নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দুঃখ হীন পৃথিবী

দুঃখ হীন পৃথিবী

একশত সিপাহী ঢাল-তলোয়ার লইয়া যে ক্ষমতা না রাখে, অনুতাপের হাত তাহার চেয়ে অধিক ক্ষমতা রাখে।

দুঃখ হীন পৃথিবী › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার অন্তিম যাত্রা

২০ শে মে, ২০১৫ দুপুর ১:৫০

আমার মৃত্যু হয় আজ সকাল দশটায়।
অনেক দিন ব্রেইনের ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত হেরে যায়, শেষ পর্যন্ত আমাকে পরাজিত করে ক্যান্সারের জয় হয়েছে।
৪ মাস পূর্বে হটাৎ করেই মাথায় কেমন যেন একটা চাপ অনুভব করলাম তারপর ক্লিনিকে এসে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলাম আমি মৃত্যু পথের যাত্রী।
সকালে যখন আমার অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে গেল সাথে সাথে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল ইমারজেন্সি ইউনিটে। আমার ট্রলি নিয়ে ছুটে চলে একঝাক অচেনা মানুষ। আমি তাদের আত্নীয় না, বন্ধুও না, চেনা-পরিচিত কেও না। কিন্তু হায়! বুকভরা ভালোবাসায় নিথর একটা দেহ নিয়ে দৌড়াতে থাকে মহৎপ্রাণ আলোকিতো কিছু মানুষ।
সাথে সাথেই ছুটে আসেন ডিউটিরত ডাক্তার। পালস দেখে, বুকে চাপ দেয়, অক্সিজেন মাস্ক লাগায়। সাধ্যমত চেষ্টা চলে। কিন্তু মৃতদেহে প্রাণ ফিরিয়ে দেবার ক্ষমতা তো বিধাতা আর তাদের দেননি। অবশেষে আধাঘন্টা পরে নার্স আমাকে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে দেয়। ডাক্তার আমায় অফিসিয়াল্যি ঘোষনা করে-“হি ইজ অলরেডি ডেড” হঠাত কে যেন কোনার দিক থেকে মুখচেপে কেদে ওঠে- মেয়েলী কান্না।
‘আরে উনি কাঁদে ক্যান!!’
‘উনারেতো আমি চিনি না।’
পরে মনে মনে ভাবি হয়তো আমার মত উনারও কোন পরিচিত জন এইভাবে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে হেরে গেছে।
যায়হোক আজ থেকে আমাকে আর কোন রোগের সাথে লড়তে হবেনা, আমি এখন রোগ-শোক, আবেগ-ভালোবাসা সব কিছু থেকে অনেক অনেক উপরে….

আধাঘন্টা পর আমি বের হয়ে আসি ইমার্জেন্সী থেকে। বেরিয়েই চমকে যাই। দেখি, আমার বড় কাক্কু আর চাচাতো ভাই এবং এলাকার বন্ধুরা কাদের সাথে যেন কথা বলছে। আমি বের হয়ে আসতেই দৌড়ে আসে আমার দিকে। প্রথমে আসে আমজাদ ভাই। চাচাতো ভাই হলেও আমি তাকে দাদাভাই বলেই ডাকি। সে এসেই আমায় ঢাকা সাদা কাপড় উচু করে, একপলক দেখেই মুখ সরিয়ে নেয়। সাথে সাথেই আসে বড় কাক্কু। কাক্কুর রিএ্যাকশনটা ঠিক বোঝা গেলো না। হঠাত যেন সে বোবা হয়ে গেলো। সব আড্ডার মধ্যমণি কৌতুক প্রিয় কাক্কুর এ মূর্তিরূপ আমি কখনোই দেখিনি।
একটু পরেই দেখি ছোটকাক্কুর সিলভার কালারের টয়োটা গাড়িটা। কাক্কুই ড্রাইভ করছে। পাশে বসা আমার আব্বু। পেছনের সীটে আমার দুই কাক্কী এবং সাব্বির বসা আছে। কিন্তু কী আশ্চর্য!
‘আব্বুর চোখের চশমাটা কই?’
‘আব্বুতো কখনোই চশমা ছাড়া বাইরে বের হয় না।’

গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ না করেই কাক্কু দৌড়ে নেমে যায়। আব্বু দৌড়ে এসে দাঁড়ায় বড় কাক্কুর পাশে।
‘আরে, আমিতো এখানে।’
‘তোমরা আমার কাছে আসো।’
কিন্তু কে শোনে আমার কথা। হঠাত আমার হাতে ছোট কাক্কুর ছোঁয়া পাই। এই আমার সেই ছোট কাক্কু-যাকে আমরা সবাই মানে চাচাতো ভাই বোনেরা বাঘের চেয়েও বেশী ভয় করি। যেই মানুষটার ছায়া দেখার সাথে সাথেই আমরা ক,খ পর্যন্ত ভুলে যাই, আর সেইকাক্কুই আজ আমার হাত ধরে আছে।
‘আজিব তো!’
হঠাত দেখি ছোট কাক্কু তাকিয়ে আছে নিষ্পলকে আমার নিথর দেহটার দিকে, সারাজীবন কঠিনরূপে দেখে আসা কাক্কুর আজ এ কী রূপ! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার প্রাণহীন দেহটার দিকে।
আব্বু আসছে আমার দিকে। পাশে আমজাদ ভাই। আব্বু এসে আমার ডানে দাড়ায়। আমজাদ ভাই ধীরে ধীরে মাথার কাপড় ওঠানো শুরু করে।
‘ধূর, আমজাদ ভাই এটা কী করতেসে!’
‘আমাকে এইভাবে দেখানোর মানে কী!’
‘আব্বুর তো হার্টের অসুখ, সকালে প্রেসারের ওসুধটা খেয়েছে কিনা কে জানে।’
আস্তে আস্তে আমার মাথার অংশ পুরোপুরি অনাবৃত করে ফেলা হয়। আমি চোখ বন্ধ করে থাকি।
‘আল্লাহই জানে এখন আব্বুর কী হবে!’
কিন্তু আব্বুর অভিব্যক্তি দেখার প্রচন্ড ইচ্ছা জাগে। সাথে সাথে চোখ মেলে তাকাই এবং সম্পূর্ণ নতুন একটা জিনিস আবিষ্কার করি।
জীবনে এই প্রথম আমার বাবার চোখে পানি দেখতে পাই। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!!

সব সময়ই আপন জগতে থাকা বাবার আদর থেকে আমি কখনো এতটুকুও বঞ্ছিত হইনি। এখনো মনে পড়ে প্রতিদিন অফিসে যাবার সময় আব্বুর কাছে করা সেই চকলেটের আবদার। এখনো মনে পড়ে প্রতি রাতেই আমার জন্য খেলনা নিয়ে বাবার ঘড়ে ফেরা। আব্বু আমার জীবনে কোন ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখেনি। সবই পেয়েছি। শুধু এই একটা জিনিসই হয়তোবা দেখা বাকি ছিলো- আব্বুর চোখের পানি। কিন্তু হায়! আজকে আমি তো মহা ফ্যাসাদে। আজ তো আমার উঠে দাড়াবার শক্তি নেই। আমি তো আব্বুর চোখের জল মুছে দেবার জন্য ট্রলি থেকে উঠতে পারছি না।
১২টা প্রায় বাজে। সূ্র্য এখন ঠিক মাথার উপরে। কাক্কু এবং ভাইয়ারা কী সব কাগজ নিয়ে যেন দৌড়াদৌড়ি করছে। হয়তোবা অফিসিয়াল ভেরিফিকেশন এবং হসপিটাল রিলিজের কাগজপত্র। হায়রে! কক্ত কক্ত নিয়মকানুন। এদিকে আমার শরীর আস্তে আস্তে শক্ত হতে শুরো করছে। আমার মাথায় তখন শুধু একটাই চিন্তা- কখন বাসায় যাব।

