছেই!...
বঙ্গবন্ধু এমনই বিব্রতবোধ করেন যে, তার কথার জবাবে তিনি তৎক্ষণাৎ কিছুই বলতে পারেন না।
সিরাজ শিকদার আবার বলে উঠে, আপনি রাষ্ট্র চালান, অথচ একজন রাজবন্দীকে কিভাবে সম্মান জানাতে হয়, তা শিখেন নাই। তাকে বসতে বলার সৌজন্যতাও আপনার নেই, না?...
একজন পুলিশ অফিসার উদ্যত আচরণের জন্য তাকে আঘাত করতে এগিয়ে আসে।
শেখ ফুজলুল হক মণি ক্ষেপে যায়।
শেখ কামালও ক্ষেপে উঠে।- এই সিরাজ শিকদারের জন্যই অসাবধানতায় একদিন পুলিশের গুলিতে গলায় গুলি লেগে মরতে মরতে বেঁচে ফিরে আসে!...
কিন্তু বঙ্গবন্ধু খুব বিব্রত হলেও খুব শান্ত আচরণ করেন। তিনি পুলিশ অফিসারকে বলেন, অফিসার, তাকে চেয়ারে বসতে দাও। এর আগে তার হ্যান্ডক্যাপটা খুলে দাও।
পুলিশ অফিসার নরম গলায় বলে, স্যার, সে খুব ডেঞ্জারাস! হ্যান্ডক্যাপ খুলে দেওয়া কি ঠিক হবে? যদি কিছু করে বসে?
বঙ্গবন্ধু ধমকের গলায় বলেন, ...ডেঞ্জারাস হোক আর যা-ই হোক, সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। বীর মুক্তিযোদ্ধা!... তার হ্যান্ডক্যাপ খুলে দাও।
পুলিশ অফিসার আর দ্বিতীয় বাক্য ব্যয় না করে সিরাজ শিকদারের হ্যান্ডক্যাপ খুলে দেয়।
হ্যান্ডক্যাপ খুলে নিতেই সিরাজ শিকদার একটু স্বাভাবিক হয়েও কেমন অহংকারী ভঙ্গিতে ধীর পায়ে চেয়ারে এসে বসে।
বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ আন্তরিক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ক্ষুধা আছে? কিছু খাবি?
সিরাজ শিকদার কথার জবাব না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করে, আপনি আমাকে এখানে কেন এনেছেন?
বঙ্গবন্ধু খুব শান্ত গলায় বলেন, তোরে বুঝাতে।
- কী বুঝাতে?
- তুই যে এতদিন ভুল করেছিস, পাপ করেছিস- ওটা বুঝাতে।
- আমি কোনো ভুল করি নাই।
- পাপ তো করেছিস?
- আমি পাপও করি নাই।
- অহংকার করছিস ভালো কথা। এই অহংকারই তোরে এখানে নিয়ে এসেছে। আচ্ছা তুই একটা কথা বল, তুই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলি কেন?
- আর কী জন্য, দেশটার স্বাধীনতার জন্য!
- দেশটা তো স্বাধীন হয়েছে। তোরাই কষ্ট করে স্বাধীন করলি। আমি চব্বিশ বছর সংগ্রাম করেছি। দেশটা স্বাধীন করার ব্যাপারে তোরা সবাই মিলে সহযোগিতা করেছিস। কিন্তু দেশ স্বাধীন করার পর তোরা এইটা কী রূপ ধরলি? কোথায় যুদ্ধবিধ্বস্ত ভাঙা দেশটারে গড়ে তুলবি। কিন্তু না, তোরা ধ্বংসাত্বক কাজে মত্ত হয়েছিস! দেশটারে ধ্বংস করছিস!...
- এইজন্য দায়ী আপনি এবং আপনার দল।
- আমি দায়ী?- তুই জানিস, এই দেশটা চালাতে গিয়ে আমার বয়স বিশ বছর বেড়ে গেছে! একটার পর একটা রোগ এসে শরীরে ভিড় করেছে। এইমুহূর্তে আমি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে পারলে বাঁচি। ক্ষমতার লোভ আমার কখনই ছিল নারে!... ক্ষমতার লোভ থাকলে তো আমি সারা পাকিস্তানেরই প্রধানমন্ত্রী হতে পারতাম। শোন, আর তিন-চারটা বছর। তারপর আমি রিটায়ারমেন্টে চলে যাবো। এর আগে আমি আমার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে যাবো। দেখি তোরা কে কত বাধা দিতে পারিস!...
- আমরা বাধা দিলাম কোথায়?
