নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যাচ্ছেতাই

সিদ্দিকী শিপলু

সিদ্দিকী শিপলু

সিদ্দিকী শিপলু › বিস্তারিত পোস্টঃ

অদ্ভুৎ সীট দখল

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৩:৫৫

১৬ /১৭ বছর আগের ঘটনা

ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, বাসা যাত্রাবাড়িতে, তাই হলে উঠার চিন্তা কখনই করিনি। অনেকগুলো লাল বাস এই এরিয়া দিয়ে যায়, কখনও "উল্লাস" বা কখনও "ঈশাখা" এভাবেই ভার্সিটিতে যাতায়াত। "আনন্দ" আর "মৈত্রী" সৎ ভাইয়ের মত আচরণ করলেও কোন সমস্যা হত না।

একসময় মনে হল ভার্সিটিতে পড়ে গেলাম, কিন্তু হল লাইফের মজাই পেলাম না, তাই কি হয়? এটাচ ছিলাম জসিমউদ্দিন এ। তো কাকে যেন ধরলাম, বললাম আমাকে একটা সীটের ব্যবস্থা করে দিতে। সে আমাকে একজনের কাছে নিয়ে গেল। জসীম উদ্দিনের ৫ তলায়।
বারান্দার এক কিনারে একজন হ্যাংলা পাতলা নেতাজী বসে ছিলেন। যিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি নেতাজীর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নেতাকে একটা সীটের ব্যবস্থা করে দিতে অনুরোধ করলেন। নেতাজী নিজের চেহারার সাথে অমানানসই ভাবে গলায় গাম্ভীর্য এনে জিজ্ঞাসা করল "তুমি ......... (রাজনৈতিক দলের নাম) কর?"
আমি চুপ করে রইলাম।
আবার একই প্রশ্ন করল নেতা।
আমি আবার চুপ করে রইলাম।
বুঝল, আমিতো ভাবলাম বলবে সীট পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, " ঠিক আছে দিচ্ছি, তবে একটা শর্ত আছে, নেক্সট হল নির্বাচনে আমি যে পোস্টে দাঁড়াব , সেই পোস্টে আমাকে ভোট দিবে। রাজী?"
আমি সানন্দে হাসিমুখে মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
আমি বললাম " তাহলে ভাইয়া কবে উঠবো?"
নেতাজী উত্তরে বললেন, " কবে উঠবে মানে? আজই উঠো, এখনী, সীটের অনেক ক্রাইসিস, এখনই দখল না করলে সীট বেদখল হয়ে যাবে, তাই এক্ষুনী সীটে উঠে পড়ো।"
আমি বেয়াক্কেল হয়ে গেলাম, উনি আমাকে টানতে টানতে রুমটাতে নিয়ে গেলেন।এর আগে বিভিন্ন বন্ধুদের রুমে আড্ডা মারতে বা কার্ড খেলতে গেছি, রাতও কাটাইছি, কিন্তু এই রুমটা ভিন্ন রকমের, পরিচ্ছন্ন রুম, চারটা সিংগেল বেড। কিন্তু প্রত্যেকটা বেডে দুইজনকে থাকে। বারান্দার দিকে একটা পরিপাটি করে গোছানো (কোন ছেলের বেড এতটা পরিচ্ছন্ন আর গোছালো রুম আমি দেখিনি) বেড দেখিয়ে বললো এটাই তোমার সীট। ঐ সীটে একজন সিনিয়র থাকেন, আমাকে তার সাথে ডাবলিং করতে হবে। জানতাম এরকমই হবে, খুব সিনিয়র বা পাওয়ারফুল না হলে সিংগেল বেডে থাকা একটা অবাস্তব স্বপ্ন। মেনে নিলাম।
