নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফেসবুকে আমি - রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার )

কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: মধুমিতা ও মেঘের অসুখ

১৪ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১১:৪৮

রাফি চায়ে চুমুক দিলো, আজও চিনি কম। এ বাসায় খাবার দাবারে প্রতিদিন কোনো না কোনো সমস্যা দেখা দেয়। চা, নুডুলস এবং ডিমে ভেজানো তেলে ভাজা পাউরুটি, এর মাঝেই ঘুরপাক খায় খাবারের তালিকা। কোনোদিন খাবারে লবন কম, কোনোদিন বেশি, কোনোদিন বরফ ঠাণ্ডা। মনে হয় চাও ফ্রিজ থেকে বের করে আনা। কোল্ড কফির পরিবর্তে কোল্ড টি। রাফি কোনো খাবারে না করে না কোনোদিন। যেদিন যে খাবার দেয়, খাবারের অবস্থা যাই হোক, খেয়ে ফেলে। রাখি মেয়েটাকে পড়াচ্ছে রাফি আজ পাঁচ মাস। মাসের টাকা পাঁচ তারিখের আগেই যদিও দিয়ে দেয়, তবুও মাঝে মাঝে মনে হয় রাখিকে বলুক, "শোনো রাখি, তোমার আম্মুকে বলবে খাবার যেন গরম করে দেন। আমি ঠাণ্ডা খাবার একদম পছন্দ করি না। আর নুডুলস, ডিম পাউরুটি বাদে অন্য আইটেম দিতে বলবে। একই খাবার প্রতিদিন ভালো লাগে না। নয়ত আমি আর কাল থেকে আসব না।"
রাফির এসব কিছুই বলা হয় না, বলা যায় না। বরফ ঠাণ্ডা চায়ে চুমুক দিতে দিতে রাফি বলে, "রসায়ন বই বের করো। আজ জৈব যৌগ পড়াব।"

রাফি বসেছে যে চেয়ারে সে চেয়ার থেকে স্পষ্ট দেখা যায় ড্রয়িং রুমটা। কে যাচ্ছে, কে আসছে। রাফি মাঝে মধ্যে ওদিকটায় তাকায়। রাখির বড় বোন মাঝে মাঝেই হাঁটাচলা করে ওদিকটা দিয়ে। ভালো লাগে দেখতে।

কলিং বেলের শব্দ হলো। রাফি তাকাল ড্রয়িং রুমে। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে দরজার দিকে চলে গেল রাখির বড় বোন রিমি। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে রাফি, রিমির খুশিতে চেচামেচি। এমন কেউ এসেছে, যাকে রিমির বড় পছন্দ। রাখি বই বের করে বলল, "স্যার, বই খুলেছি।"

রাফি যেন কোনো ধ্যান থেকে ফিরে এলো। ধ্যান ভেঙে বলল, "হ্যাঁ, পড়ো প্রথম পৃষ্ঠা। কিছু না বুঝলে বলো, আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। আর একেবারেই কিছু না বুঝলে, পুরোটাই বুঝিয়ে দিচ্ছি।"

রিমি আবার একবার এদিকটা দিয়ে ঘুরে গেল। হাতে করে নিয়ে গেল ফ্রিজ খুলে ঠাণ্ডা পানির বোতল। রিমির সাথে একজনের অদ্ভুত মিল আছে, কোথায় যেন মিল, ঠিক ধরতে পারে না রাফি। হাসিতে মিল হতে পারে, চোখে মিল হতে পারে, চেহারায় মিল হতে পারে। অদ্ভুত মিলের মানুষটার নাম মধুমিতা। মধুমিতার সাথে কথাও প্রথম অদ্ভুতভাবে। এক অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল সেদিন রাফির নাম্বারে। এপাশ থেকে হ্যালোর উত্তরে ওপাশ থেকে বলেছিল, "কেমন আছ?"
রাফি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। নিয়মিত যায় না ক্লাসে, মাঝে মাঝে ঢু মারে এটেন্ডেন্স বাঁচিয়ে পরীক্ষায় বসতে পারার জন্য। রাফি ও উত্তরে চমকে গিয়েছিল। একটু সামলে জানতে চেয়েছিল, "কে বলছেন?"
ওপাশ থেকে উত্তর এসেছিল, "আমাকে চেনাটা কি খুব জরুরী?"
রাফির জরুরী ছিল না চেনাটা। ঘট করে কেটে দিয়েছিল মোবাইল কল। খানিক পরে আবার কল। রাফি কেটে দেয় আবার। কয়েক বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে কল রিসিভ করে রাফি চুপ করে থাকে, ওপাশ থেকে গরগর করে বলে যায় কথা। দারুণ মিষ্টি এক কণ্ঠ, রাফির ভালোই লাগত, তবু মিছে মিছে একটা রাগ করার ভান করত। সে রাগ হয়ত ওপাশের মানুষটার জেদ হলো। প্রতিদিন নিয়ম করে কল করে। রাফি "আমাকে আর কল করবেন না", বলে মিথ্যে রাগ দেখায়। ওপাশ থেকে বলে, "কথা বলতে ইচ্ছা না করলে, ফোন না ধরলেই পারেন।"