দুপুর ঠিক পৌনে একটা। সাইরেন বাজাতে বাজাতে এ্যাম্বুলেন্সটা থামে ঠিক আমাদের বাড়ির সামনে। ধীরে ধীরে আমি ঢুকি আমার বাসার ভেতর। ড্রয়িংরুমের ভেতর ঠিক মাঝখানটায় নেয়া হয় আমাকে। সিলিং ফ্যানটার ঠিক নিচে। চারপাশে সব পরিচিত মুখ। কয়েকজনকে তো প্রায় আট-দশ বছর পর দেখছি। সবাই আমাকে ঘিরে রয়েছে। আমারতো ‘নিজভূমে পরবাসী’র মত অবস্থা।
‘আরে, আপনারা সবাই এমন করতেসেন ক্যান? আজব তো!’
সবাই দেখি রোল উঠিয়ে কাঁদতেসে। মনে মনে ভাবি, যার যা ইচ্ছা হয় করুক। আমার দৃষ্টি শুধু একটি মুখ খুজে বেড়ায়- আমার মা।
প্রতিদিনতো বাসায় আসলে আম্মুই দরজা খুলে দেয়। টেবিলে ভাত বেড়ে না খেয়ে বসে থাকে সেই বিকাল পর্যন্ত। কিন্তু আজকে এত দেরি করছে কেনো! আমার তো আর দেরি সহ্য হচ্ছে না। আম্মুর কথা ভান্তে ভাবতেই দরজার পাশে দেখি আম্মুর মুখ। একেই হয়তো বলে নাড়ীর টান। আর আম্মুতো শুধু আমার মা’ই না। আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুও।
আম্মু এসে দৌড়ে আমার পাশে বসে। সাথে ছুটে আসে আমার ছোটকাক্কী, বড়কাক্কী আরো অনেকে। আম্মু এসেই আমার কপালে হাত বুলাতে শুরু করলো। আমার জ্বর হলে যেভাবে মাথায় পানি মুছে দিত ঠিক সেভাবে। সে যে কী স্বর্গীয় অনুভূতি তা বলে বোঝানো যাবে না। স্বর্গে যাব কি না তার কোন ঠিক নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত মায়ের আদরলাগা ছোয়ার স্থান নরকের যন্ত্রনা কোনদিন স্পর্শ করবে না। হঠাত আম্মু বলতে শুরু করল, “এ্যাই, তুমি কোথায় গেলা? দেখো না, ছেলেটা ক্যামনে ফ্লোরে ঘুমায়ে পড়সে। ওকে ধরে তোলো। ওর রুমে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেই। আরাম করে ঘুমাতে পারবে। তাড়াতাড়ি আসো।” আমি তাকাই আব্বুর দিকে। আবার দেখি চশমাহীন সেই হতবিহবল চেহারা। আবার দেখি আমার হঠাত আবিষ্কার করা আব্বুর চোখের পানি। আব্বু অঝোরে কাঁদছে। কিন্তু কোন শব্দ নেই। একটা মানুষের চোখে এত পানি থাকতে পারে তা আমার জানা ছিলো না। তবে কি বাবার শরীরের রক্ত পানি হয়ে চোখ দিয়ে ঝরছে!
ওফফফ!!! হঠাত যন্ত্রনায় দেহের মধ্যে কেমন এক অজানা অনুভূতি জাগে।
আমি আবার চারপাশে তাকাই। সজীব’কে খুজি। ও আমার ছোট ভাই। অনেকদিন সিঙ্গাপুরে এক সাথে ছিলাম, জীবনটা চিনাতে গিয়ে কতযে ওরে বকাঝকা করসি তার কি কোন হিসেব আছে! ওকি তবে রাগ করে সামনে আসছে না।
‘আরে গাধা তোরে কি আমি কোনদিন মন থেকে বকা দিসি?’
তুই যাতে সিঙ্গাপুরে নিজের অবস্থানটা অনেক সুন্দর করতে পারিস সে জন্যই তো আমি একটু রাগ দেখাতাম। কিন্তু তুই যে ছিলি আমার পৃথিবীর সেরা ভাই।
– একথাটা মুখ ফুটে বলিনি কখনো, কেনযে বলিনি................
ওফফ!! কষ্টটা আরেকটু বাড়ে।

বেলা বাজে প্রায় দুইটা। আত্তীয় সজন, পাড়া-প্রতিবেশী, চেনা-অচেনা সবাইরে দেখি। কিন্তু আমার প্রতিদিনের আড্ডাবাজী গ্রুপের পোলাপানগুলিরে চোখে পড়ে না। কে জানে। ওরা খবর পেলো কিনা। আর ওদের যা সময়জ্জান তাতে টাইমলি আসবে কিনা তাই বা কে জানে!
‘আরে ব্যাটারা, আজকের দিনেও তোদের লেট করা লাগে?’
‘দেখিস না আমার আর বেশী সময় নাই।’
চারপাশে গোল করে বসে মাদ্রাসার ছেলেমেয়েগুলি সুর করে কোরান পড়ছে। বাকিদের হাতে তসবি।
‘আর কিছুক্ষণ পরেই তো আমার জানাজা। তোরা আসবি কখন?’