কিন্তু এইসময় রুমের অন্য কেউ একজন জানালো যে, এই সীটে অলরেডী একজনকে অন্য এক নেতা বরাদ্দ দিছে, ছেলেটা উঠেছেও। এটা শুনে আমার নেতাজী তাচ্ছিল্যের ভংগীতে বললেন, "আরে কে কাকে উঠাবে এখানে, এই ফ্লোর আমার নিয়ন্ত্রনাধীন। এখানে অন্য কারো নেতাগীরী চলবে না। আমি যাকে উঠাবো সেই উঠবে। ঐ ছেলেকে বল এই রুম ছেড়ে অন্য কোন রুমে সীট নিতে। "
যে ছেলেটাকে উঠানো হয়েছে সে তখন রুমে ছিলো না, ক্লাসে অথবা অন্য কোথাও হয়ত গেছে।
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে নেতাজী বললেন " তুমি এখানে শুয়ে থাকো, ঐ ছেলে আসলে বলবে আমি বলেছি অন্য সীটে যেতে। "
আমি ভাবলাম নেতাজী যখন বলেছে, তাও আবার ইনি ফ্লোর নেতা, সেহেতু এখানেই ঝামেলা মিটে গেছে।
আমি সীটে বসে রইলাম, আর ফ্লোর নেতা আর তার সাংগপাংগরা চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর সেই ছেলেটা আসলো, দেখেই বুঝলাম গ্রাম থেকে আসা, কৃষ্ণ বর্ণ, দেখতে সাধাসিধে হলেও সুঠামদেহী, নতুন ভর্তী হয়েছে, সাহস তখনও ভর করে নাই।আর সেই তুলনায় আমিতো ছিলাম হ্যাংলা পাতলা, ভীরু। ভাবলাম মারামারি লাগলে পালাইতে হবে।
ছেলেটা এসে এসব দেখে প্রথমে কাইকুই করলো," একেমন কথা, এটা ঠিক না" রাগারাগিও করার চেষ্টা করলো। রুমের বাকীরা তাকে তার নেতার সাথে কথা বলতে বললো। সে তার নেতার সাথে কথা বলতে চলে গেলে আমিও আমার (!!) নেতার কাছে গিয়ে ঘটনা বললাম। দেখলাম, মিঃ. নেতা ঐ ছেলের নেতার সাথে কোন প্রকার কথা বলতে আগ্রহী নয়। বরং আমাকে বললো, " ঐ ছেলেকে যায়গা দিবা না, তুমি সীটে শুয়ে থাকবা, যাও এখনী ঐ সীটে শুইয়া থাকো"
কি করবো বুঝতে পারছিলাম না, কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে ঐ সীটে যেয়ে শুয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ছেলেটা আসলো, সেও আমার সীটে শুয়ে পড়লো, চান্স চান্সে আছে কখন আমি একবার উঠি, তখনি আমার যায়গা দখল করবে। বুঝলাম তার নেতাও তাকে একই পরামর্শ দিয়েছে। এভাবে কতক্ষণ আর শুয়ে থাকা যায়, রাতে ঐ বেডেই শুয়েছিলাম না-কি বাসায় চলে গিয়েছিলাম মনে নাই।
পরেরদিন তো দুইজনেরই ক্লাস। ক্লাস শেষে আবার গ্যাঞ্জাম।
এর পরের ঘটনা খুবই হাস্যকর দিকে মোড় নিলো, সে সুযোগ পায় তো সে সীট দখল করে শুয়ে থাকে, কোন সাড়াশব্দটাও করে না, যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আবার আমি যখন চান্স পাই তখন আমি শুয়ে পড়ি, ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকি।

