নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নজরুল ইসলাম টিপু

নজরুল ইসলাম টিপু

আমি একজন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। আমি চাই আমার দেশটি সুনাম ও সুখ্যাতি সহকারে দুনিয়ার বুকে গর্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে উঠুক। আমার দেশের প্রতিটি যুবক আলস্য ও হিনমন্যতা ঝেড়ে সকল কাজে দুই হাতকে কাজে লাগাতে শিখুক। আমিও সে সব যুবকের একজন হতে চাই, যারা নিজের কর্ম ও উদ্দীপনার মাধ্যমে আমাদের জাতীয় চেতনাকে সজাগ করতে সদা ব্যস্ত। আমি আমার দেশকে ভালবাসি হৃদয়ের সমস্ত শক্তি উজাড় করে।

নজরুল ইসলাম টিপু › বিস্তারিত পোস্টঃ

মানব জীবনে বাঁশের অবদান (রম্য রচনা)

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৫:৪০


বাঁশ বাংলাদেশের একটি অবহেলিত উদ্ভিদ। বাঁশ চিনেনা এমন চালাক মানুষ বাংলাদেশে অন্তত একজনকেও পাওয়া যাবেনা। বাঁশের সাথে পুরো দুনিয়ার মানুষ সকলেই কম বেশী পরিচিত। তেলাপোকার পাখা গজানোর পরে কখনও সে নিজেকে পাখি দাবী করে। সেভাবে বাঁশ এক প্রকার ঘাস হবার পরও সে তাল গাছের উপরে উঠে কবির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। ঘাসকুলের মাঝে একমাত্র বাঁশের সম্ভ্রান্ত কিংবা উঁচু বংশের চরিত্র আছে বলে তাকে মানবজাতি কখনও ভুল করে গাছ বলে ভ্রম করেন। আসলে বাঁশ এক প্রকার উচ্চশ্রেণীর ঘাস। বাংলাদেশের মানুষের কাছে বাঁশ একটি সহজলভ্য মূল্যবান সম্পদ। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায় তালগাছের মোটামুটি একটু সম্মান দিলেও; বাংলাভাষায় আর কোন কবিকে এমন পাওয়া যায় না, যিনি একটি কিংবা একক গাছ নিয়ে কিছু লিখেছেন। তবে ফলদার বৃক্ষের ফল ও ফুল নিয়ে অনেক কবি-সাহিত্যিক তাদের মূল্যবান রচনা লিখেছেন। যতীন্দ্র মোহন বাগচী তার কবিতায় বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ দেখেছেন। এখানে বাঁশ মুখ্য বিষয় ছিলনা, কবির কাছে মুখ্য বিষয় ছিল চাঁদ। বিভিন্ন প্রকারের ফল-ফুলের রচনা সমৃদ্ধ কাহিনী শিশুতোষ সাহিত্যে ছড়িয়ে থাকলেও বাঁশ কোনদিনই কবি-সাহিত্যিকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি।

বাঁশ আর মানুষের বন্ধুত্ব, বাঁশের জন্মের পর থেকে শুরু হয়। বাঁশ মানুষকে ভালবেসে সহযোগিতা করলেও মানুষের কাছে বাঁশ কোনদিন গুরুত্ব পায়নি। কেননা বাঁশের কোন রস নাই, ফল নাই, বিচি নাই এমন কি সে সহজে ফুলও দেয়না, পাতাও শাক হিসেবে খাওয়া যায়না। বড়জোর দু’একটি সন্তান জন্ম দিয়েই তার অবদান শেষ করে। মানুষ আজীবন জীবিত ও মৃত বাঁশের দেহ দিয়েই নিজের মত করে উপকার সেরে নেয়। বাংলাদেশে বহু প্রজাতির বাঁশ পাওয়া যায় যেমন, মূলী, মিতিয়া, ছড়ি, আইক্কা, বাইজা, বররা, মাকাল, তল্লা বাঁশ ইত্যাদি। এই নাম গুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের মত করে দেওয়া। মোটা, চিকন, লম্বা, পুরুত্ব ও ভিতরের ফাঁপা অংশ মিলিয়ে বাঁশের বিভিন্ন নাম ও প্রজাতি ঠিক করা হয়। ব্যবহারের ক্ষেত্রে ও স্বাস্থ্যগত বিচারে স্বাস্থ্যবান, স্বাস্থ্যহীন, রুগ্ন, শিশু, জীবিত ও মৃত সকল বাঁশই মানুষের জন্য উপকারী। মানব জীবনের সর্বাবস্থায় যে বাঁশ এত উপকারী, সে বাঁশ এখনও বাংলাদেশের অর্থকড়ি সম্পদের মধ্যে গণ্য হয়নি, এটা বাঁশের প্রতি একটি রাষ্ট্রীয় অবহেলা ছাড়া আর কিছু নয়।

