নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শেহজাদ আমান

একজন সাংবাদিক ও সমাজকর্মী

শেহজাদ আমান

একজন সাংবাদিক ও সৃষ্টিশীল লেখক

শেহজাদ আমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

কাফকা অন দ্য শোর (হারুকি মুরাকামি)- অনুবাদের চতুর্থ ভাগ

২৬ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১০:২১




যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি ইন্টেলিজেন্স সেকশনের প্রতিবেদন
তারিখঃ মে ১২, ১৯৪৬
শিরোনামঃ রাইস ব্রাউন হিল ইনসিডেন্ট, ১৯৯৪-এর উপর প্রতিবেদন
ডকুমেন্ট নাম্বারঃ পিটিওয়াইএক্স-৭২২-৮৯৩৬৭৪৫-৪২২১৬-ডব্লিউডব্লিউএন
নিচের সাক্ষাৎকারটি ডঃ জুইচি নাকাজাওয়ার (৫৩)। সে একটা ইন্তারনাল মেডিসিন ক্লিনিক চালায় [নাম মুছে দেওয়া হয়েছে] শহরে ঘটনাটির সময়। সাক্ষাৎকারটির সাথে থাকা জিনিসপত্র পাওয়া যেতে পারে অ্যাপ্লিকেশন নাম্বার পিটিওয়াইএক্স-৭২২-এস্কিউ-১৬২ থেকে ১৮৩ ব্যবহার করে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকর্তা লেফটেনেন্ট রবার্ট ও’কনরের অভিমতঃ ডঃ নাকাজাওয়া লম্বা-চওড়া, গাড়-ত্বকের একজন মানুষ। ডাক্তারের চেয়ে তাকে ফার্মের ফোরম্যান বলেই মনে হয়। শান্ত স্বভাবের এই লোক খুবই সংক্ষিপ্তভাবে তার চিন্তাভাবনা প্রকাশ করে। চশমার আড়ালে প্রখর দৃষ্টিশক্তির অধিকারী এই ব্যক্তির স্মরণশক্তিও নির্ভরযোগ্য।

ঘটনাটা প্রথমে কিভাবে জেনেছিলেন আপনি? শুনে কী করেছিলেন?

হ্যাঁ, ১৯৪৪-এর নভেম্বরের ৭ তারিখে, সকাল ১১টায়, স্থানীয় এলিমেন্টারি স্কুলের সহকারী অধ্যাপকের কাছ থেকে একটা ফোনকল পেলাম। স্কুলের ডাক্তার হিসেবেই কাজ করতাম আমি। তাই প্রথমেই তারা যোগাযোগ করল আমার সাথে।
খুবই আপসেট ছিল সহকারী অধ্যাপক সাহেব। সে জানাল, মাশরুম তোলার জন্য পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে পুরো একটা ক্লাসের ছাত্রছাত্রী গিয়েছে অজ্ঞান হয়ে। তার মতে, সবাইই- অচেতন। কেবল দায়িত্বে থাকা শিক্ষকই চেতন ছিল। সে দৌড়ে স্কুলে এসেছে সাহায্যের জন্য। এত উত্তেজিত ছিল সে যে তার কথা থেকে আসল ব্যাপারটা ধরতে পারিনি আমি। কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার। বনের মধ্যে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল ১৬টা বাচ্চাই।

মাশরুম তুলতে গিয়েছিল বাচ্চারা। তাই প্রথমেই আমি ভাবলাম, কোনো বিষাক্ত মাশরুম খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে ওরা। তাই হয়ে থাকলে চিকিৎসা দেয়াটা হবে কঠিন। বিভিন্ন ধরনের মাশরুমের বিষের ক্ষমতা বিভিন্ন রকম। তাই চিকিৎসাপদ্ধতিও আলাদা আলাদা। এই মুহূর্তে বেশি হলে আমরা ওদের পাকস্থলি ওয়াশ করতে পারি। যদি বিষ উচ্চমাত্রার হয় আর রক্তে মিশে গিয়ে থাকে, তাহলে হয়তো বেশি দেরিই করে ফেলেছি আমরা। এই অঞ্চলে বিষাক্ত মাশরুম খেয়ে মারা যায় অনেকেই।

