নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নীরবে নির্জনে যন্ত্র-অরণ্যে

আপাতত রেস্টে আছি! :)

স্নিগ

আমি একদিন মারা যাব, এই সত্যটা নিয়ে আমার খুব বেশি আক্ষেপ নেই। তবে, আমার মৃত্যুর পর আরও অসংখ্য অসাধারণ সব বই লেখা হবে, গান সৃষ্ট হবে, চলচিত্র নির্মিত হবে।কিন্তু আমি সে সব পড়তে, শুনতে কিংবা দেখতে পারবো না।এই সত্যটা আমাকে খুব যন্ত্রণা দেয়।

স্নিগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

উধাও : খুঁজে পাওয়ার গল্প

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ভোর ৫:০৭



ডেব্যুট্যান্ট পরিচালক অমিত আশরাফের ছবি দেশে এসেছে অনেক মালা আর মুকুট জয় করে। থ্রিলারধর্মী ছবিটি ইতোমধ্যে ২১টি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ঘুরে এসেছে। জয় করেছে সাতটি পুরস্কার।

বাবু পেশায় ভ্যানচালক। তার ভ্যানে করে বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দেয়। সপ্তাহান্তে ঢাকার অদূরে নিজের বাড়িতে যায়। সেখানে তার স্ত্রী ও এক মেয়ে আছে। আপাত দৃষ্টিতে বাবুকে খুব সাধারণ মানুষ বলেই বোধ হয়। আদতে বাবু দ্বৈত জীবন যাপন করে। দিনে বাচ্চাদের স্কুল ভ্যান চালায়। আর রাতে সে অভিযানে বের হয়। যেসব মানুষ তাদের পরিবারকে পরিত্যাগ করে উধাও হয়ে আছে, বাবু তাদের খুঁজে বের করে। ফিরিয়ে দেয় তাদের পরিবারের কাছে। এভাবেই একদিন খুঁজে পায় তার জীবনের সবচে বড় শিকার আকবরকে। আকবর একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। কিন্তু আদতে মুখোশে ঢাকা এক গডফাদার। আকবরকে কিডন্যাপ করে বাবু। বাবু “মেমোরি লেন” এর পথ ধরে তাকে নিয়ে রওনা হয়, আকবরের পরিবারের কাছে তাকে পোঁছে দিতে। পথের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দুটো চরিত্র একই সমতলে এসে নামে। কথায় কথায় আর পথের অভিজ্ঞতায় সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দুটো চরিত্র একই সমতলে এসে নামে।

উধাও ছবির পরিচালক অমিত আশরাফ। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে ফিল্ম ও ড্রামাটিক রাইটিং-এ স্নাতক করা অমিতের এটাই প্রথম কাজ। শুরুটা দারুণভাবেই করলেন তিনি। তার গল্প বলার ধরণ যেমন স্মার্ট তেমনি পুরোটা সময় নিজস্ব একটা ভঙ্গিও বজায় রেখেছিলেন। প্রথমার্ধে গল্প কিছুটা শ্লথ গতিতে আগালেও ইন্ট্যারভালের পর স্ক্রীপ্ট দারুণ গতিময়ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দারুণ কিছু ডিটেইলিং-ও চোখে পড়ল। যেমন : বাবু যখন মিতাকে ভ্যানে তুলছিল অদূরে এক গাড়ি এসে এক নিশিকন্যার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। হয়তবা সেখানে আরেকটি গল্প জন্ম নিচ্ছিল।

ক্যামেরায় কাইল হেসলপের কাজ দৃষ্টিনন্দন ছিল। কাইলের চোখ দিয়ে আমরা নতুন এক ঢাকাকে আবিষ্কার করি। বিশেষ করে লঞ্চঘাটের দৃশ্যটা যেন সুশৃঙ্খলভাবে বিশৃঙ্খল ঢাকা শহরের প্রতীক। এছাড়া ফ্ল্যাশব্যাকের দৃশ্যগুলো অনেকটা দূরত্ব, কিছুটা অস্থিরতা আর সর্বদা পরিমিত ব্লারনেস নিয়ে এসেছে। অতীত চকচকে চেহারা নিয়ে এলে ভালোও লাগতো না। কয়েকটা সিকোয়েন্সের কম্পোজিশন অসাধারণ ছিল। যেমন :

