নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুজায়েত শামীম

শামীম সুজায়েত

ছাত্রজীবনে সাংবাদিকতার হাতেখড়ি।শুরু করা শখের বসে। একসময় তা নেশা থেকে পেশা।ব্যবস্থাপনায় অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে পছন্দের এ পেশায় কেটে গেলো অনেকটা সময়। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা পড়েছে পেশাগত জীবনে চলার পথে পাওয়া নানা অসঙ্গতির চিত্র।এখন লেখালেখি করি নিজের আনন্দে, ক্লান্তিহীন ভাবে যা ভালো লাগে।আমার জন্ম ১৯৭৭ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি যশোর উপশহর আবাসিক এলাকায়। আমার শৈশব ও কলেজ জীবন কেটেছে এখানেই।জীবন জীবিকার তাগিদে এখন গঙ্গাবুড়ির আলোঝলমল শহরে্ কাটছে সারাবেলা। যোগাযোগ:ই মেইল : [email protected]হটলাইন : +ফেসবুক : https://www.facebook.com/sumon.sujayet জন্মদিন : 02.02.1977

শামীম সুজায়েত › বিস্তারিত পোস্টঃ

সত্তা

২৬ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ৮:২৩

ছোট্ট একটি আলোর দলা। চোখের সামনে সেটি পাক খেল কয়েকবার। আলিফের মনে হলো, তীব্রশক্তি নিয়ে সেটি তার শরীর থেকে বের হয়েছে। সেই মুহূর্তে যেন কমে গেল শরীরের ওজন। সবুজ ও নীল রং মিশ্রিত আলোর দলা দ্রুত বদল করলো নিজ আকার। ছোট হতে হতে তা হারিয়ে গেল একসময়। সেদিকে তাকিয়ে আলিফ খেয়াল করলো, শরীরের যন্ত্রণাও ধীরেধীরে কমে যাচ্ছে।

অথচ কিছুক্ষণ আগে তীব্র এক আঘাতে সে মুখ থুবড়ে পড়ে। ওই সময় তার মনে হচ্ছিল, বুকের পাজড়ে যেন বিদ্ধ হয়ে বেরিয়ে গেলো লোহার লাইটপোস্ট। এতবেশি যন্ত্রণা আগে কখনও অনুভব করেনি সে। বিশেষ করে দম ফিরে পাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা, এবারই যেন ঘটলো প্রথম। খেয়াল করলো, তার গলার মধ্যে আস্ত একটা ইটের মত কোন কিছু বেধে থাকার যে যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল কয়েক সেকেন্ড আগে, এখন তা আর নেই।



ব্যাপারটা অবাক করার মত। কিন্তু কেন এসব হচ্ছে? হঠাৎ করে প্রচন্ড যন্ত্রণা, আবার কয়েক মিনিটের মধ্যে তা মিলিয়ে যাওয়া।

অদ্ভুত এসব প্রশ্নের উত্তর না খুজে, চারপাশে একবার চোখ বুলালো আলিফ। দেখলো পরিবেশটা বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঝাপসা এবং ধোয়াটে। সবকিছু দেখতে খুব অস্পষ্ট লাগছে। সাধারণত কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে, একটু দূরের কোনকিছু যেমন ভাল মত দেখা যায়না, এখানে পরিবেশ তেমনই মনে হচ্ছে। এর মধ্যেও বড় রাস্তার ধার ঘেষে দন্ডায়মান একটি ছায়া মূর্তিও চোখে পড়লো তার। সেদিকে এগিয়ে যেতেই, ছায়ামূর্তি সরে যেতে লাগলো। কয়েক কদম এগিয়ে গেল আলিফ। কাছে যেতেই দেখলো, মিরাজের বাবা শহিদুজ্জামান। অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। খুবই পরহেজগার ব্যক্তি।

কিন্তু তার সাথে দেখা হলো কেনো? তাকে ঘিরেও রয়েছে ক'জন মানুষ। তাদের সবার শরীর অন্য ধরণের। পেছন দিকের সবকিছু শরীর ভেদ করে স্পষ্ঠ দেখা যাচ্ছে।

ভুল কিছু দেখছিনা তো, নিজে্কে প্রশ্ন করে আলিফ। এটি কি ভাবে সম্ভব! মৃত ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত!

কিন্তু নিজের চোখে সে দেখছে সবার প্রিয় স্যার, ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিরাজের বাব তার সামনে দাড়িয়ে। অথচ দেড় বছর আগেই মানুষটি মারা গেছেন। ওই সময় কবর খোড়া থেকে শুরু করে লাশ দাফন,কাফনের বাধনগুলো খুলে দেয়া এবং কাজের ফাকে ফাকে বন্ধুকে শান্তনা দেয়ার কাজটা, তাকেই করতে হয়েছিল। সেই মৃত ব্যক্তিটি চেহাররা ভিন্নতা নিয়ে ফিরে এসেছে তার সামনে। কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে রাস্তায় চলাচলরত অন্য মানুষগুলো কি তাকে দেখছেনা?