- তোরা বাধা দিস নাই?- খুনখারাবি, লুণ্ঠন, ব্যাংক ডাকাতি, মিথ্যা প্রচারপত্র বিলি- কী করিস নাই তোরা? গণতন্ত্রের নিয়মে রাজনৈতিক দল করায় কারো আপত্তি থাকার কথা না। কিন্তু তোরা তো রাজনৈতিক দল গঠন করিস নাই, করেছিস গুপ্ত সংগঠন। চরমপন্থি গুপ্ত সংগঠন। আমারে একটা কথা বল, তোরা কি এই দেশটার স্বাধীনতা মানিস?
- স্বাধীনতা মানবো না কেন?
- তাহলে তোরা ষোলই ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস এলে সেইদিন ‘কালো দিবস’ পালন করিস কেন?
সিরাজ শিকদার কোনো জবাব দিল না।
বঙ্গবন্ধু বললেন, তোরা যদি দেশটার স্বাধীনতাই মানবি, তাহলে দেশ স্বাধীনের পরদিন থেকেই কেন বলে আসছিস, তোরা আরও কী সব যুদ্ধ করবি?
সিরাজ শিকদার এবারও চুপ।
বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বললেন, তোরা তো তোদের পার্টির নাম থেকে এখনও ‘পূর্ব বাংলা’ শব্দটাই বাদ দিস নাই! এখনও রাখছিস। তোদেররে আর কী বলবো!...
এতক্ষণ পর শেখ ফজলুল হক মণি কিছু বলতে যাবে, বঙ্গবন্ধু ইঙ্গিতে তাকে থামিয়ে দিলেন। শেখ কামাল প্রথম থেকেই চুপচাপ। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেব সিরাজ শিকদারের পাশে চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। সিরাজ শিকদারের ঠিক পেছনেই খানিকটা দূরে পুলিশ অফিসার, পুলিশ স্টাফ এবং গণভবনের স্টাফরা দাঁড়িয়ে আছে। সবারই উৎসুক দৃষ্টি বঙ্গবন্ধু ও সিরাজ শিকদারের উপর।
- আপনারা ঠিক থাকলে তো আমাদের এই নতুন করে সংগ্রামে নামতে হতো না।– সিরাজ শিকদারের গলায় আগের সেই অহংকার নেই। গলার স্বরে কিছুটা নিস্তেজ ভাব।
বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করেন, আপনারা মানে, কারা?
- আপনার পার্টি, আওয়ামী লীগ।
- মানলাম আমার পার্টির কেউ কেউ দুর্নীতি করেছে, লোভ করেছে। কেউ কেউ দলের সুযোগ নিয়ে চোরাকারবারি-দুই নম্বরি করেছে। কিন্তু একটা বড় পার্টিতে ওদের সংখ্যা তো খুবই কম।
- খুব কম না, অনেক বেশি।
বঙ্গবন্ধু মাথা নাড়েন। বলেন, অনেক বেশি না, খুব কম সিরাজ! অইগুলোরে পার্টি থেকে অতি তাড়াতাড়ি ঘাড় ধরে বিদায় করবো!... আমরা প্ল্যান করেছি, আওয়ামী লীগ ভেঙে দিয়ে সবদলের ঐক্যমতে নতুন একটা পার্টি করবো। নতুন পার্টির নাম দেবো, বাকশাল।– বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ। আওয়ামী লীগের ভিতরের দুর্নীতিবাজদের দূর করার জন্য এবং সোনার বাংলা গড়ার জন্যই আমার এই সিদ্ধান্ত। আমি অতি তাড়াতাড়ি দেশে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেবো।
সিরাজ শিকদার কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, দ্বিতীয় বিপ্লব?
- হ্যাঁ, দ্বিতীয় বিপ্লব। দেশ গঠনের জন্য দ্বিতীয় বিপ্লব। দেশ তো স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু এই তিন বছরের মাথায় এসে খোঁজে পেলাম, দেশটা যেভাবে চলার কথা ছিল, ঠিক সেভাবে চলছে না।- দেশরে ঠিকভাবে এগিয়ে নিতে হবে। তখন তোদের মতো মেধাবী তরুণ রাজনীতিবিদ প্রয়োজন হবে। আমি জানি তোরা ভুল করেছিস। পাপও করেছিস অনেক। এইজন্য তোদের জেল হবে, সাজা হবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোরা জেল থেকে শুদ্ধ হয়ে বের হবি।- আমিও তো জেল খেটেছি অনেক। জীবনের অনেকগুলো বছরই তো জেলে থাকলাম। কতবার যে আমি জেলে গেছি, হিসাবটা আমার কাছে নাই!... কিন্তু আমি তোদের মতো অন্যায় করে জেল খাটি নাই। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমারে অন্যায়ভাবে ষড়যন্ত্র করে একের পর এক আমারে জেলে আটকায়ে রেখেছিল। তবে আমি কখনই হতাশ হই নাই। ওরা আমারে জেলে রাখুক আর যেখানেই রাখুক, সবসময়ই আমি দেশের জন্য, জনগণের জন্য কাজ করেছিলাম!...
