নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফেসবুকে আমি - রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার )

কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) › বিস্তারিত পোস্টঃ

থ্রিলারঃ এ শহরেও আঁধার নামে

১৬ ই জুলাই, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৫

খুব যত্ন সহকারে স্টিলের স্কেলের কোণা দিয়ে মোবাইলের পিছনে লেখা SAMSUNG এর NG কেটে SAMSU বানিয়ে নিল। মোবাইলের পিছনে নিজের নাম থাকার ব্যাপারটা অন্য রকম। কেউ যখন জিজ্ঞেস করবে, নাম কী তোমার?
তখন মোবাইলটা বের করে পিছন দিকটা দেখিয়ে দিলেই হল। জিন্সের প্যান্টের পকেটে পিস্তলটা আলতো করে রেখে বেরিয়ে গেল। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকী আছে। গন্তব্য মোহাম্মদপুর।

মাস ছয়েক আগের কথা। সাদেক টিউশনি করায় মোহাম্মদপুর। রাজনীতির সাথে জড়ানো হয় নি, তাই জোটে নি হলের সিট। আবেদন করেও ব্যর্থ। থাকে ঝিগাতলার একটা মেসে। থাকা খাওয়ার খরচ আসে এই টিউশনি থেকেই। কোন মতে চলে, কখনও চলে না। যেমন গত মাসেই চলল না। ধার করতে হয়েছিল ৩ হাজার টাকা। গত পরশু বেতন পেয়েছে টিউশনি থেকে। মশিউর ভাইয়ের সাথে দেখা হয় নি, তাই ফেরত দেয়া হয় নি টাকাটা। আজ ফেরত দেয়া জরুরী, নয়ত খরচ হয়ে যাবে। টিউশনি শেষ করে ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল। ঝিগাতলার দিকে যাচ্ছে। হাঁটা শরীরের জন্য ভাল। বাস কিংবা লেগুনায় চড়া, শরীরের জন্য খারাপ। রিকশায় চড়া শরীরের জন্য মারাত্মক, পকেটের জন্য ভয়াবহ। তাই হেঁটে যাওয়াটাই বোধ হয় ভাল সবচেয়ে। সোজা এসে দুইটা গলি পার হয়ে তারপর মেইন রাস্তায় পৌঁছাতে হয়। এক গলি পার হবার পরে দ্বিতীয় গলিতে দেখল খানিকটা অন্ধকার। এ শহরে কখনও আঁধার নামে না, লোকে বলে। কিন্তু শহরের কিছু জায়গায় আঁধার লেগেই থাকে। আঁধার নামে, নিকশ আলো আঁধার। দ্বিতীয় গলি দ্রুত পায়ে পার হবার সময়, পিছন থেকে কেউ ডাক দিল।
"এই শোন।"
সাদেক শুনেও না শোনার ভান করল। দ্রুত হাঁটার পরও একটা ছেলে এসে ধরে ফেলল।
"ডাকতেছি, কানে যায় না?"
সাদেক একটু ইতস্তত করে বলল, জ্বি শুনতে পাই নাই।
- আচ্ছা। ঠিক আছে। এদিকে আসো একটু।

