নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নীরবে নির্জনে যন্ত্র-অরণ্যে

আপাতত রেস্টে আছি! :)

স্নিগ

আমি একদিন মারা যাব, এই সত্যটা নিয়ে আমার খুব বেশি আক্ষেপ নেই। তবে, আমার মৃত্যুর পর আরও অসংখ্য অসাধারণ সব বই লেখা হবে, গান সৃষ্ট হবে, চলচিত্র নির্মিত হবে।কিন্তু আমি সে সব পড়তে, শুনতে কিংবা দেখতে পারবো না।এই সত্যটা আমাকে খুব যন্ত্রণা দেয়।

স্নিগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অভাগিনী চন্দ্রাবতী

০৬ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ১০:১৫

চন্দ্রাবতী-"প্রথম বাঙালি মহিলা কবি", প্রাথমিকভাবে তার এই পরিচয়টাই আমরা জানি। তার রচিত কাব্যগ্রন্থগুলির মাঝে আছে : মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা আর রামায়ণ। তবে আজকের গল্প (নাকি পালা বলবো) কবি চন্দ্রাবতীকে নিয়ে নয়, অভাগিনী চন্দ্রাবতীকে নিয়ে।

বাংলায় যে সকল পালা রচিত হয়েছে, তার উৎকৃষ্ট এক সংকলন পূর্ববঙ্গ-গীতিকা। এর সংকলক হিসেবে আমরা ড. দীনেশচন্দ্র সেনকে একনামে জানি। সংকলনের সূচনার সাথেই কিন্তু জড়িয়ে আছেন কবি চন্দ্রাবতী। ড. সেন বাংলার এই অমূল্য রত্নগুলোর সম্পর্কে আগ্রহী হন ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত "সৌরভ" পত্রিকার একটা লেখা পড়ে। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত "মহিলা কবি চন্দ্রাবতী" শীর্ষক সেই প্রবন্ধটি লিখেছিলেন চন্দ্রকুমার দে। কবি চন্দ্রাবতীর কেনারামের পালা'র সারাংশ ছিল সেখানে। ড. সেন উৎসাহ নিয়ে খুঁজতে থাকেন পালার পরিপূর্ণ কাব্যরূপকে। কিন্তু এসব পালা যে কোথাও লেখা নাই। তৎকালীন বাঙালী সমাজ প্রমিত ভাষার বলে বলীয়ান হয়ে পশ্চিমা সাহিত্য তোষণে ব্যস্ত (এর একটা খন্ডচিত্র পাওয়া যায় মাইকেলের "একেই কি বলে সভ্যতা" প্রহসনে)। সুতরাং ড. সেনকে "মূর্খ চাষাদের গান" নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত হতে দেখে, অনেকেই বিশেষ বিরক্ত হলেন।

ড. সেন এবার চন্দ্রকুমার দে'র খোঁজ করতে শুরু করেন। জানা যায়, চন্দ্রকুমার অতি দরিদ্র ঘরের ছেলে; নিজ চেষ্টায় বাংলা লিখতে শিখেছেন। তিনি এক সময় মুদি দোকানে চাকরি করতেন। কিন্তু কিছুদিন পর সে চাকরি চলে যায়। এরপর নেত্রকোনা জেলার রাঘবপুর গ্রামের তারানাথ তালুকদারের অধীনে তহশিলদারের চাকরি জুটে। সেই চাকরিসূত্রেই এই পালা গানের সংস্পর্শে আসেন চন্দ্রকুমার। কিন্তু বর্তমানে তিনি মানসিক রোগে আক্রান্ত। প্রবন্ধ প্রকাশের ৬ বছর চন্দ্রকুমার দে'র সাথে দীনেশচন্দ্র সেনের দেখা হয়। স্ত্রীর রুপার গহনা বিক্রি করে তিনি কলকাতা আসবার খরচ যোগাড় করেন। শুরু হয় পূর্ববঙ্গ-গীতিকার কাজ। ১৯২৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থসাহায্যে তা প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ড. সেন Eastern Bengal Ballads নামে ইংরেজীতে অনুবাদ করেন। রূপান্তরিত সেই বইটি পড়ে পশ্চিমা সমালোচকরা যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছিলেন।

