নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পৃথিবী মাতা

সৈকত সাদিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ৈসকত সািদক

ৈসকত সািদক › বিস্তারিত পোস্টঃ

নারীর ভাষাঃ তত্ত্বগত আলোচনা

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৪ ভোর ৪:৪৯

প্রচলিত ক্ষমতার কাঠামোঃ নারীর ভাষা

সৈকত সাদিক*



বহু ফরাসী উত্তর আধুনিক নারীবাদী চান সম্পূণ নতুন ভাষা, নতুন ধারণা গড়ে তুলতে যেখানে আধুনিক চিন্তন পদ্ধতির কঠোর কাঠামোটির সীমাবদ্ধতা ভালো করে ফুটিয়ে তোলা যাব । যেমন- এলেনসিকসু, জুলিয়াক্রিস্তেভা ও লুস ইরিগারে প্রকৃত অর্থে বিনির্মাণের কথা বলেন । এঁরা চান সম্পূর্ণ পৃথক বোধ ও স্বাদের অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করতে । এঁদের ভাবনায় নারীমুক্তি মানে প্রচলিত চিন্তন প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি । অদ্ভুত এক মিশ্র মাধ্যম তাঁরা তৈরি করেছেন । সেখানে তাত্ত্বিক আলোচনা ও বিশ্লেষণে মিশে যায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর তার আকর্ষণে চলে আসে সাহিত্য । এঁদের রচনায় তাই নানা অভিজ্ঞতার সমাপতন । তাঁরা সচেতনভাবে লেখার রাজনীতিক কৌশল হিসেবে এমনটি করে থাকেন । তাদের মতে পাশ্চাত্য দর্শনে শরিরের তুলনায় মন, আত্মা ও চিন্তনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে । তাই শরীর ও শারীরিক অভিজ্ঞতা উপেক্ষিত হয়েছে । সংবেদনশীল ঘনিষ্ঠতার অভিজ্ঞতা(The experience of sensitive intemicy) কে ভাষায় প্রকাশ করা প্রয়োজন । সাহিত্যই হতে পারে প্রকাশের ভালো মাধ্যম । ক্রিস্তেভা বলেন, এ পন্থা কে “নুন্যতম বিপ্লবের” পথ মনে হতে পারে । যে (পুরুষ) তন্ত্রে সব রকম বিপ্লবের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করা হয়, সেখানেই এই নুন্যতম বিপ্লবের মুল্য কম নয় ।



ফরাসী নারীবাদীরা অনেকেই উত্তর কাঠামোবাদী ও উত্তরাধুনিক দৃষ্টিকোণ এবং মনঃসমীক্ষণী (Psychoanalytic) দৃষ্টিকোণ দ্বারা প্রভাবিত । এঁদের বিশ্লেষণ বহুলাংশে তাত্বিক । ফুকো, দেরিদা, লাকাঁ এঁদের তাত্বিক প্রেরণা । এঁদের মতে সাহিত্যের পাঠ্যবস্তু (Text) প্রাথমিক ভাবে বাস্তবের একটি উপস্থাপনা কখনই নয় । অথবা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খুঁটিনাটিও যথার্থ বর্ণনা নয় । ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বরের পুনরুৎপাদন মাত্র নয় । বরং এঁরা সাহিত্যের তুলনায় জীবনের অন্যান্য দিককে বেশি চর্চা করেন । তাঁরা ভাষা, উপস্থাপনা (Representation), মনস্তত্ব এগুলি সম্পর্কে উৎসাহী । সাহিত্যিক পাঠ্যবস্তুতে আসার আগে তাঁরা এধরণের দার্শনিক সমস্যার খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামাতে আগ্রহী । এঁদের মধ্যে ক্রিস্তেভা । এলেন সিকসো (HELENE CIXOUS) এবং লুস ইরিগারে । এলেন সিকসো’র মতে প্রথাসিদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত ভাষা হল পুরুষের ভাষা । এ পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত হলো “নারীর ভাষা” (যা আমার আলোচ্য বিষয়) । “The Laugh of the Medusa” প্রবন্ধে তিনি বলেন, এক ধরনের “Eriture feminine” বা “নারীর লেখা’র” কথা ভাবতে হবে । সেখানে ব্যাকরনের কাঠামো শিথিল। তার মধ্যে অর্থের অবাধ ক্রীড়া চলতে পারবে । তার ভাষায় “it is impossible to define a feminine practice of writing, and this is an impossibility which will remain, for this practice can never be theorized, enclosed, coded ...it will always surpass the discourse that regulates the phallocentric [male -dominated] system; it does and will take place in areas other than those subordinated to philosophico-theoritical domination. It will be conceived of by subjecs who are breakers ofautomatism, by peripheral figures that no authority can ever subjuagte.” (Coxious in Berry: 127)

