নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কোন এক সময় লেখালেখি শুরু করবো। এখন যা লিখছি তা সেই সময়ের জন্যে প্রস্তুতি আসলে। আর লেখার জন্যে নতুন নতুন তথ্য যোগাড় করছি আপাতত।

ফায়েজুর রহমান সৈকত

মুক্ত সকল চিন্তা করি, নিজের সাথে নিজেই লড়ি।

ফায়েজুর রহমান সৈকত › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভালবাসার ঢাল

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ২:১৭

ছোটকাল থেকেই খুব আনন্দ উল্লাস আর হইহুল্লোর করে আমরা বড় হয়েছি। এর অবশ্য একটা কারণ ছিল, সেটি হলো আমার দাদা-দাদি, নানা-নানি সবাইকে আমরা জীবিত অবস্থায় খুব ভালভাবে পেয়েছি। ফলে দাদি বাড়িতে গেলেতো মজা হতোই আর নানি বাড়িতে গেলে তার কোন সীমা নেই। দাদিবাড়িতে সবাই একত্র হলে তুমুল গপ্পোসপ্পো শুরু হয়ে যেত। এই গপ্পোর বেশিরভাগই ছিল আমার আব্বার দাদা অর্থাৎ বড় আব্বার গল্প, বড় আব্বা গ্রামের শিক্ষক ছিলেন তাই তার পদবী অনুসারে দাদিবাড়িকে সবাই ডাকতো মাস্টার বাড়ি। এই মাস্টার বাড়ির গল্প শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি। আমার দাদা উড়নচণ্ডী স্বভাবের আর ভীষণ রাগী লোক ছিলেন। সংসারের প্রতি তার সামান্যই টান ছিল । তবুও আমার আব্বা চাচারা ভাগ্যক্রমে ঠিকঠাক মানুষ হতে পেরেছিলেন আমার ভীষণ কর্মঠ আর দায়িত্বশীল দাদির জন্যে। তিনি একহাতে যেমন সংসার সাজিয়েছেন আবার অন্যহাতে নিজের শখের ছাগল, হাস মুরগি ইত্যাদিও লালন পালন করেছেন।

আমার দাদা-দাদি, নানা-নানি এই চারজনকে নিয়ে অভিজ্ঞতা এবং ভালবাসা দিয়ে ঘেরা ঢালের প্রথম ভাঙ্গন ঘটেছিলো ২০০৭ সালে। দাদা মারা গেলেন। কিন্তু এই মহা বিয়োগান্তের আঁচ এতটুকো পড়তে দিলেন না দাদি। তিনি তার সন্তানদের খেয়াল রাখলেন। বিভিন্ন পারিবারিক সিদ্ধান্তে দাদার স্থলাভিষিক্ত হলেন। প্রয়োজনীয় আদেশ উপদেশ দিলেন। তারপরে ২০১১ সালে হঠাৎ আম্মা মারা গেলো । আম্মার চলে যাওয়া ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিলো আমাদের পরিবারকে। আমরা ছন্নছাড়ার মতন হয়ে গেলাম। আবারও সহযোগিতা করলেন দাদি। তিনি নিজের গ্রামের বাড়ি ছেড়ে আমাদেরকে দেখাশোনার জন্যে বাসায় চলে আসলেন। আমার মনে পড়ে সন্ধ্যেবেলায় আমাদের ভাই বোনদেরকে দাদি কতশত গল্প বলতেন। তিনি আমাদেরকে রান্না করে খাওয়াতেন। স্বাভাবিকের চেয়েও দ্বিগুণ বড় করে কি এক অদ্ভুত ভাবে দাদি ডিম ভাজতেন। মায়ের জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হয়ে দাদি আমাদের শাসনও করতেন। তারপরে অনেকদিন হয়ে গেল। আমাদের সংসার আবার পূর্বের মতো সজীবতা পেলো।

