নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফেসবুকে আমি - রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার )

কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারঃ টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (পঞ্চম পর্ব)

০৭ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১২:৫৬



প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব


মৃন্ময় ফিরে আসল যখন তখন থেমে গেছে বৃষ্টি। ভাল রাত হয়েছে। বাড়িতে ঢুকতে যাবার আগ মুহূর্তে পিছন থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠের ডাক শুনল, দুলাভাই ভাইয়া।
মৃন্ময় তাকাল পিছন ফিরে। স্নিগ্ধাও এসে পৌছাল মাত্র। সাথে লুঙ্গী পরা যে লোক লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে চিনে মৃন্ময়। এনায়েত চাচা পাঠিয়েছিলেন হয়ত স্নিগ্ধাকে নিয়ে আসতে। লোকটা সাথে সাথে এলো স্নিগ্ধার। লাগেজটা রেখে চলে গেল। স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে মৃন্ময় বলল, কেমন আছ?
" ভাল দুলাভাই ভাইয়া, আপনি?" জবাব দিল স্নিগ্ধা।
- ভালই। এতো দেরী হল তোমার? আমি তো ভাবলাম বাসায় এসে দেখব দুই বোন দারুণ গল্প জুড়ে বসে আছ।
চাবি দিয়ে দরজা খুলতে খুলতে কথাটা বলল মৃন্ময়। স্নিগ্ধা লাগেজের হাতলে ধরে ভিতরে যেতে যেতে বলল, ট্রেন লেট করল সব জায়গায়। লোকাল ট্রেন হলে যা হয় আর কী। এমন কোন স্টেশন নেই যে থামে নি। পারলে তো বাসের মত স্টেশন ছাড়াই থামিয়ে মানুষ নেয়। তাছাড়া এক ক্রসিং লেগুনা এক্সিডেন্ট, তা সরানোর জন্য ট্রেন রইল থেমে।
- আচ্ছা আচ্ছা। যাই হোক। সুস্থ ভাবে এসেছ তো।
স্নিগ্ধাকে নিয়ে ভিতরে যেতেই দেখল ঘুটঘুটে অন্ধকার। স্নেহা আজ লাইট জ্বালে নি নাকি? মোবাইলের লাইট ধরে টেবিলের উপর রাখা চার্জার লাইট জ্বালল মৃন্ময়। বশির স্যারের ঘরের দরজা খোলা, কিন্তু ভিতরে কেউ নেই। নিচ থেকেই ডাক দিল মৃন্ময়, স্নেহা, নৃ মামনি?
স্নিগ্ধাকে নিয়ে উপরে গিয়ে ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল। নৃ শুয়ে আছে বিছানায়। ঘুমাচ্ছে। স্নেহা নেই। বারান্দায় চলে গেল, সেখানেও নেই। স্নিগ্ধা আসল পিছন পিছন। স্নিগ্ধা চোখ মুখ কুঁচকে একটা দ্বিধার দৃষ্টিতে তাকাল মৃন্ময়ের দিকে।
- বশিরের সাথে না তো?
স্নিগ্ধার ভয়টা মৃন্ময়ের মনের মধ্যেও ঘুরছে, কিন্তু মনকে অন্য কিছু বলে চাচ্ছে মানাতে।
- খুঁজে দেখি, যাবে কোথায়?
বারান্দায় চেয়ারের উপর ওড়নাটা পড়ে আছে। মৃন্ময় সেটা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকাল। বারান্দা থেকে বাহির থেকে তাকিয়ে আর একবার স্নেহা বলে ডাক দিল।
- স্নেহা উপরে।
কথাটায় চমকে উঠল মৃন্ময়, তাকাল স্নিগ্ধার দিকে। বলেনি স্নিগ্ধা। স্নেহার মতই কণ্ঠ। তবে বেশ গম্ভীর। উপরে মানে ছাদে। মৃন্ময় ছাদে ওঠার মই বেয়ে উঠে। উঠল স্নিগ্ধাও পিছন পিছন। স্নেহা ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে, এই নিকশ অন্ধকারে একা একা। মৃন্ময় ভিজে থাকা ছাদে সন্তর্পণে পা রেখে এগিয়ে গেল। স্নেহার কাছে গিয়ে গায়ে আলতো করে হাত রেখে বলল, এখানে কী করছ স্নেহা?
স্নেহা যেন মৃন্ময়ের কথা কিছুই বুঝে নি এমন করে তাকিয়ে রইল। স্নেহার চোখে মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ, মৃন্ময় ঘোলা চোখেও দেখতে পাচ্ছে তা। মোবাইলের লাইট জ্বালানো হাতে মৃন্ময়ের। স্নেহাকে অস্বাভাবিক লাগছে বুঝতে পারছে। পাশে দাঁড়ান স্নিগ্ধার মুখের দিকেও একবার তাকাল স্নেহা। মৃন্ময় স্নিগ্ধার দিকে আলো ধরে স্নেহাকে বলল, তোমার সারপ্রাইজ, কেমন লাগল?
এ প্রশ্নেরও উত্তর দিল না স্নেহা। চুপ করে অবুঝের মত মুখ করে তাকাল শুধু দুজনের দিকে। স্নিগ্ধা এসে বড় বোনের হাত ধরল।
- সব ঠিক আছে তো আপু?
তেমন উদাস চোখে তাকিয়েই বলল, হ্যাঁ ঠিক আছে সব।
মৃন্ময়ের মুখের হাসি স্মিত হয়ে গেল। স্নেহার মাঝে সত্যি কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। এতদিন পর স্নিগ্ধার সাথে দেখা হল, কথা হল, স্নেহার মাঝে কোন উত্তেজনা নেই, আগ্রহ নেই, এ ব্যাপারে কোন কথাও নেই। এমনকি স্নিগ্ধাকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না, কেমন আছিস?
বরং স্নিগ্ধাই জানতে চাইল, ভাল আছিস আপু?
