নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সন্ধ্যা প্রদীপ

আমার সমস্ত চেতনা যদি শব্দে তুলে ধরতে পারতাম

সন্ধ্যা প্রদীপ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভৌতিক গল্পঃ নকশীকাঁথা

২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৩১

এক
তখন নতুন নতুন বিয়ে করেছি।সবমিলিয়ে একটা বছরও পেরিয়ে যায়নি।একজন মানবীকে একদম নিজের করে পাওয়ার মাঝে যে একটা গভীর প্রশান্তি লুকিয়ে আছে তা সবে মাত্র বুঝতে শুরু করেছি।ঘটনাটা ঠিক তখনকার।বাইরের দেশে তো বিয়ে হলেই স্বামী-স্ত্রী বের হয়ে পড়ে হানিমুনে,একান্তে নিজেদের মত করে কিছু সময় কাটিয়ে আবার ফিরে আসে প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে।আমাদের দেশে এমনটা হওয়া যেন ঠিক স্বপ্নের মত বিশেষ করে আমাদের মত মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য।তাই যাব যাচ্ছি করে অনেকটা সময় কে্টে গেলেও ওকে নিয়ে কোথাও যাওয়া হয়নি।সুযোগটা এসে গেল হঠাত করেই যখন আমাদের অফিস থেকে ফ্যামিলি ট্যুরের জন্য একটা ফান্ড দেয়া হলো তাও আবার দেশের ভেতরে নয় বরং বাইরে গিয়ে ঘুরে আসার জন্য।অফিসের সব কলিগরা মিলে ঠিক করল নেপাল যাবে।আমাদের জন্য ভালই হলো,হিমালয়কন্যা দেখা হবে সেই সাথে হানিমুনটাও সেরে আসতে পারব।

দুজনে মিলে খুব উতসাহ নিয়ে কেনাকাটা করলাম।দুজনের পাসপোর্ট রেডি,ব্যাগ গোছানো শেষ এমন সময় হঠাত খবর এল আমার শাশুড়ি সিঁড়ি থেকে পিছলে পড়ে পা ভেঙ্গেছেন।এই খবর শুনে আমার স্ত্রী মনি তো কেঁদেকেটে একাকার।হবেই বা না কেন?বাপ মরা মেয়েটিকে তার মা অনেক কষ্টে অনেক যত্ন করে মানুষ করেছেন।ওর বড় বোন থাকে কানাডা,ভাইটি স্কুলে পড়ে।মা অসুস্থ হলে তাকে সেবা করার কেউ নেই।অগত্যা আমার স্ত্রীকে সব ফেলে মায়ের কাছে যেতে হলো।আমি ত দুজনের ট্রিপই বাতিল করতে চাইছিলাম কিন্ত মনিই আমাকে কান্নাকাটি করে মাথার দিব্বি দিয়ে তা বাতিল করতে দিলনা।সে চায় আমি যেন এবারের মত একাই ঘুরে আসি।তাছাড়া একেবারে একা তো না।সাথে কলিগরা থাকছে যাদের অনেকেই আমার ভাল বন্ধু।আমার মনটা কিন্ত ভেঙ্গে গিয়েছিল কিন্ত মনির জিদের কাছে হার মেনে অগত্যা রাজি হলাম।মনিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে নেপাল যাত্রার জন্য তৈরী হলাম।

ভেবেছিলাম পাঁচটা দিন দেখতে দেখতেই কেটে যাবে কিন্ত যখন কলিগরা তাদের স্ত্রীর হাত ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছিল বা পাশাপাশি বসে কথা বলছিল তখন আমার বুকের ভেতর টনটনে ব্যাথা অনুভব করতে লাগলাম।শুধু মনে হচ্ছিল মনির কথা শুনে ভুল করেছি।শুধু বন্ধুরা এলেও একটা কথা ছিল এসকল হংসমিথুনের মাঝে আমি একা জোড়া ছাড়া পাতিহাঁসের মত ঘুরে বেড়াচ্ছি কিন্ত হওয়ার কথা ছিল উল্টা।এদের সবার মধ্যে আমাদের বিয়েই হয়েছে সবচেয়ে পরে।ভেবেছিলাম সকলের মধ্যে নিজের রূপসী স্ত্রীর হাত ধরে বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াব আর সবাই আমাদের জোড়া দেখে হিংসা করবে।তা তো হলোই না বরং আমিই তাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছি।প্রথম দিনটা কোনো মতে কেটে গেলেও ২য় দিনটা আর কাটতে চাইছিল না।তাই রেগেমেগে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার একাই বেরিয়ে পড়বো।এদের সাথে না থেকে সারাদিন নিজের ইচ্ছা মত ঘুরবো সেই সাথে শপিংটাও সেরে নেয়া যাবে।

তাই ৩য় দিন সকালে একাই বের হয়ে পড়লাম এবং এই প্রথম যেন চোখ খুলে দেশটির সৌন্দর্য দেখতে পেলাম।মনি সাথে না আসায় অনেক টাকা বেঁচে গেছে তাই ভেবেছিলাম এই টাকা দিয়ে মনির জন্য ইচ্ছা মত উপহার কিনবো।তাই পরবর্তী কয়দিন দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে আর কেনাকাটা করেই কেটে গেল।চোখের সামনে অন্যদের ভালবাসাবাসি দেখতে হচ্ছেনা বলে সময়টা অত খারাপ কাটল না এবং স্বীকার করতে বাধ্য হলাম যে ট্রিপ বাতিল করাটা মস্ত বড় ভুল হতো।আসলে আমি ঘুরতে খুব পছন্দ করি,মনিও সেটা কিভাবে যেন বুঝে ফেলেছে,তাই কষ্ট হলেও জোড় করে আমাকে এখানে পাঠিয়েছে কারন নিজে থেকে এমন একটা ট্রিপ আয়োজন করার সাধ্য আমার নেই।দেরিতে হলেও বিষয়টা যখন বুঝতে পারলাম তখন স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা আর গাঢ় হলো।সেদিনই ছিল নেপালে আমাদের শেষ রাত তাই শেষবারের মত চারিদিকটা ঘুরে দেখবো বলে বেড়িয়ে পড়লাম।তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে,লাল-নীল বাতিগুলো জ্বলে উঠে রাতের আঁধারকে সজ্জিত করছে মনের মত করে।তার মাঝে হিম ঠান্ডায় প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে আমি আপন মনে রাস্তায় হাঁটছি।আমাদের হোটেলের কাছে একটা স্থানীয় বাজার আছে সেখানে এসে আমি থেমে দাঁড়িয়ে গেলাম।কারন এক বুড়ি আমার দৃষ্টি আকর্ষন করলো।

