নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

সুফিয়া

পৃথিবী আমাকে শূণ্যতায় বাঁধতে পারেনা অস্তিত্বে মাকে আগলে রেখেছি বলে।

সুফিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প --মৌপ্রিয়া

১৫ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ২:১৪

ঢং ঢং ঢং। দ্বিতীয়বার ঘন্টা পড়ার শব্দটা কানে বাজতেই ধড়ফড় করে শোয়া থেকে উঠে বসে কুদরত আলী। তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে মাথাটা একবার চক্কর খায়। হাত বাড়িয়ে চৌকির পাশটা শক্ত করে ধরে স্থিত হতে চেষ্টা করে সে। মাথার ঝিম ধরা ভাবটা তবু রয়েই যায়।



তিন দিন ধরে জ্বরের ঘোরে বিছানায় প্রায় বেহুশের মতো পড়ে ছিল কুদরত। ষাটোর্ধ শরীরে আর কতই বা সয়? ঔষধ-পথ্যের ব্যবস্থা নেই। কোনমতে তিনটি মুখের দুই বেলার আহার জুটছে এই ঢের ! তার উপর আছে মৌপ্রিয়ার পড়াশুনার খরচ। অভাবের শতমুখী আগ্রাসী তান্ডব সত্ত্বেও রোদেলা তার মেয়ের পড়াশুনার ব্যাপারে একেবারে আপোষহীন। এর পেছনে সমর্থনের তেল যুগিয়ে চলছে কুদরত আলী। বহু চেষ্টা তদবির করে স্কুলে মৌপ্রিয়ার জন্য বিনা বেতনে অধ্যায়নের সুযোগ করে দিয়েছে সে। অবশ্য এর পেছনে মৌপ্রিয়ার ভাল রেজাল্টের অবদান যেমন আছে তেমনি এলাকার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কুদরত আলীর প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাবোধের দিকটাও। মেয়ের পড়াশুনার গতিকে নিস্কন্টক রাখার জন্য এই সুযোগটা রোদেলার সামনে সম্ভাবনার অধরা দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তানাহলে এক একটা ক্লাস ডিঙাবার সাথে সাথে পড়ার খরচ যেভাবে বাড়ছিল তাতে করে সামনের পথটা অন্ধকার দেখছিল রোদেলা। তবে এটা সত্যি যে ওয়াদুদ মুন্সীর বাড়ির কাজের বিনিময়ে সে যা পায় তা দিয়ে তিনজন মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন মিটানো দুঃসাধ্য ছিল যদি ওয়াদুদ মুন্সীর মা কুদরত আলীর বাবার সাথে বহুদিনের পুরোনো সম্পর্কের সূত্রে এটা-ওটা সাহায্য না করত। এরপরও টানাপোড়েনের দৌরাত্ব যেন পিছু লেগেই আছে।



বুড়ো বাপের জন্য একটু ভাল খাবার কিংবা অসুখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পারার ব্যর্থতায় রোদেলার মনটা সব সময় কান্নাভেজা প্রহরের বুকে মাথা কুটে মরে। এর শেষ গন্তব্য কোথায় তা রোদেলা জানেনা। মেয়ের বুকের কান্না কুদরত আলীর জরাগ্রস্থ শরীরের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থাকে আরও প্রকট করে তুলে। মেয়েকে তা বুঝতে না দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে সে। কিন্তু এবার বুঝি সেই চেষ্টা করা বৃথা। কারণ নদীতীরে ঢেউ এর রেখে যাওয়া চিহ্নের মতো জ্বরটাও কুদরত আলীর কড়িকাঠের শরীরে প্রকট একটা ছাপ রেখে গেছে।