এবার আসি চন্দ্রাবতীর কথায়। চন্দ্রাবতী ১৫৫০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম দ্বিজ বংশী দাস, মায়ের নাম সুলোচনা। দ্বিজ বংশী দাসের বাসস্থান ছিল কিশোরগঞ্জ জেলার পাটোয়ারী গ্রামে (বানানভেদে পাঠবাড়ী বা পাতুয়ার-ও বলা হয়েছে)। চন্দ্রাবতীর বাবা দ্বিজ বংশী নিজেও কবি ছিলেন। স্বরচিত রামায়ণে চন্দ্রাবতী নিজের পরিচয় বর্ণনা করেছেন এভাবে :

ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়।
বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়।।
...
দ্বিজবংশী পুত্র হৈল মনসার বরে।
ভাসান গাইয়া যিনি বিখ্যাত সংসারে।।
...
বাড়াতে দারিদ্র-জ্বালা কষ্টের কাহিনী।।
তাঁর ঘরে জন্ম নিলা চন্দ্রা অভাগিনী।।

চন্দ্রাবতীকে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি বলা হলেও, তার পূর্ববর্তী আরও তিনজন মহিলা কবির নাম পাওয়া যায়। এরা হলেন : খনা, রামী বা রজকিনী ও মাধবী। তবে, চন্দ্রাবতীর যে প্রথম বাংলাদেশী মহিলা কবি, সেটা নিয়ে কোনই সংশয় নেই। ড. দীনেশচন্দ্র সেন ১৯৩২ সালে (পূর্ববঙ্গ-গীতিকার চতুর্থ খণ্ডের ২য় ভাগে) চন্দ্রাবতীর রামায়ণ প্রকাশ করেন। বর্তমানে এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে। ড. সেনের মতে, মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্যে চন্দ্রাবতীর ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। চন্দ্রাবতীর রামায়ণকে অনেকে দুর্বল ও অসমাপ্ত বলে আখ্যায়িত করেন। পরবর্তীতে নবনীতা দেব সেন এই রামায়ণকে দুর্বল বা অসমাপ্ত কোনাটিই নয় বলে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তার ভাষায় : "এটি একজন নারীর দ্বারা রচিত কাব্য যেখানে রামের গুণগান না করে, তিনি সীতার দুঃখ ও দুর্দশার দিকটাই বেশী তুলে ধরেছিলেন। যা তৎকালীন পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধাচরণ হিসেবে দেখা হয়েছিল।" নবনীতা সেন এই রামায়ণের ইংরেজী অনুবাদও করেছেন।

২০১৫ সালে দ্বিজ কানাই প্রণীত মহুয়া অবলম্বনে ছবি নির্মাণ করেছিলেন রওশন আরা নীপা। এবার এন রাশেদ চৌধুরী নয়ানচাঁদ ঘোষের চন্দ্রাবতী পালা অবলম্বনে নির্মাণ করছেন চলচ্চিত্র ‘চন্দ্রাবতী কথা’। এতে কবি চন্দ্রাবতী চরিত্রে অভিনয় করবেন মডেল ও অভিনেত্রী দিলরুবা হোসেন দোয়েল। ড: সেন এই পালাটিকে ১২টি অঙ্কে ভাগ করেছেন। চলুন চলে যাই চন্দ্রাবতীর গল্পে। তার আগে একটি কথা বলে রাখি, পালার কথাগুলো পুঁথির সুরে পড়লে অনেক বেশি উপভোগ করবেন। হয়তোবা হারিয়ে যাবেন সন্ধ্যাবেলায় বাংলার কোন এক উঠোনে। এই সুরগুলো বাংলার আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে হাজার বছর ধরে।