বুড়ি রাস্তার ধারে বসে নানা রকম হাবিজাবি বিক্রি করছিল।তার মাঝে গাছগাছড়া থেকে শুরু করে,ছোট ছোট কাঠের পুতুল সবই আছে।বয়সের কারনে বুড়ির চামড়া ঝুলে পড়েছে,চুলগুলি ধবধবে সাদা,আর তাতে নানা রঙের পুঁতি গাঁথা।মূলত তার সাদা চুলে রঙ্গিন পুঁতির কারুকাজ দেখেই আমি থমকে দাঁড়িয়েছিলাম।আমাকে দেখে বুড়ি বড় আশা নিয়ে তাকালো।হয়ত ভেবেছে আমি কিছু কিনব।আমি মনে মনে বেশ বিব্রত বোধ করলাম আর বুড়ির জিনিসগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে যেতে থাকলাম।সবকিছুই খুব সাদামাটা,কিছুই কেনার মত নেই তবুও ভদ্রতার খাতিরে একজোড়া ছোট্ট কাঠের পুতুল কিনে যখন টাকা দিতে যাব তখন আমার চোখ পড়ল পেছনের দিকে রাখা একটা কাঠের বাক্সে।আলোক স্বল্পতার জন্য আগে দেখিনি কিন্ত বুড়িকে বললে যখন সে সেটা সামনে আনলো তখন এর কারুকাজ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।বাক্সটার আকার হবে অনেকটা বালিশের মত বড়,পুরোটাই শক্ত কালো কাঠের তৈরী আর তাতে অসম্ভব সুন্দর খোদাই করা ডিজাইন।কালোর মাঝে সোনালী সেগুন কাঠের জোড়া দেয়া ফুল-পাতা গুলো ডিজাইনটাকে আরো ফুটিয়ে তুলেছে।


মনি জন্য অনেক কিছুই কিনেছি কিন্ত ইচ্ছা ছিল খুব স্পেশাল কোনো একটা উপহার দেব কিন্ত তেমন কিছুই আমার চোখে বাধেনি।তাই বাক্সটা দেখা মাত্রই এটা কেনার জন্য আমি পাগল হয়ে উঠলাম।আমার কাছে মনে হচ্ছিল এটা তেমন একটা উপহার হবে যেমনটা আমি চাইছিলাম।বুড়িকে সেটা কেনার কথা জানাতে সে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষন জুল জুল করে তাকিয়ে কি যেন দেখল।তারপর বাক্সের ডালা খুলে ভেতর থেকে ভাঁজ করা কি যেন বের করে মেলে ধরলো।দেখলাম সেটা একটা কাঁথা।সঠিকভাবে বলতে গেলে একটা পুরোনো নকশীকাঁথা।স্বল্প আলোয় ভাল দেখা যায় না তাই মনে হলো ক্রিম রঙের কাপড়ে লাল রঙের সুতো দিয়ে জমাট বাঁধনে ফুল লতাপাতা আঁকা।সেই লাল সুতোও কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে,কে জানে কাপড়টা হয়ত একসময় হলুদ ছিল।পুরোনো হতে হতে এই দশা হয়েছে।বুড়ি আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল বাক্স নিতে হলে সাথে কাঁথাও নিতে হবে।যদিও কাঁথার ডিজাইনটা চোখে লাগার মত কিন্ত এত পুরোনো কাঁথা আমি নিয়ে কি করব।কে জানে কোন যক্ষারোগে আক্রান্ত বৃদ্ধ এই কাঁথার নিচে শুয়ে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছে।মনে হতেই আমার গা গুলিয়ে উঠল আমি সাফ মানা করে দিলাম।কিন্ত বুড়িও নাছোড়বান্দা।বিরক্ত হলেও বাক্সটা হাতছাড়া করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার ছিলনা।তাই কাঁথা সমেত বাক্সটি বুড়ির কাছ থেকে কিনে নিলাম।বাক্সটা যতটা সুন্দর সে তুলনায় দামটা পড়ল খুবই কম।


ট্যুর শেষ করে শাশুড়িকে দেখতে গেলাম।দেখলাম তার অবস্থা বেশ ভাল,কোনো হাড় ভাঙ্গেনি কিন্ত বেকায়দায় পড়ে জয়েন্টে সমস্যা হয়েছে,মাস খানেক রেস্ট নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।মনি জানালো সে আরো এক সপ্তাহ থাকতে চায় তারপরে তার এক আত্মীয় এসে মায়ের দেখাশুনা করবে।অগত্যা আমি ফিরে এলাম।খালি বাসায় বসে বসে আমি মনিকে মিস করতে লাগলাম আর ভাবতে থাকলাম গিফট গুলো পেয়ে মনি কি খুশিই না হবে।এমন সময় মাথায় একটা বুদ্ধি আসল,ভাবলাম স্পেশাল গিফট টা কোনো স্পেশাল দিনে দিলে কেমন হয়?একথা ভেবেই কাঠের বাক্সটি স্টোর রুমে লুকিয়ে রাখলাম।আর কিছুদিন পরে আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী সেদিনই না হয় এটা দেব।

নির্দিষ্ট দিনে যখন মনিকে বাক্সটি দেখালাম সে অসম্ভব খুশি হলো।বাক্সের উপরের নকশায় হাত বুলিয়ে দেখতে লাগল আর আমার দিকে তাকাতে লাগল কৃতজ্ঞ চোখে।তার আনন্দ দেখে খুশিতে আমার প্রানটা ভরে গেল।ওকে বললাম,ভেতরে একটা পুরোনো কাঁথা আছে ওটা বের করে ভিক্ষুককে দিয়ে দিও।আমার কথা শুনে সে বাক্স থেকে কাঁথাটা বের করে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।মনে হলো কাঁথাটাও ওর খুব পছন্দ হয়েছে।সেদিনই সে লাজুক মুখে আমাকে জানালো আমাদের ঘরে নতুন অতিথি আসতে যাচ্ছে।ওর কথা শুনে খুশিতে আমার চোখে পানি এসে গেল।আজকের দিনে আমার জন্য এর চেয়ে স্পেশাল গিফট কি হতে পারে?