বঙ্গবন্ধু একটু থামেন। দিয়াশলাইর কাঠি ফস্‌ করে জ্বালিয়ে হাতের পাইপটা ধরান। কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে কী ভাবেন।
সিরাজ শিকাদারও চুপ। সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
বঙ্গবন্ধু বুঝানোর ভঙ্গিতে আবার শুরু করেন, দেখ সিরাজ, তোরা এখনও বয়সে তরুণ। সামনে অনেক সময় পড়ে আছে। আমার একটা অনুরোধ রাখবি?
সিরাজ শিকদার দৃষ্টি তোলে। তার দৃষ্টিটা বেশ নরম ও শান্ত, আগের সেই অহংকার বা ক্রোধ- কিছুই নেই। সে জিজ্ঞেস করে, কী অনুরোধ?
বঙ্গবন্ধু বলেন, শোন, বিচারে তোর সাজা হবে এটা সত্য। আইনের উর্ধ্বে তো কেউ না। কিন্তু তুই যদি আত্মপক্ষ সমর্থন করে স্বীকারোক্তিমূলক বয়ান দিস্‌, তাইলে আমি বিচার বিভাগের কাছে অনুরোধ রাখবো, যাতে তোর সাজার মেয়াদ কম হয়।– সিরাজ, তুই কি আত্মপক্ষ সমর্থন করে স্বীকারোক্তিমূলক বয়ান দিবি?
বঙ্গবন্ধুর সরল অনুরোধে সিরাজ শিকদার মৃদু হাসে। সে কোনোরকম দ্বিধা না করে ঘাড় হেলিয়ে সায় দেয়।
বঙ্গবন্ধু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সবার দিকে তাকিয়ে হাসেন। বেশ তৃপ্তির হাসি। তিনি বলেন, সিরাজ, আমি জানতাম তুই রাজি হবি। আমার অনুরোধ ফেলতে পারবি না। তোরে আরেকটা অনুরোধ করি, তুই কি তোর বাকি সঙ্গীদেরও হদিস দিবি?- ওদেররেও আমি তোর মতো সমান সম্মান দিবো। তুই পারবি না এই কাজটাও করতে?
সিরাজ শিকদার এবারও সহজভঙ্গিতে সায় দেয়।
বঙ্গবন্ধু বেশ উৎফুল্ল হন। বলেন, আমি জানতাম। সত্যই আমি জানতাম!... এইজন্যই তো তোরে আমি বুদ্ধি করে গণভবনে নিয়ে এসেছি!... শোন সিরাজ, জেনারেল আইয়ুব খানের সেই নিষ্ঠুর শাসনামলের সময় আমার ছয় দফা আন্দোলনে তোরাই তো আগায়ে এসেছিলি। তোরা না থাকলে কি উনসত্তরের গণআন্দোলন হতো? তোদের বাদে কি আমরা সত্তরে নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারতাম? একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলন, তারপর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ তো তোরাই করেছিস!...
সিরাজ শিকদার নরম দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকে। কথার জবাবে কিছু বলে না।
সেই রাতে বঙ্গবন্ধু বেশ আবেগ তাড়িত হয়েই সিরাজ শিকদারের সাথে রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করেন। দেশ গঠন, সমাজ গঠন, দ্বিতীয় বিপ্লবের পরিকল্পনা, বাকশাল গঠন, স্বপ্নের সোনার বাংলা!... রাত বারোটা পর্যন্ত ওদের আলাপ চলে। ততক্ষণে শেখ কামাল চলে যায়। শেখ ফজলুল হক মণিও আর বেশিক্ষণ বসেনি। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেব অবশ্য শেষ পর্যন্ত ছিলেন।
রাত বারোটার পর বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপ শেষে সিরাজ শিকদারকে গণভবন থেকে নিয়ে এসে পুলিশ হাজতে না রেখে রাজবন্দীদের চেয়েও উঁচু মর্যাদায় রক্ষীবাহিনীর কার্যালয়ের একটা কক্ষে রাখা হয়।