সবাই কেনো ব্রিজটার দিকে ছুটছে?

কিসের গোলমাল ওখানে?

আলিফও এগিয়ে গেল সেদিকে। দেখতে পেলো, সেখানে একটি এম্বুলেন্স দাড়িয়ে। একটি পুলিশের গাড়িও রয়েছে। পুলিশ লাঠি দিয়ে ঠেলে ঠেলে মানুষের ভীড় সামলাচ্ছে। কিন্তু কোন কথাবার্তা বা চিল্লাচিল্লির শব্দ তার কানে পৌছাচ্ছে না। একসময় সে ভীড়র খুব কাছে চলে আসে। রক্তে ভেজা একজন মানুষকে সে দেখতে পায় সেখানে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আর সেদিকে তাকিয়ে ছ্যাক করে উঠলো তার বুকের ভেতর! লোকটি দেখতে হুবহু তার মত। যেন সে নিজেই। তারই কাল রঙের স্যুট প্যান্ট পরিহিত।

মনে করার চেষ্ঠা করলো আলিফ। হ্যা মনে পড়েছে, একটি প্রেস কনফারেন্সে যাবে বলে স্যূটটা পড়ে সকালে বাসা থেকে বের হয়। ব্রিজটার কাছাকাছি আসতেই মটরসাইকেল আরোহী দুজন ব্যক্তি তার গতিরোধ করে। সেও তার মটরসাইকেলের হার্ড ব্রেক চেপে থেমে যায়। তারপর সেই লোক দুজনের একজন আকস্মিক ......................।



গোটা শহরে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো খবরটা। র্দুবৃত্তের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন সাংবাদিক আলিফ আজমাইন। শহরের প্রধান সড়কের ব্রিজটার কাছে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এদিকে আলিফেরও বুঝত আর বাকি নেই, সে এখন মৃত। তার শরীরের এপাশ থেকে ওপাশ দেখা যাচ্ছে। সে কিছু শুনতে পাচ্ছেনা। তার কথাও কেউ শুনছেনা। কোন কিছু স্পর্শ করা যাচ্ছেনা। তবে একটি জিনিস হচ্ছে। একই সাথে দু ভুবনের মানুষকে দেখতে পারছে।



এদিকে একে একে হাসপাতালে বাড়তে লাগলো তার চেনাজানা লোকজনের ভিড়। সন্ত্রাসির গুলিতে সাংবাদিক মারা গেছে শুনে সাধারণ মানুষ এসে ভিড় করছে। তার সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধুরা বেশ উত্তেজিত। হাসপাতাল চত্বরে উপস্থিত পুলিশসুপার ও থানার ওসির ওপর থেকে থেকে রাগারাগি করছে তারা। ওসি ওয়াকিটকি কানের কাছে নিয়ে বারবার পুলিশ কন্ট্রলরুমে কথা বলছেন। লাশকাটা ঘর থেকে চোখ মুছতে মুছতে বের হচ্ছে মানুষ। ইতিমধ্যে সেখানে ছুটে এসে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছে পরিবারের লোকজন। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে খবরটা পেয়ে সোজা হাসপাতালে ছুটে আসে আলিফের ছোট বোন। তাকে পেয়ে কোনভাবেই আবেগ ধরে রাখতে পারলোনা আলিফের মা-বাব ও ছোট ভাই। চারজন একেঅপরকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাদতে লাগলো।

আলিফ তখন তাদের পাশে চুপচাপ দাড়িয়ে। সবার দিকে তাকাচ্ছে। কে কেমন কান্নাকাটি করছে, তাও খেয়াল করতে লাগলো। তার প্রতি গোটা পরিবারের এত আবেগ, এত ভালবাসা, তা প্রাণ থাকাতে কোন ভাবেই বুঝতে পারেনি সে। আজ্ও সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সে মায়ের সাথে ঝগড়া করেছে। ইস! সেটি নিয়ে নিশ্চয় মা খুব কষ্ট পাচ্ছে এখন।

বাবারও কষ্ট হচ্ছে খুব। তিনি বারবার মর্গের দিকে ছুটে ছুটে যাচ্ছেন। আসলে কে কাকে সামলাবে। কাকে দেবে শান্তনা।

"বাবা! তুমি এমন ভাবে কেঁদোনা। তোমার চোখের জল আমি কোন ভাবেই সইতে পারবোনা।"

আলিফ চিৎকার করে বল্লো," প্লিজ বাবা। তুমি ওমন করোনা। বুকে চারটি ব্লক নিয়ে তুমি অনেক ঝুকির মধ্যে রয়েছো। উত্তেজিত হলে তোমার বুকের ব্যথাটা বাড়বে বাবা। তোমার কিছু একটা হলে মা'ও যে বাচঁতে পারবেন না।"

"আব্বু, আব্বু প্লিজ, আমার লক্ষ্যি বাব, একটু শান্ত হও।"



