নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

৩২ পৃষ্ঠায় খড়, ৩৩ পৃষ্ঠায় অাগুন

টোকন ঠাকুর

কবিতা গল্প লিখি, ছবি আঁকি-বানাই, একাএকা গান গাই...

টোকন ঠাকুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

শহীদ কাদরী বাড়ি নেই!!

৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৪:৪২

শহীদ কাদরী বাড়ি নেই!!


যা দোষ, তাই তার অহঙ্কার। কবিতার। কবি দোষী এবং অহঙ্কারী। খুব অল্প কিছু মানুষ সেই দোষ মেনে নিয়ে কবির অহঙ্কারকে স্বীকৃতি দিতে ভালোবাসে। যারা বাসে, তারাও কিছুটা দোষী, অহঙ্কারী। দোষ, ভাষাভিত্তিক মুখের কয়েকটা শব্দ এসে রচিত হলো যেই একটা বাক্য, সেই বাক্য ক্ষুরধারে চিকচিকে, সেই বাক্য ইন্দ্রধনুর মেঘডম্বুরু। সেই বাক্যে অনুভূতির মাইল-মাইল লম্বা কোনো রাস্তা, সেই রাস্তার দু'ধারে সারিসারি কৃষ্ণচূড়াগাছ। এবার হাঁটতে হাঁটতে একা তুমি যাও, হতে পারে তোমার সঙ্গে অন্য কেউ অাছে। সেই অন্য কে? সেও কি তুমি? নিজেই কি হাঁটছ নিজের সঙ্গে? নিজেই কি রহস্য হয়ে উঠছ, নিজের কাছে?
কবির দোষ, সে তোমাকে কৃষ্ণচূড়ার রাস্তাওয়ালা দিগন্ত দেখাল; কবির অহঙ্কার, এই যে ইন্দ্রীয়ঘন রাঙারাঙা বাক্যে সে ভরে দিল সবুজ মাঠ, সেটা তারই বুকের রক্ত। এত রক্ত অাসে কোত্থেকে? ক্ষত থেকে। যে-ক্ষত থেকে লালরক্ত কৃষ্ণচূড়ার রাস্তাওয়ালা দিন নির্মাণ করে, সেটা সে ভালোবেসে করে। এই ভালোবাসা বুকের পাঁজরে জমাট হয়, ফেটে যায়, তাতে একেকটা অানন্দ-বিষাদের জাদুঘর দেখা যায়, সবই অনুভূতিময়। শব্দময়, বাক্যময়।
অাদিতে ঈশ্বর বাক্য ছিলেন, বাক্য শব্দ ছিলেন, শব্দ ওঁ-কার ছিলেন, ব্রক্ষ্ম ছিলেন। কবি ও কবিতাকে সেই স্তর থেকে দেখতে হয়। দৈনন্দিনতার সীমানা ডিঙিয়েই তা দেখতে হয়। কিছু মানুষ তা দ্যাখে। ঋষিবাক্য ধরতেও কামেল হতে হয়। এভাবেই কবিতারা বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে ভালোবাসা। ভালোবাসাও অনুভূতিময়। ধরা যাবে না, দেখা যাবে না, টের পাওয়া যাবে, অাছে, না নেই? কবির বালিশে অাজ তুলো নেই, ভুলও নেই, শুধু ভালোবাসা প্রশ্রয় হয়ে অাছে।

গাছ মনে মনে বলেছে, ভালোবাসা, প্রশ্রয় হয়ে থেকো, কবিতার জন্যে, কবিতার জনক কবির জন্যে। নদী ঢেউয়ে-ঢেউয়ে বলেছে, ভালোবাসা জলময় হয়ে থেকো, ছলাৎ ছলাৎ করে ডেকো কবিতাকে। পাখি তো বলেইছে। বাগানের অাধফোটা ফুলটি বলেছে। কি বলেছে? বলেছে, ঘ্রাণটুকু দিয়ে যাই কবিতাকে, যদি কবির তা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্যে পৌঁছয়। সত্যিই কি তাই? হ্যাঁ, সত্যিই তাই। কবিতা এমনই। কবিতাকে কাছে ডেকে কথা বলা যায়। কবিতাকে বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরা যায়। কবিতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা যায়। অাবার এই কবিতাই গোপনতা ভেঙে দেয়। তাই কবির বালিশে কোনো তুলো নেই, ভুলও নেই। সত্যি, ভালোবাসা প্রশ্রয় হয়ে অাছে।