স্নেহা শুধু আস্তে করে মাথা নেড়ে মইয়ের দিকে পা বাড়াল নেমে যাবার জন্য। পিছনে আসল স্নিগ্ধা, সাথে মৃন্ময়। স্নিগ্ধাও বোনের ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। নৃর সমস্যার কথা বলেছিল মৃন্ময়, বলে নি কিছুই স্নেহাকে নিয়ে। স্নিগ্ধা তাকাল মৃন্ময়ের মুখের দিকে, মৃন্ময় একটা মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে মুখটা উজ্জ্বল করে রাখতে চাচ্ছে।

পাশের ঘরটা পরিষ্কার করে দেয়া হল স্নিগ্ধাকে। সব করল মৃন্ময়। এ ব্যাপারে স্নেহার ভিতর কোন আগ্রহ দেখা দেখা গেল না। স্নিগ্ধা বোনের পাশে এসে বসল।
- আপু আমি এসে কি কোন ভুল করলাম? আমার আসাটা কি ঠিক হয় নি?
স্নিগ্ধা আস্তে করে মাথা তুলে বলল, না ভুল করবি কেন?
- তুই আমার সাথে ভাল করে কথা বলছিস না কেন?
- আমার শরীরটা ভাল না খুব একটা।
- কী হইছে?
- কিছু হয় নাই। তুই তোর দুলাভাইয়ের সাথে গল্প কর। আমার ভাল লাগছে না।
স্নিগ্ধা তাকিয়ে রইল বোনের দিকে কিছুটা সময়। আড়াই বছরে বোনটা অনেক বদলে গেছে। স্নিগ্ধা বের হয়ে আসার সময়, মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে রেখে বলল, শেষ দিনটার জন্য আমি সর‍্যি আপু।
স্নেহা সে প্রশ্নের উত্তর দিল না। শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল জানালার দিকে।
রাতের খাবার খেতেও এল না স্নেহা। অনেক বলেও আনতে পারে নি স্নেহাকে। খেয়ে নিল স্নিগ্ধা আর মৃন্ময়। খাবার শেষে ভেবেছিল গল্প করবে কিছুটা সময় মৃন্ময়। বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাবে স্নিগ্ধাকে। কিন্তু বোনের আচরণে মনটা বড় খারাপ। কিছুই ভাল লাগছে না। ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়েই কানে এয়ার ফোন লাগিয়ে দিল, ফুল ভলিউমে গান বাজছে। স্নিগ্ধা ঘুমাবে। বড় ক্লান্তির শেষের ঘুম। রাদিব ফোন দিয়েছিল, বলেছিল ঠিকানা পাঠিয়ে দিতে। চলে আসবে কাল পরশু। শুয়ে পড়েনি স্নেহা, বসে আছে মেয়ের পাশে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময় ঘরে ঢুঁকে দরজাটা আটকিয়ে দিল। স্নেহার পাশে বসে হাতটা আলতো করে ধরে তাকিয়ে রইল।
- তোমার আজ কী হয়েছে?
- কী হবে?
- কেমন যেন লাগছে।
- না আমি স্বাভাবিক আছি।
- বশির স্যার কোথায়? আসার পর থেকে দেখালাম না যে?
স্নেহা মুখ তুলে তাকাল মৃন্ময়ের দিকে। আবার নামিয়ে নিল।
- বলতে পারি না। বলল তো আসছে বাহির থেকে।
- তোমাকে এভাবে একা একা রেখে উনি চলে গেলেন কীভাবে?
- কী নাকি জরুরী কাজ।
- ওনার আবার এখানে কীসের জরুরী কাজ?
- ওহ, আমাকে এতকিছু জিজ্ঞেস করছ কেন? ভাল লাগে না।
মৃন্ময় অবাক চোখে তাকিয়ে রইল স্নেহার দিকে। এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবার মত ঠিক কিছু বলে নি মৃন্ময়। স্নেহা বিছানায় শুয়ে যেতে যেতেই বলল, শুয়ে পড়। উনি এসে ঘুমিয়ে যাবেন।
মৃন্ময় শুয়ে পড়ল। আর কিছু জানতে চাইল না। কিছু মানুষ আছে যাদের সব কিছুর ব্যাপারেই আগ্রহ কম, মৃন্ময় সে প্রকৃতির। কোন কিছুর গভীরে ভাবতে, জানতে ভাল লাগে না। শুয়ে গিয়ে মনে পড়ল, প্রধান দরজাটা আটকানো।
- স্নেহা, দরজা তো আটকে দেয়া। বশির স্যার ঢুকবেন কী করে?
- ইশ, ঘুমাও তো। আমি ওনার কাছে চাবি দিয়েছি। সে চাবি দিয়ে ঢুকবেন।
মৃন্ময় আবার চুপ করে রইল। মৃন্ময়ের ঘুম আসছে না। কীসব ঘটছে আশেপাশে। মাথার ভিতর বারবার সেই নির্জন জায়গাটায় আজকের ঘটনা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে সেই ঘ্রাণটা। কিছু সমীকরণ মেলানো যাচ্ছে না। সেসব মিলাতেও চায় না। জীবনে মৃন্ময় পাশ মার্ক পেয়ে গেছে, চলে যাচ্ছে তাই। গভীরে ভেবে লেটার মার্কস এর আশা নেই। স্নেহা কাঁদছে। নাক ডাকার শব্দ পেল মৃন্ময়। ধীরে স্নেহার পিঠের উপর একটা হাত রেখে বলল, কী হয়েছে স্নেহা?
- কিছু না।
- কাঁদছ কেন?
- মৃন্ময়, তুমি একটা কথার উত্তর দিবে?
- বল।
- মানুষকে বশে আনা যায়, সে যা বলবে তাই শুনবে, এসব করার কোন উপায় আছে?
- মানে? কী বলছ? বুঝছি না আমি।
- আমি যদি চাই ইচ্ছা করলেই যে কাউকে আমার ইচ্ছা মত চালাতে পারব, এমন কোন যাদু আছে? বা সাধনা করে কেউ কি পারে এমন?