ফুল-তোলা

একদিন ভোর বেলা পূজার ফুল তুলতে গেলে, চন্দ্রার সাথে দেখা হয় জয়ানন্দর। জয়ানন্দ অনাথ। বাস করেন মামার বাসায়, সুন্ধা গ্রামে।

“চাইরকোনা পুষ্কুনির পারে চম্বা নাগেশ্বর।
ডাল ভাঙ্গ পুষ্প তুল কে তুমি নাগর।।”
“আমার বাড়ী তোমার বাড়ী ঐ না নদীর পার।
কি কারণে তুল কন্যা মালতীর হার।।”

“প্রভাতকালে আইলাম আমি পুষ্প তুলিবারে।
বাপেত করিব পূজা শিবের মন্দিরে।।”

এভাবেই হলো পরিচয়। তারা দুজনেই তখন ছোট। খেলার সাথী থেকে হলেন বন্ধু, কৈশরে সে বন্ধুত্ব রূপ নিলো ভালোবাসায়। সে সময় তারা দুজনেই কবিতা লিখতেন। দ্বিজবংশীর পদ্মপুরাণে দুজনের রচিত ছোট ছোট কিছু পদ পাওয়া যায়

এক দুই তিন করি ক্রমে দিন যায়।
সকালসন্ধ্যা ফুল তুলে কেউনা দেখতে পায়।।
ডাল যে নোয়াইয়া ধরে জয়ানন্দ সাথী।
তুলিল মালতী ফুল কন্যা চন্দ্রাবতী।।
একদিন তুলি ফুল মালা গাঁথি তায়।
সেইত না মালা দিয়া নাগরে সাজায়।।



প্রেমলিপি

একদিন ফুলের পাপড়িতে আড়াই অক্ষরে চিঠি লিখলেন জয়ানন্দ। (আড়াই অক্ষর শব্দটির অর্থ "অতি সংক্ষেপে"। আড়াই অক্ষরে মন্ত্রের কথা অনেক প্রাচীন বাংলা পুঁথিতেই আছে। ময়মনসিংহের গীতি-কাব্যগুলির মধ্যে অনেক জায়গাতেই আড়াই অক্ষরে লিখিত চিঠির কথা পাওয়া যায়।)

পরথমে লিখিয়া পত্র চন্দ্রার গোচরে।
পুষ্পপাতে লেখে পত্র আড়াই অক্ষরে।।
পত্র লেখে জয়ানন্দ মনের যত কথা।
“নিতি নিতি তোলা ফুলে তোমার মালা গাঁথা।।
...
কইতে গেলে মনের কতা কইতে না জুয়ায়।
সকল কথা তোমার কাছে কইতে কন্যা দায়।।
আচারি তোমার বাপ ধর্ম্মেকর্ম্মে মতি।
প্রাণের দোসর তার তুমি চন্দ্রাবতী।।
মাও নাই বাপ নাই থাকি মামার বাড়ী।
তোমার কাছে মনের কথা কইতে নাহি পারি।।
যেদিন দেখ্যাছি কন্যা তোমার চান্দবদন।
সেইদিন হইয়াছি আমি পাগল যেমন।।
তোমার মনের কথা আমি জানতে চাই।
সর্ব্বস্ব বিকাইবাম পায় তোমারে যদি পাই।।
...
তুমি যদি লেখ পত্র আশায় দেও ভর।
যোগল পদে হইয়া থাকবাম তোমার কিঙ্কর।।”

পত্র দেওয়া

পরদিন ভোরে চন্দ্রা ফুল তুলতে গেলে, জয়ানন্দ তার হাতে প্রেমপত্র তুলে দিলেন। এদিকে চন্দ্রার বাবা পূজার ফুলের অপেক্ষায় আছেন। তাই চন্দ্রাবতী যত দ্রুত সম্ভব চিঠি নিয়ে বাড়ী চলে যেতে হলো।

