নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাদাসিদে মানুষ

যে ঘুড়ি উড়তে জানে না........

নীল কথন

হারিয়ে যাওয়া চশমার খোঁজে হাঁটছি........

নীল কথন › বিস্তারিত পোস্টঃ

অন্তহীন অপেক্ষা

২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৩

গোমড়া মুখেই শহরটায় ঢুকে তুর্য। রাজধানীতে বড় হওয়া তুর্য, এখানটায় এসে হতাশায় ডুবছে। শহরটা এতোটাই ছোট, সাইকেল যোগে আধা ঘন্টায় এপাশ-ওপাশ ঘুরে দেখা যায়। তুর্যের বিশ্ববিদ্যালয়টা শহরের অদূরেই। প্রথম বর্ষে হলে ওঠা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায়, ঠাঁই হয় শহরটার এক কোণায়। দূরসম্পর্কের এক ভাইয়ের কল্যাণেই ঠাঁই মেলে। বাসাটা মনের মতো না হওয়ায় নতুন বাসা খুঁজছে তুর্য। বাসাটার গলি পেরোলেই মোড়। মোড়টায় খুচরো কিছু দোকান ছড়ানো ছিটানো। একমাত্র ওষুধের দোকান ঘরটায় নিয়মিত বসে তুর্য। বিভিন্ন পত্রিকা পড়ার টানেই এখানটায় বসে। আর দোকানের ছেলেটাও ওর সমবয়সী। টুকটাক আড্ডাও জমে। নাম রাসেল। দোকান বরাবর বেশ বড়সড় জায়গা নিয়ে চারিদিকে দেয়াল তুলে একটা বাসা, প্রবেশদ্বারের দেয়ালটায় এপিটাফে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা ‘ছবিঘর’। বাসাটার প্রবেশদ্বারে টু-লেট ফলক ঝুলছে। আগ্রহভরে রাসেলকে জিজ্ঞেস করতেই জানালো, ‘বাসাটায় ভাগ্যগুণে ঠাই মেলে। প্রয়োজনে বাসা খালি থাকবে, তবুও ভাড়াটিয়া পছন্দ না হলে বাড়িওয়ালী স্বচ্ছন্দে না বলেন। এর আগে দুটো মেয়ে থাকত। পড়াশুনার পাঠ চুকে যাওয়ায় চলে গেছে।’

-‘বাড়িওয়ালী! বাসাটা কার?’

-‘আমার ম্যাডামের, জাঁদরেল ম্যাডাম। আমাদের জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। এখন অবসরে আছেন। তবে জানেন! ওনার নামে অনেক কথা শোনা যায়।’

-‘কি কথা!’

-‘যুদ্ধের সময় তাঁর পরিবারের সবাইকে এই বাড়িতেই গুলি করে মারা হয়েছিল। তারপর নাকি ওনাকে পাকিস্তানি ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কিভাবে যেন মুক্তি পায়। এরপর আর বিয়ে করেননি। দু-চারটে কাজের মানুষ ছাড়া বলতে গেলে সম্পূর্ণ একা মানুষ। তবে তুর্য ভাই, সম্পত্তির লোভেই লোকে নানান কথা রটিয়েছে। পাড়ার মানুষগুলো বদের হাড্ডি। একই পাড়ায় থাকায় উনাকে আমি সেই ছোট্ট থেকে চিনি। আমার দোকানে প্রায়ই আসেন।’

-‘উনি দোকানে আসলে বলো, আমি বাসাটা দেখতে চাচ্ছি।’



তুর্যের বর্তমান বাড়িওয়ালা সেটেলম্যান্ট অফিসে চাকুরিরত। ভদ্রলোক পুকুরচুরিতে বেশ ওস্তাদ, অল্প কয়েক বছরেই পাঁচতলা বাড়ি দাঁড় করিয়ে ফেলছেন। এলাকায়ও বেশ দাপুটে। নানাবিধ কু-কর্মে যাদের নাম ভারি, তাকে সালাম না দিয়ে কখনই পথ পেরোয় না। ভদ্রলোকের সাথে দু-একবার কথা হয়েছে তুর্যের। বাসার সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতেই তার সাথে দেখা। কুশলাদি সেরে জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় উঠতে চাও?’

