নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাদাসিদে মানুষ

যে ঘুড়ি উড়তে জানে না........

নীল কথন

হারিয়ে যাওয়া চশমার খোঁজে হাঁটছি........

নীল কথন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্পঃ অমলকান্তির রোদ্দুর আর আমার বন্ধুর ঘুম

২৮ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১২:০০

বাসের জানালার পাশের সিটে বসা আমার বহুদিনের অভ্যাস। জানালার কাঁচ ঠেলে দিলেই হাওয়ায় ভেসে যাওয়া যায়। ঐ বাতাসে আমার ব্যক্তিগত দুঃখ-সুখগুলো মনের কোনে ভেসে ওঠে। আজ এই বাতাস খুব পরিচিত লাগছে। আমার যাত্রা উলপুর। বাড়ি যাচ্ছি। মধুমতি নদীর পাড়েই উলপুর গ্রামটা। উলপুরের বড় বাজারটা মধুমতি নদী অনেকাংশ গিলে ফেলছে। বড় বড় খাঁজ কাটা পাথর দিয়ে তৈরি বাঁধটা এখন পুরো গ্রামটাকে বাঁচিয়ে রাখছে। আমাদের স্কুলটা নদীর অদূরেই। এমনি কোন এক বাদলা দিনে ‘ঘুম বেরি’ এক গোছা কদম ফুল নিয়ে স্কুলে হাজির হল। আমাদের সব বন্ধুকে একটা একটা গিয়ে বলল, ‘‘বর্ষার উপহার”। ‘ঘুম বেরি’ নামটা আমার দেওয়া। ওর ভালো নাম সোহেল। স্কুলে ক্লাসের মাঝে সে প্রায়শ ঘুমিয়ে পড়ত। এই অপরাধে মাথা নীচু করে চুপ হয়ে স্যারের মার খেত। তবুও সে পরদিন মারের ঝাল ভুলে দিব্যি ঘুমাতো।

মাঝে মাঝে বলতাম, “তুই ক্লাসে এতো ঘুমাস কেন?” চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকত। আমার প্রশ্নের উত্তরের কোন বালাই নেই। সেই থেকে ওর নাম দিলাম ‘ঘুম বেরি’। গ্রামে ছোটখাটো ব্যবসায়ীদের বেরি বলে। ও হচ্ছে ঘুম ব্যবসায়ী।



ক্লাস নাইনে বাংলা পড়াতেন গায়ত্রী ভূষণ ভৌমিক। ধবধবে শাদা ধুতি পরে আসতেন। গায়ে জড়ানো থাকত শাদা কিংবা কলা পাতার রঙের কোর্তা। বইয়ের সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প ‘রসগোল্লা’। সরস গল্প থেকে স্যার যেন একটা একটা রসগোল্লা তুলে এনে আমাদের মুখে পুরিয়ে দিচ্ছিলেন। আমরাও চোখ বুজে গিলে ফেলছি। গল্প শেষে আমাদের বন্ধুমহলের রসগোল্লা খাওয়ার অভিলাষ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বাঁধ সাধে পকেটের ফুটা। পকেটতো গড়ের মাঠ। পিছনে বেঞ্চে বসা ‘ঘুম বেরি’ উঠে এসে ১০০ টাকার একটা নোট মেলে ধরে। বলল, “চল!”

“কই পেয়েছিস এতো টাকা?”

মিনিমিন সুরে বলল, ‘‘আব্বার পকেট মেরেছি।’’

ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘোষ মিষ্টি ভান্ডারে এসে পেট পুরে আমরা অমৃত রসগোল্লা খেলাম।



স্কুল থেকে কয়েক মিনিট হাঁটলে নদী মেলে। আমাদের আড্ডা আর হৈ-হল্লার জায়গা নদীর পাড়। ক্লাসের ফাঁকে সময়ে মিললেই আমরা নদীর বাতাসের বাণে হারিয়ে যেতাম। একদিন ‘ঘুম বেরি’ দু’হাত মেলে বাতাসে শরীর ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে বলল, “আমি মরে গেলে বাতাস হবো। বাতাসে তোরা আমায় খুঁজে পাবি। আমি বাতাসে ভেসে ভেসে উড়ে উড়ে চোখ বুজে ঘুমাবো।” ঐদিন ঘুমের প্রতি ওর অন্যরকম টানের কারণ জানতে পারি। ওর বাবা আরেক বিয়ে করছেন। এই নিয়ে প্রতি রাত্রে তার মায়ের সাথে ঝগড়া হয়। ঝগড়ার কারণে তাকে সারারাত জেগেই কাটাতে হয়। সেই থেকেই তার মনে জন্ম নেয় ঘুমের প্রতি অদ্ভুত এক টান।