আলো-আঁধারির মাঝে লাঠি খেলা (এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য। কারণ এর পরে চরিত্রগুলোর আঁধার ফুড়ে একটা রেভেলেশন আসে)। বাবুর ঘরে আকবর আর বিন্তির একটা দৃশ্য হলদে মায়া ছড়িয়েছে। অথবা ফ্ল্যাশব্যাকে বৃষ্টির দৃশ্য আর অতি অবশ্যই শেষ দৃশ্য। আকবর যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে জনগণের কল্যাণের কথা বলছিল; তখন তারই আদেশে রাজ নির্দোষ এক ফটোগ্রাফারকে মেরে ফেলছিল। অনিমেষ আইচ কানে শঙ্খ নিয়ে সমুদ্রের ডাক শুনতে পায়। ফ্ল্যাশব্যাকের একটি দৃশ্যে ক্যামেরা প্রথমে পয়েন্ট অফ ভিউ আর পরে সাবজেক্টকে ফলো করে যায়। এমন সব চমৎকার বৈপরীত্য আর দৃশ্যকল্প পরিচালকের ভাল ফিল্ম সেন্সের প্রমাণ।

তবে কিছু বিষয় ভাল লাগেনি। ওপেনিং ক্রেডিটসে পরিচালক শব্দটার বানান ভুল ছিল। এমন মানসম্মত প্রোডাকশনে “পযরিচালনা” শব্দটা দেখতে ভাল লাগেনি। কিডন্যাপিং এর দৃশ্যটা, আকবরকে ঢাকা শহরে নিয়ে ঘোরার দৃশ্যগুলো আরো বিশ্বাসযোগ্যভাবে দেখান যেত। আকবরের নির্বাচনী এলাকা পোস্টারে লেখা ছিল ২০ আর বাসার সামনের ব্যানারে লেখা ছিল ২৫। বাবু যখন র‌্যানসাম নোট টাইপ (অথবা চিঠি) করায়, টাইপিস্টের মুখে কোন ভাবান্তর দেখা যায় না। এটা বেশ অস্বাভাবিক। চিঠি লেখার পর বাবু তাকে কোন টাকা না দিয়েই চলে যায়। আকবরের ফ্ল্যাশব্যাকে তার পরনে চকচকে নতুন লুঙ্গি, গামছা চোখে লেগেছে। কারণ আকবরের অর্থনৈতিক অবস্থার সেটা একদমই যায় না। আরেকটি বড় সমস্যা হল, পরিচালক কোন প্রকার ভূমিকা ছাড়াই মুভি শুরু করেছেন। তাই যারা বাবুর সম্পর্কে আগে থেকে জানে না, গল্পটা বুঝে উঠতেই তাদের ছবির প্রথমার্ধ কেটে যায়।

ছবিতে বেশ কিছু মেটাফরের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। ছবির অধিকাংশ সময় জুড়ে আকবরের গলায় টাই, শেকল আর সিমেন্টের স্ল্যাব দেখি। যা কিনা আকবরের মিছে সম্ভ্রান্ততা আর সারা জীবনের পাপের প্রতীক। তাই ব্যক্তি আকবর মানসিক বিবর্তনের সাথে সাথে টাই, শেকল আর স্ল্যাবও একে একে হারিয়ে যেতে থাকে। আকবরের চরিত্রে একই সাথে “ইমানসিপেশন ও ইলুমিনেশন অফ মাইন্ড” পায়। আকবর এর প্রতিবিম্ব হল মাছ। সে অনিমেষের কাছে সূত্র রেখে যায় কৈ মাছ দিয়ে। কারণ পরবর্তীতে আকবর নিজেই বলে যে মরে না (কৈ মাছের প্রাণ আর কি)। ছবির শেষে আমরা আরও একবার সে কথার প্রমাণ পাই। বাল্মীকি চরিত্রটাকে কিছুটা অন্তর্দর্শী হিসেবে আনা হয়েছে। সে প্রথমে আকবর এর মাঝে মাছের গন্ধ পায়। আবার রাজকে কুকুর বলে ঠাওরায়। ভ্যানের দরজা খুলে মিনা যেন আকবরের স্মৃতির দরজা খুলে দেয়। অথবা মুক্তি দেয় দুঃস্বপ্নময় বর্তমান থেকে। পরিচালক রিয়ালিটি নিয়ে কিছু খেলা খেলেছেন। এই খেলার ফলাফল দর্শকভেদে আলাদা হওয়াটা স্বাভাবিক। ছবিতে বেশ কিছু হোমেজ-ও দেখলাম। যেমন : আকবরকে গুলি করার দৃশ্যটা যেমন ফাইট ক্লাবকে মনে করিয়ে দিল। তেমনি আকবরের বিয়ের আংটি নিয়ে খেলা করাটা বিফোর সানসেটের শেষ দৃশ্যের জুলি ডেলপিকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল।



