নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুহৃদ আকবর

Do Well, Be Well

সুহৃদ আকবর › বিস্তারিত পোস্টঃ

আসছে বইমেলা, বসছে বইয়ের হাট

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:১৩

দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেল। পুরাতনকে বিদায় আর নতুনকে বরণ এই নিয়েইতো মানুষের জীবন। দিন, সপ্তাহ, মাস এরপর আসে বছর। সময়কে কেন্দ্র করে সব কিছুর সৃষ্টি। কালের গর্বে বিলীন হয় এক একটি বছর। এভাবে আবর্তিত হয় ঋতুচক্রের হিসাব। মানুষ সারা বছর অপেক্ষায় থাকে কখন আসবে বইমেলা। তাইতো সময়ের হাত ধরে চলে আসে বইমেলা। এক সময় শেষ হয় অপেক্ষার পালা। নতুন বই নিয়ে আমাদের দরজায় এসে কড়া নাড়ে বইমেলা। ডিসেম্বর শেষ হতেই শুরু হয় বইমেলার তোড়জোড়। জানুয়ারী মাস এলেই নতুন বইয়ের গন্ধ নাকে আসতে শুরু করে। তারও আগে প্রকাশক আর লেখকরা ব্যস্ত হয়ে লেগে পড়ে যায় বই ছাপার কাজে। বাংলা বাজারসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রেসে পড়ে যায় বই ছাপার ধুম। এসবই হল একুশের গ্রন্থমেলার প্রস্তুতি।
একুশ আমার প্রাণের, একুশ আমার আবেগের, একুশ আমার ভাললাগার, একুশ আমার ভালবাসার। আমাদের মুখে হাসি ফুটায় অমর একুশের বইমেলা। নজরকাড়া কারুকার্যময় বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে আমাদের হৃদয় দোলে উঠে। মন নেচে উঠে। বইকে নিয়েই আবর্তিত হয় বইপ্রেমী মানুষের জীবন। রসনা প্রিয় মানুষ যে রকম মাছ, ভাত, ডাল, মাংসের স্বাদ পেয়ে পরিতৃপ্ত হয় তেমনি বইপ্রেমী মানুষও নতুন নতুন বই পাঠ করে জ্ঞান লাভ করে। নতুন বই পাঠ করতে না পারলে তাদের কাছে ভাল লাগে না। মন পরিতৃপ্ত হয় না, দিলে শান্তি আসে না। তাই তাদের চাই নতুন নতুন বই।
বই মানুষের মনের খোরাক জোগায়; বিবেকের অন্ধকার ঘুচিয়ে হৃদয়ে আলোর চেরাগ জ্বালায়। বইকে সঙ্গী করতে পারলে মানুষের মনে কোনো দুঃখ থাকে না। সবকিছু প্রতারণা করলেও বই কখনো মানুষের সাথে প্রতারণা করে না। বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়াম বলেছেন -‘প্রিয়ার মায়াবী চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে রুটি ও মদ ফুরিয়ে যাবে কিন্তু বই হল অনন্ত যৌবনা।’
বাংলা একাডেমিতে এখন চলছে পুরোদমে বইমেলার প্রস্তুতি। একাডেমীর দক্ষিণ পাশে ব্যবস্থা করা হয়েছে আলোচনা সভা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এ মঞ্চে প্রতিদিন বিকালে শুরু হবে আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর অথবা কোনো সাহিত্যিক ব্যাক্তিত্বের উপর প্রবন্ধ পাঠ করা হবে। প্রবন্ধটি পাঠ করবেন দেশের প্রবীণ কোনো শিক্ষাবিদ অথবা সাহিত্যিক। এরপর সেই প্রবন্ধকে কেন্দ্র করে শুরু হবে আলোচনা-সমালোচনা। সমালোচনা করবেন দেশের বড় বড় কবি সাহিত্যিক আর বুদ্ধিজীবীরা। সন্ধ্যায় শুরু হবে জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতিদিন একেকজন জনপ্রিয় শিল্পী গান পরিবেশন করবেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত, আধুনিক গান, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, মুর্শীদি, ভাটিয়ালি গানে মুখরিত হবে মঞ্চটি। পুরো একমাস চলবে এই বইমেলা।
ফেব্রুয়ারি মাস এলে বাংলা একাডেমী পরিণত হয় উৎসবের আঙ্গিণায়। বাংলা একাডেমী তখন আর আগের রূপে থাকে না। তখন নতুন বইয়ের গন্ধ আর একাডেমী প্রাঙ্গণের গোলাপ, গাঁদা মিশে একাকার হয়ে যায়। নতুন বইয়ের মৌ মৌ গন্ধে আমোদিত হয় চারদিক। সকল শ্রেণীর সকল পেশার মানুষ বইমেলাতে আসে। মেলায় এসে হাজির হন বরণ্যে কবি সাহিত্যিক, শিল্পী, কলা-কুশলীরা। লাঠিতে ভর দিয়ে আসে বয়স্ক মানুষ। মায়ের হাত ধরে আসে কোমলমোতি শিশুরা। সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় এই বইমেলা। মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয় মেলা প্রাঙ্গণ।
