নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফেসবুকে আমি - রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার )

কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্পঃঝরা দিন, ঝরা রাত

০৫ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৩৯

শীত চলে গিয়ে একটু একটু গরম হাওয়া বইতে শুরু করে দিয়েছে, তবুও গায়ে হাতা কাটা সোয়েটার পরেই জুঁইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সাব্বির। জুঁই বসে থাকা যে গাছের শিকড়ের উপর, সে গাছেই নতুন পাতায় ভরে আছে। শীতে ঝরে যাওয়া পাতা, নতুন করে ভরিয়ে দিচ্ছে গাছটাকে।

- আমি কিন্তু তোমাকে একবারও বলি নি সিলেট থেকে চলে আসতে।
জুঁই বেশ শান্ত গলায় বলল। সাব্বির একটুখানি মাথাটা উঁচু করে উত্তর দিল, ওখানে থাকলে দেখা করতে আসতে সমস্যা হত, প্রতি সপ্তাহে।
- তুমি ঢাকা চলে আসলেই সব ঠিক হয়ে গেল না।
- তুমি তো দেখা করা নিয়েই রাগ করতে।
- শুধু দেখা করা নিয়ে আমার রাগ ছিল না। রাগ করার আরও অনেক কারণ ছিল।

এইটুকু বলে একটু দম নিল জুঁই। দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো, তুমি চলে আসলে ঢাকায়, এখন কি করবে?
- আবার কোচিং করব। ঢাকায় ভর্তি হব। তোমার সাথে তাহলে নিয়মিত দেখা হবে।
- আমাদের দেখা হবে না আর। তোমার আমার সব কিছু অনেক আগেই শেষ।

সাব্বির একটু নিচু হয়ে জুঁইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার সাথে এমন কেন করছ? অপরাধ কি আমার?
- অপরাধ নেই কোন। তুমি আমার এমনিতেই সমবয়সী। সমবয়সী ভালবাসা গুলো এমনিই কয়েক বছর পর টানা পোড়নে পড়ে যায়। তার উপর আবার এক বছর গ্যাপ দিয়ে আমার জুনিয়র হয়ে যাচ্ছ।
- আমি তো তোমার জন্যই আসলাম।
- আমি তোমাকে একবারও আসতে বলি নি সাব্বির। তুমি একবারের জন্যও বুঝতে চাচ্ছ না যে, আমি তোমাকে এড়িয়ে চলতে চাচ্ছি। সম্পর্কটা আর টেনে নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।

সাব্বির হাঁ করে তাকিয়ে রইল জুঁইয়ের দিকে। একটা মানুষ হুট করে এতো বদলে যেতে পারে, ভাবতে বড় অবাক লাগে সাব্বিরের। জুঁই এমন না, সত্যি জুঁই এমন না, বিশ্বাস করে সাব্বির। জুঁই চলে যাচ্ছিল, পিছন থেকে সাব্বির বলল, একটু শুনবে?
জুঁই দাঁড়াল একটু।
- আমি যদি ঢাকা ভার্সিটিতে ফার্মাসিতে চান্স পাই, তুমি ফিরে আসবে?