পরদিন সিরাজ শিকদারকে এস.বি. অফিসে আসে। সেখানে সে স্বীকারোক্তিমূলক বয়ান দেয়। স্বীকারোক্তিমূলক বয়ানে সে আরও তথ্য জানায় যে, সাভারের একটা গোপন আস্তানায় তার সর্বহারা পার্টির কিছু নেতাকর্মী ভারি অস্ত্রশস্ত্র সহ অবস্থান করছে!...
এই তথ্যের মধ্যে সিরাজ শিকদারে ভেতরগত চালাকি ছিল। শুধু সে তথ্য দিয়েই নয়, আগের রাতে বঙ্গবন্ধুর সব কথাকে সায় দেওয়ার মধ্যেও তার প্রচণ্ড চালাকি ছিল। সে বঙ্গবন্ধুকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল!... আসলে সে মনে মনে আশা পোষণ করছিল যে, কোনোমতে ঢাকার বাইরে যেতে পারলে সে পালানোর চেষ্টা করবে। আর যদি সে পালাতে না পারে, তাহলে স্বেচ্ছায় পুলিশের গুলিতে মারা যাবে! যেটাকে বলা যায় আত্মহত্যা করার মতো ইচ্ছাকৃত মৃত্যু!... আর যা হোক, পার্টির প্রধান হয়ে সে তার পার্টির সাথে, পার্টির কর্মীদের বিরুদ্ধে গিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করার মতো বেঈমানি করতে পারবে না! কখনও না!... তার চরমপন্থি ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’র নিয়মনীতিতে প্রধান শর্তই ছিল, কোনো নেতা বা কর্মী যদি পুলিশের হাতে বা সরকারি কোনো বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে, প্রয়োজনে সে আত্মহত্যা করবে, কিন্তু কখনও মুখ খুলবে না!...
এস.বি. অফিস থেকে জানুয়ারির দুই তারিখ দুপুরে সিরাজ শিকদারকে আবার শেরেবাংলায় রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসা হয়। সন্ধার পর চারটি ডজ গাড়ি এবং একটি টয়োটা গাড়ি ভর্তি পুলিশ তাকে তার সঙ্গীদের আস্তানার খোঁজ দেওয়ার জন্য সাভার নিয়ে আসে। সাভার আসার সময় নিরাপত্তাজনিত কারণে পুলিশবাহিনী তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে রাখে।
সাভারের তালবাগ এলাকায় গাড়িগুলো আসার পর নিজের পরিকল্পনা মতোই সিরাজ শিকদার হাতকড়া পরা অবস্থাতেই গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পালানোর চেষ্টা করে।
পুলিশ তৎক্ষণাৎ তৎপর না হলে সিরাজ শিকদার প্রায় পালিয়েই যাচ্ছিল!... কিন্তু পেছন থেকে পুলিশের ছোড়া অসংখ্য গুলির কয়েকটা এসে তার প্রাণ কেড়ে নেয়!...
ঘটনাটা ঘটে রাত নয়টায়!...
পরদিন সকালেই বঙ্গবন্ধুকে খবরটা জানানো হয়। তিনি এতে খুব মর্মাহত হন। তিনি বুঝতে পারেননি, ঘটনা কোথায় থেকে কোথায় গড়িয়েছে!... তিনি বহুবার কারণগুলো খোঁজার চেষ্টা করেন, তাহলে কি আগেরদিন রাতে গণভবনে সিরাজ শিকদার তার সাথে মিথ্যা আশ্বাস ও সবকথায় সায় দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?...
বঙ্গবন্ধু অন্যদিক দিয়েও ভাবেন, বিগত তিন বছরে সে এবং তার চরমপন্থি দল- পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতাকর্মীরা সবচেয়ে বেশি আঘাত করে গ্রামগঞ্জের থানা-পুলিশের দপ্তরে। এতে বহু থানা লুণ্ঠন হয়, বহু পুলিশ সদস্য মারা যায়। তাই সেই চরমপন্থি দলের নেতার হিসেবে সিরাজ শিকদারে প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ থেকে পুলিশবাহিনী ওই কাণ্ডটা করেনি তো?...