দুই
তখন আমরা যেখানে থাকতাম সেই বাসাটা শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে যেখানে সরকারের বনায়ন কর্মসূচি চলছে।নতুন হাউজিং প্রকল্প ছাড়িয়ে ঝকঝকে রাস্তাটা মোড় ঘুরে সোজা বনের প্রান্তে গিয়ে শেষ হয়েছে।সেখানে রয়েছে বন বিভাগের একটি বাংলো যা বেশির ভাগ সময় খালি পড়ে থাকে।এই হাউজিং আর বাংলোর মাঝখানে আমাদের ছিমছাম একতলা বাড়ি।আশেপাশে যেসব বাড়ি আছে সেগুলো বেশ দূরে দূরে,দেখা যায় কিন্ত সেখান থেকে কোনো শব্দ শোনা যায় না।আমি অফিসে গেলে সারাদিন মনিকে একাই থাকতে হয়।শুধু কাজের বুয়া সকাল আর সন্ধ্যায় এসে কাজ করে দিয়ে যায়।এদিকে এমনিতেই মানুষ খুব কম তাই এলাকাটায় কেমন একটা নিরবচ্ছিন্ন শান্তি সর্বদা বিরাজ করে।আসলে একদিন এদিকে পিকনিকে এসে জায়গাটা পছন্দ হয়ে যাওয়ায় এক বন্ধুকে ধরে অনেক ঝামেলা করে বাসাটা ভাড়া নিয়েছি।নইলে এমন বাসা আমাদের পাওয়ার কথা না কারন এসব বাসায় বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই সপরিবারে থাকেন।


কিছুদিন পর সকালের দিকে অফিসে যাওয়ার সময় দেখি উঠোনে সেই কাঁথাটা মেলে দেয়া।মনিকে জিগাসা করতেই সে বললো সে ভাবছে কাঁথাটা নিজের কাছে রেখে দেবে।আমি বেশ অবাক হলাম এমন জীর্ন একটা জিনিস কেন তার এত পছন্দ হলো?আমার অবাক ভাব লক্ষ্য করে সে বললো,এটা আসলে একটা এন্টিক,এমন ডিজাইন নাকি এদেশে দেখা যায় না তাই সে ভেবেছে এটাকে পরিষ্কার করে ড্রইংরুমে্র দেয়ালে সাজিয়ে রাখবে।কিছুদিন পরে বিকেলে অফিস থেকে ফিরে দেখি মনি ড্রইংরুমের সোফায় সেই কাঁথা গায়ে দিয়ে বসে টিভি দেখছে।আমাকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে সে বেশ লজ্জা পেল।বললো শীত করছিল তাই কাঁথাটা গায়ে দিয়েছে,কাঁথাটা নাকি গায়ে দিতে খুব আরাম লাগে।ভেতরে নাকি এমন একটা উষ্ণতা আছে যা নাকি শরীরে অদ্ভুত একটা আরাম ছড়িয়ে দেয়।আমি জুতামোজা খুলতে খুলতে বললাম,দেখ আবার গায়ে চুল্কানি যেন না হয়,কোথাকার পুরোনো জিনিস,কে জানে কি না কি রোগ জীবানু আছে।


এই ঘটনার সপ্তাহ খানিক পর একদিন দুপুরে তারাতারি বাড়ি ফিরে আসলাম।এসে দেখি ড্রইংরুমে বুয়া বসে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখছে আর পান চিবাচ্ছে। আমাকে দেখে বললো মনির নাকি হঠাত শরীর খারাপ করেছিল তাই সে থেকে গেছে।বেডরুমে গিয়ে দেখলাম সে তার সেই পুরোনো কাঁথা গায়ে জড়িয়ে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে।দেখে বড় মায়া লাগল,আজকাল বেচারির শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।চুপচাপ ওর পাশে বসে ভাবতে লাগলাম মেয়েরা সত্যিই খুব অদ্ভুত।কখন যে কোন জিনিসটা পছন্দ হয়ে যায় তার কোনো ঠিক নেই।এই যে যেমন মনির এই বিশ্রী জিনিসটার প্রতি আকর্ষন হয়েছে।মনি এমনিতে খুবই পরিচ্ছন্ন মানুষ।নোংরা ময়লা দেখতে পারে না,পুরোনো ভাঙ্গাচোরা জিনিসকে বাসায় স্থান দেয় না।এমনকি ভালকরে পা ধুয়ে না আসলে আমাকে রাতে বিছানায় পর্যন্ত উঠতে দেয় না,সেই মেয়ে কিনা নিজেই একটা জরাজীর্ন কাঁথা গায়ে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে।তবে সেদিন আমার কাছে কাঁথাটা তেমন নোংরা মনে হলোনা।মনি মনে হয় ভালমতই এটা পরিষ্কার করেছে।হালকা হলুদ রংটা বেশ বোঝা যাচ্ছে,তার উপরের লাল সুতোর নকশাও তেমন ফ্যাকাসে বলে মনে হচ্ছে না।

