নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফেসবুকে আমি - রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার )

কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারঃ টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (দ্বিতীয় পর্ব)

০২ রা মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:৩৩

প্রথম পর্ব


- আরে খালি হাতে ধরিস না ওসব। হাত কেটে যাবে।
বশির স্যার নৃ কে কোলে নিয়ে স্নেহার কাছে আসলেন। উপর থেকে শব্দ শুনে নিচে এসে খুঁজে স্নেহা ভাঙলটা কি? খুঁজে পায় না। উঠে গিয়ে আবার শুয়ে থাকে। আবার সে ভেঙে যাওয়ার শব্দ। এবার খুঁজে খুঁজে দেখে, নিচ তলার টেবিলের পাশে ভাঙা গ্লাস পড়ে আছে কয়েকটা। পানি খাবার গ্লাস। এই গ্লাস গুলোও এনায়েত চাচা মনে হয় রেখে গিয়েছিলেন। স্নেহা আশেপাশে তাকাল, কেউ নেই। ভাঙল কি করে তাহলে? স্নেহার মনের মাঝে কেমন যেন খচখচ করছে। ভয় লাগছে খানিকটা। ভয়টা ঝেঁকে বসলেও মনের মধ্যে, মনকে বুঝায় স্নেহা, ইঁদুর বিড়াল কিছু একটার কাজ হবে। এভাবে পড়ে থাকলে হবে না, তাই পরিষ্কার করার জন্য হাত দিতেই বশির স্যার এসে বললেন হাত কেটে যাবে। স্নেহা আর হাত দিল না সেখানে।
- নৃ, কেমন ঘুরে দেখলে মা?
নৃ কিছু বলল না। জানত কিছু বলবে না নৃ। বশির স্যার বললেন, বল নৃ কেমন দেখলে?
- ভাল।
বেশ গম্ভীর জবাব। স্নেহা ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলল। বশির স্যার স্নেহাকে কোল থেকে নামিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিল।
- তোর জামাই মনে হয়, পছন্দ করছে না আমি এখানে এসেছি সেটা।
- স্যার, ওর কথা বাদ দেন তো। ও তো একটু অমনই, জানেনই তো।
- তাও আমি তোকে বলেছিলাম, আমার আসার দরকার নেই।
- দরকার আছে, আপনি না আসলে নৃকে সামলাতাম কি করে? ও তো আমাদের কারও কথা শুনে না।
- চিন্তা করিস না। আমি একটা তাবিজ লাগিয়ে দিছি, ঠিক হয়ে যাবে দেখিস সব।
- ঠিক হলেই ভাল।
- তোরা এখানে থাকবি কয়দিন?
- মৃন্ময়ের কাজ শেষ হবার আগ পর্যন্ত।
- হ্যাঁ রে এই বাড়িটা নাকি সবাই পায়? কথা কি সত্যি? ভুত টুতের ব্যাপার।
- লোকে তো নাকি বলে। জানি না। থাকতেও পারে।
- হাহাহা, তুই এসব বিশ্বাস করিস? ভুত টুত বলতে আছে নাকি কিছু?
