নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নীরবে নির্জনে যন্ত্র-অরণ্যে

আপাতত রেস্টে আছি! :)

স্নিগ

আমি একদিন মারা যাব, এই সত্যটা নিয়ে আমার খুব বেশি আক্ষেপ নেই। তবে, আমার মৃত্যুর পর আরও অসংখ্য অসাধারণ সব বই লেখা হবে, গান সৃষ্ট হবে, চলচিত্র নির্মিত হবে।কিন্তু আমি সে সব পড়তে, শুনতে কিংবা দেখতে পারবো না।এই সত্যটা আমাকে খুব যন্ত্রণা দেয়।

স্নিগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অগ্নিয়ানা

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ভোর ৫:০৬

শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা। পূর্ণিমা সিনেমা হলের প্রাঙ্গণ লোকে-লোকারণ্য। সাধারণত ঈদের দিন ব্যতীত এমন ভীড় দেখা যায় না। গত ঈদ-উল-আযহায় মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল জাজ মাল্টিমিডিয়ার বিগ বাজেট মুভি অগ্নি। “বিভিন্ন কারণে” ঈদে মুক্তি না পেলেও, ঈদের আমেজের সৌভাগ্য জুটেছে ছবিটির কপালে। দ্বিগুণ টাকা দিয়ে ব্ল্যাকে টিকিট কিনে দেখতে বসে গেলাম।

মাহিয়া মাহি একজন ট্রেইন্ড অ্যাসাসিন। বাবা-মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতেই নিজেকে দুর্ধর্ষ করে গড়ে তুলেছে মাহি। তার এই কাজে সহায়তা করেছে মামা ড্যানি সিডাক। কিন্তু এর মাঝে পেরিয়ে গিয়েছে ১২টি বছর। দেশ ছেড়ে হত্যাকারী আলীরাজ গং এখন থাইল্যান্ডে জাঁকিয়ে ব্যবসা করছে। তাই মাহিও হাজির হল থাইল্যান্ডে। একসময়কার চ্যাম্পিয়ন বক্সার আরেফিন শুভ আলীরাজের বডিগার্ড। জীবন বাঁচাতে আলীরাজ আর তার বন্ধুরা আশ্রয় নিল আরেফিন শুভর সেফ হাউজে। শুভর এই সেফ হাউজের ঠিকানে কেউ জানে না। তাই সেফ হাউজের ঠিকানা জানতে অন্য কৌশল অবলম্বন করলো মাহি। শুভ’র মামা কাবিলার বাসা ভাড়া নিল। আর সবার সন্দেহ এড়াতে মাহি অতি সহজ-সরল মেয়ের অভিনয় শুরু করলো, যে কিনা বন্দুক দেখলেই ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। আর এই সারল্যে ভরা মাহির প্রেমে পড়ে গেল শুভ। কিন্তু একদিন মাহির আসল পরিচয় জেনে গেল শুভ…।