এরপরে মাস খানেক কেটে গেছে।মনির শরীরটা বেশ খারাপ।ও কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে।আগের মত হাসে না, কথা বলে না এমনকি নড়াচড়াও করে না।সারাদিন শুধু বসে বা শুয়ে থাকে আর গায়ে জড়ানো থাকে সেই কাঁথা।আজকাল বুয়াই রান্না বান্না করে। ওকে একা রাখতে ভরসা পাই না তাই বুয়াকে বলে দিয়েছি আমি আসার আগ পর্যন্ত যেন বাসায় থাকে।তবুও অফিসে গেলে কেন যেন স্থির হতে পারিনা।শুনেছি এই সময় মেয়েদের হরমোন বদলে যায় বলে নানা রকম মানসিক আর শারিরীক সমস্যা হয়।কিন্ত মানুষ কি আসলে এতটা বদলে যায়?কে জানে?আজকাল মনে হয় এমন নির্জন যায়গাতে বাসা না নিলেই ভাল হতো,অন্তত কোনো সমস্যা হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া যেত।

একদিন রাতে মনির অনেক পেট ব্যাথা শুরু হলো।সেরাতেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো।ঘুম আর ব্যাথার ইঞ্জেকশন দেয়ার পর ও যখন ঘুমিয়ে তখন ডাক্তারের কাছে এমন একটা খবর শুনলাম যা আমাকে হতবাক করে দিল।ওর পেটে নাকি কোনো বাচ্চা নেই।পেট ব্যাথা আছে কিন্ত কোনো রক্তক্ষরন হয়নি যে বোঝা যাবে এবরশান হয়ে গেছে।আগের মাসের চেকাপের সময়ও সব ঠিক ছিল কিন্ত এবার কিছুই ধরা পড়ছে না।যেন বাচ্চাটা বাতাসে মিলিয়ে গেছে।আমি তো বটেই ডাক্তার পর্যন্ত হতবাক হয়ে গেলেন।শেষে ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন যে এবরশান হয়ে গেছে কিন্ত মনি টের পায়নি আর দেহে রক্তাল্পতার কারনে রক্তক্ষরন হয়নি।কিন্ত নিজেই যে এ ব্যাখ্যায় সন্তষ্ট হতে পারছেন না তা পরিষ্কার বোঝা গেল।আর আমি সন্তান হারানোর বেদনার চেয়ে অদ্ভুত ঘটনাটা নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লাম।ডাক্তার মনির ফ্যাকাসে চেহারার জন্যেও আমাকে অনেক বকাঝকা করলেন।শেষে একগাদা ভিটামিন আর ঘুম আর ব্যাথার ঔষধ প্রেসক্রিপশন করে দিলেন।


বাসায় এসে আমি যখন তাকে ভয়ানক দুঃসংবাদটা দিলাম তখন সে কোনো তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাল না শুধু তার চোখের কোন দিয়ে কিছু অশ্রু ঝরে পড়ল।তার এই আচরন দেখে চিন্তায় দিশেহারা আমি আবার উপলব্ধি করলাম মেয়েদের মন বোঝার সাধ্য কারো নেই।এরপর থেকে মনি যেন আরো চুপচাপ হয়ে গেল।তার চোখের কোনে কালি,গোলগাল গোলাপী আভাযুক্ত গাল শুকিয়ে চোয়াল দেখা যায়,চামড়া হয়েছে খসখসে আর ফ্যাকাসে সাদা।আজকাল সে খাবারও মুখে নিতে চায় না।দেখে মনে হয় দুনিয়ার কোনো কিছুতেই আর তার আকর্ষন নেই।না,ভুল বললাম একটা জিনিসে তার প্রবল আকর্ষন তা হলো সেই কাঁথা।কিছুতেই সে সেটা হাতছাড়া করতে চায় না।এমনকি কাঁথার নিচে আমাকেও জায়গা দেয় না।


আমাদের সন্তানের রহস্যময় অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথা শুনে আমার মা এবং শাশুড়ি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন।তারা দুজনেই বার বার বলতে লাগলেন আমি যেন কোন পীর বা হুজুরের সাথে যোগাযোগ করি।মনির এসব লক্ষন নাকি স্বাভাবিক না।বুয়াও সারাক্ষন কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে বলে,আব্বাজান আম্মারে কোনো কামেল লোকের কাছে নিয়া যান।মনে হয় তার খারাপ বাতাস লাগছে।নাইলে প্যাডের বাইচ্চা এমুন গায়েব হয়া যায়?দেরী কইরেন না,বাচ্চাডার ক্ষতি হইছে এবার কিন্তক আম্মাজানের ক্ষতি হইব।

আমি কখনো এসেব হাবিজাবিতে বিশ্বাস করিনি।তবে ওর অবস্থা দেখে আমার মন কেমন যেন দোটানার মাঝে পড়ে গেল।বিশেষ করে একদিনের ঘটনায় রীতিমত ভড়কে গেলাম।সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় গিয়ে দেখি মনি দরজা জানালা বন্ধ করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে।হঠাত আমার কেমন যেন রাগ হলো।গরম পড়তে শুরু করেছে।এর মাঝে সারাদিন ঘর বন্ধ করে রাখলে অসহ্য লাগে কিন্ত মনি আগে মোটেও এমন ছিলনা।ঘরে ঢুকে আমি সব জানালা খুলে দিলাম।লাইট জ্বালিয়ে মনির গা থেকে কাঁথাটা টেনে খুলে নিতে চাইলাম কিন্ত আমার স্পষ্ট মনে হলো কাঁথাটা যেন মনির গায়ের সাথে আপনা থেকেই আঁটকে আছে।ঠিক যেমনটা জোঁক মানুষের গায়ে আঁটকে থাকে।আমি চমকে উঠে সরে গেলাম।কি আশ্চর্য!কাঁথাটাকে যেন নতুন মনে হচ্ছে।হলুদ রঙ আরো উজ্জ্বল হয়েছে,টকটকে লাল সুতোয় জটিল নকশা অসম্ভব ফুটে উঠেছে।আমি খুবই ভয় পেয়ে গেলাম।একটা বিশ্রী সন্দেহ আমার মনে দানা বেঁধে উঠতে লাগল।