জুঁই ছোট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আস্তে করে বলল, আচ্ছা আগে পাও।
বলেই হাঁটতে শুরু করল। সাব্বির ঠায় দাঁড়িয়ে রইল, সেই নতুন পাতায় ভরে থাকা গাছের নিচে। মোবাইলে সময় দেখল, ৪ টা ৩৫। তারিখ দেখল, ০২/০৪/২০১২। প্রায় তিন মাস ক্লাস করল সিলেটে, শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। খুব একটা খারাপ জায়গায় ছিল না, বরং বলাই যায় ছিল বেশ ভাল একটা অবস্থানে। সি এস ই তে ভর্তি ছিল। সপ্তাহে দুই দিন বন্ধ। বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষেই সন্ধ্যায় রাতের ট্রেন ধরে ঢাকা চলে আসত। কখনও টিকেট পাওয়া যেত, কখনও যেত না। রাত জেগে দাঁড়িয়ে আসতে হত কখনও। বাসায় পৌঁছে সকালের নাস্তা করেই ছুট লাগাত জুঁইয়ের সাথে দেখা করতে। ভিতরে কোন ক্লান্তি কাজ করত না, সারা রাত জেগে এসে বিশ্রাম না নিয়েই দেখা করতে এসে। বরং বড় সুখ লাগত, হৃদয়ে একটা ভাল লাগার কাঁপন আসত। জুঁইয়ের স্নিগ্ধ মুখটার দিকে তাকালেই সব ক্লান্তি হারিয়ে যেত। এতো দূর থেকে শুধু দেখা করার জন্য এসেছে সাব্বির, এই ভেবেও বেশ ভাল লাগত জুঁইয়ের। চলছিল সব ভালই, যেমন চলত আগে ভাল সব। তবুও মাঝে মাঝেই একটু সমস্যা হয়েই যেত। ১৪ ফেব্রুয়ারী ছিল মঙ্গলবার, ভালবাসা দিবস। ভালবাসা সারা বছর থাকলেও, সে দিনটায় দেখা করা কেন যেন নিয়ম। ভার্সিটি বন্ধ না মঙ্গলবার। ইচ্ছা করলেই চলে আসা যায় না ঢাকা। জুঁইকে বলে সে কথা। জুঁই বেশ গম্ভীর হয়ে বলে, তুমি না আসতে পারলে আর কি করা? আসতে হবে না।
সাব্বিরের তবু মনে হয় জুঁই বুঝি রাগ করে বলেছে। নিজে থেকেই বলে, জুঁই, আমি আসি মঙ্গলবার।
- না আসতে হবে না। তোমার ল্যাব আছে। আমারও ক্লাস আছে। তাছাড়া তুমি আসলেও দেখা করতে পারব না। মঙ্গলবার আম্মু আসবে আমার হোস্টেলে।
১৪ তারিখ দেখা হয় না। সাব্বির থাকে সিলেটে, জুঁই ঢাকাতে। জুঁই না করেছে, যেতে চেয়েছিল সাব্বির। তবুও সকাল থেকে রাগারাগি করে জুঁই। সাব্বির সে রাগারাগির উত্তরে বলতে পারে না কিছু।
শুধু রাগ করত জুঁই ব্যাপারটা তেমন ছিল না। এতো দূরে চলে এসে সত্যি মনে হত একটা দূরত্ব, একটা ফাঁকা জায়গা সত্যি তৈরি হয়ে গিয়েছে দুজনের মাঝে। যে ব্যাপার গুলো বড় সহজ মনে হত, সে ব্যাপার গুলোতেই রাগ লাগত সাব্বিরের। সাব্বির একটু একটু করে বদলে যাচ্ছিল, কিন্তু এ বদলে যাওয়ার উপর কোন হাত ছিল না নিজের। সাব্বির ভালবাসার মানুষ, ভালবাসার মানুষটার সাথে সব বলবে এটাই স্বাভাবিক। জুঁই ঠিক বলত সারাদিনে যা ঘটেছে সব।
সেদিন মোবাইলে কথা বলবার সময়টায় বলল, আজ আমাদের ব্লাড টেস্ট করানো শিখাল। আমার ক্লাসে যেতে একটু লেট হল, সবার প্রায় শেষ রক্ত দেয়া। আমার তো সুঁই দেখলেই ভয় লাগে। আমি কি করে রক্ত দিব পরীক্ষা করার জন্য? শেষে দুজন আমার হাত ধরে রক্ত নিল। আমি চোখ বন্ধ করে কোন মতে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
- হাত ধরেছিল কে?
- হাত ধরেছিল মিনা আর রক্ত নিয়েছিল মিজান।
- মিজান মানে? একটা ছেলে তোমার হাত ধরল?
- হাত ধরবে কেন? ও রক্ত নিয়েছিল।
- হাত না ধরে তো আর রক্ত নেয়া যায় না, তাই না?
- আরে মেয়েরা কেউ ভাল ভাবে পারে না। তাই ম্যাডাম বলল মিজানকেই নিতে।
- থাক, আমাকে আর বুঝাতে হবে না। আজব, কমন সেন্স বলেও তো একটা ব্যাপার থাকা উচিৎ। একটা ছেলে তোমার হাত ধরে রক্ত নিয়েছে, ঐ গল্প এসে আমাকে শুনাচ্ছ?
- তুমি এমন করছ কেন, এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা নিয়ে?
- এটা স্বাভাবিক? একটা ছেলে তোমার হাত ধরছে এটা স্বাভাবিক লাগছে তোমার?
- আবারও একই কথা বলছ। এখানে হাত ধরবার কি দেখলে তুমি?
- কিছুই দেখি নি। ধ্যাৎ।

বলেই মোবাইল রেখে দেয় সাব্বির। রাগে কাঁপতে থাকে। এই নিয়ে মোট দু দিন ঝগড়া। যে রাগ করে থাকে সাব্বির, সে রাগ উল্টো করে জুঁই। একটা ক্লাসমেট কাজের খাতিরে একটা কাজ করেছে। এটার মধ্যে খারাপ কিছু নেই। খারাপ ভাবে নেয় নি জুঁই, কিংবা খারাপ কিছু ছিল না মিজানের মনেও। তবুও রাগ লাগে সাব্বিরের। রাগ করার কি আছে জানে না, তবুও লাগে। সাব্বির এমন না, এতো সহজে রাগ করার মত ছেলে না। তবুও রাগ করে।
সাব্বির প্রতিটা দিন ক্লাস শেষে জানতে চায় কথা বলেছিল কিনা কোন ছেলের সাথে। জুঁইয়ের এসব ভাল লাগে না। জুঁই বিরক্ত নিয়ে বলে, তুমি আমার কাছে এসব জানতে চাও কেন?
- কেন? বলতে সমস্যা?
- না সমস্যা না। কিন্তু বলার মত কিছু থাকলে আমি তো বলবই, এভাবে জিজ্ঞেস করার কি আছে? এমন ভাবে জানতে চাচ্ছ মনে হচ্ছে তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছ।