-‘এখনও বাসা ঠিক হয়নি, দু-একটা বাসা দেখা হয়েছে। মোড়ে একটা বাসার সামনে টু-লেট ঝোলানো দেখলাম। আজকালের মাঝেই খোঁজ নিবো ভাবছি।’

- ‘ও, টিচার মহিলার বাসা। ওঠার আগে ভেবে দেখো।

তার কণ্ঠস্বরে, ভদ্রমহিলার প্রতি তার বিরক্তি গোপন থাকে না।

‘মহিলাটি ভালো না, বুঝলে! যুদ্ধের সময় ফষ্টি-নষ্টি। কত কিছু শোনা যায় । তুমিতো এখানে নতুন।’ মুখ বাঁকাতে বাঁকাতে বলেন তিনি।

ভদ্রলোককে বাজিয়ে দেখার উদ্দেশ্যে তুর্য সাথে সাথে বলল, ‘ভদ্রমহিলা কি অনেক টাকা পয়সার মালিক?

-‘হ্যাঁ, তার বাবা স্থানীয় কলেজের টিচার ছিলেন, পৈতৃক সম্পত্তি বেশ পেয়েছিলেন। ও মহিলা যুদ্ধের পর কয়েক বছর নিরুদ্দেশ ছিলেন, এরপর গার্লস স্কুলের টিচার হয়ে ফিরে এসেছেন। বাড়ি, জমি সব বুঝে নিয়েছেন। তার জমির পাশেই আমার কিছু জমি রয়েছে। কত বললাম বিক্রি করতে। করলই না। সব নাকি এতিম বাচ্চাদের লিখে দিয়েছেন। দানশীল হাতেম তাই সাজছেন।’ তার কথায় ভদ্রমহিলার প্রতি স্পষ্টতই ব্যঙ্গতা প্রকাশ পায়।

রাসেলের কথার সাথে ভদ্রলোকের অমিল পেলো না তুর্য। স্মিত হাসি হেসে বিদায় নিল তুর্য।



পড়ন্ত বিকেল। চা খেয়ে তুর্য রাসেলের দোকানে এসে বসে। উদ্দেশ্য পত্রিকার ফাঁকে ফাঁকে ওর সাথে গল্প করা। তুর্যকে দোকানটা দেখতে বলে বাসায় গেছে রাসেল। ‘এই ছেলে! রাসেল কোথায়?’

মুখ তুলে তাকাতেই দেখে, এক ফর্সা ভদ্রমহিলা। ‘ও বাসায় গেছে, কী লাগবে আপনি আমাকে বলুন!’

ভদ্রমহিলার হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধগুলো খুঁজতে থাকে তুর্য। আর আড় চোখে ভদ্রমহিলাকে দেখছে। ষাট ঊর্ধ্ব হবে। হালকা পাতলা গড়নের ভদ্রমহিলার গায়ে কলাপাতা রঙের শাড়ি, মাথা থেকে ঘোমটা বারে বারে খসে পড়ায় উনি সেটা টেনে দিচ্ছেন একটু পর পর। উনি কী সেই ভদ্রমহিলা! সংকোচ ঝেড়ে ফেলে এক রকম সাহস নিয়েই তুর্য ওষুধ হাতে নিয়ে প্রেসক্রিপশনের সাথে মেলাতে মেলাতে বলল, ‘আপনি কী সামনের বাসাটায় থাকেন?’ ভদ্রমহিলা ভারি কন্ঠে বললেন- ‘হ্যাঁ, এখানেই।’

-‘বাসাটায় গেইটে টু-লেট টাঙানো। দেখা যাবে বাসাটা?’

-‘কার জন্য?’