জরুরী মেডিকেল কিট খুব একটা নেই আমার আমার ব্যাগে। তাই সাইকেলে চড়ে দ্রুত স্কুলে চলে আসলাম। ব্যাপারটা জানানো হয়েছিল পুলিশকেও। দুজন পুলিশ ইতোমধ্যে চলে গিয়েছে ওখানে। জানতাম, অচেতন বাচ্চাদের শহরে নিয়ে আসতে হবে। তাই সব রকমের সাহায্য দরকার ছিল আমাদের। অবশ্য বেশিরভাগ তরুণই এখন যুদ্ধক্ষেত্রে। আমাদের হাতে থাকা সেরা উপায়গুলিই কাজে লাগাতে হবে। আছি শুধু আমি, দুজন পুলিশ, বয়স্ক একজন পুরুষ শিক্ষক, অধ্যক্ষ ও সহকারি অধ্যক্ষ, স্কুলের তত্ত্বাবধায়ক, আর বাচ্চাদের সাথে থাকা সেই শিক্ষিকা। কাছে থাকা সব বাইসাইকেল নিয়ে আসলাম। কিন্তু সেগুলোও যথেষ্ট ছিল না সবার জন্য। তাই কোনো কোনো বাইসাইকেলে দুজন করেও উঠলাম।

কখন ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলেন আপনারা?

১১ঃ৫৫’র সময়। মনে আছে ওখানে পৌঁছেই হাতঘড়িতে সময়টা দেখেছিলাম। সাইকেলে চড়ে পাহাড়ের প্রান্তদেশে পৌঁছলাম। যতটা দ্রুত সম্ভব। এর পর পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিলাম বাকিটা পথ।

ওখানে পৌঁছে দেখলাম চেতনা ফিরে পেয়েছে বাচ্চাদের কয়েকজন। সম্ভবত তিন বা চারজন। তবে পুরোপুরি চেতন নয়। একটু ঘোর লাগা ভাব ছিল ওদের মধ্যে। বাকি বাচ্চারা তখনও অচেতন। কিছুক্ষণ পরে, সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল আরও কয়েকজন। বড়সড় অনেকগুলো কীরার মতো মোচরাচ্ছিল ওদের শরীর। খুবই অদ্ভুত দৃশ্য। যেভাবে বাচ্চারা খোলা, সমতল জায়গায় লুটিয়ে পড়েছিল, দেখে মনে হচ্ছিল গাছ কেটে ফেলে রাখা হয়েছে ওভাবে। মাটিতে পড়ে রয়েছে ষোলোজন এলিমেন্টারি স্কুল্পড়ুয়া। ওদের কেউ নড়ছে, আবার কেউ পুরোপুরি স্থির। পুরো ব্যাপারটাকে আমার কাছে লেগেছিল কোনো আজব কিন্তু নান্দনিক খেলার মতোই।

আমি যে ওখানে হাজির বাচ্চাদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য, কিছু সময়ের জন্য তা হারিয়ে গেল আমার মাথা থেকেই। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম ঘটনাস্থলে। শুধু আমার নয়, উদ্ধারকারী দলের সবারই প্রতিক্রিয়া ছিল একইরকম। তবে, এরকম দৃশ্য দেখতে চাইবে না কেউই। যুদ্ধ চলছিল। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি প্রস্তুত ছিলাম সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য। মনে হচ্ছিল দেশের কোথাও না কোথাও মুখোমুখি হতে হবে আজব দৃশ্যপটের।যদি পরিস্থিতি দাবি করে, তাহলে জাপানের একজন নাগরিক হিসেবে আমি ঠাণ্ডা মাথায় আমার দায়িত্বটা পালন করতেই প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু বনের মধ্যে এই দৃশ্য দেখে আমি যেন একেবারেই জমে গিয়েছিলাম।

তবে দ্রুতই এই অবস্থা কাটিয়ে উঠলাম। তুলে নিলাম বাচ্চাদের একজনকে, একটা বাচ্চা মেয়েকে। মনে হচ্ছিল না ওর শরীরে কোনো বল আছে। ছেড়া কোনো কাপড়ের পুতুলের মতোই লাগছে ওকে। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক, তবে তখনও অচেতন ও। চোখদুটো খোলা, তবে চোখের মণি ঘুরছিল এদিক-ওদিক। ব্যাগ থেকে একটা ফ্ল্যাশলাইট বের করে ওর চোখে আলো মারলাম। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না চোখে। তবে চোখদুটো সক্রিয়, দেখছে একটা কিছুকে। আরো কয়েকটা বাচ্চাকে তুলে পরীক্ষা করলাম। ওদের সবার একই অবস্থা। অসাড়। খুবই আচানক পরিস্থিতি!

