নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাদাসিদে মানুষ

যে ঘুড়ি উড়তে জানে না........

নীল কথন

হারিয়ে যাওয়া চশমার খোঁজে হাঁটছি........

নীল কথন › বিস্তারিত পোস্টঃ

উড়োজাহাজ

১৩ ই এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৪





আজ আমার মেয়ে ছ’য়ে পা দিল। সেই উপলক্ষে সন্ধ্যারাতে ছোটখাটো একটা আয়োজনও হবে। এর আগের জন্ম উৎসবের দিনগুলোতে, আমি ভীষণ উচ্ছ্বাসিত থাকতাম। সকালে অফিসে ঢুকে, মুহূর্তে মুহূর্তে ঘড়ি দেখতাম, আর সময় গুনতাম কখন যে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হবে। কিন্তু আজ আর তেমন কোন উচ্ছ্বাস খুঁজে পাচ্ছি না। আমার একমাত্র মেয়ের জন্মদিন। কিন্তু আজ আমার ভিতরে কোন এক পাথর চাপা বেদনা গুমড়ে কাঁদছে। একদিকে আমার কিছু পোড়া স্মৃতি, অন্যদিকে আমার সুকন্যার আবদার। আমি ভীষণ দ্বন্ধের মাঝে পড়ছি। আজ সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মেয়ে আমার হাত ধরে বলল, ‘বাবা, আজ আমার জন্মদিনের গিফটটা চাই, আনবে তো!’

আমি কোন উত্তর না দিয়ে মেয়ের গালে আলতো হাত বুলিয়ে চোখ লুকিয়ে বের হয়ে আসলাম। গত কয়েক মাসে আমার মেয়ের একটাই কথা, একটাই আবদার, ওকে একটা ছোট সাইজের সাইকেল কিনে দিতে। প্রথম প্রথম ভাবছি, চুপ থাকলে হয়ত ও ভুলে যাবে। কিন্তু না, দিন দিন ওর চাওয়ার আবেগ আরো ঘন হতে লাগল। ওর এখনো জগতের আবেগ বোঝার বয়স হয়নি। তাই ওর আবদার আমি ফিরিয়ে দিতে পারছি না।





আমার ছোট বেলার নায়ক, বন্ধু একাধারে সবকিছুই আমার মামা। আমার মা সবার বড়, এরপর একে একে চার বোনের পর আমার মামার জন্ম। আমাদের বাড়ি থেকে নানা বাড়ি বেশ কাছেই। পায়ে হেঁটে যেতে মিনিট দশেক লাগে। কাছাকাছি হওয়ায় মামা সকাল-বিকাল, যখন ইচ্ছে হত আমাদের বাড়ি চলে আসত। আর সব সময়ই সাথে ছিল তাঁর প্রিয় ফনিক্স সাইকেল। সারাদিন এদিক ঐদিক চষে বেড়িয়ে সাইকেলে যতই ধুলো লাগাতেন, তা পরিষ্কার করেই ঘরে ঢুকাতেন। কোন একদিন এক টুকরো চীর দিয়ে সাইকেল ঘঁষতে ঘঁষতে আমাকে বললেন, ‘বুঝলি ছোটন, যত্নে রত্ন মেলে। সেই দু’টাকার বাঁশিই হোক আর লক্ষ টাকার ‍পিয়ানোই হোক’। আমি তাঁর কথা সবসময়ই শিরোধার্য হিসেবে মেনে নিতাম। উনি সাইকেল ঘঁষে ঝকঝকে করার পর সাইকেলের খাঁচার সামনের পুরনো কাগজ পাল্টিয়ে নতুন কাগজ লাগালেন, যাতে লেখা বোয়িং-৭৭৭। আর বলতে লাগলেন, ‘এটা আমার সাইকেল না। এটা আমার উড়োজাহাজ। ’



উড়োজাহাজটির ড্রাইভারের পিছনের সিটে বসার অধিকার শুধু একজনেরই ছিল। সেটা আমার। পিছনে চড়ে গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে আমিও দূর-দূরান্তে হারিয়ে যেতাম। কী বর্ষা! কী রোদ্দুর! কী বাতাস! সবকিছু মাথায় চেপে চলে যেতাম কোথায়! কোথায় ! বৃষ্টিতে বাঘবন্দী খেলা, রঙধনু দেখা, দীঘির জলে অবাধ সাঁতারানো, পাটকাঠির আগায় কায়দা করে মাকড়সার জাল বিছিয়ে

ফড়িং ধরা, নারিকেল পাতার পাখা ঘুরানো, বসন্তের দিনে রঙীন কাগজ দিয়ে ঘুড়ি বানিয়ে ওড়ানো—এই সবকিছুই আমার প্রথম শেখা মামার কাছ থেকে।