-‘আমি উঠতে চাচ্ছি, এখানটায় মাস দুয়েক হল আসলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ঠিক মনের মতো বাসা খুঁজে পাচ্ছি না।’

তুর্যের চেহারার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বললেন, ‘ও, গতকাল তবে রাসেল তোমার কথাই বলেছিল। কাল আমি বাসায় আছি, বিকেলে এসো।’

ভদ্রমহিলা ওষুধের দাম চুকিয়ে বিদায় নিলেন।



পরদিন বিকেলে ভদ্রমহিলার বাসায় আসে তুর্য। ড্রয়িংরুমে পা দিয়েই কিছুটা অবাক হয় তুর্য। সোফা, টেবিল, পাশে দাঁড়ানো আলমারি বেশ পুরোনো। সবকিছু সময়ের আবরণে কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু কারুকার্য চোখে পড়ার মতো। দেয়ালটাও বিবর্ণ, তার গায়ে বাঁধাই করা বেশ পুরোনো কিছু ছবি ঝুলছে। ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তুর্য। সবগুলোই যেন নিপুণ তুলির আঁচড়ে আঁকা। ‘মুখ, প্রকৃতির রঙ, জলপিপি, চাঁদের বুড়ি, জীবনযাত্রা, বহ্নিরেখা ’ শিরোনামে ছবিগুলো আঁকা। ছবির মাঝে অস্পষ্টভাবে তারিখ দেয়া।

-‘সবগুলো আব্বার আঁকা’

কন্ঠ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তুর্য বলল, ‘ভারি নিপুণ হাতের কাজ।’

চুপচাপ ভদ্রমহিলা। বা’পাশের রুম হতে নিয়ে আসা চাবির রিংয়ের মাঝ থেকে, একটা চাবি আঙুলে চেপে ডান দিকটায় বন্ধ রুমটার তালা খুললেন। দরজা মেলতেই ড্রয়িংরুমের বাতির আলো পেয়ে ঘরটা যেন অন্ধকারের গ্লানি থেকে মুক্তি পেলো, এমন মনে হয় তুর্যের। ঘরটা হল রুমের মত লম্বালম্বি। ভদ্রমহিলা সুইচ চাপতেই একটা ঝাড়বাতি জ্বলে উঠল। এক পলক চারিদিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে তুর্য। দু’পাশের লম্বালম্বি দেয়ালটায় ছবির সমারোহ। সবগুলোই হাতে আঁকা। ভালো করে খেয়াল করে দেখল, সব ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ঘটে যাওয়া নানান দৃশ্যপট। আর একপাশের দেয়ালটায় শুধুই যুদ্ধের ভেতর নারীর প্রতিচ্ছায়া। ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে তুর্যের চোখের কোণে জল জমে উঠলো।

‘এখানের সব ছবিই আমার আঁকা। আব্বার কাছেই আমার আঁকিবুঁকির হাতে খড়ি। যুদ্ধের পরে বিভিন্ন সময়ে এই ছবিগুলো এঁকেছি’ নীরবতা ভেঙ্গে বললেন ভদ্রমহিলা।

তুর্য চুপচাপ শুনল উনার কথা।



হলরুম পেরিয়ে বারান্দা ঘেঁষা রুমের দরজা খুললেন ভদ্রমহিলা। রুমটা দেখিয়ে বললেন, ‘দেখে নাও।’

রুমটা বেশ বড়সড়। পাশাপাশি দুটি জানালা। এই বাসাটা কেমন, তা বিবেচনায় না টেনে ভদ্রমহিলাকে মনে ধরে তুর্যের। ভদ্রমহিলার ধীর-সুস্থির বাচন ভঙ্গীর ভেতরেই উনার প্রখর ব্যক্তিত্বের আঁচ পায় ও।

‘এই ঘরটা আব্বা জাগিদার থাকার জন্য বানিয়েছিল। আগে বারান্দাটা খোলাই ছিল, আমি পরে গ্রীল লাগিয়ে জায়গাটা আটকে দেই।

