নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফেসবুকে আমি - রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার )

কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ মেঘে মেঘে

১৮ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ১২:৩৪

- আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি।
-হুম।
- হিম চত্বরে, শান্ত আর সবুজ এসেছে, ওদের সাথে একটু দেখা করে আসি।
- হুম।
- দুপুরের দিকেই ফিরে আসব। বাসায় লাঞ্চ করব।
- আচ্ছা।
- চিন্তা করার কিছু নেই। তোমার বউ অন্য ছেলেদের হাত ধরে হাঁটবে না। এখানটা ঢাকার মত অত আধুনিক হয় নি যে একটা ছেলে আর মেয়ে হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করবে।

আলিফ কিছু সময় চুপচাপ মিতুর দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু না বলে সোফার উপর শরীরটা আরও ভাল করে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল। মিতু বাম হাত থেকে ভ্যানিটি ব্যাগটা ডান হাতে নিয়ে বলল, আসি আমি।
আলিফ চোখ বুঝেই আস্তে করে বলল, ঠিক আছে।

মিতু দ্রুত পায়ে দরজা পর্যন্ত গিয়ে কি মনে করে ধীর পায়ে আবার আলিফের কাছে এসে দাঁড়াল।
- শোন।
আলিফ চোখ বন্ধ করেই বলল, বল।
- চোখ খোল।
আলিফ চোখ মেলে তাকাল। সোফার পাশের ছোট টেবিলে জগ আর গ্লাস রাখা। মিতু গ্লাসে পানি ঢেলে আলিফের পাশে বসে একটা চুমুক দিয়ে গ্লাসের পানিতে ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি কি জানো, আমি তোমার মনের কথাগুলো বুঝতে পারি?
আলিফ কোন জবাব দিল না। তাকিয়ে রইল মিতুর দিকে। মিতু বলে যায়, আমি যখন তোমাকে বললাম, বাহিরে যাচ্ছি। তুমি বলতে চাচ্ছিলে, কোথায় যাচ্ছ? যখন বললাম, শান্ত আর সবুজের সাথে দেখা করে। তুমি রাগ করে বলতে চাচ্ছিলে, ফিরবে কখন? যখন বললাম, দুপুরে। তখন বলতে চাচ্ছিলে, যেতেই হবে? ঐ ছেলেদের সাথে এখনও এতো বন্ধুত্ব রাখার কী আছে? তোমার বিয়ে হয়েছে, স্বামী আছে। দরকার হলে, স্বামীকে নিয়ে ঘুরতে বের হও, হাত ধরে হেঁটে বেরাও। তোমার কথার উত্তর গুলোই আমি দিয়েছি। আমি কি ঠিক আছি?
- না।
বলে আলিফ উঠে বসল। বসে বলল, তুমি যা যা বলেছ, তার কিছুই আমি মনে মনে বলি নি।
মিতু একটা নিঃশ্বাস গোপন করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও ফেলল না।
- আমি তোমাকে চিনি, আলিফ।
- আমিও চিনি।

মিতু আবার উঠে দাঁড়াল। যেতে যেতেই জিজ্ঞেস করল, অফিসে যাবে না আজ?
- না।
- কেন?
- বস বলল, আমার নাকি কী সমস্যা হয়েছে। আমার কয়েকদিন বাসায় বিশ্রাম নেয়াটা জরুরী। তাই সাত দিনের ছুটি দিয়েছে।
- তোমার কি মনে হয়, তোমার কোন সমস্যা হয়েছে?
- না, আমি একদম ঠিক আছি।
- ঠিক থাকলেই ভাল, বিশ্রাম নাও।

