নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাবুই পাখির নীড়

লাকমিনা জেসমিন সোমা

নিজেকে জানার চেষ্টা করিছ। প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষণ।

লাকমিনা জেসমিন সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

:: পাগলাগারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি ::

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:১৬

শ্বেত পাথরের মেঝেতে এখনো রক্তের কালচে দাগ। ধুলোর আস্তরনে ঢাকা পড়েছে পুরো বাড়ী। শুকনো পাতায় ভরে গেছে বারান্দা। জং ধরা লোহার গেইটের এক পাশে ঝুলছে হলুদ রঙের ‘পোস্ট বক্স’। ওই নির্জন বাড়ী থেকেই কাল রাতে আবজালকে ধরে এনেছে পুলিশ। প্রতি মাসে পূর্ণিমা রাতে আবজাল ওখানে যায়। তার বিশ্বাস এইদিন রুপম ওই বাড়ীতে আসে। তারপর পোস্টবক্স থেকে চিঠি গুলো নিয়ে পুকুর ঘাটে যায়। আনন্দে সারা বাড়ী চরে বেড়ায়। কী সব করে। কিছুক্ষন পর চলে যাই। আড়ালে থেকে মাঝে মাঝে দু’ একটি কথাও বলে তার সাথে । যদিও ভয়ংকর সেই রাতের পর রুপম আর কখনো সরাসরি তাকে দেখা দেয়নি।

এক.

(পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আবজাল)

রুপমের আপনজন কইতে কেবল আমিই ছিলাম। আমারে আবজাল চাচা বইলাই ডাকে। ছোটবেলায় ওর বয়স যখন সাড়ে আট তক্খন দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়া বাচ্চাসহ ওর মা মইরা গেল। তিন মাসের মাথায় কোত্থেকে এক আমেরিকা থাকা মহিলারে বিবাহ কইরা বাপ চইলা যায় আমেরিকায়। ওর বাবা আমার দুঃসম্পর্কের ভাই। আমাগো বাড়ীতে অভাব-অনটন থাকায় ওই বাড়ীতে কাজের পাশাপাশি থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা কইরাছিল ওর বাপ’ই। অবশ্য কাজ করলেও আমি কোনদিন টাকা-পয়সা নিইনি। বরং ওদের পরিবারেরই একজন হইয়া থাকনের চিষ্টা কইরতাম। হাই স্কুল পর্যন্ত পড়ালিখাও কইরাছি।

কইতে গেলে রুপম আমার হাতেই মানুষ। দেশ ছাইড়া যাওনের পর ওর বাপ কোনদিন আর ছেলের খোঁজ করেনি। পরে জানতে পারলাম যাওয়ার আগে গ্রামের বাড়ীর ওই ভিটে-মাটি টুকু ছাড়া সব বেইচা দিয়া গেছে। তাই খুব অভাবের মধ্যে রুপমরে মানুষ কইরছি। আমার স্ত্রী যেদিন কইছিল, ‘আমাদের বাচ্চা-কাচ্চার কী দরকার, রুপম তো আছেই’, সেই দিন ছিল আমার বিবাহিত জীবনের সবচে আনন্দের দিন। সারাদিন খাইটা যা পাইতাম তা দিয়া আমাদের চইলা যাইত। টাকা যা জমাইতাম তা শুধু রুপমের স্কুলের বেতনের জন্য।

ছোটকালে রুপম ছিল খুবই চঞ্চল। দুষ্টের শিরোমনি। পড়ালিখায়ও তাই। কেলাসে সবসময় প্রত্থম হইত। হাই স্কুল থেইকা ক্লাসের বাইরে অনেক পড়ালেখা কইরত। খবরের কাগজে ওর গল্প কবিতা ছাপা হইতো। আইএ পাশের পর বিএ পড়ার কোন কলেজ আমাগো গেরামে ছিলনা। আর আমারো সামর্থ নেই শহরের কলেজে পড়ানোর। এর মধ্যেই একদিন সাইকেল নিয়ে ছুটতে ছুটতো আসলো রুপম।

- চাচা চাচা...চাচা...দেখো আমার নামে পত্রিকা অফিস থেকে চিঠি আইছে

- কীসের চিঠিরে, খুলিসনাই?