- স্নেহা তুমি এসব অদ্ভুত কথা বলছ কেন? কোন সমস্যা হয়েছে? আর যাদু আবার কী? এসব কিছু নেই।
- আছে, তুমি জানো না। এসবকে কালো যাদু বলে। খুব খারাপ জিনিসটা।
- স্নেহা তোমার বিশ্রাম নেয়া দরকার। ঘুমিয়ে পড়।
স্নেহা আর কথা বাড়াল না। চুপ করে রইল, মৃন্ময়ের দিক থেকে অন্য দিকে তাকিয়ে। ঘুমিয়ে গেল কিনা জানে না মৃন্ময়। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল মৃন্ময়। ঘুমিয়ে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখল, সে স্বপ্নে বশির স্যার রাসেলকে মেরে ফেলে দিচ্ছেন ছাদ দিয়ে। ফেলে দেবার আগে রাসেলের পকেট থেকে বের করে আনছেন একটা আতরের কৌটা। আর বশির স্যারকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে স্নিগ্ধা।
স্বপ্ন দেখে লাফ দিয়ে উঠল মৃন্ময়। স্বপ্ন দেখে কেন যেন ভয় লাগছে খুব। স্বপ্নের ভিতর মনে হচ্ছিল বশির স্যারই মৃন্ময়। বশির স্যারকে যখন ফেলে দিচ্ছিল, মনে হচ্ছিল ফেলে দিচ্ছে মৃন্ময়কেই। পানি খাওয়া দরকার। চশমা পরে পানি খাবার জন্য টেবিলের দিকে হাত বাড়াতেই চমকে উঠল। নৃ দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের পাশে, তাকিয়ে আছে মৃন্ময়ের দিকেই। আর একটু হলেই হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবার মত অবস্থা হত। মৃন্ময় বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল, মামনি তুমি কী কর এভাবে দাঁড়িয়ে? আসো শুয়ে পড়। সকাল হয় নি এখনও।
নৃ তাও তাকিয়ে রইল সেভাবেই। মৃন্ময় উঠে কোলে করে নৃকে বিছানায় শুইয়ে দিল। কোন প্রতিবাদ করল না নৃ। শুয়েই নৃ বালিশের কভার দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে লাগল। তুলে বের করে মুখের ভিতর নিয়ে চাবাতে লাগল। মৃন্ময় টান দিয়ে নিয়ে নিল বালিশটা নৃর থেকে। সে সময়টায় উঠে গেল স্নেহা। মৃন্ময় নৃর মুখের ভিতর থেকে তুলা টান দিয়ে বের করার জন্য হাত দিতেই হাতের আঙুলে কামড় বসিয়ে দিল নৃ। চিৎকার করে উঠল মৃন্ময়। স্নেহা নৃকে শক্ত করে ধরল।
- মামনি বের কর এসব মুখ থেকে।
নৃ আরও জোরে চাবানোর গতি বাড়িয়ে দিল। হতাশ হল স্নেহা, হতাশ হল মৃন্ময়। তুলা চাবাতে চাবাতেই ঘুমিয়ে গেল একসময় নৃ। মৃন্ময় হাতের আঙুল চেপে ধরে বসে রইল। নিতান্তই বলার জন্য শুধু স্নেহা বলল, বেশি ব্যথা পেয়েছ?
- না তেমন না।
- হুম, ঠিক আছে।
স্নেহা চুপ করে রইল কিছুটা সময়। এরপর মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মৃন্ময় জানো আমি না মরে যাব। বাঁচব না আর।
মৃন্ময় কথাটা শুনে ঘোলা চোখে তাকিয়ে রইল অনেকটা সময় স্নেহার দিকে। স্নেহা এসব পাগলের মত কেন কথা বলছে মাথায় ঢুকছে না মৃন্ময়ের।
- আজেবাজে কথা বলা বাদ দাও, তুমি বাঁচবে না কেন? ঘুমাও। রাত হয়েছে অনেক।
স্নেহা সত্যি ঘুমিয়ে গেল। আর কিছুই বলল না। পানি খাওয়া হয় নি এখনও মৃন্ময়ের। টেবিলের উপর থেকে গ্লাসটা নিল। জগটা নেই টেবিলের উপর। আশেপাশে দেখল, কোথাও নেই। স্নেহাকে ডাক দিতে গিয়েও দিল না। ঘুমাচ্ছে স্নেহা। উঠে গিয়ে নিচ থেকে পানি খেতেও ইচ্ছা করছে না। মৃন্ময় বিশ্রাম চায়, একটা প্রশান্তির ঘুম চায়।

ঘুম থেকে উঠল মৃন্ময় যখন বেলা তখন এগারটা। এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না কখনও, ডাকেও নি কেউ। ঘুম থেকে উঠে দেখল স্নেহা আর স্নিগ্ধা গল্প করছে বারান্দায় বসে। দেখা খুব স্বস্তি লাগছে। নৃ পাশেই মুখ গোমড়া করে বসে আছে। মৃন্ময় পাশে গিয়ে নৃর মাথায় হাত বুলাল।
- খেয়েছ মামনি?
পাশ থেকে স্নেহা বলল, না খায় নি
- এতো বেলা হয়েছে তাও খাওয়াও নি?
- না খেলে আমি কী করব?
- বশির স্যার কোথায়?
- তুমি না বশির স্যারকে দেখতে পারো না? কাল রাত থেকে এতো বশির স্যার বশির স্যার করছ কেন? উনি আসেন নি রাতে।
- তাই বলে মেয়েটা না খেয়ে থাকবে?