তারপর আজ সাতটা মাস গেল। এই সাত মাসে তাঁর শত্রুরা সিরাজ শিকদারকে নিয়ে জনগণের কাছে কত গল্পই না ফেঁদেছে!... বঙ্গবন্ধু মাঝেমধ্যে ভাবেন, তাঁর তো সব মানুষের মতোই দুইটা চোখ, দশটা চোখ না। ঘটনার পেছনে কত ঘটনা তাঁর যে অগোচরে ঘটে যায়!...
সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর একুশ দিন পর বঙ্গবন্ধু সংসদ ভবনে ক্ষোভে, দুঃখে ও কষ্টে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘...আজ কোথায় সিরাজ শিকদার!’... ওই কথা নিয়েও শত্রুপক্ষের কত তোলপাড়! অথচ কেউ তাঁর ভেতরের কষ্টটা দেখে না, ভালোবাসাটুকুও না!...
একটা ঘটনার কথা বঙ্গবন্ধুর মনে পড়ল। খুব ছোট্ট ঘটনা। তারপরও তাঁর এইমুহূর্তে তা মনে পড়ল। ঘটনাটা সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর পরদিনের, জানুয়ারির তিন তারিখের।...
যে ছোট্ট ঘটনাটা যার সাথে ঘটে, তার নামও সিরাজ, মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন। সে-ও একসময় মোহাম্মদ তোয়াহা সাহেবের বাম ছাত্র সংগঠন করত। সেটা সেই চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন সালের দিকে।
বঙ্গবন্ধু মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীনকে চিনেন সেই চুয়ান্ন সাল থেকেই। মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন তখন চৌমুহনী কলেজের আই.এ-র ছাত্র। আর বঙ্গবন্ধু চৌমুহনী কলেজে গিয়েছিলেন যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে। সেই থেকে পরিচয়। তারপর রাজনীতির প্রয়োজনে তাদের অনেক স্থানে দেখা হয়। বর্তমানে মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন পরিকল্পনা কমিশনে কর্মরত, যুগ্মসচিব। সেই কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন বঙ্গবন্ধু নিজে।
বঙ্গবন্ধু যেহেতু পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান, তাই মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীনের সাথে মাঝেমধ্যেই তাঁর দেখা হয়। জানুয়ারির তিন তারিখ মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি নিয়ে তাঁর কাছে সাক্ষাৎ করতে এসেছিল।
দীর্ঘদিনের পরিচয়ের সূত্র ধরে যুগ্ম সচিব হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীনকে ‘তুই’ সম্বোধনে ডাকেন। অফিসিয়াল কাজকর্মের বাইরে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলাপ করেন। এছাড়া তিনি তাকে পছন্দ করেন তার অকপটতার জন্য। সে যা বলে সামনেই বলে, আড়ালে কোনো কিছু বলে না।
বঙ্গবন্ধুর নিজেরও একই স্বভাব, তিনি যা বলেন সবার সামনে বলেন, পেছনে কথা বলা পছন্দ করেন না। তাই অনেক সময় মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন কঠিন কোনো সমালোচনা করে বসলেও তিনি হাসি মুখে শোনেন।
সেদিনও বঙ্গবন্ধু অফিসিয়াল কাজ শেষ মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীনদের দিকে তাকাতেই সে অনুযোগের সুরে সরাসরি বলে উঠে, স্যার, লোকটাকে মেরে ফেললেন?
বঙ্গবন্ধু তৎক্ষণাৎ বোঝে উঠতে না পেরে জিজ্ঞেস করেন, তুই কার কথা বলছিস?
- সিরাজ শিকদারের কথা।
