নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শেহজাদ আমান

একজন সাংবাদিক ও সমাজকর্মী

শেহজাদ আমান

একজন সাংবাদিক ও সৃষ্টিশীল লেখক

শেহজাদ আমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

কাফকা অন দ্য শোর (লেখকঃ হারুকি মুরাকামি)

০৭ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:০০



কাক নামের ছেলেটা

“টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে ফেলেছ তাহলে?” যথারীতি ওর ধীর আলস্য জড়ানো কণ্ঠে বলল কাক নামের ছেলেটা। ঘুম থেকে ওঠার পর কারও মুখে যখন জড়তা থাকে, ভারি ভারি লাগে, তখন এধরনের কণ্ঠই শুনতে পাওয়া যায়। তবে কেবলই ভান করছে ও। আসলে পুরোপুরি সজাগ ব্যাটা! যেমনটা থাকে সবসময়।
আমি মাথা ঝাঁকালাম।
“কত?”
টাকার অঙ্কটা আবার মাথায় খেলিয়ে নিলাম। “নগদে ৪০,০০০ ইয়েনের মতো। সাথে এটিএম থেকে যা পাওয়া যায়। আমি জানি তা অনেক না, তবে যথেষ্ট। এই মুহূর্তের জন্য।”
“খারাপ না,” বলল কাক নামের ছেলেটা। “এই মুহূর্তের জন্য।”
আরেকবার মাথা ঝাঁকালাম আমি।
“আমার তো মনে হয়, এটা সান্তা ক্লজের থেকে পাওয়া বড়দিনের টাকা না।”
“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ,” জবাব দিলাম আমি।
ভেংচি কেটে আরেকদিকে তাকাল কাক। “দেখতেই পাচ্ছি, তুমি রাইফ্লিং ড্রওয়ালাদের থেকে শুরুটা করবে, তাই না?”
কিছুই বললাম না আমি। ও জানে, কার টাকাটা নিয়ে আমরা কথা বলছি। তাই ঘোরানো-প্যাঁচানো জিজ্ঞাসাপর্বের দরকার নেই আর। আমাকে নিয়ে একটু খেলছে ও।
“ব্যাপার না,” বলল কাক। “এই টাকাটা আসলেই দরকার তোমার আর তুমি তা পেতেই যাচ্ছ। ভিক্ষে করে হোক, ধার করে হোক বা চুরি করেই হোক। এটা তোমার বাবার টাকা। তাই এ নিয়ে কে মাথা ঘামাবে, তাই না? কাজে নেমে পড়। তা তো তুমি করতে পারবেই। এই মুহূর্তের জন্য। কিন্তু কী হবে যদি এসবে কাজ না হয়? টাকা কোনো বনের মাশরুমের মতো না। এমনি এমনি তো আর এটা আসে না। জানোই তো! টাকার দরকার হবে খাওয়ার জন্য, ঘুমোনোর জায়গার ব্যবস্থা করার জন্য। মেলা কাজে দরকার হবে টাকা। একদিন তো হাত একেবারেই খালি হয়ে যাবে।”
“সময় আসলে দেখা যাবে,” বললাম।
“সময় আসলে দেখা যাবে,” আলতো করে আমার কথারই যেন প্রতিধ্বনি তুলল কাক সাহেব।
মাথা ঝাঁকালাম আমি।
“কোনো চাকরি পেয়ে বা এরকম কিছু করে?”
“হতে পারে,” বললাম।
মাথাটায় একটা ঝাঁকি দিল কাক। “জানো, দুনিয়া সম্পর্কে এখনো অনেক কিছু শেখার বাকি আছে তোমার! শোনো – অনেক দূরের এক জায়গায় ১৫ বছরের একটা ছেলে কী এমন কাজ খুঁজে পেতে পারে, যেখানে সে কখনো যায়ইনি? এমনকি জুনিয়র হাইস্কুলের পড়ালেখাও শেষ হয়নি তোমার! কে কাজে নেবে তোমাকে?”
গালটা একটু লাল হয়ে উঠল আমার। গাল ব্যাটা একেবারে অল্পতেই লাল হয়ে ওঠে।
“বাদ দাও,” বলল ও। “তুমি তো কেবলই শুরু করতে যাচ্ছ। এই মুহূর্তে এসব হতাশাজনক ব্যাপার তোমার উপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত হচ্ছে না আমার। কি করতে যাচ্ছ, তা তো এরমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছ। এখন স্রেফ এর গতিটা ধরে রাখা দরকার। আরে, এটা তো তোমারই জীবন। যা ঠিক বলে ভাবছ, সেটা নিয়েই তো সামনে এগোতে হবে।”
