নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি ছটফটে, পাগলা কিছিমের, জঘন্য টাইপের বদরাগী, সাইকো লেভেলের একজন মানুষ। শুধু ছবি তুলতে গেলে উপাধিগুলো বাদ যায়!!!

চিত্রযোধী আবির

ক্ষনিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে...

চিত্রযোধী আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

“নীরব ভালোবাসা”

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:১১

শশী বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। জানালার পর্দা গলে আলো আসছে। আর শশীর কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে চুরমার। কিছুটা কসরত করে জানালার পর্দা ঠিক করে দেয় শশী। মানে আলো প্রবেশের সব পথ বন্ধ করে দেয়। আর মনে মনে হাসতে থাকে। সূর্যের তেজ এই ভোরে কম হওয়ার পরেও কিংবা পুরু পর্দা সত্ত্বেও আলো ঠিকই আসছে।

কয়েক বছর আগে হলে শশী সারা ঘরে সূর্যদেবের আগমন নিশ্চিত করত। প্রতিটা কোনে, দেয়ালের মাঝে প্রতিটা মোজাইকে, তার আয়নায়। কিন্তু এখন শশীর সূর্য বা তার মৃদু আলো ভালো লাগে না। তার এই রুমে কেন, বাথরুম ছাড়া ছোট এই বাড়িটায় আর কোথাও কোন আয়না নেই। শুধু দাঁত মাজতে আয়না দরকার শশীর, দাড়ি-গোঁফ কিংবা চুলে চিরুনি বুলানো এখন শশীর কাছে বাহুল্যতা

ধীরে ধীরে শশী প্রাত্যহিক কাজগুলো শেষ করে রান্নাঘরে যায়। একলা মানুষ শশী। থানা সদরের কিছুটা দূরে, বাজারের পাশে একটা একতলা বাড়ির একটা অংশ ভাড়া নিয়ে থাকে। কোনকালে এখানে এসে কিছুদিন কাজ করেছিল, তখন পরিচয় হয় এই বাড়ির মালিক এবং এখানকার কলেজের ইংরেজির শিক্ষক বদিউল হক সাহেবের সাথে। আর তখন থেকেই আপন করে নেন তিনি শশীকে। এর পর প্রায় ৩ বছর পর শশী যখন এখানে এসে বাড়ি ভাড়া চায়, বদি সাহেব সানন্দে নিজের বাড়ির পেছনের অংশ শশীর মর্জিমাফিক তৈরি করে দেন। ৩ টা কামরার ছোট্ট একটা ঘর। না আছে বারান্দা, না আছে রঙ বা চুনকাম। শুধু কংক্রিটের কঙ্কালে সিমেন্ট দিয়ে লেপটে দেয়া একটা কাঠামো। এখন এটাই শশীর পৃথিবী।

শশীর ঝুট কাজ করে দেয়ার জন্য বদি সাহেবের ছোট মেয়ে কণা একটা ছেলে ঠিক করে দিয়েছে। সেলিম নাম। সে আসে ঠিক ৮ টায়।

শশী রান্নাঘরে ঢুকে চা বানিয়ে ধীরে ধীরে তার পড়ার ঘরে আসে। এখানে তিনটা রুম, একটাতে শশী ঘুমায়, মানে শোবার ঘর, একটাতে শশী পড়ে, সেখানে অনেক বইয়ের ভিড়ে শশীর টাইপ-রাইটারের খটখট আওয়াজ বাইরের নেড়ি কুকুরটাকে অস্থির করে তোলে। ডিজিটাল যুগে টাইপরাইটার যাদুঘরে থাকে। আর শশী কোন অংশে অর্বাচীন?

সেলিম এসে ঘরে ঢুকে চটপট শশীর বিছানা গুছিয়ে রান্নাঘরের সব চায়ের কাপ আর অন্যান্য অপরিষ্কার থালা-বাটি পরিষ্কার করতে থাকে। শশী জানে সেলিম এটা শেষ করে ঘর ঝাট দিয়ে মুছবে। এরপর কাপড় ধুয়ে বাথরুম পরিষ্কার করে নিজে গোসল করে চলে যাবে।