বলছিলাম যে সীটের দখল নেয়ার জন্য আমরা দুইজনই যখন যে সুযোগ পেতাম সীটে যেয়ে ঘুমানোর ভান করে শুয়ে থাকতাম, অন্যজন চেয়ারে বসে গভীর মনযোগের ভান ধরে বই পড়তে থাকতাম। আসলে পড়ালেখা কিছুই না, শুধু চান্সে থাকা কখন আরেকজন শোয়া থেকে উঠে। আর মনে মনে ভাবতাম, শালার আরেকজনের কি খিদাও লাগে না, বাথরুমও পায় না?
পরে বুঝেছিলাম, কারণ একবার সুযোগ পাওয়ার পর যখন আমি শুয়ে ঘুমানোর আর অন্য ছেলেটা চেয়ারে বসে পড়ার ভান করছে, তখন আমার খিদাও লাগতো না, আর বাথরুম ধরলেও চেপে রেখে শুয়ে থাকতাম, কারণ অন্য ছেলেটা এই চান্সে সীট দখল করে শুয়ে পড়লে সীট হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। রাতজেগে টিভি দেখার অভ্যাসও বাদ দিছি। সীট দখল করাই তখন আসল চ্যালেঞ্জ।

রুমের বাকিরা বিষয়টাকে মোটেও হাস্যরসাত্মক হিসেবে নেয় নাই মনে হয়, কারণ আমি কখনও এসব নিয়ে কাউকে হাসাহসি করতে দেখিনি, তবে আমি যদি রুমমেট হতাম তাহলে হাসতে হাসতে প্রতিযোগীদের দুইজনকেই উৎসাহ দিতাম। তবে বেডের অরিজিনাল দাবীদার সিনিয়র ভাই খুব বিরক্ত ছিলেন বুঝতে পারতাম। ওনাকে পলিটিক্যাল কোন বিষয়ে যেতে দেখিনি, তবে সিনিয়র হিসেবে গুরুত্ব পেতে দেখেছি।

যাই হোক, এভাবে কয়েকদিন চলার পর একদিন ছেলেটাকে বিষয়টা নিয়ে খুব উত্তেজিত হতে দেখলাম, একটু ভয়ও পেলাম।

তার কিছুদিন আগে বিটিভিতে একটা নাকট দেখেছিলাম, নাটকটার নাম মনে নেই, তবে নায়ক ছিল অভিনেতা মাহফুজ। খুব ভদ্র সাধাসিধে মেধাবী মাহফুজ গ্রাম থেকে এসে ভার্সিটির হলে উঠেছে। কিন্তু হল পলিটিক্সের পাল্লায় পড়ে তাকে হল থেকে বের হয়ে যেতে হয়েছিল, আসলে তাকে রুম থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। মাহফুজ পরে পাওয়ার পলিটিক্সে জড়িয়ে যায়, সাথে সবসময় অস্ত্র নিয়ে ঘোরে, বড় ক্যাডার হয়ে যায়। তা-র-প-র এ-ক-দি-ন যে ছেলেটা মাহফুজকে রুম থেকে বের করে দিয়েছিল সেই ছেলেটাকে একা পেয়ে যায়। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে এলোমেলো চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে, রক্তিম চোখে ঐ ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করে কেমন আছেন? চিনতে পেরেছেন? এসব বলে নায়কোচিতভাবে ঐ ছেলেটাকে ছুরিকাঘাত করে, কয়েকবার।

আমার প্রতিযোগির সাথে প্রতিযোগিতার সময়ে ঐ নাটকটায় মাহফুজের শেষ সীনটার কথা মনে পড়তো, প্রতিযোগী ছেলেটা কোন দিন শেভ না করলে নাটকের শেষ সীনের খোচা খোচা দাড়িওয়ালা মাহফুযের কথা মনে পড়ে যেত, আর সাথে তলপেটে চিনচিনে ব্যাথা।