স্নেহা চুপ হয়ে গেল। নিশ্চুপ চোখে তাকিয়ে রইল, ভাঙা গ্লাসের টুকরা গুলোর দিকে। কি স্বচ্ছ, অথচ কত ধারালো।

রান্নার কাজ চলছে। সব কিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন এনায়েত চাচা। বাজার করেও দিয়ে গেছেন এক গাদা। বাজার নাকি করে রেখেছেন আরও সকালে। রান্না করে খাবে, নাকি তাদের বাড়িতে খাবে,তা জানার জন্য পাঠিয়েছিল রাসেল কে। রাসেল ও বাড়ির অনেক দিনের পুরাতন কর্মচারী। মৃন্ময়ের চাচা হয় এনায়েত সাহেব, অত দূরের কোন সম্পর্কের না। মৃন্ময়ের দাদা আর এনায়েত চাচার বাবা দুজন ছিলেন সৎ ভাই। এনায়েত চাচাদের অবস্থাও বেশ ভাল। গ্রামের যত কিছু দেখ ভাল করা সব ধরতে গেলে এনায়েত চাচাই করেন। এখানে আসার আগে যোগাযোগ করেছিল মৃন্ময় এনায়েত চাচার সাথেই। বাড়ি বিক্রি করবে শুনে বলেছিলেন, কি দরকার বাবা? বাবা দাদার তোমাদের একমাত্র চিহ্ন, এই গ্রামে।
- না চাচা, বিক্রি করা দরকার। আপনি একটু খোঁজ খবর করেন, কেউ কিনবে কিনা।
- আচ্ছা বাবা তুমি যা ভাল বুঝ।
এখানে আসার সময় ট্রেন স্টেশনে নিজেই গিয়েছিলেন মৃন্ময়দের নিয়ে আসতে। বাড়িতে ঢুকে বলেন, তোমরা আসবে বলে, সব আগে থেকেই ঠিক ঠাক করে রেখেছি লোকজন এনে। কত বছর কেউ থাকে না, একদম থাকার মত অবস্থা ছিল না। এখন কোন সমস্যা নাই। সব আছে বাড়িতে। আর কিছু লাগলে আমি তো আছিই।
কথা হয় তখন শুধু মৃন্ময়ের সাথেই। বাজার নিয়ে এসে কথা বলেন, স্নেহার সাথে। কথা বলতে যান, নৃর সাথে। নৃ চোখ উল্টে তাকাতেই ভয়ে চলে আসেন তিনি। জিজ্ঞাসা করেন বশির স্যারের কথা, বউ মা, লোকটা কে?
- আমার স্যার।
- আচ্ছা, আচ্ছা। ভাল ভাল।

রান্না করা হয়েছে, দেশী মুরগীর ভুনা, লাউ চিংড়ি মাছের ঝোল, ঝিঙা ভাঁজি, সুরমা মাছ। বাজার ছিল আরও অনেক কিছু। এতো কিছু রান্না করতে ইচ্ছা করছে না স্নেহার তাই, করা হল না। দুপুরে এখানেই খাবে, এনায়েত চাচা। স্নেহা অনেক বলে কয়ে রেখেছেন। রাসেলও বসে আছে, এনায়েত চাচার পাশে। আবার আতরের সে বিচ্ছিরী গন্ধটা আসছে। আতরের গন্ধ যে এতোটা বিচ্ছিরী হতে পারে, জানা ছিল না স্নেহার। মনে হচ্ছে স্নেহার এই লোক, কোথা থেকে পচা আতর কিনে তা গায়ে মেখে এসেছে।
দুপুরেরে খাবারের আগেই চলে আসল, মৃন্ময়। গোসল করে বসে গেল খেতে। এনায়েত চাচা, আগে থেকেই গোসল খানায় পানি এনে রেখে দিয়েছেন। তাছাড়া মিস্ত্রি এনে টিউব ওয়েলটাও ঠিক করিয়েছেন। খেতে বসে মৃন্ময় বলল, বাহ গ্রামে এসে তোমার রান্নার হাত দেখি খুলেছে।
স্নেহা চোখ ছোট ছোট করে বলল, কেন আগে যেন খারাপ ছিল।
- না, আগে মুখে দেয়া যেত । আর এখন খাওয়া যায়।
- হইছে, আমার সবই তোমার খারাপ লাগে জানি ।
এতজনের সামনে মৃন্ময় আর কিছু বলল না । চুপ করে খেতে লাগল। খাওয়া শেষে এনায়েত চাচার সাথে কথা বলল কিছুটা সময়। চাচাকে বলেছিল লোক দেখতে একজন। চাচা বলেন, গ্রামের দিকে কেউ কিনবে না। এই গ্রামের লোকজন ভয় পায় বাড়িটা। কয়েক গ্রাম পরে, এক লোকের খোঁজ আছে, সে যেখানে যেমন খুশি জায়গা হোক, কিনে নিচ্ছে। তার সাথে কথা বলেছেন এনায়েত চাচা । একদিন গিয়ে মৃন্ময়ের দেখা করে আসতে হবে। দাওয়াত দিয়েছে একদিন মৃন্ময়কে তার বাসায়।
- আচ্ছা, চাচা, যাব।
মৃন্ময় শান্ত স্বরে বলল।
- তোমাদের রাতের জন্য বাজার রাসেল দিয়ে আসবে।
- না চাচা, লাগবে না। দুপুরের বাজারই আছে এখনও। আর চাচা হিসাবটা একটু দিয়েন।
- কিসের হিসাব?
