নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যাচ্ছেতাই

সিদ্দিকী শিপলু

সিদ্দিকী শিপলু

সিদ্দিকী শিপলু › বিস্তারিত পোস্টঃ

মা এর জন্য

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৪০

২০০৪-০৫ দিকের ঘটনা।
আই ই আর ক্যাম্পাসে। দুপুর আড়াইটা তিনটার দিকে হবে। ক্লাসমেটরা প্রায় সবাই বাস ধরেছে। আমি একা ডিপার্টমেন্টে পরের ‘‘উল্লাস” বাসটা ধরবো বলে ওয়েট করছি। ডিপার্টমেন্ট মোটামোটি জনশূন্য। ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর পিছন দিক দিয়ে টং দোকানে যাওয়া যেত। তো আমি সেদিক দিয়ে টং দোকানে চা খাওয়ার জন্য যাচ্ছিলাম। বিল্ডিং থেকে মাটিতে নামার কয়েকধাপের একটা সিড়ি আছে। সেই সিড়ি দিয়ে নীচে নামার সময় অল্প সাউন্ডে গুংগিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনলাম। অবাক হয়ে এদিক ওদিক খুজতে থাকলাম। দেখি বিল্ডিং এর পিছন দিকে একটা ছেলে উপুড় হয়ে শুয়ে গুংগিয়ে গুংগিয়ে হেঁচকি দিতে দিতে কাদঁছে।
ঐদিকে সাধারণত কেউ যায় না। এরকম জায়গায় কাউকে কাদঁতে দেখে খুব অবাক হলাম। ডাক দিয়ে ছেলেটাকে বসালাম। লম্বা হলেও বয়স ১৪/১৫ এর বেশী হবে না। ছেলেটার দু চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি বয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে কাদঁছে বুঝা গেলো।কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। কিছু বলছে না, শুধু কাদঁছে। কোমল গলায় বারবার জিজ্ঞাসা করলাম কয়েকবার, শান্ত হতে বললাম। কিছুক্ষণ পর কান্না থামালো আর চুপচাপ বসে থাকলো।
আরো কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসা করার পর জানলাম, তার বাড়ি বরিশালে, বাবা তাদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো না-কি মরে গিয়েছিলো সেটা মনে নাই এখন, তবে তার মা পরে আরেকটা বিয়ে করেছিলো। সেও তার মায়ের সাথেই থাকতো। তার সৎভাই-বোনও আছে। তার সৎবাবা তাকে বছরখানেক আগে ঢাকায় এসে ইনকাম করে টাকা পাঠাতে বলাতে সে ঢাকায় এসে একটা হোটেলে থালাবাসন ধোয়ার কাজ করতো। কিন্তু যে ইনকাম করতো সেই টাকা থেকে জমানোর বা বাড়িতে টাকা পাঠানোর অবস্থা ছিলো না। কিন্তু গত দিন বাড়ি থেকে একজন এসে ওকে জানাইছে যে, তার সৎবাপ তার মাকে অনেক মারধোর করে, মারের চোটে মা অসুস্থ হয়ে গেছে, কিন্তু সৎবাপ তার মায়ের চিকিৎসার জন্য এক টাকার ঔষধও কিনে দেয় নাই। আর বাড়ি থেকে আসা লোকটাকে দিয়ে ছেলেটার কাছে খবর পাঠাইছে যে, ছেলেটা যদি টাকা না পাঠায় তাহলে তার মাকে মেরে ফেলবে।…. এসব কথা বলে ছেলেটা মা, মাগো, আমার মারে মাইরা ফেলবে বলে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।
গ্রামের থেকে আসা লোকটার কাছে এসব শুনে সে কি করবে বুঝতে না পেরে এলোমেলো ভাবে হাঁটতে হাঁটতে এদিকে চলে এসেছে, আর বিল্ডিং এর পিছনে শুয়ে মায়ের জন্য কান্না করছিলো।
স্বাভাবিকভাবেই মায়ের কারণে কান্না দেখে আমার চোখেও পানি চলে এসেছিলো। বললাম, তো তুই চলে যাচ্ছিস না কেনো? জানালো যে বরিশাল যেতে তার টাকা লাগবে না। লঞ্চের চেকাররা খুব ভালো মানুষ, গরীব দেখলে লঞ্চের নীচে কোথায় যেনো লুকিয়ে নিয়ে যায়, টাকা নেয় না। কিন্তু তার হাতে কোন টাকা নাই।অন্তত ঔষধ কেনার টাকাটা যদি তার কাছে থাকতো তাহলে সে বাড়ি চলে যেয়ে মাকে ঔষধ কেনার টাকাটা দিতে পারতো। আর বাড়ি যেয়ে তার সৎবাবাকে ঘুষি মারবে।
মনটা খুব আদ্র হয়ে গেলো, মায়ের জন্য কান্না কি কারো সহ্য হয়? কিন্তু এসবতো মিথ্যাও হতে পারে। যদিও তার কান্নার ধরণ দেখে, নির্জন জায়গায় কান্না করতে দেখে, কোন সাহায্য না চাইতে দেখে আমার মনে বিশ্বাস জন্মেছিলো ছেলেটার প্রতি।