তবুও ভালো যে ছেড়ে গেছে জ্বরটা। নইলে কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারতনা কুদরত আলী। আজ মার্চের ১৫ তারিখ। এখনই হাত না লাগালেই নয়। মৌপ্রিয়া প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে গল্প শুনাচ্ছে কুদরত আলীকে। এ বছর কিভাবে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করবে এ নিয়ে ওর স্কুলে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। অনুষ্ঠানের মহড়াও চলছে প্রতিদিন। তাই প্রায় দিনই স্কুল ছুটি হয়ে যাচ্ছে তিনটায়। আজও সেই কারণে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। উঠোন জুড়ে পড়া লম্বা ছায়ার দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হয় কুদরত আলী। তবে মৌপ্রিয়া এখনই আসবেনা। স্বাধীনতা দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রীদের কয়েকজন অংশ নিচ্ছে। তাদের মধ্যে মৌপ্রিয়ার নামও আছে। দারুণ কবিতা আবৃত্তি করে মৌপ্রিয়া। এবার সে আবৃত্তি করবে শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি। সে জন্য ওর মধ্যে উৎসাহ উপচে পড়ছে! দেখে নিজের ভিতর একাত্তরের উন্মাদনায় ফিরে যায় কুদরত আলী।

কিন্তু গত কয় বছর ধরে এই সময়টায় যে কাজটি সে করে এসেছে নিজের শরীরে প্রাণস্পন্দন থাকতে এর ব্যত্যয় ঘটবে তা কি করে হয় ? তিন দিনের সামান্য জ্বরে বিলম্বিত হলেও মুক্তিযোদ্ধা কুদরত আলীর মনের আয়োজন সেটাকে বাস্তবায়িত করবেই। চৌকি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে একটুক্ষণ কি যেন ভাবে সে। তারপর দরমার উপর থেকে ছেঁড়া পাঞ্জাবিটা টেনে নামিয়ে গায়ে চড়িয়ে ধীর পায়ে ঘর থেকে বের হয় যায় কুদরত আলী।

সুমন্ত বাড়ি এসেছে আজ চার দিন। এই কয় বছর ধরে ডিসেম্বর এবং মার্চ মাসে তার বাড়ি আসাটা যেন একটা ছন্দোবদ্ধ নিয়মের অধীন হয়ে গেছে। কিন্তু এবারই প্রথম বীণার তারটা বেসুরো মনে হচ্ছে। কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সুমন্ত। তাই সীমাহীন বিস্ময়ে অপেক্ষা করতে থাকে সে। স্বাধীনতা দিবস সমাগত। অথচ তার খোঁজ করবেনা কুদরত আলী এমনটা হতে পারেনা। প্রতি বছর মার্চ মাস আসতেই তার গ্রামে আসার খোঁজ-খবর নিতে শুরু করে কুদরত আলী। যেন একটা অলিখিত চুক্তি হয়ে গেছে সুমন্ত ইসলাম আর কুদরত আলীর মাঝে। গত পাঁচ বছর ধরে এভাবেই চলে এসছে। সুমন্ত ঘন সবুজ ও লাল রং এর কাপড় নিয়ে আসে। কুদরত আলী সেগুলো কেটে কেটে পতাকা বানায়। নানা সাইজের পতাকা। বড়গুলো নিজ হাতে বাড়ি বাড়ি উড়িয়ে দিয়ে আসে কুদরত আলী আর ছোটগুলো গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের হাতে দিয়ে জয়বাংলা শ্লোগানে নিজেও ওদের সাথে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। একাত্তরের সেই মুক্তির আনন্দকে নতুন প্রজন্মের উপলব্ধিতে জড়িয়ে উপভোগ করার মাধ্যমে সময়ের নির্মোহ স্রোতের বুকে আমাদের জাতিসত্তার গর্বিত আবাহনকে এভাবেই সমুজ্জল রাখতে চায় কুদরত আলী। দেশ-কাল-সীমানার বাইরে এই পতাকাই আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবিনশ্বর প্রতিকৃতি। এমনটা ভেবেই নিজের আর্থিক সীমাবদ্ধতাকে আমলে না এনে গত পাঁচ বছর ধরে কুদরত আলীর পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের গৌরবোজ্জল মুক্তিযুদ্ধের প্রতি গভীর হৃদয়াবেগের প্রকাশ ঘটাচ্ছে সুমন্ত ইসলাম।