ছবিটি পরিচালনা করেছেন ইফতেখার চৌধুরী (ছবিতে ইফতেখারের একটা ক্যামিও অ্যাপিয়ারেন্সও ছিল)। তার প্রথম ছবি “খোঁজ” ব্যাপক সমালোচিত হলেও, দেহরক্ষীতে কিছুটা মুখরক্ষা করতে পেরেছিলেন। ইফতেখারের উন্নতির গ্রাফটা লক্ষণীয়। নিঃসন্দেহে অগ্নি তার সেরা কাজ। পূর্বের ছবিগুলোর তুলনায় অগ্নি অনেক গোছানো ও বোধগম্য (তার প্রথম ছবিতে গল্পের তাল ধরাই মুশকিল ছিল)। কিছু ত্রুটি চোখে পড়লো, যেগুলো খেয়াল না করলেও চলে। যেমন : মাহি ছোটবেলায় চট্টগ্রামে ছিল। কিন্তু তার বাবা যখন তাকে বাসায় নিয়ে আসছিল, তখন স্পষ্টভাবে গাড়ির জানালা দিয়ে হোটেল র‌্যাডিসন দেখা যাচ্ছিল। তানিশার বাবা-মার মৃত্যু দৃশ্যটা বড্ড অগোছালোভাবে শ্যুট করা। কে কোথায় গুলি খেয়ে, কোথায় এসে মরলো তা বোঝা দায়। গল্পনুযায়ী মাহি ২০০১ এর দিকে ঢাকায় এসেছে। মাহি ঢাকায় আসার পর শাপলা চত্বরের দৃশ্যে একটি প্রখ্যাত রেডিও স্টেশনের বিশাল বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। অথচ তখন ঢাকায় কোন এফ. এম রেডিও ছিল না। মিশা সওদাগর যে ল্যাপটপটি ব্যবহার করছিলেন সে সময়ে এমন ল্যাপটপেরও কোন অস্তিত্ব ছিল না। আরেফিন শুভ’র উইকিপিডিয়া পেজে যে ফন্ট দেখানো হল, উইকির ডিফল্ট ফন্টের সাথে তার মিল আছে কিনা এমন সামান্য বিষয় না হয় নাই তুললাম। কিন্তু শুভর স্টান্ট ডাবলের সাথে তার মিল আশা করাটা নিশ্চয়ই দোষের না। ডাবল হিসেবে যাকে ব্যবহার করা হয়েছে, তাকে প্রথম নজরেই আলাদা করা যাচ্ছিল। মাহির মামা ড্যানি সিডাক দেখলাম চির যুবা পুরুষ। ১২ বছরে তার অর্থ-বিত্ত বাড়লেও, বয়স একদিনও বাড়েনি। বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ড্যানি সিডাকের অনাগ্রহও বিস্ময় জাগিয়েছে। অ্যাকশন দৃশ্য যেহেতু পরিচালকের সবচে সবল দিক, তাই এই দৃশ্যগুলোর এক্সিকিউশন খুবই ভাল হয়েছে। অ্যাকশনগুলো যথেষ্ট স্টাইলিশ ছিল। তার চে বড় কথা, কোনও দৃশ্যমান তার (wire) অথবা উঁচু হয়ে থাকা জামা সহ্য করতে হয়নি।



ছবির কাহিনী, সংলাপ ও চিত্রনাট্য আব্দুল্লাহ জহির বাবুর করা। যদিও স্ক্রীপ্টটা অনেক গতিময়, তবে দুঃখজনকভাবে গল্পটার বেসিক প্লটলাইন ও প্লট এলিমেন্ট অলিভার মেগাটনের “Colombiana” থেকে নেওয়া। ক্ষেত্রবিশেষে সংলাপও রেহাই পায়নি। পুরোটা নেওয়া হয়েছে। আবার অনেক সময় দৃশ্য সোয়াপ করে কাজ চালিয়েছেন। যেমন, ঢাকায় ইফতেখারের সেফ হাউজ থেকে মাহির পালিয়ে যাওয়া আর কলম্বিয়ানায় কাতালিয়ার জেলের সেল থেকে বের হবার দৃশ্যগুলো সম্পুর্ণ এক। শুভর আইপ্যাডের পাসওয়ার্ড মাহি কিভাবে পেল তার উত্তর পাওয়া গেল না। কাবিলা শুভর কেমন মামা সেটাও বোঝা গেল না। কারণ শুভর মা থাই অথচ কাবিলা খাস সিলেটী। আর একটি হত্যাকান্ডের সময় কাবিলা খুব কাছ থেকে মাহিকে দেখেছে। এরপরও বাসায় ভাড়াটিয়া মাহিকে সে কেন চিনতে পারলো না, বুঝলাম না। মাহির শুরুর চেয়ারের অ্যাকশন আর ডনকে গুলি করার দৃশ্য না হয় নাতাশা রোমানফ আর ওয়ান্টেডের ফক্সের প্রতি হোমেজ হিসেবে ধরে নিলাম।