পরদিনই আমি বুয়াকে বললাম তার যে পরিচিত মহিলা পানিপড়া দেয় সে যেন আমাকে তার কাছে নিয়ে যায়।আমি সেই মধ্যবয়সী মহিলাকে আমার সব কথা খুলে বললাম।নিজের সন্দেহের কথাও বললাম।তিনি মনিকে এক নজর দেখতে চাইলেন।আমি যখন মহিলাকে নিয়ে এলাম মনি তখন যথারীতি ঘুমে অচেতন।মহিলা সব কিছু দেখে ভয়ানক চমকে উঠলেন।ওকে দেখে তিনি আমাকে হতাশ করে দিয়ে জানালেন আমদের সাহায্য করার সাধ্য তার নেই।কাঁথাটা খুবই অশুভ একটা জিনিস।এর হাত থেকে সে আমাদের মুক্তি দিতে পারবে না।শুধু যদি খুব সমস্যা হয় তবে সাময়িক সাহায্যে আসতে পারে ভেবে তার সবচেয়ে শক্তিশালী তা্বিজ আর পানি পড়া আমাকে দিয়ে গেলেন।

উনাকে বিদায় দিয়ে আমি রীতিমত ভেঙ্গে পড়লাম।এ আমি কি করেছি!উপহার হিসাবে নিজের প্রিয়তমার জন্য বিপদ ডেকে এনেছি!ঘুমন্ত মনির দিকে তাকিয়ে হঠাত আমার মনে সাহস জেগে উঠল।আমি আমার কর্তব্য স্থির করলাম।অফিস থেকে কয়দিনের ছুটি নিলাম।চাকরি পাওয়ার পর থেকে ব্যাংকে কিছু টাকা জমাতাম সেই সঞ্চয় ভেঙ্গে মনিকে বুয়ার দায়িত্বে রেখে নেপাল রওনা দিলাম।জানতাম মনির কাছ থেকে কাঁথা আলাদা করা যাবে না তাই বাক্সটা নিজের সঙ্গে নিলাম।নেপালের সেই বাজারে পৌঁছে আমি বুড়িকে পেলাম না।বাক্সটা দেখিয়ে যাকেই কিছু জিজ্ঞাসা করি সেই চমকে উঠে দ্রুত পালিয়ে যায়।বুঝলাম বাজারের সবাই এটা সম্পর্কে জানে কিন্ত কেউ কিছু বলবে না।তারা মনে হয় এটাকে ভীষন ভয় পায়।আমার অক্লান্ত ছুটাছুটি দেখে মনেহয় একজন তরুনীর দয়া হলো।সে নানারকম মিঠাই বিক্রি করতে করতে ভাঙ্গা ইংরেজিতে জিগাসা করল সাহেব যে মানুষটার বিপদ হয়েছে সে তোমার কি হয়?আমি উত্তর দিলাম,সে আমার স্ত্রী।

তরুনী যে গল্পটা বললো তা অনেকটা এমন।অনেক আগে এই গ্রামে এক মহিলা ছিল যে নানা রকম প্রেতশক্তির চর্চা করত।বৃদ্ধরা বলে সে নাকি অনেক রহস্যময় ক্ষমতার অধিকারি ছিল।লোকে তাকে পানিতে হাঁটতে দেখেছে,পাহাড়ি ঝোড়ো হাওয়ার আগে আগে ভেসে চলতে দেখেছে।শোনা যায় সে প্রেত চর্চার জন্য নরবলি দিত।গ্রামের কিছু বাচ্চা নাকি হঠাত করেই গায়েব হয়ে যেত যাদের আর হদিশ মিলত না।সকলের ধারনা ছিল সেই এসকল শিশুকে হত্যা করত।তাকে নিয়ে গ্রামে অসন্তোষ দেখা দিল।বিশেষ করে সন্তান হারা বাবা মা গ্রামের মোড়লের কাছে দাবি জানালো সেই মহিলাকে হত্যা করার।মহিলা অবশ্য আগে থেকেই তার বিপদ আঁচ করতে পেরেছিল তাই সে তার সব শক্তি অদ্ভুত উপায়ে সংরক্ষনের সংকল্প নিল।নিজ হাতে বিশেষভাবে চাষ করা তুলার সুতো দিয়ে কাপড় বুনে সে একটা কাঁথা প্রস্তত করল।তাতে লাল সুতোয় অদ্ভুত উপায়ে নকশা করল।সেই সুতোর নকশায় বাঁধা পড়ল তার বশীভূত সকল রহস্যলোকের জীব,সেই সাথে তার সব ঐন্দ্রজালিক শক্তি।সে নাকি নকশার সুতো রঙ করেছিল তার নিজের রক্ত দিয়ে।এবার সে তার নিজের আত্মাকেও বন্দি করল সেই সুতোর নকশায়।এভাবেই সে মানব জীবন ছেড়ে রহস্যলোকের বাসিন্দা হয়ে গেল চিরতরে।গ্রামবাসি তার বাসা আক্রমন করে কিছুই পেলনা।তবু তারা তার কুটির জ্বালিয়ে দিল।


শোনা যায় তার একটা কিশোরী মেয়ে ছিল।তাকেও আর দেখা গেল না।তবে এর অনেকদিন পরে মেয়েটিকে দেখা যেত মাঝে মাঝে।তার হাতে থাকত সুন্দর কারুকাজ করা কাঠের বাক্স।লোকে বলে বাক্সের মধ্যেই থাকত তার মায়ের দিয়ে যাওয়া কাঁথা,যা ছিল অপার শক্তির আধার।এই বাক্সটিই বংশ পরম্পরায় সেই বুড়ির কাছে এসেছে যার কাছ থেকে আমি এটি কিনেছি।তরুনীর কাছে জানতে পারলাম যে কেউ চাইলেই কাঁথার শক্তি ব্যবহার করতে পারেনা তার জন্য তাকে দীর্ঘ ও কষ্টকর আচার অনুষ্ঠান করতে হয়।তবে শক্তি ব্যবহার না করতে পারলেও এর যে মালিক থাকে তাকে নাকি কিছু নিয়ম অবশ্যই পালন করতে হয়।লোকে বলে প্রতি দুইবছর পর একটা নির্দিষ্ট সময়ে কাঁথার জন্য একজন মানুষের রক্ত দরকার হয়।এই রক্ত কাঁথায় নকশায় বন্দি আত্মাগুলোকে শক্তি যোগায়।কাঁথাটা একটা জীবন্ত পরজীবির মতই মানুষের দেহ থেকে রক্ত শুষে নিয়ে তাকে নিঃশেষ করে দেয়।তারপর সেই মানুষটার আত্মাও বন্দি হয় সেই কাঁথার মাঝে।তারপর সেই কাঁথা ফিরে আসে তার মালিকের কাছে।এই আচার পালন না করলে মালিকের ভীষন ক্ষতি হয় তাই কাঁথা যার কাছে থাকে সে দুই বছর পর পর বের হয় নতুন শিকার জোগাড় করতে।প্রায় দুইশ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় এই কাঁথার হাত বদল হয়েছে।কাঁথার সকল মালিকের আত্মাই নাকি বন্দি আছে এই কাঁথার ভেতরে।সেই মহিলার শেখানো বিদ্যাতেই নাকি তার বংশধররা এমন কাজ করে আসছে।