- এই যে খরচ করছেন সেসবের হিসাব।
- বাবা, তুমি এইটা কি বললে? তুমি আসছ, এতো বছর পর গ্রামে, একটু আধটু খরচ পাতি করছি, তুমি তাও শোধ করতে চাও। তুমি হইলা মেহমান, মেহমানের জন্য কেউ খরচ করলে তা কি ফেরত চায়? মনে বড় কষ্ট পেলাম।
মৃন্ময় বুঝতে পারে না, কি বলা উচিৎ। চুপ করে রইল। চাচাকে ছোট বেলা দেখে এসে আসছে। বাড়িতে আসতেন প্রায়ই। বাড়িতে আসলেই এটা ওটা নিয়ে আসতেন। ঢাকায় যাবার পর সেখানেও তিনি যেতেন, বছর খানেক পর পরই। মা একদিন বলেন, ভাই আপনি এতো টাকা খরচ করে এভাবে আসেন, সমস্যা হয় না?
- কিসের সমস্যা?
- আপনাদের দেখতে আসি।
- না মানে, কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না। আপনাকে একটা কথা বলা দরকার।
- জ্বি বলেন ভাবী।
- আসলে এটা আমাদের বাসা না, থাকছি আমার বড় ভাইয়ের এখানে। আমার বড় ভাই চাচ্ছে না, শ্বশুর বাড়ি থেকে কেউ আসুক এখানে। আমার আর মৃন্ময়ের ভালই লাগে। কিন্তু বুঝতেই পারেন।
এনায়েত চাচা মুখ শুকনা করে তাকিয়ে থাকেন, মায়ের দিকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, বড় কষ্ট পেয়েছেন। পাঞ্জাবীর হাতা দিয়ে মুখ মুছে বলেন, ভাবী, আমি তাহলে আসি।
- আজকের দিনটা থেকে যান।
- না ভাবী, মৃন্ময়কে দেখতে বড় ইচ্ছা করছিল তাই এসেছিলাম। গ্রামে একটা কাজ জমে আছে। যেতে হবে। আমার হইছে যত জ্বালা, গ্রামের সব দেখতে হয় আমার।
এনায়েত চাচা, মাথা নিচু করে বের হয়ে যান। যাবার সময় একবার বাড়ি খান, ঘরের মধ্যের সোফার সাথে। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বলেন, আমি ঠিক আছি কিছু হয় নাই।
সেদিন বেড়িয়ে যাবার পর আর কখনও আসেন নি। তবুও মাঝে মাঝে ফোন দিতেন। দিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, কেমন আছ, মৃন্ময় বাবা? গ্রামের দিকে চলে আসো না একদিন।
কিছু মানুষ অকারণে মায়া বাড়ায়। মায়া বাড়ানোর পিছনে কোন যুক্তি নেই, লাভ নেই, নেই কোন প্রাপ্তির চিন্তা তবুও। এনায়েত চাচাকেও সেই শ্রেণির লাগে মৃন্ময়ের। মৃন্ময়ের কাছ থেকে পাবার মত, কিছু নেই, তবুও অকারণে এতো ভালবেসে যাওয়া। এই যে এখানে আসার আগ থেকেই কি পরিমাণ কষ্ট করে যাচ্ছেন। একটা পুরাতন পড়ে থাকা বাড়ি নিজে নিজেই এতোটা পরিশ্রম করে পরিষ্কার করে, বাস করার মত করেছেন। করে যাচ্ছেন একটার পর একটা কিছু, আসার পর থেকেও।

- চাচা রাতেও আমাদের ওখানে খাবেন।
চাচা লজ্জা পাবার মত করে বললেন, না রে বাবা, বলছ তুমি তাতেই মনটা অনেক বড় হয়ে গেছে। তোমার চাচীর শরীরটা অত ভাল না, সাথে থাকতে হয়।
- সময় করে যাব দেখি, স্নেহাকে নিয়ে। চাচীকে দেখে আসব।
সূর্যটা হেলে পড়েছে পশ্চিম দিকে। বিকেল হয়ে গেছে। দূরে মাঠে খেলছে ছোট ছোট ছেলেরা। বড় গরম পড়েছে, তবুও ক্লান্তি নেই কোন ওদের। এনায়েত চাচা চলে গেলেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে মৃন্ময়। বাড়িটা বিক্রি করে দিলেই এই গ্রামের সাথে সম্পর্ক সব ছিন্ন হয়ে যাবে, ভাবতে খারাপ লাগছে। তবুও মানুষ মাঝে মাঝেই সেধে সেধে খারাপ লাগার কাজ করে। অদ্ভুত মানুষ। প্রতিটা মানুষই বড় অদ্ভুত।


বশির স্যার নাকি ইদানীং আঁকাআঁকি করছেন। তাকে মাঝে মাঝেই খুব চিন্তিত ভাবে রঙ তুলি নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু কারও সামনে সে কিছু আঁকে না। আঁকে একা একা। স্নেহাকে তিনি বলেছেন, তোর একটা ছবি আঁকব।
- কি বলেব স্যার?
