নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

সুফিয়া

পৃথিবী আমাকে শূণ্যতায় বাঁধতে পারেনা অস্তিত্বে মাকে আগলে রেখেছি বলে।

সুফিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প--- সুখ

০৬ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১:৩৭


সুখ


লতিফার শেষ চেষ্টা ছিল যেভাবেই হোক তার বাবার চোখের অপারেশনটা সে করাবেই। সেজন্য বেশ কিছুদিন ধরে অফিস যাতায়াতের খরচ কমিয়ে এনেছে সে। কিছু জমা টাকা আগ থেকে আছে। সব মিলিয়ে না কুলোলে অন্য একটি উপায় আছে। ওর বিয়ের জন্য তুলে রাখা অলংকার থেকে কিছু বিক্রি করে দিবে। সব মিলিয়ে বাবার অপারেশনটা করানোর সাহস ফিরে পায় লতিফা। তবে ছোট্ট একটা অসুবিধা আছে। অলংকার বিক্রির কথা ওর বাবাকে জানানো যাবে না কিছুতেই। তাহলে রাজী হবেন না তিনি অপরারেশন করাতে। অলংকার বিক্রির কথা উঠলে তিনি যা বলবেন সেটা লতিফা এখনই বলে দিতে পারে। বলবেন, মেয়ের বিয়ের চেয়ে বুড়ো বয়সে চোখে দেখাটা খুব জরুরী নয়।

লতিফা মনে মনে না হেসে পারেনা। বিয়ের বাজারে প্রায় অচল একটা মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য বাবা-মায়ের সে কি প্রাণান্ত প্রচেষ্টা ! বিয়ের বাজারে প্রথম শ্রেণীর পাত্রী সে নয়। এমনকি দ্বিতীয় শ্রেণীতে চালানোও কষ্টকর। লতিফার অবসরপ্রাপ্ত বাবা তার বিয়ের জন্য যে বন্দোবস্ত করে রেখেছে সেখানে যৌতুকের কোন অংক নির্ধারণ করা নেই। কাজেই শুরুতেই শেষ হয়ে যায় লতিফার বিয়ের পর্ব। চাকুরিজীবি পাত্রী বলে কেউ কেউ এগিয়ে এলেও ছোটকালে লতিফার একটি বিয়ে হয়েছিল শুনে পিছিয়ে যায়। অথচ মইনুল সাহেবের কি প্রগাঢ় বিশ্বাস ! মেয়ের জন্য গয়না বানানো আছে। অতএব বিয়েটা নিশ্চিত। আজকালকার বিয়ের যজ্ঞে এই ক’টা গয়না যে নিতান্তই সামান্য কিংবা কোন গুরুত্ব বহন করেনা সেটা তারা বাবাকে কিছুতেই বুঝাতে পারেনা লতিফা।

তাই এই সিদ্ধান্ত লতিফার। গয়না বিক্রি করে হলেও বাবার চোখের অপারেশন করাবে সে। সিদ্ধান্তটা মইনুল সাহেবকে জানিয়ে দেয় সে। মইনুল সাহেব একটু চমকান। জিজ্ঞেস করেন, টাকার যোগাড় কি করে হলো ?
লতিফা দু’হাতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, সে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা বাবা। তোমার মেয়ে একটা চাকুরি করে এটা কেন তুমি ভুলে যাও বলতো ।

সেই তো এক চাকুরি ! সব তো সংসারের পেছনে ঢেলে দিচ্ছিস। নিজের ভবিষ্যতের কথাটা ভাবলি না একবার। কত ভাল একটা সম্বন্ধ এসেছিল। বুড়ো বাবা-মাকে দেখাশুনা করতে পারবি না বলে বিয়েটা করলি না। এভাবে আর কতদিন মা ? তুই বিয়ে করে সংসারি না হলে আমরা দু’জন যে মরেও শান্তি পাবনা।

এসব কথা বাদ দাও তো বাবা। তোমাদেরকে আমি মরতে দিলে তো ! আচ্ছা ভাবতো বাবা, তোমার চোখের অপারেশন হলো, তুমি সবকিছু দেখতে পাচ্ছ, কি ভালই না হবে বাবা ! তুমি আবার পড়তে পারবে। নিজে নিজে ঘুরে বেড়াতে পারবে। আমি প্রতি মাসে বেতন পেয়ে তোমার জন্য তোমার পছন্দের বই কিনে আনব। তোমার খুশি লাগছে না বাবা ?

