নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শ্রাবণ আহমেদ (নিরব)\nট্রেইনার অব \"উই আর স্টুডেন্টস\" ঢাকা।

শ্রাবণ আহমেদ

শ্রাবণ আহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প

১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:০৭


কখনও হয়নি বলা
লেখক: Srabon Ahmed ( অদৃশ্য ছায়া)
.
আজি তুমি আসিয়াছো রঙিন আচ্ছাদনে
মম চক্ষু-প্রাণ হেরিছে তোমার মুখপানে।
তুমি অতি চঞ্চলা বিমলা শোভন নারী।
তোমারই সর্বাঙ্গে রহিছে রূপানল ভারী।

ক্যাম্পাসে শহীদ মিনারের পাদদেশে বসে কবিতা আবৃতি করছে নিরব। চাঁদনী আজ লালরঙা শাড়ি পড়ে ক্যাম্পাসে এসেছে। কবির মন কি আর চুপ করে বসে থাকতে পারে? চাঁদনীর রূপের বহিঃপ্রকাশ করতে চরণ কয়েক বেরিয়ে এলো মুখ থেকে।

চাঁদনীকে অমন বেশে ক্যাম্পাসে আসতে দেখে নিরব রাহাদকে বললো, আজকে কি কোনো বিশেষ দিন?
রাহাদ কিছুক্ষণ ভেবে মাথা নেড়ে বললো, না তো! আজ তো তেমন কোনো বিশেষ দিন না।
- তবে চাঁদনী আজ হঠাৎ এমন নবরূপে ক্যাম্পাসে এসেছে কেন?
রাহাদ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো, কী জানি ভাই? ওকেই জিজ্ঞেস করে দেখ।
চাঁদনী ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে এলো তাদের দিকে। সোহানকে নিরবের পাশ থেকে তুলে দিয়ে সে নিরবের পাশে বসে পড়লো। তৎক্ষণাৎ দূর থেকে আরিফ ফটোশুট করে বসলো। নিরব অনিমেষ নেত্রে চেয়ে রইলো চাঁদনীর দিকে। আহ! কী অপরূপ, অভিন্ন, অনন্য কন্যা। যেন কল্পলোক হতে নেমে আসা কোনো বিমলা নারী। দু'চোখে কাজল টানা, কাঠগোলাপে খচিত কেশকলাপ, ওষ্ঠদ্বয়ে নিমজ্জিত অধরারঞ্জনী।

নিরবকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে চাঁদনী বললো, কিরে ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
- তব রূপে বিমোহিত মম হৃদ।
- বুঝি না বাপু তোর কাব্যিক ভাষা।
- আজি মন মোর হয়েছে উতলা প্রিয় তোরই সান্নিধ্যে।

ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো দেখতে দেখতে আরিফ তাদের দিকে এগিয়ে এলো। পাশ থেকে রাহাদ উদ্দীপিত হয়ে বললো, দেখি দেখি ছবিগুলো।
ছবিগুলো দেখে সে নিরবের পানে সহাস্যে বলিলো, মামা তোকে তো রাজকুমারের মতো লাগছেরে। একটা কথা বল তো?
নিরব বললো, কী কথা?
- তুই আজ হঠাৎ পাঞ্জাবী পড়ে এসেছিস কেন?
- দেখ উল্টাপাল্টা কিছু ভাববি না। তুই যেমন আমার বন্ধু, তেমনি চাঁদনীও আমার বন্ধু।
- হ মামা, তা তো দেখেই বুঝতে পারছি। কি বলিস সোহান?
রাহাদের সাথে সোহান আর আরিফও তাল মিলালো।
.
পশ্চিমের বিল্ডিংয়ের অলিন্দ হতে রিলিংয়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে তাদের সৌহার্দ্য দেখছে জান্নাত। মেয়েটা প্রতিদিনই ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত নিরব ও তার বন্ধুরা শহীদ মিনারে বসে আড্ডা দেই। ঠিক ততক্ষণ সে একমনে চেয়ে থাকে তাদের দিকে। মনে মনে ভাবে একটু কথা বলবে তাদের সাথে, সেও তাদের একজন ভালো বন্ধু হবে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। সচকিত মন বারবার বাঁধা দেয় তাকে।

