নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

সুফিয়া

পৃথিবী আমাকে শূণ্যতায় বাঁধতে পারেনা অস্তিত্বে মাকে আগলে রেখেছি বলে।

সুফিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

আব্বার সাথে আমার ছবি।

০৬ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০০

আব্বার সাথে আমার ছবি।

আব্বার সাথে ফ্রেমে বাঁধানো কোন ছবি নেই আমার। তাই বলে আব্বার ছবি সামান্যতম মলিন হয় যায়নি আমার স্মৃতি থেকে। এখনও নিজের দিকে ফিরে তাকালে আব্বার জ্বলজ্বলে চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পাই। সেই সৌম্যকান্তির বড়সড় দেহবল্লভের অধিকারী মানুষটি। আমার স্মৃতির পাদপীঠে আব্বা আজও তার সর্বস্ব নিয়ে অবস্থান করছেন। আব্বাকে নিয়ে আমার মনের মাঝে কত ঘটনা, কত স্মৃতি, কত মধুর সময়ের অনুরনন খেলা করে সেসব বলে শেষ করা যাবেনা। আজ সেগুলো নিয়ে লিখতে গিয়ে টের পাচ্ছি বুকের ভিতরটা নিদারুন হাহাকারে ভেঙেচূড়ে যাচ্ছে।

আব্বার সাথে আমার স্মৃতিময় ঘটনার শুরু যেখান থেকে অর্থাৎ যে সময় থেকে আমার স্মৃতিতে আব্বা জেগে আছেন সেখান থেকে লিখতে গেলে আমার এই লেখা একটা মহাকাব্য হয়ে যাবে। তাই বিস্তারিত না লিখে যে ঘটনাগুলো আমার মনের গভীর তটকে আজও নাড়া দিয়ে যায় সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে মনটা যখন তখন প্রলুব্ধ হয়ে উঠে। যেমন এই মুহূর্তে খুব করে মনে পড়ছে আম্মাকে ছাড়া আব্বার সাথে ভৈরবে কাটানো আমার দিনগুলোর কথা। বড় স্মৃতিময় সেই দিনগুলো। প্রতি ধান কাটার মৌসুমে আম্মা গ্রামের বাড়িতে চলে যেতেন দুই/তিন মাসের জন্য। আমরা ভাই-বোন যারা স্কুল/কলেজে পড়াশুনা করতাম তারা সবাই আব্বার সাথে ভৈরবের বাসায় থাকতাম। সেই সময়টায় কাজের বুয়া আমাদেরকে রান্না করে দিত। মাঝে মাঝে কাজের বুয়া না আসলে আমার আব্বা নিজহাতে রান্নার সমস্ত কাজ করতেন। কিন্তু আমাদেরকে কোনভাবেই বুঝতে দিতেন না যে অফিস সামলিয়ে ঘরের রান্নার কাজ সামলানো কতটা কষ্টের ব্যাপার !

একবারের কথা ষ্পষ্ট মনে আছে। কাজের বুয়া আসেনি। ঘরে কোন গুড়া মশলা কিংবা পিষা মশলা নেই। আমার আব্বা আর কি করবেন ? নিজেই হলুদ-মরিচ পিষলেন। আমি তখন ছোট, ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে পড়ি। বুঝতে পারিনি কত কঠিন একটা কাজ আব্বা অবলীলায় করে ফেলেছেন ! আব্বার সেই মশলা পিষার দৃশ্য আমার স্মৃতিপটে আজও মাঝে মাঝে ভেসে উঠে। তখন অপরাধবোধে মনটা ব্যথিত হয় আমার। মনে হয় সেদিন কেন বুঝতে পারিনি যে এই কাজটা আমার করা উচিত। আম্মার অনুপস্থিতিতে আব্বা এভাবে আম্মার সবটুকু দায়িত্ব অবলীলায় নিজের কাঁধে তুলে নিতেন। তাই আম্মার অনুপস্থিতি বিন্দুমাত্র টের পেতামনা আমরা। আব্বা আমাদের সবাইকে সময়মতো খেতে দিতেন, স্কুলে গেলাম কি-না খোঁজ নিতেন।