- হ্যাঁ। দেখে তুই অবাক হয়ে যাবি।
- আমার কি সামনে বসে থাকতে হবে?
- না, আমি কারও সামনে আঁকতে পারি না। তোকে আমি কম দেখিনি, চোখের মধ্যে লেগে আছিস। এমনিই আঁকতে পারব।

বশির স্যার সাথে করে নিয়ে এসেছেন, রঙ তুলি, কাগজ। তিনি বিকাল থেকেই ছবি আঁকছেন। মাঝে দু একবার, উঁকি মারল নৃ সেখানে। নৃকে দেখে তিনি বলেন, নৃ তুমি একটু মামনির কাছে যাও। আমি জরুরী কাজে ব্যস্ত।
- কেমন জরুরী?
- অনেক জরুরী, এই জরুরী কাজ কারও সামনে করা যায় না।
- নৃ জানতে চায় কি কাজ?
- হাহাহা, তাই? নৃর জানবার এতো ইচ্ছা? আচ্ছা বশির স্যার এখন নৃর মামনির ছবি আঁকছে। নৃ কি জানল এটা?
- হ্যাঁ নৃ জানল। নৃ কি এখন মামনির কাছে যাবে?
- হ্যাঁ নৃ মামনির কাছে যাবে।
নৃ বাধ্য মেয়ের মত, সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। স্নেহা এখনও বসে আছে দোতলার বারান্দায়। কেমন যেন বিষণ্ণ একটা বিকেল। একবার ভেবেছিল, ঘুরে দেখবে পুরো বাড়িটা। তাও বিষণ্ণতা সে অলসতা এনেছে, তা কাটিয়ে দেখা হয় নি। দো তলা বাড়িটায় নিচ তলায় ঘর তিনটা, খাবার জায়গা, বসার জায়গা ওখানে। দোতলায় ঘর চারটা। একটা খোলা বারান্দা। একটা দোতলার একটা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে মৃন্ময়, স্নেহা আর নৃর। আর নিচ তলার এক ঘরে বশির স্যারের।
নৃ এসে পাশে দাঁড়াল চুপ করে স্নেহার। স্নেহা, মুখ ঘুরিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল, মামনি কেমন আছ তুমি?
নৃ কোন উত্তর দিল না। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। স্নেহা নৃর মুখের কাছে গিয়ে বলল, তুমি এমন চোখ বন্ধ করে রেখেছ কেন?
নৃ তাও চুপ। মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। স্নেহা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে, মেয়ের হাত ধরে কোলের ভিতর নিয়ে নিল। কোলের মধ্যে নিতেই ধক করে চোখ ফুলে ফেলল, তাকাল চোখ উল্টে। স্নেহা যদিও ভয় পেল বেশ, তবুও সামলে নিল। মেয়েটাকে আরও শক্ত করে ধরল। কষ্ট লাগছে বড়, নিজের মেয়ে অথচ কখনও ভাল করে কথা বলে না। মাঝে মাঝেই জীবনটা বড় অর্থহীন লাগে। মাঝে মাঝেই মনে হয় মেয়েটার সাথে সারারাত জুড়ে গল্প করতে। সে মনে হওয়া সত্যি হয় না। মিথ্যেই রয়ে যায়। মেয়েটাকে জড়িয়ে বুকের সাথে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
- তোকে বড় ভালবাসি রে, মা। কেন বুঝতে চাস না?