ওদের শরীরের তাপমাত্রা আর নাড়ি পরীক্ষা করলাম এরপর। নাড়ির গতি ৫০ থেকে ৫৫। তাপমাত্রা ৯৭-এর একটু নিচে। ওই বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে নাড়ির এই গতি স্বাভাবিকের অনেক নিচে। শরীরের তাপমাত্রা গড়পড়তার চেয়ে এক ডিগ্রি বেশি। ওদের নিঃশ্বাস পরীক্ষা করে দেখয়াল। কিন্তু সেটা স্বাভাবিকই ছিল। তেমনটাই ছিল ওদের ঠোঁট আর জিব।

সাথে সাথেই নিশ্চিত হলাম যে এসকল কিছুই খাদ্যে বিষক্রিয়ার লক্ষণ না। বমিও করেনি ওদের কেউ, আর দেখে মনে হচ্ছে না পানিশূন্যতায়ও ভুগছে। অভিব্যক্তিতে নেই ব্যাথার চিহ্নও। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম যে খাদ্য বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়নি ওরা। কিন্তু হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম এর পরপরই। কারণ বুঝতে পারছিলাম যে আসলে সমস্যাটা কি।

লক্ষণগুলো সানস্ট্রোকের কাছাকাছি। এই গ্রীষ্মে এরকম বেশ কিছু বাচ্চাই এতে আক্রান্ত হয়েছে। মনে হচ্ছে এটা সংক্রামিত একটা ব্যাপার – একজন ভেঙ্গে পড়েছে, তো ওর দেখাদেখি ভেঙ্গে পড়েছে বাকিরা। কিন্তু সময়টা তো এখন নভেম্বর। বনের পরিবেশ ঠাণ্ডা। একজন বা দুজনের সানস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া একটা ব্যাপার, কিন্তু ১৬ জন ছাত্র একসাথে...সম্ভব নয় এরকমটা হওয়া।

এরপরে মাথায় আসলো কোনো ধরনের বিষাক্ত গ্যাস বা নার্ভ গ্যাসের কথা। তা প্রাকৃতিক বা মানব-সৃষ্ট, যাই হোক না কেন! কিন্তু দেশের প্রত্যন্ত এই অঞ্চলের বনের মধ্যে সেরকম গ্যাসের উপস্থিতি কেমন করে সম্ভব? এটাকেও তাই দায়ী মনে হলো না। সেদিন যা দেখেছি, তাতে বিষাক্ত গ্যাসের সংযুক্ততাকে যৌক্তিক মনে হতে পারে। সবাই হয়তো ওতেই আক্রান্ত হয়ে একের পর এক লুটিয়ে পড়েছে। শিক্ষিকা এতে আক্রান্ত হয়নি, এর কারণ হয়তো একজন প্রাপ্তবয়ষককে প্রভাবিত করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না গ্যাসটা।

তবে, বাচ্চাদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে একেবারে হতবুদ্ধিই হয়ে গিয়েছিলাম আমি। স্রেফ এক গ্রাম্য ডাক্তার আমি। বিষাক্ত গ্যাসের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ গান নেই আমার। তাই বুঝতে পারছিলাম না কি করব। শহরের থেকে অনেকটাই দূরে আমরা। তাই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ডাকারও সুযোগ কম। খুব ধীরে ধীরে অবশ্য বাচ্চাদের কয়েকজন ঠিক হয়ে যাচ্ছিল। ধারণা করলাম, কিছু সময়ের মধ্যেই চেতনা ফিরে আসবে সবারই। হতে পারেই আমি বেশিই আশাবাদী ছিলাম আমি, তবে সেটা ছাড়া ওই মুহূর্তে করার কিছু ছিল না আমার। তাই আমি পরামর্হস দিলাম, ওদেরকে ওখানে কিছুক্ষণ ভালো করে শুইয়ে রাখা হোক। তারপর দেখা যাক, কি হয়।

বাতাসে কি অস্বাভাবিক কিছু ছিল?