তরুনীর বলা কথাগুলো যত আজগুবিই হোক আমি তা বিশ্বাস করলাম কারন আমি নিজেই দেখেছি মনির গায়ে কেমন জোঁকের মত লেগে থাকে ঐ অভিশপ্ত কাঁথা।আমি নিজেই চোখের সামনে নিজের প্রানবন্ত প্রিয়তমাকে প্রেতের মত ফ্যাকাসে হয়ে যেতে দেখেছি।আমি তরুনীকে সেই বুড়ির বাড়ির ঠিকানা জিগাসা করলাম।সে দূরের পাহাড়ের দিকে হাত দিয়ে দেখালো আর মাথা নেড়ে বললো ওখানে গিয়ে কোন লাভ নেই সাহেব কারন বুড়ি গত মাসে মারা গেছে।তার কোনো ছেলে মেয়ে ছিলনা তাই এর কোন দাবিদার নেই। তার কথা শুনে আমি আর্তনাদ করে বসে পড়লাম।তাহলে কি মনিকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই।আমি কাঁথাটা লুকিয়ে রেখে দেখেছি মনি কিভাবে যেন ঠিকই সেটা খুঁজে পায়।এখন বুঝতে পারছি কাঁথাটা নিজেই তার পোষকের কাছে ফিরে আসে।তাই যত দূরেই সেটা রাখা হোক মনিকে সেটা ঠিকই খুঁজে নেবে।তরুনীর বোধহয় আমাকে দেখে মায়া হলো।সে বলল এই কাঠের বাক্সটার মনেহয় কিছু ক্ষমতা আছে।সে নাকি বুড়িকে একদিন বলেছিল,বাক্সতে কি?বুড়ি নাকি ভেষজ ঔষধ তৈরী করতে করতে উত্তর দিয়েছিল,বাক্সতেই তার সব ক্ষমতা,বাক্স খুললেই নাকি সেটা পালিয়ে যেতে পারে।তরুনীর কথা শুনে মনে একটু আশার আলো দেখা দিল।মনে হলো এই বাক্সটি হয়ত কাঁথাটির জন্য একরকম খাঁচা।কারন এটি কেনার পরে আমি যখন বাসায় একা ছিলাম তখন কাঁথাটি তো আমায় আক্রমন করেনি।কাঁথাটি যেহেতু জীবন্ত সেটা তখন আমায় মেরে ফেললেও কেও জানতে পারতো না কিন্ত সেটা তখন যেখানে রেখেছিলাম সেখানেই ছিল।


তিন
আমি যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরে এলাম।যখন বাড়িতে পৌঁছেছি তখন রাত হয়েছে।বুয়াকে বিদায় করে দিয়ে আমি বেডরুমে গেলাম।যদিও সবকিছু জানি তবুও কাঁথাটির দিকে তাকিয়ে ভয়ে গা শিউরে উঠল।অন্ধকারেও সেটির গায়ের লাল নকশা রুবি পাথরের মত চকচক করছে।বুঝলাম আজকের মধ্যেই কিছু না করতে পারলে আমার মনিকে বাঁচানো যাবে না।লাইট জ্বালিয়ে দিতেই চকচকে ভাব কমে গেল আর আমি দেখলাম কাঁথাটি একদম সদ্য তৈরী করা নতুনের মত হয়ে গেছে।গাঢ় হলুদের মাঝে রক্তলাল নকশা,কিছুকিছু জায়গা আবার জমাট রক্তের মত কালচে।দেখে মনে হচ্ছে যেন এগুলো কোনো প্রানীর রক্তবাহী শিরা আর ধমনী।হঠাতই ভীষন রাগে আমার শরীর জ্বলে উঠল।কোথাকার কোন অভিশপ্ত ডাইনির অভিশপ্ত হাতের সৃষ্টি আমার গোছানো জীবনটাকে এভাবে শেষ করে দেবে???কখনোই আমি তা হতে দেব না।আমি সর্বশক্তিতে মনির গা থেকে কাঁথাটি টেনে নেয়ার চেষ্টা করলাম।এসময় স্পষ্ট দেখতে পেলাম কাঁথা থেকে খুবই সূক্ষ্ম রোয়া রোয়া কি যেন মনির চামড়ার ভেতর থেকে বের হয়ে কাঁথার মাঝে হারিয়ে গেল।আজ কাঁথাটি টেনে ধরতেই সেটা জীবন্ত প্রানীর মত কিলবিল করে উঠল।আমার হাত ছাড়িয়ে সেটি আবার মনিকে জাপটে ধরলো।আমি সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও সেটি ধরে রাখতে পারলাম না।
ততক্ষনে মনির ঘুম ভেঙ্গে গেছে।সে আমায় দেখে করুন ভাবে কেঁদে উঠল।এতদিন মনির মাঝে কেমন একটা নির্লিপ্ত ভাব ছিল যেন সে সম্মোহিত হয়ে আছে কিন্ত আজ তাকে দেখে বোঝা গেল তার সে ঘোর কেটে গেছে।এতদিনে হয়ত সে নিজের বিপদ বুঝতে পেরেছে।এই দুইদিনেই সে প্রায় কঙ্কালের মত হয়ে গেছে শুকিয়ে।সে নিজেও হয়ত বুঝতে পারছে তার শেষ সময় সমাগত।সে উঠে বসার চেষ্টা করলো কিন্ত পারল না,কাঁথাটি তাকে চেপে ধরে রাখল ঠিক যেমন কোনো অজগর তার শিকারকে ধরে রাখে।আমি এবার মরিয়া হয়ে গেলাম।একবার আগুন জ্বালানোর কথাও মাথায় আসল কিন্ত তাহলে কাঁথার সাথে মনিও পুড়ে মরবে।তাই সে চিন্তা বাদ দিতে হলো,হঠাতই মনে পড়ল সেই পানি পড়ার কথা যেটা সেই মধ্যবয়সী মহিলা আমায় দিয়ে ছিলেন।আমি রান্নাঘর থেকে বোতলটি এনে একটা বড় পানিভরা বালতিতে তা মিশিয়ে দিলাম এরপর তার পুরোটা এনে মনির গায়ে ঢেলে দিলাম।জানতাম না কোনো কাজ হবে কিনা কিন্ত সৃষ্টিকর্তা আমাকে সাহায্য করলেন।এবার আমি সহজেই কাঁথাটিকে আলাদা করে ফেলতে পারলাম।আলাদা করার পর আর দেরী না করে সেটিকে তাড়াতাড়ি বাক্সে পুরে দিলাম।বাক্সের ডালা আঁটকে আমি মনির দিকে নজর দিলাম।ভিজে চুপচুপে হয়ে বেচারী ভয়ে আর ঠান্ডায় কাঁপছিল।আমি দ্রুত হাসপাতালে ফোন করে একটা এম্বুলেন্স ডাকার ব্যবস্থা করলাম।