মইনুল সাহেব কল্পনায় তার মেয়ের উচ্ছাসমাখা মুখটা দেখতে চেষ্টা করেন। বলেন, হ্যাঁ মা। এটা তো খুশিরই খবর। তুই খুশি থাকলে আমরাও খুশি। তোর মাকে জানিয়েছিস খবরটা ?
লতিফা উত্তর দেয়ার আগেই তিনি নিজেই ডাকতে শুরু করেন।
লতুর মা, ও লতুর মা। এদিকে এসো। শুনো লতু কি বলছে। আমার চোখের অপারেশনের সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
লতিফা ওর বাবার খুশিভরা মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর উঠে যায় সেখান থেকে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলে, এইতো আমার সুখ !

মেয়ের সামনে খুশি দেখালেও একটা চিন্তা মইনুল সাহেবের মনে থেকেই যায়। তাই লতিফার মা কাছে আসতেই তিনি জিজ্ঞেস করেন, লতু যে আমার চোখের অপারেশনের ব্যবস্থা করল, তুমি জানো টাকার ব্যবস্থা কিভাবে করেছে ? এই ক’দিন আগেও তো টাকার অভাবে আমার চোখের অপারেশন হচ্ছিল না।

লতু বলছিল ওর কিছু জমানো টাকা আছে। আর অফিস থেকে কিছু টাকা ধার নিবে।
গয়না বিক্রির কথাটা চেপে যান রেবেকা। কারণ, লতিফা আগেই মাকে সাবধান করে দিয়েছে বাবাকে কিছুতেই গয়না বিক্রির কথা জানানো যাবেনা।

তবু আমার মনে একটা খটকা লাগছে। অপারেশন করাতে মেলা টাকার দরকার। সংসারের খরচ বাঁচিয়ে লতু আর কত টাকাই বা জমাতে পেরেছে ? ওর চাকুরিটাও তেমন আহামরি কিছু নয় যে অফিস থেকে ওকে এতগুলো টাকা ধার দিবে। না, না, লতুর মা। আমার কাছে ব্যাপারটা মোটেও ভাল মনে হচ্ছেনা। তুমি ভাল করে খুঁজ নাও। লতু কিছু লুকাচ্ছে না তো আমাদের কাছ থেকে ?

আপনি এ নিয়ে চিন্তা করবেন না তো। বরং অপারেশনের কথা ভাবুন। আমাদের তো ঐ একটাই সন্তান। সে তার বাবার প্রতি দায়িত্ব পালন করতে চাইছে তা নিয়ে এত কথা বলার দরকার কি ? লতু তো যোগ্য সন্তানের কাজই করছে।

না, না, লতুর মা। তুমি আমাকে ভুল বুঝছ। লতু তো একটা মেয়ে। ওকে বিয়ে করতে হবে, সংসার করতে হবে। এই বয়সের মেয়েদের কত স্বপ্ন থাকে। সেসব বাদ দিয়ে শুধু আমাদেরকে নিয়ে পরে থাকলে ওর চলবে ? তুমি দেখছ তো ওকে বিয়ে দেয়াটা তেমন সহজ কাজ নয়। আজকাল বিয়ের বাজারে পাত্রীর রূপ লাবণ্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ ততটাই গুরুত্বপূর্ণ পাত্রীর বাবার বিত্ত-বৈভব। সেসব তে কিছুই নেই আমাদের। তার উপর -----।