কমবেশি বাংলাদেশের সর্বত্র বাঁশ উৎপন্ন হলেও; চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামেই বাঁশের উৎপাত বেশী! মানুষ শিশু বাঁশ কে অকালে কেটে, ভাজি-ভর্তা বানিয়ে খায়। বাঁশ কিশোর বয়সে পৌঁছলে শক্ত হবার আগে, তাকে দিয়ে ঝুড়ি, কুলা, চালুন, পাটি, বাড়ি-ঘরের বেড়া, হাত পাখা, মাদুর, লাই, মাছ ধরার বিভিন্ন সরঞ্জাম, ঘরের নিত্য ব্যবহার্য জিনিষ তৈরি করে। বাঁশের যৌবন কাল হল দামী কাল! তখন বাঁশ দিয়ে ঘর, বেড়া, চাল, কনক্রিটের গাঁথুনি, শক্ত মাচা সহ যাবতীয় কাজে ব্যবহার হয়। বৃদ্ধ হয়েছে বলে বাঁশের কদর ও সম্মান কখনও কমে গিয়েছে এমনটি শোনা যায়না বরং তখনও মানব জীবনে তার গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা অপরিসীম। তখন বাঁশ দিয়ে পানি আটকানোর বেড়া, দালানে উঠার মই, মারামারি করার জন্য সূচালো অস্ত্র, ভার বহন করার জন্য ‘ভারী’ হিসেবে যথেষ্ট ব্যবহৃত হয়।

বাঁশের শাখা প্রশাখা কিংবা আস্তা বাঁশটাই উন্নত কাগজ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাঁশের শাখা-প্রশাখা কাগজের কলে পাঠাতে না পারলেও এসব ক্ষুদ্র অঙ্গ প্রত্যঙ্গ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জন্য বড় প্রয়োজনীয়। যাদের পুকুর আছে তারা তা পুকুরে ফেলে রাখে, ফলে চোর জাল ফেলে মাছ চুরি করতে পারেনা। মাছ বাঁশের গায়ে লেগে থাকা পিচ্ছিল নোংরা খুবই পছন্দ করে, সেটা দিয়ে মাছ সকাল-বিকাল-সন্ধ্যার নাস্তা সারতে পারে। বাঁশ এমন এক সম্মানিত ঘাস, যা পানিতে ফেললে পানি দুষিত হয়না বরং মাছ, শামুক, ঝিনুকের উপকার হয়। তাদের বংশ বিস্তারে সহায়ক হয়। শামুক, ঝিনুক এই কর্দমাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে উঠেই বর্ষার নতুন পানির স্বাদ গ্রহণ করে। যাদের পুকুর নাই তারাও নিশ্চিন্তে বাঁশের অঙ্গ ব্যবহার করে থাকে। তারা বাঁশের ছিপা নিজেদের ক্ষেতে-খামারে মাটিতে গেঁথে রাখে; সিম, বরবটি, করলা সহ সমুদয় লতা যুক্ত গুল্ম বাঁশ বেয়ে উপরে উঠতে খুবই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। লতা আর বাঁশের প্রত্যঙ্গের জঞ্জালের ফাঁকে ঘুঘু, বুলবুলি, টুনটুনি তাদের সংসারের বংশ ধরে রাখার দায়িত্বটুকু এই ফাঁকে পালন করে নেয়। কারো ক্ষেত খামারেও যদি বাঁশ ব্যবহারের সুযোগ না থাকে, তাহলে গোস্বা করে চুলোর আগুনে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। আগুন বাঁশের সান্নিধ্য পেলে খু্বই উত্তেজিত হয়ে উঠে। রাজনীতিবিদেরা যেভাবে রাজনীতির মাঠ গরম করে নিজের ফায়দা তুলে নেয় সেভাবে চালাক মানুষেরা আগুনের উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের জন্য চা বানায়, ভাত-তরকারী রান্না করে নেয়। মৃত বাঁশের গোড়ালি দিয়ে কলম রাখার পাত্র, সিগারেটের ছাইদানি, নূনদানি, পানদানি, চুনদানি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বাঁশ না থাকলে চারু ও কারুকলা শিল্প বসে যেত, হিন্দুরা পূজোর জন্য প্রতিমা বানাতে পারত না। বাঁশের অভাবে বাঙ্গালী সংস্কৃতি প্রদর্শনে ব্যাঘাত ঘটত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশাখী মেলার ভুত, পেঁচা, ময়ূর বানিয়ে রোড শো করার কথা চিন্তাই করা যেত না।