ঠিকই তো। সবকিছুর উপর এটা তো আমারই জীবন।
“তারপরও একটা কথা বলব আমি তোমাকে। এসব করতে হলে তোমাকে হতে হবে অনেক শক্তপোক্ত।”
“আমি আমার সেরা চেষ্টাটাই করছি,” বললাম।
“নিশ্চয়ই তা করছ,” কাক বলল। “গত কয়েক বছরে তুমি বেশ শক্তভাবে নিজেকে তৈরি করেছ। এই ব্যাপারে আমি একমত।”
আবার মাথা ঝাঁকালাম আমি।
“কিন্তু ভুলে যেও না – তোমার বয়স মাত্র ১৫,” কথা চালিয়ে গেল কাক। “কেবলই শুরু হয়েছে তোমার জীবন। দুনিয়ায় এমন অনেক কিছু আছে্, যা তুমি এখনো দেখোইনি। কল্পনার অতীত অনেক কিছুই হতে পারে।”
সবসময়ের মতো আমরা আমার বাবার পড়াশুনার ঘরটার পুরাতন সোফায় বসে সময় কাটাচ্ছিলাম। পড়তে পছন্দ করে কাক। বিভিন্ন জিনিস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চারপাশে। একটা মৌঁমাছি-আকৃতির পেপারওয়েট তুলে ওটা দেখছিল কাক। আমার বাবা যদি বাসায় থাকত, ওটা ভুলেও নাড়াচাড়া করে দেখতে যেত না কাক।
“তবে আমাকে এখান থেকে বেরুতে হবে,” ওকে বললাম আমি। “এছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই।”
“হ্যাঁ, আমার মনে হয় ঠিকই বলছ তুমি।” পেপারওয়েটটাকে আবার টেবিলে রেখে দিল ও। হাতদুটো রাখল মাথার পেছনে। “পালিয়ে গিয়ে সমাধান হবে না। তোমার সাথে তাল মেলাতে আমি পারব না। কিন্তু তোমার জায়গায় থাকলে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতাম না আমি। যতদূরেই দৌঁড়ে যেতে হোক না কেন! দূরে চলে যাওয়াটা কোনো সমাধান না।”
বড় করে একটা শ্বাস ফেলল কাক নামের বালক। চোখদুটো বন্ধ করে হাতদুটো চোখের উপর রাখল এরপর। যেন কথা বলতে শুরু করল একেবারে ওর ভিতর থেকে।
“আমাদের খেলাটা কেমন করে খেলব?” বলল ও।
“ঠিক আছে,” বললাম আমি। আমিও চোখদুটো বন্ধ করে গভীরভাবে শ্বাস নিলাম।
“ঠিক আছে, এক ভয়ানক মরুঝড়ের কথা কল্পনা কর,” বলল ও। “সবকিছু ঝেড়ে ফেল তোমার মাথা থেকে।”
তাই করলাম, যেমনটা ও বলল। মন থেকে সবকিছু বের করে দিলাম। এমনকি ভুলেও গেলাম আমি কে। একেবারে ফাঁকা আমি। এরপরই উপরিতলে জিনিসগুলো শুরু হতে লাগল। আমরা দুজনই আমাদের বাসার পড়ার ঘরের চামড়ার সোফায় বসে আছি। তবে, আমরা যেন আছি অন্য জগতে। কল্পনায় ভাসছিল সেই জগৎ।
কখনো কখনো নিয়তি গতিপথ বদলানো ছোটখাট কোনো মরুঝড়ের মতোই,”বলল কাক।
কখনো কখনো নিয়তি গতিপথ বদলানো কোনো মরুঝড়ের মতোই। আপনি গতিপথ বদলান। কিন্তু ঝড় ঠিকই আসে আপনার পিছুপিছু। আপনি আবারও দিক বদলান। কিন্তু ঝড় সেটার সাথে তাল মিলিয়ে নেয়। বারবার আপনাকে খেলতে হয় এই খেলা। ভোরের ঠিক আগে মৃত্যুর সাথে কোনো ভয়ঙ্কর নৃত্যের মতোই। কেন? কারণ এই ঝড় দূর থেকেই উড়িয়ে দিতে পারে আপনাকে। আপনার কিছুই করার থাকে না। এই ঝড়টা আসলে আপনি। আপনার ভিতরের কিছু। তাই একে প্রণোদনা যুগিয়েই চলতে হয় আপনাকে। ঠিক ঝড়ের ভিতরেই পা দিতে হয়। চোখ বন্ধ করে আর নাকমুখ ঢেকে, যাতে করে বালি ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। আর আপনি এর ভিতরে হেঁটে যান, ধাপে ধাপে। সেখানে নেই কোনো সূর্য, কোনো চাঁদ, কোনো পথের দিশা বা সময়ের বোধ। স্রেফ চূর্ণ করা হাড়ের মতো আকাশপানে কুণ্ডুলি পাকিয়ে ওঠা সাদা বালি। সেধরনের মরুঝড়ই আপনার কল্পনা করা দরকার।