আব্বার সাথে আরও অনেক মধুর স্মৃতি এই মুহূর্তে আমার মনের ভিতরটাকে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আব্বার অনেকগুলো ভাল লাগা কাজের মধ্যে একটি ছিল বড়শি দিয়ে মাছ ধরা। তখন সরকারী অফিসের সময় ছিল সকাল সাতটা থেকে দুপুর দু’টো পর্যন্ত। বিকেল সময়টা সম্পূর্ণরূপে অবসর থাকতেন আব্বা। আমাদের বাসাটা ছিল মেঘনা নদীর তীরে। আব্বা প্রায় প্রতি বিকেলে বড়শি নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে যেতেন। সাথে নিতেন আমাকে আর আমার ছোট ভাইকে। আমরা মহাআনন্দে ছোকরা (বাঁশের বেত দিয়ে তৈরি মাছ ধরার পাত্র বিশেষ) হাতে নিয়ে আব্বার সাথে যেতাম। নদীর পাড়ের বড় পাথরের উপর বসে আব্বা নদীতে বড়শি ফেলতেন। উঠে আসত বড় বড় বেলে মাছ। মাছ দেখে সে কি আনন্দ আমাদের ! কার আগে কে বড়শি থেকে মাছ খুলে ছোকরায় রাখব এ নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যেত আমাদের মধ্যে।

লিখতে বসে টের পাচ্ছি আব্বার সাথে আমার স্মৃতির খেরোখাতাটা কত সমৃদ্ধ ! তখন এসব ঘটনাকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে না হলেও আজ মনে হচ্ছে স্মৃতির বাতায়নে এসব ঘটনা সুখের যে অমরাবতি জ্বালিয়ে রেখেছে তা তুলনাহীন। আব্বার একটা অভ্যাস ছিল আঙুল ফুটানো। প্রায়ই এ কাজটা করে দিতে হতো আমাকে অথবা আমার ছোট ভাইকে। দুপুরে অফিস থেকে ফিরে বিছানায় শুয়ে আরাম করার সময় আব্বা আমাদেরকে বলতেন আঙুল ফুটিয়ে দিতে। আমাদের তখন খেলতে যাবার সময়। তাই কিভাবে আব্বার কাছ থেকে পালানো যায় সেই সুযোগ খুঁজতাম আমরা। আব্বা বুঝতেন সব। বলতেন, তোদের জন্য খবর আছে। কি খবর ? বলে খুশিতে নেচে উঠতাম আমরা। আব্বা বলতেন একটি আঙুল ফুটিয়ে দিলে পাঁচ পয়সা করে পাবি। তখন খেলার কথা ভুলে গিয়ে কে আব্বার বেশি আঙুল ফুটিয়ে দিব সে নিয়ে প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যেত আমাদের মধ্যে। আজ মনে হয় সেই পাঁচ পয়সার মতো মূল্যবান আর কোন কিছু নেই এই পৃথিবীতে !

