নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খাপ খোলা কলমে শাণিত হোক মঞ্চ...

কূপমন্ডূক

জানা ভালো, না জানা খারাপ, ভুল জানা অপরাধ

কূপমন্ডূক › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষবাষ্প

১৫ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ৮:৪০

“হুজুগে বাঙালি” বলে আমাদের একটা বেশ ভালো রকমের খ্যাতিই আছে। যেকোনো কিছু শুনলেই আমরা বিশ্বাস করে ফেলি, কোনোকিছু বিচার বিবেচনা না করেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমরা যেন বিশ্বাস করার জন্যেই ওঁত পেতে বসে আছি সবসময়। যাই বলা হোক না কেন, আমরা তা অবশ্যই বিশ্বাস করবো। এ বিষয়টা মারাত্মক। আমাদের আরেকটা মারাত্মক স্বভাব হচ্ছে, আমরা ভীষণ আবেগী। যেকোনো কিছু আমরা মস্তিষ্ক দিয়ে বিচার করার আগেই আবেগ দিয়ে বিচার করে ফেলি। অনেকক্ষেত্রেই, যে বিচার ভুল ফলাফল নিয়ে আসে।

“অন্তর্জাল” আমাদের এ হুজুগে বিষয়গুলোকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে, ছড়িয়েছে ভিন্ন দ্যোতনা। এ কারণেই হয়তো ফটোশপ করে মিয়ানমারের ভূমিকম্পে মৃতদের ছবিকে ৫ই মে’র শাপলা চত্বরের “হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে মৃত মানুষ” এর ছবি বলে চালিয়ে দেয়া হয়। আমরাও কোনোকিছু না ভেবেচিন্তে তা বিশ্বাসও করে ফেলি। আবহমানকাল ধরেই হুজুগ, গুজব, রটনা জাতীয় বিষয়গুলোকে বাঙালি বেশ পছন্দ করে, উপভোগ করে, তৃপ্তি পায়। সময়-অসময়ে অজস্র সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়েছে এ হুজুগ, গুজব। ভবিষ্যতেও ছড়াবে, নিশ্চয়তা দেয়াই যায়।

আমরা বোধহয় চরম প্রতিক্রিয়াশীলও। আমাদের প্রতিক্রিয়াশীলতার পালেও জোর হাওয়া দিয়েছে ভার্চুয়াল জগত। আমরা সাকিব-আল-হাসানের সস্ত্রীক ছবি দেখলে উত্তেজিত হয়ে যাই। “সাকিবের বৌ কেন টাইট জিন্স পরে, শাড়ি পরলেও মাথায় কেন কাপড় দিলোনা” আমাদের তা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। তামিমের বৌ কেন পর্দা করেনা, নাসিরের কেন এত গার্লফ্রেন্ড, এ কেন ঐটা করেনা, ও কেন এটা করেনা... ভার্চুয়াল জগতে আমরা সবাই প্রতিক্রিয়াশীল, সবাই বিচারক। ‘আমরা সবাই রাজা, আমাদেরই রাজার রাজত্বে’ গানটা বোধহয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কথা ভেবেই লেখা হয়েছিলো।

সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্টের এক বিখ্যাত বিচারকের এক সেমিনারে গিয়েছিলাম। সঙ্গত কারণেই তাঁর নাম উল্লেখ করা যাচ্ছেনা। তিনি জানালেন, আমাদের চরম প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ বা খুব আবেগী বিষয়গুলো অনেক সময় বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে, বিচারকদের অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। কীভাবে? কীভাবে, সেটাই এখন বলছি।

সাম্প্রতিক একটা ইস্যু নিয়ে কথা বলি। বনানীর “রেইন ট্রি” তে দুটি মেয়েকে যে ধর্ষণ করা হলো, সেটা মিডিয়ায় আসার সাথেসাথেই আমরা বলে ফেললাম, “ধর্ষকদের ফাঁসি চাই।“ যদিও সময় যত গড়িয়েছে, আস্তে আস্তে অনেক তথ্যপ্রমাণ এসেছে, এখন আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি, বনানীর ঘটনায় ভিকটিম দুই মেয়ের অভিযোগ সত্য। কিন্তু, প্রথম অবস্থায় আমরা কিন্তু জানতাম না, মেয়ে দুটি সত্য বলছে কী না। এমনও তো হতে পারতো, মেয়ে দুটি ছেলেদুটিকে ফাঁসানোর জন্যেই মিথ্যা অভিযোগ এনেছে। হতেও তো পারতো? দুপক্ষের কথা না শুনে আমরা কীভাবে একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলি? সিদ্ধান্ত দেয়ার আমরাই বা কে? একজন লোক আসামী না অপরাধী, সেটা কোর্টকে বিচার করতে দিন। আপনি, আমি কেন জলঘোলা করে যাচ্ছি নিয়মিত অনলাইনে? এবং অন্য কাউকে সে ঘোলাজলে মাছ শিকার করতে দিচ্ছি? কোনোকিছু আমাদের মনমত না হলে আমরা তা কেন যেন মেনেও নিতে পারিনা। নির্বাচনে কেউ হারলে “এখানে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে” বলে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাওয়ার ট্রেডিশন তো সর্বজনবিদিত। কারো বিচারের রায় পছন্দ না হলে “ব্যাটায় ঘুষ খাইছে” বলে রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করি। ডাক্তারের শতচেষ্টার পরেও কেউ মারা গেলে “ডাক্তার ভুল চিকিৎসা করেছে” বলে ডাক্তারকে আমরা কী কী করি, সেটা আর নাই বা লিখলাম। সবই তো জানেন...