এখানে ‘নারীর লেখা’র আস্ত্বিত্ব ভাবা হয়েছে যুক্তি তর্কের সীমা ছাড়িয়ে অন্য এক ক্ষেত্রে (Gatens: 111-121) । কারণ একে তাত্তিকভাবে সূত্রায়িত করা কখনই সম্ভব নয় । দার্শনিক- তত্ত্বগত প্রভূত্ত্বের আধীন নয় এমন এক ক্ষেত্রে তার আবস্থান । এ ভাষার ব্যবহারকারী কে? সিকসুর বর্ণনা থেকে যে চিত্রটি ভেসে উঠেছে তা হল এক নিরন্তন সংগ্রামরত সত্তা। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম তার ব্রত। এ হল যেন নৈরাজ্যের এক অবস্থা যেখানে চলেছে নিরন্তন বিরোধিতা । প্রান্তিক এই সত্তাগুলিকে কোনো কর্তৃপক্ষ বা কর্তৃত্ব তার পদানত করতে পারে না, পারে না অধীন রাখতে । ক্ষমতার কেন্দ্রের প্রতি আকস্মিক ও লুকোনো আক্রমণ হানা তার কাজ । সিকসুর মতে, এরূপ লেখা নারীর শরীরবৃত্ত (physiology) এর স্বকীয় একটি উৎপন্ন বস্তু । নারীর এ লেখায় ঐস্বকীয়তা প্রকাশিত হইয় । তাদের শরীরের মাধ্যমে তাদের লিখতে হবে । এ হবে এক দূভেদ্য ও অলঙ্ঘনীয় ভাষা । এ হোলো শরীরের জগত । এ নিয়ম-কানুনের ঊর্ধ্বে, বিধি-অতিক্রমকারী । সমাজের নিয়মকানুনের বাইরে । সিকসুর ভাষায়- “Women must write thought their bodies, they must invent the impregnable language that will wreck partition, classes, and rhetorics, regulation and cods, they must submerge, cut through, get beyond the ultimate reserve- discourse, including the one laughs at the very idea of pronouncing the word ‘silence’...Such is the strngth of women that, sweeping away syntax, breaking that famous threat (just a ting little thread, they say) which acts for men as a surrogate umbilical cord” (Cixous in Barry: 128). তবে সিকসুর ‘Ecriture feminine’ ধারণার অনেক সমালোচনা হয়েছে । যেমন- পিটার ব্যারি লিখেছেন, সিকসু শরীরের যে রাজ্যকে কল্পনা করেছেন তা যেন সামাজিকভাবে নির্মিত লিঙ্গ (Gender)- এর শর্তাবলী ও প্রভাব থেকে মুক্ত- ‘rhetorics, regulation, codes’ দ্বারা প্রভাবিত নয় । এ যেন নারীর এক বিশুদ্ধ সারবস্তু (a pure essence of the feminine)- এর ধারণা । কিন্তু যে নারীরবাদ মনে করে ‘নারীত্ব’ সামাজিকভাবে নির্মিত হয়, তাকে মন করে নারীর সারসত্তার কথা বলে (Cross: 86-87) ? এতো উত্তরকাঠামোবাদ ও উত্তরআধুনিকতাবাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় । এতো সারবাদী তত্ত্ব- ‘essentialism’ । উত্তরআধুনিক মতে, ‘নারীত্ব কমনেই করা হয় তা কোনো ইতিমধ্যেই প্রদত্ত, পূর্বপ্রদত্ত (geven) সত্তানয়, যার হস্যজনকভাবে আগে থেকেই বাস্তবে রয়ে গেছে । যদি নারীত্ব সামাজিকভাবে নির্মিত হয়ে থাকে, তাহলে এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতিতে তা পৃথক হতে বাধ্য । সেক্ষেত্রে সিকসু যেমন ব্যাপক সাধারণীকরণ করছেন তার অসঙ্গতি স্পষ্ট । বাস্তবের নারীদের মূর্ত অবস্থাগুলি নির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্র । সেগুলির পার্থক্যকে উপেক্ষা করে সিকসু এক ধরনের ‘সাধারণ অভিন্ন নারীসত্তা’র কথায় ফিরে যাচ্ছেন ? কে তাদের এভাবে লিখতে বাধ্যকরছে ? এবং কেন ? তার কারণ কী ? (Barry: 128) । Toril Moi- বলেছেন, সিকসুর ধারণাটি হল ‘romanticized version of the female body as the site of women’s writing’ (Gatens: 114) । তবে Moira Gatens সিকসুর সপক্ষে কলম ধরেছেন । তারঁ মতে, নারী শরীরকে সিকসু ‘romanticize’ করেছেন একথা বলা যায় না । কারণ ফরাসি ভাষায় ‘anatomy’ আর ‘morphology’- এর মধ্যে পার্থক্য আছে । ইংরেজিতে ‘women’ শব্দের ২টি বিশ্লেষণঃ (১) female (২) feminine । প্রথমটি বিশুদ্ধরূপে জৈব অর্থে নারীর কোনো দিককে বোঝায় যেমন- Sex । দ্বিতীয়টি সামাজিক নির্মাণ অর্থে নারীর কোনো দিককে বোঝায় যেমন- gender । প্রথমটির সাথে নিরপেক্ষতা-স্বচ্ছতা-বিজ্ঞান জড়িত । দ্বিতীয়টির সাথে মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, সমাজ, মতাদর্শ যুক্ত । অনেক ecriture feminine এর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন female writing বলে । কিন্তু ফরাসি ভাষায় ‘women’- এর একটিমাত্র বিশেষণ ‘female’ । এর অর্থ female body (anatomy) হতে পারে । আবার feminine body (social)-ও হতে পারে । সিকসু নারী শরীরের কথা ভাবেন ‘morphology’-র সাপেক্ষে । যার অর্থ সংস্কৃতিতে নারী শরীরের আকৃতি বা গঠন কীভাবে উপস্থাপিত হয়ে সেটা । একে anatomy/ socialization অর্থাৎ sex/ gender বাইনারির কোনটাতেই হ্রাস ক্রে আনা যাবে না । বরং এক মধ্যবর্তী শব্দ (Gatens: 114-5) ।

