নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুহৃদ আকবর

Do Well, Be Well

সুহৃদ আকবর › বিস্তারিত পোস্টঃ

হাটুরে ও কালো বিড়াল

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:২৬

আমার বাবা ছিলেন একজন কৃষক। সহজ, সরল প্রকৃতির মানুষ। বাবার মতো এমন ভালো লোক আমি এ জীবনে আর দেখিনি। আমার বাবা হলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। যাকে গ্রামীণ সমাজের সার্থক প্রতিনিধি বলা যেতে পারে। বাবা হলেন সোনার মানুষ। মাটি থেকে তিনি সোনা ফলাতেন। আমাদের এক চিলতে জমি ছিল। সে জমিতে বাবা ফসল বুনতেন। জমিটি ছিল আমাদের বাড়ির দণি দিকে। বাবা সেখানে মরিচ, বেগুন, মূলা, টমেটো সহ নানান ফসলের চাষাবাদ করতেন। সে ফসল বিক্রি করে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। সন্তানদের পড়ালেখার খরচ জোগাতেন। স্ত্রীর জন্য শাড়ি কিনতেন। প্রায় প্রতিদিনই বাবা বাজারে যেতেন। গভীর রাতে বাবা বাড়ি ফিরতেন। আসার সময় চাল, ডাল কিনে আনতেন। চাল আনলে মা ভাত রান্না করতেন। আমরা ভাইবোনেরা পাটিপাতার বিছানার উপর গোল হয়ে বসতাম। বাড়ির সবাই তখন ঘুমিয়ে পড়ত। আমরা জেগে থাকতাম ভাত খাওয়ার জন্য। রাতে ভাত না খেলে আমার ঘুম আসে না। তাই কষ্ট করে হলেও আমি জেগে থাকতাম। ভাইয়া ঘুমিয়ে পড়লে তাকে আর উঠানো যেত না। আমরা ছিলাম সাত ভাইবোন। এত বড় পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতে বাবাকে অনেক কষ্ট করতে হতো। রাঢ়ের দিনগুলিতে বাবা খুব ভালো রকম হিমশিম খেতেন। তখন আমাদের ঘরের চাল ফুরিয়ে যেত। তবে এ নিয়ে বাবাকে কখনো মন খারাপ করতে দেখিনি। তাঁর একটা স্বভাব ছিল তিনি কারো কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন না।

বাবা ছিলেন ভালোবাসার খনি। খাটি সোনার মত ছিল বাবার হৃদয়। বাজারে যাওয়ার সময় বাবা আমাকে বলতেন
- বাবা তোমার জন্য কি আনমু?
- এক টাকার খাছতা বিস্কুট আনিয়েন- আমি বলতাম
তখন এক টাকা দিয়ে পাঁচটা খাছতা বিস্কুট পাওয়া যেত। খেতে ভারি মজা। নোনতা আর দুধে মিশানো মিঠা মিঠা স্বাদ। একটা সাদা কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হত সে বিস্কুট। কাগজের ভেতর বিস্কুটের গন্ধ আর স্বাদ লেগে থাকত। আমি যখন বিস্কুট খেতাম তখন আমারদের পোষা কুকুরটি আমার পাশে এসে বসত। মৃদু স্বরে কু কু করত আর লেজ নাড়াত। বিস্কুট খেয়ে খালি কাগজটি উঠানের দিকে ছুঁড়ে মারতেই কুকুরটি খপাস করে মুখে তুলে নিত। অনেক সময় কুকুরদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেধে যেত। কে আগে কাগজটি নিতে পারে। বাবার এত অভাব তবুও কাউকে তা বুঝতে দিতেন না। প্রতিদিনই বাবা কোনো না কোনো বাজারে যেতেন। আজকে তাকিয়া বাজার তো কালকে কুঠিরহাট। পরশু কাজির হাটতো এর পরের দিন চৌধুরী হাঁট। কোনো বাজারই বাবা বাদ দিতেন না। এক বাজারে এক জিনিসের কদর বেশি থাকত। আমার বাবার প্রায় সব ফসলেরই চাষ করতেন। মরিচ, মূলা থেকে শুরু করে সব ধরণের সবজি। আমাদের বাড়ির সামনে ছিল নিচু একটা জমি। প্রায় বারো মাসই সে জমিতে পানি থাকত। বাবা সে জমিতে ঠোয়াস চাষ করতেন। কাজিরহাটে ঠোয়াসের চাহিদা বেশি থাকত। মরিচ বেশি বিক্রি হত কুঠিরহাটে। তাকিয়া বাজারে শাক-সবজির বেশি কদর ছিল। প্রায় দিন বাবা বাড়ি ফিরতে দেরি করতেন। বাজারে যাওয়ার সময় একটা হারিকেন নিয়ে যেতেন। বাবার কোনো টর্চ লাইট ছিল না। লাইট না থাকার দরুণ বাবার ভেতর কোনো দুঃখবোধ ছিল না। হারিকেন ব্যবহার করতেই তিনি স্বাচ্ছন্নবোধ করতেন। হারিকেনের টিপটিপ আলোতে বাবা পথ চলতেন। রাতে আমরা ভাইবোনেরা পড়ালেখা শেষ করে বাবার জন্য অপো করতাম। কখন বাবা বাজার থেকে বাড়িতে আসেন তার জন্য। কুড়েঘরের জানালা দিয়ে আমরা বাবাকে দেখতাম। দূরে কোনো হারিকেনের আলো জ্বলতে দেখলে বুঝে নিতাম আমার বাবা আসছেন।

