নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিহঙ্গ...

তাশমিন নূর

পথ ছাড়া নাই কিছু অনন্ত পথের অন্তর্ধানে।

তাশমিন নূর › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্পঃ ভিক্ষুক

০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১২:৪৮

-চাচা মিয়া, পক্ষীর চোখ কই? চোখ ছাড়া পক্ষী আবার কেমন পক্ষী?

আফসার সাহেব নিজের আঁকা কবুতরটির দিকে তাকালেন। সত্যি সত্যি চোখ আঁকা হয়নি। তিনি একটি চোখ এঁকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চা ছেলেটির দিকে তাকালেন। পরনে আকাশী রঙের পায়জামা-পাঞ্জাবী, মাথায় টুপি। টুপিটা মাপে একটু বড়, পাঞ্জাবী ছোট। ধূলা-বালিতে শরীর সাদা হয়ে আছে। হাতে মাঝারি সাইজের একটি ঝোলা। রোদে পোড়া ফর্সা ত্বক, তবে চেহারা খুব মায়াবী। বড় বড় টলটলে চোখে কৃষ্ণপক্ষের আঁধার। ভর দুপুরে এই রুক্ষ পরিবেশে ঝোলা হাতে একে কতই না বেমানান লাগছে। আফসার সাহেবের মায়া হল ছেলেটির জন্য। পাশে একটি টুলের ওপর ডাবের পানি রাখা ছিল। তিনি এক গ্লাস ঢেলে ছেলেটির দিকে এগিয়ে দিলেন। প্রায় এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু শেষ করল সে।

আফসার সাহেব বললেন,

-তুমি ভিক্ষা কর কেন? বাবা-মা কী করে?

-আমি ভিক্ষা করি না। সাহাইয্য চাইতে আসছি। মাদ্রাসা থেকে পাডাইছে।

আফসার সাহেব ভ্রূ কুঁচকালেন। গ্রামের মাদ্রাসাগুলো কি এভাবেই চলে নাকি? তাও আবার এই আগুন গরম রোদে বাচ্চা ছেলেদের পাঠানো হয়েছে।

-তোমার সাথে কত জন আছে?

ছেলেটি পাঁচটি আঙ্গুল দেখাল। মানে তার সাথে আরও পাঁচ জন আছে।

-বাকীরা কই?

-আশে পাশেই আছে।

-তুমি কোন মাদ্রাসা থেকে এসেছ?

ছেলেটি বিরক্ত হল। এই ছবি-মানুষটা তাকে এত প্রশ্ন কেন করছে সে বুঝতে পারছে না। সাহায্য দেবার হলে তাড়াতাড়ি দিয়ে দেবে। তা না করে আলাপ করছে। তবু সে বিরক্তি গোপন করে বলল,

-হেদায়েতপুর মাদ্রাসা।

আফসার সাহেব সরল মানুষ। তিনি ছেলেটির কথা অবিশ্বাস করলেন না। বললেন,

-তুমি একটু বোস। আমি আসছি।

এই বলে তিনি জামরুল তলা ছেড়ে বাড়ির ভেতর গেলেন। গায়ের পাঞ্জাবীটা জামরুল গাছের একটি ডালের সাথে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। ওটা গায়ে চাপাতে ভুলে গেলেন। ছেলেটিকে দেখে তাঁর ক্ষুধার্ত মনে হয়েছে। তাকে কিছু খেতে দেয়া যায় কিনা সেটা দেখতেই তিনি বাড়ির ভেতর গেলেন।



সকালের কিছু পিঠা নিয়ে ফিরে এসে দেখেন ছেলেটি নেই। জামরুল গাছের নিচে পাঞ্জাবীটা পড়ে আছে। আফসার সাহেব পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দিয়ে দেখেন টাকাটা নেই। শ’ খানেক টাকা ছিল পকেটে। টাকাটার জন্য তাঁর তেমন দুঃখ হল না। কিন্তু যখন দেখলেন ছবির খাতাটাও নেই তখন খুব মন খারাপ হল। কথা ছিল, খাতাটা পুরোপুরি ছবিতে ভর্তি হয়ে গেলে সবচে ছোট নাতনীকে উপহার হিসেবে দেবেন।