সামনের সপ্তাহে আমি সবকিছু নিয়ে আসব। বলেই বিদায় নিল তুর্য।



পরের সপ্তাহে বাসায় ওঠে তুর্য। ভদ্রমহিলার আন্তরিক ব্যবহারে অল্প কয়েকদিনেই তাঁর কাছাকাছি চলে আসে তুর্য। এই বাসায় আসার পর ভদ্রমহিলার অনুরোধে উনার সাথেই খাওয়া-দাওয়া করে। এতে ডাইনিং টেবিলে দু’জনের ছোটখাট আড্ডাও জমে। আড্ডায় ফাঁকে একটু একটু করে জেনে যায় ছবিগুলোর পিছনের গল্প। একদিন ডাইনিং টেবিলে রাতে খাওয়ার সময় তুর্য জিজ্ঞেস করে, ‘পুরো বাড়িটা যেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধারক। সারাটি জীবন আপনি একা একা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আপন করে ধরে রাখছেন কেন?’

নীচু স্বরে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তোমাকে অন্যদিন বলি!’

কয়েকদিন পর এক বিকেলে ভদ্রমহিলা তুর্যের হাতে একটি ডায়েরী দিলেন। বেশ পুরনো কিন্তু যত্ন লেগে থাকা ডায়েরী, দেখেই বোঝা যায়। ঘরে এসেই ডায়েরীটায় বুঁদ হয়ে যায় তুর্য। ডায়েরীর কাভার পৃষ্ঠা খোলার পর চোখে পড়ে- সবুজ রঙে লেখা ‘জহুরা আকতার’। প্রথম পাতা উল্টানোর পর তুর্য বুঝতে পারে বেশ কয়েকটা পাতা একসাথে স্ট্যাপ্লার দিয়ে আটকানো। দেখে মনে হয় সদ্যই করা। সম্ভবত ঐগুলো তাঁর নিজেকে নিয়ে লেখা। প্রথম পাতায় লেখা__





২৯ এপ্রিল ১৯৭১

আমার জানালায় উদাস দুপুর নেমেছে। আজ প্রায় একমাস হতে চলল আমি গৃহবন্দী। আমার প্রিয় ইডেন কলেজকে খুব বেশি মনে পড়ে। অলস সময়ে চোখে ভাসে প্রিয় বান্ধবীদের মুখগুলো। দেশের অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হওয়ায় আব্বা আমাকে ঢাকায় মামার বাসা থেকে জোর করে মাইজদী এনে ঘরে ঢুকিয়েছেন।

তপুর একটা চিঠি পেয়েছি দিন দুয়েক হল। ও আর শফিক যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুনে আমার মনটা খুশিতে ভরে গেছে। তপুকে বলতে ভয় হয়, ওর ধমককে আমি বড্ড ভয় পাই। তপু, আমারও খুব ইচ্ছে করছে তোমার সাথে যেতে। তুমি বরাবরই জানো, আমি স্বাধীনচেতা মানুষ। তুমি দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে হাসিমুখে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে, আমি কেন পারবো না?

তপু, তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো।




এই পাতার পিছনের অংশে তির্যকভাবে বড় করে লেখা।

‘তোমাকে খুব মনে পড়ে তপু। ভালোবাসি খুব।’

তুর্য অনুমান করে নেয়, আটকানো পাতাগুলোর ভিতরে তাঁর আবেগ তাড়িত একান্ত কথন। তাই অপ্রাসঙ্গিক ভেবে ঐগুলো স্ট্যাপ্লার দিয়ে আটকানো।



আরেক পৃষ্ঠায় লেখা..