আর নাস্তা বদি সাহেবের ছোট মেয়ে কণা নিয়ে আসে, বাসা ভাড়ার সাথে শশী মাস-কাবারী খাবার খরচ দেয়। আসলে সে দেয়না, দেয় তার পূজ্য পিতা। অথবা বলা যায় স্বর্গবাসী পূজ্য পিতা। বাবার রেখে যাওয়া সঞ্চয় ব্যাংকে রাখা, সেখান থেকে তার নামে মাসে সুদের টাকা আসে। যা শশীর জন্য যথেষ্টর চাইতেও বেশি। একলা মানুষ, খরচ বলতে চা আর সিগারেট। আর কিছু ওষুধ।

শশী তার পড়ার রুম থেকে বের হয়ে মাঝখানের ছোট আর শূন্য রুমটাতে এসে ইচ্ছা করে সিগারেটের ছাই পরিষ্কার মেঝেতে ফেলতে থাকে। সারা ঘরে ঘুরে ঘুরে সে কাজটা করতে থাকে। শশী চোখ বন্ধ করেই দেখতে পায় এর পরে কি হবে।

সেলিম বাথরুম থেকে গোসল সেরে বাইরে এসেই সারা ঘরে ছাই দেখে কিছু না বলে সোজা কণার কাছে গিয়ে নালিশ দিয়ে চলে যায়। প্রতিদিনের ঝামেলা এটা। মনে মনে বিড়বিড় করে সে শশীর বংশ উদ্ধার করতে করতে স্কুলে যেতে থাকে। প্রতিদিন ঘর পরিষ্কার করার সাথে সাথে অপরিষ্কার করার কি দরকার ? সেলিম বুঝে পায়না।

কণা সকালের নাস্তা নিয়ে শশীর কাছে এসেই বলতে থাকে, “প্রতিদিন এভাবে ঘর অপরিষ্কার করেন কেন? ছেলেটা কষ্ট করে ঘর গুছায় আর আপনার কাজ দেখে কষ্ট পেয়ে চলে যায়, আপনার নিজের খারাপ লাগে না এমন অপরিষ্কার ঘরে থাকতে???”

বলেই কণা চুপ করে যায়। সারা ঘরে শূন্যতা। শূন্য ঘরে শূন্যতা।

গত ২ বছর ধরে শশী তাদের বাসার ভাড়াটিয়া। অথবা পেয়িং-গেস্ট। অনেকদিন ধরেই শশী কাজটা করে। প্রতি সকালে। কণাও এসে ধমকায়। আর উত্তর গত দুই বছরে একবারও পাল্টায়নি।

শশী কণার দিকে তাকিয়ে সেই চিরচেনা উত্তর বলতে যাওয়ার আগমুহূর্তে কণা দৌড়ে এসে শশীর হুইলচেয়ারটার হ্যান্ডেল ধরে টেনে নিয়ে বাইরে নিয়ে যায়। কণার বাবা বদি সাহেবের বাগানে নিয়ে হুইলচেয়ারের পাদানিটা নামিয়ে শশীর পা দুটো মাটিতে রাখে। যত্ন-ছাড়া, কোনরকম থেরাপি ছাড়া এতদিনের ফেলে রাখা পাগুলো কেমন যেন বিকলাঙ্গের মতো লাগছিল শশীর কাছে। তার চাইতেও অদ্ভুত লাগছিল মাটির শীতলতা, ভেজা ভেজা ভাবটুকু!

আপ্রাণ চেষ্টা করছিল শশী পায়ের আঙ্গুলগুলো ভেজা মাটির বুকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গর্ত করতে। কিন্তু পারছিল না। আর সে বেদনা, সে পঙ্গুত্ব শশীর চোখে চকচক করছিল। যে আলো শশী গত দুটি বছর নিজের জীবনে পরতে দেয়বি, সেই সূর্যের আলো শশীর চোখের মনিতে জমা পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছিল।

গত দুটি বছর কণা প্রতিনিয়ত শশীর কাছ থেকে একটি উত্তরই পেয়েছে। শশী যতবার কথাটা বলেছে, কণা ততবার মেঝেতে পরে থাকা ছাই হয়েছে।

শশী বলত, “মেঝে ময়লা হলেও কিছু কি যায় আসে?? আমার পায়ে কি ছাই লাগে??”

