নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুহৃদ আকবর

Do Well, Be Well

সুহৃদ আকবর › বিস্তারিত পোস্টঃ

নকশী বাটি

২১ শে অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১১:৫০

নানার বাড়ির সেই মাটির গুদাম ঘর। সেই কাঁঠাল বাগান। সেই পেঁয়ারা বাগান। সেই আনারস বাগান। সাপের মত আঁকাবাঁকা চিকন ছড়াতে (খালে) গোসল করা। পানির স্রোতের সাথে ভেসে ভেসে অনেক দূর চলে যাওয়া। ভেজা বালু নিয়ে একে অপরের দিকে ছুঁড়ে মারা। সেগুন গাছের কচি পাতায় হাত রাঙানো। দৌঁড়াদৌঁড়ি আর ঝাপাঝাপি। এরপর ঝগড়া, শেষে হয় মারামারি। ইস্! মনে হয় এইতো সেই দিনের কোনো ঘটনা। সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়। দ্রুত ফুরিয়ে গেছেও। ঘড়ির কাটার মত আমাদের জীবনটাও চলছে টিকটিক করে। সময়ের সাথে সাথে আমরাও একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি শেষ গন্তব্যের দিকে।
নানার বাড়িতে গেলে আমরা একমাস থাকতাম। যাবার আগে এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলত প্রস্তুতি। মা বাপের বাড়ির জন্য আমাদের ক্ষেতের-বেগুন, মরিচ, সবজি, আর ঝুনা নারিকেল জোগাড় করতেন। বাবা তাঁর শাশুড়ির জন্য বাজার থেকে পান কিনে আনতেন। আমার নানা ফেনী থেকে ফটিকছড়িতে গিয়ে বসত গেঁড়েছেন। বাসে করে ফেনী থেকে বারইয়ারহাট বাজার পার হলেই খুশিতে নেচে উঠত মন। ফটিকছড়ির উঁচু নিচু আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে বাসটি যখন এগিয়ে যেত তখন আমার খুশি যেন আর ধরে না। ফটিকছড়ির বালুটিলা বাজার হেঁয়াকোর সারিসারি রাবার বাগান দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে যেত। পথের ধারে অসংখ্য লিচু আর লেবু বাগান চোখে পড়ত। ছোট-বড় টিলা। সেই টিলায় আম, জাম, জারুল, জলপাই, সেগুন গাছের সারি। গাছের ডালে পাখিদের ডাকাডাকি। চিকন চিকন খাল। গাড়ির ভেতর থেকে দেখলে বুক দুরুদুরু করত; শরীর কেঁপে উঠত। মাঝে মাঝে দিগন্ত বিস্তৃত ধানখেতের দেখা পাওয়া যেত। যেখানে টিয়া পাখিরা দলবেঁধে আকাশে ওড়ে। তাল গাছের বাসায় বাবুই পাখিরা কিচির মিচির জুড়ে দিত। বাগানগুলোতে শ্রমিকরা কাজ করে।
দাতমারা বাজারের উত্তরদিকে আমার নানার বাড়ি। নানার বাড়ির পিছনে বিশাল চা বাগান। সেই বাগানের মাঝে একটা ঝরনা ছিল। আমার মামাতো বোন শিল্পী আপু সেই ঝরনা থেকে রোজ পানি আনতে যেত। আমি যেতাম আপুর সাথে। বাগানের ভেতর একটা পুরাতন ইটভাটা ছিল। সেই ইটভাটায় আমরা খালাতে-মামাতে ভাইয়েরা গোল্লাচুট, কানামাচি খেলতাম। ঘুড়ি ওড়িয়ে ইটভাটার মধ্যে বসে থাকতাম। লুকিয়ে লুকিয়ে ঘুড়ির ওড়াওড়ি দেখতাম। একবার হলো কি-আমাদের ঘুড়িটার রশি ছিঁড়ে গেল। আমরাও ঘুড়ির পিছু পিছু ছুটলাম। যেতে যেতে অনেক দূর চলে গেলাম। ঘুড়িটি কুঁড়িয়ে পেয়েছিল এক চাকমা ছেলে। ছেলেটিকে দেখে আমাদের খুব মায়া হল। আমরা ঘুড়িটি ছেলেটিকে দিয়ে দিলাম। ঘুড়িটি পেয়ে চাকমা ছেলেটি যেন আকাশের চাঁদটা হাতে পেল।
শ্যাওলা ধরা ইটের দেয়ালে ছোট বড় অনেক গর্ত ছিল। সে গর্তে পাখিরা বাসা বুনত। গর্তের ভেতর আমরা হাত ঢুকিয়ে দিতাম। হাত দিয়ে কোনো গর্তের ভেতর থেকে ডিম বের করে আনতাম। কোনো গর্তের ভেতর থেকে ফুটফুটে বাচ্চা বের করে আনতাম। একদিন সেই ইটভাটার খোলা জায়গাটার মধ্যে খেলা করছিলাম। এ সময় আমার বড় মামা সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন।