মিতু দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। ছোট একটা পাহাড়ের পাশে বিশাল এক বাড়িতে মিতু আর আলিফের বাস। পাহাড়ের তুলনায় বাড়িটা অনেক ছোট হলেও বাড়িটা বিশাল, পাহাড়টা ছোট। বড় ছোটর হিসাব খুব জটিল। মানুষের মন কখন কোনটাকে বড় করে, কোনটাকে ছোট করে দেখে তা বোঝা বড় মুশকিল। বাড়ির বাগানের ডান পাশের গ্যারেজে একটা প্রাইভেট কার আর একটা মোটর সাইকেল। মোটর সাইকেল আলিফের কেনা, প্রাইভেট কার মিতুর বাবার দেয়া। এই প্রাইভেট কারে আলিফ কোনদিন চড়ে না, নিজে প্রাইভেট কার কিনে তারপর চড়বে। গাড়ি নিয়ে যাবে ভেবেও, শেষ পর্যন্ত নিল না মিতু। পায়ে হেঁটে অল্প একটু গেলেই, ব্যাটারিতে চলা অটো রিকশা পাওয়া যায়। হিম চত্বর সেখান থেকে এক কিলোর মত। রিকশা করে যেতেই বরং ভাল লাগবে। মিতু সেদিকেই রওয়ানা দিল।


শান্ত আর সবুজ একদম বদলায় নি। আগের মতই আছে। সেই আগের বন্ধু যেমন ছিল তেমন। বিয়ের পর মেয়েরা বদলায়, বদলায় মেয়েদের সাথে সম্পর্ক রাখা ছেলে বন্ধু গুলোও। ছেলেদের বিয়ের পর ওদের মেয়ে বন্ধু গুলো সে তুলনায় কমই বদলায়। হয়ত মনের রকম ফের। যার মনে যা চলে। মিতু বদলে গিয়েছে কিনা জানে না, কিন্তু শান্ত সবুজকে আগের মত থাকতে দেখে বেশ ভালই লাগছে। শান্ত আর সবুজের সাথে দেখা প্রায় তিন মাস পর। আলিফের সাথে বিয়ের পর এই নিয়ে পাঁচ বারের মত দেখা হল। শান্ত, সবুজ সেই ছোট বেলার বন্ধু মিতুর। স্কুল, কলেজ একই ছিল। ভার্সিটিতে গিয়ে আলাদা হয়ে গেলেও, প্রতি সপ্তাহে একবার করে দেখা করত এই হিম চত্বরেই। আলিফের সাথে ভালবাসার সম্পর্ক হবার পর সবচেয়ে বেশী ঝামেলা হয়েছে এই শান্ত আর সবুজকে নিয়েই। প্রথম প্রথম রাগ করত আলিফ। মিতু বুঝিয়ে বলত, ওরা আমার ভাল বন্ধু। ছোট বেলা থেকে, আর ওদের সাথে আমার অমন কোন সম্পর্ক নেই। হুট করে ওদের সাথে কথা বলা, যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে ওরা ভাববে ভাব ধরছি।
আলিফ এরপর দেখা করলে যদিও কিছু বলত না, তবুও বুঝতে পারত আলিফ মন খারাপ করছে। মন মরা একটা ভাব নিয়ে সারাদিন থাকত। সে মন মরা ভাব ঠিক করতে মিতুর লেগে যেত অনেকটা সময়। আলিফ এখন বলে না কিছু। চুপ থাকে, এই ব্যাপারে কোন কথাই জিজ্ঞেস করে না আলিফ। তবুও মনে মনে পাওয়া আলিফের ব্যথা গুলো বুঝতে পারে মিতু। শান্ত, সবুজের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়াটা হয়ত সহজ, কিংবা অনেক কঠিন। আর ওরা দুজনেই অনেক ভাল ছেলে, খারাপের কিছুই নেই ওদের মাঝে।
কলেজ নিয়ে কথা হল, কলেজের বাকিদের নিয়ে কথা হল অনেক। কে কোথায়, কি করছে, কার বিয়ে হয়েছে, কার বাচ্চা হয়েছে, কে সরকারী চাকরি পেয়েছে, কে বেকার রয়েছে, কে মাস্তানি করে বেরাচ্ছে। শান্ত, সবুজ দুজনেই বেশ অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের ছেলে, ওসব পরিবারের ছেলেগুলোর মত কোন উগ্র ভাবও নেই দুজনেই মাঝে।
- তোরা কি পায়ে হেঁটেই আসলি?
মিতুর প্রশ্নে শান্ত হেসে বলল, মাথা খারাপ তোর? বিয়ে করে মাথা তোর পুরা শেষ। ছয় মাইল আমি হেঁটে আসব? আর সবুজের তো আরও দূর। আমি কার নিয়ে আসছি, আর সবুজ মোটর সাইকেলে।
- গাড়ি রাখছিস কই?
- ঐ পাশে জায়গা আছে না গাড়ি রাখার? ওখানেই। ফাঁকা ছিল, গাড়ি নাই কোন, তাই রেখে আসলাম।
- ভাল করছিস। এখন চোরে এসে ফক মারলেই গেল।
- চোরদেরও তো বাঁচার অধিকার আছে তাই না? আমরা যদি না দেই, ব্যাটারা খাবে কি বল?