একাত্তরকে নিয়ে উপলব্ধির যতটা গভীরে প্রবেশ করা যায় ততটাই সে হৃদয়ের শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে নিবেদন করতে চায় মুক্তিযোদ্ধা কুদরত আলীর সামনে। সময় কুদরত আলীকে অতিদ্রুত জীবনের শেষ গন্তব্যের পাণে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কুদরত আলীর শরীরের ক্ষয়িষ্ণু আয়োজনের দিকে তাকালে চিন্তাটা আরও গভীর অবয়বে দাঁনা বাঁধতে থাকে সুমন্তর মনে। কাজেই যতদিন পারা যায় মুক্তিযোদ্ধা কুদরত আলীর মধ্য দিয়ে একাত্তরকে আমাদের জাতিসত্তার জীবন্ত ফ্রেমে ধরে রাখতেই হবে। নিজের সামান্য বেতনের চাকুরী। ক্ষতি কি ? মনের আয়োজনটা তো ছোট নয়। তাই দিয়ে এতদূর যেহেতু আসা সম্ভব হয়েছে সেহেতু এই প্রচেষ্টা থেমে যাবেনা। মনের ভিতর আত্মপ্রত্যয়ের সুর বেজে উঠে সুমন্তর।



কিন্তু এবার যদি কুদরত চাচা সত্যিই না আসে ? তাহলে ? গ্রামের বাড়িতে বছরে দুই/একবার আসলেও কুদরত চাচার বাড়িতে যাওয়া হয়নি কখনও। এবার যদিও বা যাওয়া গেলো কিভাবে কোত্থেকে শুরু করব তাও তো জানিনা।

সুমন্তর মনে আশংকার দোলাচল জেগে উঠে। কিন্তু তা বেশীদূর এগোনোর আগেই হাঁফাতে হাঁফাতে সুমন্তর সামনে এসে দাঁড়ায় কুদরত আলী। রোগকাতর জীর্ণ শরীরটা এতটা পথ হাঁটার দখল সামলে উঠতে গিয়ে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠে সুমন্ত।

একি ! আপনার এই অবস্থা কেন চাচা ? বসুন এখানে।

হাত ধরে কুদরত আলীকে নিজের পাশটিতে বসিয়ে দেয় সুমন্ত। শরীরটা তখনও কাঁপছে কুদরত আলীর। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে সে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে। সুমন্ত তাকে হাত ইশারায় থামায়।

থাক, থাক। আপনাকে এখনই কিছু বলতে হবেনা। আপনার শরীর যথেষ্ট দুর্বল। আগে একটু বিশ্রাম নিন। তারপর সব শুনব। এই নিন, পানি খান।

হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয় কুদরত আলীর দিকে। ঢক ঢক করে গ্লাসটা খালি করে সুমন্তর দিকে সেটা বাড়িয়ে ধরে কুদরত আলী। জগ থেকে আরও এক গ্লাস পানি ঢেলে দেয় সুমন্ত। সেটাও পুরোটা শেষ করে ফেলে কুদরত আলী। সেদিকে তাকিয়ে সুমন্ত বলে

খুব তৃষ্ণা পেয়েছিল বুঝি? শরীরটাও দেখছি খুব খারাপ। এতটা পথ হেঁটে আপনি না আসলেই পারতেন। আমাকে খবর দিলে আমি ঠিকই চলে যেতে পারতাম আপনার বাড়ি।

সে তো তুমি বলছ বাবা। কিন্তু খবরটা দিব কাকে দিয়ে ? আমার মেয়ে আর নাতনী আমাকে সাফ সাফ বলে দিয়েছে অসুস্থ শরীর নিয়ে এসব করা চলবেনা। কিন্তু তুমিই বলো বাবা, এছাড়া আমার বেঁচে থাকার কি কোন অর্থ হয়? আমি একটা ফসিল হয়ে যাব না?