শশীকে বাগানে রেখেই কণা দৌড়ে চলে আসে নিজের রুমে। কান্না আর কষ্ট লুকানোর জন্য তার বালিশটা অনেক দরকার আজ।

গত দুটি বছর কণার সব কষ্টের সাক্ষী তার বালিশটা। বাইশ বছরের তরুণী গত দুটি বছর পঙ্গু একটা মানুষকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসে গেছে। বড় বোনের বিয়ের পর তার বিয়ের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব আসা সত্ত্বেও সে অটল থেকেছে তার নিঃস্বার্থ আর বোবা ভালোবাসার প্রতি।

শশী যখন আজ থেকে পাঁচ বছর আগে তাদের এখানে কাজ করতে আসে, তখন সে মাত্র কৈশোর পার করা মফস্বলের এক তরুণী। কলেজে সবে পা দিয়েছে। সাহসের সর্বোচ্চ গণ্ডি ছিল বান্ধবীদের সাথে সিনেমা দেখতে যাওয়া। তেমনই একদিন সে দেখে, জিন্স আর টিশার্ট পরা এক ছেলে বাজারের চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিল আর সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হয়েছিলো কণা। কেননা, তখনকার ফ্যাশনছিল ঢোলা জিন্স, কোমর থেকে খুলে পরে যায় যায় অবস্থা। হাতে ব্যান্ড, আর চুল লম্বা আর উশকো খুশকো। তার এলাকার সব ছেলেরা টিভি আর সিনেমা দেখে নতুন স্টাইলে চলত। কিন্তু এই ছেলেটা এলাকায় নতুন, আগে দেখেনি, কাঁধে বড় একটা ব্যাগ, কোমরে জিন্স, কিন্তু তখনকার দিনের মতো ঢোলা না। পরে অবশ্য জেনেছিল, এই স্টাইলের জিন্সকে ডেনিম জিন্স বলে। টি-শার্ট আর হাতে একটা ঘড়ি। যেখানে দুটি কাটা ছাড়া আর কিছুই নেই, এমনকি নেই কোন লেখা।

পরে বাসায় এসে জানতে পারে, সেই ছেলেটার নাম শশী। ঢাকায় একটা এনজিও তে পার্ট –টাইম কাজ করে। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নানা বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করে। কখনোবা টুরিস্ট গাইড হয়। পাশাপাশি পড়ালেখা করে ভার্সিটিতে। সাবজেক্টটাও খটমটে ছিল কণার জন্য। এনথ্রোপলজি।

শশী কণাদের বাসায় এক সপ্তাহ থাকবে, এখানে কিছু কাজ করবে। এমন কিছু একটা শুনে বেশ খুশি হয়েই কণা নিজের রুমে আসে।

সদ্য তরুণী কি জানত, শশী তার জীবনে কিভাবে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছিল?

শশীর গাইড হিসেবে বদি সাহেব নিজের ছোট মেয়েকেই ঠিক করে দিয়েছিলেন। কণাও মহা উৎসাহে শশীর সাথে সারা জেলা ঘুরে বেড়াতে লাগলো। শশীর কাছে সেটা ছিল কাজ, আর কণার জন্য একটা পিকনিক বৈ আর কিছুই না। তরুণীর জীবনে প্রথম কোন মানুষ, যার সাথে রিকশায় চড়ার সময় কাঁধে মৃদু স্পর্শ কাঁপিয়ে দিত তার সারা শরীর। কখনো শশীর কথা, কখনোবা শশীর অবজ্ঞা। সব ভালো লাগতে শুরু করে কণার। মাঝে মাঝে শশী কার সাথে যেন কথা বলতো। অনেকক্ষণ। কণা ভাবতো, হয়ত অফিসের ফোন।

সপ্তাহটা কিভাবে যেন চোখের পলকে শেষ হয়ে যায়। সময় হয়ে আসে শশীর প্রস্থানের। সেদিন কণা তার নোট খাতার একটা পাতায় লিখেছিল তার অনুভূতি। তার ভালোবাসার কথা। কেনই না ভালবাসবে এমন একটা মানুষকে?

একটা সপ্তাহ সে মানুষটার সাথে ছিল। সকাল থেকে সন্ধ্যা। মুক্ত-চিন্তাধারী বাবাও তাকে যেতে বলেছেন, বলেছেন ছেলেটা অদ্ভুত। দেখেছে ছেলেটাকে নিজের বাবার সমান বয়সী মানুষের সাথে, তার বাবার সাথে অবলীলায় সিগারেট খেটে। আর সে নিজে দেখেছে, ছেলেটা একবারের জন্যও কণার চোখের দিকে না তাকিয়ে কথা বলেনি। অন্য সব ছেলেরা চোখ দিয়ে সারা শরীর দেখত। কিন্তু শশী?