চাকরী থেকে অবসর নেয়ার পর ছবি এঁকেই বেশিরভাগ সময় কাটছে তাঁর। বোন আর ভগ্নিপতির অনুরোধে বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন কয়েক দিন হল। আসার সময় ড্রয়িং খাতাটা আনতে ভোলেন নি। স্কুল জীবনে ভাল ছবি আঁকতেন তিনি। জীবন যুদ্ধে পড়ে সেসব গুণ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এখন এই অবসরে এসে যেন কৈশোরেই ফিরে যেতে চাইছেন। মন খারাপ ভাব কমাতে গ্রামের পথে বিকেলের দিকে হাঁটতে বের হলেন। হাঁটতে হাঁটতে তাঁর মনে হল, হেদায়েতপুর মাদ্রাসা থেকে ঘুরে আসলে কেমন হয়। গ্রামের লোকজনদের জিজ্ঞেস করে করে হেদায়েতপুর মাদ্রাসা পর্যন্ত চলে গেলেন তিনি। ভাঙ্গাচোরা টিনের একটি ঘর। আফসার সাহেবের মন যথেষ্টই খারাপ হল। এলাকার বিত্তবানেরা এগিয়ে এলে কি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন করুন দশা হত? ঘুরে ফিরে সন্ধ্যার পর তিনি ঘরে ফিরলেন। রাতে চোখ লেগে আসতেই দুপুরের সেই সাহায্যপ্রার্থীকে স্বপ্নে দেখলেন। সকালবেলা মাদ্রাসা চলাকালীন সময়ে তিনি আবারও গিয়ে ঢুঁ মারলেন মাদ্রাসায়। প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলে জানতে পারলেন, মাঝে মাঝে মাদ্রাসার ফান্ডে অভাব দেখা দিলে ছাত্রদের নিজ নিজ গ্রামে পাঠানো হয় সাহায্যের জন্য এটা সত্যি। তবে গত কয়েক মাসেও এই ধরনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আফসার সাহেবের মন বিষণ্ণ হয়ে গেল। সেই বিষণ্ণতা গ্রামে তাঁর শেষ দিন থাকা পর্যন্ত থাকল।



ঢাকায় যাবার দিন ভগ্নিপতি রেল স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন তাঁকে। নিজের জরুরী কাজ থাকায় ট্রেনে তুলে দিয়ে যেতে পারলেন না। টিকেট কাটার কিছুক্ষণ পর আফসার সাহেব জানতে পারলেন ট্রেন লেট হবে। তিনি স্টেশনের আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে একটা গাছের ছায়ায় বসে পড়লেন। একটা কাঠি দিয়ে মাটিতে ষোল গুটি খেলার ঘর করছিলেন। হঠাত কেউ এসে বলল,

-চাচা, কাইল থেইকা কিছু না খাইয়া আছি।’

চোখ তুলে দেখেন সেদিনের সেই ছেলেটি। তিনি ভেবেছিলেন তাঁকে চিনতে পেরে ছেলেটি পালিয়ে যাবে। কিন্তু সেটা না করে সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। যেন যে কোন শাস্তি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত। আফসার সাহেব হাত ধরে টেনে পাশে বসালেন তাকে। জিজ্ঞেস করলেন,

-তোমার নাম কী?

-নবাব।

-ভিক্ষা কর কেন?

-আমারে কেউ কাম দেয় না যে।’

-আমি জানতে চাইছিলাম তোমার অভিভাবক মানে বাবা-মা কেউ নেই?

-মা আছে।

-বাবা কোথায়?

-আমাগোরে থুইয়া চইলা গেছে।

-কোথায়?