একমাস আগ থেকে চলছে বইমেলার প্রস্তুতি। সেদিন বিকেলবেলা প্রস্তুতি পর্ব দেখতে গিয়েছিলাম। একাডেমি প্রাঙ্গনে ঢুকেই চক্ষু ছানাবড়া। বাংলা একাডেমী আর আগের মত নেই। চারিদিকে শুধু কাঠ, বাঁশ আর কাপড়ের স্তুপ। নানা বয়সী শ্রমিক স্টল তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করছে। কাঠমিস্ত্রিদের হাতুড়ির আঘাতে কেঁপে কেঁপে উঠছে একাডেমীর মরচেপড়া দালানগুলো। পেরেকের ঠুকঠাক শব্দ কানে এসে বাজছে। নাকে এসে লাগছে ছেরাই করা কাঁচা-পাকা কাঠের মিষ্টি গন্ধ। অধিকাংশ প্রকাশককেই মিস্ত্রিদেরকে পরামর্শ দিতে দেখা গেছে। কিছু সাংবাদিক ভাইকে দেখলাম নিউজ কাভার করতে। ইলেকট্রিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা ভিডিও ধারণ করতে এসেছে। টোকাই ছেলে-মেয়েদেরকে দেখলাম এটা ওটা সংগ্রহ করছে। প্রবেশ পথে লাগানে হয়েছে নতুন নতুন ফুলের গাছ। বাগানে এসে মধু পান করছে মৌমাছি। উড়ছে নানান রঙের প্রজাপতি। বটগাছের ডালে কাক ডাকছে। নজরুল মঞ্চকে সাজানো হচ্ছে নতুন সাজে। এই মঞ্চে আসবেন দেশের বড় বড় কবি সাহিত্যিকরা।
এই পৃথিবীর শুরু থেকেই বইয়ের আবির্ভাব চলে আসছে। তবে এখনকার মত তখন এত উন্নত মলাট আর প্রচ্ছদ ছিল না। তখনকার দিনে তালপাতা, হাড়, চামড়ার উপর বই লিখা হত। আল কুরআন আবর্তীণ হবার সময় তা কখনো গাছের পাতায় কিংবা হাড়ে অথবা পশুর চামড়ায় লিপিবদ্ধ করে রাখা হত। এর দ্বারা প্রামাণ হয় যে বইয়ের ইতিহাস হাজার বছরেরও বেশি।
বইমেলাকে ঘিরে অনেক মানুষেরই ভাগ্য বদল হয়। এই একটি মাত্র বইমেলার জন্য সারা বছর মুখিয়ে থাকে লেখক আর প্রকাশকবৃন্দ। বই পাগল মানুষরা ছুটে আসে বইমেলায়। বইপ্রেমীরা অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে বইমেলার জন্য। কখন আসবে ফেব্রুয়ারি মাস। কখন বসবে বইমেলা। সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এক সময় ফেব্রুয়ারি মাস এসে তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটায়। তখন ঘরের ভেতর বসে থাকা দায়; মন শুধু ছুটে যেতে চায় প্রাণের বইমেলায়।
এইতো শুরু হতে যাচ্ছে আমাদের প্রাণের বইমেলা। বইমেলার সাথে জড়িয়ে রয়েছে অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য। ফেব্রুয়ারি এলে আমাদের মনে পড়ে ভাষা আন্দোলনের কথা। শহীদ রফিক, সালাম, জব্বার, শফিউরের রক্তেভেজা শার্ট ভেসে উঠে চোখের সামনে। বুক কেঁপে উঠে পাকিস্তানি পুলিশের গুলির শব্দে। হৃদয়ে শুরু হয় রক্তক্ষরণ। রক্ত দিয়ে কিনেছি আমরা ভাষার অধিকার। এক সাগর রক্তের বিণিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লিখেছেন অমর কবিতা। ‘মাগো, ওরা বলে সবার কথা কেড়ে নেবে তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না, বলো, মা তাই কি হয়?’। কবিতাটি ভাষা আন্দোলনের অন্যতম এক স্মারক। বীর শহীদদের রক্তের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে আজকের এই বাংলাদেশ। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে এই দেশকে নিয়ে দুই শোষকের দলই ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছে। খাবলে খাচ্ছে দেশের শরীর। বিদেশি শকুনের কুদৃষ্টিতে পড়েছে প্রিয় প্রিয় দেশের উপর। এদেশে প্রতিদিন কারো না কারো প্রাণ যাচ্ছে। কোনো না কোনো মায়ের বুক খালি হচ্ছে। তই দেশ সময় এসেছে দেশ রক্ষার আন্দোলনে অংশ নেবার। এখনো প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি এদেশে। শহীদদের উত্তরসুরীর এদেশে, বার আউলিয়ার এদেশে, মুক্তিযোদ্ধাদের এদেশে কোনো দেশদ্রোহীর জায়গা হবে না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষিত তরুণ যুব সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে।