ছেলেটা সবসময় চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলত। জিজ্ঞেস করেছিল কণা, চোখের মাঝে কি আছে?

শশী বলেছিল, চোখে নাকি আকাশের তারারা বাসা বেঁধেছে। সবার চোখেই আছে নীহারিকা। সেটা কি না দেখে উপায় আছে?

কণা বুঝতে পারেনি সেদিন কথাটার অর্থ। বুঝেছিল যখন সে শশীকে তার প্রথম লেখা চিঠি, কিংবা প্রথম লেখা প্রেম-পত্রটা দিতে গিয়েছিল। শশীর রুমের বাইরে দাড়িয়ে সে শুনতে পেয়েছিল, শশী কাকে যেন বলছে, সে এবার এসেই সব রাগ ভাঙ্গাবে। বলেছিল শশী কাকে যেন, নাম না জানা কোন এক ভাগ্যবতীকে, তাকে শশী ভালবাসে।

কান্না করেনি সেদিন কণা। শুধু বাগানে দাড়িয়ে চিঠিটা মাটিতে পুঁতে ফেলে চলে এসেছিল। কাদেনি কণা সেদিন, শুধু বুঝতে পেরেছিল, কিভাবে চোখের মনিতে নীহারিকা থাকে।

এরপর দিনগুলো কেটে যায় কণার, শুধুই কেটে যায়। তাতে কোন ঢেউ ছিলনা, কোন কম্পন ছিলনা। শুধু ছিল নিশ্চলতা।

দু’বছর আগে যেদিন হঠাৎ বদি সাহেবের কাছে ফোন আসে শশীর, সেদিনও কণা জানত না কি হয়েছে। শুধু জেনেছিল, কেউ একজন আসছে তাদের বাড়ির পেছনের খালি জায়গাটাতে থাকতে, সে হিসেবে ফরমায়েশ পাঠিয়েছে। জানতে ইচ্ছা ছিলনা কণার এসব। আসলে ইচ্ছা নামের কোনকিছুই ছিলনা কণার কাছে।

সেদিন বিকালে বাসায় এসে জানতে পারে, নতুন ভাড়াটিয়া এসে গিয়েছে, তার কাজ খাবার দিয়ে আসা। কণা খাবার নিয়ে সেই নতুন ভাড়াটিয়ার কাছে যায়। এবং ভেতরে ঢুকে পুরানো সেই অদ্ভুত মানুষটাকে নতুন রুপে দেখে বহুদিন পর নিজের চোখে নীহারিকাগুলোর অস্তিত্ব অনুভব করে কণা। একটা হুইল-চেয়ার, তাতে বসে আছে তার মনের মানুষ। আজ পরনে ডেনিম জিন্স কিংবা টি-শার্ট নেই মানুষটার, নেই সেই ছোট করে কাটা চুল, নেই মুখে সেই হাসি। লুঙ্গি আর একটা শার্ট পরে মাথা ভর্তি চুল আর মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল নিয়ে বসে আছে সেই অদ্ভুত মানুষ শশী। কিছুই আগের মতো নেই, আছে শুধু কালো ডায়ালের সেই দুই কাঁটাওয়ালা ঘড়িটা।

শশীকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি কণা। আগের মতই হইচই করে শশীকে খাইয়ে দিয়ে শশীর খাটে মশারি খাটিয়ে তাকে বিছানায় শুইয়ে চলে আসে কণা। কিন্তু নিজের রুমে কান্না ধরে রাখতে পারেনি। সারারাত কেঁদেছিল তরুণী, আর পাশের বারান্দায় দাড়িয়ে মেয়ের কষ্টটুকু অনুভব করেছিল পিতা।

বদি সাহেব শশীর খবর কলেজ থেকে পেয়েছিলেন। শশীর এনজিও এর একজন তাঁরই কলেজের এক লেকচারারের আত্মীয়। সেই সুত্রে শশী এখানে সাহায্য চেয়েছিল। আর বদি সাহেবও হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কথায় কথায় শশী নামের সংস্কার মুক্ত ছেলেটার প্রতি একটা মুগ্ধতা চলে আসে বদি সাহেবের। তাই তো গাইড হিসেবে নিজের মেয়েকেই বেছে নিয়েছিলেন। মানুষ চিনতে কখনো ভুল হয়নি বদি সাহেবের। বুঝতে পেরেছিলেন, এই ছেলে অন্যরকম। ছেলেটা অদ্ভুত।