২০ মে ১৯৭১

সারাদিন এতো আতংঙ্কে আর উৎকন্ঠায় কাটে, ডায়েরীর পাতা যে ছুঁয়ে দেখব, তার জন্য মনটাকে নিজের করে বসাতে পারি না। তপু, তোমার চিঠি কবে আসবে, আমার জানা নেই। তুমি কোথায়, কেমন আছো, তাও আমার জানা নেই। তবে আশাকরি তুমি যেখানে আছো, অবশ্যই ভালো আছো।

জানো, আজ আমি খুব খুশি। আজ থেকে আমিও তোমার মতন একজন যোদ্ধা। মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধা। আজ সকালে আব্বার কলিগ রহমান স্যার বাসায় এসেছেন। আব্বা আর রহমান স্যার বসে আমাদের শহরটার পাকিস্তানি ক্যাম্পটার, শহরের পথগুলোর ম্যাপ এঁকেছেন। এছাড়া বেশ কিছু দিক-নির্দেশনামূলক লেখা সম্বলিত একটা চিঠি লিখেছেন। কিন্তু বাঁধ সাধছে কিভাবে চিঠিটা মুক্তিবাহিনীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া যায়! পথিমধ্যেই পাকবাহিনীর চেক পোষ্ট। তাঁরা ঠিক করেন কোন মেয়েকে বোরকা পরিয়ে পাঠাবেন। আমি শুনেই রাজী হয়ে যাই। কিন্তু আব্বা কিছুতেই আমাকে পাঠাবেন না। চেকপোষ্টে নাকি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চেক করে। ধরা পড়ার ঝুঁকি বেশ। আমি আর রহমান স্যার আব্বাকে অনেকভাবেই বুঝিয়েছি। শেষে উপায়ান্তর না দেখে আব্বা রাজী হয়ে যান।

বের হওয়ার সময় আব্বা, আম্মা আর জাবের ও জাবেদের মুখটা শুকনো দেখালেও তারা আমাকে বেশ সাহস দিয়েছেন। বাসা থেকে বের হয়ে পথে পা দিতে না দিতেই কাসেম শিকদারের ছেলে আমার সামনে এসে দাড়াঁয়। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে যায়। কাসেম শিকদার আমাদের এখানকার শান্তি কমিটির প্রধান হয়ে পাকিস্তানি হারামজাদাদের সাহায্য করছে। আর ওর এই ছেলেও পুরো বাবার মতই বদ। অনেকদিন ধরেই আমার পিছে পিছে লেগে আছে। ওর লোলুপ দৃষ্টি আমি বুঝতে পারি। এড়িয়ে চলি, কিন্তু এমন সময়ই আমার সামনে এসে হাজির। আমি নিজেকে সামলিয়ে ওর সাথে সহজ হয়ে বুদ্ধি করে বলি, ‘আমি আমার খালাম্মার বাসায় যাচ্ছি। ওদের বাসায় যেতে চেকপোষ্ট পার হয়েই যেতে হয়। আপনি যদি ওখানটায় একটু এগিয়ে দিতেন।’ও ব্যাটা সহজেই রাজী হয়ে গেল।

চেকপোষ্ট কাছে আসতেই ওকে আবার বলি, ‘চেকপোষ্টের পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে একটু পরিচয় করে দিতেন! যাতে ফেরার সময় ঝামেলা না করে।’বোরকার মুখের পর্দা উঁচিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে কথা বলি। ম্যাপ আর চিঠি পৌঁছে দিয়ে প্রায় আড়াই ঘন্টা পর নির্ঝঞ্ঝাটে বাসায় ফিরি। ঘরে পা দেওয়ার মুহূর্তেই মনের মধ্যে অদ্ভুত রকমের এক সুখ লেগেছে আমার। আত্মিক সুখ।



বেশ আগ্রহ নিয়ে তুর্য ডায়েরীর অন্য পাতা খুলে__



১৭ আগষ্ট ১৯৭১

তপু, অবস্থা খুবই গোলমেলে। আমাদের সারা শহর এখন বেশ থমথমে। ডায়েরীর পাতা ছোঁয়া তো দূরের কথা, মনের কোণের ছোট্ট অভিলাসও এখন আর পাত্তা পায় না। আজ সকালে তোমার পাঠানো ছবি পেয়ে আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছি। তুমি বেঁচে আছো! ভাবতেই আমি শিহরিত হয়েছি। ছবির সাথে কোন চিঠি ছিলনা, শুধুই ছবির পিছনে তোমার হাতে লেখা কয়েকটা কথা ছিল।