-জানি না। তয় হুনছি অন্য জায়গায় সংসার পাতছে।

-মা কী করে?

-মার ওসুখ। কাজ-কাম করতে পারে না।

-কী অসুখ?

-জানি না। খুব কাশি হয় আর মুখ দিয়ে রক্ত বাইর হয়।

আফসার সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে একটা দোকানের দিকে এগিয়ে গেলেন। একটা কলা, একটু আলু ভাজি আর তিনটা পরোটা এনে খেতে দিলেন নবাবকে। নবাব একটা পরোটা আর ভাজি খেল। কলা আর বাকী দুটো পরোটা ঠোঙ্গায় ভরে মুড়ে পাঞ্জাবীর পকেটে রাখল।

-বাকী দুটো পরোটা কার জন্য রাখলে?

-মা আর বইনও না খাইয়া আছে।

আফসার সাহেবের বুকের ভেতরটা টন টন করে উঠল। জীবনে আর কোন ভিক্ষুকের জন্য তো তাঁর এমন অনুভুতি হয়নি! তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

-সেদিন মায়ের অসুখের কথা বললেই পারতে। আমি একটু বেশি করে টাকা দিতাম।

নবাব বলল,

-মার ওসুখের কতা কেউ বিশ্বাস করে না গো চাচা। গেরামে ভিক্ষা করতে গেলে মাদ্রাসার কতা কই। মানুষ বেশি কইরা ধান-চাউল দ্যায়।

কথাটা বলে সে মাথা নিচু করে থাকল। আফসার সাহেব দেখলেন, নবাব নামের নয়-দশ বছরের এই ছোট্ট ভিক্ষুকটি কাঁদছে। চোখের পানি ফোঁটায় ফোঁটায় গাল বেয়ে নেমে আসছে। তিনি বললেন,

-চল, তোমাদের বাড়ি যাব।

নবাব কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ‘চলেন’।

ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছিল। সেই শব্দ উপেক্ষা করে তিনি এক জনের ভিক্ষুকের পিছু পিছু হেঁটে চললেন।



কবিতায় পড়া আসমানীদের বাড়ির মতই নবাবদের বাড়ি। আসমানীদের বাড়ির ছানি ছিল ভেন্না পাতার। নবাবদের অবশ্য টিনের। কিন্তু উপরে তাকালে সহস্রটা বড় বড় ফুটো চোখে পড়ে। সন্দেহ নেই, একটু বৃষ্টি-বাতাস হলে এই ঘরেও পানি গড়িয়ে পড়ে। ঘরের এক কোনে একটা মাত্র চৌকি পাতা। তাতে একজন মহিলা শুয়ে আছেন। মহিলার মাথার পাশে সাত-আট বছরের ফুটফুটে একটি মেয়ে ময়লা একটা ন্যাকড়া হাতে বসে আছে। ন্যাকড়ায় রক্ত লেগে আছে। কাশির দমকে দমকে মায়ের মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, আর মেয়ে খুব যত্ন করে বার বারই ন্যাকড়া দিয়ে সেই রক্ত মুছে দিচ্ছে। পুরো ঘরে দম বন্ধ করা অসুস্থ পরিবেশ। আফসার সাহেব চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি কাছের সরকারি হাসপাতালে নবাব আর শিউলির মাকে ভর্তি করে দিলেন। সন্ধ্যার দিকে ওদের মা মারা গেল।



নবাব আর শিউলির সাথে দুই দিন কাটিয়ে দিলেন তিনি। ভগ্নিপতিকে ফোন করে জানালেন তিনি ভাল আছেন। চিন্তা যেন না করে। ঢাকা থেকে ছেলে ফোন করলেও একই কথা বললেন। কিন্তু কোথায় আছেন জানালেন না। যাবার দিন নবাব আর শিউলিকে একলা ফেলে যেতে তাঁর মন চাইছিল না। তাঁর ইচ্ছে করছিল দুই ছেলে মেয়েকে সাথে করে নিয়ে যেতে। কিন্তু তাদের নিজেদেরই টানা-পোড়েনের সংসার। ছেলে আর ছেলের বউ অনর্থ বাঁধাবে। তিনি নবাব আর শিউলিকে দুই সেট নতুন জামা কিনে দিলেন। দুই ভাই-বোনকে জিজ্ঞেস করলেন,

-তোমরা একা থাকতে ভয় পাবে না?