প্রতিযোগিতার মাঝে প্রায়ই আমার নেতাজীর সাথে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতাম। একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, এভাবে আর না, কতদিন আর ফাইট দেয়া যায়। ছেলেটার চালচলন আর বেশভূষা দেখে তাকে মোটেও গরীব বলে মনে হয়নি। তাই তাকে কোন ছাড় দেয়ার কথাও কখনই মাথায় আসে নাই। কিন্তু একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নিজেই অসুস্থ বোধ করছিলাম। তাই হল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরে ভারহীন লাগছিল, তাই ক্লাস শেষে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে বিকেল করে রুমে গেলাম আমার দুই একটা জামা কাপড়, যা রুমে এনে রেখছিলাম, তা নিয়ে আসতে। এসে দেখি ছেলেটা যথারীতি বেডে শুয়ে আছে, অথবা আমার আসাঁটা টের পেয়ে শুয়ে গেছে। আমি জামা কাপড় গোছাতে যাবো এসময় ফ্লোর নেতার কাছ থেকে ডাক আসল। যাওয়ার পর প্রায় ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করল এতক্ষণ কোথায় ছিলাম, আর কেন সীটের দখল নেই নাই। আমি জানালাম যে আমি আর এই খেলার মধ্যে নেই, রুম আমার দরকার নাই। আমার কথা শুনে বিষ্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একটা ধমক দিলেন। বললেন "খবরদার এরকম কাজ করবে না। ছেলেরা সীট পায় না, আর তুমি সীট ছেড়ে দিবে? এরকম কাজ করলে তোমার খবর আছে, এই সীট তুমি ছেড়ে দেয়া মানে এই সীট আমার হাতছাড়া হওয়া। এটা আমি হতে দিব না। " এসব বলে আরো অনেক বকাঝকা দিলেন, কিছু পরোক্ষ হুমকি ধামকিও দিলেন।
রাজনৈতিক ক্যাচাল, মারপিট, গোলাগুলি ইত্যাদি দেখে আসছি বেশ অনেকদিন। কোনপ্রকার রাজনৈতিক সাপোর্ট ছাড়া আমি একটা বেকায়দায় পড়লাম, শুদ্ধ ভাষায় (!!) বললে মাইনকা চিপায় পড়লাম। কিছুক্ষণ অনুনয় বিনয় করেও কোন লাভ হল না। বুঝলাম, হল দখল বা সীট দখলের রাজনীতিতে আমি একটা "জনগণ" এ পরিণত হয়েছি। আমি সীট ছেড়ে দিলে ফ্লোর নেতার দখলিতান্ত্রিক তথা হল রাজনৈতিক পরাজয় হবে, তাই কোন ছাড় দিবে না। ইচ্ছা করলে হয়তো অন্য কাউকে দিতে পারতেন, কিন্তু এই সীটে যেহেতু অন্য ফ্লোরের এক ফ্লোর নেতা একজনকে বসিয়েছে বা শুইয়েছে, সেহেতু আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে এখানে প্রতিস্থাপন করা সোজা হবে না।
বাটে পড়লাম, অসহায় হয়ে আবার রুমে গেলাম। ততক্ষণে প্রতিযোগিতা করার মানসিকতা শেষ হয়ে গেছে। আর যেদিন ছেলেটা রেগে গিয়েছিল সেদিন উলটো আমার মধ্যে একটা জেদও চলে আসলো, ভাবলাম দেখা যাক কি হয়। আমার প্রতিযোগী ছেলেটাকেও বললাম, " দেখো, আমার সীট ছাড়ার কোন উপায়ও নাই, আর তোমার বিষয়টারও সমাধান করা দরকার, তুমি তোমার নেতার কাছে ফয়সালার জন্য বলো, এভাবে তোমারও পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে। (আমার পড়ালেখার কথা বলিনি, কারণ আমি একটা চরম ফাকিবাজ স্টুডেন্ট, এতবড় ফাকিবাজ ছিলাম যে মিথ্যামিথ্যি করেও নিজের পরালেখার কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলাম) "। ছেলেটা বুঝেছিল, সে তখনি তার নেতার কাছে গেল কি যেন বলতে। কিন্তু আদতে কোন ফল আসে নাই।
একদিন ফ্লোর নেতাকে বললাম, হয় আপনি এটার সমাধান করেন, নয়তো আমি কোনভাবেই এখানে আর থাকবো না। এবার নেতা রাজী হয়ে উপরের নেতাদের কাছে যেয়ে অভিযোগ করে সমাধান করে দিলেন। কিছুক্ষণ পর প্রতিযোগী অন্য রুমে চলে গেল। খুব তাড়াতাড়িই সমাধান হয়ে গেল।
আমিও থিতু হলাম, হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

অদ্ভুত কোন কারণে সেই ছেলেটার সাথে আর দেখা হয়নি। দেখা হলে অবশ্যই বন্ধুত্ব পাতাতাম।

তবে এই ঘটনার পর হলে সীট পেয়েছিলাম বলে রুমে কিছু চমৎকার মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।

আর হ্যাঁ, খোঁচাখোঁচা দাড়িওয়ালা মাহফুজ টাইপ কাউকে ফেস করতে হয়নি আমাকে।
ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, বাসা যাত্রাবাড়িতে, তাই হলে উঠার চিন্তা কখনই করিনি। অনেকগুলো লাল বাস এই এরিয়া দিয়ে যায়, কখনও "উল্লাস" বা কখনও "ঈশাখা" এভাবেই ভার্সিটিতে যাতায়াত। "আনন্দ" আর "মৈত্রী" সৎ ভাইয়ের মত আচরণ করলেও কোন সমস্যা হত না।