সত্যি কি অবিশ্বাস করছে জুঁইকে সাব্বির, বুঝতে পারে না সাব্বির। হয়ত করছে, কিংবা করার কথা নয়। যেখানে ভালবাসা সত্যি থাকে, সেখানে অবিশ্বাসের কথা আসে না। তবুও ভিতরে ভিতরে জ্বলে যায়, জুঁইয়ের আশেপাশে কোন ছেলের কথা শুনলে। প্রতিদিন জানতে চায়, মেডিকেল কলেজের কোন বড় ভাই বিরক্ত করেছে কিনা, ভালবাসার কথা বলেছে কিনা। তেমন কিছু হলে বলত জুঁই। তবুও মনের মাঝে খচ খচ করে। দূরত্ব মনটাকে বদলে দেয়। মনের ভিতরের অনেক কিছু পাল্টে দেয়। ছোট খাটো বিষয় গুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত ঝগড়া বেধেই থাকে। আগেও ঝগড়া হত, সে ঝগড়া গুলো দেখা হলেই ভেঙে যেত। এতোদূর থেকে প্রতিটা দিন দেখা করা যায় না। ঝগড়া গুলোও মিটে যায় না। ঝগড়া করে মাঝে মাঝেই জুঁই মোবাইল বন্ধ করে রেখে দিত। সাব্বির করে বেরাতো সে সময়টায় যে পাগলামি গুলো সে গুলোও বড় অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মত। একরাত সারারাত বৃষ্টি হল। ঝুম বৃষ্টি। আকাশে যখন তখন চমকাচ্ছে বিজলী। তার মধ্যেই সারারাত দাঁড়িয়ে রইল সাব্বির। জেদ ধরল জুঁই যতক্ষণ না কল করবে ঘরে যাবে না। সত্যি যায় নি। এ খামখেয়ালী গুলো করার কোন মানে নেই। তবুও করে সবাই, করে যেমন সাব্বির। তেমন খামখেয়ালীতে চলে আসল সিলেট ছেড়ে ঢাকায়। আবার কোচিং করবে। ভর্তি হবে ঢাকায়। দেখা করবে সবসময় জুঁইয়ের সাথে। রাগ হলেই ভাঙাতে যাবে। নিজেকে বদলাবে সাব্বির। ঢাকা চলে আসা নিয়ে বাবা মায়ের সাথেও কথা কাটাকাটি হল অনেক। সাব্বির বলে দিল, আমার সিলেট ভাল লাগে না।
বাবা বলেন, তোর ভাল লাগল না আর চলে আসলি তুই? পড়বি না তাইলে এতো গুলো টাকা দিয়া ভর্তি হইলি কেন?
বাবা খারাপ ভাষায় একটা বকা দেন সাব্বিরকে। সাব্বির বুঝতে পারে নতুন করে ঢাকায় চলে আসা, কোচিং এ ভর্তি হওয়া, আবার অনেক গুলো টাকার ব্যাপার। বাসা থেকে ফার্মগেটে গিয়ে এতো দূরে কোচিং করাও যাবে না। ফার্মগেট মেসে থাকতেও টাকা পয়সার ব্যাপার। বাবার উপর অনেক চাপ পড়ে যাবে।
বাবা চিৎকার করে বলেন, তোর কোচিং এর টাকা তুই যোগাড় করবি। কই থিকা যোগাড় করবি তুই জানিস। টাকা কি বলদের ...... দিয়া পড়ে। চাইলেই পাওয়া যাইবে। থাপড়াইয়া কান ফাটাইয়া দেয়া দরকার।
অনেক কথা কাটাকাটির পরও, তিন দিন পরেই মা এসে চুপিচুপি সাব্বিরের হাতে টাকা দিয়ে দেন। কোচিং এ ভর্তি হবার জন্য। মা বলেন, তোর কি ফার্মগেটে মেসে থাকতে হবে?
সাব্বির ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে। ফেলে বলে, না মা, এখান থেকেই কোচিং করব।
- এতো জার্নি করে পারবি ক্লাস করতে?
- পারব। ওখানে কি না কি খাব। তার চেয়ে বাসায় তোমার রান্না খাব। এটাই তো ভাল।