- হ, খুলছি। পত্রিকা থেইকা লিখছে ওদের সাহিত্য পাতায় কাজ করতে পারব কিনা। বেতন দিবো পঁচিশ’শো টাকা। আর এর সাথে দুইডা টিউশনি জুগাড় করতে পারলে আমার আর সমস্যা হবেনা। ভালো কইরাই কলেজ ভর্তি হইতে পারমু।



আমি আর ‘না’ করলাম না। শহরে চইলা গেল রুপম। ভর্তি হইলো ইংরেজি সাহিত্যে। আমাদের কাছে নিয়মিত চিঠি লিখতো। মাসে দুই-চারশ বাঁচলে তা আবার আমারে পাঠাইতো। কতো নিষেধ কইরাছি শুনতো না। দুই বছরের মাথায় একবার চিঠিতে জানাইলো-

‘ শ্রদ্ধেয় চাচা, এই চিঠিটা পেয়েই শহরে চলে আসবা। আমি যে পত্রিকায় কাজ করি তার মালিক আমাকে খুব স্নেহ করেন। আমাকে তার ফাঁকা পড়ে থাকা বাগান বাড়ীতে থাকতে দিয়েছেন। কাজ শুধু বাড়ীটা দেখে-শুনে রাখা আর লেখালেখি করা। তোমার কথাও বলেছি। তার কোন আপত্তি নেই।’

আমি চইলা গেলাম। চাচা-ভাইপো’র বেশ ভালো দিন কাটতেছিলো। রুপমের অনেক পরিবর্তন দ্যাখলাম। গেরামের ভাষায় আর কথা কয় না। দেইখতে-শুনতে মাস-আল্লাহ।পোষাক-আসাক পরিপাটি। সারাদিন পড়ে আর লেখে। সইন্ধ্যার পরে পেরাইভেট পড়াইতে যায়। ওর স্বপন কইতে একখানই ছিল। গেরামে ফিরে স্কুল বানাবে। সারাক্ষণ তাই নিয়েই গল্প কইরত আমার লগে। ওর উন্নতি দেইখা আমার বুগটা ভইরা যায়।

একদিন সান বাধানো পুকুরডার পাড়ে বইসা জঙ্গল পরিষ্কার কইরতাছি। হঠাৎ মাইয়া মানুষের হাসির শব্দ পাইলাম। গেটের দিকে চাইয়া দেহি, একখান মাইয়ারে নিয়া ঢুকতাছে রুপম। পরনে তার শাড়ী। শ্যাম বর্ণের মাইয়াগো চোখ এত মায়াবী হয় জানতাম না। রুপমের পাশে প্রত্থমবার দেইখাই এমন সুন্দর লাগলো আমি অনেক কিছুই চিন্তা কইরা ফেলাইলাম।

- স্যার, এই আপনার বিখ্যাত বাগান বাড়ী?

- শিশির, এইটা কিন্তু আমার বাড়ী না, বারবার আপনার আপনার করবা না। আমার কিছুই নেই। হয়ত কোনদিন হবেও না। তোমার পাগলামির জন্য তোমাকে এখানে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।

- আচ্ছা ঠিক আছে স্যার। এত সিরিয়াস হয়ে যান কেন? যাইহোক, কোথায় আপনার সে সুপারি বাগানের ফাঁকে শরতের আকাশ? পুকুর পাড়ের নীলকন্ঠ? পত্রিকায় ছাপা গল্পে তো খুব লেখা হয় দেখি। ও, হ্যা মায়া মাখা আবজাল চাচাকেও কিন্তু দেখাতে হবে।

-আমার গল্প পড়ে যদি সব পাঠক এভাবে গল্পের বর্ণনা দেখতে চলে আসে তাহলে আমার চাকরি শেষ। বাগান বাড়ী থেকেই বের করে দেবে মালিক।

-সব পাঠক কি আর আপনার ছাত্রী?