পকেটে তেমন টাকা ছিলো না। যতটুকু মনে পড়ে দুইশ টাকার বেশী ছিলো না। পুরোটাই দিয়ে দিলাম ছেলেটাকে, আর অন্তত ৪/৫ বার ওয়াদা করালাম যে মায়ের নামে মিথ্যা বললে ধ্বংস হয়ে যাবি, মিথ্যা বলবি না, আর টাকাটা মায়ের হাতেই দিবি। সেও ওয়াদা করলো। এরপর সে চলে গেলো, আজকেই বরিশাল চলে যাবে। পিছনের মাঠ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে যাচ্ছে। মনটা খারাপ হয়ে গেছিলো। নারী নির্যাতন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে, সামাজিকভাবেই হোক বা রাষ্ট্রীয়ভাবেই বলি, নির্যাতিত নারীদের অধিকাংশই সবার চোখ এড়িয়ে যায় বা অবহেলার শিকার হয়। কিন্তু ঐসবের চেয়ে আমার মনকে বিষন্ন করেছিলো ছেলেটার মাতৃভক্তি, আসলে মাতৃভক্তি কি-না কে জানে, আসলে অসহায় মায়ের জন্য সন্তানের এই হাউমাউ কান্নাই আমাকে খুব বিষন্ন করেছিলো। ভুলতে পারছিলাম না। এমনকি পরের দিনও সারাক্ষণ এই বিষয়টা আমাকে খুব বিষন্ন করে রেখেছিলো।
মনে আছে, পরেরদিন সকাল ১০/১১ টার দিকে হবে হয়তো, মলচত্বরের মাঝের রাস্তাটা দিয়ে এমাথা ওমাথা একা একা হাঁটছি আর আগেরদিনের ছেলেটাকে নিয়ে ভাবছি। ভাবছি, ছেলেটা হয়তো এতক্ষণে তার মায়ের কাছে চলে গিয়েছে, তার মায়ের হাতে হয়তো টাকাটা দিয়ে বলেছে, মাগো, এই টাকাটা দিয়ে ঔষধ কিনিও। ভাবছিলাম, তার সৎবাবার সাথে কি সে কোন গ্যাঞ্জাম করেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
হঠাৎ শুনলাম আইইআর এর মলচত্বরের দিকের গেইট থেকে একটা ছেলে স্যার স্যার বলে চিৎকার করে ডেকে হাসতে হাসতে আমার দিকে দৌড়ে আসছে। কাছাকাছি আসতে আসতে চেহারা স্পষ্ট হচ্ছিল, দেখলাম কালকের সেই ছেলেটা। আমি প্রথমে হতবম্ব হলাম, তারপর রাগে হাত-পা কাঁপতে লাগলো। এতো রাগ অনেকদিন হইনি। ছেলেটা তখনও কাছে এসে পৌঁছায়নি, খুব জোরে একটা ধমক লাগিয়ে বললাম, তুই এখানে? তুই বাড়ি যাসনি? রাগে আমার হাত মুঠ হয়ে ছিলো, মন চাচ্ছিল একটা ঘুষি মেরে আগে মাটিতে ফেলে দেই। আমার এতক্ষণের মানসিক তৃপ্তিটাকে সে একমুহুর্তে মাটিতে নামিয়ে এনেছে। আমার ধমকে ছেলেটা দাড়িয়ে পড়লো। এবার আমি তার দিকে এগিয়ে যেয়ে ধমকিয়ে বললাম, তুই বাড়ি যাসনি কেনো?
ছেলেটা হাসতে হাসতে বললো, স্যার কালকে আপনি যে টাকা দিয়েছেন সেটা দিয়ে আমি গতকালকে মাটির ঢেলা দিয়ে জুয়া খেলে ৫০০ টাকা জিতেছি। (মাটির ঢেলা দিয়ে কিভাবে জুয়া খেলে আমি জানি না)
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, অপমানে, হতবম্বে আমার মুখ হা হয়ে গেছিলো, বললাম, ‘‘তোর মায়ের ঔষধের জন্য দেয়া টাকা দিয়ে তুই জুয়া খেলছস?’’ এরপর ধমক দিয়ে প্রায় চিৎকার দিয়ে বললাম “তুই ঐ টাকা দিয়ে জুয়া খেলছস?” এরপর ছেলেটার চোখে পানি দেখলাম, চোখ মুছতে মুছতে বললো, “ঐ ২০০ টাকা দিয়ে কিছুই হইতো না, স্যার। আমি আজকে ঐ ৭০০ টাকা নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি” এবার খেয়াল করে দেখলাম তার হাতে ছোট্ট একটা পুটলী। আবার বললো “যাওয়ার আগে ভাবলাম আপনার সাথে একবার দেখা করে যাই। ঐ বিল্ডিং এ আমি অনেকক্ষণ ঘুরেছি, আপনাকে পাইনি। এখন আপনার সাথে দেখা হইছে, এখন লঞ্চ ধরবো।’’
জুয়া বা এই ধরণের অবৈধ ইনকামের প্রতি আমার চিরদিনরই ঘৃণা। কিন্তু এই মুহুর্তে আমার কিইবা করার আছে? আসলেইতো ঐ ২০০ টাকা দিয়ে তো তেমন কিছুই হতো না। ছেলেটা আমাকে এসব না বললেই হত। কিন্তু কেনো যে আবার আমার কাছে এসে এসব বলতে গেলো, বুঝলাম না। তবে এই ঘটনাটা আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিলো যে সে আসলেই তার মায়ের কাছে টাকাটা নিয়ে দিবে।
মুখটা থমথমে করে বললাম, যা তাড়াতাড়ি বাড়ি যেয়ে মায়ের হাতে টাকাটা দিস, নয়তো অভিশাপ পড়বে তোর উপর।
অবাক-হতবম্ব আমাকে পিছনে রেখে ছেলেটা ছোট্ট একটা পুটলি হাতে মলচত্বর থেকে বের হয়ে গেলো।

