নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবন হলো এক কাপ গরম চা আর একটি জ্বলন্ত সিগারেটের মতো। গরম চা এক সময় জুড়িয়ে যাবে, সিগারেটের তামাকও পুড়ে শেষ হয়ে যাবে।

পয়গম্বর

The woods are lovely, dark and deep, But I have promises to keep, And miles to go before I sleep, And miles to go before I sleep.---Robert Frost

পয়গম্বর › বিস্তারিত পোস্টঃ

দেয়ালের ভেতরে ঘুমন্ত মৃতদেহ

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৫

টরন্টো থেকে কাছেই পিটারবরো নামের একটা জায়গায় পাবলিক হেল্থের একটা জব ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছি। ইন্টারভিউ যিনি নিচ্ছেন, তিনি খুব গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, "কানাডায় বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার সাবজেক্টে পড়াশুনা করে তুমি কি (অভিজ্ঞতা) পেয়েছ?" ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে খুব সুন্দর করে হেসে সত্যি উত্তরটাই দিলাম "বাঞ্চ অব ফ্রেণ্ডস"। অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কয় ঘন্টা পড়াশুনা করেছি, তার থেকে আমার বন্ধুর সংখ্যা বেশি।

পাঠক, তাহলে বুঝতেই পারছেন যে, আমি মানুষটা বন্ধু পাগল। কেউ আমার সাথে অতিরিক্ত ভাব না দেখালে তার সাথে বন্ধুত্ব হতে আমার কয়েক মিনিট সময়ের দরকার মাত্র। এরকমই কয়েক মিনিটের পরিচয়ে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে ছেলেটার সাথে, তার নাম 'ক্রিস'। বয়সে আমার সাথে বেশ ভালোই ফারাক আছে। মানে বলতে চাইছি যে, আমার থেকে বয়সে সে অনেক ছোট। কিন্তু বন্ধুত্বতো আর বয়স মানেনা। অবশ্য সেদিন চিন্তা করে দেখছিলাম, একটা অদ্ভূত ব্যাপার হলেও সত্যি যে, আমার নিজের বয়সী কোন বন্ধু আমার নেই। সত্যিই নেই। আমার যাদের সাথে বন্ধুত্ব, তারা হয় আমার একবারে হাতে গুণে দশ বছর বা তার বেশি ছোট অথবা দশ বছর বা তার বেশি বড়। প্লিজ এখন আবার আমার বয়স জিজ্ঞেস করে আমাকে বিব্রত করবেননা আশা করি। শারীরিক বয়স যা-ই হোক না কেন, মনের দিক থেকে আমি 'অলওয়েজ সুপার ইয়ং ম্যান।'

ক্রিস-এর ব্যাপারে বলছিলাম। ওর সম্পর্কে ছোট একটা ভূমিকা না দিলেই নয়। ক্রিসের বাবা ইটালিয়ান, মা ফ্রেঞ্চ। আর জন্মসূত্রে সে কানাডিয়ান। সেই লেভেলের ফানি টাইপ একটা ছেলে। নতুন যে মেয়েকে দেখে, তারই প্রেমে সে দিন-রাত হাবুডুবু খাচ্ছে। আর আমার লাইফে এরকম বাচাল মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। একটা মানুষ ক্রমাগত কথা বলেই চলেছে। কিভাবে সম্ভব? তাকে অবশ্য আমার ব্যাপারেও জিজ্ঞেস করেছিলাম। তার দৃষ্টিতে আমার মতো বোরিং রসকষবিহীন মানুষ নাকি সে পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি দেখেনি। পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একদিন ক্রিসের কথাটা চিন্তা করে দেখলাম। খুব একটা ভুল বলেনি।

যে বিষয়টা নিয়ে লিখতে বসেছি, সেই গল্পটা বলি এবার।

ক্রিসের পুরো পরিবার ক্যাথলিক ক্রিশ্চিয়ান। ওর নানা ক্যান্সারের রোগী ছিলেন। ছিলেন বলছি কারণ সপ্তাহখানেক আগে তিনি পরলোকগত হয়েছেন। ক্রিসকে মানুষ করেছেন তারা এই নানা-ই। তার নানা ছিল তার কাছে বাবা'র মতো। কাজেই নানা'র এই মৃত্যুতে সে যথারীতি ভেঙ্গে পড়েছে।

ক্যাথলিক ক্রিশ্চিয়ারদের নিয়ম অনুযায়ী ক্রিস আর তার পরিবার ক্রিসের নানার 'ফিউনারেল'-এর আয়োজন করলো। গেল মঙ্গলবার সকালে আমিও গেলাম সেই ফিউনারেল অনুষ্ঠানে। স্কারবরো সিটির ওয়ার্ডেন এবং শেপার্ড এর ইন্টারসেকশনে হাইল্যাণ্ড ফিউনারেল হোম। সত্যি কথাটা এই বেলা স্বীকার করি। আমি কখনো এর আগে ক্রিশ্চিয়ারদের ফিউনারেল-এ যাইনি। তাই ভাবলাম, একটা এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে আসি। কি ঘটনা হয়, একটু দেখি।

