নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফেসবুকে আমি - রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার )

কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ সুহাসিনী

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:০৮

সুহাসিনী যখন হাসতে ভুলে গেছে, নীরব তখন অনেক চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কাঠে শ্যাওলা ধরে, দেয়ালে শ্যাওলা ধরে, মানুষের মনেও দিনে দিনে ব্যথা দু:খের হিসাবে শ্যাওলা ধরে যায়। নীরব চায় না ছোট বড় যাই হোক, মলিনতা কিংবা আর্দ্রতায় মনের মাঝে শ্যাওলা জমুক। আলতো করে হলেও ব্যথারা বাসা বাধুক। সরু গলির এই এলাকায় উৎসব লেগেই থাকে। এর গায়ে হলুদ আজ তো কাল বিয়ে, এর নতুন সন্তানের আগমন আজ তো কাল সুন্নাতে খতনা, এর ছেলে পাস করেছে তো কাল চাকরি পেয়েছে, এ নতুন ব্যবসা দিয়েছে তো কাল লাভ করেছে। এখানে উৎসবের উৎসের অভাব হয় না। এখানে চুপ করে এক কোণে বসে কাঁদার অবকাশ নেই, নেই সুযোগ সস্তা ঢোল বাদকদের ঢোলের তালে তাল না মিলিয়ে গা দুলিয়ে। এ এলাকায় বলতে গেলে যারা স্থানীয় সবাই অবস্থা সম্পন্ন। পড়ালেখার পাট চুকাবার চেয়ে মনযোগের মাত্রা বেশি কারও চেয়ে বেশি উপার্জনে, কারও চেয়ে বেশি ব্যবসায় লাভ করাতে, কারও চেয়ে বেশি হই হুল্লোড় করে কোন উপলক্ষ উদযাপনে। হাতে গোণা কয়েক খানা শিক্ষিত পরিবারের মধ্যে সুহাসিনীদের নাম আগে আসবেই। সুহাসিনীর বড় ভাই সৌরভ আইন পাশ করে বড় উকিল, ছোট বোন সপ্তম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান করা, বাকি রইল সুহাসিনী, সেও কম যায় না। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বেশ ভালোয় ভালোয় চালাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে সম্মানের পড়াশুনা। কয়জন বা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছে পড়ার এ এলাকার? ঐ সুহাসিনীর বড় ভাইয়ের পর গোটা দুয়েক আর এখন সুহাসিনী। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার পথেই রাস্তার মাঝে একদিন দেখেছিল নীরব সুহাসিনীকে। নামের মতই সুহাসিনী বড় হাস্যোজ্জ্বল, ঠোঁটের কোণায় এক খানা হাসি লেগেই থাকে যেন সবসময়। নীরব যদিও সেদিক থেকে নিজের নামের প্রতি অতটা সুবিচার করতে পারে নি। আগে যাও চুপচাপ থাকত, এখন ঐ ক্লাসের পাজি ছাত্র গুলোর সাথে উঠতে বসতে পাজিগিরী নিজেও অনেকটা আয়ত্ত করেছে। আগে চুপচাপ এখন কারণ ছাড়াই বকর বকর। এইটুকু পার্থক্যই। সুহাসিনীকে দেখার পরই মনের মাঝে ভালবাসা চলে এসেছে ব্যাপার কিন্তু অমন নয়। প্রথম দেখায় ভালোলাগা হয়, ওটাকে অনেকেই ভালবাসার সাথে গুলিয়ে ফেলে। অতটা বোকা ছেলেও নীরব নয়। ভালোলাগার বীজ খানায় সুহাসিনীকে দেখলেই বৃষ্টির পানি ছিটিয়ে দেবার মত ভিজে যেত, বীজ খানা যত্ন পেতে পেতে একদিন ভালবাসার গাছ হয়ে আত্মপ্রকাশ করল। সে ভালবাসা নীরব বোঝাতে পারে না, বলতে পারে না, শুধু দূর থেকে দেখার মাঝে লুকিয়ে রইল।
- বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছ বুঝি?