আবে করে ঝিলিমিলি সোণায় বরণ ঢাকা।
প্রভাতকালে আইল অরুণ গায়ে হলুদ মাখা।।
হাতেতে ফুলের সাজি কন্যা চন্দ্রাবতী।
পুষ্প তুলিতে যায় পোষাইয়া রাতি।।
...
হেনকালে নাগর আরে কোন কাম করে।
পুষ্পপাতে লইয়া পত্র কন্যার গোচরে।।
...
পত্র নাইসে নিয়া কন্যা কোন কাম করে।
সেইক্ষণ চল্যা গেল আপন বাসরে।।

বংশীর শিবপূজা, কন্যার জন্য বরকামনা


এদিকে চন্দ্রার বাবা পূজায় বসেছেন, মেয়ের জন্য ভালো বরের প্রার্থনায়।

...
পূজা করে বংশীবদন শঙ্করে ভাবিয়া।
চিন্তা করে মনে মনে নিজ কন্যার বিয়া।।
“এত বড় হইল কন্যা না আসিল বর।
কন্যার মঙ্গল কর অনাদি শঙ্কর।।
বনফুলে মনফুলে পূজিব তোমায়।
বর দিয়া পশুপতি ঘুচাও কন্যাদায়।।
...
বর মাগে বংশীদার ভূমিতে পড়িয়া।
“ভাল ঘরে ভাল বরে কন্যার হউক বিয়া।।”

চন্দ্রার নির্জ্জনে পত্রপাঠ

চন্দ্রা চিঠি পড়ে নীরবে কাঁদতে থাকে। জয়ানন্দকে সে ভালোবাসে, কিন্তু বাবাকে এ কথা কিভাবে জানাবে? তাই ঈশ্বরের কাছে জয়ানন্দকে স্বামী হিসেবে প্রার্থনা করে, চিঠির জবাব পাঠায় চন্দ্রাবতী।

পূজার যোগার দিয়া কন্যা নিরালায় বসিল।
জয়ানন্দের পুষ্পপাত যতনে খুলিল।।
পত্র পইড়ে চন্দ্রাবতীর চক্ষে বয়ে পানি।
কিবা উত্তর দিব কন্যা কিছুই না জানি।।
...
কিমতে লিখিব পত্র বাপ আছে ঘরে।
ফুল তুলে জয়ানন্দ ভালবাসি তারে।।
ছোট হইতে দেখি তারে প্রাণের দোসর।”
সেই ভাবে লেখে কন্যা পত্রের উত্তর।।
...
যত না মনের কথা রাখিল গোপনে।
পত্রখানি লেখে কন্যা অতি সাবধানে।।
...
শিবের চরণে কন্যা উদ্দেশে করে নতি।
পত্র পাঠাইয়া দিল কন্যা চন্দ্রাবতী।।

নীরবে হৃদয় দান

চন্দ্রা একদিকে মন দিয়ে বসেছে জয়ানন্দকে। অন্যদিকে চন্দ্রার বিয়ে ঠিক করছেন তার বাবা।

বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে মল্লিকা-মালতী।
জন্মে জন্মে পাই যেন তোমার মতন পতি।।
...
এইরূপে কান্দে কন্যা নিরালা বসিয়া।
মন দিয়া শুন কথা চন্দ্রাবতীর বিয়া।।

বিবাহের প্রস্তাব ও সম্মতি

এদিকে ঘটক এসে চন্দ্রাবতীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। দ্বিজ বংশী নিজে কুলীন বংশের। তাই পাত্রও দরকার সদবংশের।

একদিন ত না ঘটক আইল ভট্টাচার্য্যের বাড়ী।
“তোমার ঘরে আছে কন্যা পরমা সুন্দরী।।
বয়স হইল কন্যা রূপে বিদ্যাধরী।
ভাল বরে দেও বিয়া ঘটকালি করি।।”