চাচা, আপনার কথা, আপনার মেয়ে-নাতনীর উপলব্ধি সবই আমি বুঝতে পারি। কিন্তু আপনার শরীর সত্যিই ভেঙে পড়েছে। এতগুলো পতাকা সেলাই করা যে সে কথা নয়! আপনার শরীর এ দখল সইবে না। তার চেয়ে এক কাজ করি। আমি দর্জিকে দিয়ে সেলাই করিয়ে দেই।

না বাবা, না। এ হতে পারেনা। ওখানেই তো আমার আসল আনন্দ। পতাকার গায়ে আমার হৃদয়ের উত্তাপই যদি জড়িয়ে না থাকবে তাহলে তো ঐ কথাই হলো। আমার মেয়ে-নাতনীর কথায় ফিরে যাওয়া হলো। তাছাড়া সেলাই এর বাড়তি খরচটার কথাও তো ভাবতে হবে।

সে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নিতে পারব। কিন্তু আপনার যুক্তিকেও যে অগ্রাহ্য করতে পারছি না ! তারচেয়ে আমাকে শিখিয়ে দিন। সেলাই এর কাজটা আমি করি।

এ তো একদিনে হবার নয় বাবা। এত সময় তুমি পাবে কোথায় ? তোমার চাকুরী আছে না ? আমার শরীর নিয়ে ভাবছ তো ? দেখো, পতাকা সেলাই করতে করতে শরীরের জড়তা একেবারে কেটে যাবে।

কুদরত আলীর কথার পিঠে দাঁড় করাবার মতো আর কোন যুক্তি খোঁজে পায়না সুমন্ত। মনে মনে ভাবে ইতিহাসের পাদ-প্রদীপ থেকে উঠে আসা জীবন্ত এক সত্তাকে তার ক্ষয়িষ্ণু জীবন প্রবাহের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার অর্থ হবে তাকে সময়ের কাছে করুণার পাত্র করে তোলা। যেটা কোনমতেই সমীচীন নয়। তাই শুধু বলে

আপনার কথাই যেন ঠিক হয় চাচা। আমি মনে-প্রাণে চাই শরীরের সমস্ত জড়তাকে বিসর্জন দিয়ে আপনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুন আরও অনেক অনেক দিন।

বাবা, আমি তাহলে উঠি। অনেক কাজ করতে হবে। সময় খুব বেশী নেই।

উঠে দাঁড়িয়ে আবার বলে

আমিও দোয়া করি বাবা, তোমার মতো আরও বহু সুমন্ত জন্ম নিক বাংলার ঘরে ঘরে। মুক্তিযুদ্ধ দেখনি, অথচ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তোমার হৃদয়াবেগের তুলনা হয়না। দেশপ্রেমিক যোদ্ধা হবার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রটা যে অপরিহার্য নয় তা তুমি নতুন করে দেখালে বাবা !

কথাটা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কুদরত আলী। সুমন্তও বেরিয়ে আসে তার পিছু পিছু।

চাচা, আমি আপনার সাথে আসি ? একটু ঘুরাও হবে, আপনার বাড়িটাও চিনে আসা হবে।

আমাকে এগিয়ে দিতে চাচ্ছ কিন্তু সেই কথাটা বলতে চাচ্ছ না এই তো ? ঠিক আছে, চলো।

নানু ভাই, তুমি এই অসুস্থ শরীরে কোথায় গিয়েছিলে ? আমি আশেপাশের সব বাড়ি খোঁজে এসেছি। না পেয়ে মাকে খবর দিয়েছি। মা-ও তোমাকে খুঁজতে গেছে।

বাড়ি ঢুকেই মৌপ্রিয়ার সামনে পড়ে যায় কুদরত আলী। কিন্তু তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মৌপ্রিয়া পুণরায় বলে

তুমি আবারও পতাকা সেলাই করবে ? এই অসুস্থ শরীরে ? মা কিন্তু খুব রাগ করবে নানু ভাই।

কেন, তুমি একটু সাহায্য করতে পারবে না তোমার নানু ভাইকে ? তাহলে তো উনার কষ্ট অনেক কমে যাবে।

কথার উৎস ধরে চকিতে আগুন্তুকের দিকে ফিরে তাকায় মৌপ্রিয়া। তার নানু ভাই এর সাথে একজন লোক এসেছে তা এতক্ষণ খেয়ালই করেনি সে। অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

আমি ?