প্রথম কথা এটুকুই। নীরব মনে কতটা সাহস সঞ্চয় করে সে কথা বলেছিল তা কেবল নীরবই জানে।সুহাসিনী জবাবে মুখ খুলেনি, হাসিটা লুকাবার চেষ্টা করে মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল। সুহাসিনী খেয়াল করত ছেলেটা মাঝে মাঝেই ঘুর ঘুর করে আশেপাশে। হয়ত ঘুর ঘুর করে সবসময়, সুহাসিনীর নজরে আসে কদাচিৎ। খুব একটা বিরক্ত করে তেমন না, তবুও এভাবে আশেপাশে ঘুর ঘুর করা অস্বস্তির কারণ হতেই পারে। নীরব তা বুঝে না। দ্বিতীয় বার কথা বলাটা আরও সাহস করে, সরু গলির মাঝ দিয়ে যাবার জন্য একজনের যেখানে কষ্ট হয়ে যায়, সেখানে সুহাসিনীর পাশ ঘেঁষে একদিন যাবার সময় বলে যায় সুহাসিনীর দিকে না তাকিয়েই, আমি তোমার পাশের বাসাতেই থাকি। বিকাল বেলা ছাদে আসি প্রতিদিন।
সুহাসিনী সে কথা শুনেছে কিনা, শুনলেও তা আদৌ গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে কিনা জানে না নীরব। জানবার কথাও না। এত সহজে মানুষের মনের কথা বুঝবার সাধ্য নীরব কেন, বোধ হয় কারও নেই। তবু বেলা গড়িয়ে যখন মধ্যাহ্ন তখন থেকেই নীরব ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে। কাঠ ফাটা রোদে মিটিমিটি চোখে এদিক ওদিক দেখে। বিকেল তখনও হয় নি যদিও, তবুও ঔৎসুক চোখ জোড়া ও বাড়ির ছাদে, আলতো করে দেখতে পাওয়া বারান্দায় চোখ বুলায়। অপরাহ্ণে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করে, কাঠ ফাটা রোদে একটা স্নিগ্ধ প্রলেপ দিয়ে দেয়। পূর্বাভাস ছাড়াই ঝুম বৃষ্টি নামে। সে বৃষ্টিতেও নীরবের স্থিরতা নেই, অবসর নেই, নেই চোখ জোড়ার বিশ্রাম। ভাবে হয়ত সুহাসিনী বৃষ্টিতে ভিজতে আসবে, আকাশের দিকে চোখ বুজে তাকিয়ে থাকবে, বৃষ্টির ছোঁয়া অনুভব করবে। আর এদিকটায় মুগ্ধ হয়ে নীরব দেখবে সুহাসিনীকে। ভালবাসার গাছটা আরও আদর পাবে, আরও বড় হবে, ডাল পালা ছড়াবে। অমন কিছু ঘটে না। সন্ধ্যার আবছা আলোতেও নীরব ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। সুহাসিনী আসে নি, সুহাসিনী আসে না।
সেদিনের সে ঘটনা নীরবকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। নীরব আর ছাদে যায় না, সুহাসিনীর পথ আগলায় না, সরু গলিতে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কিছু বলে না, দূর থেকেও দেখে না। শুধু ভালবাসে। ভালবাসার গাছখানা তবু অযত্ন পায় নি, বেড়েই চলে। বিস্ময় আর কৌতূহলে খেয়াল করে নীরব, এ ভালবাসা বড় অদ্ভুত জিনিস।
পাশের বাসায় থাকে সুহাসিনীরা, এ বাসায় ভাড়া থাকে নীরবরা। কীভাবে কীভাবে যেন বেশ ভাল সম্পর্ক হয়ে যায় সুহাসিনীর মা, নীরবের মায়ের মাঝে। দুজনের পরস্পরের বাসায় আসা যাওয়া চলে, আসা যাওয়া চলে না শুধু নীরব আর সুহাসিনীর। মায়ের মারফতেই জানতে পারে, সুহাসিনীকে পাত্র পক্ষ দেখতে এসেছিল, পছন্দ হয়েছে, বিয়ে অতি শীঘ্র। নীরব সে কথা শুনে চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, কী যেন ভাবে। ভেবে চিন্তে ভাবনা ভেঙে বলে, ওটুকু মেয়ের আবার কীসের বিয়ে?