আর ঠিক সেটাই আমি করি। কল্পনায় ভাসে, কোনো সাদা ফানেল যেন খাড়া আকশে উঠে গিয়েছে মোটা কোনো দড়ির মতোন। চোখ আরও বেশি করে বন্ধ করি। হাতদুটো দিয়ে চোখদুটোকে ঢেকে রাখি ভালোমতো। যাতে করে ভিতরে না ঢুকতে পারে বালির সুক্ষ্ম কণাগুলো। আরও কাছে আসে মরুঝড়। অনুভব করি বাতাসের চাপ যেন এসে লাগছে আমার চামড়ায়। এটা আসলেই যেন গিলে ফেলতে চাইছে আমাকে!
কাক নামের বালক ওর একটা হাত আলতো করে রাখল আমার কাঁধে। সাথে সাথেই অদৃশ্য হয়ে গেল ঝড়!
“আজকে থেকে, যা-ই হোক না কেন, তুমি হবে দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তপোক্ত ১৫ বছরের ছেলে। এই একটিমাত্র উপায়েই তুমি টিকে থাকতে পার। আর সেটা করতে হলে, তোমাকে বুঝতে হবে শক্তপোক্ত হওয়ার অর্থ কী? আমাকে অনুসরণ করছ তো?”
চোখ বন্ধ করেই রাখলাম আমি। কোনো জবাব দিলাম না। এভাবেই আমি ঘুমে ঢিলে পড়তে চাই। ওর হাতটা আমার কাঁধে নিয়েই। অনুভব করলাম ডানার নিঃশব্দ ঝাপটানিকে।
“তুমি হতে যাচ্ছ দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তপোক্ত ১৫ বছরের ছেলে,” ফিসফিসিয়ে বলল কাক, আর আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। যেন ও আমার হৃদয়ে কোনো নীল ট্যাটু খোদাই করার মতো করে গেঁথে দিয়েছে কথাগুলো।
আর সেই ভয়ানক, উপমার্থক, প্রতীকী ঝড়ের ভিতর দিয়ে যেতে হবে আপনাকে। যত উপমার্থক বা প্রতীকীই তা হোক না কেন, এই ব্যাপারে কোনো ভুল করা যাবে না। হাজারটা রেজর ব্লেডের মতো করে এটি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিবে আপনার শরীরকে। লোকজন রক্তাক্ত হবে। হবেন আপনিও। তাজা, লাল রক্ত! নিজ হাত দিয়ে স্পর্শ করবেন সেই রক্তকে। আপনার নিজের আর অন্যদের রক্তকে।
আর যখন ঝড় শেষ হবে, কেমন করে আপনি তা পেরিয়ে এসেছেন, তা মনে করতে পারবেন না। বলতে পারবেন না কেমন করে টিকে গেলেন এই দূরন্ত ঝঞ্ঝার ভিতরেও। এমনকি আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন না যে ঝড়টা আসলেই শেষ হয়েছে কিনা। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত! ঝড়টা পেরিয়ে আসার পর আগের সেই একই মানুষটা আর থাকবেন না আপনি। এই ঝড়ের মোজেজা এটাই!
আমার পনেরোতম জন্মদিনে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব। যাত্রা করব দূরের এক শহরে আর এক ছোট্ট লাইব্রেরির এক কোণায় বসবাস করব। সবকিছু ঠিকমতো ঠাহর করতে সপ্তাহখানেক সময় নেব আমি।
এটাকে খানিকটা রুপকথার গল্প বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, কোনো রুপকথার গল্প নয় এটি। আপনি যতই একে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে দেখতে যান না কেন! এটাই নিদারুন বাস্তবতা!