হঠাত সিঁড়িতে জুতা পরে খুব দ্রুত কারো উঠার শব্দ শুনতে পাই। ‘টক,,টক,,টক,,,
’শুনেই বুঝতে পারি সাজ্জাদ ভাই আসছে। আমার সব কাজের সাপোর্টার এই মানুষটা কতযে হাসি খুশি থাকতে পারে না দেখলে বুঝার কোন উপায় নাই। আমার ব্যবসায়ীক জ্ঞানের হাতেখড়ি তো সাজ্জাত ভাইয়ের কাছেই। কি সুন্দর ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতো সবকিছু। একটা প্রশ্ন দশবার করলেও কিছুই মনে করতো না। কিন্তু ফ্যাশনেবল হাসিখুশি সাজ্জাত ভাইয়ের চেহারার আজকের এই গাম্ভী্র্য তো আমার পুরোপুরি অচেনা। সাজ্জাত ভাইয়ের সাথে সাথেই ঢোকে আহসান ভাই। আমজাদ ভাইয়ের ভাই- আমার কাজিন। আমার চেয়ে বয়সে চার বছরের সিনিয়র। কিন্তু সম্পর্ক ঠিক বন্ধুর মতো। আমার কম্পিউটার জ্ঞানের হাতেখড়ি তো আহসান ভাইয়ের কাছে, বিদেশ যেতে কিংবা দেশে আসতে সবসময় এই মানুষটা এয়ারপোর্টে আসত এবং নির্বাকভাবে তাকিয়ে থাকত।কখনো দেখা হলেই হাসিমুখে বলতো- “কিরে, কোন সমস্যা নাই তো? এবারেরর ছুটিতে কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবি?”
সাজ্জাত ভাইকে পাশ কাটিয়ে আহসান ভাই দৌড়ে এসে আমার পাশে বসে। ক্ষাণিক পরেই মাথা টলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় আমার খাটিয়ার পাশে। হায়রে! ধীরে ধীরে কষ্ট তো বাড়ছেই। চিন্তা করি, কখন দ্যাখা শ্যাষ হইব এইসব।

বাজে প্রায় তিনটা। হঠাত করেই আসা শুরু করলো আমার সব জিগরি দোস্তোরা।
‘কিরে ভাই, তোগোর সবার মুখ এমন ক্যান? কি হইসে তোগোর? আমারে ক’
চমকে ভাবি- না না, কারো প্রবলেম সলভ করার ক্ষমতা আমার আর নেই। ইকবালকে আমার আর কোনোদিন টাকা ধার দিতে হবে না। শাহীনের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর চুরি করা হবে না। জাহীদের সাথে তর্ক হবে না আর কোনোদিন। আজিজুল আমার উপর হঠাত হঠাত রেগে যাবে না আর কখনোও। সুমনকে বাটপার বলে দৌড় দিব না আর কোনদিন। বিকেল হলেই কামরোলের সাথে চুপি চুপি সিগারেট খেতে যাব না আর ব্রিজের ধারে। আমি আর তোদের কোন কিছুরই অংশ হতে পারব নারে। হয়তো ওপর থেকে দেখব সবকিছু। মেঘ হয়ে ভেসে বেড়াব, বাতাস হয়ে ছুঁয়ে যাব। কিন্তু তোরা আমায় পাবি না আর কোনদিন।
হঠাত চিৎকার শুনি। বারান্দার দিকে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পাই একটা জটলা। গলার স্বর শুনে আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এবার গলা ফাটিয়ে কাঁদছে শাওন। আরে কী আশ্চর্য! বারান্দার ওই কোনার দিকের চেয়ারে ওটা কে! শাহীনের মত লাগছে দেখতে। হ্যাঁ হ্যাঁ, শাহীনই তো। ও মুখে রুমাল চেপে বসে আসে ক্যান? এই শাহীনের মাঝে কোনদিনও আবেগ ছিলো বলে তো মনে পড়ে না। ওতো সবকিছুই ঠাট্টা মনে করে উড়িয়ে দেয়। অথচ সেই শাহীনের চোখেও পানি। অন্তরের সব কঠিন আবেগ যেন চোখ বেয়ে গলে গলে পড়ছে। এত ভালোবাসতি তোরা আমাকে! এত!! এত!!! কই, কোনদিন তো কিছু বলস নি! কোনোদিন তো দেখাস নি। আমিও তোদের অনেক ভালোবাসতাম রে। অনেক, অনেক। কিন্তু কোনদিন তোদের বলিনি। তোরা সবসমই আমার চারপাশ আলোকিত করে থাকতি। আমার এই ক্ষুদ্র জীবন তোদের মত বন্ধু পেয়ে ধন্য।
হায়রে! এত ভালোবাসার কোন প্রতিদান না দিয়েই কী স্বার্থপরের মত চলে এলাম পৃথিবী থেকে। কষ্টটা আরো বাড়ে।