তপু, আব্বার কলিগ, রহমান স্যারকে পাকিস্তানি বাহিনী বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, দুদিন পর রহমতখালী খাল পাড়ে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। আর এইসব কান্ডের মূল হোতা, কাসেম শিকদার। কে কে মুক্তিফৌজদের সহায়তা করছে, তাদের নাকি লিস্ট করা হয়েছে।

আব্বা ভীত নয়, তবে আব্বা এখন বেশির ভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা, খাওয়ার রসদ যোগাচ্ছেন, পাশাপাশি শহরের পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবেগের তথ্য পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন।

আমিও আব্বার পাশাপাশি পূর্ণ উদ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছি। আমাদের বাসার চিলেকোঠা ঘরটা যুদ্ধে আহতদের আশ্রয়স্থল। ঐদিন একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে যাওয়ায় ডাঃ বিমল দত্তের গোপন চিকিৎসালয়ে নেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছিল। আব্বা বাসায় নেই তখন, উপায় না পেয়ে আমি আমাদের পাড়ার ভ্যান চালক হাসমত আলীর কাছে ছুটে যাই। হাসমত আলী নিঃসংকোচে রাজী হয়ে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি উনার বিশুদ্ধ টান দেখে আমি সত্যি মুগ্ধ হই। আমাদের বাসার পিছনেই ধানক্ষেত। বর্ষা শেষ হলেও এখনো কোমর সমান পানি। আমি আর হাসমত ভাই মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়াকে ধরাধরি করে ধানক্ষেত পেরিয়ে শহরের পিছনের রাস্তায় উঠাই। ওখানটায় ভ্যানটা রাখা ছিল। সময়মত ডাক্তার খানায় নিয়ে যাওয়ায় উনার জীবন বাঁচে। ডাক্তার বাবু ফিরবার সময় আমায় বলে, ‘মেয়ে হয়েও এতো সাহস!!’ আমি হাসি মুখে বললাম, ‘সাহসতো নারী-পুরুষ দেখে মনে জন্মায় না। সাহসতো জন্মায় নিজের ভিতরে লালিত সত্যের আত্মিক সৌন্দর্য থেকে।

আজ কলম ছাড়ছি।




ডায়েরীর একেবারে শেষদিকটায় বেশ বড়সড় একটা লেখা চোখে পড়ে তুর্যের। লেখাটা ১৯৭২ সালের মাঝামাঝিতে লেখা। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বেশ কয়েকদিনের বিরতি নিয়ে লিখেছিলেন।



১৩ জুন ১৯৭২

তপু, মনের উঠোন বাড়িতে হুটহাট জন্ম নেওয়া খুচরো অনুভূতিগুলো ডায়েরীতে লেখলেও তোমাকে অনেকদিন লেখা হয়ে ওঠেনি। আসলে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়াটাই এখন অনেক বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মামার বাসায় থেকে আপতত পড়াশুনা শেষ করাটাই এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য।

তোমাকে খুঁজতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে গিয়েছিলাম, কেউ কোন সঠিক তখ্য দিতে পারে নাই। তোমার বাড়ি, সিরাজগঞ্জেরও খোঁজ নিয়েছি, তারাও সদুত্তর দিতে পারে নি।