আমাদেরকে দেখে বললেন-‘হিয়ানে কিল্লায় গেছচ? হিয়ানে হাঁপ আছে। কাম্বাই দিবো। চলি আয় তোরা।’
মামার কথা শুনে আমরা সবাই দৌঁড়ে চলে এলাম। আর কোনোদিন সে ইটভাটায় যাইনি। তবে যতবার নানার বাড়িতে যেতাম সে ইটভাটাটিকে একবার চোখ মেলে দেখতাম। আজো সেই ইটভাটাটি আমার কিশোরবেলাকার স্মৃতির গুদাম হয়ে টিকে আছে।
সেবার নানার বাড়িতে গিয়ে ঘটলো অন্য রকম এক কান্ড। আমার বড় মামীর নকশী করা একটা বাটি ছিল। সে বাটি দেখে আমার খুউব পছন্দ হল। আমি সেই নকশী বাটির প্রেমে পড়ে গেলাম। গ্লাসে করে পানি খাওয়া বাদ দিয়ে সে বাটি করে আমি পানি খাওয়া শুরু করলাম। আসলে ছোটবেলার ইচ্ছে আর স্বপ্নগুলো বড়ই বিচিত্র ধরণের। সময়ের সাথে সাথে সবকিছুরই পরিবর্তন হয়; মানুষও পাল্টে যায়। মনে পড়ে সেবার যতদিন নানার বাড়িতে ছিলাম ততদিন সেই গোল বাটিতে করেই পানি খেয়েছি। এখনো যেন আমার চোখের সামনে সেই গোল বাটির ছবি ভাসছে। কী সুন্দর কারুকার্যময় নকশী আঁকা বাটি! বাটিটি যত দেখতাম তত ভাল লাগত। মা যতই বলেন আমি মার কথা শুনি না।
মা বলেন ‘বাটি করি হানি খরে কিল্লায়? গেলাসে করি খা। এই নে ধর, এই সুন্দর গেলাসটা তোর।’
কে শোনে কার কথা। আমি আছি আমার তালে। এ নিয়ে আমার মামাতো বোন অনেক হাসাহাসি করত। হাসাহাসি করলে আমার কি আসে যায়; আমি কিন্তু নাছোড় বান্দা। সেই বাটি আমার চাই চাই। সেই বাটি আমার লাগবেই। আমি যে সেই বাটির প্রেমে পড়ে গেছি। সেই বাটি করেই আমি পানি খাব। অন্য কোনো গ্লাস কিংবা মগ হলে হবে না। সেবার প্রায় বিশ দিনের মত নানার বাড়িতে ছিলাম। প্রতিদিনই আমি সেই বাটি করে পানি খেতাম। আগেই বলেছি বাটির ভেতরে এক ধরনের নকশী করা কাজ ছিল। সেই নকশী আমার মন কেড়েছে। পানি খাবার পর সেই বাটি অনেকক্ষণ আমার হাতে ধরে রাখতাম। আমার আদরের বাটিটি নেড়েচেড়ে দেখতাম। খুটিয়ে খুটিয়ে নকশী করা কাজ দেখতাম। চোখ বড় বড় করে দেখতাম। দেখতাম বাহ্ কী সুন্দর নকশী আঁকা কাজ! গাছপালা-লতাপাতা, ফুল-ফল আরো কত কি। যত দেখতাম তত আমার ভাল লাগত। আমি আনমনা হয়ে দেখতাম। উদাস হয়ে ভাবতাম, ইস্ এত সুন্দর একটা বাটি যদি আমার থাকত! ভাত খাওয়ার সময় মামী আমাকে সেই বাটি করে পানি দিতেন। বাটিতে করে পানি খেয়ে আমি তৃপ্ত হতাম। এক সময়ের সেই বিচিত্র শখটি আজ কেবলই স্মৃতি। কত কাল হল বাটি’টির আর খবর রাখিনা। আজ হঠাৎ মনে পড়ল সেই নকশী বাটির কথা।
বিশদিন থাকার পর মা যখন সব গোছাচ্ছিল তখন আমি কেবল সেই বাটির দিকে চেয়ে রইলাম। আমার বড় মামী সেটি লক্ষ্য করলেন। মামী এগিয়ে এসে বাটি’টি আমার থলের ভেতর দিয়ে দিলেন। বাটি পেয়ে আমিতো মহাখুশি! মামীর সেই সহৃদয়তা আমাকে মুগ্ধ করল। আজ ভাবি, আমার মামী কত্ত ভালো। যে আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছে। আরো ভাবি, কতইনা মজা হত! পৃথিবীর সকল মামী যদি আমার মামীর মত হতো।
আমার সেই সোনাঝরা স্মৃতি। সেই আমার সোনা বাটি। সেই মাটির ঘর। সেই পেঁয়ারা গাছ। পেঁয়ারা গাছে কাঠ বেড়ালির দৌঁড়াদৌঁড়ি। মামীর সেই আদর। আপুর সেই স্নেহ। মামাতো ভাইয়ের সাথে সেই দুষ্টুমির স্মৃতি। খালাতে ভাইয়ের সাথে ঘোরাঘুরি। এসব ভুলি কেমনে! মা, মামা-মামী সবাই আছেন তবে আমার সেই স্বপ্নের বাটি’টি আর নেই। চোখ বন্ধ করলেই আমি দেখতে পাই আমার মামীর মুখ, আপুর হাসি, মামার ছবি আর সেই প্রিয় ‘নকশী বাটি’।

লেখক:
গল্পকার ও সংবাদকর্মী
০১৭৬৬১০৭০৮৮

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.