-শিশির, তুমি কিন্তু আমার ছাত্রী হিসেবে এখানে আসনি। আমার গল্পের একজন পাঠককে যাস্ট সম্মান দেখিয়ে নিয়ে এসেছি। স্টুডেন্টের সাথে এতটা পার্সোনাল সম্পর্ক আমার পছন্দ না। যাইহোক, আসো তোমাকে দেখাই।

দুই.

শিশির অনেক গম্ভীর হয়ে গেল। রুপম ওকে নিয়ে গেল সুপারি বাগানে। সুপারি বাগানের ফাক দিয়ে শরতের আকাশ নাকি বেশিই নীল দেখায়। শিশির আগের মতই চুপ করে থাকলো। শিল্পপতি বাবার আদুরে মেয়ে সে। খুব অভিমানি। বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী। রুপম তাকে ইংরেজি পড়াই। হাটতে হাটতে পুরো বাড়ী ঘুরে দেখালো রুপম। তারপর আবজাল চাচার কাছে নিয়ে গেল।

- চাচা, এ হলো শিশির। আমি ওকে পড়াই।

- বুইঝতে পাইরাসি। তুমার মনডা তো ভালই ছিল মা। এহন মুখ কালা কইরা আছো ক্যান?

- জ্বী না চাচা, আমি ঠিক আছি। আজ তবে আসি।

- আসি মানে? চলো তিনজন মিইলা পুকুর থেইক্যা সরপুঁটি ধইরা আনি। গরম গরম মাছ ভাজা আর খিচুড়ী। সাথে গেরাম থেইকা আনা খাটি ঘি।

আনন্দে লাফিয়ে উঠল শিশির। মুখ থেকে গম্ভীরতা উড়ে গেল।

- সত্যি? কী মজা , মাছ ধরব!

- বুঝছেন চাচা, এইজন্য শিশিরকে আমি শরতের আকাশ বলি। যেন এই রোদ-এই বৃষ্টি! (যদিও এর আগে সে কখনোই তাকে শরতের আকাশ বলেনি)।

দিনটি বেশ গেল। শিশির যেন অন্যরকম এক জগত দেখে এলো। বাবা-মা দু’জনই তার মহাব্যস্ত। মাসের বেশির ভাগ সময় থাকে দেশের বাইরে। ছোটবেলা থেকে গাছের সাথে বাড়ীর ছাদে থাকা কবুতরের সাথে কথা বলে সে। ঘুমের মধ্যেও বকবক করে। এ নিয়ে কয়েকবার তাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞকেও দেখানো হয়েছে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ শোনার মত সময় তার বাবা-মায়ের হয়ে ওঠেনি।

তিন.

মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হলো রুপমের। দ্বিতীয় বর্ষ ফাইনাল দেবে শিশির। ক’দিন থেকেই মনমরা হয়ে আছে মেয়েটা। পড়াশুনায় মন নাই। রুপম বলল-

- তুমি কি কোন কারনে আপসেট? তোমার বাবা-মা তো দুই সপ্তাহ ধরে বাইরে। কোন সমস্যা থাকলে আমাকে বলতে পারো। তোমাদের ম্যানেজার কে হয়ত অনেক সময় সব বলতে পারো না।

- নো, থ্যাংক্স। আমার সমস্যার কথা বললে যদি সমাধান করে দিতেন তবে ঠিকই বলতাম।

- কি আশ্চর্য্য! কেন করবনা? বলোনা..দেখি পারি কি না।

- ঠিক আছে, বিস্তারিত বলব না। শুধু বলব, প্রত্যেক সপ্তাহে আমাকে একবার আপনার আবজাল চাচার কাছে নিয়ে যাবেন। সারাদিন তার সাথে গল্প করে চলে আসব।

- কপাল কুচকে রুপম বলল, এটা কি ধরনের সমস্যা? বুঝলাম না।

বাড়ী ফিরে তার আবজাল চাচাকে শিশিরের আবদারের কথা খুলে বলল। আবজাল চাচা বলল, তোর সমিস্যা কোথায়? আসতে তো চেয়েছে আমার কাছে। তোর কাছে তো না।