মা চোখ ছোট ছোট করে বলেন, ও টুকু মেয়ে? তোর চেয়ে দুই বছরের বড়।
- বললেই বড় হল? আমার সমানই। তোমরা ইচ্ছা করে সার্টিফিকেটে আমার বয়স দুই বছর কমিয়ে দিয়েছ, সে কথা আমি জানি।
মা মুখটা হাঁ করে কিছুক্ষণ এরপর বন্ধ করে বলেন, এ কথা তোকে কে বলেছে?
- কে বলবে আবার? আমি আমাকে দেখে বুঝি না আমার বয়স কত?
- ছাই বুঝিস। যা গোসলে যা। দুপুরে আবার এ বাড়িতে পানি থাকে না। ভাড়াটিয়া হলে যত যন্ত্রণা, এমন ভাব করে বাড়িওয়ালা, যেন আমাদের ঘরে আরেক খানা পানির ট্যাংকি আছে, তার মধ্যে সব পানি আমরা ভরে রেখে দেই। রাতের বেলা তা ফেরী করে বিক্রি করি।
নীরবের কানে সে কথা যায় না। নীরব ভাবছে অন্য কথা। হয়ত জীবনের সবটুকু সাহস সঞ্চয় করে মাকে বলে দিল, ও মা, আমি সুহাসিনীকে বিয়ে করব।
মায়ের মুখে কোন কথা আসে না, নীরবের দিকে এক দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি অনুভব করেন, ছেলের মুখে কোন কৌতুকের হাসি নেই। এ কথা হয়ত মনের কথা। তবুও তিনি সে কথায় সায় দেন না। উদোম পিঠে একটা হালকা চড় দিয়ে বলেন, যা গোসলে যা।
মা নীরবের মনের কথা সত্যিই বুঝতে পারেন নি। মা বুঝতে না পারলে, সুহাসিনী বুঝবে কী করে? ছোট একটা আশা তাও কল্পনাতে পর্যবসিত হয়ে গেল। নীরব আর কাউকে কিছু বুঝাতে চায় না। মনের চাওয়া গুলো বুঝিয়ে দিতে সবাই পারে না, কেউ কেউ ভেবেই নেয়, মনের চাওয়া গুলো মানুষ বুঝে নিক। মানুষ গুলো তা বুঝতে পারে না, বুঝবার ক্ষমতা সবার থাকে না।
আজ সুহাসিনীর বিয়ে। বিয়ের সাথে মেয়ের মুখ গোমড়া করে রাখার একটা সম্পর্ক আছে। তাই সুহাসিনী মুখের ভাব এমন করে রেখেছে যেন হাসতে ভুলে গেছে, নীরব তখন চঞ্চল হয়ে উঠেছে অনেক। এদিক দেখছে, ওদিক দেখছে। বিয়ের এই কাজ করছে, করছে ঐ কাজ। মা সুহাসিনীর মায়ের সাথে বসে বসে পান চিবুচ্ছেন। নীরব পারত পক্ষে সুহাসিনীর দিকে তাকাচ্ছে না। তাকালেই মনের মাঝের ভালবাসার গাছটায় যেন আঘাত লাগছে, বুক চিরে কিছু ডাল পালা বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। কষ্ট দিচ্ছে, খুব কষ্ট। সুহাসিনীকে সেদিন শেষ দেখেছিল, স্বামীর সাথে গাড়িতে উঠবার সময়। অত লোকের ভিড়ে ফাঁক গলে সুহাসিনীর দেখা পাওয়াটা ছিল দুষ্কর। তবু কেন যেন মনে হচ্ছিল নীরবের, মলিন মুখে, উদাস চোখে সুহাসিনী তাকিয়েছিল নীরবের দিকে। এ সত্যি হতেই পারে, মনের ভুল না হবার সম্ভাবনাও কম নয়। গাড়িটা যখন ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিল নীরবের মনে হচ্ছিল হারিয়ে যাচ্ছে খুব প্রিয় কিছু, শূন্যতা হয়ে যাচ্ছে বুকের ভিতরের সব কিছু, এ শূন্যতা পুরো পৃথিবী এসে বুকে ভর করলেও পূরণ হবার না। মনে হচ্ছিল ভালবাসাটার গাছে ডালা গুলো প্রচণ্ড