সাদেক অনুসরণ করল ছেলেটাকে। চার পাঁচ গজ হাঁটতেই আরও তিন চার জনকে দেখা গেল। মোটর সাইকেল নিয়ে বসে আছে। আবছা আঁধারে সিগারেটের ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে, ছেলেগুলোর মুখ থেকে ছাড়া সিগারেটের ধোঁয়া। কেউ একজন বলল, নাম কী?
সাদেক একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল, তেমন কেউ নেই। আস্তে করে বলল, জ্বি সাদেক।
- কোথায় থাকো?
- ঝিগাতলা।
- আচ্ছা। কী কর?
- পড়াশুনা করি।
- কোথায়?
সাদেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলল। আরও দু তিন জন কোথা এসে হাজির। ঘিরে ধরল সাদেককে। একজন পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সূক্ষ্ম কিছু পিঠে ঠেকিয়ে বলল, কথা বা চিৎকার করলে, নাই হয়ে যাবি। যা আছে বের কর। মানিব্যাগ বের কর, মোবাইল বের কর। পকেটে টাকা থাকলে তাও বের কর।
সাদেক ভীত গলায় বলল, ভাই প্লিজ আমার কথাটা শোনেন। আমার ফ্যামিলির অবস্থা ভাল না। টিউশনি করে চলতে হয়। গত মাসেও টাকা চুরি হয়েছে মেস থেকে।
- আলগা আলাপ বন্ধ কর। টাইম কম। যা বললাম কর।
- ভাই, আমি আপনাদের কিছু টাকা দেই?
- চুপ।
ধমক দিয়ে একজন সাদেকের পকেটে হাত দিল, মোবাইল মানিব্যাগ বের করে, অন্যান্য পকেটও খুঁজল। নিজেদের কাছে জিনিস গুলো রেখে সিমটা খুলে সাদেকের হাতে দিয়ে বলল, যা এখন।
সাদেক কিছু বলতে যাচ্ছিল। শুনল না। মোটর সাইকেলে চড়ে ধোঁয়া ছেড়ে চলে গেল। আর সাদেক বিধ্বস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আঁধারের মাঝে। মাথাটা ভন ভন করে ঘুরছে। কান্না পাচ্ছে খুব। গলি পার হয়ে মেইন রাস্তায় আসতেই দেখল, রাস্তার ওপাশে পুলিশ বসে চা সিগারেট খাচ্ছে। এদের কাছে গিয়ে লাভ নেই, কিছু বলে লাভ নেই। একটা কেস, একটু দৌড়াদৌড়ি, একটা ফাইল। এরপর সব ধুলো পড়ে হারিয়ে যাবে। এখানে প্রকাশ্যে খুন হয়, ধর্ষণ হয়। সেসবের অপরাধী ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে, আশ্বাসে আশ্বাসে একদিন মানুষ সে ঘটনা ভুলে যায়। আর সাদেকের এই ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়ে কে মাথা ঘামাবে? কেউ বুঝবেও না, ঐ অল্প কয়েকটা টাকা, ভাঙা একটা মোবাইল সাদেকের কাছে কী। কেউ মানবেও না, সাদেক ঐ আঁধারে ধর্ষণ হয়েছে, খুন হয়েছে।

-আচ্ছা, শুনলাম সব। নাম যেন কী বলছিলে তুমি?
- জ্বি ভাই, সাদেক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের গেস্ট রুমে বসে, হলের এক রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলছে সাদেক। সব বলল, গতকাল রাতে ঘটেছে যা। জানে তেমন একটা সুবিধা হবে না। তবুও আরিফ জোর করে নিয়ে আসল। আরিফ, হোসেন ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ভাই আপনি ব্যাপারটা একটু দেখেন প্লিজ। ছেলেটা অনেক বিপদে। ঐ টাকায় চলত আর মেস ভাড়া দিত।
হোসেন ভাই সাদেকের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয়ে বলল, হলে থাকো না তুমি?
- না ভাই।
- কেন?
- এপ্লাই করছিলাম, সিট পাই নাই।
-ধুর মিয়া, হলে এপ্লাই কইরা কোন কচুটা হয়? আমাদের সাথে যোগাযোগ করবা না? হলে সিট দেই আমরা।
সাদেক বলল না কিছু, চুপ করে কথা শুনে গেল। গেস্ট রুমের ফ্যানটা চলছে। তবুও ঘামছে সাদেক। হোসেন ভাই বলে যান, এখন যদিও হলে তোলা বিশাল ঝামেলার কাজ। তাও আমি বললে তার উপর কথা বলার সাহস কারও নেই। তুমি কালকের মধ্যেই সব বেড পত্র গুছাইয়া হলে এসে উঠবা।
সাদেক মাথা নাড়ল, আচ্ছা ভাই।
হোসেন ভাই পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগটা বের করে তিন হাজার টাকা হাতে ধরিয়ে দিল।
- এইটা রাখো। কাজে লাগবে। পরে শোধ করে দিও। আমি পিচ্চি কাল থেকে মোহাম্মদপুরেই বড় হয়েছি। বাবা, মা ওখানেই থাকেন। টাকা মোবাইল হয়ত ফেরত আনতে পারব না। তবে কিছু একটা ব্যবস্থা তো করতে পারবই।
সাদেক আশ্বাস পেল কি পেল না জানা নেই। তবে হলে সিটটা পেয়ে বড় উপকার হল। অনেক গুলো টাকা বেঁচে যাবে।