আমরা এমন আবেগী জাতি যারা হুমায়ূন আহমেদের নাটক “কোথাও কেউ নেই” এর কেন্দ্রীয় চরিত্র “বাকের ভাই”কে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছিলাম। এই একটি ঘটনাই আমাদের বাড়াবাড়ি রকমের “আবেগ”কে খুব স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলে। আমাদের এই আবেগের পারদের ক্রমবর্ধমান উর্ধ্বগতি বিচারকদের বিচারব্যবস্থাকে বিব্রত করে, তাদেরকেও বিব্রত করে।

ধরুন, আমি একটা খুন করেছি। কিন্তু, পরবর্তীতে আমার অনুসারীরা এ খুনকে ধামাচাপা দেয়ার জন্যে এমন নাটক সাজিয়েছে, যে পুরো দেশের মানুষ আবেগের অত্যাচারে আক্রান্ত হয়ে আমার পক্ষে চলে এসেছে। আমার অবস্থা তখন অনেকটা বাকের ভাইয়ের মত। আমার কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে... টাইপের অবস্থা। এ অবস্থায় আমার মামলা কোর্টে উঠেছে। আমার বিচারটা বিচারকেরা কী স্বাভাবিকভাবে করতে পারবে? দিনশেষে, তারাও রক্তমাংসের মানুষ। ডাক্তারদের সাথে আজকাল কী আচরণ হচ্ছে, আমরা কী দেখছিনা? কোনো রোগী হাসপাতালে আনার পরে মারা গেলেই আমরা হাসপাতাল ভাংচুর করছি, ডাক্তারকে পেটাচ্ছি, রক্তাক্ত করছি। বিচারকেরা এগুলো দেখছেন নিয়মিতই। আমাদের আবেগ, আমাদের চরম প্রতিক্রিয়াশীলতা তাদের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যে সবসময়ই ওঁত পেতে আছে, তারাও ভুগছেন তীব্র অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে।

একটা হাস্যকর ব্যাপার প্রায়শই লক্ষ্য করি অনলাইনে। যেকোনো অপরাধের জন্যেই আমরা ফাঁসি চাই। ও খুন করেছে, ফাঁসি চাই। ও ধর্ষণ করেছে, ফাঁসি চাই। ও অর্থ-লোপাট করেছে, ফাঁসি চাই। রুবেল ক্যাচ মিস করেছে, তারও ফাঁসি চাই। আমরা জানিই না, কোন অপরাধের জন্যে কোন শাস্তির বিধান রয়েছে এ দেশে। যে অপরাধই হোক না কেন, পাজামার ফিতে থেকে পুকুর চুরি... সব শাস্তির একটাই বিধান, ফাঁসি। আমাদের এ মহামারী “ফাঁসি” রোগের জন্যে বাংলা সিনেমার আদালতের রায়ের দৃশ্যগুলো দায়ী কী না, সে নিয়ে হয়তো গবেষণা করাই যায়। আগ্রহীরা ভেবে দেখতে পারেন বিষয়টা। কেউ কাউকে কিছু নিয়ে অভিযোগ করলেই হলো, যাচাই-বাছাই না করে, দুপক্ষের মন্তব্য না শুনেই আমরা সবাইকে গনহারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিই। অদ্ভুত, উদ্ভট, বিস্ময়কর রকমের সব কার্যকলাপ আমাদের।

অনলাইনে আমরা সবাই বিশেষজ্ঞও আজকাল। যে লোক কোনোদিন মাঠে গিয়ে একবার ক্রিকেট ব্যাট ছুঁয়েও দেখেনি, সেও ফেসবুকে এসে ক্রিকেটারের ব্যাটিং টেকনিক নিয়ে সমালোচনায় আগুন ঝরায়। যে লোক বেতনের চেয়ে ঘুষের টাকা পায় বেশি, সেও অনলাইনে এসে সততার গল্প শেখায়। মিথ্যেবাদী লোকটি ভার্চুয়াল এরেনায় এসে সবাইকে সত্যবাদী হওয়ার শিক্ষা দেয়... কিবোর্ড, মেগাবাইট আমাদের পরিণত করে একেকজন মহাপুরুষে, সুপার হিউম্যানে। বাস্তবের জমিনে এলেই বোঝা যায়, আমরা কে কেমন।

প্রতিক্রিয়া থাকা খারাপ না। কার্জন হলে জিন্নাহ’র “রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে”কে থোড়াই কেয়ার করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেছিলো কিন্তু বাঙ্গালীর প্রতিক্রিয়াই। অথচ, এই আবেগী, প্রতিক্রিয়াশীল বাঙালীদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়ে আমরা কী করছি? কেন করছি?

আমাদের এ ভুলগুলোর জবাবদিহিতা অবশ্যই আমাদেরই করতে হবে। আমরা ভুল খাতে, ভুল স্রোতে বইয়ে দিয়েছি আবেগ আর প্রতিক্রিয়াশীলতার নৌকা। বেলাশেষে, এ ভুল বিশাল কোনো ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসে কী না পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে, সেটাই এখন ভাববার বিষয়। সেটাই এখন দেখবার বিষয়...

© শুভ সরকার Shuvo Sarkar

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.