হঠাৎই রাহাদের চোখ পড়লো জান্নাতের দিকে। সে তখনও পলকহীনভাবে চেয়ে আছে তাদের দিকে। রাহাদ নিরবকে বললো, মামা মেয়েটাকে চিনিস?
- কোন মেয়েটা?
- ওদিকে দেখ, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
নিরব জান্নাতের দিকে চোখ ফেরাতেই জান্নাত চোখ নামিয়ে নিলো।
নিরব বললো, "না তো, চিনি না। কেন?"
- না মানে আমাদের দিকে চেয়ে রয়েছে। তাই বললাম আরকি!

সোহান তার ব্যাগটা নিচ থেকে তুলে বললো, এই মেয়েকে তো আমি প্রতিদিনই দেখি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। আমরা যতক্ষণ আড্ডা দেই। মেয়েটা ঠিক ততক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে।
নিরব সোহানকে বললো, কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ে?
- আমাদের ডিপার্টমেন্টেই।
- কী?
- হ্যাঁ।
- তবে সে ওখানে কেন? ডাক দে ওকে।
- তুই ডাক দে।
- চাঁদনী, মেয়েটাকে ডাক দে তো।

চাঁদনী ডাক দিলো জান্নাতকে। জান্নাত তাদের কাছে এলে নিরব বললো, "তুমি আমাদের ডিপার্টমেন্টের?"
সে মাথা নেড়ে "হ্যাঁ" সূচক উত্তর দিলো।
- তবে তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছিলে?
- না মানে, না মানে....
- নাম কি তোমার?
- জান্নাত।
- বাহ্, বেশ সুন্দর নাম তো!
- কোথায় থাকো?
- টঙ্গি।
- এতো দূর থেকে ক্যাম্পাসে আসো?
জান্নাত আবারও মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' বললো।
- সমস্যা হয় না?

এবার সে কিছু বললো না। নিরব বললো, এখন থেকে ওখানে দাঁড়িয়ে না থেকে সোজা এখানে চলে আসবে, আড্ডা দেবে, মজা করবে, কেমন?
- হু।
.
রাতে রান্না হয়নি। মাসের শুরু, বাজার সদাই না হওয়াতে পাতিল ফাঁকা পড়ে আছে। আজ রাতে নিরবের বাইরেই খেতে হবে। পাশের রুম থেকে সিফাত ভাই বললেন, নিরব আজ রাতে রান্না হয়নি। তুমি সবার থেকে বড় বাজারের টাকাটা উঠাও। আর আমার টেবিলের উপরে দেখো বিরিয়ানি রাখা আছে, খেয়ে নাও।

নিরব বিরিয়ানির প্যাকেটটা খুলতেই তার ফোন বেজে উঠলো। চাঁদনী কল করেছে। নিরব কল রিসিভ করে বললো, কিরে? হঠাৎ কল দিলি যে?
- ঐ মেয়েটার সাথে এতো সখ্যতা দেখানোর কী আছে?
- কোন মেয়ে?
- কোন মেয়ে মানে? সকালে যেই মেয়েটার সাথে ক্যাম্পাসে কথা বললি!
- জান্নাত?
- হ্যাঁ জান্নাত।
- তাতে কী হয়েছে? সে তো আমাদের ডিপার্টমেন্টেই পড়ে। তাছাড়া তার কোনো বন্ধুও নেই।
- বন্ধু থাকুক বা না থাকুক, তাতে তোর কী?
- এই ওয়েট ওয়েট, তুই এমন বিহেভ করছিস কেন?
- কেন করছি বুঝিস না?
- না।
- দেখ ফাইজলামি পছন্দ না কিন্তু। আমি এখন সিরিয়াস মুডে আছি।
- তুই আমাকে ভালোবাসিস?
- তোকে ভালোবাসতে যাবো কেন?
- তবে এসব কথা বলছিস কেন?
- কালকে ক্যাম্পাসে আয়। তারপর বুঝাবো এসব কথা বলছি কেন?