রাফির কথা বলতে ইচ্ছা করত, কেমন যেন একটা অদ্ভুত নেশা ছিল কথার মাঝে। কথা বলতে বলতে, একসময় বন্ধুত্ব হলো, মেয়েটার নাম জেনেছিল মধুমিতা। থাকে সিলেটে। আকাশে চাঁদ উঠলে জ্যোৎস্নার কথা হতো, মেঘ করলে বৃষ্টির কথা হতো, শীত নামলে কুয়াশার কথা, অমানিশায় শুধু নিকশ আঁধারের কথা হতো। চাঁদ, বর্ষা, শীত পেরিয়ে কীভাবে যেন একটা বছর পার হয়ে গেল। ভালো বন্ধুত্ব তখন একটু একটু করে ভালোবাসা হতে শুরু করেছে। মধুমিতা ওর ছেলে বন্ধুদের কথা বললে, সহ্য হত না রাফির। রাফির ল্যাব গ্রুপে কোনো মেয়ে পড়েছে শুনলে জ্বলে যেত মধুমিতা। এর মাঝেই মধুমিতা একদিন বলেই দিলো, "আমি যদি তোমাকে বলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তবে কি তুমি খুব রাগ করবে?"
"একই প্রশ্ন যদি আমিও করি?" উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করে রাফি।
অমনি ভালোবাসা হয়ে গেল দুজনের। কিন্তু কী অদ্ভুত, দুজনের কখনও দেখা হয় নি। রাফিকে দেখেনি মধুমিতা, মধুমিতাকে রাফি। রাফি মাঝে মাঝেই বলত, "তুমি ফেসবুক চালাও না?"
মধুমিতা হেসে উত্তর দিত, "আমার ওসব ভালো লাগে না।"
"একটা আইডি খুলে নাও। তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করে, ফেসবুকে ছবি পাঠাবে।"
"সামনা সামনিই দেখো।"

প্রায় দুই বছর পর, রাফি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে, তখন দুজনের দেখা হবার দিন এল। হাতিরঝিলের রামপুরা ব্রিজের উপর শীতের সেই বিকেল বেলা নীল শাড়ি, খোঁপায় শিউলির মালা পরে আসার কথা মধুমিতার। দুজনের দেখা হবে। রাফি গিয়েছিল সেদিন মেরুন রঙের পাঞ্জাবি পরে। নীল রঙের কোন পাঞ্জাবি রাফির নেই, থাকলে বেশ হতো। নীল শাড়ির পাশে নীল পাঞ্জাবি হাত ধরে ঘুরে বেড়াতো। শেষমেশ যদিও হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো হয় নি। ধূসর রঙের প্রাইভেট কার থেকে যখন নীল শাড়ি আর খোঁপায় শিউলি জড়িয়ে যখন নেমেছিল মধুমিতা, বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছিল রাফি। জীবনে এতোটা চমকে যাওয়া, এমন দম বন্ধ হওয়া অনুভূতি, খুব কমই হয়েছিল।