নৃকে নিয়ে নিচে চলে আসল মৃন্ময়। খাবার দিল, খেল না। নৃ মুখ চেপে বসে রইল। মৃন্ময় অনেক কিছু বলেও, চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারল না। নৃ খাবার রেখে দৌড়ে চলে গেল বশির স্যারের ঘরে। ঘরে নেই কেউ। আসেননি কাল রাতে আর বশির স্যার। কোথায় গেলেন? স্নেহাও কিছু স্পষ্ট করছে বলছে না। নৃর পি ছন পিছন আসল মৃন্ময়। ঘরটা কেমন যেন। কেমন একটা গন্ধ আসছে ঘর থেকে। নিজের মত করে জায়গায় জায়গায় কীসব সাজিয়ে রেখেছেন। নৃ ঘরে ঢুকেই বশির স্যারের বিছানার নিচ থেকে একটা ছোট পুতুল বের করে আনল। সে পুতুলের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুটা সময়। পুতুলের গায়ে নানা রকম সুতা দিয়ে পেচিয়ে রাখা। নৃ সে পুতুল বাতাসে ভাসিয়ে ভাসিয়ে খেলতে লাগল। মৃন্ময় ঘরের ভিতর ঘুরে ঘুরে দেখছে। একজন গানের শিক্ষক, একজন ছবি আঁকা লোকের ঘরে এসব জিনিস থাকে কী করে। নৃর হাত থেকে পুতুলটা পড়ে যেতেই একটু অবাক হয়ে সেদিকে তাকাল মৃন্ময়। পুতুলটার পিছন দিকে একটা ছবি। মৃন্ময় হাতে তুলে নিল সে ছবিটা। মৃন্ময়ের মায়ের ছবি সেখানে। মাথায় আসছে না এখানে মায়ের ছবি আসল কোথা থেকে? মৃন্ময় পুতুলের শরীর থেকে সুতা ছাড়িয়ে নিল। ছিঁড়ে ফেলল পুতুলটা। আরও অবাক করা বিষয়, সেখানে এক গাঁদা মাথার চুল, একটা শাড়ির কোণার কাপড়। ভিতরের জিনিস গুলো নিয়ে বসে রইল বেশ কিছুটা সময়। এসবও কি মায়ের?
কাল রাতের কথা মনে পড়ছে। স্নেহা জানতে চাচ্ছিল, কালো যাদুর কথা। বশির স্যার কি তাহলে কালো যাদুর চর্চা করেন? মৃন্ময় এসব বিশ্বাস করে না, করতেও চায় না। তবু মায়ের শেষ দিকে ওসব অস্বাভাবিক আচরণ অনেক কিছুই ইঙ্গিত করে। নৃকে নিয়ে বেরিয়ে আসল মৃন্ময়। আটকিয়ে দিল দরজাটা। আটকিয়ে বের হতেই দেখল স্নেহা দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির কাছে। তাকিয়ে আছে অন্যরকম এক দৃষ্টি মেলে মৃন্ময়ের দিকে। মৃন্ময় সব স্বাভাবিক করার জন্য বলল, স্নিগ্ধা কোথায়?
স্নেহা সে ব্যাপারে উত্তর দিল না। বরং পাল্টা প্রশ্ন করল, বিশ্বাস করছ এখন? সত্যি আছে ওসব।
মৃন্ময় ইতস্তত করতে লাগল, কী বলবে না বলবে। কপালের ঘামটা মুছে বলল, কী থাকবে?
- বশির স্যার আর মনে হয় আসবেন না।
স্নেহার কথায় চুপ করে তাকিয়ে রইল মৃন্ময়। তাকাল একবার মেয়েটার দিকে। মেয়েটা খুব মনোযোগ সহকারে শুনছে মৃন্ময় আর স্নেহার কথা। এতোটা মনোযোগ কখনই দেখেনি মৃন্ময় নৃর মাঝে।
- স্নেহা, কী হয়েছে আমাকে কি তুমি খুলে বলবে সব?
- বলব।
- বল এখন তাহলে।
- রাতে বলল, মৃন্ময় আমরা সত্যি বড় বিপদে পড়ে গেছি।
মৃন্ময় ছোট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। স্নিগ্ধা উপর থেকে দৌড়ে আসল হাসি মুখে।
- দুলাভাই ভাইয়া, রাদিব ভাইয়া আসতেছে।
স্নেহা বোনের দিকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি ছুঁড়ে জানতে চাইল, রাদিব ভাইয়া কে?
- আছে একজন, তুই চিনবি না।
- সে এখানে আসবে কী করতে?
- সে একজন ডাক্তার। তাই সে এখানে আসবে।
- ডাক্তার এখানে আসবে কী করতে?
- আপু, তুই ভাল করে জানিস কেন আসবে, তাও কেন এমন করছিস?
বলেই স্নিগ্ধা নৃর দিকে তাকাল। নৃ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধার দিকে। স্নেহা কেমন যেন একটা অবাক হওয়া চোখে তাকিয়ে বলল, আমি জানি মানে? আমি জানব কী করে? তুই আমাকে বলেছিস কিছু?
মাঝ থেকে মৃন্ময় বলল, আহা হইছে। আসুক লোকটা আগে। তারপর দেখা যাবে তার কাজ কী। যদি কোন কাজ নাই থাকে, আমাদের গ্রাম ঘুরিয়ে দেখিয়ে একবেলা খাইয়ে পাঠিয়ে দিব। ঠিক আছে? আর সে স্নিগ্ধার খুব কাছের বন্ধু, আসতেই পারে।
মৃন্ময়ের কথায় স্নিগ্ধার মুখ লাল হয়ে গেল। চুপ করে তাকিয়ে রইল নিজের পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে। স্নেহাও তাকাল স্নিগ্ধার দিকে। স্নিগ্ধা তাও মুখ তুলে তাকাল না। সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল উপরের তলায়। স্নেহা মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, দেখো যেই আসুক, আমাদের বাসায় যেন না থাকে রাতে।
- কেন, সমস্যা কোথায়?
- সমস্যা আছে। তুমি এনায়েত চাচাকে বলে ওনার বাসায় থাকার ব্যবস্থা করবে।
- স্নেহা আমি বুঝতে পারছি না সমস্যা কোথায়।
- কোন সমস্যা নেই। আবার অনেক সমস্যা আছে। প্লিজ তুমি এ বাসায় রাতে কাউকে রাখবে না, ঠিক আছে?