ঝড়ে দুলছে, তার সাথে দুলছে নীরব, সে ঝড় থামবার নয়, সে ঝড় সব এলোমেলো করে দেবার, সব ছিন্ন ভিন্ন করে দেবার। প্রচণ্ড শব্দে ঢোল বাদকরা বাজাচ্ছে ঢোল, সে ঢোলের প্রতিটা আঘাত এসে যেন আঘাত করছে নীরবের বুকে, সে শব্দের প্রতিধ্বনি নীরবের কানে আঘাত খেয়ে ফিরে যাচ্ছে, ফিরে যাচ্ছে দূরে কোথাও, এতোটা দূরে যেন তা বিলীন হচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে অসীমে।
সুহাসিনীর বিয়ে হয়েছে যার সাথে, সেও এ এলাকার যে কারও সাথে পাল্লা দেবার মত টাকা পয়সাওয়ালা। চালের আড়ত, পেয়াজের আড়ত, ডিমের আড়ত, নিজের দুই দুইটা বাড়ি, রাজনৈতিক ক্ষমতা সবই আছে। অগত্যা নীরব ভেবে নেয়, ভালই হল, ও লোকের সাথে পেরে ওঠা নীরবের কর্ম নয়। সুহাসিনীর সাথে ওভাবে আর দেখা হয় নি, তবে শুনেছে নীরব সুহাসিনী ভালই আছে। ভাল থাকবেই, নীরবের কথা ভাববার সময় সুহাসিনীর নেই, কখনও ছিল সময় তেমনও কিন্তু নয়। এর মাঝে ঘটনার প্রবাহে ঘটে যায় অনেক কিছু। নীরব পিতাকে হারিয়েছে সেই ছেলেবেলা। এক মাত্র কাছের মানুষ মা, সেও গত হয়েছেন হুট করেই। পড়াশুনা আর শেষ করা হয় নি নীরবের। যে মামার কাছে থেকে বড় হয়েছে, সে মামার ছেলে পেলে না থাকাতে, অল্প স্বল্প ব্যবসার দায়িত্ব পড়েছে নীরবের উপর। ব্যবসার লোক নীরব নয়, ব্যবসাতেও তাই ক্ষতি হচ্ছে, সে ক্ষতি কোনভাবেই পুষিয়ে উঠতে পারছে না নীরব। সব বদলে গেলেও, শুধু বদলায় নি নীরবের থাকা সেই বাড়িটা। ও বাড়িতেই এখনও থাকে নীরব। হয়ত অদৃশ্য কোন টানে আটকা পড়ে আছে। মাঝে মাঝেই ছাদে উঠে উদাস ভাবে আকাশ দেখে। সে আকাশে চাঁদ উঠে না সূর্য থাকে, মেঘের প্রলেপে ঢাকা পড়ে না রংধনু খেলা করে সে সবে নীরবের আগ্রহ জন্মায় না। নীরব এখনও ওপাশের ছাদটায় মাঝে মাঝেই তাকিয়ে থাকে, আলতো করে দেখতে পাওয়া বারান্দায় উঁকি দেয়, সেখানে কাউকে খুঁজে বেরায়, সে কেউ ফিরে আসে না, দেখা দেয় না।
একদিন হঠাৎ খবর পায় সুহাসিনীর স্বামী গত হয়েছে। হরতালের দিনে মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না, হরতাল সমর্থকদের পেট্রোল বোমায় মোটর সাইকেল থেকে পড়ে ওখানেই নিহত হয়। খবরটায় নীরবের খুশি হবার কথা থাকলেও কেন যেন খারাপ লাগছিল খুব। ছুটে গিয়েছিল সুহাসিনীর কাছে নীরব, এ বিপদের দিনে পাশে না দাঁড়াতে পারলে কীসের ভালবাসা? সুহাসিনীও যেন নীরবকে পাশে চাইছিল। নীরবের ডাকে তিন বছরের বাচ্চা সহ চলে এসেছিল নীরবের কাছে, নতুন করে সংসার শুরু করে নীরবের সাথে। খুব যত্নে মনের মাঝে কোন বাসনা লালন করলে তা নাকি একদিন সত্যি হয়। নীরবের বাসনাও সত্যি হয়েছিল। সুহাসিনী যেদিন সংসারে আসে, সেদিনই নীরব সুহাসিনীর প্রিয় নয়ন তারা ফুলের গাছ নিয়ে আসে অনেক