তপু, আমি যে বেঁচে আছি এটা ভাগ্যের ব্যাপার। মাঝেমাঝে নিজেও বিশ্বাস করে উঠতে পারি না, সত্যিই আমি জ্যান্ত মানুষ! গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর রাত্রে আম্মা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, জ্বর ১০৪ ডিগ্রী ছুঁইছুঁই। ঐ দিন রাত্রে আব্বা তাই বাসায় ছিলেন, যদিও তখন বাসায় থাকা নিরাপদ ছিল না। আমি জাবেদ আর জাবেরকে নিয়ে আমার রুমে ঘুমাচ্ছিলাম। হুট করে জানালা দিয়ে ঘরের ভিতরে আলো দেখে জেগে যাই। শোয়া থেকে উঠতে না উঠতেই দরজায় বিকট শব্দে একের পর এক আওয়াজ শুনি। জাবেদ আর জাবের জেগে যাওয়ায় আমি ওদের জড়িয়ে ধরি। আব্বা-আম্মা দৌড়ে এসে আমার রুমে ঢুকলেন। আম্মা আতংকিত হয়ে আমাদের সব ভাইবোনকে জড়িয়ে ধরলেন। ওরা আমার রুমে এসেই কোন কথা না বলে আব্বার বুকে সজোরে লাথি মারল, আম্মা আর আমি দৌড়ে ধরতে যেতেই একজন আম্মার মাথা বরাবর রাইফেলের হাতল দিয়ে আঘাত করল, আম্মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। আমাকে দুজন ধরে ফেলল। জাবেদ আর জাবের অঝোরে কাঁদছিল। মুহূর্তেই একজন আম্মা-আব্বার উপর গুলি চালালো। পরপরই আমার কোমলমতি দু’ভাইয়ের মাথায় গুলি করে। আমি আর্ত-চিৎকারে ওদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করি। তৎক্ষণাৎ একজন এসে আমার মাথার মাঝ বরাবর রাইফেলের হাতলের নীচ অংশ দিয়ে সজোরে আঘাত করে। আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ি।

আমার যখন জ্ঞান ফিরে, চোখ মেলতেই অনুভব করি আমার ডান চোখের পাতার উপর রক্ত লেগে আছে। দু ’হাত পিছনে খাটের পায়ায় দড়ি দিয়ে বাঁধা। আমি খাটের একপাশের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছি। আর আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ। আমার শরীরের নানান জায়গায় ছোপ ছোপ ক্ষতের দাগ। বুঝতে পারি আমার শরীরের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। কয়েক ঘন্টা পর দু্ই শুয়োর ঘরে ঢুকে। একজনের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটে টান দিয়েই হাঁটু গেঁড়ে বসে আমার স্তনের বোঁটায় জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরে। আমি সাথে সাথে একদলা থুথু তার মুখে ছিটাই। আর বলতে থাকি, শুয়োরের বাচ্চা। মুহূর্তেই আমার গালে কষে চড় বসায়। এরপর অন্য রুম থেকে রাইফেল এনে আমার শরীরে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচাতে থাকে। আমার যোনীতে বেয়োনেট ঢুকিয়ে সজোরে খোঁচাতেই তীব্র ব্যথায় আমি আবার জ্ঞান হারাই।

আবার জ্ঞান ফেরা পর আমি দেখি আমার দু’পাশে দুটো মেয়ে ঝুলছে। তাদের মত আমার হাতও দড়ি দিয়ে বেঁধে উপরে ঘরের চালের সাথে ঝুলিয়ে রাখা । তাদের পুরো শরীর ক্ষত-বিক্ষত আর রক্তাক্ত। দু’জনই সংজ্ঞাহীন। আমি মৃদু গলায় বললাম, পানি! পানি! আমার ক্ষীণকন্ঠের আওয়াজ শুনে এক মহিলা দৌড়ে আসেন। আমি চোখ তুলে তাকাতেই, উনি আমার গালে, কপালে হাত দিয়ে বলতে লাগলেন, ‘বেঁচে আছো! তুমি এখনি পালাও। এই রাত্রেই পালাতে হবে। আমি ওদের এখানেই থাকি। ওদের ঘরের কাজকর্ম করে দেই। কাসেম শিকদার জোর করে আমাকে এনেছে। বলছে তবে আমার পরিবারের কাউকে মারবে না। মাঝে মাঝে ওরা আমার উপর প্রচুর শারীরিক নির্যাতন চালায়, বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হয়ে পড়ে আছি।’