চাঁদনী কল রেখে দিলো। নিরব মৃদু হেসে বললো, পাগলী মেয়েটা।
.
পরদিন সকালে হুটহাট করে নিরবের প্রচণ্ড জ্বর আসায় সে ক্যাম্পাসে যেতে পারলো না। ঘড়ির কাটা বেলা এগারোটার কাছাকাছি। এর মাঝে রাহাদ, সোহান, আরিফসহ অনেকেই কল করেছে। নিরব রিসিভ করেনি। কিন্তু চাঁদনী মেয়েটা তাকে এখন অব্দিও করলো না। সে আনমনে হেসে উঠলো। মনে মনে বললো, এই ভালোবাসিস আমাকে?
ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। নিরব ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো, চাঁদনী কল করেছে। সে কলটা রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে "কুত্তা, বিলাই, ইঁন্দুর, হনুমান" ইত্যাদি ভাষায় গালি শুনতে পেলো।

- ক্যাম্পাসে আসিসনি কেন?
- প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে।
- কী? রাতেও না ভালো ছিলি?
- হু।
- ঔষুধ খেয়েছিস?
- না।
- কেন খাসনি?
- এমনিই।
- দাঁড়া অাসছি আমরা।
- এই না না, তোরা আসিস না। আমাদের মেসে মেয়ে এলাউ না। বাড়িওয়ালা জানতে পারলে বের করে দেবে।
- জান্নাত তোর সাথে কথা বলবে।
- তোর ফোন দিয়ে?
- হ্যাঁ,  আমার ফোন দিয়ে।
- তোর জেলাস ফিল হচ্ছে না তো?
- আরে না, রাতে আমি এমনিই ওসব বলেছি।
- আচ্ছা দে।

অপর পাশে নিরবতা। নিরব বললো, জান্নাত?
- হ্যাঁ.. হ্যাঁ...  হ্যাঁ।
- কেমন আছো?
- ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?
- আমিও ভালো আছি।
- তোমার না জ্বর?
- তোমার সাথে কথা বলে ঠিক হয়ে গিয়েছে।
- কী?
- না, কিছু না।
- আজ ক্যাম্পাসে আসবে না?
- বিকেলে থেকো, তখন আসতে পারি। আর একটা কল দিও।
- আচ্ছা।
.
মধ্যাহ্নে আহার শেষে একটা লম্বা ঘুম দিলো নিরব। বিকেলে ঘুম ভাঙলে তার অনুভূত হলো, সকালে সহসাই আসা জ্বরটা আর নেই। সে এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে রাহাদকে কল করলো।
- বন্ধু কোথায় তোরা?
- ক্যাম্পাসে।
- থাক আমি আসতেছি।
- গিটারটা নিয়ে আসিস।
- আচ্ছা।

দ্রুত ফ্রেস হয়ে গিটারটা কাঁধে ঝুলিয়ে বাসা থেকে বের হলো সে। জ্যামে পড়লে ঘণ্টা খানেক লেগে যাবে। মিরপুর-১ থেকে ফার্মগেটের দিকে কয়েকটা বাস যায় মাত্র। নিরব ফার্মগেটের বাসে না উঠে "বাহনে" উঠে বসলো। আসাদগেটে নেমে সংসদ ভবন পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে সেখানেই আড্ডা দেবে, এই পণ করলো। রাহাদকে সে কল করে জানিয়ে দিলো খামাড়বাড়ি আসতে।

সিটিং সার্ভিস বাস। মাত্র কয়েকজন উঠেছে শুধু। তাছাড়া পুরো বাস ফাঁকা পড়ে আছে।  স্কুল পড়ুয়া একটা মেয়ে এসে তার পাশে বসলো। তার ড্রেস দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে। সম্ভবত নবম কিংবা দশম শ্রেণীতে পড়ে। মেয়েটা নিরবের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি গিটার বাজাতে পারেন?
- হ্যাঁ।
- একটু শোনাবেন প্লিজ?