আমি নিজেও চিন্তিত ছিলাম সেটা নিয়ে। তাই গভীর করে শ্বাস নিয়ে বোঝার চেশটা করতেছিলা যে ওরকম অদ্ভুত কিছু আছে কিনা বাতাসে। কিন্তু বনের সোঁদা মাটি আর গাছপালার একটা গন্ধ ছাড়া আর কিছুই পাইনি। সেখানকার গাছপালা আর ফুলের ভিতরও ছিল না অস্বাভাবিক কিছু। বদলে যায়নি কোনো কিছুর রঙ বা ক্যাশে হয়েও যায়নি কোনো কিছু।

বাচ্চারা যে মাশরুমগুলো তুলছিল, এক এক করে পরীক্ষা করে দেখলাম সেগুলকেও। খুব বেশি মাশরুম সেখানে ছিল না। যেটা থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে এগুলো তোলার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। সেগুলোর সবগুলোই ছিল খাওয়ার উপযোগী মাশরুম। ডাক্তার হিসেবে সেখানে বেশ কিছুদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বিভিন্ন ধরনের মাশরুমের ব্যাপারে ভালোই জানতাম। তবে নিজেকে সেফ রাখতে আমি ওগুলোর সবগুলো জরো করলাম পরে বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করানোর জন্য। যতটুকু আমি বলতে পারি, ওগুলর সবগুলোই ছিল বাগানের খাদ্য উপযোগী মাশরুমের মতোই।


আপনি বললেন যে অচেতন বাচ্চাদের চোখগুলো এদিক থেকে অদিক ঘুরছিল। আর কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ বা প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েছিল আপনার? যেমন, ওদের চোখের মণির আকৃতি, চোখের সাদা অংশের রঙ, পলক ফেলার গতি?

না। সার্চলাইটের মতো ঘোরা ওদের চোখ ছাড়া অন্যকিছুই ছিল না স্বাভাবিকের বাইরে। অন্য সব শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া ছিল স্বাভাবিক। কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে ছিল বাচ্চারা। আরো ভালো করে বললে, এমন কিছুর দিকে তাকিয়ে ছিল ওরা যা আমরা দেখতে পাইনি, কিন্তু দেখতে পেয়েছিল ওরা। মনে হচ্ছিল কোনো কিছু সাধারণভাবে দেখার বদলে পর্যবেক্ষণ করছিল ওরা। দেখলে মনে হবে ওরা অভিব্যক্তিহীন, কিন্তু মোটের উপর শান্তই ছিল ওরা। ভীত বা ব্যাথায় কাতর ছিল না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওদের মাটিতে শুইয়ে দিয়ে তারিপর দেখা যে কি হয়।

কেউ কি বলেছিল যে বাচ্চারা গ্যাসে আক্রান্ত?

হ্যাঁ, তারা বলেছিল। কিন্তু তারা বুঝতে পারছিল না যে কেমন করে এটা হয়েছে। কারণ এভাবে বনে গিয়ে গ্যাসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার কথা শোনেনি কেউই। সহকারী অধ্যক্ষ মন্তব্য করেছিল যে ওরা আমেরিকানদের ছোঁড়া গ্যাসের শিকার। তারা নিশ্চয় বিশাক্ত গ্যাসে ভরা বোমা ছুঁড়ে মেরেছে, বলেছিল সে। হোমরুম শিক্ষিকা স্বরণ করল, পাহাড়ে ওঠার আগে আকাশে বি-২৯-এর মতো একটা কিছুকে দেখার ব্যাপারটা। একেবারে ঠিক মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল ওটা। হ্যাঁ, তাই। সবাই বলছিল, নতুন ধরনের বিষাক্ত বোমা ছুঁড়ে মেরেছে আমেরিকানরা। আমেরিকানরা যে নতুন ধরনের বোমা তৈরি করছে, সেই ব্যাপারে গুজব পৌঁছে গিয়েছিল বনের প্রান্তের জনপদেও। কিন্তু এরকম আজাইরা জায়গায় কেন বোমা ফেলবে আমেরিকানরা? সেটার ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি আমরা। কিন্তু ভুল জীবনেরই অংশ। আর কিছু বিষয় হয়তো বোঝার ক্ষমতাই থাকে না আমাদের।

এরপর কী আপনাআপনিই ধীরে ধীরে ভালো হয়ে গেল বাচ্চারা?