উত্তর আধুনিক নারীবাদের আর একজন বিশিষ্ট তাত্ত্বিক ক্রিস্তেভা । ‘হাল ফ্যাশনের যে প্রচলিত রীতিনীতিগুলিকে আমারা নিরাপত্তার খাতিরে আঁকড়ে ধরি, বা যে চিন্তাধারাকে যুগান্তকারী ভেবে আত্নপ্রসাদে আত্নহারা হয়ে উঠি, সেই প্রতিষ্টিত বেদ বাক্যগুলিকে অবিন্যস্ত করে চিহ্নিতের আধিপত্যকে বিপর্যস্ত করে তোলেন ক্রিস্তেভা । একবাচক (monologic) বিজ্ঞানের প্রভুত্বে, পরস্পরায়, বাধ্যতামূলক বশ্যতার মূল শিকড়ে আঘাত করেন” (চন্দনঃ ১১৩) ।

নারীবাদের তত্ত্বে তিনি এনেছেন মনঃসমীক্ষণের ধ্যান-ধারণা । সমাজে নারী লেখকদের বৈপ্লবিক সম্ভাবনাকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন । সিকসুর সঙ্গে ক্রিস্তেভার কোনো কোনো বিষয়ে ধারণাগত পার্থক্য থাকলেও একদিন থেকে তাঁরা সমমনোভাবাপন্নঃ “Female sexuality is diretly associated with poetic productiveity-with the phychosomatic drives which disrupt the tyranny of unitary meaning and logocentric (and) therefore phallogocentric discourse. The major proponents of this theory are Julia Kristeva and Helene Cixous” (Selden etc: 142) ।

“যুগ যুগান্তর ধরে নারীদের যে তত্ত্ব বা দর্শনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে, তার প্রতিকার হিসাবে দৈনন্দিন জীবন যাপনের জমিতে তত্ত্বের শিকড় প্রোথিত করার মধ্যে অতীতের ক্ষমতাশালী পুরুষ শাসিত তাত্ত্বিক জগতের আমূল বদলের সংকেত পাওয়া যায় । এই প্রক্রিয়ার প্রথম দিকেই ক্রিস্তেভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । পুরুষতান্ত্রিক, পুরুষ শাসিত বুদ্ধির জগতে যুক্তি ভিত্তিক তর্ককে চরম সীমা পর্যন্ত প্রসারিত করার যে মেয়েলি প্রকল্পে নিযুক্ত হয়ে ক্রিস্তেভা স্বাভাবিক কারণেই সব প্রতিষ্ঠিত বয়ানের বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন । তারঁ ভয় ছিল যে নারীবাদ যদি বিকল্প হিসাবে প্রতিষ্টা পায় তবে অচিরেই তা জীবনবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতাশালী নারীবাদীদের হাতের অস্ত্রে পরিণত হবে । স্থান-কাল-পাত্রবর্জিত ‘প্রভুর’ বয়ান যা, বার্থের তথাকথিত অরাজনৈতিক মিথও তাই । দুটি ক্ষেত্রেই একপক্ষ বয়ান নিয়ন্ত্রনকরে । তাকে ‘স্বাভাবিক’ বা অমোঘ ঈশ্বরপ্রদত্ত সত্যের উপস্থাপনা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে অন্য সকলকে তা মেনে নিতে বাধ্য করে এবং সেই সুবাদে কর্তৃত্ব বহাল রাখে । পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ঠিক এই কাজটিই করা সম্ভব হয়েছিল, নারীদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা, মাতৃত্ব এবং সতীত্ব সম্পর্কে নানা মিথ তৈরি করে । পুরুষতান্ত্রিক ‘প্রভুত্বের বয়ানের’ মধ্যেই নিহিত থাকে নারীর অবদমনের প্রক্রিয়া ও ইতিহাস এবং সেই অবদমনকে স্বভাবিক ও সামাজিক বলে স্বীকার করার রহস্য। ক্রিস্তেভার উদ্বেগ ছিল যে সেই একই পরিণতি নারীবাদী বয়ানের যেন না হয়।” (চন্দনঃ ১২১) ।

ক্রিস্তেভা ‘Normal’ (ordered and rational)-এর সাথে ‘poetic’ (heterogeneous and irrational)-এর সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করেছেন । একেবারে শুরুতে, শিশুর জীবন থেকে pre-Oedipal পর্যায় । একটি অসংগঠিত প্রাক-ভাষাগত পর্যায় এটি । এটি সৃষ্টি করে দেয় সেই ভিত্তিকে যা প্রাপ্তবয়স্কের পরিণত ভাষাগত কার্যকলাপের তলদেশে সক্রিয় থেকে যায় । (Seleden etc: 171-2) ।