-আমার সমস্যা আছে। তোমাকে বলা যাবে না।

-আমারে না কয়ে থাকতে পারবি? পারলে ভালো, বুঝব বড় হয়ে গেছিস। আমার চিন্তা কমবে।

-উহ! চাচা। তুমি না সবসময়....। আচ্ছা শোনো, আসলে ওই মেয়েটার দিকে তাকালে আমার খুব মায়া হয়। বাবা-মা থেকেও নেই। সারাদিন একা একা বাড়ী থাকে। আমি প্রায় দিন যেয়ে দেখি ছোট বাচ্চাদের মতো গাছ-ফুল-পাখির সাথে কথা বলছে। কখন্ ঘুমাই কখ্ন খায় দেখার কেউ নেই। এক ওই ম্যানেজার আঙ্কেল, সে তাকে কতটুকুই বা সময় দেবে। বন্ধু-বান্ধবের বাড়ী যাওয়াও নিষেধ। গাড়ীতে কলেজ যাই, গাড়ীতেই আসে। এভাবে একটা মানুষ বাঁচতে পারে, বলো?

-ভালোই তো বুঝিস। তাইলে তার পাশে দাড়াস না ক্যা?

-ভয় লাগে, হাজার হোক রক্তে-মাংসে গড়াই তো এক মানুষ আমি। তারপর আবার পুরুষ। তাই নিজেই নিজের প্রতিও মাঝে মাঝে বিশ্বাস হারায়।

-এত কথা বুজিনে, তুই ওরে এহন থেইকা নিয়ে আসবি।

চার.

নিয়মিত প্রত্যেক সপ্তাহে আসতে লাগল শিশির। আগের চেয়ে এখন সে অনেকটা উচ্ছল। রুপমের অবস্থাও বেশ ভালো। গেল একুশের বই মেলায় তার দুই টা বই পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। বড় বড় প্রকাশনা থেকে প্রস্তাব আসছে লেখার। এরই মধ্যে একদিন এক অবাক কান্ড ঘটিয়েছে শিশির। দিনটি ছিল ২৫ ভাদ্র। আকাশে বড় একখানা চাঁদ উঠছে। বাগান বাড়ী থেকে সন্ধ্যায় বাড়ী ফেরার সময় জিদ ধরল, আজ সে যাবেনা। ম্যানেজার আঙ্কেল সেদিন রাতে তাদের বাড়ীতে থাকবেনা। তাই জানবেও না সে বাড়ী ফেরেনি। শিশিরের কথা শুনে আগুনের মতো রেগে গেল রুপম। আমার ইচ্ছায় শিশির থেকে গেল কিন্তু রাগে গদগদ করতে করতে একা গিয়ে পুকুর ঘাটে বসল রুপম। রাত তখন প্রায় ২ টা।

- কে !!!!???? (চমকে উঠে বুকে থু-থু দিল রুপম)

-আমি, সরি। আমার জন্য আপনার আজ রাতটা’ই মাটি। আমি এখনো চলে যাচ্ছি। ড্রাইভার কে বললেই নিয়ে যাবে। ম্যানেজার আঙ্কেলকে রিকুয়েস্ট করলে এ ঘটনা বাবা-মা'কে বলবেনা।

এ কথা বলে চলে যাচ্ছিল শিশির। চাঁদের আলোই তার চোখের পানি চকচক করছে। রুপম কিছু বললনা। হঠাৎ পেছন থেকে শিশিরের হাত চেপে ধরল। শিশির বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেদে ফেলল। কান্না দেখে না কি মনে করে রুপমও কেঁদে ফেলল। অস্পষ্ট স্বরে শুধু বলল, ‘আমি তোমাকে বুঝি’।



তারপর থেকে প্রত্যেক পূর্ণিমা রাতে গল্পের আসর নিয়ে পুকুর ঘাটে বসে তারা। একটু একটু করে কাছে আসার চেষ্টা শিশিরের। রুপম গেট কিপার হয়ে দাড়ায় হৃদয়ের দরজায়। তারপরও মাঝে মাঝে মনে মনে ভিজে যায় শিশিরের প্রেমে। তবু গোপন করার চেষ্টা সবসময়।

পাঁচ.

