নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গল্পকার

গ্রিন জোন

গল্পকার

গ্রিন জোন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গুম

০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৪০

লম্বা লম্বা পা ফেলায় তালিপ। অফিস থেকে বেরিয়েই গলিটা খুব একটা ভালো ঠেকে না তার। গলিটি চিকন আর দীর্ঘ মনে হয়। প্রতিদিন রাত ১১টার পর অফিস থেকে বেরোতে হয়। অনেক দায়িত্ব। কাজ সেরে তবেই পা বাড়াতে হয় বাসার দিকে।

অফিসের সামনের গলিটার বাম দিকে খানিকটা এগোলেই প্রধান সড়ক। সারাদিন এ সড়কে গাড়ি গিজ গিজ করে। প্রধান সড়কের পাশেরই একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। মেডিকেল শিক্ষার্থীদের হইহুল্লোড় চলে দিনভর।প্রতিদিন সকালে নাকি এখানে অনেকগুলো পরি নামে। পরি দেখতে অনেক যুবক নেমে আসে রাস্তায়। কফি হাউজে পরিগুলো ডানা মেলে।

কিন্তু রাতটা বড় অলক্ষুণে। ঢাকা শহরে একা একা পথ চলতে ইদানিং ভয় করে তালিপের। চারদিকে গুম আর হত্যার খবর। পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে অমুক রাজনৈতিক দলের অমুক নেতা গুম..শীতলক্ষ্যায় লাশ উদ্ধার..। এম এম কলেজের অমুক শিক্ষার্থী ঘরে ফেরেনি। অমুক আইনজীবী নিখোঁজ..ইত্যাদি খবর আজকাল বড় বেশি হচ্ছে।

তালিপের গা শির শির করে ওঠে। কালো পিচঢালা রাস্তা রাতের হলুদ আলোতে আরও কালো দেখাচ্ছে আজ। গাছের ছায়ারা যেন অন্ধকারে রূপ নিয়েছে। অজানা শঙ্কায় ভারি হয়ে ওঠে তালিপের চারপাশ। দ্রুত পা ফেলায় সে।

পেছনে গলিটা দূরে সরে গেছে। মেডিকেল কলেজের গা ঘেষা ফুটপাতের দোকানগুলো বস্তা দিয়ে মোড়ানো। হয়তো দোকানিরা এখন আর রাত করে দোকান খুলে রাখে না। আগেই পরিবার স্বজনদের কাছে চলে যায়। তাদের মনেও আজকাল ভয় ঢুকে গেছে। কখন কে ধরে নিয়ে যায়। কালো পোশাক পরে আবার কখন র্যাব পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যায়, সে ভয়ে সবাই কর্মস্থল থেকে আগে ভাগেই বাসায় ফিরে যায়।

পেছন দিয়ে শো-ঝকক শব্দ করে একটা কালো কার গাড়ি তালিপের গা ঘেষে চলে গেল। চমকে ওঠে তালিপ। সব চিন্তার যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায় তার। ততক্ষণে গাড়িটা বহুদূর চলে গেছে। গাড়িটির ব্যাক লাইটের আলো যেন শয়তানের চোখ মনে হচ্ছে।

জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে তালিপ। ইদানিং গাড়ি দেখলেও ওর ভয় করে। বিশেষ করে কালো গাড়ি। মনে হয় সব কালো গাড়ির মধ্যে কালো পোশাকের লোক। হ্যাচকা টানে যদি উঠিয়ে নিয়ে যায় তাহলে সেও নিখোঁজের তালিকায় পড়ে যাবে। তাকে নিয়ে খবর হবে। রাজধানীতে সাংবাদিক অপহরণ। দুটি পরিবার চিরদিনের জন্য বঞ্চিত হয়ে যাবে। কাঁদতে কাঁদতে অনেকের চোখের পানি শেষ হয়ে যাবে। তারপর হয়তো স্বাভাবিক হয়ে যাবে সব। কেবল দুনিয়ার বাতাসে হয়তো দুটি গরম নিঃশ্বাস আর পড়বে না।

রাতের আকাশে আজ মেঘ নেই। বামে মেডিকেল স্টোরটা রেখেই আরেকটি প্রধান সড়ক। ডান-বামে তাকিয়েই সড়কে পা রাখে তালিপ। পকেট থেকে মাস্কটা বের করে নেয়। বাম দিকে তাকিয়ে রাস্তাটা পার হয়ে ওপার প্রান্তে চলে যায় সে। শা-ঝাকক করে আগুনের মতো চোখ রাঙিয়ে আরেকটা গাড়ি চলে যায় চৌরাস্তার দিকে। ওই গাড়িটাও কালো। গাড়িটার মধ্যে কালো পোশাকের কেউ আছে কিনা কে জানে। চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে তালিপ। মাস্কটা পরে ফেলেছে সে। ঢেকে গেছে নাক ও মুখ।