বাঁশের ব্যবহারের কোন কমতি নাই। হিরোইন, আফিম, গাঁজা, তামাক গুল্ম থেকে উৎপন্ন হলেও সেগুলো চাষ ও সংরক্ষণ অবৈধ। সে হিসেবে বাঁশ কোন অবৈধ উদ্ভিদ নয়; তবে বাঁশের ব্যবহারের উপর নির্ভর করে কদাচিৎ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বাঁশকেও অস্থায়ী ভাবে অবৈধ বলে থাকেন। স্থায়ী ব্যবহারের মাঝে বাঁশের মেলা কদর! যেমন, বাঁশ দিয়ে কবিরাজেরা বংশলোচন ঔষধ তৈরি করে। বাঁশ দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ লিখতে শিখে। বাঁশের বেত দিয়ে পিটিয়ে গাধা মার্কা ছাত্রকে মানুষ বানানো হয়। সেভাবে জীন ভুত তারাতে বৈদ্যরা বাঁশের ছিপা ব্যবহার করে। বাঁশের তাজা পাতা সিদ্ধ করে গাভীর দুধ বাড়ানোর খাদ্য তৈরি করে। বাঁশের শলা দিয়ে কাবাব পোড়ানো, আলু সিদ্ধ, পিঠা সিদ্ধ, দাঁতের খিলাল সহ হাজারো কাজে ব্যবহার হয়। মিছিল-মিটিংয়ে বাঁশের ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। প্ল্যাকার্ড বহন, ব্যানার টাঙ্গানো, সামিয়ানার খুঁটি হিসেবে বাঁশের ব্যবহার যথেষ্ট। সমাবেশে হামলা হলে কিংবা অপরের সমাবেশ পণ্ড করতে হলে প্ল্যাকার্ডের বাঁশ খুবই কাজে আসে। বর্তমানে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে বাঁশ চাষ ও সংরক্ষণ করার জন্য অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি পরামর্শ দিচ্ছেন। ছাত্ররা উত্তেজিত হলে দা, ছুরি, তলোয়ারের পিছনে না দৌড়ে, বাঁশ নিয়ে হামলে পড়বে। ফলে নিহতের সংখ্যা কমবে, ছাত্ররাও সহজে উত্তেজনা প্রশমিত করতে পারবে। মানুষের জীবনের শেষ যাত্রার শেষ উপকরণটির নাম হল বাঁশ। শিশুকালে বাঁশের দোলনা দিয়ে শুরু করে, মরণ কালে লাশ কবরে রাখার পর, দুনিয়ার জীবনের শেষ ছাদখানা নির্মিত হয় বাঁশ দিয়ে। চিতায় লাশ জ্বালানোর সময়, তাড়াতাড়ি ছহি সালামতে লাশকে ছাই বানাতে বাঁশের গুঁতোর বিকল্প নাই। বন্যার পানিতে যখন দেশ সয়লাব হয় তখন নৌকা থাকুক, ভেলা থাকুক, বড় পাতিলে চড়ে কেউ ভেসে থাকুক না কেন, একটিমাত্র বাঁশ ছাড়া সবকিছুই অর্থহীন হয়ে পড়ে। সে সময় হাজার মানুষের সাহায্য ধ্বনি অর্থহীন হয়ে পড়ে একটি মাত্র বাঁশের অভাবে! বেওয়ারিশ ও দুর্ঘটনায় লাশের শেষ বস্ত্র হয় বাঁশের তৈরি চাটাই পোশাক। বাংলাদেশের সকল প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি, সেনাপতি থেকে শুরু করে ছাইপোষা কেরানী পর্যন্ত সকলেই তৈলাক্ত বাঁশে বানরের বেয়ে উঠার অংক কষেই শিক্ষিত হয়েছেন।