কথা বলতে বলতে মিতু ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করল। শান্ত আর সবুজের দিকে তাকিয়ে বলল, আলিফ ফোন দিয়েছে রে। একটু বস তোরা, আমি একটু কথা বলে আসি।
- বাপ রে, আমাদের সামনে কথাও বলতে পারবি না। খাইছে। প্রেম কি দিন দিন নতুন হইতেছে নাকি?
- তোর মাথা।

সবুজ দুই হাত উপরে বলল, আল্লাহ, বুইড়াই তো হইয়া গেলাম। এখন তো অন্তত কাউরে দাও। মইরা গেলে পড়ে আফসোস থাকব, জীবনে কোন মাইয়া মুখের দিকে ভালবাসা নিয়া তাকাইলও না।
মিতু হাসি দিয়ে বলল, মর তোরা।
বলে মোবাইল কানে নিয়ে চলে গেল সামনের দিকে।

মিতু দুপুরের দিকেই ফিরে আসলো বাসায়। দরজার কাছেই মোটর সাইকেলটা। যাবার সময় দেখে গিয়েছিল গ্যারেজে। ঘরে ঢুকে দেখল, আলিফ ওভাবেই শুয়ে আছে সোফায়। শুধু যাবার সময় দেখেছে ট্রাউজার পরা, এখন লুঙ্গী। মিতু এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আবার লুঙ্গী পরেছ? তোমার জন্য পরশু দিনও কতগুলো ট্রাউজার কিনে এনেছি।
- বাতাস লাগাচ্ছি।
- কোথায় বাতাস লাগাচ্ছ? রুম এসি করা, বাতাস তো এমনিতেই লাগে, আলাদা করে আবার কোথায় বাতাস লাগাতে হয়?
আলিফ কিছু বলল না। চুপ করে শুয়ে লুঙ্গীটা হাঁটুর উপরে তুলে আসন গেঁড়ে সোফার উপর বসে রইল। মিতু ঘর থেকে কাপড় এনে, গায়ের কাপড় বদলাতে বদলাতে বলল, তুমি বাহিরে গিয়েছিলে?
- হ্যাঁ?
- বললাম তুমি কি বাহিরে গিয়েছিলে?
কিছু সময় মিতুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, না তো।
- না মোটর সাইকেল যাবার সময় দেখলাম গ্যারেজে আর এখন দেখলাম দরজার সামনে।
- আরে না ওখানেই তো ছিল।
- দেখো, আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি মোটর সাইকেল গ্যারেজে দেখে গেছি।
আলিফ একটু মাথা চুলকিয়ে কি যেন ভেবে বলল, তাহলে বোধহয় আমিই বের করেছিলাম। বের করে ওখানে রেখেছি।
মিতু এসে আলিফের পাশে বসে দুই হাত দিয়ে আলিফকে জড়িয়ে ধরে বলল, এই কী হয়েছে তোমার?
- কী হবে?
- তুমি ঠিক আছ তো?
- হ্যাঁ।
- দেখো, আমাকে তো বলতে পারো তাই না?
- কিছু হয় নি মিতু।