পুরো বাড়ী জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পূর্ণিমা রাত হলেও মেঘের কারনে আজ জোসনার ছিটেফোটাও নেই। সন্ধ্যা অবধি অপেক্ষা করেও শিশির আসেনি।

-তোর কি মনডা খারাপ? কই তুই? অন্ধকারে তো কিছুই দেহা যায়না।

-মন খারাপ কিনা জানিনা। তুমি আমার পাশে বোস,চাচা। অন্ধকারে সাবধানে এসো।

-বসলাম। বল। অন্ধকারে ভালো লাইগছেনা।

-চাচা, আজ শিশির আসেনি ভালো করেছে। এমন অন্ধকারে কী হতো বলো তো? ওর তো অভ্যাস নাই। ওদের বাড়ীতে বিকল্প আলোর ব্যবস্থা আছে।

-ওওক নিয়ে তুই কতো ভাবনাই না ভাবিস! নিজেরে লুকাইয়া কি পাস ক তো দেহি? তুই ওরে খুব ভালোবাসিস, তাই না?

(অন্যদিনের মত তেলে বেগুনে জ্বলে না উঠে চুপ করে থাকে রুপম)। কিছুক্ষণ পরে বলে-

-আচ্ছা চাচা, আমার মা যদি মারা না যেত, যদি বাবা আমাদের ছেড়ে না যেত। আমাদেরও বাড়ীও শিশিরদের মতো অমন আলো ভরা থাকতো তাই না?

-তোর বাবা যদি সব বিক্রি কইরা না যাইত তাইলে হইতো। অযথা তোরে কষ্ট দিয়া গেল।

-চাচা, শিশির কি কখনো আমাদের গ্রামে ওই মাটির বাড়ীতে থাকতে পারবে? আমার স্কুলের ওই কাদা-মাখা ছেলে মেয়েদের কে কি কোলে তুলে বই পড়া শেখাবে?

- ক্যান শিকাবে না। মাইয়্যাডারে তুই চিনতেই পারলি না। ওর সমস্যা নিয়ে সবসুময় ভাবিস। কতকিছু বুঝিস। আর সে যে তোর মতো পোলারে ভালোবাইসা জ্বইল্যা-পুইড়া মরতাছে সিডা বুঝিস না? ভয়ে তোরে কইতেও পারেনা, সইতেও পারেনা। একটু সুযোগ দিয়েই দেখিস না..?

- .....চাচা, আমি ওকে ওর চেয়েও বেশি ভালোবাসি। অনেক আগে থেকে। ওকে না দেখলে আমার কলম দিয়ে এক লাইনও বের হয়না। ধুর, তোমাকে কীসব বলছি। যাও তো। ঘুমাই।

-ঠিক আছে গেলাম। ভয় পাস না যেন!



(চোখ বুজতেই পাশে বসে কপালে হাত রাখলো শিশির)

-চাচা, তোমার হাত এত ঠান্ডা আর এমন লাগছে কেন?

-আমি শিশির। এতক্ষণ এখানেই ছিলাম। অন্ধকারে টের পাননি। চাচাকে বলতে নিষেধ করেছি। এখন বলেন, আমাকে নিয়ে আর কী কী চিন্তা হয় আপনার? আমাদের গাড়ীটা আপনাদের গ্রামের রাস্তায় ঢুকবে কি না? কাঁদা লাগলে ধুয়ে দেবে কে? এই গুলা?



রুপম কোন কথা বলতে পারলো না। একবার ঝড়ে বেগে বিছানায় উঠে বসে। তারপর কিছু না বলে শিশিরের মাথাটা বুকের মধ্যে টেনে নেয়। শিশির কেবল বাচ্চাদের মতো আবদার করে বলে, আমাকে বাঁচান, প্লিজ।

ছয়.