স্বামীকে এখানেই থামিয়ে দেন রেবেকা। লতুর জীবনের অপ্রিয় ঘটনাটা কোনভাবে সামনে আসুক এটা তিনি চাননা। তাই বলেন, লতুর বিয়ে নিয়ে আপনি কোন চিন্তা করবেন না। খালি বিয়ে আর বিয়ে ! এদিকে মেয়ে তো অন্য কথা বলে।
কি বলে লতু ?
বলে, বিয়েটাই মেয়েদের জীবনে সব নয়। বিয়ে না হলে না হবে। নিজকে চালিয়ে নেবার মতো একটা উপায় তো আমার আছে। দিব্যি চলে যাবে আমার।

এসব কি কথা লতুর মা ? লতু এসব কথা বলল আর তুমি চুপ করে শুনলে ? মেয়েদের জীবনে থাকা-খাওয়া-পরাটাই কি সব ? সে সবের ব্যবস্থা ও করে নিতে পারবে আমি জানি। কিন্তু আমরা তো চিরকাল থাকব না। নির্ভর করার মতো একটা মানুষ তো ওর চাই। এখানে সমাজ বলে একটা কথা আছে সেটা ভুলে গেলে চলবে কেন ? ও একা থাকতে চাইলেই সমাজ ওকে দিবে কেন একা থাকতে ? তুমি ওকে বুঝাও লতুর মা। ওকে বুঝাও আমি অপারেশন করাব তখন যখন লতু আমাকে কথা দিবে যে ও বিয়ে করবে। আমার অপারেশনের পর আমি ওর বিয়ের ব্যবস্থা করব। ওকে বিয়ে করতে হবে।

লতিফা দূরে দাঁড়িয়ে বাবা-মায়ের কথা শুনছিল। মইনুল সাহেবের শেষ কথায় সে সতর্ক হয়। বাবা বেঁকে বসলে সব আয়োজন ভেস্তে যাবে। এগিয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আচ্ছা বাবা, আমার বিয়ের কথা ছাড়া তোমার কি আর কোন কথা থাকতে নেই ? খালি বিয়ে, বিয়ে আর বিয়ে ! আচ্ছা ? ঠিক আছে। এই আমি তেমাকে ছুঁয়ে কথা দিলাম আমি বিয়ে করব।

কিন্তু -------
কিছু বলতে যাচ্ছিলেন মইনুল সাহেব। কিন্তু এ প্রসঙ্গটাকে আর এগোতে দেয়না লতিফা। তাড়াতাড়ি বলে, বাবা ডাক্তারের সাথে আমার সব কথা হয়ে গেছে। আজ বিকেলে একবার তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে। আমি অফিস থেকে ফিরে তোমাকে নিয়ে যাব। তুমি তৈরি হয়ে থেকো।
আজই ?
হ্যাঁ বাবা। ডাক্তার বলেছেন আর দেরি করা ঠিক হবেনা। তোমাকে পরীক্ষা করে বলে দিবেন কবে নাগাদ অপারেশনটা করবেন।

যথারীতি চোখের সফল অপারেশন হয় মইনুল সাহেবের। তিনি এখন দু’চোখ ভরে দেখতে পান সবকিছু। পরিবারের প্রত্যেকে খুশী এ নিয়ে। মইনুল সাহেব মেয়ের জন্য প্রাণভরে দোয়া করেন। বাবার জন্য এটুকু করতে পেরে লতিফাও খুব খুশি। তবে মাঝে মধ্যে দুশ্চিন্তা ভর করে মনে। তখন বুকের ভিতরের সুখের পায়রাটা একটু যেন নেতিয়ে পড়ে। মনে হয় কখনও যদি বাবা খুঁজ করেন অলংকারের, তখন কি হবে ? বাবার কাছে মিথ্যেবাদী প্রমাণিত হবে সে। আহত হবে তার বাবা।