মিতু অনেকক্ষণ ধরে আলিফের দিকে তাকিয়ে রইল। গালে একটা চুমো খেয়ে বলল, আমি যে তোমাকে অনেক ভালবাসি, ব্যাপারটা তুমি জানো?
আলিফ নিঃশব্দে মাথা তুলে তাকাল মিতুর দিকে। এরপর মাথা নিচু করে বলল, জানি আমি।
- আর তুমি?
- আমিও ভালবাসি। আমি সব করতে পারি এ জন্য।
- মানে?
- কিছু না।
মিতু আবার কিছুক্ষণ আলিফের দিকে তাকিয়ে রইল। আলিফের ভিতর কিছু একটা চলছে। আলিফ দিন দিন মিতুর কাছে দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে। একটু একটু করে অচেনা অজানা হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।
মিতুর মোবাইলে একটা কল আসল। মিতু মোবাইলটা হাতে নিয়ে, তারপর আবার রেখে দিল। আলিফ সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কে? শান্ত ফোন করেছে? ধরো, দেখো কি বলে।
মিতু অবাক হয়ে আলিফের দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যি শান্ত ফোন করেছিল। আলিফ উঠে পাশের ঘরে চলে গেল। শান্ত আবার কল করেছে, মিতু ফোনটা ধরতেই, শান্ত চিৎকার শুরু করল, তুই কই মিতু? তাড়াতাড়ি নবীনগর হাসপাতালে আয়। সবুজ মোটর সাইকেল এক্সিডেন্ট করেছে।
- কি বলিস? কীভাবে?
- মোটর সাইকেল সহ কালভার্টের ওখানের রাস্তা থেকে ছিটকে নিচে পড়ে গেছে। অবস্থা খারাপ খুব।
- আমি আসতেছি দাঁড়া।

মিতু দৌড়ে আলিফের কাছে চলে গেল। আলিফ বিছানার উপর শুয়ে আছে।
- এই শুনছ, সবুজ এক্সিডেন্ট করেছে?
- হুম।
- অবস্থা নাকি খুব খারাপ।
- হুম।
- আজব তুমি এমন হুম হুম করতেছ কেন?
- তো কি করব? আর শোন, মাথা ঠাণ্ডা রাখো, সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। সব পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারাটা সবাই পারে না। তাই বার বারই ভুল সিদ্ধান্ত নেয়।
- আমি এখন এসব শুনতে চাচ্ছি তোমার থেকে? তুমি যাবে আমার সাথে?
- না।
- আচ্ছা থাকো, আমি যাচ্ছি।

মিতু গাড়ি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। হাসপাতালে পৌঁছে দেখল, শান্ত দাঁড়িয়ে আছে।
- কী অবস্থা এখন?
- ভাল না। মাথায় অনেক আঘাত পাইছে। রক্তও গেছে অনেক।
- কীভাবে কী হল?
- আরে আমরা তো যাচ্ছিলাম কলেজের দিকে। বললাম আমি সবুজকে গাড়িতে ওঠ। ও বলল তাহলে মোটর সাইকেল কী করব? পরে ও মোটর সাইকেল নিয়েই যেতে লাগল আমার সামনে সামনে। কিছুক্ষণ পর থেকেই দেখি ও উল্টাপাল্টা গাড়ি চালাচ্ছে, একবার রাস্তার বামে, একবার ডানে। এলোমেলো চালাতে চালাতেই রাস্তার পাশের খাঁদে পড়ে গেল। নিচে পাথর ছিল। বুঝতে পারছি না কী হবে।
- তোরা কি উল্টাপাল্টা কিছু খাইছিলি?
- আরে না, কী বলিস? তোর ওখান থেকে আসার পর পানি ছাড়া আমরা কিছুই খাই নি।
মিতু মুখে হাত দিয়ে বসে রইল। কষ্ট হচ্ছে খুব বুকের ভিতর। অনেকটা কষ্ট।

ডাক্তাররাও বলছেন কিছু বলা যাচ্ছে না। জ্ঞান ফিরে নি এখনও তবে বেঁচে আছে। অবস্থা সুবিধার না। মিতুর খুব অস্থির লাগছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে এখন একটু আধটু অন্ধকার হতে শুরু করেছে। মিতু বলল, পানি খাব।
- তুই তো মিনারেল খাস।
- হ্যাঁ।
- তুই এখানে থাক, আমি বাহির থেকে নিয়ে আসছি।

মিনিট পাঁচেক পরেই শান্ত ফিরে আসল। পানির বোতলটা মিতুর দিকে এগিয়ে দিকে বলল, আলিফ এসেছে তোর সাথে?
পানির ঢোক গিলে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে মিতু বলল, না তো। কেন?
- আলিফের মত কাউকে দেখলাম হাসপাতালের সামনে। মোটর সাইকেলে।
- ও তো বাসায়।
- তাহলে ভুল দেখতে পারি, বাদ দে।