এরপর অনেকদিন কেটে গেছে।আমরা দুজনে ভাল আছি।সেই রাতে মনির স্বাস্থের অবনতির জন্য আমার ডাক্তারের কাছে অনেক গালমন্দ শুনতে হয়েছিল।ওকে তিন ব্যাগ রক্ত দেয়ার পর ওর জীবন বাঁচানো গেছে।আজকাল সে বেশ সুস্থ আছে আর দেখতেও বেশ গোলগাল (আগের চেয়ে বেশিই গোলগাল) হয়েছে।আমরা একসপ্তাহের মধ্যেই সেই বাসা বদল করে শহরে নতুন বাসা নিয়েছিলাম।আমার অনুমান ঠিক ছিল।বাক্সে ভরার পর কাঁথাটি আর কোনো ক্ষতি করেনি।বাসা বদলের আগে আমরা দুজনে মিলে সেই অভিশপ্ত কাঁথা বাক্স সমেত বাসার পেছনের কড়ই গাছের নিচে গভীর গর্ত করে পুঁতে দিয়েছিলাম।মনি আবার আমাকে একটা সুখবর শুনিয়েছে কিন্ত আমি এবার কোনো রিস্ক নিতে চাই না।তাই আমি মনিকে এখন একটা রাবারব্যান্ড কিনেও উপহার দিই না।এই জন্য অবশ্য সে মাঝে মাঝে অভিমান করে কিন্ত আমি পাত্তা দিই না।

আমি কাঁথার বিষয় নিয়ে অনেক ভেবেছি।মালিকহীন কাঁথাটি কি তাজা রক্তের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে নাকি অনন্তকাল অপেক্ষা করবে নতুন মালিক পাওয়ার আশায়?শুনেছি যে নির্দিষ্ট আচার ব্যবহার পালন করে কাঁথাটির নিয়ন্ত্রন নিতে পারবে সেই হবে অসীম ক্ষমতার অধিকারি।আমার ক্ষুদ্র জীবনে অসীম ক্ষমতা চাইনা শুধু নিজেদের ছোট্ট নীড়ে সুখের একটা জীবন চাই আর আমার মনেহয় তা আমি পেয়েছি।আপনাদের মাঝে কারো কি অসীম ক্ষমতা দরকার?থাকলে আমার পুরোনো বাসায় চলে যেতে পারেন।বাসার পেছনের উঠোনের ধারে বড় শিলকড়ই গাছটার নিচে বাঁ দিকে বড় পাথরটার নিচেই ওটাকে পুঁতেছিলাম।বাসার ঠিকানা হচ্ছে রোড নম্বর সাতাশ,বাড়ি নম্বর এগারো,জেলা-----থাক, কি দরকার শুধু শুধু জীবনে দুঃস্বপ্ন ডেকে নিয়ে আসার?

মন্তব্য ৩২ টি রেটিং +৯/-০

মন্তব্য (৩২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৫৮

মনিরা সুলতানা বলেছেন: দারুন রহস্যময় ...
এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম ...

প্রথম +++++++

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:১৬

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: গল্পটি ভাললেগেছে জেনে কৃতজ্ঞ বোধ করছি---

ভাল থাকবেন

২| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:০৬

আহলান বলেছেন: সুপার ...

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:১৭

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: থ্যাঙ্ক ইউ আহলান।

৩| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:২৩

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: অসাধারণ একটি গল্প ++++++++++

চালিয়ে যান , ভৌতিক গল্প ব্লগে আজকাল কেউ লেখেই না । আমি একটা লিখছি , আগামী মাসে দিবো :)

অনেক শুভকামনা :)

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:২৬

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: অসম্ভব ব্যস্ত সময়ের মধ্যে মাথার মাঝে গল্পটি ঘুরপাক খেয়ে আমাকে জ্বালিয়ে মারছিল----তাই যন্ত্রনাটা শেষ করেই দিলাম লিখে ফেলে।

ভাল লেগেছে জেনে সত্যিই ভাল লাগছে।আপনার গল্পটির অপেক্ষায় রইলাম।
ভাল থাকবেন।

৪| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:০৬

 বলেছেন: ++++++

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:২৭

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: ধন্যবাদ।

৫| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৩৬

সোহানী বলেছেন: কাথাঁর হরর গল্পে ভালো লাগা..... তবে আমি খুব ভুত ভয় পাই তাই ভুতের গল্প এড়িয়ে যাই। তারপর ও ভালো লাগা........