পর মুহূর্তে নিজের পক্ষে যুক্তি খুঁজে পায় লতিফা। গয়না দিয়ে কি হতো ? সিন্দুকে পড়ে থেকে থেকে জং ধরে যেত। তার জীবনে বিয়ের মহাযজ্ঞ কখনও আসবে কি-না কে জানে ? অনিশ্চিত এই কাজের জন্য গয়নাগুলো আগলে বসে থাকার চেয়ে একটা ভাল কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এটাই বাবাকে বুঝাতে হবে।

কিন্তু মইনুল সাহেব লতিফার এই বুঝ মেনে নিবেন তো ! বলবেন না তো যে তুই সন্তান হয়ে নিজে বাবার চিকিৎসার টাকা যোগাড় করতে পারলি না। উল্টে আমার কেনা গয়নাগুলো বিক্রি করে দিলি ?
কথাটা মনে হতেই লতিফার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠে। মনে মনে বলে, আমি মিথ্যেবাদী হয়ে যাব না তো বাবার কাছে ?

এদিকে চোখের দৃষ্টি ফিরে পেয়ে নতুন করে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠেন মইনুল সাহেব। তিনি উঠে-পড়ে লাগেন লতিফার জন্য পাত্রের খুঁজ করতে। ঘটকের শরণাপন্ন হন তিনি আবার। এক সময় কাজ হয়। সম্বন্ধ ? ঠিক হয় লতিফার। ছেলে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। প্রথম স্ত্রী মারা গেছে বিয়ের এক বছরের মাথায়। তাই লতিফাকে বিয়ের ব্যাপারে তার কোন আপত্তি নেই।

মইনুল সাহেব দেরি করেন না এ ব্যাপারে। বিয়ে হয়ে যায় লতিফার স্কুল শিক্ষক বারেক মজুমদারের সাথে। মেয়েকে গা ভর্তি গয়না দিয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন মইনুল সাহেব। বুকের উপর থেকে একটা ভারী পাথর নেমে যায় তার।

কিন্তু তার এই তৃপ্তিসুখ স্থায়ী হয়না বেশিক্ষণ। পরদিন সকাল বেলায় লতিফার শ্বশুর লোক পাঠিয়ে ডেকে নিয়ে যায় তাকে। অবাক হন মইনুল সাহেব। তিনি তো এমনিতেই আসতেন আর একদিন পর লতিফাকে জামাইসহ ফিরানি নিতে। তাহলে আজ কেন ডেকে পাঠানো হলো তাকে। দুরু দুরু বক্ষে তিনি গিয়ে হাজির হন মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে।

লতিফার শ্বশুর আজগর মজুমদার তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। মইনুল সাহেবকে দেখে তিনি রাগে ফেটে পড়েন। নতুন অতিথিকে বসতে বলার সামান্য সৌজন্যটুকু দেখাতেও তিনি ভুলে যান। প্রায় গর্জন করে উঠেন তিনি।
এই আপনাদের শিক্ষা ! নিজে একটা সরকারি চাকুরি করতেন, আপনার মেয়েও চাকুরি করে। বাপ-মেয়ে মিলে আমাদের সাথে এভাবে প্রতারণা করতে আপনাদের বিবেকে বাঁধল না ?

তথোমতো খেয়ে যান মইনুল সাহেব লতিফার শ্বশুরের এই অকস্মাৎ আক্রমণে। আমতা আমতা করে বলেন, এসব কি বলছেন বেয়াই সাহেব ? আমরা আপনার সাথে প্রতারণা করেছি ?
এটাকে প্রতারণা বলে না তো কি বলে ? মেয়েকে সোনার গয়না দিয়ে সাজিয়ে দিবেন বলেছিলেন। আর দিলেন সব ইমিটেশনের গয়না। এটাকে প্রতারণা বলেনা ? আমি ইচ্ছে করলে এই প্রতারণার দায়ে আপনাকে পুলিশে দিতে পারি। নেহায়েৎ আপনারা আমার আত্মীয় তাই।