হরিণী সুখে কেটে গেল রুপম-শিশিরের এক বছর। প্রতিদিনই নতুন করে প্রেমে পড়ে রুপম। তবে একজনের সাথেই। সে হলো শিশির। নিয়মিত তাদের দেখা হলেও প্রত্যেক মাসে দুজন দুজনকে চিঠি লিখবেই। পোস্ট বক্সে ডাকপিয়ন এসে চিঠি রেখে যায়। চিঠি পেয়ে সেদিন একটু অন্যরকম আনন্দে কাটে দুজনার। এমনিতে আপনি সম্বন্ধ করলেও চিঠিতে রুপমকে ‘তুমি’ করেই লেখে শিশির। তাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে থাকে রুপমের স্কুল। রুপমের লেখালেখির খ্যাতিও তখন বেশ। শিশিরের অনার্স শেষ। তাদের সম্পর্কের কথা তার বাবা-মা একটু একটু জেনেছে। মত না দিলেও শিশির হয়ত তাদের মানবেনা। হঠাৎ একদিন রুপম তার চাচাকে ডেকে বলল-

-চাচা, আমি শিশিরকে বিয়ে করব। তবে তার আগে ওর একটা পরীক্ষা নেব। তুমি শুধু কথা দাও, ওকে কিছুই বলবে না।

- তোর যা ইচ্ছে কর। তই কীসের পরীক্ষা?

- আমি দেখবো, আমি যদি শিশিরকে দুরে সরিয়ে রাখি তবে ‘ও’ আমাকে ভুলে যায় কিনা। আমাকে ছেরে ান্য কারো....। তারপর কতদিন ভালোবাসে আমাকে। পরীক্ষায় পাশ করলেই আমরা চলে যাবো গ্রামে। ওখানে আমার স্কুলের পাশাপাশি শুধু লেখালেখি আর লেখালেখি।

সাত.

এরপর থেকে রুপম শিশিরকে নিয়মিত এ্যাভয়েড করতে লাগলো। দেখা করতে বললে করেনা। শিশির যখন আসে ইচ্ছা করে বাড়ী থাকেনা। সারাক্ষণ ব্যাস্ততা। বহু দিন থেকেই একই আচরণ করতে থাকে রুপম। আবজাল চাচা, বহুবার বলেছে ‘মেয়েটা অনেক কষ্ট পাচ্ছে। তোর পরীক্ষা শেষ কর’। রুপম বলে, ‘যে টুকু কষ্ট পাচ্ছে, ভালোবেসে সুদে আসলে তার দ্বীগুণ উসুল করে দেবো। আর তো মাত্র দু’ মাস। তারপরই বিয়ের কথাটি বলব ওকে’। আবজাল রুপমকে কথা দেওয়ায় শিশিরকে কিছুই খুলে বলতে পারেনা।

এদিকে প্রথম তিন মাসেই বেহাল অবস্থা শিশিরের। তার একাকিত্ব জীবনের সবটুকু পূর্ণ করেছিল রুপম। প্রথম ভালোবাসায় যেন মাতাল হয়ে ছিল মন। বাড়ী-গাড়ী ইট-পাথরে তার সুখ নেই। রুপমকে নিয়ে সে মাটির বাড়ীতেই থাকতে চেয়েছিল। আগের মতই চিঠি লেখে, কিন্তু রুপমের কাছ থেকে কোন জবাব আসেনা। এখন তার কেবলই মনে হয়, আর দশটা ছেলের মতই প্রতারণা করেছে রুপম। দিন রাত তার হাজারো প্রশ্ন মাথায় আসে। কতদিন ঠিক মত ঘুমাইনা তার হিসেব নেই। ছয় মাস কোন রকম পার হওয়ার পর প্রায় পাগলের মত হয়ে গেল শিশির। চিঠি লেখা বাদ দিয়েছে। সে ভাবে, নিজের মরণদশার কথা বলে আর কী লাভ! আর ‘ও’ বাড়ীতে যাওয়ার মতো শক্তিও তার নেই। প্রায়ই আকাশের দিকে তাকিয়ে একা একা চিৎকার করে। কয়েকবার আত্মহত্যাও করতে গেছে। ইদানিং শিশিরের চিন্তাগুলোও অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। ভয়াবহ এক চিন্তা! ভয়ংকর এক সীদ্ধান্ত!

আট.