গত বছর দাদি তার গলায় সামান্য ব্যথা অনুভব করলেন। আমরা ভাবলাম হয়তো সর্দি কিংবা কোন ঘা টা কিছু হবে। এই ভাবনার অবশ্য কারনও ছিলো। দাদি খুব পান চিবুতেন। আমরা মানা করতাম ঠিকই কিন্তু যার যা খেতে ভাল লাগে সে কি শোনে কারোর মানা? তাই ভাবলাম পানের কারণে হয়ত ঘা হয়েছে। এলাকায় ডাক্তার দেখানো হলো তাকে। ডাক্তার বললো ভিটামিনের অভাব নাকি । তাই ভিটামিনের ওষুধ খেলেন তিনি কিন্তু তবুও ব্যথাটা তার রয়েই গেলো। তাই আমরা তাকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখানোর সিদ্ধান্ত নিলাম । সিলেটে এনে তার চ্যাকাপ করালাম। সেদিন বড়দিন ছিলো। সন্ধ্যায় ক্রিসমাসের অনুষ্ঠান থেকে ঘুরে ডাক্তারের চ্যাম্বারে রিপোর্ট দেখাতে গিয়ে শুনতে পেলাম দাদির গলায় ক্যান্সার হয়েছে। চ্যাকাপ রিপোর্টের রেজাল্টটা আমিই আনতে গিয়েছিলাম, তখন ডাক্তার আমতা আমতা করে দুঃখিত হয়ে আমায় এই তথ্য দিলেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু খুব শান্ত ভাবে সবাইকে দাদির খবর জানালাম। যদিও দাদিকে এ ব্যাপারে কিছু জানানো হলো না। দাদি খুবই কর্মঠ এবং সাহসী মহিলা ছিলেন তো তাই মরনব্যধি এই রোগের ব্যাপারটি তিনি বুঝতে পেরেও এমন ভাব ধরে থাকলেন যেন তিনি কিছুই বুঝেন নি এবং শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবেন। দাদির ক্যান্সার চিকিৎসা শুরু হলো। আমরা সব ভাই বোনেরা মিলে দাদির সাথে হাসপাতালে তার সাথে সারাক্ষণ থাকলাম। দাদি ধীরেধীরে দূর্বল হতে থাকলেন। যত দিন যেতে থাকলো তার অসুখটি আরো বাড়লো। এক সময় তাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসা হলো।

এবার শুরু হলো দাদির আসল সংগ্রাম। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ তিনি আরো দূর্বল হতে থাকলেন। কিন্তু মনের জোরে তিনি যেন সকল অসুখকে হারিয়ে দিতে চাইলেন। যে-ই তাকে দেখতে যেতো, তাকে স্বান্তনা দিতে চাইতো উলটো তিনি তাদেরকে সাহসী বানী শোনালেন। তিনি বলতেন, “আমার এম্নে কোন অসুখ নাই। খালি খাইতে গেলে একটু বেদনা করে। গলাত দুখ ফাই। আল্লা যদি দুইলা ভাত খিলাইতো আমারে তাইলেই আর কিছু চাইনা আমি। ও নাতী, কতদিন ধইরা কিছু খাইতে পারিনা।”
আমরা তাকে বলতাম, “দাদি দেইখেন সব ভালা হইয়া যাইবো। আর কয়ডা দিন। আপনে আবার খাইতে পারবেন।” আমাদের মিথ্যা আশ্বাসের কথা দাদি বুঝতেন। আমরাও বুঝতাম যে তিনি বুঝতে পারছেন। কিন্তু উভয়েই না বুঝার ভান ধরতাম। আমরা হাসতাম, তিনি হাসতেন না। গলায় ব্যথা করতো তার।

তারপর একরাতে হঠাৎ খবর এলো দাদির অবস্থা ভীষণ খারাপ। আমরা তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসলাম। এসে দেখি সবাই দাদিকে ঘিরে আছে। কেউ কান্না করছে, কেউ সূরা পড়ছে। দাদির ভীষণ শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল। আমরা দাদির খুব কাছে যেতেই হয়ত বুঝতে পেরেছিলাম যে ভীষণ এই প্রত্যয়ী মানুষটি শীঘ্রই মারা যাচ্ছেন না। ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে স্থানীয় হাসপাতালে এনে অক্সিজেন দেওয়া হলো। অনেক সংগ্রাম করে সেবার দাদি বেঁচে ফিরলেন। একটু স্বস্তি নিয়ে আমরাও আবার ফিরে গেলাম।