“কেবা বর কিবা ঘর কহ বিবরণ।
পছন্দ হইলে দিব মনের মতন।।”

ঘটক কহিল “সুন্ধা” গ্রামে ঘর।
চক্রবর্ত্তী বংশে খ্যাতি কুলিনের ঘর।।
জয়ানন্দ নাম তাঁর কার্ত্তিক কুমার।
সুন্দর তোমার কন্যা যোগ্য বর তার।।
...
কুষ্টিতে মিলিছে ভাল যখন এই বরে।
এই বরে কন্যাদান করিব সুস্থরে (অবশ্যই)।।”

পাত্র আর কেউ নয়, চন্দ্রার প্রেমিক জয়ানন্দ চক্রবর্তী। দুজনের কুষ্ঠি মিলিয়ে রাজি হয়ে গেলেন দ্বিজ বংশী দাস।


বিবাহের আয়োজন

বিয়ের দিন ধার্য হলো। শুরু হলো বিয়ের সব আচার অনুষ্ঠান।

সম্বদ্ধ হইল ঠিক করি লগ্ন স্থির।
ভাল দিন হইল ঠিক পরে বিবাহের।।
...
চুরপানি ভরে সবে উঠিয়া প্রভাতে।
গীত জুকার যত হইল বিধিমতে।।
আব্যধিক করে বাপে মণ্ডপে বসিয়া।
তার মাটি কাটে যত সধবা মিলিয়া।।
...
আগে চলে কন্যার মায় ডালা মাথায় লইয়া।
তার পাছে কন্যার খুড়ি লোটা হাতে লইয়া।।
তার পরে যত নারী গীত জুকারে।
সোহাগ মাগিল কত বাড়ী বাড়ী ফিরে।।

অন্য মেয়ের সাথে সাথে জয়চন্দ্রের ভাব

এদিকে হঠাৎ করেই জয়ানন্দের মাথা বিগড়ালো। সে প্রেমে পড়লো আসমানী নামের এক মুসলমান মেয়ের। শুধু তাই না, হিজল গাছের মূলে একটা প্রেমপত্রও লিখে আসলো।

পরথমে হইল দেখা সুন্ধা নদীর কূলে।
জল ভরিতে যায় কন্যা কলসী কাকালে।।

“কে তুমি সুন্দরী কন্যা জলের ঘাটে যাও।
আমি অধমের পানে বারেক ফির‍্যা চাও।।
নিতি নিতি দেখ্যা তোমায় না মিটে পিয়াস।
প্রাণের কথা কও কন্যা মিটাও মনের আশ।।

“সাক্ষী হইও ইজল গাছ নদীর কূলে বাসা।
তোমার কাছে কইয়া গেলাম মনের যত আশা।।
এইখান আসিব কন্যা সুন্দর আকার।
এই পত্র দেখাইও আমার সমাচার।।


হাতেতে ফুলের সাজি কপালে তিলক-ছটা।
ফুল তুলিতে যায় কুমার মনে বিন্ধ্যা কাঁটা।।

দুঃসংবাদ

বিয়ের দিন। চারদিকে বাজনা বাজছে। চন্দ্রাবতী বিয়ের সাজে জয়ানন্দের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু সন্ধ্যা নামার পরেও জয়ানন্দ আসেনি। এমন সময় খবর এলো, জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হয়ে আসমানীকে বিয়ে করেছে। বাজনা থেমে গেল। লগ্নভ্রষ্টা চন্দ্রার জীবনে নেমে এলো আধাঁর।

পুরীতে জুড়িয়া উঠে কান্দনের রোল।
জাতিনাশ দেখ্যা ঠাকুর হইল উতরুল।।
“কপালের দোষ, দোষ নহে বিধাতার।
যে লেখ্যা লেখ্যাছে বিধি কপালের আমার।।