গুলো। টবে করে বসিয়ে দেয় বারান্দায়, বারান্দার যেখানটায় রোদ পড়ে সেখানটায়। নয়ন তারা ফুলকে ভালবাসার মত কী আছে কে জানে, না দেখতে খুব সুন্দর, না আছে কোন ঘ্রাণ। সুহাসিনী সত্যি বড় রহস্যে ঘেরা, সে রহস্যে ডুব দিয়ে নীরব চায় কিছুটা ভেদ করতে। আপন করে ভালবেসে কিছুটা জানতে। এই যেমন এতদিনে জেনে গেছে, নীরব যেদিন বলেছিল বিকালে ও ছাদে আসে, লজ্জায় যদিও সামনে আসতে পারে নি সুহাসিনী, তবুও ঠিকই বারান্দায় দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল নীরবকে। নীরব যখন মন মড়া আকাশের কান্নার সাথে ভিজছিল সুহাসিনী বার বার চাইছিল, চিৎকার করে বলতে, অমন মন খারাপ কোরো না না তো। আমি তো আছি আশেপাশে।
নীরবের ব্যথা গুলো বুঝতে পেরে, বর্ষণস্নাত সে সন্ধ্যায় ঘরের বাতি নিভিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল একা একা অনেকটা সময়। নীরব তার কিছুই বুঝতে পারে নি। খামখেয়ালী মনে অভিমান করেছে শুধু, মন খারাপের দেয়ালে মাথা ঠুকে ভুল বুঝেছে শুধু। সুহাসিনীর বিয়ের কথা যখন চলে, নীরবের মা তখন সুহাসিনীর মায়ের সাথে নীরব বিয়ে করতে চায় সুহাসিনীকে এসব বলে হাসি ঠাট্টা করছিল। সুহাসিনী তখন দরজার ওপাশ থেকে সব শুনে, মনে মনেই বলেছিল, ভুল কী বলেছে নীরব? সবটাই তো সত্যি। ঐ সার্টিফিকেটে দুই এক বছরে বড় ছোটতে কিইবা আসে যায়? মনের আবার বয়েস আছে নাকি?
বিয়ের দিনটাতে নীরবের চঞ্চল আভার আড়ালের ব্যথা গুলোও বুঝতে পেরেছিল সুহাসিনী। তাই তো মুখের হাসি নাই করে, চুপ করে গিয়েছিল। আশেপাশে নীরবকেই খুঁজছিল বার বার। ভাবছিল, অন্তত শেষ বারের মত এসে নীরব বলুক, এই সুহাসিনী বিয়ে করছ কেন? আমি তোমাকে যে ভালবাসি তার কোন দাম নেই নাকি? চল পালিয়ে যাই দুজনে।
নীরব এসে অমন করে বললে সত্যি সেদিন পালিয়ে যেত সুহাসিনী চোখ বুজে নীরবের হাতটা ধরে। নীরব বুঝতে পারে নি সুহাসিনীকে, সুহাসিনী তাই মেনেই নিয়েছিল ভাগ্যকে। নীরব যদি সেদিন ওটুকু সাহস দেখাতো, ঠিক এতো গুলো বছর অপেক্ষা সত্যি করতে হত? সুহাসিনীর তিন বছরের বাচ্চা এখন নীরবকে বাবা ডাকত। নীরব আরও অনেক গুলো বছর সুহাসিনীর সাথে ভালবাসায় কাটাতে পারত।
যা হয় নি তা নিয়ে ভেবে আর কী! তার চেয়ে বরং এই বেশ, সুহাসিনী তো নীরবের হল। ছোট বাচ্চাটার প্রতি কোন রাগ, অভিমান, অনুযোগ নীরবের নেই। ও বাচ্চাকেও ভালবাসে নীরব। আদর করে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, গোসল করাবার সময় সুহাসিনী ক্লান্ত হয়ে গেলে, বাবা দেখি তো, বলে গোসল করিয়ে দেয়। ঘুমাবার আগে নানা রকম গল্প বলে। প্রতিদিন টুকটাক খেলনা কিনে নিয়ে আসে। আর সব কিছুর পরে ঐ নয়ন তারা গাছের যত্ন করে। সময়ের সাথে সুহাসিনীর সাথে