মৃন্ময় বুঝতে পারছে না স্নেহার ভিতর কী চলছে। স্নেহাকে বড় অস্থির লাগছে। মৃন্ময় আস্তে করে মাথা নেড়ে বলল, আচ্ছা আমি এনায়েত চাচার সাথে কথা বলছি। তুমি দেখো নৃকে কিছু খাওয়াতে পারো কিনা।
নৃ খায় নি কিছু স্নেহার থেকেও। মুখ বন্ধ করে বসে থাকে। আর একটু পর এদিক ওদিক তাকায়। খুঁজে বেড়ায় কিছু একটা। স্নেহা যেন বুঝতে পারে কী খুঁজছে, তবুও চুপ থাকে, খুঁজতে দেয় নৃকে।

১০
রাদিব সত্যি চলে আসল, বিশ্বাস করতে পারছে না স্নিগ্ধা। রাদিব আসার পর থেকেই কেন যেন স্নিগ্ধা বড় লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জার কিছু নেই। রাদিবের সাথে এর আগেও অনেক বার দেখা হয়েছে, হয়েছে অনেক কথা। তবুও লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে কথা বলতে গেলেই কথা আটকে যাবে, কিছুই বলতে পারবে না। তাই একটু দূরে দূরেই থাকছে। বাড়িতে আসল রাদিব বৃষ্টি ভিজেই। বিকাল থেকে আবার বৃষ্টি। এর মধ্যে কীভাবে কীভাবে বাড়ি চিনে আসল রাদিব তা নিয়ে বেশ চিন্তিত স্নিগ্ধা। রাদিব বাড়িটায় ঢুকেই সবার আগে দেখা হল, স্নেহার সাথে। প্রথম যারা দেখে, তারা স্নেহা আর স্নিগ্ধার মাঝে উলটপালট করেই ফেলে। কিন্তু রাদিব বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল, ভাল আছেন আপু?
স্নেহার দিকে তাকিয়ে। স্নেহাকে স্নিগ্ধা ভেবে ভুল করে নি। স্নিগ্ধার খুব জানতে ইচ্ছা করছে কীভাবে রাদিব এটা করল। কিন্তু কাছে যেতেই লজ্জা করছে। এসেই পরিচিত হল মৃন্ময়ের সাথে। মৃন্ময় হাত বাড়িয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেক করেই বলল, আপনার কথা স্নিগ্ধার মুখে শুনতে শুনতে মুখস্থ। আমার শালিটা তো কিছু হলেই শুধু রাদিব ভাইয়া, রাদিব ভাইয়া।
প্রথম আলাপেই এমন কথা শুনে কিছুটা লজ্জাই পেল রাদিব। তবুও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলল, আপনাদের সবার কথাও সবসময় গল্প করত। আপনাদের সবার নাম, কে কেমন তাও আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।
মৃন্ময় রাদিবকে নিয়ে চেয়ারে বসতে বসতেই বলল, আপনি এতো বড় একজন ডাক্তার, তাও সময় বের করে আসলেন।
রাদিব একটা মৃদু হাসি হেসে বলল, এটা মিথ্যে ছিল। আমি বড় ডাক্তার না। এমবিবিএস কোনমতে পাশ। এরপর বড় কোন ডিগ্রি নেই। ঘুরে ফিরে দিন কাটাই। এখানে ওখানে থাকি।
- তাও আপনি জানেন অনেক কিছু।
- আমি কিছুই জানি না।
মৃন্ময় তর্ক করতে চাচ্ছে না। আসার পর থেকেই রাদিব ভেজা কাপড়ে। রাদিব সাথে করা কিছুই আনে নি। মৃন্ময় রাদিবের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ভেজা কাপড়ে বসে আছেন যে? আমি কাপড় দিচ্ছি পাল্টে নিন। আমার কাপড় পরতে আপত্তি নেই তো?
- জ্বি না আপত্তি নেই।
মৃন্ময় কাপড় নিয়ে আসতে বলল স্নিগ্ধাকে। রাদিব কী যেন ভাবল। ভেবে বলল, আপনাদের বশির স্যার নাকি কাল থেকে নিখোঁজ?
মৃন্ময় চমকে উঠল। রাদিব বলল, স্নিগ্ধাই বলল। যাই হোক, ওনার কোন কাপড় থাকলে দেন। সেগুলো পরি।
মৃন্ময় অবাক হল। রাদিব বশির স্যারের কাপড় পরতে চাচ্ছে কেন? কিন্তু কোন রকম মানা করল না মৃন্ময়। বশির স্যারের একটা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গী রাদিবকে দিল পরতে। রাদিবের লুঙ্গী পরতে বড় সমস্যা হয়। তবু কোনমতে পরে নিল।
রাদিব আসার পর থেকে নিচে আসে নি একবারও স্নেহা নৃকে নিয়ে। স্নেহার সাথেও দেখা হয়েছে সেই প্রথমে একবার। আর হয় নি। স্নেহা নৃকে নিয়ে বসে আছে ঘরের মধ্যে। আসছে না নিচে। স্নিগ্ধাই চা বানিয়ে নিয়ে আসল। তিনজনে বসে চা খেল। রাদিবও স্নিগ্ধার সাথে কোন কথা বলল না। যেমন বলছে না স্নিগ্ধা। মৃন্ময়ই বলল, আপুকে ডেকে নিয়ে আসো স্নিগ্ধা।
- আপুকে বললাম, আসবে না। নৃ নাকি ঘুমাবে।
- এখনি কি ঘুমাবে? সন্ধ্যা বেলা কেউ ঘুমায়?
- জানি না।
রাদিব চুপচাপ থেকে কিছুটা সময়, একটু হাসি দিয়ে বলল, আমি থাকতে পারব না এখানে বেশিদিন। স্নিগ্ধা আসতে বলাতে আসা। এখন কারণটা জানা দরকার, এখানে কাজটা কী আমার?
মৃন্ময় স্নিগ্ধার দিকে তাকাল একবার, আর একবার রাদিবের দিকে।
- স্নিগ্ধা আপনাকে বলে নি কিছু?
- বলেছে, তবুও স্নিগ্ধা আপনাদের থেকে দূরে থাকে বহুদিন। আপনি ওকে যে টুকু বলেছেন, জানে সে টুকুই। আপনি বা আপনারা যে টুকু জানেন, স্নিগ্ধা অত টুকু জানে না।
- আচ্ছা কী জানতে চান বলেন।
রাদিব কিছু বলতে যাবে তখনই চোখ উপর দিকে গেল। স্নেহা এসে দাঁড়িয়েছে দোতলায়। তাকিয়ে আছে এদিকটায়। পাশে হাত ধরা নৃ। রাদিবের দৃষ্টি ধরে তাকাল মৃন্ময়ও। নৃ স্নেহার হাত ছাড়িয়ে নিচে নেমে আসল। খুব অবাক করা বিষয়, চুপ করে এসে মৃন্ময় আর রাদিবের মাঝখানের চেয়ারটায় বসল। রাদিব নৃর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল।
- নাম কী তোমার?