চন্দ্রার অবস্থা

অধিক শোকে চন্দ্রা যেন এখন পাথর। খায় না, ঘুমায় না; পাগল হতে বসেছে।

“কি কর লো চন্দ্রাবতী ঘরেতে বসিয়া।”
সখিগণ কয় কথা নিকটে আসিয়া।।
শিরে হাত দিয়া সবে জুড়য়ে কান্দন।
শুনিয়া হইল চন্দ্রা পাথর যেমন।।
না কান্দে না হাসে চন্দ্রা নাহি বলে বাণী।
আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষাণী।।

এক দিন দুই দিন তিন দিন যায়।
পাতেতে রাখিয়া কন্যা কিছু নাহি খায়।।
...
সেই হাসি সেই কথা সদা পড়ে মনে।
ঘুমাইলে দেখিব কন্যা তাহারে স্বপনে।।
নয়নে না আসে নিদ্রা অঘুমে রজনী।
ভোর হইতে উঠে কন্যা যেমন পাগলিনী।।

এদিকে বাবা চন্দ্রার জন্য আবার ছেলে দেখছেন। কিন্তু চন্দ্রা আর বিয়ে করতে চায় না। তিনি বাবার কাছে দুটো জিনিস চাইলেন। ফুলেশ্বরী নদীর তীরে শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করার অনুরোধ। আর বাকি জীবন চিরকুমারী থেকে শিবের সাধনায় নিয়োজিত থাকার অনুমতি।

চন্দ্রাবতী বলে “পিতা, মম বাক্য ধর।
জন্মে না করিব বিয়া রইব আইবর।।
শিবপূজা করি আমি শিবপদে মতি।
দুঃখিনীর কথা রাখ কর অনুমতি।।”

অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে।
“শিবপূজা কর আর লেখ রামায়ণে।।”

বাবা দুটো অনুরোধই রাখলেন। সেই সাথে বললেন রামায়ণ লিখতে। কিশোরগঞ্জে ফুলেশ্বরী নদীর ধারে চন্দ্রাবতীর সেই শিব মন্দিরটি এখনো আছে। নদীটির স্থানীয় নাম ফুলিয়া। হুমায়ূন আহমেদের "চলে যায় বসন্তের দিন" বইতে একটি চরিত্রের নাম ছিলো ফুলফুলিয়া। মজার ব্যাপার হলো, হিমু প্রথমে ভেবেছিল মেয়েটার আসল নাম ফুলেশ্বরী নদীর নামে রাখা।

শেষ

মন্দির নির্মিত হলো। চন্দ্রাবতী সেখানে পূজা করেন আর অবসরে রামায়ণ লিখেন।

নির্ম্মাইয়া পাষাণশিলা বানাইলা মন্দির।
শিবপূজা করে কন্যা মন করি স্থির।।
অবসরকালে কন্যা লেখে রামায়ণ।
যাহারে পড়িলে হয় পাপ বিমোচন।।

এভাবেই কাটছিল দিন। একদিন চন্দ্রাবতীর কাছে চিঠি এলো। পত্রলেখক আর কেউ নয়- জয়ানন্দ।

এমন কালেতে শুন হইল কোন কাম।
যোগাসনে বৈসে কন্যা লইয়া শিবের নাম।।

এই পত্রে লিখিয়াছে দুঃখের ভারতী।
জয়ানন্দ দিছে পত্র শুন চন্দ্রাবতী।
পত্রে পড়িল কন্যা সকল বারতা।
পত্রেতে লেখ্যাছে নাগর মনের দুঃখকথা।।

“শুনরে প্রাণের চন্দ্রা তোমারে জানাই।
মনের আগুনে দেহ পুড়্যা হইছে ছাই।।
অমৃত ভাবিয়া আমি খাইয়াছি গরল।
কন্ঠেতে লাগিয়া রইছে কাল-হলাহল।।

জলে বিষ বাতাসে বিষ না দেখি উপায়।
ক্ষমা কর চন্দ্রাবতী ধরি তোমার পায়।।

শিশুকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের মালা।
তোমারে দেখিতে কন্যা মন হইল উতালা।।