থাকার ব্যবস্থা খারাপ না। এক রুমে ছয় জন। নিজস্ব বেড আছে আলাদা। সবচেয়ে বড় কথা রুমের বাকী পাঁচ জন খুব সমীহ করে কথা বলছে সাদেকের সাথে। হুট করে একজনের রুমে আগমন যে কারও জন্যই বিরক্তির উদ্দেক হবে। কিন্তু এরা তেমন করছে না। রুমে একজন ক্লাসমেট চার জন সিনিয়র। সবাই সাদেককে খুব সম্মান করে কথা বলে। ব্যাপারটা প্রচণ্ড ভাল লাগা দিচ্ছে সাদেককে। ভাল লাগার জায়গাটা একটু বিচ্যুত হচ্ছে এই ভেবে যে হলে ওঠা মানে নিশ্চিত রাজনীতির সাথে জড়িয়ে যাওয়া। মিটিং মিছিলে যাওয়া, ইদানীং দেশের অবস্থা ভাল যাচ্ছে না বেশী একটা, দু দিন পর পরই মারামারি, সেসবেও সুনিশ্চিত অংশগ্রহণ করতে হবে। আবার ভাবে, সবাই যখন পারছে, সাদেকও পারবে। আলাদা একটা সম্মানের জায়গা তৈরি হবে সাদেকের। লোকে দেখলে ভয় পাবে। চায়ের দোকানে ওকে দেখে সাধারণ ছাত্ররা সিট ছেড়ে দিবে। এই ব্যাপার গুলো তো খারাপ না।
দু দিন পরে রাতেই গেস্ট রুমে ডাক পড়ল। এন্টি পার্টি হরতাল ডেকেছে। হরতাল বিরোধী মিছিলে সবার অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। গেস্ট রুম শেষে হোসেন ভাই কয়েক জনকে আলাদা করে থাকতে বললেন, এর মধ্যে সাদেকের নামও আছে। কেমন একটা ভয় কাজ করছে। কোন ভুল করল না তো আবার? নতুন রুমে ওঠার পর আর হোসেন ভাইয়ের সাথে দেখাও করতে যায় নি। মনে মনে ঠিক করতে রইল কি বলবে হোসেন ভাইকে, কেন যাওয়া হয় নি তার রুমে। গেস্ট রুম শেষের আলোচনায় তেমন কিছু হল না। প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ আলাদা। হোসেন ভাই সাবধান করে দিলেন, কাল মারামারি হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। সতর্ক থাকবে হবে আমাদের এবং আক্রমণ আসলে তা প্রতিরোধ ও পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। হোসেন ভাই বললেন তার রুমে অস্ত্র আছে। কে কোন অস্ত্র নিবে তা তিনি ঠিক করে দিবেন। আর এই খবর যেন এই কয়েকজন ছাড়া আর কেউ না জানে। এখানকার এই কয়েক জনকে বিশ্বাস করার কারণেই তাদের উপর এতো বড় দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যে কাউকে দিয়ে তো আর এসব হয় না।

মিছিল হচ্ছে। হরতাল বিরোধী মিছিল। এন্টি পার্টির বিরুদ্ধে ও পার্টির পক্ষে স্লোগান দেয়া হচ্ছে। মিছিলে প্রথমে কালকের গেস্ট রুমের বেশীর ভাগই ছিল। আস্তে আস্তে মানুষ কমছে। পিছন থেকে হয়ত পালাচ্ছে। সাদেক সামনের দিক থেকে চার নম্বর লাইনে। যাদের কাছে অস্ত্র আছে, তাদের মাঝখানটায় রাখা হয়েছে, যেন বাহির থেকে দেখে শান্তিপূর্ণ মিছিল বলেই মনে হয়। মানুষ সব কিছুরই বাহির দেখে সিদ্ধান্ত নেয়। ভিতর খতিয়ে কখনই দেখা হয় না। সাদেকের হাতে কাপড়ে মোড়ানো মাঝারি আকারের একটা রাম দা। এন্টি পার্টি আক্রমণ করলেই মাঝে যারা আছে তারা সামনে সামনে চলে যাবে। ভয় পাওয়া যাবে না। সাহস নিয়ে কোপ বসাতে হবে, যাদের হাতে পিস্তল, তাদের নিশানা ঠিক করে গুলি করতে হবে। সাদেকের তবু ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে যে কোন সময় মিছিলে একটা বোমা পড়বে, শরীরটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকবে। বোমা ফাটল একটা, তবে মিছিলে না, একটু দূরে। বোমার শব্দেই মিছিল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, যে যার মত দৌড়াতে লাগল। কোথা থেকে যেন কত গুলো মানুষ এসে এলোপাথাড়ি কোপাতে শুরু করল রাম দা দিয়ে। গুলির শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ করে সাদেকের মনে হল, সাদেকের অনুভূতি ঠিক মত কাজ করছে না। এতো শব্দের কিছুই কানে আসছে না। একটা সূক্ষ্ম শব্দ কানের পর্দা ভেদ করে চলে যাচ্ছে। সাদেক কি জ্ঞান হারাচ্ছে। শক্ত করে রাম দা টা হাতে ধরে দেখল কেমন যেন শক্তি পাচ্ছে না, একদম না। এক সময় সবটাই অন্ধকার হয়ে গেল। শরীরটা লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়।