পড়া বাদ দিয়ে কখন যেন টুপ করে রাখি চলে গিয়েছে। খানিক পরে ফিরে এসে বলল, "স্যার, আজকে আর পড়ব না। আমাদের বাসায় মেহমান এসেছে। আপনাকে আজ রাতে খেয়ে যেতে বলেছে আম্মু।"
মনে মনে বেশ খুশি হলো রাফি। খাবারের রুটিন বদলে গিয়েছে। রাতের খাবারের টাকাটাও বেঁচে গেল। রাখি চলে যাবার পর, রাফি চুপচাপ বসে রইল। অপেক্ষা করতে রইল, কখন খাবার আসবে। খেতে ডাকবে। রাখি মেয়েটা এখন ইন্টারে পড়ে। রাফি যখন কলেজে পড়ে, সে সময়কার কথা মনে করল। মীম নামের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা, অতি আবেগের বশে রাফির প্রেমে পড়ে গেল। রাফির ভাবনায় তখন আসেনি, রাফিকে ভালোবাসার কী আছে? কিংবা যে আবেগ দিয়ে, অত সুন্দরী একটা মেয়েকে না বলা যায় না, সে আবেগ তখন জন্মায় নি, জন্মেছে আরও প্রায় বছর তিনেক পর। মীমের প্রতি কোন আবেগ অনুভূতি কাজ করত না, যে আবেগ কাজ করেছিল মধুমিতার প্রতি না দেখেও। রাফির কাছে ক্রমাগত ভালোবাসার কথা বলে, ঋণাত্মক উত্তর পেতে পেতে একসময় ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিল মীম। কলেজের শেষ দিন গুলোতে দেখা হলেও, কথা বলত না, অন্যদিক থেকে চলে যেত, চোখাচোখি পর্যন্ত করত না পারতপক্ষে মীম। যদিও যেদিন ইন্টারের শেষ ল্যাব পরীক্ষা, সেদিন ল্যাবের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল মীম রাফির জন্য। রাফি আসতেই ডেকেছিল মীম। রাফি মুখ ঘুরিয়ে চলে যায় নি, বরং স্বাভাবিকভাবে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল, "কিছু বলবে?"
মীম ছলছল চোখে কাঁপা গলায় উত্তর করেছিল , "আমি কিন্তু তোমাকে এখনও ভালোবাসি।"
বলে মাথা নিচু করেছিল মীম। রাফি মীমের সামনে থেকে চলে এসেছিল কোনো উত্তর না দিয়ে। মীমের চোখের কোণে জমে থাকা জল, গাল বেয়ে নেমেছিল কি-না জানে না রাফি। আর কোনো খোঁজ খবরও পায় নি কখনও মীমের। আসলে খোঁজ নেবার বা যোগাযোগ করার চেষ্টা করে নি, প্রয়োজন বোধ করেনি রাফি।

রাফি খেতে বসেছে। রাখির মা এসে খাবার তুলে দিচ্ছেন প্লেটে। এখন পুরুষ পর্বের খাওয়া দাওয়া চলছে। এরপর নারী পর্ব শুরু হবে। রাফির স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির মত কম্বাইন্ড খাওয়া দাওয়ার নিয়ম আজ চালু করলেই পারত এ বাসায়। রিমি বসত রাফির সামনে, আর খাবার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখত রাফি। কিন্তু না, সামনে বসেছে টাক মাথার অপরিচিত এক লোক। যদিও রাফির নিজের মাথার চুলের অবস্থাও বেগতিক। টাক দৃশ্যমান হতে বেশি সময় লাগবে না।

"তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না? এক মুরগি নিয়ে বসে আছ। গরুর মাংস নাও, ইলিশ মাছ নাও।"
বলেন রাখির মা। রাফি "না না, ঠিক আছে", বলে উত্তর করে।
উনি উপস্থাপন করেন ব্যাখ্যা, যে কারণে রাফির কপালে প্রতি টিউশনির দিনে জোটে চায়ের সাথে নুডুলস কিংবা চায়ের সাথে ডিমে ভাজা পাউরুটি। উনি বলে যান, ওনার প্রেসারে বড় সমস্যা, ডায়াবেটিকের রুগী, শ্বাস কষ্ট আছে, ঠাণ্ডা গরম কোনটাই সহ্য করতে পারেন না। তাই রাফিকে ভালো মন্দ কোন খাবার দিতে পারেন না। কিন্তু তার মাঝে মাঝেই নাকি ইচ্ছা করে রাফিকে ভালো মন্দ খাওয়াতে। রাফি তা বিশ্বাস করে। উনি ওনার বড় মেয়েকে নিয়েও আফসোস করেন, মেয়েটা কিছুই পারে না। রান্না বান্নাও না, ঘরের অন্য কোন কাজও করে না। মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি গেলে কী করবে, তিনি সেই চিন্তায় অস্থির। রাফি মনে মনে বলে, "কোটিপতি দেখে বিয়ে করিয়ে দিবেন। পাঁচ ছয়টা কাজের লোক থাকবে, তারাই সব করবে।"