বাঁশ কোন ফলজ বৃক্ষ নয়, ফুলের জন্য তার কোন সুনাম-সুখ্যাতি নাই। হাজারো নাই’য়ের মাঝেও বাঁশ মানুষের জন্য খুবই দরকারি উদ্ভিদ। প্রচুর বাঁশের উৎপত্তিস্থল হওয়াতে চন্দ্রঘোনায় কাগজের কল প্রতিষ্ঠিত হয়। কাগজ হিসেবে বাঁশের কাগজ সেরা; সুন্দর, উজ্জ্বল ও দীর্ঘস্থায়ী হয়। বাঁশ সর্বদা কাটতে হয়, যদি রীতিমত কাটা না হয়, হাজারো বাঁশের জন্ম হয়ে মাটি শক্ত ভাবে চিপে যায়, মাটিতে পুষ্টি থাকেনা ফলে বাঁশে ফুল চলে আসে; এতে বাঁশ বাগান ধ্বংস হয়ে যায়। বাঁশ নিজের গোড়া থেকে সরাসরি বাচ্চার জন্ম দেয়। মানুষ অন্যান্য গাছের বাচ্চাকে সহজে আদর করতে পারলেও বাঁশের বাচ্চার গায়ে হাত দিলে খবর আছে। শিশু বাঁশের লক্ষ লক্ষ খাড়া লোম, মানুষের দেহে অনায়াসে বিদ্ধ হয়। ডাক্তারের বাপের সাধ্য নাই সে লোম থেকে রোগীকে উদ্ধার করে। তাই তো বনের বানরদের কোন কাজ না থাকলে বাঁশ বনে গিয়ে, শিশু বাঁশ নিয়ে বাঁদরামি আর ফাজলামো করে। পরে কয়েক সপ্তাহ বসে বসে শরীর থেকে তা পরিষ্কার করার আশায় গা চুলকায়। বাঁশে যখন ফুল আসে, তখন কৃষকদের মাথায় হাত পড়ে, তারা দুর্ভিক্ষের আশঙ্ক্ষায় দুঃচিন্তা গ্রস্থ হয়ে পড়ে। বাঁশে ফুল আসা মানে, সে বনের বাঁশের গোষ্ঠী সমূলে ধ্বংস হওয়া। তারপরের বছর থেকে আর কোনদিন সে বনে বাঁশ জন্মায় না। তাজ্জবের কথা! কৃষকের দুঃচিন্তা কিন্তু বাঁশের অস্তিত্ব বিলীন নিয়ে নয়, দুঃচিন্তা অন্য খানে। বাঁশের ফুলের গন্ধে সকল ইঁদুরের দেহে নতুন করে নব যৌবনের জোয়ার আসে। বালিকা, বৃদ্ধা, শিশু, বন্ধ্যা প্রকৃতির সকল ইঁদুরের অসম্ভব প্রকারের প্রজনন ক্ষমতা বেড়ে যায়, আর পুরুষ ইঁদুরের হয় পোয়াবারো। সে বছর অগণিত ইঁদুরের জন্ম হবে, ইঁদুরের দল পাশের অঞ্চলেও সয়লাব হবে, বাংলা ভাষায় এটাকে ইঁদুর বন্যা বলে। এই ইঁদুর কৃষকের ফসলের মাঠ ও বাড়ীর সম্পদের সর্বনাশ করবে। ইঁদুর শুধু সর্বনাশ করবে না, কৃষকের কিছু উপকারও করবে। তার বিশ্রামের সময়ে বাঁশ বাগানের, বাঁশের পরিত্যক্ত গোড়া গুলো কাটতে থাকে, মাটিতে গর্ত করে, মাটিকে ঝুরঝুর করে। কয়েক বছরের বৃষ্টির পর মাটি উর্বর ও নরম হবে। ইঁদুরের মাধ্যমে ঝুরঝুরে হওয়া মাটিতে, নতুন করে আবার বাঁশ বাগানের জন্ম হবে।