- ধরা পড়লি কীভাবে? যখন দেখলি অবস্থা বেগতিক তখন পালিয়ে যাস নাই কেন?
সাদেক কিছুই বলল না। গেস্ট রুমের সোফার উপর পা ভাঁজ করে বসে নাক চুলকাচ্ছে। হোসেন ভাই, একটু কেশে নিয়ে আবার বলা শুরু করলেন, ধরা পড়ছিস আরও রাম দা সহ। পুলিশ ভাবছে তুই এন্টি পার্টির। পুলিশ কি গায়ে হাত তুলছিল নাকি?
সাদেক শুষ্ক গলায় জবাব দিল, না।
-পুলিশকে বলিস নাই কেন তুই আমাদের পার্টির? আমাদের পার্টি এখন ক্ষমতায়, তোরে ধরার হ্যাডম আছে কারও?
- কয়েক জন বলছিল ওরা আমাদের পার্টির, ওরা আমাদের পার্টির না তাও। ওগুলা এন্টি পার্টির। পুলিশ তো ছাড়ে নাই।
হোসেন ভাইয়ের যেন রাগে মাথায় রক্ত উঠে গেল। সাদেকের দিকে মুখটা নিয়ে এসে বললেন, কী বলিস? শালারা পুরাই শু... বাচ্চা। খালি ফাঁসানোর ধান্ধা। যাক তোকে ছাড়াতে বেশী একটা বেগ হতে হয় নি। খালি নাম নিয়ে ঝামেলা হইছিল। সাদেক বললাম নাম, পুলিশ নাম চেক করে দেখল সাদেক নাম নাই।
- পুলিশকে পুরা নাম বলছিলাম, প্রথম টুকু লিখছে, শেষের টুকু লিখে নাই।
- তুই কোন চিন্তা করিস না। তুই ঠাণ্ডা মাথার ছেলে। রাজনীতিতে মাথা গরম পোলাপান কিছু করতে পারে না। ওদের দিয়ে কাজ করায়, হুদাই চিল্লাবে, গরুর মত খাটবে, পোস্ট পাবার সময় ফক্কা। কিছু পাবে না। নেতা হয় তোর মত ঠাণ্ডা মাথার ছেলেরা। তার উপর তুই ৫ ঘণ্টার জেলও খেটে ফেলছিস। জেল না খাটলে নেতা হওয়া যায় না। আমি নিজেও তিন দিন জেলে ছিলাম। তখন এন্টি পার্টি ক্ষমতায়। যে মাইরটা দিছিল। গিরায় গিরায় মাইর। পুলিশের মাইর বুঝিস তো। কেউ ছাড়াতে যায় নাই। ভার্সিটি থেকেও কেউ যায় নাই। শেষ দিকে হলের ক্যান্টিনের দিদার ভাই আমাদের জন্য খাবার নিয়া গেল। খাবার খেতে গিয়ে এতো কান্না পাইছিল। খাবার নিয়া হাউ মাউ কইরা কাঁদছিলাম। বাদ দে। এইটা রাখ।
হোসেন ভাই পকেট থেকে আবার কিছু টাকা বের করে সাদেকের হাতে দিলেন। দিয়ে বললেন, কালকের মিছিলের জন্য টাকা। সাথে সাথে থাক, আরও পাবি। আমার কেন যেন তোরে মনে ধরছে। তোর একটা ব্যবস্থা আমি করে দিয়া যাবই।
সাদেক টাকাটা পকেটে রেখে দিল। হোসেন ভাই সিগারেট ধরালেন।
- সিগারেট খাস?
সাদেক সিগারেট খায় না। তবুও বলল, জ্বি।
- আচ্ছা নে টাইনা তারপর আমাকে দে।