হ্যাঁ, তুমি ?

আরও জোড় দিয়ে বলে সুমন্ত।

করবে করবে। আমার নানু ভাই ঠি--ক করবে। তুমি দেখো সুমন্ত। আমি ওকে দেখিয়ে দিলে ও ঠিক পারবে।

সহাস্যে কথাগুলো বলে মৌপ্রিয়ার দিকে ফিরে তাকায় কুদরত আলী।

নানু ভাই, ওকে বসতে দে। এই প্রথম আমাদের বাড়ি এলো। একটু----

না না, আমার জন্য ব্যস্ত হতে হবেনা। আমি বেরিয়েছি একটু ঘুরার জন্য । এখন যাই।

বসুন না ! দাদু বলছে।

শুধু দাদু কেন ? তুমিও তো বলছ। কিন্তু আমি যে বসতে পারব না ? তবে তোমার নামটা খুব জেনে যেতে ইচ্ছে করছে।

আমি মৌপ্রিয়া।

মৌপ্রিয়া ! নামটা শুনলেই মনের ভিতর সুরেলা গুঞ্জন খেলা করে। নামটার সাথে তোমার কোথায় যেন অদ্ভূত মিল আছে।

সুমন্তর মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয় কুদরত আলী।

তুমি ঠিকই বলেছ বাবা। নাতনীর মুখটা প্রথম দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম এই নামটা ওর জন্যই মানানসই। আমি তো ওর কথা-হাঁটা-চলা সব কিছুতেই সুরের ছন্দ খোঁজে পাই। অথচ দেখো, কেমন পাষন্ড বাপ। ছোট্র শিশুটাকে ছেড়ে সেই যে গেল আর ফিরে এলো না। মরে গেলে অবশ্য ক্ষমা করে দিতাম। কিন্তু---

নানু ভাই, তুমি আবার ওসব কথা বলছ ? তুমি আর মা থাকলে আমার আর কাউকে দরকার নেই তুমি জাননা?

ঠিক আছে নানু ভাই, আর বলবনা। কিন্তু আমার একটা কাজ করে দিতে হবে যে !

কি কাজ ?

এবার আমার সাথে তুমিও পতাকা সেলাই করবে। তোমারও শেখা হবে, আমারও কাজ এগোবে।

তাছাড়া নানু ভাইকে সাহায্যও করা হবে।

সুমন্তর কথায় দু’জনই ফিরে তাকায় ওর দিকে। নানা-নাতনী এতক্ষণ ভুলেই গিয়েছিল সুমন্ত এখনও দাঁড়িয়ে আছে। মৌপ্রিয়া তাড়াতাড়ি বলে

আপনাকে বসতে দেইনি সে খেয়ালই নেই আমার। ছি, ছি। আমি এক্ষুণি ছোট চৌকিটা নিয়ে আসছি।

না, না তোমাকে কিছু আনতে হবেনা। আমি যাচ্ছি।

বলে আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ায় না সুমন্ত। ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটতে থাকে সামনের দিকে।



পতাকা বানানোর কাজে নানা-নাতনীর যৌথ প্রয়াসের মুখে রোদেলা কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। তার বাবাকে এ কাজ থেকে বিরত রাখার সাধ্য তার নেই। মেয়েকে বারণ করলে বুড়ো বাবার উপর বাড়তি চাপ পড়বে। ভাল হত যদি এটা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা যেতো। কিন্তু এর অর্থ হবে তার বাবাকে গলা টিপে হত্যা করার সামিল। এই বয়সেই মৌপ্রিয়া নিজের আগ্রহে তার কাছ থেকে সেলাই ফোড়াই সব শিখে নিয়েছে। সেটাই কাজে লাগাচ্ছে আজ। কাজেই অনর্থক বাক্য ব্যয না করে নিজকে গুটিয়ে নেয় রোদেলা।