ভালবাসা বাড়ে, বেড়ে ওঠে নয়ন তারা গাছ। নয়ন তারা গাছে ফুল ধরে, সাদা ফুল, বেগুনী ফুল। বছর না পেরুতেই টুপ করে নয়ন তারা মরে যায়, নয়ন তারার শোকে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয় সুহাসিনী। নীরব আবার কিনে আনে নয়ন তারা গাছ, সাথে দুইটা বেলি ফুলের চারা। সে চারাও বড় হয়, ফুল দেয়, মরে যায়। বছর বছর নতুন নতুন ফুলের গাছে বারান্দা ভরে উঠে। প্রতিদিন কিনে আনা খেলনায় ভরে উঠে ঘর, সুহাসিনীর জন্য কেনা শাড়িতে ভরে ওঠে শোবার ঘর। সুহাসিনী, সুহাসিনীর তিন বছরের ছেলেটা, আর বারান্দার ফুলের গাছদের সাথে বেশ কাটে দিন। সব ভালোয় খারাপ যায় মাত্র মামার ব্যবসাটা যা দেখা শুনা করে নীরব। এ সময় একদম শেষ হয়ে যায় ব্যবসা। বাড়ি ভাড়া দেয়া হয় না, তিন বছরের বাচ্চার জন্য খেলনা কেনা হয় না, কেনা হয় না সুহাসিনীর জন্য নতুন শাড়ি, বারান্দার লাগানো হয় না আর নতুন ফুলের চারা। একদিন বাড়িওয়ালা এসে জানিয়ে দেন, বাবা, এভাবে তো চলে না আর। তুমি বাড়িটা ছেড়ে দাও। ভাড়া বাকী তোমার প্রায় এক বছরের।
নীরব ভেজা ভেজা চোখে বলে, চাচা এই অবস্থায় আমি কোথায় যাব বলেন? বউ আর তিন বছরের বাচ্চা নিয়ে তো হুট করেই একটা জায়গায় চলে যাওয়া যায় না।
বাড়িওয়ালা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ নীরবের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মাথা থেকে টুপিটা খুলে হাত নিয়ে বলেন, কী বলতেছ বাবা তুমি এসব?
নীরব চিৎকার করে বলে, সুহাসিনী চাচাকে কিছু নাস্তা দাও।
তিন বছরের বাচ্চার দিকে তাকিয়ে বলে, দাদুকে সালাম দাও তো বাবা।
বাড়িওয়ালা মাথায় টুপি দিয়ে উঠে দাঁড়ান। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। ঘামটা মুছে বলেন, না বাবা, কিছু লাগবে না। আমার কাজ আছে, আসি আমি।
বাড়িওয়ালা সাহেব দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। এভাবে চলে যাবার কিছুই বুঝতে পারে না নীরব।
পরদিন সুহাসিনীর বাবা মা আসেন বাসায়, বাড়িওয়ালার সাথে। নীরব তাদের দেখেই ব্যস্ত হয়ে উঠে। সুহাসিনীর সাথে বিয়ের পর কখনও যোগাযোগ করেন নি আর তারা সুহাসিনীর সাথে। এ বিয়েতে তাদের সম্মতি ছিল না। সুহাসিনীরও কড়া নির্দেশ ছিল যেন কখনও তাদের সাথে যোগাযোগ করে নীরব ছোট না হয়। নীরব আবার চিৎকার করে বলে, সুহাসিনী দেখো কে আসছে। তোমার বাবা মা, দৌড় দাও দ্রুত।
তিন বছরের বাচ্চার দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার নানা নানু। এদিকে আসো।
সুহাসিনীর বাবা, মা, বাড়িওয়ালা তিন জনেই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে নীরবের দিকে। সুহাসিনীর বাবা নীরবকে ধরে বলেল, তুমি ঠিক আছ, বাবা?