এই দেখা চক্ষের দেখা এই দেখা শেষ।
সংসারে নাহিক আমার সুখশান্তির লেশ।।
একবার দেখিয়া তোমার ছাড়িব সংসার।
কপালে লেখ্যাছে বিধি মরণ আমার।।”

চিঠি পড়ে চন্দ্রার মন গলে গেল। বাবা দ্বিজ বংশীর কাছে গেলেন অনুমতি চাইতে।

পত্র পড়ি চন্দ্রাবতী চক্ষের জলে ভাসে।
শিশুকালের স্বপ্নের কথা মনের মধ্যে আসে।।

“শুন শুন বাপ আগো শুন মোর কথা।
তুমি সে বুঝিবে আমি দুঃখিনীর ব্যথা।।
জয়ানন্দ লেখে পত্র আমার গোচরে।
তিলেকের লাগ্যা চায় দেখিতে আমারে।।”

কিন্তু বাবা বাধা সাধলেন। যার কারণে মেয়ে এত কষ্ট পেয়েছেন, তাকে দেখা দেবার প্রশ্নই ওঠে না।

“শুন গো প্রাণের কন্যা আমার কথা ধর।
একমনে পূজ তুমি দেও বিশ্বেশ্বর।।
অন্য কথা স্থান কন্যা নাহি দিও মনে।
জীবন মরণ হইল যাহার কারণে।।

তুমি যা লইছ মাগো সেই কাজ কর।
অন্য চিন্তা মনে স্থান নাহি দিও আর।।

দেখা হবে না জানিয়ে চিঠি লিখলেন চন্দ্রা। তারপর মন্দিরের দরজা বন্ধ করে মগ্ন হলেন পূজায়। এদিকে চিঠি পেয়ে উল্টোটাই হলো। এক সন্ধ্যায় দুজনের বিচ্ছেদ হয়েছিল, আরেক সন্ধ্যায় দুজনের মিলন হবে ভেবে জয়ানন্দ পাগলপারা হয়ে ছুটে এলো দেখা করতে।

পত্র লিখি চন্দ্রাবতী জয়ের গোচরে।
পুষ্পদূর্ব্বা লইয়া কন্যা পশিল মন্দিরে।
শুকাইল আঁখির জল সর্ব্ব চিন্তা দূরে।
একমনে পূজে কন্যা অনাদি শঙ্করে।।

শান্তিতে আছয়ে কন্যা একনিষ্ঠ হইয়া।
আসিল পাগল জয়া শিকল ছাড়িয়া।।
“দ্বার খোল চন্দ্রাবতী তোমারে শুধাই।
জীবনের শেষ তোমায় একবার দেখ্যা যাই।।
আর না দেখিব তোমায় নয়ন চাহিয়া।
দোষ ক্ষমা কর কন্যা শেষ বিদায় দিয়া।।”

কপাটে আঘাত করে শিরে দিয়া হাত।
বজ্রের সমান করে বুকেতে নির্ঘাত।।
যোগাসনে আছে কন্যা সমাধিশয়নে।
বাহিরের কথা কিছু নাহি পশে কানে।।

পাগল হইল জয়ানন্দ ডাকে উচ্চৈস্বরে।
“দ্বার খোল চন্দ্রাবতী দেখা দেও আমারে।।
না ছুঁইব না ধরিব দূরে থাক্যা খাড়া।
ইহজন্মের মতন কন্যা দেও মোরে সাড়া।।

কিন্তু চন্দ্রার কানে এসব আহাজারির কিছুই যায় না। হতাশ হয়ে জয়ানন্দ সন্ধ্যামালতী ফুলের রস দিয়ে মন্দিরের দরজায় চার লাইনের একটি কবিতা লিখে যায়।


“শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী।।
পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত।
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত।।”