বাসা ছেড়ে যাওয়ার সময় বাবার পড়াশোনার রুম থেকে কেবল নগদ টাকাই নিলাম না আমি। নিলাম ছোট্ট একটা সোনার লাইটারও। দারুণ লাগে এর ডিজাইনটা। হাতে নিলে লাগে অন্যরম একটা অনুভূতি। আর নিলাম ভাঁজ করে রাখা যায় এমন একটা ধারালো ফলার ছুঁরি। এটা তৈরি করা হয়েছে হরিণের চামড়া ছাড়ানোর জন্য। ফলাটা এর পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। হাতলটাও দারুণ। মনে হয় দেশের বাইরের কোনো ভ্রমণের সময় এটা কিনেছিলেন তিনি। ড্রয়ার থেকে নিলাম লম্বা, উজ্জ্বল আলো দিতে পারে এমন একটা পকেট টর্চ। পাশাপাশি, আমার বয়সটাকে ঢেকে দেওয়ার জন্য একটা আকাশী-নীল রেভো সানগ্লাস। এটা পড়লে আমাকে একটু ব্যাটাছেলে-ব্যাটাছেলেই লাগবে!
বাবার প্রিয় সি ওইস্টার রোলেক্স ঘড়িটাও নেব কিনা ভাবছিলাম। সুন্দর একটা ঘড়ি এটা। কিন্তু চোখ ধাঁধানো কিছু কেবলই মানুষের নজরে পড়ে যায়। একটা স্টপওয়াচ ও অ্যালার্মযুক্ত সস্তা প্লাস্টিকের ক্যাসিও ঘড়িই আসলে যথেষ্ট। আর কাজও করবে ভালো। তাই অবহেলে ঘড়িটা আবার রেখে দিলাম ড্রয়ারে।
আমার আর আমার বড়বোনের ছবিটা নিলাম আরেকটা ড্রয়ারের পেছন থেকে। আমাদের ছোটবেলার ছবি। আমাদের দুজনই সৈকতে দাঁড়িয়েছিলাম। হাসছিলাম দাঁত বের করে। আমার বোনের সাইড ফেসটাই অবশ্য দেখা যাচ্ছে। ওর মুখের অর্ধেক অংশটাই ছায়ায় ঢাকা। তাই ওর হাসিমুখের অর্ধেকটাই দেখা যাচ্ছে। যেন পাঠ্যবইয়ে দেখা কোনো গ্রিক ট্র্যাজেডির মুখোশের মতো, যার অর্ধেকটায় থাকে একটা আইডিয়া এবং বাকি অর্ধেকটায় এর বিপরীত কিছু। আলো এবং আঁধার। আশা ও হতাশা। বিশ্বাস ও একাকিত্ব। আমি অবশ্য সরাসরিই তাকিয়ে ক্যামেরার দিকে, নির্ভয়ে। সৈকতে আর কেউ ছিল না। বোন আর আমার, দুজনের পরনেই স্যুইমস্যুট। ওর পরনে ফুলফুল ডিজাইনের পুরো একটা লম্বা স্যুট। আমার পরনে পুরনো স্টাইলের বেগি জাঙ্গিয়া। একটা প্লাস্টিকের কাঠি ধরা আমার হাতে। আমাদের পায়ে আছড়ে পড়ছে সাদা রঙয়ের ফেনিল ঢেউ।
কে, কখন তুলেছিল এই ছবিটা, সেই ব্যাপারে ধারণা নেই আমার। কেমন করে আমাকে এত সুখী সুখী দেখাচ্ছিল? কেন বাবা কেবল এই একটা ছবিই রেখে দিয়েছিল? পুরো ব্যাপারটাই একটা রহস্য। আমার বয়স ছিল তিন, বোনের নয়। আমাদের মধ্যে কি ভালো ছিল সম্পর্কটা? ওদের সাথে কোথাও যাওয়ার স্মৃতি নেই আমার মনে। যাই হোক, আমি ছবিটাকে বাবার এখানে ফেলে যেতে পারি না। তাই, ওটাকে আমার ওয়ালেটে ঢুকিয়ে দিলাম। মায়ের কোনো ছবি নেই আমার কাছে। সেগুলো সবই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল বাবা।