একসময় মনে হল ভার্সিটিতে পড়ে গেলাম, কিন্তু হল লাইফের মজাই পেলাম না, তাই কি হয়? এটাচ ছিলাম জসিমউদ্দিন এ। তো কাকে যেন ধরলাম, বললাম আমাকে একটা সীটের ব্যবস্থা করে দিতে। সে আমাকে একজনের কাছে নিয়ে গেল। জসীম উদ্দিনের ৫ তলায়।
বারান্দার এক কিনারে একজন হ্যাংলা পাতলা নেতাজী বসে ছিলেন। যিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি নেতাজীর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নেতাকে একটা সীটের ব্যবস্থা করে দিতে অনুরোধ করলেন। নেতাজী নিজের চেহারার সাথে অমানানসই ভাবে গলায় গাম্ভীর্য এনে জিজ্ঞাসা করল "তুমি ......... (রাজনৈতিক দলের নাম) কর?"
আমি চুপ করে রইলাম।
আবার একই প্রশ্ন করল নেতা।
আমি আবার চুপ করে রইলাম।
বুঝল, আমিতো ভাবলাম বলবে সীট পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, " ঠিক আছে দিচ্ছি, তবে একটা শর্ত আছে, নেক্সট হল নির্বাচনে আমি যে পোস্টে দাঁড়াব , সেই পোস্টে আমাকে ভোট দিবে। রাজী?"
আমি সানন্দে হাসিমুখে মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
আমি বললাম " তাহলে ভাইয়া কবে উঠবো?"
নেতাজী উত্তরে বললেন, " কবে উঠবে মানে? আজই উঠো, এখনী, সীটের অনেক ক্রাইসিস, এখনই দখল না করলে সীট বেদখল হয়ে যাবে, তাই এক্ষুনী সীটে উঠে পড়ো।"
আমি বেয়াক্কেল হয়ে গেলাম, উনি আমাকে টানতে টানতে রুমটাতে নিয়ে গেলেন।এর আগে বিভিন্ন বন্ধুদের রুমে আড্ডা মারতে বা কার্ড খেলতে গেছি, রাতও কাটাইছি, কিন্তু এই রুমটা ভিন্ন রকমের, পরিচ্ছন্ন রুম, চারটা সিংগেল বেড। কিন্তু প্রত্যেকটা বেডে দুইজনকে থাকে। বারান্দার দিকে একটা পরিপাটি করে গোছানো (কোন ছেলের বেড এতটা পরিচ্ছন্ন আর গোছালো রুম আমি দেখিনি) বেড দেখিয়ে বললো এটাই তোমার সীট। ঐ সীটে একজন সিনিয়র থাকেন, আমাকে তার সাথে ডাবলিং করতে হবে। জানতাম এরকমই হবে, খুব সিনিয়র বা পাওয়ারফুল না হলে সিংগেল বেডে থাকা একটা অবাস্তব স্বপ্ন। মেনে নিলাম।
কিন্তু এইসময় রুমের অন্য কেউ একজন জানালো যে, এই সীটে অলরেডী একজনকে অন্য এক নেতা বরাদ্দ দিছে, ছেলেটা উঠেছেও। এটা শুনে আমার নেতাজী তাচ্ছিল্যের ভংগীতে বললেন, "আরে কে কাকে উঠাবে এখানে, এই ফ্লোর আমার নিয়ন্ত্রনাধীন। এখানে অন্য কারো নেতাগীরী চলবে না। আমি যাকে উঠাবো সেই উঠবে। ঐ ছেলেকে বল এই রুম ছেড়ে অন্য কোন রুমে সীট নিতে। "
যে ছেলেটাকে উঠানো হয়েছে সে তখন রুমে ছিলো না, ক্লাসে অথবা অন্য কোথাও হয়ত গেছে।
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে নেতাজী বললেন " তুমি এখানে শুয়ে থাকো, ঐ ছেলে আসলে বলবে আমি বলেছি অন্য সীটে যেতে। "
আমি ভাবলাম নেতাজী যখন বলেছে, তাও আবার ইনি ফ্লোর নেতা, সেহেতু এখানেই ঝামেলা মিটে গেছে।
আমি সীটে বসে রইলাম, আর ফ্লোর নেতা আর তার সাংগপাংগরা চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর সেই ছেলেটা আসলো, দেখেই বুঝলাম গ্রাম থেকে আসা, কৃষ্ণ বর্ণ, দেখতে সাধাসিধে হলেও সুঠামদেহী, নতুন ভর্তী হয়েছে, সাহস তখনও ভর করে নাই।আর সেই তুলনায় আমিতো ছিলাম হ্যাংলা পাতলা, ভীরু। ভাবলাম মারামারি লাগলে পালাইতে হবে।
ছেলেটা এসে এসব দেখে প্রথমে কাইকুই করলো," একেমন কথা, এটা ঠিক না" রাগারাগিও করার চেষ্টা করলো। রুমের বাকীরা তাকে তার নেতার সাথে কথা বলতে বললো। সে তার নেতার সাথে কথা বলতে চলে গেলে আমিও আমার (!!) নেতার কাছে গিয়ে ঘটনা বললাম। দেখলাম, মিঃ. নেতা ঐ ছেলের নেতার সাথে কোন প্রকার কথা বলতে আগ্রহী নয়। বরং আমাকে বললো, " ঐ ছেলেকে যায়গা দিবা না, তুমি সীটে শুয়ে থাকবা, যাও এখনী ঐ সীটে শুইয়া থাকো"
কি করবো বুঝতে পারছিলাম না, কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে ঐ সীটে যেয়ে শুয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ছেলেটা আসলো, সেও আমার সীটে শুয়ে পড়লো, চান্স চান্সে আছে কখন আমি একবার উঠি, তখনি আমার যায়গা দখল করবে। বুঝলাম তার নেতাও তাকে একই পরামর্শ দিয়েছে। এভাবে কতক্ষণ আর শুয়ে থাকা যায়, রাতে ঐ বেডেই শুয়েছিলাম না-কি বাসায় চলে গিয়েছিলাম মনে নাই।
পরেরদিন তো দুইজনেরই ক্লাস। ক্লাস শেষে আবার গ্যাঞ্জাম।
এর পরের ঘটনা খুবই হাস্যকর দিকে মোড় নিলো, সে সুযোগ পায় তো সে সীট দখল করে শুয়ে থাকে, কোন সাড়াশব্দটাও করে না, যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আবার আমি যখন চান্স পাই তখন আমি শুয়ে পড়ি, ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকি।