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৩০

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: আমি ভুত ভয় পাই আবার পছন্দও করি।রাত তিন্টার দিকে নিস্তব্ধ হলের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় গা ছছম করে আবার ভুতের গল্পের বই পেলে রাত জেগে পরতেও দ্বিধা করিনা।

গল্পটি ভাললেগেছে জেনে আমি আনন্দিত।
ভাল থাকবেন সোহানী।

৬| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৫

এমএম মিন্টু বলেছেন: +++++++++

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৩১

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: ধন্যবাদ

৭| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৫৬

ভবিষ্যত নেতা আসিফ বলেছেন: অনেকদিন পর এক নিঃশ্বাস এ একটা গল্প পরলাম... অনেক অনেক ভালো লাগছে +++++++++++

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৩৬

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন:
আমার কিন্ত গল্প পড়তে খুবই ভাল লাগে।মনটা কেমন যেন ফ্রেস হয়।
গল্পটি অনেক ভাল লেগেছে জেনে খুশি হয়েছি।

গল্পগুলি হয় মানুষের জীবনের অংশ নয়ত মানুষের মনোজগতের বিচিত্র চিন্তার প্রতিফলন।

তাই নতুন নতুন গল্প পড়তে থাকুন।খুশি থাকুন।ভাল থাকুন।

৮| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:১০

হু বলেছেন: ++++++++++ খুবই সুন্দর গল্প। ভৌতিক গল্প পরতে ভালই লাগে। একটানে পরে শেষ দিলাম। লিখা চালিয়ে যান। শুভকামনা রইল।

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৪০

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: আপনাদের দোয়ায় যদি সুস্থ থাকি তবে নিজের উদ্ভট খেয়া্লগুলোকে গল্পে পরিনত করে মাঝে মাঝে আপনাদের জীবন থেকে ২০-২৫ মিনিট কেড়ে নেব।এমনটাই ইচ্ছা আছে।

গল্পটি ভাল লেগেছে জেনে কৃতজ্ঞ বোধ করছি।

৯| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:৩২

ইমরাজ কবির মুন বলেছেন:
চমৎকার, বাহ !

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৪১

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: ধন্যবাদ। :) :) :)

১০| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৪৬

জলমেঘ বলেছেন: খুবই ভালো লাগলো গল্পটা। আরো গল্পের অপেক্ষায় রইলাম :)

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৪৪

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: প্রথমেই একটি কথা না বললে নয়,যে 'জলমেঘ' নামটি কিন্ত চমতকার!!
গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। :) :)

১১| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৫৯

সকাল রয় বলেছেন:
অনেক ভালো লাগা

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৪৫

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ এবং শুভকামনা।

১২| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৩৯

আমি তুমি আমরা বলেছেন: চমতকার গল্প। এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম। ভাল লেগেছে :)

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৪৭

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ গল্পটি পড়ার জন্য।ভাল থাকবেন।

১৩| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:১৯

কলমের কালি শেষ বলেছেন: ভৌতিক গল্প চমৎকার লাগলো ।

২৯ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:৫১

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: গল্পটি ভাল লেগেছে জেনে কৃতজ্ঞ বোধ করছি।

১৪| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:৩৮

রিফাত হোসেন বলেছেন: +

২৯ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:৫২

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: :)

১৫| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:২০

সুমন কর বলেছেন: চমৎকার গল্প। গুছিয়ে লিখেছেন।

৮ম ভাল লাগা রেখে গেলাম।

২৯ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:৫৭

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: ভৌতিক গল্প আমার খুবই ভাল লাগে তবে কখনো লিখতে পারবো বলে মনে করিনি।সহব্লগার দের উতসাহ আর প্রেরনা আমাকে লেখার শক্তি যুগিয়েছে।
অনেক ধন্যবাদ এসবের জন্য।
ভাল থাকুন সব সময়। :)

১৬| ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:০১

ডি মুন বলেছেন: আমাদের সন্তানের রহস্যময় অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথা শুনে আমার মা এবং শাশুড়ি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন।তারা দুজনেই বার বার বলতে লাগলেন আমি যেন কোন পীর বা হুজুরের সাথে যোগাযোগ করি।



লোকে বলে প্রতি দুইবছর পর একটা নির্দিষ্ট সময়ে কাঁথার জন্য একজন মানুষের রক্ত দরকার হয়।এই রক্ত কাঁথায় নকশায় বন্দি আত্মাগুলোকে শক্তি যোগায়।কাঁথাটা একটা জীবন্ত পরজীবির মতই মানুষের দেহ থেকে রক্ত শুষে নিয়ে তাকে নিঃশেষ করে দেয়।


ভৌতিক গল্পে ভালো লাগা +++
তবে বেশ কিছু টাইপো আছে লেখাটিতে। যেমন অনেক যায়গায় " ৎ " এর বদলে আপনি "ত" লিখেছেন, আবার "ণ " এর জায়গায় লিখেছেন "ন" । এগুলো খুব বড়ো কোনো ত্রুটি নয়। তবু এডিট করে নিলে গল্পটি আরো সুন্দর হয়ে উঠবে।


ভবিষ্যতে আরো সুন্দর সুন্দর গল্প উপহার পাব আপনার কাছ থেকে, এটাই প্রত্যাশা।

ভালো থাকা হোক।

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:১৩

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: বানান নিয়ে আমার একটু সমস্যা আছে তা স্বীকার করতে দোষ নেই।প্রায়ই আমি বুঝতে পারিনা হ্রস্ব-ই কার না দীর্ঘ-ই কার হবে,কোন ধরনের ন হবে বা স হবে ইত্যাদি।

তবে অভ্র ফোনেটিকস এ লিখি বলে অনেক ভাবে চেষ্টা করেও খন্ড-ত দিতে পারিনা তাই এ ভুলটি করা ছাড়া উপায় নেই।অন্য ভুল গুলোর দিকে খেয়াল রাখার চেষ্টা করব।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
ভাল থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.