হ্যাঁ, তাই হয়েছিল। বোঝাতে পারব না, তখন কেমন স্বস্তি অনুভব করেছিলাম আমরা। প্রথমে একটু মোচড় খেল ওদের শরীরটা। এরপর উঠে বসল অস্থিরভাবে। ধীরে ধীরে ফিরে পেল চেতনা। এই ব্যাপারে কষ্ট পাওয়ার কথা জানায়নি ওদের কেউ। প্রক্রিয়াটা ছিল খুব শান্ত, যেন স্রেফ গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠছে ওরা। চেতনা ফিরে পেলে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল ওদের চোখের নড়াচড়া। ওদের চোখে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেললে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াই দেখাল ওরা। ঘুম থেকে উঠে কথা বলতে যেমন সামান্য সময় লাগে, সেরকমটাই করল ওরা।

প্রতিটা বাচ্চাকেই জিজ্ঞাসা করা হলো যে গয়েছে কি। কিন্তু সবাই এমনভাবে তাকাল যেন কিছুই হয়নি, এমন ব্যাপারে আমরা জিজ্ঞাসা করেছি। পাহাড়ে উঠতে উঠতে মাশরুম তুলছিল – এটুকুই বলতে পারল ওরা। এরপর আর কিছু বলতে পারে না ওরা। এরপর কত সময় পার হয়েছে, সে সম্পর্কেও ধারণা নেই ওদের। ওরা মাশরুম তুলছিল, তখনই অন্ধকারের একটা পর্দা ওদের সামনে চলে এসেছিল। তারপরই দেখল, ওরা মাটিতে শুয়ে আর চারিদিকে ঘিরে আছে প্রাপ্তবয়ষ্করা। এমনকি ওরা বুঝতেও পারছে না কেন আমরা আপসেট। ওদের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে আমাদের তাকিয়ে থাকতে দেখে উল্টো ভয়ই যেন পেয়ে গেল বেচারারা!

দুঃখজনক ব্যাপার হলো বাচ্চাদের একজন, নাকাতা নামের একটা ছেলে জ্ঞান ফিরে পায়নি। টোকিও থেকে আসা ছেলেদের একজন ও। হালকা-পাতলা এক ছোট্ট বালকটি শুয়েই ছিল মাটিতে। চোখ ঘুরতে থাকল আগের মতোই। বয়ে নিয়ে পাহাড় থেকে ওকে নামিয়ে আনলাম আমরা। অন্য ছেলেমেয়েরা এমনভাবে পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে আসলো যেন হয়নি কিছুই।

নাকাতা ছাড়া অন্য কোনো ছেলেমেয়েদের ভিতর কী পরে কোনোরকম লক্ষণ দেখা গিয়েছিল?

না, কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখায়নি ওরা। কেউ বলেনি যে কষ্ট লাগতছে বা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। স্কুলে এসেই বাচ্চাদের এক এক করে নার্সের রুমে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। তাপমাত্রা মাপলাম, স্টেথোস্কোপ দিয়ে হৃদযন্ত্রের গতি মাপলাম, পরীক্ষা করে দেখলাম দৃষ্টিশক্তি। যা যা করা সম্ভব ছিল তখন করলাম তা-ই। কিছু সহজ অঙ্ক করিয়ে নিলাম। চোখ বন্ধ করে একপায়ে দাঁড়াতে বললাম। শারীরিক দিক থেকে ভালোই ছিল ওরা। খুব বেশি ক্লান্তও মনে হলো না। তবে, লাঞ্চ করতে পারেনি ওরা। তাই সবাইই ছিল বেশ ক্ষুধার্ত। ওদেরকে রাইস বল দেওয়া মাত্র খেতে লাগল গপাগপ।

কয়েকটা দিন পরে, স্কুলে আসলাম দেখতে যে ছেলেমেয়েদের বর্তমান অবস্থাটা কী। ওদের কয়েকজনকে নার্সের রুমে ডেকে কিছু প্রশ্ন করলাম। তবে, এবারও সবকিছুকে মনে হলো ঠিকঠাক। ওই আজব অভিজ্ঞতার কোনো চিহ্নমাত্র যেন অবশিষ্ট নেই। না শারীরিকভাবে, না মানসিকভাবে। এমনকি ওরা মনে করতেও পারে না যে সব ঘটেছিল। ঘটনার প্রভাবের বাইরে থেকে স্বাভাবিকভাবেই চলছে ওদের জীবন। যথারীতি ওরা ক্লাস করে, গান গায়, বিরতির সময় বাইরে খেলে সময় কাটায়। যেমনটা করে আর আট-দশটা স্বাভাবিক বাচ্চা। কিন্তু ওদের হোমরুম শিক্ষিকার অবস্থাটাই বরং আলাদা। মনে হলো সে কাটিয়ে উঠতে পারেনি ধাক্কাটা।