আজগর সাহেবের শেষ কথাগুলো কানে যায়না লতিফ সাহেবের। তার কানে বাজতে থাকে ইমিটেশনের গয়নার কথাটা। তিনি অবাক হয়ে বলেন,
ইমিটেশনের গয়না ? এটা কি করে হয় ? আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো বেয়াই সাহেব ?
আপনি বলতে চান আমি সোনা আর ইমিটেশনের পার্থক্য করতে জানিনা ?
আরও রেগে যান আজগর সাহেব। মইনুল সাহেব কাচুমাচু হয়ে বলেন, না না বেয়াই সাহেব। আমি সেকথা বলছিনা।
আজগর সাহেব এ কথায় কান না দিয়ে গলার স্বর উঁচু করে ডাকতে থাকেন। এই কে আছিস ? বৌ মার গায়ের গয়নাগুলো খুলে নিয়ে আয় তো।

তার ছোট মেয়ে রিনি তৎক্ষণাত একটা কাপড়ে পোটলায় বেঁধে গয়নাগুলো এনে আজগর সাহেবের সামনে টেবিলে রেখে দেয়। সেদিকে এগিয়ে যান মইনুল সাহেব। আজগর সাহেব বলেন
দেখুন, ভাল করে দেখুন। আমি মিথ্যা বলছি না কি সত্যি বলছি। ইমিটেশন আর সোনার পার্থক্য করতে আপনি ভুল করতে পারেন, আমি পারিনা। এগুলো খাঁটি ইমিটেশন।

মইনুল সাহেব গয়নাগুলো হাতে নিয়ে অবাক হয়ে যান। এটা কি করে সম্ভব ? সেই একই ডিজাইন, একই রকমভাবে বানানো। কেবল সোনার জায়গায় ইমিটেশন। তিনি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন।
এমন সময় লতিফা সেখানে আসে। মইনুল সাহেবের হাত থেকে গয়নার পোটলাটা নিয়ে বলে, গয়নাগুলো ইমিটেশনের একথা সত্যি। কিন্তু এতে আমার বাবার কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার। আপনি আমার বাবাকে আর অপমান করবেন না। এজন্য যা শাস্তি দিতে হয় আমাকে দিন।

লতিফার স্বামী বারেক মজুমদার খুব ভোরে টিউশনি করতে চলে গিয়েছিল। লতিফার গয়না নিয়ে এত ঘটনার কিছুই সে জানতে পারেনি। টিউশনিশেষে ঘরে ফিরে শ্বশুরকে দেখে খুব অবাক হয়ে যায় সে। সেখানে লতিফাও দাঁড়ানো, হাতে গয়নার পোটলা। বারেক দ্রুত লতিফার শরীরের দিকে দৃষ্টি বুলায়। না, কোন গয়না নেই লতিফার শরীরে। বরং সেই গয়নাগুলো হাতে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। ঘটনার কিছু বুঝতে না পেরে সে তার বাবাকে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে বাবা ?
কি আর হবে ? তোর শ্বশুর আর বউমা মিলে আমাদেরকে ঠকিয়েছে। এই গয়নাগুলো সব ইমিটেশনের।
তাতে কি হয়েছে বাবা ? গয়না তো আমি-তুমি পরবনা। পরবে লতিফা। সে যদি ইমিটেশনের গয়না পরে আনন্দ পায় তাহলে আমাদের কি এসে যায় ?
চুপ করো তুমি। কতদিন না বলেছি সব ব্যাপারে এত দিল-দরিয়া হলে চলেনা।
কিন্তু বাবা, এ নিয়ে এতটা হৈ চৈ করার কি আছে ?
তারপর শ্বশুরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন, আপনি বসুন বাবা। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
হাত ধরে শ্বশুরকে নিয়ে সোফার উপর বসায় বারেক। বসতে বসতে মইনুল সাহেব বলেন, তুমি বিশ্বাস করো বাবা, আমি এসবের কিছুই জানিনা। আমার একমাত্র মেয়ে লতিফা। ওকে আমি ঠকাব ? ওর জন্য আমি সোনার গয়নাই বানিয়েছিলাম। কিন্তু কিভাবে এই ঘটনা ঘটল আমি জানিনা।
আমি জানি বাবা।
লতিফার কথায় সবাই চমকে তাকায় ওর মুখের দিকে। লতিফা সব কথা খুলে বলে। মইনুল সাহেবের চোখের অপারেশনের জন্য টাকার ব্যবস্থা করতে না পেরে সে বাধ্য হয়েছিল গয়নাগুলো বিক্রি করে দিতে। বিক্রি করার আগে একই ডিজাইনের ইমিটেশনের এই গয়নাগুলো বানিয়ে রেখেছিল সে।