গল্প করতে করতে খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে যায়। সবার শেষেই উঠেছে রাফি খাওয়া দাওয়া করে। একজন মুরুব্বি মানুষ এতো করে সব খেতে বললেন, রাফি আর না করতে পারল না। হাত ধুতে বেসিনের কাছে যেতেই ড্রয়িং রুমে অল্প সময়ের জন্য কিছু দেখে চমকে উঠল রাফি। সেই মধুমিতার সাথে দেখা হবার দিনের মতন। ড্রয়িং রুমে মীম বসে আছে, পাশে রিমা। রাফির সোজা যে টাক মাথার লোক বসেছিল, সে মীমের হাসবেন্ড। মীম এখানে কী করছে? তাই মনে মনে ভাবছে রাফি। ঠিক সেদিনটার মত। সেদিনও নীল শাড়ি, শিউলি খোঁপা মাথায় গাড়ি থেকে নেমেছিল মীম। এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছিল রাফিকে। রাফি একটু আড়াল করে নিয়েছিল নিজেকে। নিজেকে বড় অবাঞ্ছিত লাগছিল। রাফি একবারের জন্যও বুঝতে পারে নি, এতদিন মধুমিতা হয়ে কথা বলেছিল মীম। কণ্ঠস্বর বদলে গিয়েছে অনেক, তাই হয়ত চিনতে পারে নি রাফি। তবুও বুঝতে পারা উচিৎ ছিল, ভাবনায় একবার হলেও আসা দরকার ছিল, মীম এই কাজ করতেই পারে। যে ভালোবাসা পায় নি কলেজ জীবনে, কৌশলে তা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে আদায় করে নিতেই পারে। রাফি এ জিনিসটাও ভুলে গিয়েছিল, কেউ একজন বলেছিল বন্ধুদের মধ্যে, মীম পড়াশুনা করছে সিলেটে। সেদিন ওখান থেকে চলে এসেছিল রাফি, মধুমিতার সাথে দেখা করতে গিয়ে। শূন্য, বিষণ্ণ, বিমর্ষ রাফি। ভেঙে গিয়েছিল অনেক দিনের দেখা স্বপ্ন, আবেগ। খানিক পরেই মধুমিতা কল করেছিল। বলেছিল, "কোথায় তুমি? আমি এসেছি তো।"
"আমি তোমাকে দেখেছি। আর আমি অবশ্যই একজন মিথ্যুকের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাব না।"
কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিল মধুমিতা, "আমাকে তোমার পছন্দ হয় নি?"
"তোমাকে আমার কখনই পছন্দ ছিল না। বাই, আমাকে তুমি আর কখনও কল দিবে না। প্লিজ।"

মধুমিতা আর কখনও কল দেয় নি। মধুমিতা মানেই মীম, মীম মানেই মধুমিতা। ভাবে রাফি। তবে মধুমিতার জন্য এখনও ভালোবাসা বুকের ভিতর আছে, অদেখা মধুমিতা, যাকে না দেখেই ভালোবেসেছিল রাফি, যার সাথে কথা বলতে বলতেই কল্পনায় একটা মুখ ভেবে নিত রাফি। বড় স্নিগ্ধ, কোমল, ভালোবাসার সে মুখ। ও মুখের সাথে মীমের কোন মিল নেই।

রাফি হাত ধুয়ে, বেরিয়ে আসল ও বাসা থেকে। আকাশ মেঘলা আজ সকাল থেকেই। বৃষ্টি নামবে, শীত নামানো বৃষ্টি। এক শীতের বৃষ্টির রাতে বাবা চলে গেলেন, কিছু না বলেই। এরপর পুরো সংসার রাফির ঘাড়ে। পাশ করে চাকরি পায় না, টিউশনি করিয়ে বেড়ায়। চাকরি খুঁজে বেড়ায় ফাঁকে ফাঁকে। জীবনের এই গৎবাঁধা বাস্তবতায় একদিন মধুমিতার কথা ভুলেই যায় রাফি। তবে গত পাঁচ মাস ধরে, রিমিকে যতবার দেখে, কথা শুনে, মধুমিতার সাথে মিল খোঁজার চেষ্টা করে ততবার।