এমনিতেই সকালে সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর খবরটা শোনার পর থেকে সারাটা দিন বঙ্গবন্ধুর মনটা খুব বিষণ্ণ ছিল, তার উপর মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীনের কথা শুনে তাঁর মনটা আরো বিষণ্ণ হয়ে যায়। তিনি তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে বলেন, চল!...
মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করেন, কোথায় স্যার?
বঙ্গবন্ধু বলেন, আমাকে অনুসরণ কর।
মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন মাথা ঝাঁকিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে।
ওরা গণভবন থেকে বের হয়ে দীর্ঘ ঘাসের লন পেরিয়ে লেকের কাছে এসে দাঁড়ায়।
এরিমধ্যে কোথায় থেকে এসে জিল্লুর রহমান সাহেবও দাঁড়ান।
গণভবন থেকে বের হয়ে লেকের পাড়ে আসা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু একটা কথাও বলেননি। এমন কী জিল্লুর রহমান সাহেবকে দেখেও না।
বঙ্গবন্ধু লেকের ঘাটপাড়ের সিঁড়ি বেয়ে পানির কাছাকাছি আসেন। কী ভেবে লেকের পানির দিকে একটা দীঘল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে সিঁড়িতে উবু হয়ে বসেন। তারপর ডানহাতটা পানিতে ডুবিয়ে আবেগের গলায় ডাকেন, আয়, আয় ,আয়!...
বঙ্গবন্ধুর ডাকে তৎক্ষণাৎ অসংখ্য ছোটবড় মাছের পোনা তাঁর ডুবন্ত ডানহাতের উপর লুটোপুটো খেতে শুরু করে। মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন এবং জিল্লুর রহমান সাহেব অবাক হয়ে সেই অভুতপূর্ব দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাছের পোনাগুলো ভালোবাসায় কেমন নির্ভয়ে নির্বিগ্ন!...
বেশ কয়েক মুহুর্ত বঙ্গবন্ধুর হাতের উপর মাছের সেই লুটপুটো খেলা চলে।
বঙ্গবন্ধু তারপর উঠে দাঁড়ান। সিঁড়ি বেয়ে কয়েকধাপ উপরে উঠেন। তিনি মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীনের দিকে পূর্ণাংগ দৃষ্টিতে তাকান। আস্তে করে বলেন, সিরাজ উদ্দীন, তুই যা, পানিতে হাত দে!...
মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন সিঁড়িতে নেমে উবু হয়ে বসে ডানহাতটা পানিতে ডুবিয়ে দেয়। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখে, বঙ্গবন্ধুর ডাকে আসা মাছের পোনাগুলো স্বচ্ছ পানির নিচে তিড়িংবিড়িং করে তার হাত দেখেই লুকিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা মাছের পোনাও তার হাতের কাছাকাছি নেই।
মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সে সিঁড়ির দুই ধাপ উপরে উঠে আসে। সে বিব্রত এবং অবিশ্বাস্য চোখে বঙ্গবন্ধু দিকে তাকায়। তাকিয়ে সে একটা অপ্রস্তুতের হাসিও দেয়। সে জিজ্ঞেস করে, এটা কী হল স্যার?
বঙ্গবন্ধু সাথে সাথেই মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীনের কথার জবাব দেন না। তিনি আগের মতোই দীঘল দৃষ্টি মেলে লেকের পানির দিকে তাকিয়ে থাকেন। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে তিনি বিষণ্ণ গলায় বলেন, বোঝছিস সিরাজ উদ্দীন, একটা কথা কী, আমি ওদেররে ভালোবাসলে ওরা মাছ হয়ে আমার ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানে। আমারে ভালোবাসে!... কিন্তু তোরা মানুষ হয়ে পারিস না!
-তালপাতার পুথি-২ চ্যাপ্টার-৭
মহিবুল আলম