বলছিলাম যে সীটের দখল নেয়ার জন্য আমরা দুইজনই যখন যে সুযোগ পেতাম সীটে যেয়ে ঘুমানোর ভান করে শুয়ে থাকতাম, অন্যজন চেয়ারে বসে গভীর মনযোগের ভান ধরে বই পড়তে থাকতাম। আসলে পড়ালেখা কিছুই না, শুধু চান্সে থাকা কখন আরেকজন শোয়া থেকে উঠে। আর মনে মনে ভাবতাম, শালার আরেকজনের কি খিদাও লাগে না, বাথরুমও পায় না?
পরে বুঝেছিলাম, কারণ একবার সুযোগ পাওয়ার পর যখন আমি শুয়ে ঘুমানোর আর অন্য ছেলেটা চেয়ারে বসে পড়ার ভান করছে, তখন আমার খিদাও লাগতো না, আর বাথরুম ধরলেও চেপে রেখে শুয়ে থাকতাম, কারণ অন্য ছেলেটা এই চান্সে সীট দখল করে শুয়ে পড়লে সীট হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। রাতজেগে টিভি দেখার অভ্যাসও বাদ দিছি। সীট দখল করাই তখন আসল চ্যালেঞ্জ।

রুমের বাকিরা বিষয়টাকে মোটেও হাস্যরসাত্মক হিসেবে নেয় নাই মনে হয়, কারণ আমি কখনও এসব নিয়ে কাউকে হাসাহসি করতে দেখিনি, তবে আমি যদি রুমমেট হতাম তাহলে হাসতে হাসতে প্রতিযোগীদের দুইজনকেই উৎসাহ দিতাম। তবে বেডের অরিজিনাল দাবীদার সিনিয়র ভাই খুব বিরক্ত ছিলেন বুঝতে পারতাম। ওনাকে পলিটিক্যাল কোন বিষয়ে যেতে দেখিনি, তবে সিনিয়র হিসেবে গুরুত্ব পেতে দেখেছি।