ক্রমেই বাসে যাত্রী উঠতে করলো। এর মাঝে গিটার বাজানোটা বেমানান দেখায়। প্রসঙ্গ পাল্টে সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো, নাম কি তোমার?
- অহনা।
- বাহ, সুন্দর নাম তো!
- কোথায় থাকো?
- ডি ব্লক, আট নাম্বার রোড, ৩২ নাম্বার বাসা।
- বাব্বাহ।

হঠাৎই একজন বৃদ্ধা নিরবকে বললেন, বাবা একটু বসতে দেবে? সে তৎক্ষণাৎ সিট ছেড়ে দিয়ে বললো, বসুন বসুন।
.
আসাদগেটে নেমে হাঁটতে হাঁটতে সে খামাড়বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
সেখানে গিয়ে দেখলো, সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। রাহাদ বললো, জ্বর কেমন এখন?
- নেই, একদমই নেই।
- আদৌ ছিলো কি?
- সকালে এসেছিলো। আর বিকেলেই প্রস্থান করেছে।
- জান্নাত কেমন আছো?
- ভালো, তুমি কেমন আছো?
- এইতো ভালোই রয়েছি।

পাশ থেকে চাঁদনী বললো, এখন তো নতুন বান্ধবী পেয়ে ভুলেই যাবি আমাকে।
- এসব কি বলিস? তুই এবং তোরা আমার অন্তরে মিশে আছিস। প্রতিটি ধমনি, শিরা-উপশিরা জানে, তোরা আমার কতটা জুড়ে রয়েছিস!
- হয়েছে হয়েছে, এতো বলতে হবে না। এখন জান্নাত একটা কবিতা শোনাবে। চুপ করে বসে শোন।

নিরব জান্নাতের দিকে চেয়ে বললো, সত্যিই?
জান্নাত 'হ্যাঁ' সূচক মাথা নাড়লো।
- শুরু করো তাহলে।

জান্নাত শুরু করলো,

"প্রিয় সখা সহসাই হেরিলাম তোমাকে।
বৃষ্টিদিনে একেলা একা দাঁড়িয়েছো
ক্যাম্পাসের এককোণে সন্তর্পনে।
ভাঙা ছাওনিতে ভিজিছো নিভৃতে তুমি।
তৃষাতুর হয়ে রহিছো চেয়ে অন্যত্রে
খুঁজিছো প্রিয় অনুপ স্থান অনুক্ষণে।"

এটুকু বলেই সে থেমে গেলো। নিরব বললো,

"অলক্ত চরণ তোমার ভিজিছে বৃষ্টিজলে।
ভাঙা ছাওনিতে পড়িছে জল অলক্ষ্যে প্রিয়,
দু'ফোটা এক ফোটা করে তোমার ঐ কেশ-ফুলে।"

জান্নাত হেসে ফেললো। কেননা সে নিরবের লেখা কবিতাই আবৃতি করার চেষ্টা করেছে। নিরব কবিতাটি একটা মেয়েকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলো। সেখানে "সখা" কথাটার জায়গায় "সখি" লেখা ছিলো। কিন্তু জান্নাত সেটুকু পরিবর্তন করতে পেরেছে ঠিকই। তবে পরের স্তবকে থাকা কথাগুলো আর পরিবর্তন করতে পারেনি। তাই সে প্রথম স্তবক বলে থেমে গিয়েছে।

কবিতা শেষ হতেই চাঁদনী বলে উঠলো,
- বাহ বাহ, দারুণ আবৃতি করেছিস। যেন দু'টো পাখির ছানা বৃষ্টিজলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।
- পাম দিলি? নাকি প্রশংসা করলি?
- ঐ হলো একটা। এখন গান ধর।
- কোন গানটা গাইবো?
- নতুন কোনো গান লিখিসনি?
- পুরোপুরি লিখিনি, তবে আংশিক লিখেছি।
- ওটুকুই শোনা।

নিরব গিটারে সুর তুলে গান গাইতে আরম্ভ করলো,

"তোমাতে আছে যে কী
তাই দেখে পরাণ সুখী
আনমনে তোমায় ডাকি ওগো সখি,
রও না বুকে মিশে।

তোমার বিরহে প্রাণ কেমন করে।
আছো মনে মিশে।
মরি হায় হায়রে
তোমার বিরহে প্রাণ কেমন করে।
আছো মনে মিশে।

সখি তোমার সাথে প্রতি রাতে
সময় যাবে হেসে হেসে।
তোমায় ভালোবেসে, আমি ধন্য প্রণয় দেশে।"