ক্রিস্তেভার মতে, সামাজিক চুক্তি লঙ্ঘনকারীর তীব্র উল্লাস লক্ষ করা যায় শিল্পে, রীতিতে ও মিথে, যাকে তিনি একত্রিতভাবে ‘কাব্যিক ভাষা’ নাম দেন । সামাজিক চুক্তি ও রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা থেকে মুক্তির পথ দেখাতে কীভাবে এই কাব্যিক ভাষা উৎপাদন হয় তা তিনি সন্ধান করেন । তার ভাশাতাত্ত্বিক লঙ্ঘনের বিশ্লেষণ হয়ে দাঁড়ায় কাব্যিক ভাষার বিপ্লবের বিবরণ । ক্রিস্তেভা এই গতিময়তা আবিষ্কার করেন ফরাসী সাহিত্যে (মালার্মে, লত্রেমঁ) ইতালীয় রেনেসাঁস চিত্রকলায় (বলিনি, জিয়োত্তো) এবং চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব । তিনি কবিদের বিপ্লবী হিসাবে প্রমাণ করেন ।

ক্রিস্তেভার অর্থ বা মানে তত্ত্ব সংস্কৃতির লঙ্ঘনকারী উপাদানসমূহের (যেমন অচেতন, যৌনতা, নারী, শরীর...) ঐক্য ব্যাখ্যা করতে চান । তিনি মুক্তি খুঁজেছেন সংস্কৃতিতে শিশুর প্রাক-ভাষিক প্রাক-সামাজিক স্থানাঙ্ক বিশ্লেষণ করে। লাকাঁ কথিত প্রতীকী ক্রম হল যে সামাজিক চুক্তি তার অরথ-পদ্ধতির বিপরীতে শিশুর অবস্থানের বর্ণনা তৈরী করেন । অর্থের তত্ত্বকে পুংমিথ হিসাবে গণ্য করে তিনি প্রস্তাব দেন এক পাল্টা তত্ত্বের, অর্থের এক সমালোচনামূলক তত্ত্ব, যাকে তাৎপর্য বিশ্লেষণ বলা যেতে পারে ।

প্রাক-ভাষিক শিশুর অচেতন ধারণ করে প্রাথমিক চিহ্নক্ষেত্র, যা মায়ের পালনকারী শরীর ও তার স্বরকে শুদ্ধ শব্দ হিসেবে পাবার ইচ্ছা দ্বারা চালিত। ক্রিস্তেভার বিশ্বাস যে এই প্রাথমিক মাতৃতান্ত্রিক মুহূর্ত প্রভাবিত করে পিতৃতান্ত্রিক প্রতীক ক্ষেত্রে প্রবেশকে । লিঙ্গনির্বিশেষে অচেতনে এই প্রাথমিক অবস্থার খোঁজ পাওয়া যায়, যা ভাষার মাধ্যমে তথা ছন্দে, ছড়ায় ও অনান্য লক্ষণায় প্রকাশিত হয় ।

“This unorganized pre-signifying process she calls the ‘semiotic’ comes under the regulation of the logic, coherent syntax and rationality of what Kristeva, following Lacan, terms the ‘symbolic’. Entry into the ‘symbolic’ conferes identity upon subjects but its mastery over the ‘semiotic’ is never complete”(Selden etc: 172)

১৯৭০-এর দশক থেকে ফরাসী নারীবাদ প্রভাব বিস্তার করতে থাকে । তাঁদের মতে, একটি পুংলিঙ্গ কেন্দ্রিক প্রতীকী বা সিম্বলিক ব্যবস্থা (Phallocentric symbolic order) মানব জীবনের প্রতিটি দিকের গভীরে নিহিত রয়েছে, তা দমনমূলক, তা উক্ত প্রতিটি দিককেই অবদমন করে । এর বিপরীত সংস্কৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন । জুলিয়া ক্রিস্তেভার মতে, সিম্বলিতে রয়েছে ব্যাকরণের বিধি মেনে চলা । নৈরাজ্যমূলক কামনা বাসনা দমন করা । সেজন্য এইরুপ বাসনার উপর ভাষাগত রীতিনীতিকে চাপিয়ে দেওয়া হয়, সামাজিক শৃঙ্খলাকে পুনরুৎপাদন করা যায়, সিম্বলিকের বিপরীতে semiotic হল pre-Oedipal প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত । এ হল বিভাজনমূলক (Dichotomous) যথা-জীবন/ মৃত্যু । আবার একই সাথে এ হল মিশ্রধর্মী ও অসমসত্ত্ব । সামাজিকভাবে স্বী্কৃত কঠোর আদর্শমানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে Symbolic । আর স্যম্বলিকে ভেঙে দেয় Semiotic- কাব্যের মাধ্যমে, Avan-guard শিল্পকলা, মাতৃত্ব ইত্যাদির মাধ্যমে । আমাদের pre-Oedipal self বা ‘আত্না’র সাথে মিলিত হতে সে সাহায্য করে। তবে সিম্বলিক ও সিমিওটিক পরস্পর গ্রন্থিবদ্ধ । প্রথমটিতে আছে বিজ্ঞাননিষ্ঠ অনুশীলন । আর দ্বিতীয়টিতে আছে কাব্যিক অনুশীলন । বৈজ্ঞানিক অনুশীলন সিমিওটিককে অবদমন করে কিন্তু কাব্যিক অনুশীলন সিমিওটিককে প্রাধান্য দেয় (Barry: 124-30) ।