তারও এক সপ্তাহ পরে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে বাড়ি থেকে খবর এলো দাদি মারা গেছেন। ভীষণ এই কষ্টের চেয়ে হয়ত তার মৃত্যুটি তার জন্যে ভাল ছিল। আমরাও হয়ত তাইই চাচ্ছিলাম কিন্তু তবুও কষ্টে আমার বুক ফেটে গেলো। মাঝরাতে আমরা সবাই বাড়ি পথে রওয়ানা হলাম। আসার পথে আমাদের বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনদের জানালাম। তারা সমবেদনা জানালেন। কিন্তু একটু পরে আবার খবর এলো তিনি মারা যাননি। হঠাৎ নাকি তার দেহ নড়ে উঠলো। আমরা স্বস্তি পেলাম। কয়েকদিন বাড়িতে থেকে আমরা আবার ফিরে গেলাম।

পরশুরাতে আবার খবর এলো। আবার দাদি মারা গেলেন। আমরা জানতাম আবার কোন খবর এলে আর তাকে ফেরানো যাবেনা। এবার আর কোন ভুল হলো না। এক ভীষণ শূন্যতা আমাদের গ্রাস করলো। যেন সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এত সুখস্মৃতি, এত সংগ্রাম, সবকিছু শেষ হয়ে গেলো। এমনকিছুর জন্যে প্রস্তুত থাকার পরেও মনে হলো হঠাৎ যেন তার মৃত্যু খবর পেলাম। ১০/৮/২০১৭ তারিখ বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে দশটায় দাদি মারা গেলেন। শুক্রবার জুম্মার পরে দাদিকে দাফন করা হলো। আম্মার লাশের ভারবাহী খাটিয়া নেবার ভাগ্য হয়েছিলো আমার। দাদির লাশটিকেও বহন করতে পেরেছি আমি। আম্মা আর দাদার লাশের ঠিক পাশেই আমাদের ভালবাসা দিয়ে ঘেরা ঢালটিকে সমাধিস্থ করা হলো।

দুবছর আগে আমার নানী মারা গিয়েছেন। নানাও ভীষণ অসুস্থ। সব আত্মীয় স্বজন এখন নানার পাশে রয়েছেন। আমাদের চারটি ঢালের তিনটি ঢালই ভেঙে গিয়েছে। ভীষণ অসুস্থ অবশিষ্ট ঢালটি এখন কাউকে ভাল মতন চিনতে পারছেন না। আমি ভাবি মানুষের ভালবাসার ঢালগুলো কিভাবে চোখের সামনে ধীরেধীরে ভেঙ্গে যায়। আবার অন্যদিকে অন্যভাবে হয়ত ভালবাসা গড়ে উঠে কিন্তু একবার যা গিয়েছে তা কি আর ফেরত পাওয়া যায়? যায়না। :

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ২:৪১

কঙ্কাবতী রাজকন্যা বলেছেন: এভাবেই প্রিয় স্বজনেরা একে একে হারিয়ে যায়।

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ২:০৩

ফায়েজুর রহমান সৈকত বলেছেন: হ্যাঁ। আমরাও এভাবে হারিয়ে যাবো। :)

২| ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:১৮

মোস্তফা সোহেল বলেছেন: সবাইকে একদিন এভাবে একে একে চলে যেতে হবে।
আল্লাহ আপনার দাদিকে জান্নাত দান করুন।

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ২:০৩

ফায়েজুর রহমান সৈকত বলেছেন: :)

৩| ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:০৮

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: এভাবেই সবাই একদিন চলে যায়।

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ২:০৪

ফায়েজুর রহমান সৈকত বলেছেন: :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.