আব্বাকে নিয়ে আমার স্মৃতিপটে একটা বড় জায়গা দখল করে আছে আমাদের গ্রামের বাড়ির দিনগুলো। আম্মা মাঝে মধ্যে বাড়িতে গিয়ে থাকতেন বলে আমরাও ছুটি পেলে বাড়ি চলে যেতাম। তখন যেহেতু আমাদের মসজিদ কিংবা স্কুলে যাওয়া বন্ধ থাকত সেহেতু আব্বা আমাদের পড়াশুনার দিকে খুব মনযোগী থাকতেন। প্রতিদিন ফজরের নামাজের সময় নিজে তো ঘুম থেকে উঠতেনই, আমাদেরকেও ডেকে তুলতেন নামাজ পড়ার জন্য। সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠতে যে কি কষ্ট হতো ! কিন্তু আব্বার কাছে কোন মাফ ছিলনা। আব্বার সাথে আমরা ভাই-বোনেরা জামায়াতে নামাজ পড়তাম। যারা তখনও নামাজ শিখেনি তাদেরকেও আব্বা জামায়াতে দাঁড় করাতেন, আর একটা দোয়া শিখিয়ে দিতেন মনে মনে পড়ার জন্য। নামাজশেষে আরবি পড়ার পালা। সবাই আব্বার পাশে গোল হয়ে বসতাম আমরা। যার যার মতো কুরআন শরীফ, ছিপারা কিংবা কায়দা পড়তাম। তারপর দীর্ঘ মোনাজাত। আমরা এতেই প্রায় অতীষ্ট হয়ে উঠতাম।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আমাদের ছুটি মিলত আরও পরে। নামাজ আর আরবি পড়ার পর যার যার বাংলা বই নিয়ে বসতে হতো আব্বার সামনে। ততক্ষণে আম্মা রান্নাঘরে নাস্তার কাজে লেগে যেতেন। নাস্তা খাওয়ার জন্য আম্মা এসে ডাক না দেয়া পর্যন্ত আব্বার সামনে আমাদেরকে পড়া চালিয়ে যেতে হতো। তাই ছুটি পাবার আশায় আমরা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বারবার আম্মার আশার পথের দিকে তাকাতাম। আব্বা মাঝে মাঝে আমাদের দিকে সদয় হতেন। আম্মাকে ডেকে তাড়াতাড়ি নাস্তা দিতে বলতেন ।

আরও আছে, যা না বললেই নয়। ভৈরব থেকে বাড়ি যাওয়া কিংবা বাড়ি থেকে ভৈরব আসা – আমাদের নিরন্তর এই যাত্রায় সব সময় নেতৃত্ব দিতেন আব্বা। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ে আব্বার সাথে বাড়ি থেকে ভৈরব আসার কথা। আমরা নান্দাইল রেল ষ্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে ভৈরব এসে নামতাম। কিন্তু শেরপুরের আমাদের বাড়ি থেকে রেল স্টেশনে আসার জন্য সরাসরি কোন যানবাহন ছিলনা। আমরা বাড়ি থেকে তিন মাইলের মতো পথ হেঁটে নান্দাইল বাজারে আসতাম। সেখান থেকে রিকশা নিয়ে আরও প্রায় তিন মাইল অতিক্রম করে রেল স্টেশনে যেতাম। কিন্তু বাড়ি থেকে নান্দাইল বাজার পর্যন্ত তিন মাইল হেঁটে আসাটা খুব কষ্টকর ছিল। আমার এখনও মনে আছে প্রায়ই দুপুর আড়াইটার ট্রেন ধরতাম আমরা । সেজন্য বাড়ি থেকে রওনা দিতে হতো নয়টা/দশটার দিকে। আম্মা রাস্তায় খাবারের জন্য হালকা খাবার ও পানি দিতেন আমাদের সাথে। আমরা ছোটরা অর্ধেক রাস্তা হেঁটে এসেই ক্লান্ত হয়ে যেতাম। তখন চানপুর থেকে ঘোষপালা পুল পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তায় কোন গাছপালা এমনকি রাস্তার দুইপাশে কোন বাড়িঘর পর্যন্ত ছিলনা। চানপুর পৌঁছুতেই দুপুর হয়ে যেত। এরপর প্রচন্ড রোদ মাথায় নিয়ে চানপুর থেকে ঘোষপালা পর্যন্ত রাস্তাটা হাঁটতে হতো আমাদেরকে। আব্বা তাই চানপুর পৌঁছে একটা বড় বটগাছের ছায়াছ আমাদেরকে নিয়ে বসতেন। আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতাম, সাথে আনা খাবার খেতাম, তারপর আবার হাঁটতে শুরু করতাম দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে। আব্বা আমাদের মাথায় ছাতাটা ধরে রাখতেন যাতে রোদ না লাগে। অথচ উনার নিজের মাথা তখন রোদে প্রায় পুড়ে যেত।