যখন তিনি বুঝতে পারেন তার ছোট আদরের মেয়েটা শশীকে নিয়ে স্বপ্ন বুনে ফেলেছে, তিনি তখনো কিছু বলেননি। কেননা তিনি জানতেন, এই স্বপ্ন মাকড়শার জালের মতো, ক্ষণস্থায়ী। কেননা তিনি চেয়েছিলেন, মেয়েটা তার জগতের নিয়মগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক। কষ্ট পেয়ে তাপে নিখাদ হয়ে উঠুক।

যেদিন শশী ফোন দিয়ে বলে, সে এখানে এসে থাকতে চায়, তাকে একটা ছোট ঘর বানিয়ে দিতে, সে টাকা দিবে, সেদিন বদি সাহেব কিছুই বলেননি, শুধু বলেছিলেন, কাজ শেষে জানাবো।

শশী যেদিন আসে সেদিন বদি সাহেব চমকে উঠেন। এই শশীকে তিনি চিনতে পারেননি। চিনেছেন অনেক পরে, কিন্তু নতুন করে। এই শশী একটা বরফে জমে যাওয়া নদ। আগের শশী খরস্রোতা ছিল। সেখানে রংধনু হত। কিন্তু এই শশী নিশ্চল।

সেদিন রাতে কণার কান্না দেখে বদি সাহেব কিছুই বলেননি। সারারাত দাড়িয়ে থেকে ভোরে মেয়ের কঁধে হাত রেখে বলেছিলেন,

“বরফের মাঝে রঙধনু দেখা যায়না, কিন্তু সেখানে মেরুপ্রভা দেখা যায়। রঙধনু অনেকেই দেখেছে। কিন্তু কয়জন মানুষ মেরুপ্রভা দেখতে পেয়েছে???” ভাগ্যবানরা দেখা পায় মেরুপ্রভার।”

কণাও সেদিন থেকে সেই বরফ-শীতল নদের মাঝে মেরুপ্রভা খুঁজে যাচ্ছে।

বদি সাহেবের দুই মেয়ের মাঝে ছোট মেয়েটাই সবচাইতে বেশি কাছের, পৃথিবীতে বদি সাহেব এই মানুষটাকেই সবচাইতে বেশি ভালোবাসে।

কণার জন্মের পরেই কণার মা মারা গিয়েছিলেন। আর বদি সাহেব স্ত্রীর মৃত্যুর পরে মেয়ে দুটির মাঝেই জগত বানিয়ে সাজিয়েছিলেন সেই জগত।

কণার প্রতি আলাদা টানের মুল কারণ কণার চিবুকের তিল। একেবারেই মায়ের মতো তিল নিয়ে জন্মেছিল কণা।

সমাজের মাঝে থেকেও সমাজের ত্রুটিগুলো ডিঙিয়ে চলার মতো সাহস বদি সাহেবের ছিল দেখেই মেয়েটাকে তিনি সেভাবেই গড়েছিলেন।

আর কণা?

বাবার আদরের প্রশ্রয়ে সমাজের সেই ভিত্তিহীন মূল্যবোধ আর নিচু মানসিকতার অনেক উপরে থেকেই দেখতে শিখেছে কণা।

মাটির বুকে বৃথা আঁচড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে শশী বুঝতে পারে, সে কতটা অসহায়। কতটা পঙ্গু সে। যতটা না শারীরিকভাবে, তার চাইতে ঢের বেশি মানসিকভাবে।

সেদিন শশী প্রতিদিনকার মতো কাজ শেষে বাসায় ফিরছিল। ক্লান্ত শশী বাস থেকে নেমে শর্ট-কাট হিসেবে ছোট গলিটা দিয়ে হাটা ধরে। কিছুক্ষন পরেই দেখতে পায়, তিন-চারজন যুবক একজন মানুষকে মারছে। দৌড়ে শশী এগিয়ে যায়, মানুষটাকে বাঁচাতে। টানা-হেঁচড়ার মাঝে কখন যে কোমরে আঘাত পায় শশী, বুঝতেই পারেনা। প্রচণ্ড ব্যাথায় জ্ঞান হারায় শশী।

জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারে, তার পায়ের মাঝে অনুভূতি আছে, কিন্তু কোন শক্তি নেই। সে বুঝতে পারে তার পা, অনুভব করতে পারে সবকিছু।