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১:১৪

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: সিরাজ শিকদারের মৃত্যু যেভাবেই হোক, এই মৃত্যুকে ঘিরে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি অনেকটাই ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

২| ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১:১৬

ঢাকার লোক বলেছেন: এর কতটা ইতিহাস আর কতটা গল্প সে প্রশ্নের উত্তর দিবে কে ?

৩| ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১:২৪

চাঁদগাজী বলেছেন:


এটা কি লেখা, নাকি ম্যাঁওও ম্যাঁও প্যাঁও প্যাঁও?

৪| ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ২:৫৮

জগতারন বলেছেন:
সিরাজ সিকদার আর কর্নেল তাহের দুই সন্ত্রাসি আর দানব স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে মধ্য ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে দুনিয়া থেকে বিদায় না করা পর্যন্ত বাংলাদেশে এক মহা তান্ডব চালিয়েছিল। তা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায় নতুন প্রজন্মের কাছে। কিন্তু আমি দেখেছি আমাদের এলাকায়। তখন আমার বয়স ১২/১৩ বছর। কত মা'য়ের সন্তান যারা ছিলেন সম্ভাবনাময় তরুন যুবক ও মুক্তিযোদ্ধা যাদের স্বাধীন বাংলাদেশের থেকে অকালে সরায়ে দিয়েছে তার ইওত্তা নেই।

একজন সন্ত্রাসী (সিরাজ সিকদার) আরেকজন দানব (কর্নেল তাহের) তাদের জাহান্নামের নিকৃষ্ট স্থানে পাঠিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর জেনারেল জিয়া।

তার পরে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত (স্বঘোষিত জেনারেল ও রাষ্ট্র পতি) খুনি জিয়া কত প্রশিক্ষিত মুক্তি যোদ্ধা আর্মি অফিসারদের ফাঁসী দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে বিদায় করেছে তার সঠিক পরিসংখান হয়তো খুজলে পাওয়া যাবে।

৫| ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:২৯

রাজীব নুর বলেছেন: পড়লাম। তবে লেখাটা বড্ড অগোছালো।
হুমায়ূন আহমেদ তার দেয়াল উপন্যাসে সিরাজ শিকদার সাহেবকে নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।

৬| ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:১৬

উচ্ছল বলেছেন: সবই রাজনীতির খেলা, দিন শেষে দোষ পরাজিত নন্দঘোষের।

৭| ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৯

পলাশবাবা বলেছেন: সিরাজ শিকদারের হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় পালানোর চেষ্টা , নিরুপায় পুলিশের গুলি , বাদ ছিল শুধু "ওত থাকা সহযোগিদের" গুলি বর্ষন আর ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা ...... আধুনিক ক্রসফায়ারের গল্পের সাথে এতটুকুই পার্থক্য।

তবে আমি সব সময়ই বাকশাল আর রক্ষীবাহিনীকে বিশ্বাস করার চেষ্টা করেছি। সেই চেষ্টা এখনও চলছে। আমার ধারনা এই চেষ্টা আগামীতেও থাকবে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.