ফিউনারেল অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি তার নানা'র মরদেহ একটা ক্যাসকেড অর্থাৎ কফিনে শোয়ানো আছে। দেখে মনে হচ্ছে মুখে মেক-আপ দিয়ে স্যুট-টাই পরিহিত অবস্থায় তিনি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছেন। ওখান থেকে তার মরদেহকে শববাহী গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হলো 'মেমরী গার্ডেনস লেন' নামের একটা জায়গায়। এখানেই বাকী কাজ হবে। অর্থাৎ, তার মৃতদেহকে দাফন করা হবে।

শববাহী গাড়ির পেছন পেছন গাড়ি চালিয়ে আমরা '৩৩ মেমরী গার্ডেনস লেন' -এর 'আর্বর মেমরিয়ালে'র এক বিশাল বিল্ডিং-এর সামনে এসে নামলাম। শুরু থেকেই আমার মাথায় ছিল যে, ক্রিশ্চিয়ারদের মৃতদেহকে মাটি খুঁড়ে গোড় দেয়া হয়। কিন্তু ক্রিসের কথায় এবার আমার অবাক হবার পালা। এই বিশাল বিল্ডিং-এর ভেতরেই নাকি তার নানাকে সমাহিত করা হবে। কিন্তু কিভাবে? মনে হাজারটা প্রশ্ন এসে ভীড় করলো।

মৃহদেহসহ আমরা সবাই সেই বড় বিল্ডিং-এর ভিতরে ঢুকলাম। বিল্ডিং বললে ভুল বলা হবে। পুরো এক ফাইভ স্টার হোটেল। কিন্তু এই হোটেলের কোন রুম নেই। অনেকগুলো লেভেলে রুমের জায়গায় আছে বিশাল বিশাল দেয়াল। অনেকটা জিগজ্যাগ টাইপ দেয়াল। অর্থাৎ, বিল্ডিং-এর যে ফ্লোরে আমি হাঁটছি, সেই ফ্লোরের ভেতরে ছোট জিগজ্যাগ করিডর। আর আমার সামনে পেছনে পাশে এরকম বড় বড় কম করে হলেও তিন মানুষ উঁচু সব দেয়াল। আর সেইসব দেয়ালের এক একটাতে আনুমানিক ৪০-৫০ টা চার কোণৃকৃতির খোপ। সেইসব চতুষ্কোন খোপের ভেতরেই অসংখ্য মৃতদেহ শুয়ে আছে।

হ্যাঁ, পাঠক, এক বর্ণও মিথ্যে বলছিনা। ক্রিসের মুখে যখন শুনলাম যে, তার নানাকেও দেয়ালের একটা চারকোণা খোপের ভেতরে সমাহিত করা হবে, তখন আমার চারপাশের দেয়ালগুলো দেখে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। ভাবতে পারেন যে, একটা বিশাল বাড়ির ভেতরে আমি দাঁড়িয়ে। আর আমার চারপাশে বিশাল উঁচু ছাদ আর উঁচু উঁচু সব দেয়াল। সেইসব দেয়ালের ভেতরে না জানি কত মৃতদেহ শুয়ে আছে।

ক্রিসের নানাকে নিয়ে আমরা লেভেল ফোর-এ চলে এলাম। এসে দেখি সেখানে আগে থেকেই সব আয়োজন করা আছে। অর্থাৎ, তার নানা যে দেয়ালের ভেতরে সমাহিত হবেন, সেই দেয়ালের একদম উপরের কর্ণারের চারকোণা একটা খোপের টাইলস খোলা আছে। উপরে তাকিয়ে বুঝলাম যে, ওই খোপটার ভেতরে একটা মানুষকে শুইয়ে দেবার মতো করে জায়গা বানানো আছে। নিচে একটা ক্রেন। আর দুইজন মানুষ তৈরি আছে ক্যাসকেডসহ ক্রিসের নানাকে দেয়ালের ভেতরে ঢুকিয়ে দেবার জন্যে।

ক্যাথলিক ক্রিশ্চিয়ান নিয়ম অনুযায়ী মৃতদেহের সামনে পাদ্রী (ফাদার) ধর্মীয় বাণী শুনালেন। এরপর আমরা একে একে সেই মুখবন্ধ ক্যাসকেডের ওপরে লাল গোলাপ রাখলাম।