বাসা থেকেই কোচিং করে সাব্বির। যাওয়া আসায় ৫ ঘণ্টার মত চলে যায়। কোচিং এ যায় সময় আরও। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার পর এসে আর পড়তে মন চায় না। মনটাও ভাল লাগে না। জুঁই কথা বলে না আর সাব্বিরের সাথে। কল দিলে ধরে না। মাঝে মাঝেই অনেক রাতে মোবাইল ওয়েটিং থাকে। সাব্বিরের সে সময়টায় শরীরের ভিতর রাগ লাগে খুব। মনে হয় সামনে যা পায় ভেঙে চুরে শেষ করে দেয়। ইচ্ছা করেই নিজের উপর নিজে রাগ দেখায়। পাগলের মত, নিজের শরীরে নিজে আঘাত করে। সাব্বির বুঝতে পারে, দিন দিন অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে সাব্বির। ঠিক স্বাভাবিক ভাবে চলতে পারছে না । তবুও কিছু স্বপ্নে বাঁচে সাব্বির। রাগ ভুলে মাঝে মাঝেই সাব্বির মেসেজ লিখে পাঠায় জুঁইকে, জুঁই ফিরে আসো না। আমি সত্যি আর রাগারাগি করব না। আমি ঠিক তোমার মনের মত, তোমার পরিবার যেমন চায় তেমন হতে পারব।
পরিবারের কথা আসত না। তবুও চলে আসে। শেষ যেদিন দেখা হল, জুঁইয়ের সাথে। তার আগের দেখা হবার দিনটার কথা। তখন সে গাছটায় পাতা নেই কোন, যে গাছটার নিচে বসে ছিল জুঁই। সেদিন দুজন পাশাপাশিই বসা। আগের দিনের তুমুল ঝগড়ার পর, সাব্বিরের সামনে এসে সরি বলাতেই মনে হল সব রাগ গলে গেল। জুঁই কেন যেন আর অভিমান করে থাকতে পারল না। পাশাপাশি বসে, হাতে হাত লুকিয়ে বসে থাকে। শীত ছিল সেদিন কিছুটা। সাব্বিরের গায়ে জড়ানো যে শার্ট, তাতে শীত মানে না। জুঁই নিজের গায়ের চাদরটা দিয়ে বলে, ঠাণ্ডা লাগবে। দুজন এক চাদরের ভিতর থাকা যাবে। আমার চাদরটা অনেক বড়।
সে গাছটার শিকড়ের উপর, দুজন গায়ে গা ঘেঁষে একই চাদরে বসে থাকে। জুঁই মাথাটা এলিয়ে দেয় সাব্বিরের কাঁধে। কাঁধের উপর জুঁইয়ের নিঃশ্বাস অনুভব করে সাব্বির। জুঁই ধীর গলায় বলে, সাব্বির আমি ক্লান্ত। আমার এতো রাগারাগি ঝগড়া আর ভাল লাগে না। আমরা আগের মত হতে পারি না?
সাব্বির কিছু একটা উত্তর দিবে, ঠিক তখন পিছন থেকে কেউ ডাক দিল।
" এই যে আপনারা, এ দিকে আসেন।"
খাকি পোশাক পরা যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে এ পার্কের গার্ড। সাব্বির চাদরের ভিতর থেকে উঠে আসল। জুঁইকে বলল বসতে।
- জ্বি আমাকে বলছেন?
- হ্যাঁ আপনাদের বলছি। আপনার সাথের জনকেও ডাকেন।
- কেন কি হয়েছে?
- কি হয়েছে না? ডাকেন বলছি।
- আচ্ছা কি হয়েছে আমাকে বলেন। ওকে কেন ডাকব?
- কেন ডাকবেন, না? আপনাদের গার্ড রুমে নিয়ে যাব। অভিভাবক এসে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে।
- আমরা কি করেছি?
- এক চাদরের ভিতর বসে আছেন। আর বলছেন কি করছি, না? ফাজলামি করেন? ডেকে আনেন ওনাকে। একটু আগে পিছন থেকে এক সাংবাদিক ছবি তুলে নিয়ে গেছে আপনাদের। ওগুলো অফিসে দেখালে আমার চাকরির সমস্যা হয়ে যাবে। আপনি ওনাকে ডেকে নিয়ে গার্ড রুমে চলেন।

সাব্বিরের মনে হল, ব্যাপার খুব একটা সুবিধার না। এই লোক সাথে করে নিয়ে যাবেনই। আর বাসায় জানালে বিশাল সমস্যা। সাব্বির এদিক ওদিক তাকাল। আশেপাশের মানুষ জন সব তাকিয়ে আছে সাব্বিরের দিকে। সাব্বির মানিব্যাগ বের করে, ৩০০ টাকা বের করল। লোকটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, আঙ্কেল ভুল হয়ে গেছে। আমরা চলে যাচ্ছি।
লোকটা টাকাটা হাতে নিয়ে দেখল।
- হুহ, কি দিলেন এইটা? আপনাদের জরিমানাই হইছে ১৫০০ টাকা। টাকা বের করেন আরও দ্রুত। নয়ত চলেন।
সাব্বির পকেট থেকে আরও ৫০০ টাকা বের করে দিল। পকেটে আর মাত্র ২০০ টাকা।
- আঙ্কেল এটা রাখেন।
- ধুর মিয়া চলেন তো আপনি। ওনাকে ডাকেন।
সাব্বির অসহায় মুখ নিয়ে লোকটার দিকে মানিব্যাগের অবশিষ্ট ২০০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল, আমার কাছে আর নেই। এই যে মানিব্যাগ দেখেন। এক টাকাও নেই। প্লিজ আঙ্কেল।
লোকটা বেশ তাচ্ছিল্য রকম একটা ভাব নিয়ে টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে বলল, এখান থেকে উঠে অন্য কোথাও যান।
বলে লোকটা চলে গেল। সাব্বির এসে বসল জুঁইয়ের পাশে। বসে বলল, আচ্ছা চল আমরা অন্য কোথাও বসি।
- কেন? অন্য কোথাও কেন বসব? ঐ লোক তোমাকে কি বলল?
- আরে এখানে একটু সমস্যা আছে। চল না।
- না, আমি তো যাব না। কি হইছে আমাকে সবটা বল।