যাই হোক, এভাবে কয়েকদিন চলার পর একদিন ছেলেটাকে বিষয়টা নিয়ে খুব উত্তেজিত হতে দেখলাম, একটু ভয়ও পেলাম।

তার কিছুদিন আগে বিটিভিতে একটা নাকট দেখেছিলাম, নাটকটার নাম মনে নেই, তবে নায়ক ছিল অভিনেতা মাহফুজ। খুব ভদ্র সাধাসিধে মেধাবী মাহফুজ গ্রাম থেকে এসে ভার্সিটির হলে উঠেছে। কিন্তু হল পলিটিক্সের পাল্লায় পড়ে তাকে হল থেকে বের হয়ে যেতে হয়েছিল, আসলে তাকে রুম থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। মাহফুজ পরে পাওয়ার পলিটিক্সে জড়িয়ে যায়, সাথে সবসময় অস্ত্র নিয়ে ঘোরে, বড় ক্যাডার হয়ে যায়। তা-র-প-র এ-ক-দি-ন যে ছেলেটা মাহফুজকে রুম থেকে বের করে দিয়েছিল সেই ছেলেটাকে একা পেয়ে যায়। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে এলোমেলো চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে, রক্তিম চোখে ঐ ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করে কেমন আছেন? চিনতে পেরেছেন? এসব বলে নায়কোচিতভাবে ঐ ছেলেটাকে ছুরিকাঘাত করে, কয়েকবার।

আমার প্রতিযোগির সাথে প্রতিযোগিতার সময়ে ঐ নাটকটায় মাহফুজের শেষ সীনটার কথা মনে পড়তো, প্রতিযোগী ছেলেটা কোন দিন শেভ না করলে নাটকের শেষ সীনের খোচা খোচা দাড়িওয়ালা মাহফুযের কথা মনে পড়ে যেত, আর সাথে তলপেটে চিনচিনে ব্যাথা।

প্রতিযোগিতার মাঝে প্রায়ই আমার নেতাজীর সাথে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতাম। একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, এভাবে আর না, কতদিন আর ফাইট দেয়া যায়। ছেলেটার চালচলন আর বেশভূষা দেখে তাকে মোটেও গরীব বলে মনে হয়নি। তাই তাকে কোন ছাড় দেয়ার কথাও কখনই মাথায় আসে নাই। কিন্তু একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নিজেই অসুস্থ বোধ করছিলাম। তাই হল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরে ভারহীন লাগছিল, তাই ক্লাস শেষে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে বিকেল করে রুমে গেলাম আমার দুই একটা জামা কাপড়, যা রুমে এনে রেখছিলাম, তা নিয়ে আসতে। এসে দেখি ছেলেটা যথারীতি বেডে শুয়ে আছে, অথবা আমার আসাঁটা টের পেয়ে শুয়ে গেছে। আমি জামা কাপড় গোছাতে যাবো এসময় ফ্লোর নেতার কাছ থেকে ডাক আসল। যাওয়ার পর প্রায় ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করল এতক্ষণ কোথায় ছিলাম, আর কেন সীটের দখল নেই নাই। আমি জানালাম যে আমি আর এই খেলার মধ্যে নেই, রুম আমার দরকার নাই। আমার কথা শুনে বিষ্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একটা ধমক দিলেন। বললেন "খবরদার এরকম কাজ করবে না। ছেলেরা সীট পায় না, আর তুমি সীট ছেড়ে দিবে? এরকম কাজ করলে তোমার খবর আছে, এই সীট তুমি ছেড়ে দেয়া মানে এই সীট আমার হাতছাড়া হওয়া। এটা আমি হতে দিব না। " এসব বলে আরো অনেক বকাঝকা দিলেন, কিছু পরোক্ষ হুমকি ধামকিও দিলেন।
রাজনৈতিক ক্যাচাল, মারপিট, গোলাগুলি ইত্যাদি দেখে আসছি বেশ অনেকদিন। কোনপ্রকার রাজনৈতিক সাপোর্ট ছাড়া আমি একটা বেকায়দায় পড়লাম, শুদ্ধ ভাষায় (!!) বললে মাইনকা চিপায় পড়লাম। কিছুক্ষণ অনুনয় বিনয় করেও কোন লাভ হল না। বুঝলাম, হল দখল বা সীট দখলের রাজনীতিতে আমি একটা "জনগণ" এ পরিণত হয়েছি। আমি সীট ছেড়ে দিলে ফ্লোর নেতার দখলিতান্ত্রিক তথা হল রাজনৈতিক পরাজয় হবে, তাই কোন ছাড় দিবে না। ইচ্ছা করলে হয়তো অন্য কাউকে দিতে পারতেন, কিন্তু এই সীটে যেহেতু অন্য ফ্লোরের এক ফ্লোর নেতা একজনকে বসিয়েছে বা শুইয়েছে, সেহেতু আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে এখানে প্রতিস্থাপন করা সোজা হবে না।
বাটে পড়লাম, অসহায় হয়ে আবার রুমে গেলাম। ততক্ষণে প্রতিযোগিতা করার মানসিকতা শেষ হয়ে গেছে। আর যেদিন ছেলেটা রেগে গিয়েছিল সেদিন উলটো আমার মধ্যে একটা জেদও চলে আসলো, ভাবলাম দেখা যাক কি হয়। আমার প্রতিযোগী ছেলেটাকেও বললাম, " দেখো, আমার সীট ছাড়ার কোন উপায়ও নাই, আর তোমার বিষয়টারও সমাধান করা দরকার, তুমি তোমার নেতার কাছে ফয়সালার জন্য বলো, এভাবে তোমারও পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে। (আমার পড়ালেখার কথা বলিনি, কারণ আমি একটা চরম ফাকিবাজ স্টুডেন্ট, এতবড় ফাকিবাজ ছিলাম যে মিথ্যামিথ্যি করেও নিজের পরালেখার কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলাম) "। ছেলেটা বুঝেছিল, সে তখনি তার নেতার কাছে গেল কি যেন বলতে। কিন্তু আদতে কোন ফল আসে নাই।
একদিন ফ্লোর নেতাকে বললাম, হয় আপনি এটার সমাধান করেন, নয়তো আমি কোনভাবেই এখানে আর থাকবো না। এবার নেতা রাজী হয়ে উপরের নেতাদের কাছে যেয়ে অভিযোগ করে সমাধান করে দিলেন। কিছুক্ষণ পর প্রতিযোগী অন্য রুমে চলে গেল। খুব তাড়াতাড়িই সমাধান হয়ে গেল।
আমিও থিতু হলাম, হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