এক সময় ধ্যান ভাঙে চন্দ্রাবতীর। বুঝতে পারেন মন্দিরে কেউ এসেছিল। মন্দিরকে পবিত্র করতে পানির প্রয়োজন। কলসী নিয়ে নদীর ধারে যান চন্দ্রাবতী। সেখানে গিয়ে দেখেন এক অদ্ভূত দৃশ্য।

ধ্যান ভাঙ্গি চন্দ্রাবতী চারিদিকে চায়।
নির্জন অঙ্গন নাহি কারে দেখতে পায়।।

কপাটে আছিল লেখা পড়ে চন্দ্রাবতী।
অপবিত্র হইল মন্দির হইল অধোগতি।
কলসী লইয়া জলের ঘাটে করিল গমন।
করিতে নদীর জলে স্নানাদি তর্পণ।।
জলে গেল চন্দ্রাবতী চক্ষে বহে পানি।
হেনকালে দেখে নদী ধরিছে উজানি।।
একেলা জলের ঘাটে সঙ্গে নাহি কেহ।
জলের উপরে ভাসে জয়ানন্দের দেহ।।

আঁখিতে পলক নাহি মুখে নাই সে বাণী।
পারেতে খাড়াইয়া দেখে উমেদা কামিনী।।

স্বপ্নের হাসি স্বপ্নের কান্দর নয়ান্ চান্দে গায়।
নিজের অন্তরের দুস্কু পরকে বুঝান দায়।।



*অভাগিনী চন্দ্রাবতীর উপাখ্যান এখানেই শেষ। লোকে বলে, জয়ানন্দের সাথে সাথে চন্দ্রাও সেদিন জীবন বিসর্জন দিয়েছিল। আপনার যে সমাপ্তিটা ভালো লাগে, সেটাই বেছে নিন।

**লেখায় প্রচুর ভুল থাকার কথা, সম্ভবত আছেও। এর সম্পূর্ণ দায় অক্ষম অনুলিপিকারের।

সবার জীবন আনন্দময় হোক!
ঈদ মোবারক!!


মন্তব্য ৯ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ১১:০৬

শায়মা বলেছেন: চন্দ্রাবতী উপাখ্যান আর চন্দ্রাবতী নিয়ে এই পোস্ট অনেক অনেক ভালো লাগলো ভাইয়া!:)

১৫ ই জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৭

স্নিগ বলেছেন: ধন্যবাদ শায়মাপু! :D

২| ০৭ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ১:১৯

হাসান মাহবুব বলেছেন: সময় করে পড়ে নেবো। শুভ ঈদ।

১৫ ই জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৮

স্নিগ বলেছেন: ওকে বস!

৩| ০৭ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ১:২৩

মানসী বলেছেন: একসময়ে এই পালাগুলিই ছিল আমাদের বিনোদন এবং মানসিক উদযাপনের অন্যতম মাধ্যম। আমাদের আধুনিক প্রজন্মকেও এই ভিত্তি গুলো জানতে হবে, কারণ শিকড় ছাড়া গাছ হয় না। সেই জন্যে আপনার এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।

পোস্টে ++++++++

১৫ ই জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪১

স্নিগ বলেছেন: ধন্যবাদ, মানসী!

৪| ০৭ ই আগস্ট, ২০১৬ ভোর ৫:৫৬

ডঃ এম এ আলী বলেছেন: অনেক গবেষনালব্দ লিখা এটি । আনেক লম্বা সময় নিয়ে পাঠ করেছি ।
খুব সুন্দরভাবে চন্দ্রাবতি ও তার রচনাকারীদের ফুটিয়ে
তুলেছেন । আমি মুগ্ধ হয়েছি লিখাটিতে ।
শুভেচ্ছা রইল ।

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৬

স্নিগ বলেছেন: অনেক, অনেক ধন্যবাদ!

৫| ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৫:৫৬

ভ্রমরের ডানা বলেছেন:
লেখায় কিছু টাইপো দেখছি। ঠিক করে নিয়েন। শুভকামনা!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.