সাব্বির বুঝতে পারে, বলতেই হবে। জেদ ধরেছে জুঁই। এই ঠাণ্ডায়ও ঘামতে থাকা কপাল মুছে সাব্বির বলে সব। তবে মাঝে একটা মিথ্যা বলে, দিয়েছে ১০০০ টাকা জুঁইকে বলে ৫০০ টাকা।
জুঁই তাতেই রেগে বলে, তুমি ঐ লোককে ৫০০ টাকা দিয়েছ এই জন্য। দুইটা ধমক দিলে এসব লোক কই যায়। এমন কেন তুমি?
- বাসার লোকদের খবর দিলে তখন?

শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুটা সময় জুঁই। কিছু একটা ভাবে। এরপর উঠে সোজা হাঁটতে থাকে। পিছন পিছন যায় সাব্বির। ডাক দিয়ে বলে, কোথায় যাচ্ছ?
জুঁই পিছন ফিরে বলে, তুমি একদম আমার পিছন পিছন আসবে না। যেখানে আছ, ওখানেই থাকো।
- কি হয়েছে?
- কিছু হয় নি। তোমার সাথে আমার থাকা সম্ভব না। এটাই হল কথা। তুমি আসবে না।
তাও কত দূর যায় সাব্বির। জুঁই রিকশা নিয়ে চলে যায়। চলে যাওয়া সে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে সাব্বির। এরপর থেকেই একটু একটু বদলে যায় জুঁই। কেন যেন এড়িয়ে চলে। কথা বলতে চায় না। সময় দিতে চায় না। চায় না শুনতে কোন কথা। শুধু একদিন মেসেজে বলে জুঁই, আমি শুধু বার বার ভাবছিলাম, যদি আমাদের ওখানে নিয়ে গিয়ে আব্বু আম্মুকে ফোন দিতই। আমি তোমার ব্যাপারে কি বলতাম? তোমাকে নিয়ে বলার মত তো কিছুই নেই। বরং আমার বাবা মার সামনে আমি লজ্জা পেতাম, এই কারণে যে এমন একটা ছেলের সাথে আমি প্রেম করি। তুমি বলতে পারো, তোমাকে নিয়ে আমার পরিবারের কাছে আমি কি বলতে পারি? কি নিয়ে বলতে পারি বল?
এই মেসেজ দেখে সাব্বিরের বড় কষ্ট লাগে। বুকের ভিতর মনে হয় ছিঁড়ে যাচ্ছে। কেউ একজন হৃদয়ের শিরা উপশিরা ধরে টানছে। ভেবে দেখে সাব্বির, সত্যি একটা মেয়ে গর্ব করে বলতে পারে তার ভালবাসার মানুষটাকে নিয়ে কিছু। তেমন কিছুই নেই সাব্বিরের মাঝে। যদি বলে, নিজেদের বাড়ি আছে, উত্তর হবে, না। অনেক টাকা পয়সা আছে, তাও হবে, না। দেখতে শুনতে অনেক ভাল, তাও বলতে হবে, না।
জুঁই কোনটার কথাই বলে নি। তবুও জানে একটা ছেলেকে নিয়ে একটা মেয়ে পরিবারের কাছে যা যা বলতে চায় উঁচু গলায়, সে কথা গুলো এগুলোই।
কি মনে হয় সাব্বিরের, চলে আসে ঢাকায়। মনে মনে ভেবে নেয় বদলে দিতে পারবে, বদলে নিতে পারবে অনেক কিছু। কেমন করে সে কিছু জানে না সাব্বির।
কোচিং এ ক্লাস করে যায়। পড়াশুনা হয় না। পরীক্ষা এগিয়ে আসে। তবুও সাব্বির স্বপ্ন দেখে, সত্যি কিছু বদলে নিতে পারবে, পারবে ঠিক বদলে দিতে। জুঁই কখনও কল ধরে না। ধরলেও অনেক দিন পর পর এক মিনিট দুই মিনিট কথা বলে। বলে, আমার সাথে আর যোগাযোগ কইর না সাব্বির। আমার পক্ষে সত্যি সম্ভব না তোমার সাথে থাকা। আমি সত্যি খুব ক্লান্ত। আমার এসব ভাল লাগে না।
- আমি বদলে যাব জুঁই।
- সব কিছু ইচ্ছা করলেই বদলানো যায় না। যে বিষয় গুলো নিয়ে আগে ভাবেনি, সে বিষয় গুলো এখন আমার মাথায় এসে গেছে। তোমার আমার রিলেশন সম্ভব না। আমি অন্য একটা রিলেশনে যাচ্ছি।
- প্লিজ জুঁই।
- সম্ভব না সাব্বির।
- আমি যদি ঢাকা ভার্সিটির ফার্মাসিতে চান্স পাই?