দুরন্তপনা মামা খেলাধুলায়ও বেশ ভালো ছিলেন। ফুটবল কিংবা ক্রিকেট দুটোতেই সমান পারদর্শী। মাঝে মাঝে খেপে খেলতে যেতেন দূর-দূরান্তে। একবার স্কুল বন্ধের দিন ভর দুপুরে আমাদের বাড়ি এসে বললেন, ‘চল, আজ তোকে দূরে এক জায়গায় নিয়ে যাব। আমার ক্রিকেট ম্যাচ আছে।’ আমি সানন্দে উড়োজাহাজের পিছনে চড়ে বসলাম। ওখানে পৌঁছে দেখলাম, কোন মাঠের দেখা নেই। পুরোই ফসল তোলার পর ধান ক্ষেত। খাঁজ করে পিচ বানানো। আর খেলোয়াড়দের অনেকেই মালকোঁচা মারা। খেলা শেষের দিকে একটা আউট নিয়ে লাগলো ঝামেলা। কিছু বুঝে উঠার আগেই স্বাগতিক দলের খেলোয়াড়রা মামাদের উপর চওড়া হলেন। স্ট্যাম্প তুলে পেটানো শুরু করলেন। মামা দৌড়ে উড়োজাহাজ নিয়ে পালাতে লাগলেন। আমি তাঁর পিছু পিছু দৌড়াতে লাগলাম। আমাদের পিছনে ধর ধর বলে একপাল ছেলে তেড়ে আসতে লাগল। উপায়ান্তর না দেখে মামা আমাকে রেখেই উড়োজাহাজে চড়ে পালিয়ে গেলেন। আমি দৌড়ের তাল সামাল দিতে না পেরে হোঁচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে ধুলোয় হাবুডুবু খেতে লাগলাম। আমার অবস্থা বেগতিক দেখে পাশের এক বয়োজেষ্ঠ্য বৃদ্ধ আমাকে তুলে নিলেন। সন্ধ্যার দিকে উনি আমাকে আমাদের বাড়িতে দিয়ে গেলেন। ঘরে ঢুকে দেখি মামার মুখে এক রাজ্যের কালো মেঘ ভর করেছে। বুঝলাম তাঁর পিঠের উপর বেশ ভালো রকমের বাদ্য-বাজনা বাজানো হয়েছে।



মামা আমাকে দেখে বুকে জড়িয়ে আদর করলেন। তারপর সন্ধ্যারাতে পাড়ার মজুমিয়ার চা ঘরের পিছনে নিয়ে ডাল পুরি খাওয়ালেন। মামা মুখে সিগারেট গুঁজে দীর্ঘ টান মেরে ধোঁয়া ছেড়ে বলতে লাগলেন, ‘আমি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তুই ফিরে এসেছিস দেখে আনন্দে একটা সিগারেট খাচ্ছি।’





বাকেরগঞ্জ বাজার আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে। বড়সড় গাড়ীর পাকা রাস্তা পেরিয়ে যেতে হয়। হাট বাসার দিন নিজেদের এবং আমাদের ঘরের বাজার সদাইয়ের দায়িত্ব থাকে মামার। আমি সারা বিকেল হুটেপুটি করে সন্ধ্যায় ঘরে এসে পড়তে বসলাম। ঘরের বাহির থেকে কে যেন ডাক দিল। দরজার হুড়কো খুলে বাহিরে তাকাতেই দেখি চা দোকানদার মজুমিয়া। হাতে মামার উড়োজাহাজ। বললেন, ‘মানিক বাজার থেকে ফেরার পথে বড় রাস্তায় এক্সিডেন্ট করছে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ এর পরের দিন আমার মামা মারা যান।

মামা মারা যাওয়ার পর আমি আর কখনও কারো পিছনে উড়োজাহাজে চড়েনি। এমনকি আমি আর উড়োজাহাজ চালানোও শিখিনি।





সাইকেলের উপর আমার এক ধরণের ভীতি জন্মে। দেখলেই আমার মামার কথা মনে পড়ে যায়। আমার মেয়ের সাইকেল প্রীতি, আমার ভীতিকে আরো সজাগ করে তোলে। তবু মেয়ের আদুরে আবদারের কাছে হেরে গিয়ে আমি সাইকেল কিনতে বিকেলেই অফিস থেকে বের হলাম। সন্ধ্যা নামার পর সাইকেল নিয়ে বাসায় ফিরতেই মেয়ে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চোখে বুজে নিষ্পাপ ভালোবাসার ডোরে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলাম। মেয়ের কপালে ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে বললাম, ‘এটা তোমার উড়োজাহাজ।’

সাইকেল পেয়ে মেয়ের আনন্দের আতিশয্য আমার চোখে জল নিয়ে আনল। তবু মনের কোণে ভীড় করছে, কোন এক অজানা শঙ্কা!



১৩০৪২০১৪

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৯:০৪

মুজাহিদুর রহমান বলেছেন: ইনশাআল্লাহ সাইকেলের কারণে আপনার মেয়ের কেন বিপদ হবে না।

১৪ ই এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১১:০৯

নীল কথন বলেছেন: পঠনে কৃতজ্ঞতা। এটা নিছক গল্প।

২| ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:০৬

হাসান মাহবুব বলেছেন: একটা বেশ জটিল মানসিক দ্বন্দ্বকে ঘিরে আবর্তিত গল্পটি ভালো লাগলো।

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:০৯

নীল কথন বলেছেন: আপনার মন্তব্য পেয়ে ভাইয়া সত্যি ভালো লাগলো। সবসময়ই ভালো লাগে। আপনি দেরিতে হলেও আমার লেখায় মন্তব্য টুটে যান, কৃতজ্ঞতা। আর আমাকে বেশ উৎসাহও যোগায়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.