ঢাকা শহরের ধুলাবালি থেকে রক্ষা পেতে নিয়মিত নাক-মুখে মাস্ক পরে তালিপ। এটা ইদানিং অভ্যেস হয়ে গেছে ওর। মাস্ক ছাড়া হাঁটলে এখন প্রায় দম আটকে আসে মনে হয় ওর। মাস্ক ছাড়া হাঁটলে মনে হয়, মুঠি মুঠি ধুলো নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করছে। মাস্ক পরলেই শরীরটা অনেক চাঙ্গা ভাব আসে। যেনো নতুন প্রাণ পায় শরীর।

তীব্র গরম। এই গরমে দিনে ও রাতের বেলায় শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে তালিপের। মাঝে মাঝে দুই এক পশলা বৃষ্টি ঢাকা শহরের প্রাণ বলে মনে হয়। আবার বেশি বৃষ্টি হলে সামান্যতেই রাস্তায় পানি জমে যায়। দুই দিকেই ঝামেলা।

বাসায় চারটি চোখের কথা মনে পড়ায় ঝটপট পা বাড়ায় তালিপ। রাতের আকাশ।যতদূর চোখ যায় ততদূর দেখা যায় মিটমিট করে জ্বলছে তারা। কিন্তু শহরে আকাশ দেখতে ভাল লাগে না তারা। মনে হয় শহরের আকাশে তারা থাকলেও কিসের জানি অভাব। শহরের তারাভরা আকাশ মনে ভালবাসার আবেশ জাগাতে পারে না।

আকাশে মেঘের বালাই নেই। ঝকঝকে তারাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঝলমলে তারা দেখলে তালিপের মনে পড়ে তার তিন মাস বয়সের ছেলেকে। স্ত্রীর মায়াবি চোখ দুটোও ভেসে ওঠে। দ্রুত যেতে হবে। ওরা বাসায় অপেক্ষা করছে। প্রতিদিন রাতে অফিস থেকে ফেরার কারণে ওরা উদ্বিগ্ন থাকে। সময় ভালো যাচ্ছে না। গোটা দেশে অশান্তি।

কৃষকের শান্তি নেই। ব্যবসায়ীরা মন্দার কবলে। মাছ মেলেনা বলে জেলেরা মাছ ধরা ছেড়ে দিয়েছে। উপকূলে হাহাকার। সাগরেও তেমন সুখবর নেই। সেখানেও লাশ ভেসে ওঠার খবর এখন অহরহ। এইতো সেদিনও অনলাইন পত্রিকায় বড় অক্ষরের খবর ছাপা হয়েছে- সমুদ্রে ৭ লাশ। লাশগুলোর চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। কেউ সনাক্ত করতে পারছে না..এমন কত তথ্য।

ঘড়ঘড় শব্দের তীব্রতায় ফিরে তাকায় তালিপ। ৬ নম্বর গাড়ি রাস্তায় থেমে যায়। গাড়ির শব্দে চিন্তাজগত থেকে ফিরে আসে তালিপ। বাসায় যেতে হবে। জোরে জোরে সামনের দিকে পা বাড়ায় সে।

পাশেই ৮-৯ জন পুলিশ দাঁড়িয়ে। এখন পুলিশকে আর সাহায্যকারী বলে মনে হয় না। তারা সাহায্যকারী হলেও সাধারণ মানুষ তাদের ভয় পায়। তালিপের মনে হয় এ পুলিশগুলো কারো দালালি করতে সারাদিন ব্যস্ত থাকে। রাতের বেলায় তারা রক্ষকের ভূমিকা পালন করবে তা বিশ্বাস হয় না।

পুলিশের সামনে দিয়ে মাস্ক পরে যেতেও কেমন জানি গা ছম ছম করে ওর। কি জানি পুলিশ অপরাধী হিসেবে প্রচার করে জেলে ভরে দেয়। আজকাল পুলিশে ধরলে আর রেহাই নেই। গেপ্তার বাণিজ্য জমজমাট। লাখ টাকা দিলেই ছেড়ে দেয় তারা। এভাবেই চলছে গ্রেপ্তার বাণিজ্য।

হো হো করে হেসে ওঠে একজন পুলিশ। পাশের দেয়ালে হাসির প্রতিধ্বনি বড় কর্কশ শোনায়। হাসির শব্দে তালিপের মনে হয় ওরা নিজেরাই অপরাধী। ওদের প্রতিটি পদক্ষেপ জনগণের বিরুদ্ধে। ওরা রাস্তায় রাতভর ডাকাতি করতেও পারে। পুলিশগুলোকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় তালিপ। ফিসফিস শব্দ করে পুলিশগুলো একে-অপরকে কি যেন বলছে। আরও জোরে পা ফেলায় সে। পুলিশকে অপহরণকারী মনে হয়। মনে হয় সামনে শীতলক্ষ্যা নদী। জেলেদের জালে উঠে এসেছে ছয়টি লাশ..কত কিছু..