বইমেলা আমাদের প্রাণের, আমাদের আবেগের। বইমেলা এলে মন খুশিতে নেচে উঠে, বুকে জাগে শিহরণ। আনন্দে বাগ বাগ হয়ে যায় আমাদের মুখ। বাংলাদেশের মানুষ বইকে কত যে বেশি ভালবাসে বইমেলা এলে তা দেখা যায়। লম্বা লাইন ধরে বইমেলায় ঢুকে। বইমেলা এখন আর নিছক সাধারণ কোনো মেলা নয়। এটি এখন পরিণত হয়েছে র্সাবজনীন মেলায়। বইমেলা বাংলার অপরিহার্য এক সাংস্কৃতিক অংশ। যারা বই পড়েনা তারাও বইমেলায় এসে ঘুরে যায়। দুই একটি বইও কিনে নিয়ে যায়। প্রিয় মানুষের হাতে তুলে দেয় নতুন বই। নতুন বইয়ের নজরকাড়া প্রচ্ছদ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যে বইয়ের মলাট একটু সুন্দর সে বইটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে অনেকে। বইয়ের গন্ধ শুঁকে।
বইমেলার সাথে জড়িয়ে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। চিত্তরঞ্জনসাহার স্মৃতি বিজড়িত বইমেলা। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর স্বপ্নের বইমেলা। ভাষা আন্দোলন আর স্বাধীনতা যুদ্ধ একই সুতোয় গাঁথা। বইকে শুধু ভালবাসলেই হবে না পড়তেও হবে। বুক সেলফে সাজিয়ে রাখার ভেতর বইয়ের কোনোই সফলতা নেই। কেননা বই মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তোলে, আতœাকে উন্নত করে, মনুষ্যত্বকে বিকশিত করে, ব্যাক্তিত্বকে দৃঢ় করে, অজ্ঞতাকে দূরীভূত করে, চলার পথকে সুগম করে। আগামীর পথে চলার দিক নির্দেশনা দেয় বই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বই পড়ার লোক দিন দিন কমে যাচ্ছে। স্বার্থবাদী আর ভোগবাদী এই পৃথিবীতে বই পড়ার মত লোকের আজ বড়ই অভাব।
ছোটবেলায় আমাদের মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মহোদয় একটি প্রবাদ বাক্য প্রায়ই বলতেন। তা হল-‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’। প্রিন্সিপাল সাহেবের নাম ছিল মুহাম্মাদ ইসমাঈল। তাঁর ব্যাক্তিগত সংগ্রহে অনেক বই ছিল। উনার লাইব্রেরীতে গিয়ে প্রথম ‘ভারত বিচিত্রা’র পরিচিত হই। এ ছাড়া সে লাইব্রেরীতে কুরআন, বাইবেল, ত্রিপিটক, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই থেকে শুরু করে সাহিত্য, সংস্কৃতি আর রাজনীর অসংখ্য বই ছিল। ইসমাঈল সাহেব ছিলেন জ্ঞানের এক বড় সমঝদার। প্রিন্সিপাল সাহেবের মত জ্ঞানের এরকম তৃষ্ণা কয়জন মানুষেরইবা আছে।
বইমেলায় প্রতি বছর হাজার হাজার বই প্রকাশিত হয়। এদের মধ্যে প্রবীন লেখক যেমন আছে তেমন নবীন অনেক লেখকের বইও প্রকাশিত হয়। অভিষেক হয় অনেক নতুন লেখকের। তখন সে বইমেলাটি ঐ লেখকের জন্য স্বরণীয় হয়ে যায়। সে বইমেলাটি তার হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। বইমেলা মানে নতুন লেখা, বইয়ের গন্ধ আর বইপ্রেমীদের পদযাত্রায় মুখরিত মেলা প্রাঙ্গণ।
বইমেলা অন্যান্য মেলার মত হলেও গুরুত্ব আর তাৎপর্যের দিক দিয়ে এর মর্যাদা আলাদা ধরণের। দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় অনেক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। যেমন ডিসেম্বর মাসে চট্টগ্রামে বিজয়মেলা। জানুয়ারি মাসে ঢাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা। সেসব মেলা গুলোতে মানুষের ব্যাক্তিগত ব্যবহার্য জিনিজপত্র বিক্রি করা হয়। সেসব মেলাও মানুষ দলবেঁধে মেলাতে যায়, কেনাকাটা করে। আনন্দ ফূর্তি করে। তবে বইমেলার আনন্দ আর বাণিজ্যমেলার আনন্দ এক নয়। কিংবা বিজয়মেলার মত নয়। কেননা একুশের বইমেলায় মানুষের মনের খোরাক বিক্রি করা হয়। একমাত্র বই কিনে আর পড়ে কাউকে পস্তাতে হয় না। তাই বই হোক আমাদের নিত্যসঙ্গী। বইমেলা হল বইপ্রেমী মানুষের আবেগ অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু। ভালবাসার ধন, চোখের মণি। বই পড়ে কাটুক আমাদের অবসর। তাইতো মন রাঙাতে এলো বইমেলা।

লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মোবাইল-০১৭৬৬১০৭০৮৮

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.