অতএব, জুলিয়া ক্রিস্তেভার মতে, ভাষার দুটি পৃথক দিক আছে । তাঁর ‘The System and the Speaking Subject’ প্রবন্ধে তিনি এ দুটিকে ব্যাখ্যা করেছেন । প্রথমত সিম্বলিক দিক (Symbolic aspect) যা কর্তৃত্ব, শৃঙ্খলা, পিতৃবর্গ দমন, নিয়ন্ত্রন ইত্যাদির সাথে জড়িত । তাঁর ভাষায়- “the family, normalcy, normative classico-psychological-tending discourse, all of which are just so many characteristics of fascist ideology” (Kristeva in Barry:128) । ভাষার এই দিকটি ধরে নেয় যে ‘আত্না’ (Self) হল অপরিবর্তনীয়, স্থির, এবং অবিমিশ্র, ঐক্যবদ্ধ, সুসংহত, সংগতিপূর্ণ (তাঁর ভাষায়- “a language with forceclosed subject or with a transcendental subject-ego” (kristeva)) । দ্বিতীয়ত সেমিওটিক দিক (Semiotic aspect) যা প্রতিসরণ (displacement), স্খলন (Slippage), ঘনীভবন (condensation) ইত্যাদির সাথে জড়িত । এদিকটি আদৌ তর্কধারা (logic) এবং শৃঙ্খলা (Order)-এর সাথে যুক্ত নয় । এটি অনেক বেশি শিথিল । এলোমেলো, অসংবদ্ধ, অসঙ্গতিপূণ, বিক্ষিপ্ত । ফলে যোগাযোগের সম্ভাব্য পথ এখানে সংখ্যায় অনেক বেশি । এর সাথে কাব্যের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ এবং তা মাতৃধর্মী । পিতৃধর্মী নয় । পিতৃধর্মী হল গদ্য রচনা। অবশ্য ধারণাগতভাবে তা মাতৃধর্মী । তার মানে এই নয় যে, পুরুষ লেখকদের মধ্যে এ ধারণাটি অনুপস্থিত। বস্তুত ভাষার যেকোনো উদাহরণেই এ দুটি দিক সর্বদা উপস্থিত। বলা যায়, সিম্বলিক হল সচেতনতার দিক আর সিমিওটিক হল অবচেতনতার দিক । লাকারঁ প্রভাব এখানে লক্ষণীয় । সিম্বলিক হল কঠোরভাবে প্রতিষ্ঠিত পৃথকীকরণ ও কাঠামোর মাধ্যমেই ভাষা কাজ করে থাকে। কাঠামোবাদীরা (যেমন-স্যসুর) এদিকটার ওপর জোর দেন । স্যসুর ‘Network of Differences’-এর কথা বলেন । কিন্তু এর বিপরীতে রয়েছে ভাষাগত অবচেতন (unconscious) । তা সর্বদাই উপস্থিত। সেখানে আছে ভাসমান চিহ্নায়কসমূহ (signifiers), খাপছাড়া ও এলোমেলো যোগাযোগ, হঠাৎ করে তাৎক্ষণিক উন্নতি, প্রায় ছুঁয়ে যাওয়া প্রকাশ, আকস্মিক, স্খলন-সবকিছুই-যা উত্তর কাঠামোবাদী ভাষাতত্ত্বে আলোচিত । দেদিদার বিনির্মাণ (deconstruction)-কে তাই কেউ কেউ বলেছেন, এ হল পাঠ্যের মধ্যে অর্থের পস্পরবিরোধী প্রবাহগুলিকে আবিষ্কার করা- “contradictory cross-currents of meaning are discovered in texts” (Berry: 129) । অর্থাৎ পাঠ্যের মধ্য-কের ‘অবচেতন’ যেন বাইরে বেরিয়ে আসছে এবং উপরিতলের ‘সচেতন’ অর্থের মধ্যে প্রবেশ করছে ও তার মসৃণ ক্রিয়াপথে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে । যুক্তির রাজ্যে, আগেকার স্থিতিশীল কাঠামোর জগতে, এ ধরণের ব্যাঘাত লক্ষ করা যাবে কবিতায়, স্বপ্নে, পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক লেখায় । এগুলি ভাষার উপরিতলের মসৃণকে ঘেঁটে দেয়। অত্যন্ত সুসংবদ্ধ, সতর্ক, সাবধানী রচনাও এরূপ এলোমেলো অসংবদ্ধ উপাদান থেকে মুক্ত থাকতে পারে না । ভাষার যেহেতু উদ্ভাবনমূলক, তাৎক্ষণিক উন্নতি তার বৈশিষ্ট, ক্রিস্তেভা বর্ণিত সিমিওটিকের রাজ্য থেকে সে কখনই বিচ্ছিন্ন হতে পারে না । ক্রিস্তেভার এই সিমিওটিক আর সিম্বলিকের ধারণা লাকাঁর ইমাজিনারি ও সিম্বলিক ধারণার দ্বারা প্রভাবিত । শিশুর প্রাক-ভাষাগত স্তরে রয়েছে ইমাজিনারি জগত । ‘আত্না’ (self)-কে অপর সব কিছু থেকে পৃথক করে বুঝতে সে তখনও সে শেখেই । অবশিষ্ট জগত থেকে শরীরকে পৃথক করে দেখার বোধ তখনও আসেনি । শিশু তখন আকাঙ্খা ও বঞ্চনা উভয় থেকে মুক্ত। সিমিওটিকের অন্তর্নিহিত চরিত্রই হল এটি রাজনৈতিকভাবে অন্তর্ঘাত ঘটায়, বদ্ধ সিম্বলিক অর্ডারকে সর্বদা ভেঙে দেবার ভয় দেখায় । ঐ সিম্বলিক অর্ডার মূর্ত রূপ ধারণ করে আছে সরকারে, সমাজ থেকে সংগৃহীত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, এ স্ট্যান্ডর্ড কোনো ভাষার ব্যাকরণের মধ্যে। কোনো কোনো নারীবাদীর চোখে, সিকসু ও ক্রিস্তেভা বর্ণিত এই ‘সিমিওটিক’ নারীর ভাষা, নারীর লেখা ও নারীর জগতের ধারণা অতি মুল্যবান । কারণ এখানে বিকল্প সম্ভাবনার কথা নারী ভাবতে সক্ষম। অন্যদিকে কিছু নারীবাদীর মতে, এর ফলে যুক্তির জগতকে পুরুষের হাতে তুলে দেওয়া হল । নারীর থাকল প্রথাগত ঐতিহ্যবাহী আবেগ, যুক্তি অতিক্রমকারী, ব্যক্তিগত অনুভূতি ও স্বজ্ঞার ক্ষেত্র (Barry: 130) । ‘বদ্ধ’ যুক্তিনিষ্ঠ ব্যবস্থা তার উন্মুক্ত ভাঙনমুখী অযোক্তিক ব্যবস্থা-এদুয়ের মধ্যে বৈপরীত্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন ক্রিস্তেভা । এটা করতে গিয়ে ১৮ শতকের এনলাইটেনমেন্টের যুক্তি কেন্দ্রিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন ।