নৃ মায়ের বুকের কাছ থেকে সরিয়ে নিতে চাইল, মুখটা। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মৃন্ময়কে, ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে আসছে। ভাল নেই স্নেহা, ঠিক জানে ভাল নেই মৃন্ময়ও। মাঝে মাঝেই নৃ ঘুমিয়ে গেলে, গালের কাছে এসে চুমু দেয়। ছোট ছোট হাত গুলো নিয়ে খেলা করে মৃন্ময়। স্নেহাকে ডেকে তুলে বলে, দেখো তো মেয়েটার হাত তোমার মত, চোখ তোমার মত, চুল তোমার মত, শুধু দেখতে আমার মত, তাই না?
স্নেহার চোখে পানি চলে আসে সে দৃশ্য দেখে। মৃন্ময়ের হাতের উপর উপর দিয়ে হাত দিয়ে নৃর হাত ধরে, আলতো করে কাঁধে মাথা রাখে। ভারী নিঃশ্বাসের সাথে বলে, না সবই তোমার মত। তোমার মেয়ে তোমার মত।
মৃন্ময় ছেলেটা ভাল, সত্যি বড় ভাল। নৃর এই অবস্থার জন্য কখনও দায়ী করে নি স্নেহাকে। অন্য কোন স্বামী হলে ঠিক দোষ দিত, স্নেহার। তেমন কিছুই করেনি। আবার বাচ্চা নেয়ার ব্যাপারেও দ্বিমত ছিল, মৃন্ময়ের। স্নেহাকে ডেকে চুলে হাত বুলিয়ে একদিন বলে, স্নেহা, তোমাকে একটা কথা বলব, রাখবে?
- হ্যাঁ বল।
- আমরা আর কোন বাচ্চা নিব না কেমন?
স্নেহা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ, বলে, কেন?
- আমাদের আর একটা সন্তান হলে, নৃর জন্য ভালবাসা কমে যাবে। আমি সেটা চাই না। যেমন হোক, নৃ আমাদের মেয়ে। আমার মেয়ে, তোমার মেয়ে। এই মিষ্টি মেয়েটার জন্য আমাদের ভালবাসা কখনও কমে যাক, সত্যি আমি চাই না।
সেদিন অবাক হয়ে তাকিয়েছিল স্নেহা, মৃন্ময়ের দিকে। মৃন্ময়ের চোখে পানি ছিল, টপ করে পড়েছিল এক ফোঁটা, কাঁদছিল মৃন্ময়। খুব করে চাচ্ছিল, সে পানি লুকাতে। ছেলেরা কাউকে দেখিয়ে কাঁদতে পারে না, কখনই পারে না। ছেলেদের চোখে জল, ব্যাপারটা বড় বেমানান। কোন বেমানান কাজ কারও সামনে করতে বড় অস্বস্তি লাগে। তাই খুব কষ্টের মাঝেও ছেলেরা বুকের মাঝে ব্যথা জমিয়ে রাখতে পারে, মেঘ করে সব কষ্ট গুলো লুকিয়ে রাখতে পারে। যখন সে মেঘ ছুঁই ছুঁই করে, বুকটা উপচে উঠে, তখনই কাঁদে ছেলেরা। সত্যি কতটা ভালবাসে নৃ কে মৃন্ময়, সেদিন বুঝেছিল স্নেহা। এতোটা ভাল জানে ঠিক কখনও বাসতে পারবে না কাউকে স্নেহা। এতো ভালবাসা সত্যি সম্ভব না।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সূর্য ডুবে গেছে, হয়ে যাচ্ছে অন্ধকার। এনায়েত চাচা ঘরে কিছু চার্জার লাইট দিয়ে গেছেন, দিয়ে গেছেন চার্জার ফ্যান। এই বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। নৃকে কোলে নিয়ে স্নেহা বাতি ধরাতে গেল। নৃ হ্যাচকা টানে নেমে গেল কোল থেকে। নেমেই দৌড় দিল।
একটা চার্জার লাইট বশির স্যার এর ঘরে নিয়ে ঢুকল স্নেহা। অন্ধকারের মধ্যে তুলি হাতে বসে ছিলেন, বশির স্যার।
- স্যার কি করছিলেন?