গ্রাম আর শহরের স্কুলের মাঝে তফাৎ চিরন্তন। শহরের স্কুলের সকল বন্ধুরা হয় সব ভালো ছাত্র। স্কুল শেষে তারা ভর্তি হয় নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেউ ডাক্তার, কেউবা ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ব্যাংকার, কেউবা হয় নামজাদা ব্যবসায়ী। আমার বন্ধুরা তেমন নয়। কেউ কাজ করে সেলুনে, কেউ হয় বাসের ড্রাইভার, আবার কেউবা দাপটের সাথে মাড়িয়ে বেড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ। একবার বাসে চড়ে হলে ফিরছিলাম। বাস কন্ট্রেকটার আমার ভাড়া না নিয়ে সবার ভাড়া নিলেন। ভাড়া না নেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতে আবিষ্কার করলাম, ঐ বাসের ড্রাইভারের সিটে বসা লোকটা আমার বন্ধু। তাই আমার ভাড়া নেওয়া বারণ। ‘ঘুম বেরি’র স্কুলের গন্ডি আর পার করা হয় না। এস.এস.সি পরীক্ষায় দু’বার ফেল করে উলপুর বাজারে ছোট একটা মোবাইলের ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকান দিয়ে বসে। বাড়ি গেলে ওর দোকান ঘরটায় আমাদের টুকটাক আড্ডা হত।



ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় জীবিকার টানে বিদেশে পাড়ি জমায় ‘ঘুম বেরি’। ওখানে কোন এক দোকানের কাজ করত। তার জীবনের রঙ পরিবর্তন হতে বেশি দিন সময় লাগেনি। ওখান থেকে মাঝে মধ্যে ফোন করত। তার সহাস্য কথাগুলো কেমন যেন ভালো লাগার জন্ম দিত। হুট করে শুনি ওর শরীরে অসুখ বাসা বাঁধে। ওর কিডনি দুটো খেয়ে ফেলে অসুখ। দেশে ফিরে আসে। দেশে এসে এখানে ওখানে হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে হাতের সম্বলও শেষ হয়। কিছুদিন আগে ওকে বাড়ি গিয়ে দেখে আসি। অসহায়ত্ব ওর চোখগুলো খেয়ে ফেলছে। জীবনের দৌড়ে পিছনের বেঞ্চে বসা একটা মানুষের নীরবে হারিয়ে যাওয়া দেখে আসলাম। আজ খুব ভোরে বন্ধু তপু ফোন করে জানাল, গতরাতে ‘ঘুম বেরি’ আত্মহত্যা করছে।



আবছায়া গৌধূলী বেলায় বাস উলপুর বাজারে থামে। বাস থেকে নেমে আমি মধুমতি নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়াই। হু হু করে তেড়ে আসা বাতাস আমার কানে কানে বলছে, অমলকান্তি রোদ্দুর হতে না পারলেও আমাদের বন্ধু ঘুম হতে পেরেছে।



২৭০৭২০১৪

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:৩৯

পাজল্‌ড ডক বলেছেন: অনবদ্য লিখেছেন :)

২৮ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:১২

নীল কথন বলেছেন: ধন্যবাদ ভ্রাতঃ

২| ২৮ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:০২

মামুন রশিদ বলেছেন: লেখাটা মন ছুঁয়ে গেল । অসাধারণ ।

২৮ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:১৩

নীল কথন বলেছেন: পঠনে কৃতজ্ঞতা।

৩| ২৮ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৬

অপ্‌সরা বলেছেন: প্রিয়তে ভাইয়া!!!

২৮ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৪:০৩

নীল কথন বলেছেন: এক বাগান ধইন্না পাতা। ভালো থাকুন।

৪| ৩০ শে জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩৮

হাসান মাহবুব বলেছেন: শেষ লাইনটা একদম মোক্ষম। মনের ভেতর আঘাত করে।

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৪ রাত ৮:৪৩

নীল কথন বলেছেন: মন্তব্য পেয়ে ভালো লাগছে হামা ভাই।

৫| ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:২৬

জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন:
চমৎকার ৷ সুখপাঠ্য ও গতিশীল গদ্য ৷

কবিতা থেকে যাপিত জীবনের কথনে রূপান্তরগুলো স্বকীয়তার দাবি রাখে নিঃসন্দেহে ৷

০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৭

নীল কথন বলেছেন: আপনার সুন্দর ও দিল খোলা মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
সতত ভালো থাকুন।

৬| ১০ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ৮:৩১

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন:
আপনার সূক্ষ্ম হিউমার দিয়ে শুরু করা গল্পটি শেষ হলো ঘুম বেরি’র মর্মস্পর্শী পরিণতির মধ্য দিয়ে। অনবদ্য লেখনি। মন ভিজে গেলো।


আমি মরে গেলে বাতাস হবো। বাতাসে তোরা আমায় খুঁজে পাবি। আমি বাতাসে ভেসে ভেসে উড়ে উড়ে চোখ বুজে ঘুমাবো।


উদ্ধৃত কথাগুলো চমৎকার, তেমনি শেষ প্যারাটাও।

১০ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ৮:৫৮

নীল কথন বলেছেন: আমার ব্লগ বাড়িতে স্বাগতম।

আপনার চমৎকার মন্তব্য পেয়ে বেশ ভালো লাগছে। ভালো থাকা হোক অহর্ণিশ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.