“ইউরোপে আলোকপ্রাপ্তির যুগ যে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার জন্ম দিয়েছে, তা বিশ্বব্যাপী সামাজিক ও দার্শনিক কাঠামোর মূলে স্থিত । এই সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন প্রকাশমাধ্যমে চিহ্ন ও রূপকের আন্তঃসম্পর্কের ইতিহাসের ব্যাখ্যা করে তিনি (ক্রিস্তেভা) বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই সভ্যতা ও তার ধারক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নিহিত আছে দ্বৈত-আত্ন-পরের অন্তর্দ্বন্দ্ব, যার উপর এই সভ্যতা স্থিত এবং যার চরম প্রকাশ ঘটে পুরুষ (আত্ন) ও নারীর (অপর) বিভাজনে । যাকে তিনি irreducible বলেছেন অর্থাৎ যে আকরকে পুনরায় বিশ্লেষণ করা যায় না ।” (চন্দনঃ ১২২-৩)

বদ্ধ যুক্তি আর উন্মুক্ত অযুক্তির মাঝখানে রয়েছে কাব্য । তাই বিশ্লেষণের পক্ষে সুবিধেজনক তার অবস্থান । কাব্য মাঝেমাঝে আকাঙ্ক্ষা ও ভয়- এর প্রাথমিক অভিঘাত প্রকাশ । ঐ আকাঙ্ক্ষা ও ভয় থাকে যুক্তির শৃঙ্খলা- ব্যবস্থার বাইরে । তাই তিনি কাব্যকে বিপ্লবী বলেছেন । “সত্য অনির্বচনীয়, কারণ বাচন প্রাতিস্থানিক বয়ান ছাড়া সম্ভব নয় এবং ক্রিস্তেভার মতে, সুস্থ, স্বাভাবিক ভাষা ব্যবহার কখনই প্রতিষ্ঠানকে অতিক্রম করতে পারে না । আর স্বাভাবিকতার আসল নাম সামাজিকতা । সত্য প্রকাশ পায় একমাত্র সাহিত্যের ভাষায়, যে ভাষা সামাজিক স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষনা করে । যেমন করেছেলেন মালার্মে, যার কবিতা নিয়ে ক্রিস্তেভা গবেষণাপত্র তৈরি করেছেলেন । মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষের ভাষাই চিনিয়ে দেয় সামাজিক ভাষার ঘেরাটোপ । তাদের ভাষা ব্যবহার সামাজিক দৃষ্টিতে স্বাভাবিকের বাধ্যবাধকতা মেনে চলে না বলেই তাদের বিকৃত বলা হয় । এবং এই পুরুষশাসিত সমাজের স্বাভাবিকতা অবশ্যই পুরুষনির্ধারিত । সুতরাং ক্রিস্তেভা ভাবেন, নারী ছাড়া আর কেইবা ছুঁতে পারে সেই অনির্বচনীয় সত্য, যা সামাজিক ভাষার জালে ধরা দেয় না ?