কিছুক্ষণ ভাবার পর মোবাইল ফোনটা সাথে নেব বলে ঠিক করলাম। বাবা যদি বুঝতে পারে আমি ওটা আমার সাথে নিয়েছি, তাহলে সে হয়তো মোবাইল ফোন কোম্পানিকে ওটার লাইন কেটে দিতে বলবে। অ্যাডাপ্টারের সাথে ওটা ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে একবার দোলা দিলাম। খুব একটা ভারি তো হয়নি এখনও। কাজেই নেব না কেন? যখন এটা আর কাজ করবে না, তখন না হয় ফেলে দেব।
কেবল জরুরী জিনিসগুলোই নেব। কোন কাপড়টা নেব, তা বাছা বেশ কঠিনই। কয়েকটা সোয়েটার আর একজোড়া আন্ডারওয়্যার দরকার হবে আমার। কিন্তু শার্ট ও ট্রাউজারের বেলায় কি করব? হাতমোজা, স্কার্ফ, শর্টস, একটা কোট? যেন এসবের শেষ নেই। যদিও একটা জিনিস আমি জানি। কোনো অপরিচিত জায়গায় আমি বিশাল এক ব্যাকপ্যাক কাঁধে ঝুঁলিয়ে পথ চলতে পারব না, যেটা চিৎকার করে বলবে, ‘হ্যালো ভাইসব, দেখুন আমি পালিয়ে এসেছি!’ ওটা করলে লোকের চোখে পড়ে যাব। এরপরেই, পুলিশ আমাকে তাড়া করে পাকড়াও করবে আর সোজা পাঠিয়ে দেবে বাড়িতে। যদি না আমি কোনো গ্যাংয়ের সাথে জড়িয়ে যাই।
বাইরে ঠান্ডা। তাই উষ্ণ একটা জায়গা বেছে নিতে হবে আমার। তাহলে আমি কোট আর হাতমোজাটাকে রেখে যেতে পারি। নিতে চাইলে নিতে পারি আমার কাপড়-চোপড়ের অর্ধেকটা। সহজেই ধুয়ে পরা যায় এমন কাপড়ই বেছে নিলাম। একেবারে হালকাগুলো। সুন্দর করে ভাঁজ করে ওগুলোকে ঢুকিয়ে রাখলাম ব্যাপপ্যাকে। তিন মৌসুমেই ব্যবহার করা যায়, এমন একটা স্লিপিং ব্যাগও প্যাক করলাম। যা কিনা সহজেই রোল করা ও চেপেচুপে রাখা যায়। এছাড়াও নিলাম তেল-সাবান, একটা রেইন পাঞ্চো, নোটবুক, একটা কলম, একটা ওয়াকম্যান আর দশটা ডিস্ক। গান তো শুনতেই হবে! তাই একটা খুচরো রিচার্জেবল ব্যাটারিও নিলাম। এই তো সব! রান্নাবান্নার জন্য কোনো হাড়ি-পাতিল নেওয়ার দরকার নেই। ওসব অনেক ভারী, জায়গাও নেয় প্রচুর। খাবার তো আমি বাইরের দোকান থেকেই কিনতে পারব।
একটু সময় নিলাম, তবে আমার তালিকা থেকে অনেক কিছুই বাদ দিতে হলো। আমি কিছু জিনিস যোগ করি, পরে কেটে দিই সেগুলোকে। এরপর আবার অনেক জিনিস যোগ করি, আবার কেটেও দেই।
আমার পনেরোতম জন্মদিনই বাড়ি থেকে পালানোর জন্য আদর্শ সময়। দেরি হলে আমি সুযোগটা হারিয়ে ফেলব।
জুনিয়র হাইস্কুলে আমার প্রথম দুই বছরে আমি কাজ করেছি, প্রশিক্ষণ নিয়েছি আজকের এই দিনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে। গ্রেড স্কুলের প্রথম কয়েক বছরে জুডোর চর্চা শুরু করেছিলাম আমি। এখনো মাঝে মাঝে জুনিয়র হাইস্কুলে যাই। তবে কোনো স্কুল দলে যোগ দেইনি। যখনি সময় পেতাম স্কুলের মাঠে জগিং করতাম। সাঁতার কাটতাম বা স্থানীয় জিমে যেতাম। আমাকে