সত্যিতো টাকার অভাবে গত দু বছরেও করা সম্ভব হয়নি বাবার চিকিৎসা। স্রেফ এনজিওগ্রাম করা গেছে। বাবার ওপেনহার্ট সার্জারি বা রিং পড়ানোর কথা অনেকদিন ধরে ভেবে আসছিল আলিফ। ঢাকা কিংবা ভারতের কোন বড় হাসপাতালে বাবার অপারেশন করানোর জন্য বেশ কিছুদিন ধরে মনে মনে টাকাও জমিয়ে আসছিল সে। কিন্তু হলো না। জীবনে সবচেয়ে বেশি ভালবেসেছে যে মানুষটিকে, যার একটু সুখ, শান্তির জন্য সাংবাদিকতা পেশা ছেড়ে ভাল বেতনের কোন চাকরি করার কথা ভাবছিল আলিফ, সেই মানুষটিকে রেখে তাকে বিদায় নিতে হবে, কখনও ভাবেনি সে।



ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে লাশের ময়না তদন্ত। খাটিয়া রাখা রয়েছে মর্গের সামনে। ডোম গোবিন্দ, যাকে বহুদিন ধরে চেনে আলিফ, বিশেষ করে মেডিকেল প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করার সময় তার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল গত দু তিন বছর আগে। বহুদিন পর আজ তার সাথে দেখা হলো লাশকাটা ঘরে লাশ হয়েই। ডোম গোবিন্দ এ শহরের অনেক সুপরিচিত, বিশিষ্টজনদের লাশ কেটেছে। তাদের কেউ খুন হয়েছেন, কেউবা দুর্ঘটনায় নিহত। সে যেই হোক না কেনো, লাশ কাটার আগে নিহতর পরিবার বা আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে মদের দাম আদায় করা তার একটা স্বভাব। একরকম জোর করেই নিয়ে নেয় দু বোতল বাংলা মদের দাম। তা না হলে সে কোন ভাবেই লাশে হাত দেবেনা। লাশ কাটা না হলে ময়নাতদন্তের কাজও শুরু করতে পারেন না ডাক্তাররা। আর তাই অধিকাংশ সময় এ ক্ষেত্রে পরিবারের লোকজন দেরি না করে দু পাচশো টাকা তাকে দিয়ে দেয়। কিন্তু আজ তার কোন ভাবেই মদ পান করতে ইচ্ছে করছেনা।



ময়নাতদন্ত শেষে দুপুর দু'টা নাগাত পরিবারের কাছে তার লাশ হস্তান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আছরবাদ নামাজের জানাযা শেষে মহল্লার কবরস্থানে সম্পন্ন হয় সাংবাদিক আলিফ আজমাইনের দাফন। তার মৃত্যুর পর টানা এক সপ্তাহ নানা কর্মসূচি পালন করে সাংবাদিক সমাজ। দু-চার জন চিন্হিত সন্ত্রাসীকে আটক করে পুলিশ আলিফ হত্যা মামলায় চালান দেয়। তাদের কাছ থেকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায়ের চেষ্টাও চলে। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ধামাচাপা পড়ে যায় আলোচিত এ হত্যা মামলা। মাঝের মধ্যে এটি নিয়ে দু একটি কাগজে ফলোআপ রিপোর্ট আসলেও প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতার বা হত্যার মোটিভ উদঘাটনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয় পুলিশ।



অবশ্য এ নিয়ে আলিফের কোন দু:খ নেই। সে নিজেও এতদিনে বের করতে পারেনি দু'জন মানুষকে, যারা সরাসরি ছিল কিলিং মিশনে। হতে পারে তারা পেশাদার খুনি। ঘটনার সময় তারা দুজনই ছিল হেলমেট পড়া। ব্রেকে পা রেখেই মটরসাইকেলের পিকাপ বাড়িয়ে রেখেছিল তাদের একজন। কিন্তু গত তিন বছরে তাদেরকে কোথাও খুজে পাওয়া গেলো না। না মৃত্যুর দেশে, না তার চেনা শহরে।



এভাবে কাটতে কাটতে থানায় ঢুকে একদিন থমকে যায় আলিফ। ডিউটিরত পুরিশ অফিসারের সাথে হাসি তামাশা করছে যে লোকটি, তাকেইতো এতদিন মনেমনে খুজে আসছিল সে। চোখের সামনে নিজের খুনি। উত্তেজনায় যেন তার গলা চেপে ধরতে চাইলো আলিফ। কিন্তু কিছুতেই কিছু করা গেলোনা।

আসলে দেখা ছাড়া, আর কিছুই করার থাকেনা একজন মৃত মানুষের।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে মার্চ, ২০১৩ দুপুর ২:৫০

বোকামন বলেছেন: সুন্দর লিখা .... ভালো লাগলো .....সত্তা !

২| ৩০ শে মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৪:১৬

শামীম সুজায়েত বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই বোকামন। আপনি আমার সব গল্পগুলো পড়েন এবং মন্তব্য করেন বলে ভাল লাগে। ভাল থেকেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.