তবে, নাকাতা নামের সেই বালক তখনও ফিরে পায়নি জ্ঞান। তাই পরেরদিন ওকে নিয়ে যাওয়া হলো কোফুতে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে। এরপর, স্থানান্তরিত করা হয় এক সামরিক হাসপাতালে। আর শহরে ফিরে আসেনি ও। কি হয়েছিল ওর তা জানতে পারিনি আমি।

ঘটনাটা সংবাদপত্রেও যায়নি। কর্তৃপক্ষ হয়তো ভেবেছিল, এতে শুধু অস্থিরতাই বাড়বে। তাই এই ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল তারা। আপনাকে মনে রাখতে হবে, যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী সব ধরনের ভিত্তিহীন গুজবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। ওদিকে যুদ্ধ চলছিল তুমুলগতিতে। দক্ষিণ ফ্রন্টে পিছিয়ে এসেছিল সেনাবাহিনী, একের পর এক ঘটছিল আত্মঘাতী হামলা, শহরের উপর বিমান হামলা ধারণ করছিল ভয়ঙ্কর রুপ। জনগনের মধ্যে যুদ্ধ-বিরোধী বা শান্তিকামী মনোভাবকে ভয় পেত সেনাবাহিনী। ঘটনার কয়েকদিন পর তারা এসে আমাদের সাবধান করে দিয়ে গেল যেকোনো পরিস্থিতিতে এই ব্যাপারে মুখ না খুলতে।
পুরো ব্যাপারটাই ছিল এক আজব, বেদনাদায়ক ঘটনা। এমনকি আজকের দিনেও, এটি ভারী করে দেয় আমার মনকে।


মন্তব্য ১০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১০:৫১

ঠাকুরমাহমুদ বলেছেন:




হারুকি মুরাকামির অনুবাদ বেশ ভালো হয়েছে আমি প্রথম থেকে সবগুলো পর্ব পড়বো, সাথেই্ আছি।
ধন্যবাদ।

২৬ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:০০

শেহজাদ আমান বলেছেন: ধন্যবাদ! অন্যান্য অনুবাদের ফাঁকে ফাঁকে এটা অনুবাদ করছি। এবছরই এটার বাংলা অনুবাদ বই পাবেন। এর আগে ব্লগে যতটুকু পারি দিয়ে যাব! :)

২| ২৬ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:৫৮

ঠাকুরমাহমুদ বলেছেন:




উক্ত বিষয়ে আপনার লেখালেখির আগ্রহ দেখে বলছি: এসপিওনাজ সংক্রান্ত বিষয়গুলো অনুবাদ, গল্প, উপন্যাস সহ আলোচনায় সাবধান থাকবেন কারণ বিশ্বের সকল দেশের এসপিওনাজ ঘটনাগুলো প্রায় এক। লিখবেন জাপান নিয়ে মিলে যাবে বাংলাদেশের সাথে। - আশা করি বুঝতে পারছেন। আপনার লেখালেখির হাত ভালো। ধন্যবাদ।।




২৭ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১:২২

শেহজাদ আমান বলেছেন: পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ! পাশেই থাককেন, আশা করছি!

৩| ২৭ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১:০৮

ব্লগার_প্রান্ত বলেছেন: খুবই ইন্টারেস্টিং!
পরের পর্ব দিন।

২৭ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১:২২

শেহজাদ আমান বলেছেন: ধন্যবাদ! দেব, দুই-একদিন পরই! :)

৪| ২৭ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১:৪৯

নেওয়াজ আলি বলেছেন: Excellent

২৭ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১:২৩

শেহজাদ আমান বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই! :)

৫| ২৭ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১:৫১

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর।

২৭ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১:২৩

শেহজাদ আমান বলেছেন: ধন্যবাদ রাজীব ভাই! ফেসবুকে আপনাকে অ্যাড দিয়েছি। একসেপ্ট কইরেন! :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.