ফ্রিতে শেখাত সেখানকার তরুণ প্রশিক্ষকরা। দেখাত কিভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে স্ট্রেচিং ব্যায়াম করা যায়, কিভাবে ব্যবহার করা যায় ফিটনেসের যন্ত্রপাতিগুলো। কোন পেশিগুলো আমরা প্রতিদিন ব্যবহার করি, কোনটা যন্ত্রের মাধ্যমে তৈরি করা যায়, সেটাই শিখিয়েছিল তারা। এমনকি সঠিক উপায়ে বেঞ্চ প্রেস করার পদ্ধতিটাও। শুরু করতে খুবই উৎসাহী ছিলাম আমি। আর এইসকল ব্যায়ামের মাধ্যমে চওড়া কাঁধ ও প্যাক বানাতে পেরেছিলাম।
জিমের প্রশিক্ষক আর আমাদের বাসায় প্রতিদিন আসা হাউসকিপার বাদে অন্য কারো সাথে খুব একটা কথা বলতাম না। স্কুলেও বলতাম ততটুকুই, যতটুকু না বললেই নয়। দীর্ঘ সময় ধরে বাবা আর আমি একে অন্যের সাথে দেখা করা থেকে বিরত ছিলাম। একই ছাদের তলায় থাকলেও আমাদের স্কেজিউল ছিল একেবারেই আলাদা। অনেক দূরে তার স্টুডিওতে বেশিরভাগ সময় কাটাত সে। তাকে এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন বেঁচে যেতাম আমি।
যে স্কুলে আমি যাচ্ছিলাম, ওটা একটা বেসরকারি জুনিয়র হাই স্কুল। এমন বাচ্চাদের জন্য, যারা উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। কোনো সমস্যা না হলে সবাইই স্বয়ংক্রিয়ভাবে একই ক্যাম্পাসের হাই স্কুলে উত্তীর্ণ হয়। সব ছাত্রছাত্রীই এখানে পরিপাটি করে জামা-কাপড় পরে স্কুলে আসে। দাঁতগুলোও যেন ওদের ঝকঝকে-চকমকে, আর সবাইকেই আমার কাছে লাগে চরম বিরক্তিকর। স্বাভাবিকভাবেই আমার কোনো বন্ধু নেই। আমার চারিদিকে তুলে দিয়েছি একটা দেয়াল। আমার ভিতরে-বাইরে কারও বিচরণ করে দিয়েছি বন্ধ। এরকম কাউকে কে পছন্দ করবে? আমাকে কেবল দূর থেকেই দেখে ওরা। ওরা আমাকে ঘৃণা করতে পারে, এমনকি পেতে পারে ভয়ও। কিন্তু তারা যে আমাকে বিরক্ত করছে না, সেজন্যই আমি খুশি। স্কুল লাইব্রেরির বই পড়তে আমার অবসরটাকে কাজে লাগানোসহ করার মতো টনকে টন কাজ আছে আমার।
(প্রথম দশ পেজের অনুবাদ)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:১২

রাজীব নুর বলেছেন: আর একটু নরমভাবে অনুবাদ করুন।

০৭ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:১৬

শেহজাদ আমান বলেছেন: নরম করেই অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি আমি! তারপরও যদি... :)

২| ০৭ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৪৪

নেওয়াজ আলি বলেছেন: নন্দিত উপস্থাপন ।

০৭ ই মার্চ, ২০২০ রাত ৯:২০

শেহজাদ আমান বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই! ভালো থাকবেন! :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.