গান শুনে চাঁদনী উদগ্রভাবে বললো,
- এটা কি গাইলি?
- কেন? গান গাইলাম!
- জাতীয় সঙ্গীতের মতো কেন?
- আরে সুর পাচ্ছিলাম না। তাই ঐ সুরে গেয়েছি।
- বেশ করেছিস।
- রেটিং দিবি না?
- চোরদের আমি রেটিং দেই না।
- এখানে চোর এলো কোথা থেকে?
- তা নয়তো কী? তুই রবি ঠাকুরের জাতীয় সঙ্গীত নকল করেছিস।
- কোথায় নকল করলাম? আমি তো শুধু সুরটা নিয়েছি।
- ঐ একই কথা।
- না, এক কথা না। রবি ঠাকুর বাউল সাধক "গগণ হরকরার- আমি কোথায় পাবো তারে" গানটি নকল করে জাতীয় সঙ্গীত রচনা করতে পারলে আমি পারবো না কেন?

পাশ থেকে জান্নাত নিরবের উদ্দীপনা বাড়ানোর স্বার্থে বললো, ঠিক তো! তুমি কেন পারবে না? অবশ্যই পারবে তুমি।
.
দু'দিনের পরিচয়ে জান্নাত মনে মনে নিরবকে নিয়ে তার হৃদয় কোণে বহুবিধ কল্পনা জল্পনা আঁকতে শুরু করেছে। সে একাকী হলেই নিরবের কথা ভাবে। কত সুন্দর করেই না ছেলেটা কথা বলে। কবিতাবৃত্তির ধরণটাও বেশ। তার বেশ কিছু কবিতা সে নিজের ডায়েরীতে অতি যতন করে লিখে রেখেছে। ক্লাসের প্রথম দিন সে যেই প্রতিবাদী কবিতাটি সকলের সামনে আবৃত্তি করেছিলো, সেই কবিতাটি বারবার তার মনে জাগে। একই ক্লাসে থাকা সত্ত্বেও আজ মাস দশেক পর সম্প্রতি নিরবের সাথে তার কথা হলো। এতে আনন্দের শেষ নেই তার।

অম্বরে আজ নক্ষত্রের ছড়াছড়ি। চারিপাশ আলোকিত হয়ে আছে নক্ষত্রের আলোয়। জান্নাত অলিন্দ কোণে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎই..
- আপু ঘুমাবি না?

সুরাইয়ার ডাকে পশ্চাৎ ফিরে চাইলো জান্নাত। বললো, তুই ঘুমাসনি?
- না, এসাইনমেন্ট করতে হচ্ছে। এজন্য জেগে আছি।
- রাত অনেক হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়। বাকিটুকু কাল সকালে করিস।
- আপু একটা কথা বলি?
- হুম, বল।
- তোকে আজ দুই দিন একটু অন্যরকম লাগছে।

জান্নাত সুরাইয়ার প্রশ্ন-প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, আজকের আকাশটা সুন্দর না?
- হ্যাঁ, অনেক সুন্দর। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ডেকে দিস। নয়তো এসাইনমেন্ট করা হবে না।

সুরাইয়া চলে গেলো। জান্নাত আরও কিছু সময় দাওয়ায় দাঁড়িয়ে রইলো।
.
সকাল হতে না হতেই ফোনের আওয়াজে নিরবের ঘুম ভেঙে গেলো। গতরাতে অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছে সে। ভেবেছিলো সকাল ন'টা পর্যন্ত জমপেশ একটা ঘুম দেবে। কিন্তু ফোনের জ্বালায় তা আর হল না। কলকৃত ব্যক্তিকে ইচ্ছামতো বকবে বলে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই তার সকল রাগ নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো।