অদ্ভুত কোন কারণে সেই ছেলেটার সাথে আর দেখা হয়নি। দেখা হলে অবশ্যই বন্ধুত্ব পাতাতাম।

তবে এই ঘটনার পর হলে সীট পেয়েছিলাম বলে রুমে কিছু চমৎকার মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।

আর হ্যাঁ, খোঁচাখোঁচা দাড়িওয়ালা মাহফুজ টাইপ কাউকে ফেস করতে হয়নি আমাকে।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৪:৫২

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন: বাস্তব চিত্র। আমাদের ছাত্রনেতাদের সিল রাজনীতিও একটা নীতি। সব ব্শ্বিবিদ্যালয়েই এটা হয়ে আসছে। প্রশাসন আছে বলে মনে হয়। সিট বন্টনের দায়িত্ব প্রশাসনের। কোন নেতা বা পাতি নেতার নয়।

২| ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৬

কাউয়ার জাত বলেছেন: সবই বুঝলাম, কিন্তু ভোট দেয়ার বিষয়টা বুঝলামনা। হলে পোস্টের জন্য সাধারণ ছাত্রের ভোটাভুটি? কত সালের ঘটনা?

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১১:৩৫

সিদ্দিকী শিপলু বলেছেন: ১৬/১৭ বছর আগের ঘটনা

৩| ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:৫০

রাজীব নুর বলেছেন: ১৬/১৭ বছর ঘটনা। আজও তা বিদ্যমান।

৪| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:৪৯

পদ্মপুকুর বলেছেন: কিসের ভোট? আমি ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত মুহসীন হলের আবাসিক স্টুডেন্ট ছিলাম। ছাত্রলীগ-কেয়ারটেকার-ছাত্রদল, তিন আমলই পেয়েছি, কিন্তু ভোটের কোনো বিষয়তো মনে করতে পারছি না। যাই হোক, আপনার লেখা বেশ সাবলীল। আরেকটু বেশি লিখুন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.