কাল এক বছর পূর্ণ হবে। শিশিরকে নিয়ে রুপমের পরীক্ষা শেষ। তাকে ছেড়ে কোথাও যায়নি শিশির। আজ এই পূর্ণিমা রাতেই বিয়ের কথা বলে দুর্দ্যান্ত এক চিঠি লিখবে রুপম। গোপন করার আর কিছু নেই। সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েই লিখবে সে। লিখবে, ‘আমি তোমার শিক্ষক তাই শেষ পরীক্ষা টা নিয়ে নিয়েছি। হান্ড্রেডে হান্ড্রেড।’ অর্ধেকটা লিখেও ফেলল...। এমন সময় দরজার কোনায় শব্দ। চাচা আসছে ভেবে চিঠিটা ড্রয়ারে ঢুকালো রুপম। চিঠি লেখার উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে আসছিল,তাই চাচাকে পাঠিয়েছিল পানি আনতে।



ঝড়ে বেগে ঘরে ঢুকলো শিশির। চট করে খিল লাগিয়ে দিল। উত্তেজনায় কাপছে শিশির। দরদর করে ঘামছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলির শব্দ। হাত কেঁপে লক্ষ ভেদ করে রুপমের কানের পাশ দিয়ে চলে গেল। দৌড়ে এলো আবজাল চাচা। দরজা ধাক্কাতে লাগলো, কিন্তু খুললনা। অসহায় চাচা এতবার দরজার সামনে একবার জানালায় এসে কাকুতি মিনতি করছে। উত্তেজনায় কথা গুলো তার জড়িয়ে যাচ্ছে। হতভম্ব রুপম। শিশিরের দ্বিতীয় গুলি মিস হলো না। কপালের ঠিক মাঝখানে গর্ত হয়ে ঢুকে গেল। চাচার দিকে তাকিয়ে রুপম কেবল বলল, এতা দেরি করলে পানি আনতে?

নয়.

চার মাস হলো পাগলাগারদে শিশির। ডাক্তার বলেছে, অনেক আগে থেকেই শিশির মানসিক রোগী। মাঝখানে অনেকটা ভালো ছিল। কিন্তু বড় ধরনের শক্ পেয়ে রোগটা বেড়ে যায়। রুপমকে খুন করার পর সে প্রায় পাগলই বলা চলে। কিন্তু প্রত্যেক পুর্ণিমা আগের দিন রুপমের বাগান বাড়ীর ঠিকানায় চিঠি লেখে। নিজে হাতে পোস্ট করতে না দিলে উন্মাদ হয়ে যায়। তাই কয়েকজন নার্সকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নিয়মিত যেন তাকে নিয়ে চিঠি পোস্ট করা হয়।

অল্প বয়সী এক নার্সকে শিশির একবার জিজ্ঞাসা করেছিল,‘আচ্ছা আমি যেখানে থাকি এখানের নাম কি?’ নার্স হেসে বলে, ‘পাগলাগারদ’। তাহলে কি আমি পাগল? নার্স আবারো ফিক করে হেসে বলে, ‘হ্যাঁ’। শিশির আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা’ । তারপর থেকে প্রত্যেক চিঠির খামেই প্রেরকের ঠিকানায় সে লিখে দেয় ‘পাগলাগারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি’।

-----------------------------

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:৪৩

খেয়া ঘাট বলেছেন: তারপর থেকে প্রত্যেক চিঠির খামেই প্রেরকের ঠিকানায় সে লিখে দেয় ‘পাগলাগারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি’।
---------------------

অনেক ভালো লিখেছেন সোমা।

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৫২

লাকমিনা জেসমিন সোমা বলেছেন: হুমমমমমমমমম। খেয়া ঘাটের ছোট গল্পরা কেমন আছে.?? ওদের ভালো রাখবেন.।:-)

২| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৫৮

স্বপ্ন নীল বলেছেন: অনেক কিছু মনে পড়ে গেল।
অনেক ভালো লিখেছেন

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৫২

লাকমিনা জেসমিন সোমা বলেছেন: ধন্যবাদ....

৩| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:০৯

ধুলাবালি বলেছেন: অবহেলা আর ভালবাসা দু'ই মানুষকে ভয়ংকর করে তোলে। আমার জীবনেও এমনটা হতে পারে। ভাবছি কী করব??

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৫৩

লাকমিনা জেসমিন সোমা বলেছেন: যা করার দ্রুত করে ফেলৈন...।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.