উনি আমার হাতে একটা বোরকা দিয়ে বললেন, তুমি এটা পরে স্কুলের পিছন দিয়ে চলে যাও। আমি বের হওয়ার আগে উনার নাম জিজ্ঞেসা করি। উনি জানালেন, সাইদা। যুদ্ধের পর আমি সাইদাকে খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখনও তাঁর দেখা পাইনি।

ওখান থেকে কোন রকমে পালিয়ে এসে সোজা আমাদের বাসায় আসি। এসেই দেখি আব্বা-আম্মা, জাবেদ, জাবেরর লাশে পচন ধরছে। নিজেকে এক প্রকার পাথরের মত শক্ত করে আমি দেরী না করে, আলমারি থেকে আমার কিছু শাড়ি-কাপড় আর এই ডায়েরী একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ঐ রাত্রেই গ্রামে নানাবাড়ির পথ ধরি। নানা বাড়িতে এসেই নিজেকে একটু সামলিয়েই লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করি। কোন পথে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমন করলে ফলপ্রসু হবে, সে জন্য স্কুলে পাকিস্তুানি ক্যাম্পে-এর পুরো একটা ছবি আঁকি। এই ছবিটা মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কাজে দিয়েছিল। সহজেই মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি ক্যাম্পটাকে উড়িয়ে দিয়ে দখল করতে পেরেছিল।

তপু, তখন মনে হয়েছিল, আমিও তোমার মত সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা।




ডায়েরীর পাতায় জল পড়তেই সম্বিত ফিরে তুর্যের। নিজেকে সামলানের পূর্বেই দরজার কড়া নাড়ার শব্দ শোনে তুর্য।

‘আসবো?’

হ্যাঁ, আসুন আন্টি’

আন্টির হাতে একটি সাদাকালো ছবি। তুর্যের হাতে দিলেন।

ছবিটার এককোণায় লেখা ‘তপু’। তুর্য আন্টির মুখ পানে একপলক চেয়ে ছবিটার উল্টো দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে__

জয়ের নেশায়

রক্তের সমুদ্রে তরী বেয়ে চলি,

হিম হিমাদ্রির টানে

ফিরবই একদিন বিজয়ী পাল উড়িয়ে

অপেক্ষায় থেকো প্রিয়তমা…




২০০১১৪

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২১

হাসান মাহবুব বলেছেন: চমৎকার লেখা।

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১২:৫২

নীল কথন বলেছেন: পাঠে কৃতজ্ঞতা হামা ভাই। ভালো থাকুন সবসময়।

২| ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:৪৯

আরজু পনি বলেছেন:

সব মিলিয়ে উপস্থাপনটা খুব ভালো লাগলো ।।

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১২:৫৪

নীল কথন বলেছেন: ধন্যবাদ আপু। আমার ব্লগবাড়িতে পদ চিহ্ন দেখে ভালো লাগল ।

৩| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১২:৪৬

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: চমৎকার! লেখাটা বেশ ভালো লেগেছে। +

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১:০২

নীল কথন বলেছেন: ধন্যবাদ।

৪| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১০:১৬

ইসতিয়াক অয়ন বলেছেন: মুক্তিযুদ্ধের গল্পে ভাল লাগা :)

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১:০৩

নীল কথন বলেছেন: আরে অয়ন ভাই দেখি। দেখেই আমার চক্ষু খুশিতে আত্মহারা।

৫| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:০৪

আজ আমি কোথাও যাবো না বলেছেন: চমৎকার লেখা!

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১:০৩

নীল কথন বলেছেন: ধন্যবাদ। অনেকদিন পর আপনাকে আমার ব্লগবাড়িতে পেলাম। সতত ভালো থাকুন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.