- জ্বি বাবা, আমি ঠিক আছি, কিন্তু ব্যবসার অবস্থার ভাল না। এই অবস্থায় বাড়িওয়ালা চাচা বের করে দিতে চাচ্ছেন। আপনার মেয়ে আর তিন বছরের বাচ্চা নিয়ে কই যাব বলেন?
সুহাসিনীর বাবা, মাও শেষমেশ চলে আসেন। তারা অনেক করেও বুঝাতে পারেন নি, সুহাসিনী ওর স্বামীর সাথে চার বছর আগেই মারা গিয়েছে। মারা গিয়েছে সুহাসিনীর তিন বছরের বাচ্চা শোভনও। নীরব বুঝতে চায় না, নীরব মানতেও চায় না, চার এর সাথে তিন যোগ করলে সাত। এখন বাচ্চার বয়স হত সাত। বছরের পর পর গাছের বয়স বাড়ে, ফুল হয়, ঝরে পড়ে, বয়স কেন বাড়ে না সুহাসিনীর ছোট তিন বছরের বাচ্চার। কেন একটা কাপড়ও সুহাসিনীর জন্য নিয়ে আসা, পরে নি সুহাসিনী। কেন এখনও শোভনের জন্য আনা সব গুলো খেলনা জমে আছে ঘরের মাঝেই। নীরবের পৃথিবী ওসব নিয়ম মানে না। সব নিয়ম সব জায়গায় খাটে না। অনেক শ্রমে, অনেক দিনের সাধনায় নীরব সুহাসিনীকে পেয়েছে, এই সুহাসিনীকে আর নীরব হারাতে চায় না। নীরব মানতেও চায় না, সেদিন হরতালের দিন ছিল না, সাধারণ একটা দিনে, জনাকীর্ণ একটা জায়গায়, ঐ মোটর সাইকেলে পেট্রোল বোমা মেরেছিল নীরব। কেউ দেখে নি নীরবকে। শুধু এসে দেখেছে, পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া তিনটা লাশ। সুহাসিনী, ওর তিন বছরের বাচ্চা আর স্বামীর। নীরব একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি করে, নতুন একটা অধ্যায় শুরু করেছে। সেখানে কল্পনায় বসবাস সুহাসিনী আর সুহাসিনীর তিন বছরের বাচ্চার সাথে নীরবের। সেখানে সবই আছে, কিন্তু বুকের মাঝে যে ভালবাসার গাছটা ছিল, সেটা কেন যেন নেই। তাই টবে গাছ লাগিয়ে ভুলে থাকে সে কথা নীরব। নিজের কল্পনায় ভাল থাকার সুখ খুঁজে বেরানো সুখ গুলো যে অসুখ তা নীরব জানে না। জানে না, অনেক দিনের যত্নে বেড়ে ওঠা বুকের মাঝের যে ভালবাসার গাছটা সেদিন হিংস্র নীরবের আঘাতে সুহাসিনীর মৃত্যুর সাথে সাথে মরে গিয়েছে, সে গাছের শূন্যতা ঐ বন্দী বারান্দায় টবে লাগানো গাছ দিয়ে কখনও পূরণ করা সম্ভব না। সম্ভব না এই সংকীর্ণ বারান্দায় ডাল পালা মেলে অত বড় হওয়া।
যে ভালবাসা যত্নে বাড়ে, সে ভালবাসা একটু অযত্ন পেলেই চুপ করে হারিয়ে যায়, শূন্যে মিলিয়ে যায়। তার দেখা পাওয়া আর কখনই যায় না। ব্যাপারটা কঠিন করে ভাবলে অনেক সহজ, সহজ করে ভাবলে সত্যি অনেক জটিল।

- সুহাসিনী
- রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

মন্তব্য -১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (-১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:৪৬

আদর্শ সৈনিক বলেছেন: এটা কি গল্প না কবিতা? এগুলা লিখলে কি হয়?

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:৪৩

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: এটা কবিতা, আর এতেতে কিছুই হয় না, অপ্রয়োজনীয় জিনিস।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.