এবং এই পার্থক্য সর্বত্র, সুতরাং এই সম্ভাবনাও সর্বব্যাপী ।... শত বাধা বঞ্চনা সত্ত্বেও সেই সব মেয়ের লিখনী তুলে নিয়ে, শব্দকে হাতিয়ার করে লিঙ্গ নির্ধারিত সামাজিক-মানসিক বাঁধন ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন । কিন্তু এসবের পরেও শেষ বিচারে কি মুক্তি এসেছিল । তাদের কবি জীবন কি সত্তাহীন থেকে সত্তা-নিমার্ণের পথে যাত্রা ?...কারণ এই সমাজে সত্তানির্মাণের নিয়ম, ভাষার নিয়মাবলীর মতই পুরুষের শাসনাধীন ? ... কিন্তু পিতৃশাসিত ভাষার ছককে ছিঁড়ে ফেলে নারীর কি গতি হয় ? কী তার ভবিষ্যৎ ? যদি নারী পিতৃতান্ত্রিক প্রতিভূর ছকের সঙ্গে একাত্ন হয়, তাহলে সে হয়ে যায় পুরুষের উত্তরণের উপকরণ । কিন্তু এই প্রতিভূর ছক, যা অবদমন করে, যা তার নিরিখে নিষিদ্ধ, যখন সেটাই হয়ে যায় নারীর প্রেরণা, তখন নারীই কি হয়ে ওঠে না চরম বিদ্রোহী, চরম নৈরাজ্যবাদী ? এই বিদ্রোহ ক্রিস্তেভার কাম্য । বারবার তিনি দেখিয়েছেন যে, প্রাতিষ্ঠানিক পুরুষতান্ত্রিক স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, তিনি তাঁর শরিক । নারীবাদী আন্দোলন যদি পুরুষতন্ত্রের বদলে নারীতন্ত্রকে কায়েম করে তাহলে তিনি নিজেকে সসরিয়ে নিবেন- এটাই স্বাভাবিক ।” (চন্দনঃ ১২৯-৩০) ।

আভাঁগার্দ সাহিত্যে ভাষার যৌক্তিক শৃঙ্খলাকে ভাঙতে চায় প্রাথমিক আবেগ । বক্তা ও পাঠকের একধর্মী বিষয়ী সত্তাকে ভাঙতে প্রয়াসী । তা বিষয়ী আর অর্থের উৎস নয় । বরং সে অর্থের ক্ষেত্র । ফলে সংগতি হারায় বিষয়ী । তার আত্নপরিচিতি মূলগতভাবে ছেত্রে যায় । ক্রিস্তেভার আগ্রহ সেখানে ।

উত্তর আধুনিক নারীবাদী মতে, ভাষা ও সংস্কৃতি স্বয়ং নারীর প্রতি দমনমূলক । কারণ তারা পুংলিঙ্গকেন্দ্রিক জ্ঞানের উপর দণ্ডায়মান (phallologocentric) । নারী সর্বদা এই ডিসকোর্সের মধ্যে কার্যকর । তাই তাদের নিজেদের কোনো ভাষা নেই । ক্রিস্তেভার মতে, আভাঁগার্দ কবিতা, অঙ্কন, মাতৃত্ব, এই সিম্বলিক পিতৃতান্ত্রিক শৃংখলা-ব্যবস্থাকে ভাঙে । সিকসুর মতে, নিজেদের শরীর দিয়ে লিখে নারীকে এই ডিসকোর্সের মধ্যে অন্তর্ঘাত করতে হবে । এই ‘অপর’ ভাষা লিখার সময়, নারী পুংলিঙ্গকেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চাকে ভাঙতে পারবে । ক্রিস্তেভার মধ্যে আছে হতাশা । সিকসুর মধ্যে আছে নারী মুক্তির আশা, যা অন্তর্ঘাতমূলক লিখার মধ্যে দিয়ে সম্ভব । লেখার মধ্যে দিয়ে নারী তার শরীরে ফিরতে পারবে বলে তাঁর বিশ্বাস । পুংলিঙ্গকেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চা এই শরীর থেকে বারীকে বঞ্চনা করছে । এবার সে ইতিহাসে প্রবেশ করবে । তাঁর ভাষায়, “By writing her self, women will return to the body which has been more confiscated from her, which has been turned into the uncanny stranger on display...” (cited in Mazumdar : 42) । সিকসুর মতে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেয়েও নারী মুক্তি হবে মানবজাতির কাছে ঢের বেশি তাৎপর্যপূর্ণ । কারণ তা প্রচলিত ক্ষমতা সম্পর্ককে ধূলিসাৎ করবে ।