ড্রয়িংরুমের ডান পাশটাতে দুইটা অপরিচিত মুখ দেখতে পেলাম, তবু কেন জানি মনে হল এদেরকে কোথাও দেখেছি। আরে এরা যে ইমু আর উর্মী, ছোট ভগ্নীপতির ভাগ্নী। দোজনকেই আমি মামনি বলে ডাকতাম, খুবই বন্ধুর মত মিশেছিলাম এদের সাথে যদিও জীবনে কোনদিন এদের সাথে আমার দেখা হয়নি মাঝে মাঝে ফেইসবুক কিংবা মোবাইলে কথা হত। হাসি আনন্দ সব কিছুই ভাগ করে নিতাম ওদের সাথে, কিন্তু আজ যখন প্রথম এদের দেখছি তখন নিশ্চয় আনন্দ প্রকাশ করার কথা কিন্তু ওরা কি কাঁদছে?
না, না ওরা কাঁদবে কেনো। ওরা তো আমার রক্তের সম্পর্কের কেও না। তবে কি রক্তের বাধনের চেয়ে আত্তার বাঁধন বড়?’
তাই হবে হয়তো।

বিকেল সাড়ে চারটা। আমায় গোসল করানো শেষ। আসরের নামাযের পর জানাযা। মা এখনো আমার মুখে শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে।
‘দাও মা, দাও। আর একটু পরই তো আমি চলে যাব। তোমার এই পরশ তো আর পাব না।’
“দেখসো শেলী (আমার ছোট কাক্কী), ছেলেটা যত বড় হচ্ছে ততই মনভোলা হয়ে যাচ্ছে। রাতে যে ওর বাহ্মনবাড়িয়া যাবার কথা আছে। ও মনে হয় ভুলেই গেসে। সেই কখন থেকে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে”-আম্মার এই কথা শুনে ছোট কাক্কী বড় কাক্কী আর সব ভাইবোন আবার চিৎকার করে কান্না শুরু করে। মা এখনো কিছু বুঝতে পারে না। আমার সারা শরীরে নিরন্তর হাত বুলিয়ে চলে।

বিকেল পাঁচটা। ছোট কাক্কু বড় কাক্কু এবং বন্ধুরা এগিয়ে আসে আমার খাটিয়ার দিকে। আমি বুঝতে পারি আমার এ বাসায় আর আমি আসতে পারব না। আমার ছোট্ট বারান্দায় বসে গভীর রাতে আর জোৎস্নাগোসল করা হবে না। নাস্তার টেবিলে বসে দেয়ালে টানানো ওয়ালম্যাটটার দিকে আর আমি চেয়ে থাকব না। হঠাত করেই যেন চেঞ্জ হয়ে গেলো সবকিছু।
ধীরে ধীরে আমায় নিয়ে আসা হয় গেটের বাইরে। বের হতে হতে দেখি সুমী আপা, বিন্তী, লুৎফা আপা সহ কয়েকজন আসছে। এরা কিছুটা দেড়ি করে ফেলেছে হয়ত শেষ দেখাটাও আর হলনা। বাহিরে চোখ ফেলতেই দেখি পাশের বাসার কাক্কী, পিচ্ছি, এনাম ভাই, হাই কাক্কু আরো কতো কতো মানুষ তার ইয়ত্তা নেই। সবাই আজ এসেছে আমাদের এই ছোট্ট বাড়িটায়।