এইবার ক্যাসকেডকে খোপের ভেতরে ঢোকানোর পালা।

সেই দুইজন লোক অত্যন্ত দক্ষ হাতে ছোট ক্রেনটা দিয়ে নির্ধারিত দেওয়ালের সামনে ক্রিসের নানাসহ ক্যাসকেডটাকে নিয়ে প্রায় দুই মানুষ সমান উঁচুতে উঠে গেল। এরপর তারা দেয়ালের গায়ের সেই চারকোণা খোপের ভেতরে বিশাল কফিনটা ঠেলে ঢুকিয়ে দিলো। চারিদিকে কান্নার রোল। সেই মানুষ দু'টি এরপর দক্ষ হাতে খোপের মুখটা আঠা জাতীয় কোন এক বস্তু দিয়ে 'সিল' করা শুরু করলো। পুরো কাজটা করতে তাদের সর্বোচ্চ হয়তো দশ মিনিটের মতো লেগেছিল। ব্যাস। কাজ শেষ। ক্রিসের নানা এখন সেই বড় বাড়ির বড় দেওয়ালে ছোট একটা খোপের ভেতরে ঘুমুচ্ছেন। কয়েকদিন পরে সেই খোপের বাইরে তার ছবিসহ নাম থাকবে। যেমনটা আছে আরও অনেক খোপের সামনে।

ফিউনারেল অনুষ্ঠান শেষে ক্রিসকে খরচের ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। যা জানলাম, তার সারমর্ম হলো, ক্রিস তার নানাকে তিনভাবে সমাহিত করতে পারতো। এক. পুড়িয়ে (ক্রিমেশন), দুই. মাটিতে গোড় দিয়ে আর তিন. যেটি ক্রিসরা করলো। দেয়ালের ভেতরে সমাহিত করে। এভাবে দেয়ালের ভেতরে সমাহিত করতে ক্রিসের খরচ পড়েছে প্রায় বিশ হাজার কানাডিয়ান ডলার। অন্যভাবে করলে খরচ হয়তো কিছুটা কম পড়তো। কিন্তু প্রিয় নানার জন্যে ক্রিস এবং তার পরিবার সর্বোচ্চটুকুই করার চেষ্টা করেছে।

ফেরার পথে একটা কথা ভাবছিলাম। কানাডায় জন্মানো ফ্রি। এক কানাকড়ি খরচ নাই। কিন্তু মৃত্যু? যে কোন ধর্মের মানুষের জন্যে মৃতদেহ সমাহিত করা এখানে আসলেই একটা বড় আর্থিক ধাক্কা। এই বিশাল অঙ্কের টাকা দেবার ভয়েতো কারও মৃত্যু চিন্তা মাথায় আসারই কথা না। ভুল বললাম কিছু?

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫৫

চাঁদগাজী বলেছেন:



চাকুরী হয়েছিল?

২| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৪

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: এক ভিন্নরকম ফিউনারেলের সাথৈ পরিচিত হলাম।
একদমই অজানা এক সমািহতকরণের কথা জানানো অনেক ধন্যবাদ।

অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর শুভকামনা

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৮:০১

পয়গম্বর বলেছেন: ধন্যবাদ।

৩| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩২

দয়িতা সরকার বলেছেন: পুড়িয়ে ও এই পদ্ধতি জানা ছিল না। জানানো জন্য ধন্যবাদ।

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৮:০১

পয়গম্বর বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

৪| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৪৬

বিচার মানি তালগাছ আমার বলেছেন: নতুন পদ্ধতি। সম্ভবত আধুনিক মমি টাইপের ব্যপার...

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৮:০১

পয়গম্বর বলেছেন: মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ।

৫| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৩১

চাঁদগাজী বলেছেন:


আপনি আছেন তো?

৬| ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:৫৯

রাজীব নুর বলেছেন: মনে হলো- অনুবাদ গল্প পড়ছি।

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৭:৫৭

পয়গম্বর বলেছেন: ধন্যবাদ।

৭| ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১১:৩৪

রুদ্র নাহিদ বলেছেন: এরকম ভাবে ফিউনারেল করার আসল কারন টা কি?

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৯:১৪

পয়গম্বর বলেছেন: যদ্দুর শুনলাম, এভাবে ফিউনারেল করাটা ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের এক ধরণের রীতি।

৮| ১৩ ই জুন, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৬

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন: সেবা প্রকাশনীর ব্ই পড়লে এমন অনুভূতি হয়। খুব ভালো লেখা।

১৯ শে জুন, ২০১৮ রাত ২:০৯

পয়গম্বর বলেছেন: মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ।

৯| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৩১

শান্তির দেবদূত বলেছেন: বাহ্‌, এই বিষয়টা একেবারেই জানা ছিলো না। ভালো লিখেছেন, পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল আমি নিজেও আপনার পাশে দাঁড়িয়ে পুরো অন্তেষ্টিক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করছি।

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ৮:১৮

পয়গম্বর বলেছেন: মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.