নিরব কল রিসিভ করে বললো
- সুপ্রভাত প্রিয়।
- সুপ্রভাত।
- কেমন আছো স্বর্গ?
- স্বর্গ?
- জান্নাতের আরেক নাম তো স্বর্গই!
- হ্যাঁ, তাই বলে....
জান্নাতকে পুরো কথাটা শেষ করতে না দিয়ে নিরব বললো, হঠাৎ এই প্রভাত বেলায় আমাকে স্মরণ করলে যে?
- কেন? স্মরণ করা বারণ আছে নাকি?
- না, তা নয়।
- এখনও ঘুমিয়ে আছো?
- হ্যাঁ। জান্নাত শোনো।
- হ্যাঁ প্রিয় বলো।
- তুমিও দেখছি কবিদের মতো কথা বলতে শিখে গিয়েছো!
- কবির সাথে থাকলে একটু আধটু শিখতে হয়।
- বাহ, বেশ তো!
- কী যেন বলতে চাইছিলে?
- ও হ্যাঁ। শোনো।
- হুম বলো শুনছি।
- আমরা তো ফ্রেণ্ড, তাই না?
- হ্যাঁ ফ্রেণ্ড।
- সো, আমি তোমাকে "তুমি" সম্বোধনে ডাকতে পারবো না।
- ডেকো না।
- আর তুমিও ডাকতে পারবে না।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
.
মার্কেটিং ক্লাস চলছে। স্যার এক এক করে সবাইকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন, বাজার কাকে বলে?
প্রথমত স্যার ছেলেদের দিক থেকে শুরু করলে নিরব বললো, স্যার এটা কিন্তু অন্যায়।
স্যার ভ্রু-কুঞ্চিত করে বললেন, অন্যায় মানে?
- স্যার, সবসময় তো আমাদের দিক থেকেই শুরু করেন। আজ না হয় মেয়েদের দিক থেকে শুরু করলেন!

স্যার কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, তা মন্দ বলোনি। এই মেয়ে তুমি দাঁড়াও। বলো, বাজার কাকে বলে?
এক এক করে প্রথম দুই বেন্চের সবাইকে দাঁড় করালো স্যার। হঠাৎই স্যার বলে উঠলেন, জান্নাত তুমি বলো।

"জান্নাত" নামটা শুনতেই নিরব ক্ষিপ্র গতিতে জান্নাতের দিকে চক্ষুগোচর করলো। মেয়েটা আজ শাড়ি পড়ে এসেছে। চোখে টানা করে কাজল দেওয়া। পুষ্পে খচিত কালো কেশে দারুণ মানিয়েছে তাকে। হঠাৎই তার মনে হলো, আরে মেয়েটা দেখি চাঁদনীর মতো করে সেজে এসেছে। তাহলে কি.....
.
মধ্যাহ্নে শহীদ মিনারের পাদদেশে বসে পূর্বদিনের মতো আজও আড্ডা দিচ্ছে নিরব এবং তার বন্ধুরা। আজ চাঁদনী আসেনি। সে নিরবকে কল করে জানিয়ে দিয়েছে কী একটা কাজে নাকি সে আটকা পড়েছে।

জান্নাত মেয়েটা নিরবের পাশে বসেছে। নিরব অনিচ্ছাসত্ত্বেও জান্নাতের অলক্ষ্যে তার দিকে বারবার চোখ ফেরাচ্ছে। জান্নাত বিষয়টা বুঝতে পেরে বললো, নিরব এদিকে ঘুরে বস।
নিরব জান্নাতের দিকে ঘুরে বসলে জান্নাত বললো, এবার যতক্ষণ মন চায় তাকিয়ে থাক। ওরকম চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার কী আছে?
- জান্নাত, তুই এতো সুন্দর কেন? সৃষ্টিকর্তা সকল সৌন্দর্য্য বুঝি তোর মাঝেই অর্পন করেছেন।

মেয়েটা লজ্জা পেলো। বললো, তোর চোখে সবাই সুন্দর। কবিদের চোখে কৃষ্ণকলিও অনন্য রূপের অধিকারীনি হয়ে থাকে।
- তা বটে, তবে তোকে দেখে মনে প্রেম জাগছে ভীষণ। মন চাইছে, তোকে একটু ছুঁয়ে দেই।
- নিষেধ করেছে কে?