আমায় নিয়ে আসা হয় বাসার পাশের জামে মসজিদে। কি সুন্দর চকচকে টাইলস লাগানো চারপাশের দেয়ালে। মনে পড়ে যায় এই মসজিদে ২০১১ সালের শবে-বরাতের রাতে বাবার সাথে নামাজ পড়তে এসেছিলাম। দুইদিন পূর্বে সিঙ্গাপুর থেকে এসেছিলাম তাই বাবা একপ্রকার ছোট্ট ছেলের মত হাত ধরে নিয়ে এসেছিল যেন ছেড়ে দিলে আমি হারিয়ে যাব। অথচ আজ আমার হাটিয়াতে বাবার শক্ত করে দরে রাখতে হচ্ছেনা, আমারি জানাযায় সবাই এসেছে। এলাকার সবচেয়ে পুরনো মসজিদে আজ হাজারো মানুষের ঢল।
নামাজ শেষ হয়। জানাজা শেষ হয়। আমজাদ ভাই আর ছোট কাক্কু আমার পক্ষ থেকে সবার কাছে কান্নাজড়ানো কন্ঠে ক্ষমা প্রাথনা করে। ইমাম সাহেবও মোনাজাতের সময় হু হু করে কেঁদে ওঠেন। মসজিদে সবার মাঝে নীরব কান্নার রোল ওঠে। নামাজ শেষে সোনালি সবুজ কারুকাজ করা চাদরে ঢেকে দেয়া হয় আমার খাটিয়া।

মসজিদ থেকে ধীরে ধীরে বের হতে থাকি আমি। গেটের সামনে এসে দেখি বৃষ্টি পড়ছে। ‘আরে আজব তো! এতগুলি মানুষ কি আমার জন্য বৃষ্টিতে ভিজবে নাকি? কারো কাছেই তো ছাতা নেই, রেইনকোট নেই।
‘কিন্তু না, কেউই আর বাকি থাকে না। সবাই আমার খাটিয়া নিয়ে বের হয়ে আসে বৃষ্টির মাঝেই। হয়তো এটাই নিয়ম। মৃতের প্রতি অন্তিম শ্রদ্ধা হয়তো এভাবেই জানাতে হয়।
আমি আবার আসি বাসার সামনে। কবরস্থানের চল্লিশ কদম শেষ করতে হলে এ রাস্তা দিয়েই এক চক্কর ঘুরে যেতে হয়। গেটের সামনে সব মহিলাদের ভীড়। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই বারান্দা থেকে নেমে এসেছে সামনের খালি মত জায়গাটাতে। আমার দৃষ্টি খুজে বেড়ায় আম্মাকে দেখার জন্য।
‘আম্মা তুমি কই? তুমিকি এখনো বুঝছো না যে তোমার ছেলে চলে যাচ্ছে অন্য এক জগতে। তুমি কি এখনো ভাবছো আমি সন্ধ্যার পরই ফিরে আসবো বাড়িতে। আবার গিয়ে বসব আমার খাবার টেবিলে।
’হায়রে! এই পাগল মা’টারে কে যে বুঝাবে এই সত্যি কথাটা কে জানে!
‘আল্লাহ তুমি আমার মায়ের মনটা একটু শক্ত করে দাও। প্লিজ আল্লাহ, প্লিজ’

আঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। ধীরে ধীরে আমি ছাড়িয়ে যাচ্ছি আমার বাড়ির সীমানা। হঠাত চোখ যায় বাসার ছাদের দিকে।
‘আরে ছাদে ওটা কে!
’তনির মত লাগছে দেখতে।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই তো। বৃষ্টির মধ্যে একা ছাদে দাঁড়িয়ে এদিকে তাকিয়ে আছে কেনো?
’ঢাবির এইবিএতে বিবিএ সেকেন্ড ইয়ারে পড়া ব্রিলিয়ান্ট তনির তো এভাবে বৃষ্টিতে ভেজার কথা না।
‘আজ ওর চোখের গোল গোল চশমাটা কই’
কী অপূব সুন্দর একটা মেয়ে, অথচ নিষ্পাপ চোখ দুটি সব সময় কালো ফ্রেমে বন্দী করে রাখতো। দেশে এসে বিকেলে ছাদে উঠলে মাঝে মাঝে কথা হত, আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্কটা কেমন জানি অদৃশ্য সুতার মত একটা টান অনুভুত হত। প্রায় ১২ টা বছরের সেই অদৃশ্য সুতাটা ছিড়ে যায় গত বছর। আজকে আর ঐসব কথা কল্পনা করে লাভ নেই।
তনির সাথে গল্প করতাম, পাশা পাশি হাটতাম আনন্দ উল্লাস শেয়ার করে নিতাম। আর সেই তনিই আজ এলোমেলো বৃষ্টিতে একা দাঁড়িয়ে আছে ছাদে। কী অপূর্ব লাগছে দেখতে ওকে। ওর এই স্বর্গীয় অবয়ব তো আজকেই আমার প্রথম দেখা।
‘ও কি কাঁদছে?’
‘না, না ও কাঁদবে কেনো। ও তো আমার রক্তের সম্পর্কের কেও না। তাছাড়া ওর একটা অভিযোগের তীর আমার দিকে তাক করানো, সে কাঁদতেই পারেনা।
তবে কি রক্তের বাধনের চেয়ে আত্তার বাঁধন বড়?’ অভিযোগের তীরটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে? তাই হবে হয়তো।
অঝোর বৃষ্টি ওর গাল বেয়ে নিচে নেমে আসছে। চোখের জল মিশে বৃষ্টির অঝোর ধারার সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। আশ্চর্য! একটা অভিযুক্ত অপরিচিত মানুষের জন্য কারো মায়া থাকতে পারে! আমার জানা ছিলো না। নিথর দেহে যেন একটা শিহরণ খেলে যায়। মনে হতে থাকে ভালই তো ছিলাম এই পৃথিবীতে অজানা সব মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে। কেনো যে চলে যাচ্ছি। পরক্ষনেই মনে হয়, আমি চলে না গেলে তো জানতাম না আমার প্রতি সবার এই ভালোবাসার কথা। বুঝতাম না অদৃশ্য এই মায়ার টান কতটা প্রবল, কতটা স্বর্গীয়।

চল্লিশ কদম শেষে গোরস্তানে আমি পৌছাই সন্ধ্যা ৬টায়। আগে থেকেই খোদাই করে রাখা কবরটায় বৃষ্টির কারণে সামান্য পানি জমেছে। ওটাই এখন সেচে ফেলা হচ্ছে।
আমার খাটিয়া সামনে ধরে আছে আব্বু আর সজীব, পেছনে সাজ্জাদ ভাই আর ছোট কাক্কু। আমি আব্বুকে চিতকার করে বলি- ‘আব্বু আমায় নিচে নামিয়ে রাখো। সন্তানের লাশের ভার তো পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী। কেমন করে বইছ এই বোঝা!’
কিন্তু আমি তো আজ বোবা। যতই চেচাই না কেন, এই জাগতিক পৃথিবীতে কেউ আজ আমার কথা শুনবে না, কেউ আমার কথার জবাব দেবে না।
মনে আছে আমি একদিন মিষ্টি খাবার বাইনা দরেছিলাম, বাবা কাধে করে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল বাজারে। সেইদিন বাবার মুখে আনন্দের হাসি ছিল ছেলেকে সে বাজারে নিয়ে এসেছে। আজও বাবা আমাকে কাধে নিয়ে রেখেছে কিন্তু সেইদিনের আনন্দের হাসিটা আজ চাপা কষ্ট হয়ে কান্নার জলে বিন্দু বিন্দু করে গাল হয়ে বুক বেয়ে মাটিতে পরছে।