এতো গেল দৃশ্যমান বাঁশের কথা সমাজে অদৃশ্য বাঁশের ব্যবহারও কিন্তু কম নয়। কেউ কাউকে অতিমাত্রায় প্রশংসা করলে সে ব্যক্তিকে বন্ধুরা প্রশ্ন করে, তিনি কি তোমার প্রশংসা করল, নাকি বাঁশ দিল? রাজনীতির মাঠে ময়দানে এধরনের প্রকাশ্য বাঁশ থেরাপি চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সবাই একে অপরকে প্রশংসার বাঁশ, উত্তেজনার বাঁশ, গোস্বার বাঁশ দিয়েই চলছেন। যাকে বাঁশ দেয়া হল তার কাছে তো খারাপ লাগবেই, অধিকন্তু যিনি বাঁশ দিয়েছেন তাকেও প্রশ্ন করা হয় আপনি যে বাঁশ দিয়েছেন তা’কি গিরা যুক্ত, নাকি মসৃণ? এটা বাঁশ দেওয়ার পরিমাণ-মাত্রা অনুধাবন করার জন্য জিজ্ঞাসা করা হয়। বাঁশ দেওয়া, বাঁশ খাওয়া বাংলাদেশে বিব্রতকর হলেও; আরব দেশে বাঁশ দিলে কিন্তু সম্মান ও মর্যাদা দুটোই বাড়ে। কোন ইঞ্জিনিয়ারকে ‘বাশ ইঞ্জিনিয়ার’ বলা হলে তিন খুবই খুশী হন। আবার কোন কর্মকর্তাকে ‘বাশ কর্মকর্তা’ বললে তিনি আবেগে গদ গদ হন। সরকারী কাজে কর্মকর্তাদের মাধ্যমে, কাজ হাসিল করতে চাইলে ‘বাশ থেরাপি’ দারুণ কার্যকর। হতেও পারে বাশ কর্মকর্তা খুশী হয়ে দুপুরের আপ্যায়ন টুকু ভালমতো করিয়ে দিতে পারেন। তাই বলে সবাইকে বাশ বলতে গিয়ে, অফিস বয়কে বাশ বলে ফেললে কিন্তু হিতে বিপরীতও হতে পারে। লোক কথায় আছে বাশের তৈরী বাঁশির সুরে নাকি জ্বীন, পরী, সাপ পর্যন্ত ঘর ছাড়ে। তবে মর্তের বহু মানুষ যে বাঁশির সূরে ঘর ছেড়েছে তার প্রমান তো অহরহ আছে। ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া আর পল্লীগানের প্রধান যন্ত্রের নাম বাঁশের বাঁশি। ভগবান শ্রী কৃষ্ণ তো বাঁশের বাঁশির সূর দিয়েই বৃন্দাবনকে মাতিয়ে রাখতেন। মানবজাতিকে দুনিয়ার মোহে আবদ্ধ রাখতে শয়তানের প্রধান অস্ত্রের নামই নাকি বাঁশের বাঁশি!

বাঁশের মহত্ব মর্যাদার কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ১৯৬৩ সালে শিকাগো শহরে ৪৩ তলা বিশিষ্ট ‘চেস্টনাট ডিউইট অ্যাপার্টমেন্ট’ নির্মিত হয়। এ ভবনটির ডিজাইনার গোলাকার ভাবে সেটিকে তৈরি করেন। এই ভবন তৈরি হবার পর পুরো দুনিয়ায় হই চই পরে যায়। কেননা এর আগে দুনিয়ায় কেউ গোলাকার ভবন তৈরির কথা স্বপ্নেও আনেন নি। দুনিয়া কাঁপানো যুগান্তকারী তথ্য দিয়ে যিনি এ ভবন তৈরি করেছিলেন, তিনি ছিলেন বাংলাদেশেরই কৃতি সন্তান ড. এফ, আর, খান। এই ভবন তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন মহল থেকে, তিনি নিন্দিত ও বাধাপ্রাপ্ত হন। বিশ্ব নন্দিত বহু প্রকৌশল সংস্থা সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, এই যুগান্তকারী চিন্তাধারা ও নির্মাণপদ্ধতি আদৌ কার্যকর হবে কিনা। দুনিয়ার মিডিয়াগুলো তাঁকে ঘিরে ধরেন; প্রশ্ন করেন আপনি কোন গবেষণাগারে পরীক্ষা করেননি, এর আগে এ জাতীয় ভবন কোথাও তৈরি হয়নি, যেটা দিয়ে সত্যাসত্য নিরূপণ করা যায়। আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন, এই ভবন ভেঙ্গে পড়বে না, কাৎ হয়ে হেলে যাবেনা এবং ভূমিকম্পে চুরমার হবেনা? নিশ্চয়ই আপনি শুধুমাত্র কল্পনা শক্তি দিয়েই, গোলাকার ভবন তৈরির জন্য ঝুঁটিযুক্ত প্রকৌশলে হাত দিয়েছেন?