জুঁই ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে, আচ্ছা আগে পাও।
বললেও সাব্বির। জানে না তা সম্ভব কিনা। সাব্বির মেধাবী, চেষ্টা করলে পারবে। কিন্তু সে চেষ্টাই করা হয় না। রাস্তা দিয়ে হাঁটবার সময় মাথার ভিতর এসব ঘুরে। রাস্তার ব্যস্ত গাড়ির চলাচল দেখে ভাবে সাব্বিরও একদিন ব্যস্ত হয়ে যাবে। তখন ইচ্ছা করলেও সবাই সাব্বিরের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না। সাব্বির অনেকটা বদলে যাবে।
সেদিন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতেই দেখল, লটারির টিকেট বিক্রি হচ্ছে। ১০ টাকা টিকেটের দাম। প্রথম পুরষ্কার, ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট বা ৩০ লক্ষ টাকা। সাব্বির সেখান থেকে অনেক ভেবে চিন্তে একটা টিকেট কিনে নেয়। লটারি ভাগ্য সারাজীবন খারাপ সাব্বিরের। তবুও কিনে নেয়। মাঝে মাঝেই রাতের বেলা যখন জুঁইকে কল দিলে ওয়েটিং দেখে, তখন সে টিকেট বের করে। বের করে ভাবে, সত্যি সাব্বির প্রথম পুরষ্কারটা পেয়ে গেছে। জুঁইকে চমকে দিয়ে বলছে, জুঁই আমাদের এখন ঢাকায় ফ্ল্যাট আছে।
কিংবা ৩০ লক্ষ টাকা নিলেও হয়। সে টাকায় সবার আগে একটা মোটর সাইকেল কিনবে। সে মোটর সাইকেল নিয়ে জুঁইয়ের কলজের সামনে গিয়ে চমকে দিবে। ওখানকার দামী রেস্টুরেন্টে খাবে জুঁইকে নিয়ে। জুঁইয়ের জন্য কিনে নিয়ে আসবে দামী দামী সব উপহার। সাব্বির তখন অন্য রকম ভাবে সাভে চলবে। সাব্বির তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসিতে পড়ে। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। টাকা পয়সারও অভাব নেই। ইচ্ছা করলেই অনেক টাকার টিউশনি করাতে পারবে। সাব্বিরের তখন অনেক দাম। অভাব গুলো থাকবে না, একদমই থাকবে। হতাশা গুলো প্রাপ্তির আড়ালে হারিয়ে যাবে। এই ভাবনা গুলো যখন মনে থাকে, একবার হলেও মনে হয়, সাব্বির বড় সুখী কেউ। সত্যি কোন কষ্ট নেই। জুঁইয়ের এড়িয়ে চলায় কষ্ট লাগে না, কষ্ট লাগে না বাবা মায়ের সারাদিনের বকা ঝকাতেও, একদম খারাপ লাগে না ঘরের বেহাল দশা দেখেও, একদম হতাশা ছুঁয়ে যায় না, একটা বছর নষ্ট করছে এই ভেবেও।
পরীক্ষা চলে আসছে। পরীক্ষার তারিখ ১২ অক্টোবর,২০১২। আজ ১ তারিখ, হাতে ১২ দিন। পড়া হয় নি বলতে গেলে কিছুই। শুধু কোচিং এ গিয়ে ক্লাস করা, ক্লাস লেকচার তুলে আনা এ পর্যন্তই। অনেকটা কাজ বাকী। মাথার ভিতর ঝিম মেরে বসে আছে নানা রকম চিন্তা। এভাবে হেরে গেলে হবে না। সাব্বির হেরে যেতে চায় না। ১২ দিন কম সময় না। অনেকটা সময়। বই খাতা নিয়ে পড়তে বসে সাব্বির। নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধটার প্রস্তুতি নিবে সাব্বির। এক টানা পড়তে থাকে। একবারের জন্যও অন্য কিছু ভাবে না। জুঁইকে কল করে না। জুঁইয়ের কথা মনে হলেই মনে হয়, এই কাজটায় হতেই হবে সফল। সাব্বিরকে পারতেই হবে। সারাদিন সারারাত পড়ে সাব্বির। মা এসে বলেন, সাব্বির তোর কি হইছে? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? এতো পড়ছিস কেন? একটু ঘুমা।
- ঘুমাই তো মা। রাতে ঘণ্টা খানেক। মা চান্স পেতে হবে তো। একটা বছর নষ্ট করলাম।
- তুই ভাল ছাত্র, তুই পারবি। এতো পড়তে হবে না। শরীর খারাপ করবে।
- করবে না মা।
১২ টা দিন, ১২ দিন মানে কত ঘণ্টা সে হিসেব করেনি সাব্বির। শুধু জানে এই ১২ দিন জীবনের সবচেয়ে বেশী পরিশ্রম করেছে। বিছানায় যে ভাবে পড়তে বসেছিল, ১২ দিন পর সেখান থেকে বই খাতা গুছিয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছে। শুধু গতকাল রাতে একবার জুঁইকে কল করেছিল। পরীক্ষা আজ এ কথাটা বলার জন্য। জুঁইয়ের নাম্বারটা ওয়েটিং ছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু সাব্বির। ছোট করে মেসেজ দেয়, আমার কাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা।
জুঁই কল ব্যাক করে নি। শুধু ছোট করে রিপ্লাই দিয়েছিল, ভাল করে পরীক্ষা দিও। তোমাকে ভাল কোথাও দেখলে আমার মত খুশি আর কেউ হবে না। আর আমার জন্য জীবনটা নষ্ট করবে না, প্লিজ।
পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েছে সাব্বির। বের হয়ে বড় কান্না পাচ্ছে। পরীক্ষায় কমন পড়েনি ব্যাপারটা তেমন না। পরীক্ষা দিতে দিয়ে মাথার ভিতর কি হল জানে না। সব বড় এলোমেলো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, উত্তর পত্র বড় ঝাপসা। একটা বৃত্ত পূরণ করতে গিয়ে করছিল অন্যটা। ইচ্ছা করেই মনে হচ্ছিল করছিল ভুল। উত্তর গুলো পারে সাব্বির। তবুও ভুল দাগাচ্ছিল। ছেলেদের কাঁদতে নেই। কাঁদে নি সাব্বির। প্রশ্নটা বাসের জানালা দিয়ে ফেলে দিল। প্রশ্নের উত্তর মিলাবে না সাব্বির। উত্তর মিলিয়ে হতাশ হতে চায় না। সাব্বির তবুও স্বপ্ন দেখে, আশা করে, যখন ফলাফল দিবে, বেশ ভাল একটা ফলাফল পাবে। সাব্বিরের স্বপ্ন গুলো সব সত্যি হবে। জুঁইকে ঠিক চমকে দিতে পারবে। যে মানুষ গুলো এতো বছর পরিশ্রম করে এই অবস্থানে নিয়ে এসেছেন তাদের মুখে হাসি ফুটাতে পারবে।
দিন গুলো কাটে অপেক্ষায়। কখন ফলাফল দিবে। পরীক্ষা হয় শুক্রবার। এর মাঝে জুঁই কল করে, ধরে না সাব্বির। মেসেজ দেয় কেমন হল পরীক্ষা, তার উত্তরও দেয় না। একেবারে চমকে দেবার অপেক্ষা। ফলাফল দেবার আগ পর্যন্ত কল করে না সাব্বির জুঁইকেও। শুধু লটারিটা মাঝে মাঝে বের করে দেখে। স্বপ্ন গুলো বুনে। লটারির ড্র ১৯ তারিখ। ৩০ লক্ষ টাকা বা ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট।
পরীক্ষার ফলাফল বের হয় ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার। মোবাইল থেকে ইন্টারনেটে ঢুকে রেসাল্ট দেখে সাব্বির। হাতটা বড় কাঁপে যে সময়টায় লোড হয় রেসাল্ট। বুকের ভিতর বড় অস্থিরতা বাড়ে সে সময়। বার বার মনে মনে বলে, আমি জীবনে আর কিছুই চাই না। এখানে সফলতা পেলে।
ফলাফল দেখল সাব্বির, মার্কস ১৫০.২৫, মেধাক্রম ২৮৭২।
ফলাফল দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল সাব্বির। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটা ঘুরছে। মাথার ভিতর ঝিম ঝিম করছে। পারল না সাব্বির সত্যি পারল না। সত্যিই হেরে গেল। বাবা মার কাছে শুকনো মুখে এই ফলাফল বলে। বাবা মা শুধু জানতে চান, চান্স পাইছিস?
সাব্বির আস্তে করে মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ।
২১ তারিখের পত্রিকায় লটারিতে যারা পুরষ্কার পেয়েছে, তাদের লটারির নাম্বার এসেছে। সাব্বির তা খুব আগ্রহ নিয়ে মিলায়। এতো গুলো নাম্বারের মধ্যে কোনটাই মিলে না সাব্বিবের নাম্বারের সাথে। এই স্বপ্নটাও অপূর্ণ।
জুঁই একবার মেসেজ করে জানতে চেয়েছিল, তোমার রেসাল্ট কি?
সাব্বির সে মেসেজেরও উত্তর দেয় নি। লটারির টিকেটটা ছিঁড়ে ফেলে দেয়। সব মানুষের দেখা সব গুলো স্বপ্ন কখনই পূরণ হয় না, বুঝতে পারে সাব্বির। বুঝতে পারে কিছু না পাওয়া জিনিস, কখনও পাবার মত না আসলেই। জুঁইয়ের সাথে আর কখনও যোগাযোগ করে না। নাম্বার পরিবর্তন করে ফেলে। কথা বলে না। বদলে যেতে চেয়েছিল সাব্বির, বদলে গেছে ঠিক। জুঁইকে নিয়ে ভাবে না, জুঁইয়ের উপর রাগ করে না, জুঁইয়ের সাথে ঝগড়া করে না। জুঁই সাব্বিরের মাঝে দূরত্ব, সে দূরত্ব কমাতেও যায় না।

কাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাব্বিরের প্রথম ক্লাস। বিষয় পদার্থ বিজ্ঞান। যে হতাশা গুলো ছিল কেন যেন হারিয়ে গেছে সময়ের সাথে। সে গাছটার শিকড়ের উপর এসে বসেছে সাব্বির। শীত চলে এসেছে। নতুন যে পাতা গুলো দেখে গিয়েছিল গাছে, তাও ঝরে গেছে। এ শীতের দিনেও আকাশ বড় মেঘলা। বৃষ্টি নামবে হয়ত। এ গাছের শিকড়ের উপর বসে ভাবছে সাব্বির, জুঁইয়ের কথা। কেন যেন মনে হচ্ছে, পিছন ফিরে দেখবে জুঁই দাঁড়িয়ে আছে। দেখবে সাব্বিরের মত, জুঁইও পুরনো কথা ভেবে এসেছে এ জায়গাটায়। এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল, পড়ল দুই ফোঁটা, এরপর কয়েক ফোঁটা। তারপর ঝুম বৃষ্টি। সাব্বিরের বড় কান্না পাচ্ছে। এ গাছটা ছেড়ে পিছন ফিরে মনে হচ্ছে জুঁইকে দেখবে। সাব্বির কান্না করে দিলে জুঁই সে জল মুছে দিবে। সাব্বির দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছন ফিরে তাকাল। বৃষ্টি হচ্ছে। আশেপাশে কেউ নেই। মনে থেকে ভাবলেই কেউ সামনে চলে আসে না। মন থেকে বললেই কিছু সত্যি হয়ে যায় না। সত্যি গুলো সত্যি, মিথ্যে গুলো মিথ্যে। বৃষ্টির মাঝে কাঁপতে কাঁপতে হাঁটছে সাব্বির, এই হেরে যাওয়া মানুষটা, এই চাওয়া জিনিস গুলো না পাওয়া মানুষটা বৃষ্টির মাঝে চিৎকার করে গান গাচ্ছে। চোখের জল গুলো সে গানের সাথে মিশিয়ে ঠাণ্ডার মাঝেও উড়িয়ে দিতে চাচ্ছে।