ধীরে ধীরে আমার দেহ নামিয়ে দেয়া হয় সাড়ে তিন হাতের অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে গর্তটাতে। চাটাই দিয়ে ঢেকে দেয়ার পর সবাই মাটির ঢেলা তুলে নেয়। আমি ঢাকা পড়ি মাটির স্তুপের আড়ালে। লাগানো হয় ঘাস, দেয়া হয় ফুল। এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে কারো যেন কোন তাড়া নেই। সবাই মোনাজাত ধরে। কী সুন্দর করে কোরান পাঠ করেন ইমাম সাহেব। আত্তার মাগফিরাতের জন্য পরওয়ারদিগারের দরবারে জানানো হয় অন্তিম ফরিয়াদ।
দূর মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসে। চারিদিকে ধীরে ধীরে নেমে আসতে থাকে অন্ধকার। কেমন যেন কাঁপনলাগা শীতল অনূভুতি। আস্তে আস্তে জটলা কাটতে থাকে। একজন দুজন করে পা বাড়ায় বাড়ির পথে, কেউবা মসজিদ পানে। হঠাত কারো কান্নার আওয়াজ পাই।
‘আরে, সবকিছু তো করা শেষ। এখন আবার কাঁদে কে!’
কান পেতে থাকি ওই কান্নাশব্দ পানে। বুঝতে পারি, এ যে আমার বাবার কন্ঠ। এবার আর বাবা নিঃশব্দে কাঁদছে না। হাউমাউ করে একেবারে শিশুর মতো কাঁদছে। এলোমেলো ভাবে কতো কিছুই না বলে যাচ্ছে। হয়তো পুত্রের অকাল প্রস্থানে পিতৃহদয় সৃষ্টিকর্তার আরশে আবারো ফিরে পাবার আকূল আবেদন জানাচ্ছে।
‘কিন্তু বাবা, এতো আর হবার নয়। এ যে বিধাতার বিধানে নেই। তুমি কেঁদো না বাবা, আমার কষ্ট লাগছে
’চাচার কাঁধে ভর দিয়ে বাবাও বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
‘যাক, বাঁচা গেলো। সারাদিন সবার চোখের পানি দেখতে দেখতে আমি এখন বড্ড ক্লান্ত। কেমন যেন ঝিমুনি আসছে। আমি এখন ঘুমাবো। অনন্তকালের সেই ঘুম যে কবে ভাঙ্গবে কেউ জানে না।
’আশেপাশে দেখে নেই, কেউ নেই তো আবার।
আরে!!!
আমার দুটা কবর পরে কিনারায় দাঁড়ানো আবছা ছায়াটা কার?
ভালো করে খেয়াল করতেই দেখি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে সজীব। অঝোর বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আমার আদরের ছোট্ট ভাইটা।
‘ভাইরে, তুই বাড়ি যা। এভাবে ভিজিস না। তোর যে ঠান্ডা লেগে যাবে রে। আব্বু আম্মার কতো সপ্ন ছিলো- দুই ছেলে অনেক বড় হবে উনারা কিছুদিন সিঙ্গাপুর কিছুদিন বাংলাদেশে বেড়াবে, আমি তো সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম নারে। কিন্তু তোকে যে পারতেই হবে। তুই এভাবে ভেংগে পড়লে আব্বু আম্মুকে দেখবে কে! তুই বাড়ি যা, প্লিজ।
’আমার কথা বুঝি ওর কানে পৌছে। মাথা নিচু করে বেরিয়ে যেতে থাকে মেইনগেট ধরে।

আহ, কি শান্তি। আজ থেকে আমার আর কোন কাজ নেই। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। আড্ডা দেবার আকূলতা নেই। আমার প্রতি কারো আর কোন দাবি নেই। কারো প্রতি আমার আর কোন অধিকার নেই। কিন্তু এই মুক্তি নিতে যে আমি হারিয়ে ফেললাম আমার চারপাশের জগতটাকে। নিদয়ভাবে ছিন্ন করলাম সব মায়ার বাঁধন। বঞ্চিত হলাম বাবার স্নেহ আর মায়ের মমতার পরশ থেকে। হারিয়ে ফেললাম ভাইয়ের হাসিমাখা মুখটা দেখার সুযোগ। এই মুক্তি যে জোয়ারের টানে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো আমার আড্ডার আসর, আমার আপন খেলাঘর। তবে কি আমি ঠকে গেলাম!!

‘না, আর কিছুই চিন্তা করতে পারছি না। আমার এখন একটু ঘুমের দরকার। আমি এখন ঘুমোবো।’

(সম্রাট কে নিয়ে লেখা "সপ্ন হত্যার এক বছর" গল্পটার অনুকরনে লেখা, আমার ছোট্ট কাক্কু অনেকদিন পূর্বেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু গল্পটার একটা সু্ন্দর সমাপ্তির দিকে নিতে কাক্কুকেও রাখতে হল। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি আামর কাক্কুকে যেন জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান করে দেন।)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ৯:২০

শারলিন বলেছেন: আসাধারন লেখা...............।

১২ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১:১৬

দুঃখ হীন পৃথিবী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.