সম্বিত ফিরে পায় তালিপ। সে পেছন ফিরে পুলিশগুলোর দিকে ফিরে তাকায়। অলস ভঙ্গিতে তারা বসে আছে। তাদের দায়িত্ব বলে কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না। ওরা গোলামীর জিঞ্জির পড়ে রাস্তায় পড়ে আছে। কিন্তু কেন গোলামী করছে? এ প্রশ্নের কোনো সংক্ষিপ্ত জবাব খুজে পায় না তালিপ। জবাবের মধ্যে অনেকগুলো নাম চলে আসে। ইতিহাস চলে আসে। রাজনীতি চলে আছে।

ওইতো একটা বাস থামলো স্ট্যান্ডে। তালিপ দ্রত পা চালায় বাসটি ধরতে হবে। কিন্তু পারল না সে। বাসটি ছেড়ে দিয়েছে। আজকে রাত হয়ে যাবে বাসায় ফিরতে। গাড়ি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। ক্রিংক্রিং মোবাইল বেজে ওঠে তালিপের। স্ক্রিনে বাংলায় দুটি অক্ষর ভেসে ওঠে ‘বউ’।

হ্যা আমি আসছি। এইতো… গাড়ি মিস করেছি। আজ তেমন কোনো গাড়ি নেই। আমি দ্রুত চলে আসছি। তুমি চিন্তা করো না। স্বামী পাগল বউয়ের কথা মনে পড়ে যায় তালিপের। গত বছর যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন বউকে যেমন দেখেছিল, বউটা ঠিক তেমনই আছে। এখনও বাসায় দেরি করে ফিরলে জড়িয়ে ধরে কেদে ওঠে।এতদিন পরও বউকে পুরোনো মনে হয় না একটুও।মনে হয় আজীবন নতুন ‘বউ’ থাকবে ও। একথা বললে ও আবার পাত্তা দেয়না মোটেও। বলে তুমি বড় মসকরা কর। তবে তালিপ বুঝতে পারে ছেলেটা জন্ম নেয়ার পরে মাতৃত্ববোধটা ওর প্রবল হয়েছে। ও মা হয়েছে।

রাস্তায় মানুষ ও গাড়ির চলাচল নেই বললেই চলে। গাড়ির অপেক্ষায় তালিপ। হেটে যেতেও বেশিক্ষণ লাগবে না। আধাঘণ্টা হাঁটলেই চলে যাওয়া যায়। কিন্তু পথঘাট আজকাল ভাল না। রাস্তায় মামারা (ছিনতাইকারী)আটকাতে পারে। বেতনের সবগুলো টাকা তালিপের কাছে। ওগুলো মামারা কেড়ে নিতে পারে। ভাগ্য খারাপ থাকলে জীবনটাও চলে যেতে পারে।

শা-ঝাক……একটা পুলিশ ভ্যানের ব্রেক কসার শব্দে সম্বিত ফিরে পায় তালিপ। পুরো গাড়িটা কালো রঙে ঢাকা। হকচকিয়ে যায় তালিপ। গাড়ির চারপাশ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে কয়েকজন অস্ত্রধারী। সবার পরনে কালো পোশাক। ইনসিগনিয়ায় জ্বলজ্বল করছে র্যাব-১৮। ভয়ে কাঠ হয়ে যায় তালিপের শরীর। কি করবে ওরা? একজন হেসে বলে ভাই কি করেন এখানে? একা দাঁড়িয়ে কেন? বাসায় যাব উত্তর দেয় তালিপ।

স্যার আসুন। আরেকজন কালো পোশাকধারী লোক ডাকছে তালিপকে। বলল, উঠুন। বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। পোশাকধারী বলল, দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। নিঃসঙ্কোচে উঠে পড়ে তালিপ। কিন্তু বিধি বাম। মালিবাগের মোড় পার হলেও গাড়ি থামেনি। ততক্ষণে তালিপ বুঝতে পারে, তার দুই চোখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়ে গেছে।
সমাপ্ত

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.