সাদাকালো এ জীবনের মাঝে, রঙ্গীন ছিলে তুমি শুধু,
তোমায় নিয়ে লেখা কত কবিতায়
দিয়েছিলাম কত সুর,
আজ আমার হাতের মুঠোয় নেই যে তোমার হাত,
ভোরের আলো ফুটবে কখন, ভেবেছি কত রাত।

তুমি তো দিয়ে ছিলে মোরে কৃষ্ণচূঁড়া ফুল
আমি তো বসেছিলাম নিয়ে সেই গানের সুর,
তুমি তো দিয়ে ছিলে মোরে কৃষ্ণচূঁড়া ফুল
চলে গেছ কোথায় আমায় ফেলে বহুদূর...বহুদূর।

সময়ের সাথে কিছু চাওয়া পাওয়া হয়, কিছু স্বপ্ন তবুও অপূর্ণ রয়ে যায়। কিছু মানুষ সুখী থাকে, কেউ সুখে থাকার অভিনয় করে, কেউ দুঃখ জড়িয়ে বেঁচে থাকে। কারও স্মৃতি মুছে দেওয়া যায় না, তবুও আড়াল করে ভাবতেই হয় মুছে গেছে সব। কেউ কারও নয়, কারও ঠিক হবার নয়, তবুও আজন্ম কারও হৃদয়ের মাঝে বেঁচে থাকা। দূরে বহুদূরে অন্য কারও কায়ায় জড়িয়েও, কারও হৃদয়ের মাঝে ছায়ার সাথে মিশে থাকা। অনিয়মের কিছু নিয়মে কিছু গাছের পাতার ঝরে যাওয়া দেখে, স্মৃতির ঝরে যাওয়ার মিল খোঁজা। স্মৃতি গুলো অদ্ভুত, অমন গাছের পাতার মত ঝরে যায় না।

ঝরা দিন, ঝরা রাত
- শেষ রাতের আঁধার (রিয়াদুল রিয়াদ)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.