কিন্তু শশী তার পা কোনক্রমেই নাড়াতে পারেনা। বুঝতে পারেনা ব্যাপারটা। শুধু ডাক্তারের কথায় জানতে পারে, চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠবে।

শশী সেই চেষ্টাও করেছিল। ফিজিওথেরাপি, নানারকম কসরত, সব করতে থাকে। কিছুটা ফল পেতেও শুরু করে। কিন্তু ততদিনে শশীর মনের মানুষটা চলে যায় নিজের ভবিষ্যত শিকারে।

সবসময় ম্যাসেজ করলেও এই প্রথমবার মানুষটা চিঠি লিখেছিল। সেখানে লেখা ছিল, “তোমার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকবো শশী”

শশী চিঠিটা নিজের বুক পকেটে রেখে কিছুক্ষন চুপ করে বসে থেকে শেষে বদি সাহেবকে ফোন দেয়। সেই দু’বছর আগে।

কণা শশীকে এখন প্রতিদিন নানা ধরনের ব্যায়াম করায়। নিয়মিত ডাক্তার কিংবা ফিজিও সেন্টারে যায়। সেদিন মাটির স্পর্শে শশীর মাঝেও নতুন করে ইচ্ছা জাগে।

একটু ইচ্ছা, একটা স্বপ্ন আর একজন মানুষের চেষ্টা.........

কণা মেরুপ্রভা দেখতে পায় আট মাসের মাথায়। যেদিন শশী মাটির বুকে আঁচর কেটেছিল, সেদিন থেকে আট মাসের মাথায় শশী হাঁটতে শুরু করে।

সন্তান প্রথমবার যখন হাঁটতে শেখে তখন তার সাফল্যে মা-বাবা হাসে, কিন্তু শশীর হাটা দেখে কিংবা কণার খুশি দেখে বদি সাহেব, কণা কিংবা শশী নিজেই কেঁদে ফেলে।

কণা কাঁদে, শশী কাঁদে, কাঁদেন সৌম্য পিতা বদিউল হক।

যেদিন শশী ফিরে যায় তার চিরচেনা শহরে, সেদিন সে বদি সাহেবের কাছ থেকে একটা খাম পায়। বদি সাহেব বলেছিলেন,

“কখনো যদি কষ্ট হয়, কখনো যদি একা লাগে, নিঃস্ব মনে হয়, তাহলে যেন খামটা খুলে, নাহলে না।”

শশী কিছুই বুঝতে পারে না। সে তার স্বপ্নে বিভোর। তার জীবন, তার কাজ, তার মনের মানুষ।

কণা শশীকে এবারো বিদায় দেয় হাসিমুখে, মানুষকে নাকি কেঁদে বিদায় দিতে হয়না। মনের মানুষটাকে কিভাবে কেঁদে বিদায় দেবে সে???

শশীকে দেখে লোপা খুশিতে নেচে উঠে। জড়িয়ে ধরে। এতদিন পর সে তার ভালোবাসা ফেরত পেল। এতদিন পর।

হাঁটতে পারছে শশী। এখন সে শশীকে নিয়ে জগত ঘুরে বেড়াতে পারবে। সব স্বপ্ন এখন পূর্ণ হয়ে পরিপূর্ণ করবে লোপাকে।

শশী লোপার খুশি দেখে হাসে। কিন্তু সে অপেক্ষায় থাকে একটি প্রশ্নের। সেই প্রশ্ন যেটা লোপা করলে শশী বলতে পারবে, সব কিছু সম্ভব হয়েছে লোপার ভালোবাসার জন্য।

প্রশ্ন প্রশ্নই রয়ে যায়, লোপা জিজ্ঞেস করেনা শশীর সেই পৌনে তিন বছরের কষ্টের জীবনের কিছুই।

শশীও পারেনা বলতে তার ভালোবাসার কথা, তার বিশ্বাসের কথা।

একসময় বাধ্য হয়ে শশী জিজ্ঞেস করে লোপাকে,

“তুমি জানো এই সময়টা কিভাবে কেটেছে আমার?”

লোপার উত্তর শশীর বিশ্বাস কিংবা ভালোবাসার ভিত কাঁপিয়ে দেয়।

লোপা বলেছিল, “তুমি সুস্থ হয়েছ তাই অনেক, অতীত নিয়ে ভেবে কি হবে?”

শশী অনেক কষ্টে হেসে বলেছিল, “তাই তো, তোমার কি দরকার?”