ছবিতে কোন গান না থাকলেও জেকব জোফির মিউজিক ছবির দ্যোতনা বজায় রেখে গল্পের টোনকে আরও সুদৃঢ় করেছে। বিশেষ করে লাল মিঞার র‌্যাপেরগুলো দারুণ উপযোগী ছিল। ছবির কলা-কুশলীদের মাঝে যে পূর্ব আর পশ্চিমের মেলবন্ধন রয়েছে আবহ সঙ্গীতে ফিউশনের উপস্থিতি সে কথায় শব্দে শব্দে জানান দিচ্ছিল। তবে, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের নীচে অনেকসময়ই ছবির সংলাপ চাপা পড়ে যাচ্ছিলো। বেশি কিছু সংলাপ তো কান পেতেও বোঝা গেল না। এটা বেশ বিরক্তিকর অংশ ছিল।



বাবু চরিত্রে শাহেদ আলী আর আকবর চরিত্রে শাকিল আহমেদ ভালো করেছেন। তবে, তাদের অভিনয়ের গ্রাফটা খুব ওঠা-নামা করছিল। বিশেষ করে অনেকগুলো ডায়ালগ ডেলেভারীর সময় কোন কারণ ছাড়াই গলার স্বরটা চড়ে একটা থিয়েটারী ভঙ্গি চলে আসছিল। নিজের রবিন হুড নাম নিয়ে বাবুর মাঝে এক ধরণের আত্নতুষ্টি কাজ করে। এই রবিন হুডকে আরেকটু চৌকস দেখালে ভাল হত। আর বাবু যেহেতু আগেও অনেক “কিডন্যাপ” করেছে, তার চরিত্রটা আরও ডিসক্রিট হতে পারতো। মজার ব্যাপার হল, তুলনামূলকভাবে ছোট চরিত্রগুলোয় (সাপোর্টিং কাস্ট) যারা ছিলেন তারা দুর্দান্ত কাজ করেছেন। অনিমেষ আইচের চরিত্রটা খুব স্ট্রং একটা চরিত্র হতে পারত। অনিমেষের অ্যাপিয়ারেন্স, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দারুণ এক খুনে চরিত্রের সম্ভাবনা দেখিয়েছিল। কিন্তু পরিচালক সেদিকে খুব একটা মনোযোগ দেননি। নওশাবা, শাহীন আকতার, ঈথিলাকে তাদের চরিত্রে খুব প্রাণবন্ত লেগেছে।



মানুষ চাইলেও সব মুছে উধাও হতে পারে না। না আগের জীবন থেকে আর না এখনকার জীবন থেকে। ছবির শেষ দৃশ্য তাই ট্যাগলাইনটিকেই আরেকবার মনে করিয়ে দেয়, “Escape is not an option”। শেষে এসে কি হবে তার ক্লু পরিচালক অনেকবারই দিয়েছেন। আকবর তো বরাবরই জুয়াড়ী। জয় না পেলে, বাজিমাৎ না করে সে মাঠ ছাড়ে না। হোক সে নদীর পাশে জুয়ার আসর অথবা গলফের মাঠ কিংবা সংসদ নির্বাচন। স্ত্রীকে কথা দিয়েছিল নির্বাচনে জেতার পর নিজের সব গুন্ডাকে সরিয়ে দিবে। তাইতো রাজের মরতে হয়। আকবর সৈকতে দাঁড়িয়ে থাকে তার আগেকার সম্ভ্রান্ত পোষাকে। বারবার বলে ওঠে “হয় মারতে হইবো, নয় মরতে হইবো”। মানুষ তো পালিয়ে নিস্তার পায় না। তা সে অতীতের কৃতকর্মের থাবা অথবা বর্তমানকে গ্রাস করা পিশাচই হোক না কেন। আর শেষে এসে আলো আর চরিত্রগুলোর পোশাক সর্বোপরি ইল্যুশন অফ ডেপথ তৈরী করে পরিচালক শিল্পিত ভঙ্গিতে আমাদের মিজ-অঁন-সেনের সার্থক ব্যবহার দেখান।



উধাও নিয়ে যারা হলিউড মানের প্রোডাকশন আশা করেছিলেন তাদের অনেকেই হয়ত হতাশ হবেন, মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখাবেন । কিন্তু বাস্তবতা হল আমাদের তুলনীয় পরিমাপক হওয়া উচিৎ বাংলাদেশের এখনকার ছবি। মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি না, প্যারালাল সিনেমা বা আর্ট ফিল্ম (যে নামেই ডাকি না কেন) এর তুলনায় উধাও ছবির উপস্থাপনা খুবই প্রশংসনীয়। এখন অনেক নতুন পরিচালকরা আসছেন। আশা থাকবে অমিত আশরাফরা যেন উধাও না হয়ে যান। এমন ছবির যেমন দর্শক আছে, তেমনি দর্শকের জন্যও এমন ছবির প্রয়োজন আছে।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.