মইনুল সাহেব অবাক হয়ে শুনেন মেয়ের কথা। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। লতিফা এগিয়ে গিয়ে বাবার চোখের পানি মুছে দেয়। মইনুল সাহেব বলেন
কিন্তু মা তুই একবারও ভাবলি না এই বুড়ো বাপটার কথা। তুই না হয় নিজের বিলাসিতার চেয়ে আামার চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনাটা জরুরী মনে করেছিলি। কিন্তু সবাই এটা বুঝবে কেন ? আজ এই বুড়ো বয়সে আমাকে প্রতারকের বদনাম শুনতে হলো, সেটা তুই দূর করবি কিভাবে ? এরচেয়ে আমার অন্ধ থাকাটাই ভাল ছিল রে মা।
বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠেন তিনি। লতিফা দু’হাতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে
বাবা আমি বুঝতে পারিনি। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি তখন শুধু তোমার চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনার কথাই ভেবেছিলাম। ডাক্তার বলেছিল আর কিছুদিন দেরি হলে অপারেশন করে কোন লাভ হবেনা। এই অল্প সময়ে কোথাও থেকে টাকার ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। তাই আমি একাজটা করেছি। আমি তোমার অযোগ্য সন্তান বাবা। তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

বাবা-মেয়ের কথার মাঝে এগিয়ে আসে বারেক। বলে
আমি সব বুঝতে পেরেছি। এখানে তোমার কিংবা বাবার কারও কোন অপরাধ নেই। অপরাধ যা হয়েছে সেটা আমাদের দিক থেকে হয়েছে। আমি এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আমার বাবা যদি আপনাকে কোন কটু কথা বলে থাকেন তাহলে ছেলে হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
মইনুল সাহেব এরপর কি বলবেন ভেবে পাননা। জামাই এর মুখের দিকে তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। বারেক আবার বলে, আপনার বা আপনার মেয়ের উপর আমার কোন রাগ নেই। বরং আপনার মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে আমি গর্ব বোধ করছি বাবা।

তারপর আজগর সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, বাবা লতিফা হয়তো একটা অন্যায় করেছে। কারণ, সে আগে বলেনি যে এই গয়নাগুলো ইমিটেশনের। কিন্তু আমার শ্বশুরের এখানে কোন দোষ নেই। যে কারণে লতিফা সোনার গয়নাগুলো বিক্রি করে দিয়ে ইমিটেশনের গয়না পরে শ্বশুর বাড়ি এসেছে সে কারণটা আমি আগে জানলেও ওকেই বিয়ে করতাম বাবা। বাবা গয়না মেয়েদের খুব প্রিয় জিনিস। লতিফা যদি তার গয়নার মায়া ছাড়তে পারে তাহলে আমরা কেন পারব না ? লতিফার মতো মেয়েরা আরও অনেক কিছু করতে পারে, তুমি দেখো বাবা। লতিফা আজ ওর বাবার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছে প্রয়োজনে তোমার জন্য তার চেয়েও বেশি ত্যাগ স্বীকার সে করবে। তোমার ছেলের বউ এর এই সামান্য ভুলটুকু তুমি ক্ষমা করবে না বাবা ?