মনের ভিতর কিশোরী বয়সের স্বপ্নাতুর আবেগ। তার সাথে এই প্রথম দেশকে নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে শিহরিত অনুভূতির দোলা। এই মুহূর্তে মৌপ্রিয়ার ভাবনার সবটুকু জুড়ে এক ধরনের আচ্ছন্নতা খেলা করছে। আর এসব কিছুকেই এক সূতোয় বেঁধে রেখেছে তার নানু ভাই। সুঁই এর ফোড়ে ফোড়ে কিশোরী বয়সের চপলতাকে মাড়িয়ে অর্ন্তভেদী দেশাত্ববোধের চেতনায় ক্রমে পরিণত যোদ্ধা হয়ে উঠতে থাকে মৌপ্রিয়া। কুদরত আলীর অভিজ্ঞ দৃষ্টি নতুন মৌপ্রিয়াকে আবিস্কার করে সম্ভাবনার বিশাল আঙিনায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করবার আগেই নিজ থেকে বেরিয়ে আসে মৌপ্রিয়ার কথার মধ্য দিয়ে।

নানু ভাই, এখন থেকে তোমাকে আর পতাকা সেলাই করতে হবে না। তোমার ছুটি। সব পতাকা আমি সেলাই করব। তবে বাড়ি বাড়ি পতাকা উড়িয়ে দেবার কাজটা তুমিই করবে। আমি দলবল নিয়ে সেল্যুট করব সেই পতাকাকে।

সত্যি বলছিস নানু ভাই ? তাহলে তো আমার আর কোন চিন্তাই রইলনা। এটাই তো চেয়েছিলাম রে আমি। আমি থাকবনা, কোন মুক্তিযোদ্ধা থাকবেনা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের আরাধ্য অনুভূতি জেগে থাকবে চিরকাল, তোরাই জাগিয়ে রাখবি!

বলতে বলতে মৌপ্রিয়াকে বুকের মধ্যে টেনে নেয় কুদরত আলী। তার দু’চোখ থেকে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মৌপ্রিয়ার মাথায়। আঙুল ডগায় করে সেই অশ্রু কপালে মাখে মৌপ্রিয়া। আরও আরও অশ্রুর ফোঁটা ঝরে পড়তে থাকে কুদরত আলীর দু’চোখ থেকে। ছোট্র দুই হাতের আজলা পেতে সেই অশ্রুর সবটুকু নিজের মাথায় মেখে নেয় মৌপ্রিয়া। যেন প্রতীজ্ঞা করেছে সে একজন মুক্তিযোদ্ধারও চোখের পানি আর মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দিবেনা। কুদরত আলীর মনে হয় তার ছোট্র মৌপ্রিয়া মুহূর্তেই শতাব্দির সমস্ত সংকীর্ণতার অবরুদ্ধ বেড়াজাল ভেঙে মুক্তির দেবদূত হয়ে বেরিয়ে এসেছে। ওর হাতেই দিয়ে যেতে হবে এই গুরুদায়িত্ব। ওর মতো মৌপ্রিয়ারাই পারবে যুগ যুগ ধরে দেশ থেকে দেশান্তরে এই পতাকার মান সমুজ্জল রাখতে। আর তার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ বিদায়ের আয়োজনকে প্রশান্তময় করে তুলতে।

মন্তব্য ৩২ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৩২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ২:৫০

অর্বাচীন পথিক বলেছেন: পতাকার সংগ্রাম
জীবন যুদ্ধের সংগ্রাম
ভাল লাগগলো গল্প টা

১৬ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:২১

সুফিয়া বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য ও মন্তব্য করার জন্য।