উত্তর আধুনিক নারীবাদী ভাষা ও মনঃবিশ্লেষণের উপর জোর দেয় । পাশ্চত্য দর্শন যেখানে সত্যানুসন্ধনে আগ্রহী, যেভাবে তা নিশ্চয়তা খুঁজে বেড়ায়, এই নারীবাদী তার সমালোচক । কারণ বর্তমান সমাজে এরূপ সত্য ও নিশ্চয়তা অপ্রাসঙ্গিক ও অর্থহীন । বর্তমান সমাজে রয়েছে খণ্ডীকরণ, বৈচিত্র্য, অনিশ্চয়তা, বহুত্ব, ছেদ, অসঙ্গতি, ফাটল, স্ববিরোধিতা, দ্ব্যর্থবোধকতা, অস্পষ্টতা । তাই ‘নারী’ নামক কোনো অভিন্ন যৌথ সত্তার সাধারণ অভিজ্ঞতার কথা আর ভাবা যায় না । উত্তর আধুনিকরা শুধু পার্থক্য ও ভিন্নতাকেই তুলে ধরেন, তা নয়, তারা দেখান, পার্থক্য মুছে সমসত্ত্ব সত্তা নির্মাণের পেছনে কীভাবে ক্ষমতা, ভাষা, জ্ঞান, যৌনতা কাজ করে । উত্তর-কাঠামোবাদী নারীবাদে যাঁরা চরমপন্থী তাঁদের অবস্থান থেকে ভাবা হয়ে যে, ‘নারী’ একটি বাস্তব সত্তা নয় । বরং যেন ‘লেখার ফসল’ (‘writing-effect’) । ‘ecriture feminine’ সম্পর্কে Mary Jacobus বলেছেন, এটি “asserts not sexuality of the text but the textuality of sex” (cited in Selden etc : 147) । এই চিন্তাধারা লেখাকে সুনির্দিস্থভাবে ‘লিঙ্গায়িত’ (gendered) মনে করে না । কিন্তু স্থির অপরিবর্তনীয় অর্থ (meaning)-কে ভাঙতে চায় । লেখকের কর্তৃত্ববাদী (authorial) নিয়ন্ত্রণ বা সমালোচকদের নিয়ন্ত্রণ অতিক্রম করে পাথ্যবস্থুর অবাধ ক্রীড়া (textual free play)-তে উৎসাহী । এই চিন্তাধারা মানববাদ-বিরোধী, বাস্তববাদ-বিরোধী, সারবাদ-বিরোধী । এখানে রাজনৈতিক, সাংকৃতিক ও সমালোচনামূলক বিনির্মাণ গুরুত্ব পায় । সাহিত্যিক রচনার এটি পুনর্মূল্যায়ন করে । বিশ্বজনীন কোনো তত্ত্বের এটি বিরোধী । ক্ষমতা- ভাষ্য (discourse)-এর সাথে জড়িত সমস্ত অনুশীলন ও কর্মকে একটি রাজনৈতিক চরিত্র দান করে ।



বাস্তবের নারী-সমস্যাগুলি দিয়েই নারীবাদী তত্ত্ব ও আন্দোলনের সূচনা । কিন্তু ক্রমশ তা প্রসারিত হয়েছে ধারণা-নির্মাণের গভীর তলদেশে । যা ছিল সত্তাতাত্ত্বিক (ontological) সমস্যা তা হয়ে উঠেছে ক্ষমতা-ভাষ্যগত (discourse) বিশ্লেষণের জটিল ও সূক্ষ্মতম পতিসর । নারীর উপর যে অন্যায় অবিচার সমাজে চলে তার মূল যে কত গভীরে, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের প্রাথমিক প্রক্রিয়াতে, বিষয়ী, মনন ও মানস নির্মাণের আদি পর্যায়ে ।

























































গ্রন্থপঞ্জি



1. Swati Ghosh, ‘A Brief History of Feminisms’ , The Calcutta Journal of Political Studies, New Series, 2, 1-2, April 2002-March 2003. Dept. of Political Science, Calcutta University.

2. Valerie Bryson, ‘Feminism’ in Roger Eatwell and Anthony Wright, Contemporary Political Ideologies.

3. Elizabeth Gorsz, ‘Sexual Difference and the Problem of Essentialism’ in From Margins 2, 1 (February 2002)

4. Peter Barry, Beginning Theory, Manchester: Manchester University Press, 2007.

5. Immanual Kant, On History, Lews White Beck, ed., Indianapolis: Boobs-Merrild, 1963.

6. Madan Sarup, An Introductory guide to Post-structuralism and Post modernism, Wheat Shelf, Hatvester, 1988.

7. Michel Foucault, Power/Knowledge, London: Pantheon, 1980.

8. Michel Foucault, Descipline and Punish, The Birth of the Prison, London: pantheon, 1997.

9. Shefali Moitra, Feminist Thought, Kolkata: Munshiram Manoharlal, 2002.

10. Moira Gatens, Feminism and Philosophy, Bloomington: Indiana University Press, 1991.

11. শেফালী মৈত্র, নৈতিকতা ও নারীবাদ, নিউ এজ, কলকাতা, ২০০৩ ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.