ছেলের এত যুক্তির পেছনে কোন কথা না বলে আজগর সাহেব সেখান থেকে উঠে যান। মইনুল সাহেব জামাই এর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, কি হবে বাবা ?
কিচ্ছু হবে না, আপনি কিচ্ছু ভাববেন না। এ প্রসঙ্গে আর কোন কথা আশা করি হবেনা। প্রয়োজনে আমি বাবাকে আরও বুঝিয়ে বলব।

জামাইয়ের কথা শুনে খুশিতে মইনুল সাহেবের মুখটা উজ্জল হয়ে উঠে। তিনি সেখান থেকেই বিদায় নিয়ে চলে বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু তার মনের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তার ছাপ থেকেই যায়। দু’দিন পর লতিফা তার স্বামীসহ নায়র আসে বাবার বাড়িতে। মেয়ের গা ভর্তি সোনার গয়না দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েন লতিফার বাবা-মা দু’জনই। জামাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠে তাদের। মইনুল সাহেব জামাইকে কাছে ডেকে বলেন, বাবা তুমি যে কাজটা করেছ আমার মেয়ের ত্যাগের চেয়েও সেটা অনেক বড়। আজ আমি সত্যিই সুখী।

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:০৩

ইমতিয়াজ ১৩ বলেছেন: সমাজের প্রতিচ্ছবি।

০৭ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ৯:২৪

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ মইমতিয়াজ ১৩ আমার গল্পটি পড়ার জন্য ও মন্তব্য করার জন্য। ভাল থাকুন আপনি সব সময়।

২| ০৬ ই জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:৪০

হাসান মাহবুব বলেছেন: স্নেহ, মায়া, ত্যাগ আর লোভ মিলিয়ে সুপাঠ্য একটা গল্প।

০৭ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ৯:২৬

সুফিয়া বলেছেন: সুন্দর করে গল্পের নির্যাসটুকু বের করে এনেছেন। অনেক অনেক ধন্যভাদ আপনাকে হাসান মাহবুব। ভাল থাকুন আপনি সব সময়।

৩| ০৬ ই জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৮

কাবিল বলেছেন: ভাল লাগল।

০৭ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ৯:২৭

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ কাবিল গল্পটা পড়ার জন্য ও মন্তব্য করার জন্য।

৪| ০৬ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ৯:০৩

সুমন কর বলেছেন: চমৎকার বাস্তবস্পর্শী গল্প পড়লাম। শেষটা দারুণ।

সমাজের সবাই যদি বারেক হয়ে যেতো, তাহলে এতো হিংসা-বিদ্বেষ থাকতো না।

০৭ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ৯:২৮

সুফিয়া বলেছেন: আপনি ঠিকই বলেছেন। সমাজের সবাই যদি বারেক হয়ে যেতো, তাহলে এতো হিংসা-বিদ্বেষ থাকতো না। তবে একেবারে যে নেই তা কিন্তু নয়। তাই তো সমাজটা এখনও টিকে আছে।

ধন্যবাদ আপনাকে গল্পটা পড়ার জন্য ও মন্তব্য করার জন্য। ভাল থাকুন সব সময়।

৫| ০৭ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:৩২

নীল জোসনা বলেছেন: অনেক ভাল লাগল গল্পটা পড়ে । সমাজে লতিফাদের অভাব নেই কিন্তু বারেক এর মত স্বামীর খুব অভাব ।

০৮ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ৯:২৫

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ নীল জোসনা আপনাকে আমার গল্পটা পড়ার জন্য ও সুন্দর করে মন্তব্য করার জন্য। ভাল থাকুন আপনি সব সময়।

৬| ০৮ ই জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:৫৬

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: হৃদয় ছোঁয়া আবেগ আর ভালবাসার সাথে বাস্তব জীবনের গল্প। শেষে ভালবাসা আর মানবতার জয় দিয়ে সমাপ্তি। গল্পে ভালো লাগা। ভালো থাকুক লতিফা আর বারেকেরা।

ভালো থাকুন সবসময়, শুভকামনা রইল।

০৮ ই জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪৩

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে বোকা মানুষ বলতে চায় আমার গল্পটা পড়ার জন্য এবং এত সুন্দর করে মন্তব্য করার জন্য। ভাল থাকুন আপনি সব সময়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.