পাশ থেকে রাহাদ বলে উঠলো, চাঁদনী আসুক। তারপর তোর প্রেম জাগানো ছুটাবে, শালা লুচ্চা।
- ধুর বেটা, তুই আবার প্রেমের মাঝে বা'হাত ঢুকিয়ে দিলি কেন? ও হ্যাঁ, রাহাদ তুই যাওয়ার সময় আমার সাথে একটু দেখা করে যাস।
- কেন? জুরুরি কোনো খবর আছে নাকি?
- আমার কাছে বিষয়টা জুরুরি। তবে তোর কাছে কেমন, সেটা জানি না।
- আচ্ছা।
.
জান্নাতকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে নিরব রাহাদকে বললো, এখন তোকে কিছু কথা বলবো। মন দিয়ে শুনবি। কথার মাঝখানে কোনো কথা বলবি না। আমার বলা শেষ হলে তুই বলবি। ওকে?
রাহাদ মাথা নাড়লো।
নিরব বললো, দেখ তুইতো জানিস আমি সোজাসাপটা কথা বলতে পছন্দ করি।
রাহাদ আবারও মাথা নাড়লো।
নিরব বললো, "চাঁদনী তোকে পছন্দ করে। পছন্দ বৈকি! ভালোও বাসে। গতরাতে সে আমাকে কথাটা জানিয়েছে। সে প্রত্যক্ষভাবে বলতে পারবে না, সে কারণে আমিই তার হয়ে তোকে কথাটা বললাম। তোর মতামতটা তুই সরাসরিই জানাবি তাকে।

রাহাদ হা করে নিরবের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে কল্পনাতেও ভাবেনি চাঁদনী নিরবকে নয়, বরং তাকে পছন্দ করে।
.
হাসি আনন্দের মধ্য দিয়ে দুইটা বছর কেটে গিয়েছে। আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু, এভাবে মাসের পর মাস কেটে যায়। তবু জান্নাত নিরবকে তার ভালোবাসার কথা বলতে পারে না। আগামীকাল তার জন্মদিন। গত বছর নিরব পুরো ক্লাসরুম সাজিয়েছিলো তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে। হয়তো এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।
সে ফোন হাতে করে নিরবকে কল করতে যাবে। ঠিক সেই মুহূর্তে নিরবই তাকে কল করে।
- জান্নাত...
- হ্যাঁ, কেমন আছিস?
- এইতো আছি বেশ। তুই কেমন আছিস?
- আলহামদুলিল্লাহ।
- কালকে না তোর জন্মদিন?
- আমি তো ভেবেছিলাম তুই ভুলে গিয়েছিস।
- তোর কোনো কিছু ভুলে যাওয়ার আগে আমি নিজেকে ভুলে যাবোরে জান্নাত।
- হয়েছে হয়েছে, এতো ঢং করতে হবে না।
- জান্নাত তোকে একটা কথা বলার ছিলো।
- বল।
- না, এখন না। কালকে বলবো।
- কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু?
- তার থেকেও বেশি।
- আচ্ছা অপেক্ষায় রইলাম।
.
পরদিন সকাল সকাল নিরবের কথানুযায়ী তার বন্ধুরা পুরো ক্লাসরুম সাজিয়ে ফেলে। নিরব বলে রেখেছিলো, তার যেতে একটু দেরি হবে। ততক্ষণ যেন তারা আড্ডা দেয়।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো। তবু নিরবের আসার কোনো নামগন্ধ নেই। এদিকে কয়েকটা স্যার ক্লাস নিতে এসে ফিরে গিয়েছে। ক্লাসের বাকি স্টুডেন্টগুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে জন্মদিনের উইশটা দেখবে বলে। নিরবকে না আসতে দেখে রাহাদ ফোন বের করে তাকে কল করলো। রিং হচ্ছে, কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। বার কয়েক কল করার পর রিসিভ হলে রাহাদ রাগি কণ্ঠে বলে উঠলো, "কিরে জমিদার, আসতে এতো দেরি হচ্ছে কেন?"
ওপাশ থেকে নিরব মৃদু কণ্ঠে উত্তর দিলো, দোস্ত একটু হাসপাতালে এসেছিলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। আমি চলে আসছি।
- কী হয়েছে মামা তোর?
- আরে তেমন কিছু হয়নি।
- কোন হাসপাতালে তুই? আসবো আমরা?
- আরে না, আসতে হবে না। একজন মায়ের রক্তের প্রয়োজন ছিলো। তাই রক্ত দিতে এসেছিলাম।