- ছবি আঁকছিলাম।
- এই অন্ধকারে?
- ওহ, অন্ধকার হয়ে গেছে দেখি, খেয়ালই করি নি।
স্নেহা হাসল আলতো করে।
- ছবি আঁকা কত দূর?
- তুই লাইট রেখে চলে যা। ছবি পুরো না আঁকার আগে দেখা যাবে না।
স্নেহা আবার মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বেরিয়ে আসল ঘর থেকে। চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন বশির স্যার। ঘরের ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে মৃন্ময়কেও। স্নেহাকে সাথে নিয়ে উঠে যাচ্ছে উপরে।
মৃন্ময় আর স্নেহা দোতলার যে ঘরটায় থাকে, তার পাশের কোন ঘরেই আলোর ব্যবস্থা করে নি স্নেহা। একটা লাইট রেখেছে নিচ তলায় বসার ঘরে, একটা বারান্দায়, একটা ওদের ঘরে আর একটা দোতালায় ঘরের বাহিরে। মৃন্ময় ঘরে ঢুকেই বিছানায় বসে পড়ল। লাইট রেখে যাবার সময় বারান্দায় স্নেহা শুনল, ওরা থাকে যে ঘরটায় তার পাশের ঘর থেকে একটা ফিসফিসানি কথা শোনা যাচ্ছে। স্নেহা একটু অবাক হল। ভয়ে ভয়ে কান রাখল দরজার কাছে, কোন শব্দ নেই। আবার হাঁটতে শুরু করবে তখন আবার শুনল তেমন ফিসফিসানি শব্দ। কেমন একটা ভয় কাজ করল স্নেহার মধ্যে। একবার ভাবল ডাকবে মৃন্ময়কে। আবার কি মনে করে যেন ডাকল না। ধীরে ধীরে দরজার কড়া ধরে আস্তে করে নাড়া দিয়ে, দরজাটা খুলল। দরজাটা খোলা ছিল। স্নেহা গলা ঝেড়ে বলল, কে?
কোন শব্দ নেই। ঘরের সামনে একটা লাইট আছে, সে লাইটটা এনে স্নেহা ঘরে ঢুকল আস্তে আস্তে। কিছু একটা দেখে স্নেহা চমকে গেল। কেউ একজন বসে আছে, জানালার কাছটায়। আর একটু হলেই লাইটটা পড়ে যাচ্ছিল হাত থেকে। কিন্তু সামলে নিয়ে তাকাল ভাল করে সামনে, নৃ, হ্যাঁ নৃ ই তো। স্নেহা দৌড়ে নৃ র কাছে গেল। ধরে কোলে নিল, নৃ নির্বাক হয়ে বসে আছে। স্নেহা কাছে গিয়ে কোলে তুলতেই চোখ বড় বড় করে তাকাল স্নেহার দিকে। যেন স্নেহা এখানে আসাতে খুব বিরক্ত হয়েছে। তাকাল নৃ জানালার দিকে, করুণ চোখে।
- মামনি তুমি অন্ধকারে একা একা বসে কি করছিলে?