রিমি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। এতদিন পর মীম আসলো তবুও খুব একটা কথা বলা হলো না। একটা আনন্দ প্রথম প্রথম লাগছিল, এরপর কেমন যেন হুট করে মাথা ব্যথা করে উঠল। চলে আসলো ড্রয়িং রুম থেকে। মীম আর মীমের হাসবেন্ড কী মনে করল কে জানে? মীম রিমির সবচেয়ে কাছের বান্ধবী। পরিচয় যদিও সিলেটে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করবার সময়। রিমি জানে, রিমি দেখতে আহামরি কিছু না। বরং মীমের সাথে বের হলে, সবাই মীমকেই হাঁ করে দেখত। রিমির দিকে কেউ তাকাত না। মীম চাইত সবসময় রিমির একটা ভালোবাসার মানুষ থাকুক, যে রিমির মতই ভালো। একদিন একটা ছেলের নাম্বার দেয় মীম। বলে অপরিচিতা হিসাবে কথা বলতে। কথা হয়, ভালোবাসা হয়, দেখা হয় না। রিমির নাম বদলে হয়ে যায় মধুমিতা। রাফিকে যখনই দেখে নিজেকে মধুমিতা মনে হয় রিমির। রাফি সপ্তাহে তিনদিন আসে, তিনটা দিনের দেড় ঘণ্টা করে সময় বড় ভালো লাগে। যদিও রাফিকে বাসায় টিচার হিসাবে রাখতে কম ঝামেলা পোহাতে হয় নি রিমির। রিমির বাবা মা কোন ভাবেই রাখির বাসায় শিক্ষক রাখবেন না, রাখবেন শিক্ষিকা। অনেক ভালো পড়ায়, এই সেই বলে রাফির নাম্বার দেয় বাবা মাকে। মা কথা বলে, রাখির জন্য শিক্ষক হিসাবে রাখে রাফিকে। রাফি কখনও জানতেও পারবে না, এ বাসায় আসার পিছনে রিমির হাত আছে। রিমি ভেবেছিল এ বাসায় এসে রিমিকে দেখে, আর আসবে না কখনও রাফি। অমন কিছু হয় নি। পাঁচ মাস ধরেই পড়াচ্ছে রাফি।

আকাশে আরও মেঘ জমছে। কিছু মেঘ রিমির জানালা দিয়ে দেখা আকাশে, কিছু মেঘ রাফির মাথার উপরের আকাশে। কোন মেঘে বৃষ্টি হবে জানে না রাফি, জানে না রিমি। মানুষের জীবনে জানা শোনার ব্যাপার গুলো সবসময় সঠিক নয়।
রাফি যেমন জানে না, সেদিন মধুমিতা ছিল গাড়ির ভিতরে। বাহিরে বের হতে লজ্জা পাচ্ছিল। তাই মধুমিতার বান্ধবী মীম একটু চারপাশে তাকিয়ে দেখেছিল রাফি কোথায়। একই রঙের শাড়ি আর খোঁপায় ফুল পরে দেখা করতে এসেছিল দুজন। মীম চাইছিল ক্ষমা চেয়ে নিবে রাফির কাছে, রিমিকে মধুমিতা করে রাফির ভালোবাসায় বেঁধে দিয়ে যাবে।
রিমি তেমন জানে না, রিমি দেখতে অত সুন্দর নয়, এ অজুহাতে মধুমিতাকে ত্যাগ করেনি রাফি। মীমকে মধুমিতা ভেবেছিল রাফি। মীম ছাড়া মধুমিতা যে কেউ ই হোক তাকে ভালোবাসত রাফি। রাফি জানে না, মধুমিতাকে সপ্তাহে তিন দিন সামনে ঘুরে বেড়াতে দেখে রাফি। মধুমিতার সাথে মিল খুঁজে বেড়ানো মানুষটাই মধুমিতা। রিমি জানে না, রাফি এখনও মধুমিতাকেই ভালোবাসে। লুকিয়ে দেখে রিমির মাঝেই মধুমিতাকে খুঁজে ফিরে।

দুজনের কেউ হয়ত জানতে চায় না, জানার আগ্রহ মরে গেছে। একটা সময় অনেক কিছুর আগ্রহই হুট করে মরে যায়। রাফির কাছে মধুমিতা মিথ্যেবাদী, রিমির কাছে রাফি মধুমিতার সুন্দর নয় চেহারা দেখে পালিয়ে যাওয়া এক মানুষ।