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:৪৪

মোঃ কবির হোসেন বলেছেন: লেখাটা চমতকার। ভালো লাগলো।

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:৫৬

সিদ্দিকী শিপলু বলেছেন: ধন্যবাদ

২| ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:১৭

তারেক_মাহমুদ বলেছেন: সত্যি ভাল লাগলো

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:৫৬

সিদ্দিকী শিপলু বলেছেন: ধন্যবাদ

৩| ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:২২

গরল বলেছেন: ছেলেটার কাহিনী বিশ্বাসযোগ্যই মনে হচ্ছে, যাই হোক এরকম একটা ্উপকার করার জন্য আপনাকে সাধুবাদ জানাই।

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:৫৭

সিদ্দিকী শিপলু বলেছেন: ছেলেটার কাহিনী আমার কাছেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিলো। ধন্যবাদ

৪| ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৫২

তারেক ফাহিম বলেছেন: পড়লাম

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:৫৮

সিদ্দিকী শিপলু বলেছেন: পড়ার অন্য ধন্যবাদ

৫| ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:০১

বিচার মানি তালগাছ আমার বলেছেন: জীবনে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়, যার কোন হিসাব মেলানো যায় না...

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:৫৮

সিদ্দিকী শিপলু বলেছেন: ঠিক তাই। ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.