ড. এফ, আর, খান বললেন, ‘আমি পরীক্ষাগারে পরীক্ষা না করলেও কাজটি হাজার হাজার বছর ধরে সফলভাবে পরীক্ষিত হতে দেখেছি! তিনি বললেন, মূলত উচ্চ ভবন বানানোর বিদ্যা-বুদ্ধি আমি বাঁশ থেকে শিখেছি! তিনি আরো বললেন, আমাদের বাড়ীর পাশে বাঁশ বাগান ছিল। ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের প্রচণ্ড ধাক্কায় বাঁশ মাটি বরাবর নুয়ে পড়ত, বাতাস চলে গেলে আবার আগের অবস্থায় ফির যেত, কখনও ভেঙ্গে পড়ত না। তা দেখে আমি চিন্তা করতাম কেন এমনটি হয়? কেন সেটা ভেঙ্গে পড়েনা? কোন ভিত্তি তাকে এমন শক্তভাবে দাঁড়াতে সাহায্য করে? অতঃপর আমি একটি বাঁশ কেটেছি, তার অভ্যন্তরে দেখেছি, প্রতিটি গিরা পর্যবেক্ষণ করেছি, তাতে সর্বোচ্চ কয়টি গিরা গুনেছি, সর্বোপরি বাঁশের নিম্নাংশের গঠন-প্রকৃতি দেখেছি। অবশেষে এ সিদ্ধান্তে এসেছি যে, চারিদিকে শক্ত গাঁথুনি, ভিতরে ফাঁপা, ঘন ফ্লোর, মজবুত গোড়া বানিয়ে, বাঁশের মত উঁচু দালান বানালে সেটাও ধ্বংস হবেনা। বাঁশের এই দক্ষ কারিগরি গাঁথুনি দেখে আমি সর্বোচ্চ দালান বানানোর প্রেরণা পেয়েছি। এই ঘটনা থেকে মানব জাতির জন্য বাঁশের অবদান নতুন মাত্রা যোগ করল, বর্তমান যুগের সকল গোলাকার ভবন হল বাঁশের অমর কীর্তির বাস্তব প্রতিফলন’।

ড. এফ, আর খান এর পরে নির্মাণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের হাউসটন শহরে ৫২ তলাবিশিষ্ট ‘শেল প্লাজা ভবন’। এটি ছিল কনক্রিট নির্মিত বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন। শিকাগো শহরে ১০০ তলাবিশিষ্ট জন ‘হ্যানকক অট্টালিকা’ তৈরি করেও তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি আমেরিকার শিকাগো শহরে ১১০ তলাবিশিষ্ট ১৪৫৪ ফুট উঁচু ‘সিয়ার্স টাওয়ার’ নির্মাণ করে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ১৯৭৩ থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত এটিই বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন ছিল। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরে বর্তমানে এটিই যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অট্টালিকা। এসব অতি উচ্চ ও মনোরম অট্টালিকা তৈরি করে তিনি প্রমাণ করেন, বাঁশ থেকে প্রাপ্ত বিদ্যা কোন তামাশা-মশকরার বিষয় ছিলনা। অনন্য প্রতিভার অধিকারী ড. এফ, আর, খান সহজেই প্রমাণ করেন তাঁর আবিষ্কৃত গোলাকার ডিজাইনের ভবন সম্পূর্ণরূপে বিজ্ঞান সম্মত ও বাস্তবানুগ। বাঁশ থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি দুনিয়ায় ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায় বিশাল অবদান এবং সর্বোচ্চ ভবন তৈরির জন্য বহু তথ্য-প্রমাণ রেখে গেছেন। যার কারণে তাঁকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়।