শীত নামানো বৃষ্টি নেমে গেল। রাফি জায়গা নিল একটা যাত্রীছাউনির নিচে। রিমি অমন জানালা ছুঁয়ে। মেঘের অসুখ করলেই, মেঘেরা কেমন কাঁদে। রিমির মনে অসুখ, রাফির মনে অসুখ। মেঘের সাথে তবু দুজনের তাল মিলাতে খুব বাঁধে। বুকের ভিতর অসুখ গুলো জমতে জমতে ব্যথা হয়, কখনও মেঘের মত কাঁদতে চায়। আবার ব্যস্ত জীবনে তাল মিলিয়ে একসময় মানিয়ে নিয়ে চলতে শিখে যায়।

২০১৭
রিয়াদুল রিয়াদ

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১২:২৫

জনারণ্যে একজন বলেছেন: অতি-নাটকীয়তার দোষে দুষ্ট এই গল্পটা।

টুইস্ট থাকা ভালো, কিন্তু সেক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে তা যেন বর্ণনা বা নাটকীয়তার আতিশয্যে পাঠকের বিরক্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।

এনিওয়েজ, আমার এই মন্তব্যও আপনার জন্য বিরক্তির কারণ হবে।

১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১:৩০

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: বলেছেন: ধন্যবাদ, আপনার মন্তব্যের জন্য। আমি অবশ্যই আপনার মন্তব্যে বিরক্ত হই নি, হবার কথাও নয়।

আগের লেখাগুলো ব্লগে দেবার অন্যতম কারণ কিন্তু এটাও যে, লেখাগুলোর ভুলত্রুটি শুধরে নেয়া। মতামত না জানলে, বোঝার উপায় কোথায়, ঠিক কোন জায়গাটায় পরিবর্তন দরকার।

আপনার মতামত মাথায় রাখলাম।

২| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ ভোর ৫:৫৩

শায়মা বলেছেন: আমি মুগ্ধ! এই গল্প অনেকটা নাটকীয় মনে হলেও । জীবনে এমন নাটক হতেই পারে। আর সেটা নিয়েই জীবনের নাটকীয় ঘটনা হয় আর সেটাই হয়ে যায় গল্প!!


অনেক ভালো লাগা ভাইয়া!

১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ সকাল ১০:১০

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ। হয়ত শত সম্ভাবনার একটি ছিলো গল্পের ঘটনা প্রবাহ। জীবনের প্রতিটি ঘটনার একাধিক সম্ভাবনা হতেই পারে, একেকটা ঘটনা একেকটা বাটারফ্লাই ইফেক্ট হয়ে আমাদের সামনে ধরা দিতেই পারে।
আমি গল্পে, শত সম্ভাবনার একটিকে বেছে নিয়েছি।

ভালোবাসা জানবেন, গল্প পাঠের জন্য।

৩| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ সকাল ৮:৪৮

সেলিম আনোয়ার বলেছেন: নাটকীয়তা মানুষের কল্পনার জন্ম হয় না শুধু বাস্তবও হতে পারে। সুন্দর লিখেছেন।

১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ সকাল ১০:১১

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: ধন্যবাদ প্রিয় কবি, ভালোবাসা নিবেন।

কিছু নাটকীয়তা সুখ হয়ে ধরা দেয়, কিছু নাটকীয়তা জীবনের অসুখ।

৪| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫

রাজীব নুর বলেছেন: রাফি কি আপনি নিজেই।

১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ সকাল ১০:১৩

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: হাহা, না আমি রাফি নই। টিউশনির অনেক গল্প আছে, সিলেট নিয়ে স্মৃতি আছে, তবে এ গল্প আমার নয়। এক বন্ধুর জীবনের এক ঘটনা হতে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা।

৫| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

বিজন রয় বলেছেন: আপনি খুব সমস্যায় ফেললেন, প্রতিদিন আপনার গল্প পড়ার সময় পাই না। আবার এড়িয়ে যেতেও পারি না।

সপ্তাহে ১/২ টি পোস্ট দেওয়া যায় না?

১৬ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ২:০৬

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: হাহা, দাদা, এবার ব্লগে আসার পর অনেক কিছুই পরিবর্তন করেছি। তার বেশির ভাগ অবদান আপনার। এই উপদেশও মাথায় রাখলাম।

ধন্যবাদ।

৬| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ২:২৯

নয়ন বড়ুয়া বলেছেন: চমৎকার।

১৬ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ২:০৭

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.