সাদেক এখন সবসময় হোসেন ভাইয়ের সাথে সাথেই থাকে। হোসেন ভাইয়ের কাছ থেকে রাজনীতির অনেক কিছুই জেনেছে। ভিতরের কথা। সাদেককে একদিন মোটর সাইকেলের পিছনে বসিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় বলল, হ্যাঁ রে, শুনতেছিস?
- জ্বি ভাই।
- আমাদের পার্টি তো পিস্তল ব্যবহার করে। রাম দা হল এন্টি পার্টির। তাও তোরে সেদিন রাম দা দিছিলাম কেন জানিস?
- না ভাই।
- এইটাই হল পলিটিক্স। নেতা হতে হলে এসব পলিটিক্স তোর জানতে হবে। এই জিনিস শুরু করছে এন্টি পার্টিরা। শালারা আগে খালি রাম দিয়ে মারত। হুট করে রাম দা এর সাথে ওরা পিস্তলও নিয়ে ঘোরাঘুরি শুরু করল। ব্যাপার কিছুই না, আমাদের ফাঁসানো। রাম দাঁ দিয়ে একটা কোপ দিয়ে পিস্তল দিয়ে গুলি করে। পিস্তল ব্যবহার করি আমরা। সাংবাদিক শালারা ঘুরে ফিরে সে দোষ আমাদের উপর দেয়া শুরু করল। কিছু কিছু সাংবাদিক অবশ্য রাম দাঁ এর ব্যাপারটা হাইলাইট করছিল। শুনতেছিস?
- হ্যাঁ ভাই।
- এক সাংবাদিক পেপারে, এন্টি পার্টি আর আমাদের পার্টি দুই পার্টি নিয়েই লিখল। ভাল কিছু না, সব খারাপ। ওদের পার্টি নিয়ে বলা কথা গুলো সত্য হলেও, আমাদেরটা ভুয়া ছিল। পেপারে প্রতিবেদন ছাপার তিন দিনের মাথায় সাংবাদিক খুন। পিঠে কোপ, আর মাথায় গুলি। কাজটা করল এন্টি পার্টি। দোষ আসল আমাদের। আমাদের নিয়ে লিখছে তাই নাকি আমরা মেরে ফেলছি। আরে ব্যাটা লিখছে তো এন্টি পার্টি নিয়েও, সেটা দেখবে না? শালারা পুরাই শু... বাচ্চা।
- জ্বি ভাই।
- আর চোখ কান খোলা রাখবি সব সময়। শত্রু খালি এন্টি পার্টি না, পার্টির ভিতরেও আছে। তুই পোস্ট পাবি, অন্য জন পাবে না। তোরে তো আর পূজা করবে না তখন। উপরে ওঠার জন্য মানুষ কত কী যে করে।
- জ্বি ভাই।