- নৃ।
চমকে তাকাল মৃন্ময়, চমকে গেল স্নিগ্ধাও। এতো সহজে রাদিবের কথার উত্তর দিল নৃ এটা যেন বিশ্বাস করার মত না। নৃ বশির স্যার ছাড়া কারও সাথেই কথা বলেনা। কিন্তু খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলল, রাদিবের সাথে। একটু হাসি মুখে তাকাল মৃন্ময় স্নেহার দিকে, স্নেহা তাকিয়ে আছে মুখ শক্ত করে এদিকটায়। আরও কিছু টুকটাক কথা হল নৃর সাথে রাদিবের। খুব অল্প কথায় হলেও উত্তর দিল সেসবের।
বাহিরে এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। টুপটাপ করে পড়ে যাচ্ছে বৃষ্টি। এর মধ্যেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। মৃন্ময়ের প্রথমেই মনে হল বশির স্যার ফিরে এসেছেন। প্রধান দরজা খুলে নিল মৃন্ময়। মনে হওয়াটা ভুল। রাসেল দাঁড়িয়ে আছে বাহিরে। এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে একটা প্লাস্টিকের জগ। রাসেলের হাতে ছাতা থাকলেও সে ছাতা মাথায় দেয় নি। ভিজেই দাঁড়িয়ে আছে। মৃন্ময় নাক টান দিল, ঘ্রাণটা নেবার জন্য। ঠিক পেল ঘ্রাণটা। একটু সূক্ষ্ম চোখে তাকাল রাসেলের দিকে। রাসেল জগটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ভাইজান আপনাগো লাইগা দুধ পাঠাইছে। আর মেহমানরে নিয়া যাইতে কইছে।
মৃন্ময় দুধের জগটা হাত থেকে নিয়ে তাকাল রাদিবের দিকে। এরপর রাসেলের দিকে তাকিয়ে বলল, খাওয়া দাওয়া করে নি এখনও সে।
- ভাইজান নিয়া যাইতে বলছেন। ওনার জন্য রান্না করেছেন বাড়িতে।
রাদিব একটু তাকাল মুখ তুলে মৃন্ময়ের দিকে। মৃন্ময় একটু ইতস্তত করে বলল, আসলে একটু সমস্যা হয়ে গেছে। পুরাতন বাড়ি, বহুদিন পড়ে আসলাম। এনায়েত চাচা থাকার জন্য দুইটা ঘর পরিষ্কার করে রেখেছিলেন। অন্য ঘরগুলো থাকার মত না। তাই আর কি আপনাকে একটু কষ্ট করে আজ রাতে এনায়েত চাচার বাড়িতে থাকতে হবে। কিছু মনে করবেন না। বলতে যদিও লজ্জা লাগছে কথাটা।
- হাহা, আচ্ছা ব্যাপার না। এ আর কী?
- না, আসলেন আপনি। এভাবে অন্য বাড়িতে থাকা।
- আমি কিছু মনে করছি না। আজ তো তাহলে কথা হল না এতো। কাল কথা হবে। আমি আসলেই বেশি সময় থাকতে পারব না এখানে।
ঘর ফাঁকা আছে আছে। ইচ্ছা করলেই রাখা যেত রাদিবকে। বশির স্যারের ঘরেও কেউ নেই। ওখানেও রাখা যেত। তবুও স্নেহার কারণে আজ দিনের বেলাতেই কথা বলে রেখেছিল মৃন্ময় এনায়েত চাচার সাথে। রাদিব লোকটা কী মনে করল, কে জানে? রাদিব বেরিয়ে যেতেই স্নিগ্ধা বলল, দুলাভাই ভাইয়া, রাদিব ভাইয়াকে ঐ বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন যে?
- তোমার বোনকে জিজ্ঞেস কর।
স্নিগ্ধা তাকাল স্নেহার দিকে। স্নেহা নিঃশব্দে মাথা নিচু করে চলে গেল ঘরের ভিতর।

রাদিব হাঁটছে ছাতা মাথায়, আর পাশে হাঁটছে রাসেল। রাদিব অনেক করে বলেও ছাতার ভিতর আনতে পারে নি রাসেলকে।
- না আপনি থাকেন। আমি ভেজাই। ছাতার ভিতরে যাইয়া কী হবে? ছাতার ভিতরে গেলেই কি গা শুকাইয়া যাবে?
রাসেল লোকটা বেশ গম্ভীর। কথা কম বললেও, মাঝে মাঝে খুব মজার কিছু বলা বলছে। দেখেই বোঝা যায় বেশ মজার মানুষ। কিন্তু সারাক্ষণ সে মজা করে না। রাদিব হাঁটতে হাঁটতেই জানতে চাইল, নৃদের বাড়িটা নাকি সবাই ভয় পায়? কথাটা কি সত্যি?
- জ্বে সত্যি। ভূত আছে বাড়িত। কতজন মইরা গেল। ভূতে মাইরা আবার কাগজে কীসব লেইখা রাইখা যায়।
- হাহা, ভূতে আবার পড়াশুনাও জানে নাকি?
- জানব না কেন? জ্বিনে পড়ালিখা করে, ভূতে করতে দোষ কোথায়? আমার বড় চাচা তো হুজুর ছিলেন। সকালে মসজিদে কোরান পড়াইতেন। তার কাছে এক জ্বিন পড়তে আসত, সবার সাথে।
- জ্বিনটা দেখতে কেমন ছিল?
- জ্বিন কি আর ওর রূপে আইবে? সে আসে মানুষের রূপে।
- সে কি বলেছিল, সে জ্বিন?