নিরবের কথা শুনে রাহাদ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সে বললো, ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি একদম। তো আমাদের কল করে একবার জানাতে তো পারতি?
- আরে সময় সংক্ষিপ্ততার কারণে কল করতে পারিনি।
- আচ্ছা ঠিক আছে, এখন দ্রুত চলে আয়। আর শোন, এ কয়দিন তো ভার্সিটি বন্ধ ছিলো। স্যার ম্যাডামদের সাথেও তেমন যোগাযোগ হয়নি। তাছাড়া এই বছরটাই আমাদের শেষ। তারপরে তো এই ভার্সিটি ছেড়ে চলে যেতে হবে। উনাদের জন্য কিছু নিয়ে আসিস।

নিরব "আচ্ছা" বলে ফোন রেখে দিলো। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ফুলের দোকান থেকে একটা ফুল নিলো সে। আজ সে পণ করেই বাসা থেকে বের হয়েছে, যে করেই হোক। আজ সে জান্নাতকে প্রপোজ করবেই।

ক্যাম্পাসে ঢুকার আগে মিষ্টির দোকান থেকে কয়েক প্যাকেট মিষ্টিও নিলো সাথে, শিক্ষকদের দেবে বলে।
.
- কিরে মামা এতক্ষণে আসার সময় হলো? কল করেছি আরো ঘণ্টা খানেক আগে। আর এখন আসলি?
- রাস্তার যানজটের অবস্থা তোর অজানা নয়।
- নে এখন কেকটা কেটে আমাদের উদ্ধার কর।

মিষ্টির প্যাকেটগুলো বেন্চের উপর রেখে ফুল বা'হাতে পেছনে করে জান্নাতের হাতে হাত রেখে কেক কাঁটলো নিরব। কেক খাওয়ার চেয়ে সকলের মুখে মাখামাখির পরিমাণটা বেশি।
জান্নাত আজও শাড়ি পড়ে এসেছে। পূর্বের ন্যায় চোখে টানা কাজল, কাঠগোলাপে খচিত কেশকলাপ। কী অপূর্ব চাহনি গো! নিরব আবারও প্রেমে পড়ে গেলো তার। সে জান্নাতের পানে চেয়ে বললো, "প্রিয় সখি, তোমার হাতটি বাড়াও।"

এরই মধ্যে ক্যাম্পাস ছুটির আগে কেনা একটি অঙ্গুরীয় সে তার হাতের মধ্যে নিয়ে রেখেছে। জান্নাত তার হাতটি বাড়ালো। নিরব তার বা'হাতটি পেছন থেকে সামনে এনে জান্নাতের আঙ্গুলে তা পড়িয়ে দিতে গিয়ে দেখতে পেলো, একটি নব অঙ্গুরীয় তার আঙ্গুলে জড়ানো।
নিরব বললো, এটা কী জান্নাত?
জান্নাত নির্লিপ্ত নয়নে মৃদুস্বরে বললো, গত পরশুদিন আমাকে দেখতে এসে ছেলেপক্ষ এটা পড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে।

জান্নাতের কথা শুনে নিরবের হাত থেকে ফুল এবং অলংকার দু'টোই পড়ে গেলো। রাহাদ, সোহান, আরিফ, চাঁদনী এবং ক্লাসের অন্যসকলে সবাই নীরব, নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।

নিরব বলতে পারলো না তার প্রণয় বাক্য। ব্যক্ত করতে পারলো না হৃদগহীনে জমানো সব কথা। শুকনো পাতার ন্যায় নিমিষেই সকল প্রেম ব্যঞ্জনা মরমর করে ঝড়ে পড়লো। অদূর হতে ভেসে এলো তারই লেখা গান.....

"মরমে রয়েছো অন্যেরই হয়েছো
দুঃখ দিয়েছো গো পরানে সখি।
হেরিলে তোমারে হৃদয়ও কিনারে
ওঠে গো প্রেম সখি যতনে ডাকি।
প্রেমেরও নদীতে তোমারে দেখিতে
চরণ ফেলি আমি নিভৃতে সখি।
ছিলে গো আদরে মনেরই ভেতরে
ছিলে তুমি ওগো পরানের পাখি।"

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:২০

রাজীব নুর বলেছেন: মোটামোটি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.