নৃ কিছু বলল না। এলোমেলো চোখে তাকাল চারদিকে। আবার তাকাল জানালার দিকে। নৃ কে কোলে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে পাশের ঘরে গেল স্নেহা। মৃন্ময় বিছানা থেকে নেমে এসে দ্রুত, নৃর পিঠে হাত রাখল। অস্থির ভাবে বলল, কি হইছে আমার নৃ মামনির? নৃ, এই নৃ।
জমে থাকা গলায় স্নেহা উত্তর দিল, পাশের ঘরে অন্ধকারে বসে ছিল। কার সাথে যেন কথা বলছিল।
মৃন্ময় দ্রুত নৃকে কোলে নিয়ে জানতে চায় কি হয়েছে। জানে মৃন্ময় এই ঘটনা ঘটেছে আগেও আরও। তবুও মেয়ের কাছে এমন ভাবে জানতে চাচ্ছে যেন, আজ প্রথম এই অঘটন ঘটল। নৃ মৃন্ময়ের কোল থেকে নেমে গিয়ে চুপ করে বসে রইল বিছানার উপর। মুখ ভার করে। কথা বলল না কোন। মৃন্ময় স্নেহা দুজন দুজনের দিকে শুধু করুণ চোখে তাকাল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্নেহা, চুপ করে বসে গেল ঘরের মধ্যে রাখা চেয়ারটায়। যেন কিছুই হয় নি, এমন করে বসে তাকিয়ে রইল, আলোর দিকে। লাইটের আলোর উপর এসে পোকা পড়ছে, অনেক পোকা। সে পোকা খাবার জন্য আশেপাশেই ঘুর ঘুর করছে একটা টিকটিকি। ভয় পায় টিকটিকি স্নেহা। দেখলেই চেঁচামেচি। তবে আজ শুধু সরে আসল সে জায়গা থেকে, কিছুই বলল না।

রাত ৯ টার দিকে খাবার খেতে বসল, সবাই। নতুন করে কিছু রাঁধে নি স্নেহা। শুধু দুপুরের খাবার গুলো গরম করেছে। নৃকে একটু একটু করে খাইয়ে দিচ্ছেন বশির স্যার। খেতে চাচ্ছে না নৃ। কোন সময়ই চায় না আসলে। খাবার মধ্যে খেলো শুধু সুরমা মাছ, তাও মাছের কাঁটা সহ। কাঁটা খেতে দেখে, আঁতকে উঠল মৃন্ময়। নৃ খুব স্বাভাবিক ভাবে পানি খেল, যেন এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। একবার বলতে চাচ্ছিল, নৃ মামনি কাঁটা খায় না। ফেলে দাও।
জানে নৃ শুনবে না, তাই বলেও লাভ নেই আসলে। শুধু অসহায় ভাবে তাকাল একবার স্নেহার দিকে, একবার বশির স্যারের দিকে।
খাওয়া শেষ করে উঠেই বশির স্যার বললেন, মৃন্ময়, তোমার এনায়েত চাচার বাড়িটা কোনদিকে?
- কেন?
- চাচ্ছিলাম গান শুনাব। একটা ছোট খাটো গানের আসর হোক।
- তিনি আসবেন না মনে হয়।
- তুমি ঠিকানা বল, আমি যাব।
ঠিকানা নিয়ে বশির স্যার ই চলে গেলেন। মৃন্ময় যেভাবে বলেছে, সেভাবে বাড়ি খুঁজে পাওয়ার কথা না। তবুও খুঁজে পেলেন। বাসার সামনে গিয়ে বললেন, এনায়েত সাহেব, বাসায় আছেন?এনায়েত চাচা বেরিয়ে আসলেন। বেশ গরম পড়েছে। গায়ে একটা গামছা পরেই চলে আসলেন, বাহিরে।
- চলেন, বাড়িতে যাবেন।
- আপনি আসলেন? সমস্যা কোন?