কিছুটা উদ্ভ্রান্তের মতো ঘরে ফিরে এসেছিল শশী। তার রুমে ঢুকেই পায়ে ময়লা ময়লা লাগে। নিচে তাকিয়ে দেখে, সিগারেটের ছাই। যেই ছাই দেখে কণা মিথ্যে রাগ দেখাতো।

বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে আবার শশী। জট পাকানো সব সুতো খুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে।

স্যান্ডেলটা ছিড়ে যায় কখন যেন। রাগের মাথায় ছুড়ে মারে রাস্তার পাশে। খালি পায়ে হাঁটতে থাকে শশী। হঠাৎ মাটিতে আঙ্গুল দিয়ে আঁচড় কাটতে থাকে। অনুভব করতে থাকে মাটির স্পর্শ, সাথে পায়ের অস্তিত্ব।

কিছুদিন আগেও তো তার কাছে এটা অবাস্তব ছিল। আসলে ইচ্ছাই ছিল না। ছিল না স্বপ্ন দেখার সাহস।

লোপা কি সহজেই বলে দিল, অতীত নিয়ে ভেবে কি হবে। লোপা কি জানে, তার বর্তমান কে দিয়েছে??? লোপা কি জানে, শশীর অতীতে একটা মেয়ে কি প্রগাড় মমতায় তার সব কষ্ট মুছে দিয়েছে???

মনে পরে যায় বদি সাহেবের দেয়া সেই খামটা। খুলে পড়তে থাকে ল্যাম্প- পোস্টের সোডিয়াম আলোর নিচে।

সেই রাতে বদি সাহেবের দেয়া খামটা খুলে একটা নোটখাতার ছেড়া পাতায় লেখা মাটি আর ময়লামাখা চিঠি পেয়েছিল শশী। আর চিঠিটা পড়েই সব সুতোর জট খুলে যায় শশীর।

এক দৌড়ে ছুটে যায় বাস-স্ট্যান্ডে যায় শশী। কোন কিছুই না ভেবেই।

কণার দিন থেকে রাত হয়, রাত থেকে দিন। আবার সেই আগের মতো, কিন্তু এখন তার মনে প্রশান্তি আছে।

সে মেরুপ্রভা দেখেছে। এর বেশি কি কিছু চাওয়ার থাকতে পারে কোন মানুষের জীবনে। কণা জানে, পারেনা।

এসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক কণা সেই বাগানে দাড়িয়ে থাকে, হঠাৎ করে পেছন থেকে শশী পেছন থেকে তার কোমর জড়িয়ে কানে কানে বলে উঠে,

“নীহারিকার চাইতে সুন্দর হৃদয়ের কম্পন, কেননা সৃষ্টি হয়েছে শব্দ থেকে...... আমাকে শুনতে দেবে?”

কণা কিংবা শশী, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শশী-কণা এক হয়ে যায়। নিবিড় ভালোবাসায়.........

প্রবীণ পিতা কখন যে দূর থেকে হাত তুলে আশীর্বাদ করেন, তারা জানতেই পারেনি।

পিতা, সেই প্রবীণ পিতা কন্যার প্রথন প্রেম-পত্র, সেই প্রথম লেখা চিঠিটা মাটিতে পচতে দেয়নি। আগলে রেখেছিল।

বৃথা যায়নি প্রথম চিঠি, বৃথা যায়নি কণার অশ্রু।

বৃথা যায়নি নীরব ভালোবাসা।

ভালোবাসা নারী-পুরুষে, পিতা-কন্যায়, মানুষে মানুষে...............

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ৯:০৬

প্রেতরাজ বলেছেন: অসাধারণ লিখেছেন।
এক নিষ্পাপ ভালবাসা।
সত্যি খুব ভাল লাগল।

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ৯:৪৭

চিত্রযোধী আবির বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে......

২| ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:৩৮

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: সুন্দর

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:৪১

চিত্রযোধী আবির বলেছেন: ধন্যবাদ........

৩| ০১ লা মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১:৩৯

আফসানা যাহিন চৌধুরী বলেছেন: দারুণ.. :)

০৪ ঠা মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৪:১৫

চিত্রযোধী আবির বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে..........

৪| ০২ রা মার্চ, ২০১৫ রাত ১১:৪২

সুমন কর বলেছেন: ভাল লাগল।

০৪ ঠা মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৪:১৫

চিত্রযোধী আবির বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.