বাঁশ বাংলাদেশে জ্বালানী লাকড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, মেধাহীন মানুষের কাছে বাঁশের কোন মূল্য নেই। বাঁশ দিয়ে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, চীন, থাইওয়ানে প্রচুর শিল্প গড়ে উঠেছে। রাজপ্রসাদ, দামী ভিলা, রেস্টুরেন্ট, পাঁচতারা হোটেল গুলোর অভ্যন্তর ভাগ সাজাতে বাঁশের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলছে। নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী, ঘর সাজানোর বস্তু, বৈদ্যুতিক বাতি নির্মাণে, ফটো ফ্রেম তৈরিতে বাঁশের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে। এ সমস্ত সামগ্রী যেমনি মূল্যবান তেমনি আকর্ষণীয়, তেমনি চাহিদাপূর্ন। লেখক নিজেও দেশে বিদেশে বাঁশ সামগ্রীর কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ঘুরে দেখেছেন। আমাদের দেশে বাঁশের কাঁচামাল যথেষ্ট থাকলেও নিপুণ ব্যবহারে অনেক পিছিয়ে। দেশের ছেলেদের কম্পিউটার বিষয়ে পড়ার প্রতি ঝোঁক বেশী, এটি একটি বিপদজনক প্রবণতা। তার চেয়ে বরং উপরোক্ত দেশে গিয়ে বাঁশ শিল্পের উপর উচ্চ শিক্ষা তথা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশে কিছু করা অনেক উত্তম। অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঁশ শিল্পের উপর ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী দেওয়া হয়। আপাত শুনতে অবহেলার মতো মনে হলেও, দেশ-জাতি গড়তে এটা বড় সহায়ক বিদ্যা হবে সন্দেহ নেই।

আল্লাহ বলেছেন ‘যে জাতি নিজ হাত দিয়ে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করেনা, তিনিও তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করান না’। নিজ হাতের বিদ্যার জন্য চাই পর্যাপ্ত কাঁচামাল ও রসদ। বাঁশ-বেত সম্পর্কিত মালামাল আমাদের দেশে প্রচুর। তাই যে কোন শিক্ষিত ব্যক্তি এই শিল্পে হাত দিলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারবে। তাছাড়া কোন বিশ্ববিদ্যালয় ইচ্ছে করলে এ বিষয়ের উপর কোর্স চালু করতে পারে। বিদেশ থেকে দক্ষ শিক্ষকদের নিয়ে এসে দেশের ছাত্রদের নিপুণভাবে গড়ে তুলতে পারে। বাংলাদেশের ভোকেশনাল ইনিষ্টিউট গুলোতে যা শেখানো হয়, তা পুরানো ও সেকেলে পদ্ধতির। যার বাস্তব ব্যবহার বাহিরের জগতে কোথাও নাই। ভোকেশনাল স্কুল গুলোতেও বাহিরের দুনিয়ার আধুনিক সৃষ্টির কোন সংগ্রহশালা নাই। ফলে এই স্কুলের ছাত্ররা নিজেদের বিদ্যা কাজে লাগাতে পারেনা, অন্যের বিদ্যা দেখারও সুযোগ পায়না। সরকারী ভাবে চিন্তা করা হলে, বাঁশ সম্পর্কিত শিল্পে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হবে, প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ ঘটবে। আমাদের ছেলেদের বেকারত্ব দূর হবে। আল্লাহ বলেছেন আমার সৃষ্টি নৈপুণ্যের মধ্যে, ত্রুটি দেখতে পাবেনা, তা নিয়ে তোমরা ভাব, গবেষণা করো, তাহলে তোমরা সফল হবে’। বাংলাদেশের ছেলে যেভাবে ক্ষুদ্র বাঁশ নিয়ে ভাবতে গিয়ে পৃথিবী বিখ্যাত হয়েছেন, বাঁশকে সম্মানিত করতে গিয়ে নিজে সম্মানিত হয়েছেন। এধরনের প্রচুর সম্ভাবনয় সন্তান আমাদের প্রতিটি গ্রামে লুকিয়ে আছে; দরকার শুধু পথ নির্দেশনার আর দরকার একজন নকিবের। যিনি তাদের জানিয়ে দেবেন আমরা কিছুই হারাই নি, প্রচুর সম্পদ আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন, দাঁড়াবার জন্য এগুলোই যথেষ্ট।
লেখক আমীরাত প্রবাসী।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:০৯

অলওয়েজ এ্যান্টি গর্ভণমেন্ট বলেছেন: +++

২| ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫২

কসমিক- ট্রাভেলার বলেছেন:







সাবাস, সাবাস, বাশের চমৎকার তথ্য সমৃদ্ধ লেখা

আসলে বাঙ্গালীর জীবনে বাশের গুরুত্ব অপরিসীম তাইতো একে অন্যকে ক্রমাগত বাশ দিয়ে যাচ্ছে। (একটু মজা করলাম)



শুভেচ্ছা সতত।





৩| ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫৬

হাসান বায়জিদ বলেছেন: পোষ্ট ভাল লেগেছে। ঠিক বলেছেন, দরকার একজন নকিবের।
ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.