- আরে না কোন সমস্যা না। এমনি ভাবলাম আমি আসলে আপনি না করবেন না, তাই আসলাম।
এনায়েত চাচার ইচ্ছা ছিল কিনা জানা নেই, তবে বশির স্যার কে মুখের উপর না করে দেয়া যায় না। তাই চলে আসলেন। সাথে করে রাসেলকে নিয়ে আসলেন। রাতের বেলা একা বের হবেন না।

গানের আসর দেখে খুব বিরক্ত হলেন এনায়েত চাচা। এসবের জন্য ডেকে নিয়ে আসল। এখন ধর্ম কর্ম করার বয়স। এ বয়সে নাকি নিয়ে আসছে, গানের আসরে। এনায়েত চাচা খুব অস্বস্তি নিয়ে বসে রইলেন, অস্বস্তি মৃন্ময়ের মাঝেও। তবে খুব আগ্রহ দেখা গেল স্নেহার মাঝে, রাসেলের মাঝেও। আর নৃ বসেছিল বশির স্যারের কোলের মধ্যেই। ও একটু পর পর গান শুনে শুনে ছোট হাত দিয়ে হাতে তালি দিচ্ছিল।
গানের আসর শেষে, বশির স্যার বললেন, আর একটা সারপ্রাইজ আছে সবার জন্য। সবাই একটু বসেন।
বসে রইল সবাই। বশির স্যার তার ঘরের দিকে যেতে লাগলেন, পিছন পিছন আসতে লাগল নৃ।
- তুমিও বস নৃ। আমি এখনি চলে আসছি।
নৃ বসল না। সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
বশির স্যার একটু পর ফিরে আসলেন হাতে করে একটা কাগজে মোড়ানো কিছু নিয়ে। তিনি সেটা এনে বললেন, আমি ইদানীং গানের সাথে সাথে আর একটা জিনিস করার চেষ্টা করছি। সেটা হল ছবি আঁকা। প্রথম একটা মানুষের ছবি আঁকা আমার।
স্নেহার দিকে কাগজে মোড়ানো ছবিটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, স্নেহার একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করলাম। স্নেহা, এটা খুলে দেখো।
স্নেহা সবার দিকে তাকিয়ে একটু লজ্জা পেল। তবুও হাতে নিয়ে সেটা। কাগজটা খুলল। খুলে তাকাল, ছবিটার দিকে। তাকিয়ে বেশ বড় সড় মাপের ধাক্কা খেলো। স্নেহা ভেবেই নিয়েছিল, ছবিটা ভাল হবে। বশির স্যার এঁকেছে খারাপ হবার কথা না। কিন্তু এতোটা ভাল হবে ভাবতে পারে নি। একটু হাসি দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, ছবিটার দিকে। দেখে মনেই হচ্ছে না এটা আঁকা ছবি। মনে হচ্ছে কেউ একজন, ছবি তুলে তা বড় করে বাঁধাই করে এনেছে। বিরক্তি নিয়ে হলেও অবাক হয়ে দেখল, মৃন্ময় নিজেও। সত্যি বুঝবার উপায় নেই, হাতে আঁকা নাকি, তোলা ছবি। এনায়েত চাচা কোন আগ্রহ দেখালেন না, তবে ছবি দেখে মোটামুটি চিৎকার করে রাসেল বলল, আল্লাহ এইটা আঁকা ছবি নাকি?
এনায়েত চাচার ধমকে চুপ হয়ে গেল রাসেল, এতো জোরে চিল্লাস কেন? কানে লাগে না?
এনায়েত চাচা ছবি দেখে, মনে মনে বিড়বিড় করলেন। মনে মনেই বললেন, ছবি আঁকাআঁকি, গান বাজনা, ধর্ম কর্মে এদের কোন আগ্রহ নেই। কোন আগ্রহ নেই।
সে কথা শুনল না কেউ। এনায়েত চাচা চলে আসলেন, রাসেলকে নিয়ে। রাস্তায় আসার সময় বললেন, কেমন মানুষ দেখ একবার। বয়স হইছে , এখন কই আল্লাহ খোদার নাম নিবে। তা না করে করতেছে গান বাজনা। আঁকতেছে ছবি।
- জ্বে ভাইজান।
- একদম শেষ হয়ে গেল সব।
- ভাইজান, কথা কইব একটা?
- বল।
- ভাইজান আপনেও তো খালি জুম্মার নামাজ পড়েন, আর মাঝে মাঝে মাগরিবের নামাজে যান।
- ঐ থাপ্পড় দিব ধইরা। বেশী কথা বলিস কেন? তুই জানিস আমি কখনও নামাজ পড়ি না পড়ি? আমি ঘরে পড়ি নামাজ।
- জ্বে ভাইজান।
রাত নেমেছে। এতো রাতে এনায়েত চাচা বের হন না কখনও। চারপাশটা বড় ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে দূর অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে, কারও খিল খিল হাসির শব্দ। এনায়েত চাচা, রাসেলের হাত শক্ত করে ধরে দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। ভ্যাপসা গরমে, থেমে থাকা বাতাস, সে চলার পথের সাথে তাল মিলাচ্ছে।

- রিয়াদুল রিয়াদ

(পরবর্তী অংশ আগামী কাল)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.