ভাল থাকুন সব সময়।

আপনার মন্তব্যটা দুইবার হয়ে গিয়েছিল। তাই একটা মুছে দিলাম। মনে কিছু করবেন না।

২| ১৫ ই মার্চ, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৯

এম এম করিম বলেছেন: ভালো লাগলো গল্পটা।

১৬ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:২২

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য ও মন্তব্য করার জন্য। ভাল থাকুন সব সময়।

৩| ১৫ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ৮:১৪

মনিরা সুলতানা বলেছেন: সেটাই দায়িত্ব গুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে যাক ।।
লেখা ভাল হয়েছে আপু ...


শুভ কামনা :)

১৬ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:২৩

সুফিয়া বলেছেন: আমিও এটাই চাই মনিরা। দায়িত্ব গুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে যাক ।।

ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য ও মন্তব্য করার জন্য।

ভাল থাকুন সব সময়।

৪| ১৫ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ৮:৫৫

শায়মা বলেছেন: ওর মতো মৌপ্রিয়ারাই পারবে যুগ যুগ ধরে দেশ থেকে দেশান্তরে এই পতাকার মান সমুজ্জল রাখতে। আর তার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ বিদায়ের আয়োজনকে প্রশান্তময় করে তুলতে।

খুব খুব ভালো লাগা!

১৬ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:৩৫

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ শায়মা। আপনাদের ভাল লাগা দেখে আমারও খুব ভাল লাগছে।

৫| ১৫ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ৯:২৪

সকাল রয় বলেছেন:
মাঝখানে কিছু ফ্রন্ট ভেঙ্গে গেছে।
গল্পটা তরতর করে এগিয়ে গিয়েছিল। ভালো লাগা রইল। আরো লেখা পড়বো

১৬ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:৩৯

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য। কিছু কিছু সংযুক্ত শব্দ ভেঙে গেছে আমিও লক্ষ্য করেছি। ঠিক করে দেবার চেষ্টা করছি।

৬| ১৫ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১০:০৪

দিশেহারা রাজপুত্র বলেছেন: গল্পে ভালো লাগা জানবেন।

+++

১৬ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:৪০

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে গল্পটা পড়ার জন্য এবং মন্তব্য করার জন্য।

ভাল থাকুন।

৭| ১৫ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১০:১০

তাশমিন নূর বলেছেন: ভাল লাগা রইল। মৌপ্রিয়ারা এগিয়ে নিয়ে যাক দেশকে।

১৬ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:৪৩

সুফিয়া বলেছেন: আপনার সাথে আমারও কামনা। মৌপ্রিয়ারা এগিয়ে নিয়ে যাক দেশকে।

ধন্যবাদ আপনাকে।

৮| ১৬ ই মার্চ, ২০১৫ ভোর ৫:২৮

বিদ্রোহী বাঙালি বলেছেন: কুদরত আলীর মতো যদি সবাই তাদের সন্তান এবং নাতি নাতনীদের এভাবে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতো, এভাবে তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলতো, দেশপ্রমের কথা বলতো, আমাদের লাল সবুজ পতাকার কথা বলতো এবং কুদরত আলীর মতো শেখাতো কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের, কীভাবে নিজের দেশ ও পতাকাকে ভালবাসতে হয়, তবে হয়তো আমাদের সন্তানেরা একটা একটা মৌপ্রিয়া কিংবা সুমন্ত ইসলাম হয়ে উঠতো। জীবনের নিয়মেই একদিন কোন মুক্তিযোদ্ধা থাকবে না আমাদের দেশে; কিন্তু মৌপ্রিয়া আর সুমন্ত ইসলামরাই তাদের স্মৃতি বুকে মুক্তিযুদ্ধদের ইতিহাসকে বয়ে নিয়ে যাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। চমৎকার একটা পটভূমি বেছে নিয়েছেন। লিখেছেনও বেশ দারুণ ভাবে। অনেক ভালো লাগলো।