- না, সে হইল ভদ্র জ্বিন। চুপচাপ মানুষের মত। আমার চাচার এক মাদ্রাসাও ছিল। সে মাদ্রাসায় ঐ জ্বি ভর্তি হইল। ভাল পড়া লিখা করে। অনেক মেধবান। একদিন হইল কী, রাইতের বেলা, পরীক্ষার আগের রাইত। আমার চাচা জ্বিনের ঘরের পাশ দিয়া যাইতেছেন। হঠাৎ কী মনে কইরা তাকাইলেন জানালার ফাঁক দিয়া। তারপর দেখলেন, সে জ্বি পড়বার মাঝেই হাত বাইড়াইয়া দিয়া বইয়ের তাক থিকা বই নিতাছে। টেবিল থিকা না উইঠাই। হাত ইয়া লম্বা হইয়া গেছে। দেইখা তো আমার চাচা সেই চিৎকার। তার পরদিন থেইকা আর জ্বিনটারে কোনদিন পাওয়া যায় নাই।
রাদিব মুচকি একটা হাসি দিল। বলল না কিছু। যতটা গম্ভীর ভেবেছিল রাসেলকে রাদিব। ঠিক ততটা না সে। কথা বলার সুযোগ পেলে অনেক কথাই বলে। কথা বলতে বলতেই জেনে গেল রাদিব, রাসেল কী কাজ করে এখানে, কেন করে, বাড়ি কোথায়, বিয়ে সাদি করেছে কিনা। জেনে নিল, মৃন্ময়ের পরিবারের সম্পর্কে কি কি জানে।
রাসেলও জানতে চায় রাদিব কী হয় মৃন্ময়দের। রাদিব বলে, আমি কিছুই হই না। আমি একজন ডাক্তার। চিকিৎসা করতে এসেছি।
রাসেল যেন একটু সাহস পেল এই কথায়। ছাতার ভিতর মাথা ঢুকিয়ে বলল, আপনারে একটা কথা কই। কাউরে বইলেন না কিন্তু।
- কি বলবেন?
- ঐ বাড়ির সব গুলান পাগল। মাইয়া একটা কারও লগে কথা কয় না। বউ যেইডা, হুদাই কিছু হইলেই আন্দাজে মানুষরে দোষ দেয়। ভূতে গ্লাস ভাঙ্গে, দোষ দেয় আমার। আর মৃন্ময় ছেলেটা ভাল। তয় এদের লগে থাকতে থাকতে পাগলা হইয়া যাইব কয়দিনের মইধ্যে। কেমন কেমন কইরা জানি ঘুইরা বেরায়।
- আর বশির স্যার?
- ঐ টাক ব্যাটা? ঐটারে আমার ভয় লাগে। কেমন জানি। আমার না একটা জিনিস মনে হয়। আপনারে কি বলব?
- বলেন।
- ব্যাটা খারাপ যাদু জানে।
রাদিব একটু একটু অন্ধকারে রাসেলের মুখের দিকে তাকাল। তাকিয়ে আবার ঘুরিয়ে নিল মুখ। রাস্তায় জমে থাকা কাদায় পা দিতে দিতেই বলল, এটা কেন মনে হল আপনার?
- আমি একদিন দরজার আড়ালে ফুঁকা দিয়া দেখছি, সে পুতুল নিয়া কীসব জানি করে। ধোঁয়া ছাইড়া পুতুলরে কীসব জানি বলে। লোকটা ভাল না।
রাদিব আবারও হাসল। চলে এসেছে এনায়েত চাচার বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকবার আগে আগে রাসেল বলল, আপনারে এতো কিছু কইলাম, কাউরে বইলেন না। আপনারে দেইখা ক্যান জানি বলতে ইচ্ছা করছে। আমি সবার সাথে বেশি কথা কই না, আপনাকে হুদাহুদি ক্যান জানি আপন আপন লাগছে।
রাদিব আবারও হাসল, না না কাকে বলব?
একটু থেমে আবার বলল, আপনি আতর দেন গায়ে?
- জ্বি, দামী আতর। সুন্দর না ঘ্রাণডা?
- হ্যাঁ অনেক সুন্দর।
আতরের ঘ্রাণ সুন্দর বলাতে মনে হল বেশ খুশি হল রাসেল।
রাতের খাওয়া দাওয়া হল এনায়েত চাচার বাড়িতে। বিশাল আয়োজন। এতো খাবার একজনের জন্য করেছে ভাবতেই কেমন লাগছে। মাছ, মাংস, ডিম, সবজি সবই আছে। হয়ত তারা জানে না রাদিব কী পছন্দ করে, তাই সব রকম রান্নাই করে রাখা। টাটকা সব খাবার, রাদিব খেলও বেশ তৃপ্তি নিয়ে। খাওয়া শেষে অনেক কথা হল, এনায়েত চাচা আর ওনার বউয়ের সাথে। এনায়েত চাচা খুব দুঃখ নিয়ে বললেন, একটা হাসপাতাল এলাকায় নাই। এজন্য গ্রামের লোকজনের বড় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তিনি একবার ভেবেছিলেন একটা হাসপাতাল বানাবেন গ্রামে। কিন্তু সমস্যা হল, এই গ্রাম ডাক্তারি করতে আসবে টা কে?
রাদিব এনায়েত চাচার বউকেও দেখল কিছুটা সময়। চোখ মুখে দেখে মনে হয়, ঘুমে চোখ লেগে আসছে ওনার। রাদিব জানতে চাইল, চাচীকে কী ঘুমের ওষুধ খাইয়েছেন নাকি?
এনায়েত চাচা রাদিবের কাছে এসে বলল, না ঘুমাতে পারলে আরও অসুস্থ হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর থেকেই অসুখ বাড়ে। তাই কবিরাজ যে সব ওষুধ দিছে তার মধ্যে মনে ঘুমেরও আছে।
- ঘুমের ওষুধ খাওয়া ঠিক না। ঘুমের ওষুধ খাওয়াটা বাদ দেন। সুস্থ হয়ে যাবেন উনি।
এনায়েত চাচা খুব একটা বিরক্তি নিয়ে তাকাল রাদিবের দিকে। কিন্তু সে বিরক্তি বুঝতে দিলেন না। মনে মনে বললেন, শহরের ডাক্তার গুলা একটু বেশিই বুঝে। এহ বলল আর সুস্থ হয়ে গেল, না?