রাতের বেলাতেই সবুজকে আই সি ইউ তে পাঠানো হল। মুখ আর মাথা একদম থেতলে গেছে। চেনা যাচ্ছে না সবুজকে।
শান্ত বলল, রাতে হাসপাতালে থাকা যাবে না। বাসায় চলে যা তুই, আমিও বের হচ্ছি একটু পর। কাল সকালে আসব আবার।
মিতু বেরিয়ে আসল হাসপাতাল থেকে, চোখ মুছতে মুছতে। গাড়িতে উঠতে যাবে তখন দেখল শান্তর গাড়ির চাকার কাছে কিছু স্ক্রু পড়ে আছে। সেদিকে দেখে রাস্তার ওপাশে তাকাতেই দেখল আলিফের মত কাউকে। গাড়ি নিয়ে ওদিকে যেতেই নিশ্চিত হল, আলিফই।
গাড়ি থেকে নেমে আলিফের কাছে গিয়ে বলল, তুমি এখানে?
- হ্যাঁ।
- কি করছ?
- হাসপাতাল খুঁজে পাচ্ছি না। এখানে তিনটা হাসপাতাল। কোনটাতে তোমরা বুঝতে পারছিলাম না।
- সবুজের অবস্থা ভাল না। আই সি ইউ তে আছে।
- আচ্ছা।
- তুমি না বললে আসবে না?
- আসলাম।
- বাসায় ফিরব এখন চল।

বাসায় ফিরে আসতে রাত সাড়ে এগারটা বাজল। সারাদিন কিছু খাওয়া হয় নি। ফ্রিজে রাখা খাবার গরম করে আলিফের সাথে খেতে বসল মিতু। খাবার মুখে দিতেই বমি আসছে। সবুজের চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছে। আলিফ গপাগপ খাচ্ছে। মিতু একটু পর পর মোবাইলটা দেখছে চিন্তিত মুখে। আলিফ বলল, শান্তর ফোনের অপেক্ষা করছ?
মিতু খাবার মুখে দিয়ে মনোযোগ অন্য দিকে সরানোর চেষ্টা করে বলল, না, ফোনের অপেক্ষা কেন করব?
- আমি জানি করছ।
মিতু শান্ত চোখে আলিফের দিকে তাকাল। আলিফ খাবার খেতে খেতে, খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়েই বলল, মৃত মানুষ কি ফোন করতে পারে বল?
মিতু চমকে গিয়ে আলিফের দিকে তাকাল। মিতুর কপাল ঘামছে এসির মধ্যেও।
- মানে? কী বলছ তুমি?
আলিফ খাওয়া শেষ করে প্লেট ধুতে চলে গেল। মিতু পিছন থেকে বলল, আলিফ, বল কী বলছ তুমি?
আলিফ প্লেট ধুতে ধুতেই শান্ত স্বরে জবাব দিল, আমি কী বলছি তুমি ভাল করেই জানো। সকাল পর্যন্ত তো অপেক্ষা কর। অন্য কারও মোবাইলটা পেয়ে কল দিতে অন্তত সকাল তো হবেই। এখন ঘুমাতে আসো।

মিতু না খেয়েই উঠে গেল। শোবার ঘরে আলিফের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
- আলিফ, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি ক্লিয়ার কর কথা।
- মাথা ঠাণ্ডা রাখাটা সত্যি অনেক জরুরী মিতু। ঠাণ্ডা মাথায় তুমি সঠিক কিছু করতে পারবে, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে না। এটা আমার ক্ষেত্রেও, তোমার ক্ষেত্রেও, সবার ক্ষেত্রে।
- আলিফ, তুমি বল, ওটা কেন বললে? মৃত মানুষ মানে? শান্তর সাথে মৃত মানুষের কী সম্পর্ক?
- আমি কী বলছি, তুমি ভাল করে জানো তুমি। শান্ত এখন জীবিত না মৃত, আমার চেয়ে তুমি ভাল জানো। তাই না?
মিতু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আলিফ মিতুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি ভাবো, তুমি আমার মনের কথা বুঝতে পারো। সত্যিটা হল আমি তোমার মনের কথা বুঝতে পারি। ঘুমাও মিতু, অনেক রাত হয়েছে। বাহিরে মেঘ করেছে, বৃষ্টি নামতে পারে, ঘুম ভাল হবে।