সময় যায়। এর মাঝে আরও তিন চারটা মিছিলে যোগ দেয় সাদেক। সাদেকের এখন ক্যান্টিনে খেতে কোন টাকা লাগে না। উল্টা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার টং দোকান গুলোর তিনটা থেকে চাঁদা পায় সাদেক। ছয় মাসের মাথায় হোসেন ভাই মোটর সাইকেলের ব্যবস্থা করে দেন। নতুন একটা দামী মোবাইলও কিনেছে। সাদেককে এখন আর কেউ সাদেক নামে ডাকে না। নাম বদলে গেছে। পুলিশের কাছে যে নামে এন্ট্রি করে কেস আছে, সাদেকের নাম এখন সেটা হয়ে গেছে। নেতা হবার জন্য এই নামটা জরুরী। পুলিশকে নাম বলেছিল সামসুর রহমান সাদেক। পুলিশ শুধু সামসুর রহমান লিখেছিল, সাদেক না। নাম এখন সামসুর থেকে সামসু। সবাই ডাকে সামসু ভাই।
মোবাইলের পিছনে স্টিলের স্কেল দিয়ে NG তুলে নিজের নাম লিখে মোটর সাইকেল চেপে বেরিয়ে গেল সাদেক। পকেটে একটা পিস্তল। যাবে মোহাম্মদপুর। যেখান থেকে টাকা আর মোবাইল ছিনতাই হয়েছিল সেখানে। মোটর সাইকেলটা গলি থেকে একটু দূরে রেখে গলির ভিতর হাঁটতে রইল। সব আলোকিত শহরের এ গলিতে অন্ধকার। চার পাঁচ জন ছেলে একটু দূরেই মোটর সাইকেলে বসে আছে। সাদেক সেদিক দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল। আড় চোখে আবছা অন্ধকারে ওদিকে দেখতে রইল। যা চাচ্ছে তা হচ্ছে না। পার হয়ে চলে আসল ওদের। কেউ ডাক দিল না। গলির শেষ মাথায় আসতেই পিছন থেকে একজন বলল, এই যে ভাই শোনেন একটু।
সাদেক পিছন ফিরে বলল, আমাকে বলছেন?
- জ্বি, আপনাকে একটু আমাদের বড় ভাই ডাকে।
সাদেক আলতো একটা হাসি দিয়ে সেদিকে গেল। চার পাঁচটা ছেলে। আবছা অন্ধকারে পরিচিত মুখ খুঁজছে। সেদিনের কেউ নেই এখানে। অন্য গ্রুপ এটা। আবারও একই রকম প্রশ্ন আসল। সাদেক এবারও বলল, ঝিগাতলা থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করল, তাও অন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলল।
নাম জানতে চাইলে নিজের দামী SAMSUNG মোবাইলটা বের করে পিছনটা দেখাল। আধো আলো ছায়ায় সে নাম পড়তে পারল কিনা জানা নেই। পরের দৃশ্য জানা সাদেকের। পেটের কাছে একটা চাকু ধরল একটা ছেলে। যা আছে বের করতে বলল। সাদেক টাকা বের করার জন্য পকেটে হাত দিয়ে পিস্তলটা বের করে চাকু ধরা ছেলেটার পেটে ঠেকিয়ে দিল।
- একদম চুপ থাকবি। কেউ নড়াচড়া করলে, পিস্তল থেকে গুলি বেরিয়ে যাবে।
পিস্তল দেখে সবাই ভড়কে গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। পিছন থেকে একজন বলল, ভাই আপনি চলে যান , আপনার কিছু দিতে হবে না।
যে ছেলেটার পেটে পিস্তল ধরে আছে সে ছেলেটার মুখে অন্য বুলি, দেখেন ভাই ঝামেলা কইরেন না। আমাদের সাথে ঝামেলা করে পার পাবেন না। আমরা কিন্তু হোসেন ভাইয়ের লোক। হোসেন ভাইকে চিনেন? হোসেন ভাই?
সাদেক একটু ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নিঃশব্দে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। আবছা আঁধারে, সে নিঃশ্বাস মিশে গেল। শান্ত দৃষ্টি নিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে পিস্তলে চাপ দিল। নিঃশব্দ পরিবেশটায় হঠাৎ করেই বিশাল শব্দে কেঁপে উঠল। সাথের ছেলে গুলো দলের নেতাকে ধরল। সাদেকের দিকে এগুবার সাহস পেল না। শহরের এই অন্ধকার গলিতে, রক্তে মাখামাখি ছেলেটার রক্ত আঁধারের রঙের সাথে মিশে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে না। একটা কেস, কিছুদিন তদন্ত, কিছু আশ্বাস, এরপর সব ঠাণ্ডা। সাদেক শান্ত ভাবেই মোটর সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। এ শহরে আঁধার নামে, সে আঁধারে হারিয়ে যায় সত্য মিথ্যার হিসাব, ন্যায় অন্যায়ের বোধ, ভাল খারাপের সমীকরণ। সে আঁধার বড় গাঢ়, সে আঁধার কেটে আলো আসে না। সে আঁধারে পাশের মানুষটাকেও চেনা যায় না, বিশ্বাস করা যায় না।
পরদিন পত্রিকায় বড় করে শিরোনাম হল ব্যাপারটা। হোসেন ভাই পত্রিকা দেখিয়ে বললেন সাদেককে, দেখ শু... বাচ্চারা কী করছে? আমার পার্টির লোককে মেরে ফেলছে।
সাদেক আস্তে করে হোসেন ভাইকে বলল, নিজের পার্টির কেউও তো মারতে পারে ভাই। পার্টির ভিতর কি কোন শত্রু থাকতে পারে না?
হোসেন ভাই নির্বিকার দৃষ্টি ছুঁড়ে তাকিয়ে রইলেন সাদেকের দিকে। সাদেক শুধু বলল, ভাই আজ আপনার আর আমার মাওয়া যাওয়ার কথা। ইলিশ খাবার জন্য। ১১ টার দিকে বের হই আমরা কি বলেন?
হোসেন ভাই কোন উত্তর দিল না। সাদেক চলে আসল ওখান থেকে। পিস্তলটার গুলি চেক করে আবার পকেটে রেখে দিল। আজ মাওয়া যাওয়ার কথা, হোসেন ভাইয়ের সাথে।

(সময়, কাল, চরিত্র সব কাল্পনিক)

- রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৫:৪৫

জয় সুমন বলেছেন: অসাধারন ভাই

০৮ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ২:০১

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.