কিন্তু সেসব মুখে বললেন না। রাদিবের ঘুমাবার জায়গা হল, রাসেলের ঘরে। রাসেল আজ ঘুমাবে না এখানে। কোথায় ঘুমাবে কে জানে? হয়ত বাজারের আড়তে পাঠিয়ে দিবেন এনায়েত চাচা।
রাদিব বিছানায় শুয়ে পড়ল। ছোট একটা ঘর। উপরে টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা পড়বার শব্দ হচ্ছে। সে শব্দ শুনতে বড় ভাল লাগছে। দালানে যারা থাকে, এই শব্দ তারা কখনই পায় না, অনুভব করতে পারে না। এই শব্দের মাঝে মিষ্টি একটা ভাব আছে। গ্রামে রাত হয় দ্রুত। সব নিশ্চুপ হয়েও যায় দ্রুত। রাত বাড়ার সাথে সাথে দূর বহুদূর থেকে আসা ঝি ঝি পোকা বা বুনো কোন রাত জাগা পাখির ডাক শোনা যায়। আজ এই বৃষ্টির শব্দে সেসবের কিছুই কানে আসছে না। মাথার কাছে মিটমিট করে জ্বলা হেরিকেনের আলোর দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে রাদিব। মানুষ জন কত অদ্ভুত বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকে। যে জিনিসের ব্যাখ্যা পায় না, তা কষ্ট করে খুঁজতেও যায় না, খুব সহজে তার আগে কিছু মন গড়া বিশ্বাস লাগিয়ে দেয়। যাই অদ্ভুত, তাই ভূতের কাণ্ড বলে চালিয়ে দেয়। কিন্তু একটু চিন্তা, একটু বিশ্বাসের গণ্ডি পেরিয়ে যা অবিশ্বাস তার দিকে পা বাড়ালে এমন কিছু হয় না। একটা অবিশ্বাস বিশ্বাস হতে পারে তখনই, যখন সাহস করে যুক্তির দিকে যাওয়া যায়।
স্নিগ্ধার এখানে আসার পর থেকেই মনে হচ্ছে ঘুম বেড়েছে। আজও ঘুমিয়ে গেল দ্রুত। যথারীতি কানে এয়ার ফোন গুঁজে। বাহিরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। বৃষ্টির রাতে ঘুমের মত মধুর জিনিস খুব কমই আছে।
মৃন্ময় রাতের বেলা ঘুমাবার আগে স্নেহার কাছে জানতে চাইল অনেক কিছু , বশির স্যারের কী হয়েছে, বশির স্যার কোথায় গিয়েছে, কেন এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে স্নেহা, কেন বলছে মরে যাবে, বশির স্যার কি আসলেই কালো যাদুর চর্চা করে, কেন আসবে না আর বশির স্যার বলেছে স্নেহা। সেসব প্রশ্নের কোনটারই উত্তর দিল না স্নেহা। আজ রাতেও খায় নি কিছু। খায় নি নৃও। খুব ক্ষুধা লাগাতে স্বার্থপরের মত খেয়ে নিল মৃন্ময়। মৃন্ময়ের সত্যি ভাল লাগছে না কিছু। কিন্তু স্নেহা কিছুই খোলাসা করছে না। শুধু বার বার বলছে, আমরা খুব বিপদে পড়েছি মৃন্ময়। আমি আর বাঁচব না সত্যি।
মৃন্ময় হাত ধরে শক্ত করে ধরে বলে, আমাকে বাঁচাতে পারবে না?
মৃন্ময় বুঝতে পারে না কী বলবে।
রাত হয়েছে অনেক। বাহিরে থেমে গেছে বৃষ্টি। শুয়ে আছে মৃন্ময়, পাশে স্নেহা। ঘুমায়নি দুজনের কেউ ই। ঘুমাচ্ছে নৃ। টেবিলের উপর দুধ রাখা জগ ভর্তি। গরম করে রেখেছিল মৃন্ময় তা। মৃন্ময় একবার বলল, স্নেহা দুধ খেয়ে নাও। শরীরটা ভাল লাগবে। না খেলে শরীর খারাপ করবে।
- আমি খাব না কিছু।
আস্তে করে বলে স্নেহা। স্নেহার কথা শেষ হতেই মনে হল ঠক করে আওয়াজ হল একটা। স্নেহা স্পষ্ট শুনেছে। শুনে চমকে উঠল। মৃন্ময় বলল, কী হল?
স্নেহা ফিসফিসিয়ে বলল, তুমি শব্দ শুনেছ?
- কীসের শব্দ?
- ঐ যে হল একটু আগে।
- আরে কোন শব্দ হয় নি।
আবার ঠক করে আওয়াজ হল জানালায়। এবার ঠিক শুনেছে মৃন্ময়। স্নেহা বেশ শক্ত করে ধরল মৃন্ময়কে।
- ঐ যে আবার হল।
মৃন্ময় স্নেহার হাত ধরে বলল, দাঁড়াও জানালা খুলে দেখছি।
মৃন্ময় জানাল খুলতে যাবে, স্নেহা বাঁধা দিল, না না তুমি খুলবে না। তুমি আমার কাছে থাকো।
- কেন? দেখি কীসের শব্দ।
- দেখতে হবে না, আমি জানি কীসের শব্দ।
আবার শব্দ হল সাথে সাথে। মৃন্ময় যাবে, পিছন থেকে টেনে ধরল স্নেহা।
- না খুলবে না।
- কেন?
স্নেহা মাথা নিচু করে বলল, এটা বশির স্যার। আমি জানি। মৃন্ময় আমার খুব ভয় করছ, প্লিজ তুমি আমার পাশে থাকো। জানালা খুলবে না প্লিজ। আমরা সত্যি বড় বিপদে আটকে গেছি। জানালার কাছে বশির স্যার।
মৃন্ময় অবাক চোখে তাকিয়ে রইল স্নেহার দিকে। স্নেহার চোখে পানি টলমল করছে। মৃন্ময়ের জামা শক্ত করে ধরে স্নেহা বলছে, ওখানে বশির স্যারই।
মানা করছে জানালা খুলতে।
আর মৃন্ময় পাচ্ছে একটা ঘ্রাণ। খুব পরিচিত একটা ঘ্রাণ। নাক টেনে সে ঘ্রাণটা কিনা নিশ্চিত হচ্ছে।

-রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

(পরবর্তী পর্ব আগামী কাল)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.