আজ বাবা বাড়ি ফিরতে দেরি করছেন। বাবা দেরিতে বাড়ি ফিরেন একথা ঠিক তবে আজকের মত এত দেরি কখনো করেননি। কেন দেরি করছেন তিনিই ভালো জানেন। এখনকার মতো তখনতো আর মোবাইলের যুগ ছিল না যে, কল করে বাবার খবর নিব। রাত এগারটা বেজে গেল বাবার দেখা নাই। বারটা বেজে গেল তবুও বাবার কোনো খবর নাই। বাবার হারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে না। রাস্তায় শুধু টর্চের আলো চোখে পড়ছে। কয়েকটি কুপির আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে পুবের চরে। রাতে যারা মাছ ধরতে বের হয়েছে ওগুলো তারা জ্বালিয়েছে। আমার বাবাকে কোনোদিন মাছ ধরতে দেখিনি। গাছ বলতে শুধুমাত্র তিনি খেজুর গাছে উঠতেন। শীতকালে অনেক বড় বড় খেজুর গাছে তিনি উঠে যেতেন। আমরা বাড়ির ছোটছোট ছেলেরা তখন উপরের দিকে তাকিয়ে দেখতাম। বাতাসের সাথে খেজুর গাছে মাথাটি দুলতে থাকত। বাবার জন্য তখন আমার বুকটা ধক করে উঠত। বাবা ছিলেন নিখাদ কৃষক। নম্র, ভদ্র একজন মানুষ। কখনো বাবার মুখে গালি শুনিনি।

আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। মা এখনো জেগে আছেন। মেজো বোনটি বারবার জিজ্ঞাস করছেন বাবার কথা। আমার বুকটা দুরুদুরু করছে। না জানি বাবার কোনো বিপদ হলো কিনা। কিছুদিন আগে মেজো আপুর মুখে শেখর চাচার খুনের কাহিনী শুনেছিলাম। আমি মনে মনে ভয় পেয়ে গেলাম। না জানি বাবার কোনো বিপদ হলো কিনা। বাবার কিছু হলে আমাদের কি হবে! না আমার বাবার কোনো শত্র“ নেই। এ রকম মানুষের কোনো শত্র“ থাকতে পারে না। অনেক দূরে একটা ীণ আলো দেখা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আলোটি স্পষ্ট হতে লাগল। হারিকেনের মৃদু আলোয় বাবার ছেকের লুঙ্গিটি দেখা যাচ্ছে। বাবার আগে দুইজন লোক হাঁটছে। বাবা তাদের পিছু পিছু হাঁটছেন। তারা দুইজন পরস্পর কথা বলছে। বাবা একাই হাঁটছেন। তারা বাবার সাথে কোনো কথা বলছে না। বাবার সাথে কথা বলার কোনো মানুষ নাই। ইস! আমি গিয়ে যদি বাবার সাথে কথা বলতে পারতাম। লোকগুলো কেন যে বাবার সাথে কথা বলছে না তা বুঝতে পারছি না। তাদের পরণে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী। আমি মেজো আপু সহ বাবাকে এগিয়ে নিতে বাড়ির দরজায় গেলাম। দেখলাম, বাবা বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন। বাবার সামনে হাঁটা লোক দুইটি মসজিদের দিকে চলে যাচ্ছে। মুহূর্তেই লোকগুলোকে আমি আর দেখতে পেলাম না। আমার আপু ঘটনাটি প্রত্য করলেন। আমি আর আপু একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। আমাদের গা চমচম করে উঠল। আমরা কিছুটা ভয় পেলাম বলা যায়।

বাড়িতে এসে বাবা আমাদেরকে আসল ঘটনাটি খুলে বললেন। বাবা বললেন, আমি যখন স্কুলের ওখানে আসলাম দেখলাম আমার সামনে দিয়ে একটা কালো বিড়াল দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সামনে দিয়ে বিড়ালটি কিছুদূর গেল। কখনো আমি ভয় পাইনা। কালো বিড়ালটি দেখে আমার গা চমকে উঠল। আজ কেন জানি আমার ভয় ভয় লাগছিল। আমি মনে মনে আল্লাহর নাম স্বরণ করলাম। কিছুদূর গিয়ে দেখি সামনের রাস্তা থেকে দুইজন মানুষ আমার রাস্তার দিকে এগিয়ে আসছেন। এতে আমি কিছুটা স্বস্তি পেলাম। লোক দুইটি কথা বলতে বলতে আমার সামনে দিয়ে হাঁটতে লাগল। তাদের জামা থেকে এক ধরণের খুশবু বের হতে লাগল। এ ধরণের খশবু আর কখনো পাইনি। এক সময় আমার ভয় কেটে গেল। দরজার সামনে এসে তোমাদের হারিকেনের আলো দেখার পর লোক দুইটি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:২৭

কল্লোল পথিক বলেছেন: চমৎকার গল্প।

২| ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৮

সুমন কর বলেছেন: এটি কি গল্প নাকি সত্য ঘটনা !!! ভালো লেগেছে।

+।

৩| ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:০৯

অগ্নি সারথি বলেছেন: হুম! বেশ সুন্দর করে লিখেছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.