ছবির ক্যামেরাওয়ার্ক আর এডিটিং খুবই মানসম্মত ছিল। বিশেষ করে মাহির অ্যাকশন সিকোয়েন্সগুলো শ্যুট করতে বেশ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন চিত্রগ্রাহক। তবে,লিফটের দৃশ্যটায় লাইটিং ভালো হয়নি। পুরো লিফট অন্ধকার, অথচ মাহির পায়ের কাছে স্টেডিয়ামের ফ্লাডলাইটসম আলো। ওপেনিং টাইটেলে মাত্রাজ্ঞানের অভাব পীড়াদায়ক ছিল। সবচে অবাক হলাম এই দেখে, পরিচালক থাইল্যান্ডের দারুণ লোকেশনকে খুব একটা কাজে লাগাননি। মোটর বাইক আর জেট স্কির চেজ সিকোয়েন্স, ইয়টের দৃশ্য, “ভালবাসি তোকে” গানটা বাদ দিলে থাইল্যান্ডকে তেমনভাবে ছবিতে পাওয়া যায়নি। ছবির গানগুলো শ্রুতি মধুর হলেও চিত্রায়ন খুব দায়সারা ছিল। টাইটেল সং, অগ্নিগিরি, সহেনা যাতনা গান তিনটি ভাল হয়েছে। আইটেম সংটির কোরিওগ্রাফি ভাল হলেও নীতি মোহনের গায়কী বিরক্তিকর ছিল।

টাইটুলার ক্যারেক্টার তানিশা ওরফে অগ্নি চরিত্রে মাহি তার আগের সব কাজকে ছাড়িয়ে গেলেও, এমন সবল চরিত্রের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। মাহির অভিনয়ে দুর্বলতা, এক্সপ্রেশন স্বল্পতা ছবির এক বড় মাইনাস পয়েন্ট। অ্যাকশন হোক অথবা রোম্যান্টিক, বেশিরভাগ সময় তার মুখে কোন এক্সপ্রেশনই ছিল না। অগ্নি চরিত্রটি আরও শ্রেয়তর পারফর্ম্যান্সের দাবীদার। ছবিতে আরেফিন শুভ নিজেকে ছাড়িয়ে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। যদিও তার ক্যারেক্টারটা স্ক্রীপ্টে যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি। পুরো ছবিতে মাহির পিছে ঘোরা আর তার কাছে নাকানি-চুবানি খাওয়া ছাড়া তেমন কিছু করার সুযোগ চরিত্রটির হয়নি। তারপরও অসাধারণ কমিক টাইমিং, ইম্প্রোভাইজেশন, দুর্দান্ত ফাইটিং স্কিল সব মিলিয়ে একজন পার্ফেক্ট অ্যাকশন হিরোর প্রতিভূ ছিলেন শুভ। আলীরাজ আর ডন তাদের গেটআপ আর ডায়লগ থ্রোয়িং পাল্টালেও অভিনয়ে তেমন ভিন্নতা আনতে পরেননি। মিশা সওদাগর আর কাবিলা বরাবরের মত ভাল করেছেন। তবে এই ছবির সেরা কাজ দেখিয়েছেন শিশুশিল্পী পূজা। তার অভিনয় আর এক্সপ্রেশন্স ছবির অন্য পুরনো অভিনেতাদের লজ্জায় ফেলার জন্য যথেষ্ট।

ভালো টিম, লোকেশন, বাজেট, পূর্বলব্ধ অভিজ্ঞতাকে এবার দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন ইফতেখার চৌধুরী। কিন্তু এত সব “ভাল” ধূলিসাৎ হয়ে যায় তাদের “থাইল্যান্ডিয়ানার” কাছে। লো বাজেট মুভি তামিল-তেলেগু থেকে কপি করছে আর এই বিগ বাজেট মুভি কপি করলো হলিউড থেকে। এই যা পার্থক্য। নকলের বৃত্ত থেকে আমাদের গল্পগুলো কেন বেরিয়ে আসতে পারছে না! তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল, মূল হলিউডি ছবিটির গল্প এমন আহামরি ছিল না, নতুনত্বও ছিল না। একটু ভাবলেই আমাদের দেশের লেখকরা এর থেকে ভাল গল্প লিখতে পারেন, সে প্রমাণ আমরা আগেও পেয়েছি। এমন অন্ধ অনুকরণ চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নতির পথে বড় অন্তরায়। ছবিতে মাহির একটা সংলাপ ছিল “এই অগ্নি তোকে ধংস করে দেবে, ধংস”। ছবির সংলাপ ধার করেই বলছি, আগুন শুধু ধংস করে না, নতুন কিছু সৃষ্টিও করে। এই “অগ্নি” থেকে উত্তাপ নিয়ে এগিয়ে যাক দেশীয় চলচ্চিত্র। শুরু হোক সৃ্ষ্টির মহোৎসব।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.