আমার আব্বা আসলে ছড়িয়ে আছেন আমার দেহ-মনের সর্ব অস্তিত্ব জুড়ে। আব্বা পড়পাড়ে চলে গেছেন এক যুগেরও বেশি আগে। কিন্তু আব্বার সাথে আমার স্মৃতিগুলো তেমনি আছে। একটু পেছন ফিরে তাকালেই দেখতে পাই আমার শৈশবের দিনগুলোর যা কিছু স্মৃতিময় ঘটনা প্রায় সবগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে আমার আব্বা।

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩৬

শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: আমাদের সবার জীবন কি ভীষনভাবে এক!! পড়তে গিয়ে ফিরে ফিরে দেখছিলাম।

০৭ ই মে, ২০১৫ সকাল ৭:২৭

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ শতদ্রু আমার লেখাটা পড়ার জন্য ও মন্তব্য করার জন্য। ভাল তাকুন আপনি।

২| ০৬ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭

জেন রসি বলেছেন: এইসব স্মৃতিগুলো একই সাথে আনন্দের এবং মন খারাপ করার মত।

শুভকামনা রইল।

০৭ ই মে, ২০১৫ সকাল ৭:২৯

সুফিয়া বলেছেন: ঠিকই বলেছেন আপনি জেন। তবে বাবা থাকতে পুরোটা্ই আনন্দের মনে হলেও এখন মনে করলেই বুকের ভিতর কষ্ট বাড়ে।

ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য ও মন্তব্য করার জন্য।

৩| ০৬ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৫

বঙ্গভূমির রঙ্গমেলায় বলেছেন:
সব স্মৃতিগুলোই পড়লে নস্টালজিক হয়ে যাই।

মনটা উদাস হয়ে যায়।

শুভকামনা রইল আপু। :D ভাল থাকবেন।

০৭ ই মে, ২০১৫ সকাল ৭:২৯

সুফিয়া বলেছেন: আপনার জন্যও শুভ কামনা রইল। লেখাটা পড়ার জন্য এবং মন্তব্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

ভাল থাকুন।

৪| ০৭ ই মে, ২০১৫ সকাল ১১:৪৪

ইমতিয়াজ ১৩ বলেছেন: আব্বা আমাদের মাথায় ছাতাটা ধরে রাখতেন যাতে রোদ না লাগে। অথচ উনার নিজের মাথা তখন রোদে প্রায় পুড়ে যেত।

এখন যেমন আমার সন্তানের জন্য প্রতিটি মূহুর্ত ভাবনায় মশগুল থাকি ঠিক তখনই অনুভব করি আমার বাবা কি পরিমাণ কষ্ট করে আজকে আমাকে নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে সাহায্য করেছে।


ভাল থাকুক পৃথিবীর সব বাবারা।


আমার বাবা ভীষণ অসুস্থ, দোয়া করবেন প্লিজ।

০৭ ই মে, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৭

সুফিয়া বলেছেন: অবশ্যই দোয়া করি। দয়াময় আল্লাহ আপনার বাবাকে সুস্থ করে তুলুন। অনেক অনেক ভাল থাকুন বাবানক নিয়ে, নিজের সন্তানকে নিয়ে।

ধন্যবাদ আপনাকে।

৫| ০৭ ই মে, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৯

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: স্মৃতিগুলো পড়ে কাতর হলাম। এরকম একজন মানুষ জীবনে থাকা অনেক বিশাল একটা ব্যাপার।

ভাল থাকবেন।

০৮ ই মে, ২০১৫ বিকাল ৫:০৬

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ প্রোফেসর আমার লেখাটা পড়ার জন্য এবং মন্তব্য করার জন্য। ভাল থাকুন আপনি।

৬| ১০ ই মে, ২০১৫ রাত ১:৫৯

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: জেন রসি বলেছেন: এইসব স্মৃতিগুলো একই সাথে আনন্দের এবং মন খারাপ করার মত।

আবেগাপ্লুত :(

১০ ই মে, ২০১৫ সকাল ৭:১৭

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ বোকা মানুষ ভাই আমার লেখাটি পড়ার জন্য ও মন্তব্য করার জন্য। ভাল তাকুন আপনি সব সময়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.