মিতু আর আলিফ পাশাপাশি শুয়ে আছে। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না, আলিফ ঘুমিয়েছে কিনা। মিতু ঘুমায় নি। আলিফের রাগ, অভিমানের জায়গাটা আর কাল থেকে থাকবে না। পুরোপুরি নিশ্চিন্তে মিতুকে নিজের মত করে পাবে আলিফ। সবুজ হয়ত নেই এতক্ষণে, শান্তও হয়ত কোথাও মরে পড়ে আছে। আলিফের জন্য সবটাই করতে পারে মিতু। মিতু কখনও বুঝাতে পারে নি আলিফকে, কতটা ভালবাসে ও। আলিফ বুঝিয়ে দিত, সব কথাই শুনত। কিন্তু মিতু চলত নিজের মত। তবুও ভালবাসত, ভালবাসে, ভালবাসবে। হয়ত ভালবাসা বুঝাবার ক্ষমতা নেই মিতুর। তবু ভালবাসার ক্ষমতা তো আছে। শান্ত, সবুজকে নিয়ে সবচেয়ে বেশী ঝামেলা হত আলিফের সাথে মিতুর। শেষ দিকে এসে আলিফ কোন ঝামেলা করত না। তবুও ভালবাসার মানুষের মনের মাঝের ব্যথাটা অন্তত বুঝত মিতু। চাইলেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া যেত ওদের সাথে, তবু কোথায় যেন একটা বন্ধুত্বের টান ছিল। পারত না, চাইলেও পারত না। তাই শান্ত, সবুজকে দূরে অনেক দূরে পাঠিয়ে দিলে, যেখান থেকে চাইলেই যোগাযোগ করা যায় না, তাহলেই তো সমাধান। ঠাণ্ডা মাথায় মিতু সেদিন আলিফের সাথে কথা বলার কথা বলে সবুজের মোটর সাইকেলের কাছে গিয়ে, মোটর সাইকেলে রাখা খাবার পানির বোতলে ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল। সে পানি খেয়েই, ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় উল্টাপাল্টা মোটর সাইকেল চালিয়ে এক্সিডেন্ট সবুজের। শান্ত যখন পানি আনতে গেল, তখন কাদেরকে ফোন দিয়ে বলল, শান্তর গাড়ির চাকার স্ক্রু খুলে দিতে, লুস করে দিতে। নিশ্চিত এতক্ষণে এক্সিডেন্ট করেছে শান্তও। মিতু চোখ বুঝল। ঘুমানো দরকার। কালকের সকালটা অন্য রকম হবে। আলিফ আর মিতুর।
আলিফ জানে সবটাই যা যা করেছে মিতু। মিতু যখন পানির বোতলে ওষুধ মিশিয়েছে মোটর সাইকেল নিয়ে দূর থেকে দেখেছে। দেখেছে কাদের যখন গাড়ির স্ক্রু লুস করছিল তখনও। কাদের মিতুদের বাসার পুরনো কর্মচারী। যদিও এখন আর কাজ করে না।
মিতু ভাবছে খুব ঠাণ্ডা মাথায় কাজ গুলো করেছে। আসলে কিছুই ঠাণ্ডা মাথার ছিল না। একটা সিদ্ধান্তহীন মানুষের এলোমেলো অনেক গুলো সিদ্ধান্তের একটার বাস্তবায়ন ছিল শুধু।
ভালবাসায় মান অভিমান আসে, ভালবাসার মানুষের বন্ধুদের মাঝে মাঝে খারাপ লাগাটা সহজাত প্রবৃত্তি। এই খারাপ লাগাও ভালবাসার প্রকাশ। শুধু মাত্র এইটুকু খারাপ লাগায় ভালবাসা হারিয়ে যায় না। ভালবাসা এতো সহজে হারিয়ে যাবার জিনিস না।
মেঘ করেছে বাহিরে। আষাঢ় মাসের শেষের দিক। মেঘে মেঘে বৃষ্টি হচ্ছে। এখানেই বৃষ্টি এখানেই রোদ। বুঝতে পারা কঠিন, কোন মেঘে বৃষ্টি হবে, কোন মেঘে হবে না। মানুষের মনের মত জটিল সেই হিসাব।

- রিয়াদুল রিয়াদ ( শেষ রাতের আঁধার )

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.