১৬ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:৪৪

সুফিয়া বলেছেন: অনেক সুন্দর করে অনেক ভাল ভাল কথা বলেছেন। ভাল লাগল আমার।

ধন্যবাদ আপনাকে। ভাল থাকুন।

৯| ১৬ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ৮:২৫

জাফরুল মবীন বলেছেন: সময়োপযোগী গল্প।

বেশ ভালো লেগেছে।

ধন্যবাদ ও শুভকামনা জানবেন বোন।

১৬ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:৪৫

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ জাফরুল ভাই। আপনার জন্যও রইল অনেক অনেক শুভ কামনা।

ভাল থাকুন।

১০| ১৬ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১:৪৫

অলওয়েজ ড্রিম বলেছেন: চমৎকার চেষ্টার জন্য সাবাস। লিখতে থাকেন। আরও ভাল অবশ্যই পারবেন।

আন্তরিক শুভেচ্ছা জানবেন।

১৬ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ২:১৬

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য।

১১| ১৭ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১১:৫১

বঙ্গভূমির রঙ্গমেলায় বলেছেন:
বেশ ভাল লিখেছেন।+++

১৭ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১২:২১

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য। ভাল থাকুন আপনি।

১২| ১৭ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১২:৫৪

কলমের কালি শেষ বলেছেন: যুদ্ধ নিয়ে লেখা গল্পে ভাল লাগলো বেশ । এমন করে বেঁচে থাকুক আমাদের গর্ব ।

১৮ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ৯:৪০

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য ও সুন্দর মন্তব্য করার জন্য।

ভাল থাকুন আপনি।

১৩| ১৭ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ৮:৪২

সুপ্ত আহমেদ বলেছেন: ্প্রিয় লেখিকার গল্প ভালো না হয়ে পারে :)

আপু আমাদের সাথে যোগ দিন - https://www.facebook.com/onirban.org

খুশি হবো আপনি আমাদের সাথে থাকলে :)

১৮ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ৯:৪১

সুফিয়া বলেছেন: অবশ্যই যোগ দিব। ধন্যবাদ আপনাকে গল্পটা পড়ার জন্য। ভাল থাকুন আপনি।

১৪| ১৭ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১১:২০

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: শায়মা বলেছেন: ওর মতো মৌপ্রিয়ারাই পারবে যুগ যুগ ধরে দেশ থেকে দেশান্তরে এই পতাকার মান সমুজ্জল রাখতে। আর তার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ বিদায়ের আয়োজনকে প্রশান্তময় করে তুলতে।

১৮ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ৯:৪২

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য। ভাল থাকুন আপনি।

১৫| ১৮ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:০৭

জুন বলেছেন: মৌপ্রিয়ারাই পারবে যুগ যুগ ধরে দেশ থেকে দেশান্তরে এই পতাকার মান সমুজ্জল রাখতে
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব । সেই দেশ মাতৃকার গর্বিত সন্তানদের নিয়ে লেখা গল্পটি অনেক ভালোলাগলো সুফিয়া

১৮ ই মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৩:১১

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ জুন আপনাকে গল্পটা পড়ার জন্য এবং মন্তব্য করার জন্য।

ভাল থাকুন আপনি।

১৬| ১৮ ই মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৪:৪১

মুদ্রা সংগ্রাহক বলেছেন: চমৎকার গল্প। তর তর করে এগিয়ে গেছে - বিজয়ের গল্প।
কিছু বানান হয়ত অনিচ্ছাকৃত-ভাবে ভুল থেকে গেছে - যেমন

অধ্যায়নের - অধ্যয়নের
নিস্কন্টক - নিষ্কণ্টক
তানাহলে - তা-নাহলে / তা নাহলে
দৌরাত্ব - দৌরাত্ম্য
আগুন্তুকের - আগন্তুকের

এরকম আরও কিছু ভুল রয়েছে। ঠিক করে ফেললে আরও সুপাঠ্য হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

১৭| ১৮ ই মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৫

ঢাকাবাসী বলেছেন: সুন্দর গল্প, ভাল লাগল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.