-না, আমরা এক লগে থাকুম। ভয় পামু না।

-খাবে কী?

-দুই জনে মিল্ল্যা ভিক্ষা করমু।

আফসার সাহেব নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন,

-আমার সাথে ঢাকায় যাবে?

দুই ভাই-বোনের বিস্ময়ের সীমা রইল না। একটা মানুষ তাদের চেনে না, জানে না, অথচ কত কী করল তাদের জন্য। উত্তর দেবার আগেই দীর্ঘ হুইসেল বাজাতে বাজাতে ট্রেন চলে এল। আফসার সাহেব উত্তরের অপেক্ষা না করেই ট্রেনে উঠে পড়লেন। এমনকি নবাব আর শিউলির হাতে কিছু টাকা দেবার কথাও ভুলে গেলেন তিনি। চোখ ভরা জল নিয়ে দুই ছেলে মেয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে রইল। আজ থেকে তারা দুজনেই ভিক্ষুক।





সেদিন ঢাকায় ফিরেই আফসার সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শেষ মুহূর্তের একটি ভুল তাকে ভীষণ পীড়া দিতে লাগল। তাঁর বুকে ব্যথা হতে লাগল। নয়-দশ বছর বয়সে তাঁর ছেলে বাবুল রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর ফেরে নি। মৃত্যুর আগের দিন তাঁর মনে হল, নবাবের সাথে বাবুলের চেহারার খুব মিল। হয়তো বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বাবুলও ভিক্ষা করেছে। মৃত্যুর ঠিক আগে আগে তিনি নিজের ছেলেকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই ভাষা কেউ বুঝতে পারে নি।

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১:৪০

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: গল্প ভালো লেগেছে। চমৎকার ঝরঝরে লেখা!
সামনে আরো ভালো লেখা পাবার প্রত্যাশা রইল।

শুভরাত!

২| ০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ২:৫৮

প্রবাসী পাঠক বলেছেন: প্রাঞ্জল লেখনী। খুব ভালো লাগল। শুভ কামনা রইল।

৩| ০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ ভোর ৪:০৭

শান্তির দেবদূত বলেছেন:
জীবনের গল্প, কষ্টের গল্প, ভালভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। গতিশীল কাহিনী, সাবলিল লেখার স্টাইল, সুন্দর প্লট ও চমৎকার ফিনিশিং সব মিলিয়ে স্বার্থক একটি ছোট গল। এমন লেখা সামনে আরও পাব আপনার কাছ আশা করি। শুভেচ্ছা রইল।

৪| ০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ৭:৫৬

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: চমৎকার গল্প। লিখন শৈলী আকর্ষণীয়।

ধন্যবাদ, তাশমিন নূর।

৫| ০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ৮:১৪

জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন:
ডিডেইলস বর্ণনা ৷ পড়তে ভাল লাগল ৷

৬| ০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:৪০

সুমন কর বলেছেন: গোছানো লেখা। পড়তে ভাল লাগল।

৩ প্লাস।

৭| ০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১২:২৪

C/O D!pu... বলেছেন: ভালো লাগলো...

৮| ২৩ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১২:১২

তাশমিন নূর বলেছেন: মতামত এবং উতসাহ প্রদানের জন্য ধন্যবাদ সবাইকে। সাথে থাকুন।

৯| ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১:৩৪

ইমরান নিলয় বলেছেন: সুন্দর

১০| ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৪:৪১

তাশমিন নূর বলেছেন: Dhonnobad.

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.