সেই প্রশ্রয়ে ছিলেন শহীদ কাদরী। বাংলাভাষার কবি। মৃত্যু-অবধি জীবনের শেষ সাড়ে তিন দশক বিদেশের মাটিতে বসবাস করে চলে গেলেন ২৮ অাগষ্ট, অাটলান্টিকের ওপারের এক দেশে। নীরা কাদরী, তার তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন পাশে। বহুকাল বাংলা ভাষা থেকেই দূরে থাকলেন এই কবি। বাংলাদেশ থেকে দূরে থাকলেন। দূরে থেকেই চলে গেলেন তিনি। অামাদের প্রজন্মের কাছে এই শহীদ কাদরী জ্বাজ্জাল্য মিথ। অামরা যারা, কবিতার ঘর-বারান্দায় পেতেছি জীবন, মেতেছি হাওয়ায়, অামরা এই কবিকে দেখিনি কখনো। কারণ, অামরা যারা মফস্বল থেকে একদিন কবিতাকে ভালোবেসে ঢাকায় এসেছি, ধরা যাক অামার কথাইঃ অামি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হই, সেই সূত্রেই অামার ঢাকায় এসে থাকবার সুযোগ পাওয়া হলো। কবিতা তো লিখি ঢাকা অাসবার অাগে থেকেই, যখন খুলনায় ছিলাম, যখন ঝিনাইদহ-যশোরে ছিলাম। যখন বাল্যকাল ছিলাম। যখন কুমার নদ ছিলাম, যখন কালিগঙ্গা-নবগঙ্গা-ভৈরবের পাড়ে বিকেলের দিকে অকারণ হাঁটাহাঁটি ছিলাম, সূর্যাস্তের মেঘবর্ণ দেখে নেশা ছিলাম, যখন গ্রামের সন্ধ্যায় হারিকেন ছিলাম, তখন থেকেই কবিতায় ছিলাম। সম্ভবত একধরনের অসুখ, কবিতা। কারো কারো বাল্যকালেই এই অসুখ হয়। অামার হয়েছে। ছাড়েনি। ছাড়বে? মনে হয় না। কবিতা থেকে সেরে ওঠানোর কবিরাজও নেই দেশে। সুতরাং অসুখ বয়ে বেড়াচ্ছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি। শহীদ কাদরীও বেড়াতে গিয়েছিলেন, জার্মানি বা অ্যামেরিকায়, থাকলেন প্রবাসী হয়ে অনেকবছর। প্রবাস থেকেও বেড়াতে গেলেন অারো প্রবাসে, যে-প্রবাস থেকে ফেরার কোনো ভিসা নেই মানুষের।

তো বলছিলাম না, ঝিনেদা-শৈলকুপা-মাগুরার দিকে বালকাল ছিলাম? ছিলাম। ওদিকেই তারুণ্যের উন্মেষে ছিলাম। গতশতাব্দির এইটটিজে অামি ওদিকেই ছিলাম, খুলনা-যশোরে ছিলাম। কুষ্টিয়া-ফরিদপুরের দিকেও ছিলাম। অার সেই ছোট্ট শহর, নবগঙ্গা নদীর পাড়ে, ঝিনাইদহ, যার প্রধান দুটি পুরনো সড়কের নাম গীতাঞ্জলি সড়ক এবং অগ্নিবীণা সড়ক, অামি সেই শহরে বসেই কলেজে পড়ার দিনগুলোতে হাতে পাচ্ছিলাম অামার না-জানা কবিদের কবিতা। শামসুর রাহমানকে হাতে পাচ্ছিলাম। অাবুজাফর ওবায়দুল্লাহকে হাতে পাচ্ছিলাম। অাল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, সুনীল-শক্তি-বিনয়-উৎপল-শহীদ কাদরীকেও হাতে পেলাম। অাবুল হাসান-নির্মলেন্দু গুণকে পেলাম। রফিক অাজাদ-অাবিদ অাজাদ পেলাম। পেলাম কি...পাচ্ছি তো পাচ্ছিই। প্রতিদিনই পাচ্ছি। সেইসব দিনেই অামি শহীদ কাদরীকে পড়ে পড়ে উঠি। অামাদের বন্ধুদের কার না মুখস্থ--প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিকই, কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না! তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা, শহীদ কাদরীর এই কবিতা কলেজ-ইউনিভার্সিটি পেরুনো কোন ছেলেমেয়ের মুখস্থ নেই, যারা বা কিছুটা দুষ্টুছাত্র! কিন্তু বলতেই হয়, অনেককালের প‌্যানপ‌্যানানির পর নাইনটিজের বাংলা গানে পুরনো গাঁথুনি ভেঙে নতুন একটি ছন্দের জাহাজ নিয়ে ভিড়লেন সুমন চট্টোপাধ্যায়। সুমনের সুর-কণ্ঠে বেজে উঠল 'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা'। সেই সুর-কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়ল শহীদ কাদরীর কবিতাটি। কাদরীর কবি পরিচিতি সুমনের গান শোনা শ্রোতাদের ঘরেও পৌঁছুল।

একদা, সংবাদ ট্র্যান্সলেটর সুমন চাটুজ্যের সহকর্মী ছিলেন নাজমুননেছা পিয়ারি, জার্মানিতে, ডয়চে ভেলে। সেই সুন্দরী পিয়ারি ছিলেন কবি শহীদ কাদরীর প্রথম দিকের দ্বিতীয় নারী। জার্মানিতে তখন সত্তুরের দশক। অন্যান্য জায়গাতেও তাই, সত্তুরের দশক। তাইলে অার জার্মানিতে তখন সত্তুরের দশক_এ কথা বলার মানে কি? কোনো মানে নেই। বলতে বলতে চলে এলো। যাই হোক, সেখানে শহীদ কাদরীর সঙ্গে পিয়ারির অার বেশিকাল একছাদের নিচে থাকাথাকি হয়নি, কাদরী চলে গেলেন অাটলান্টিকের ওপারে, মার্কিন মুলুকে। এবং শোনা কথা বলি? পিয়ারি অার সুমন থাকলেন একছাদের নিচে, জার্মানিতে। সেই ছাদও ভঙ্গুর, ফলে অাকাশ দেখা যায় ঘরে শুয়েই। অাকাশে উড়োজাহাজ চলে, ঘরের বিছানায় শুয়েই দেখা যায়। একসময় সুমন চট্টোপাধ্যায় কোলকাতা ফিরে গিটার বাজিয়ে অচেনা ছুটির ছোঁয়াতে বললেন 'তোমাকে চাই'। অাগের অনেক রেকর্ড ভেঙে গলা ছাড়লেন, হাল না ছাড়ার কথা বললেন, বব ডিলান বা শহীদ কাদরীর কবিতাকে সুরে ফেললেন। প্রিয়তমার উদ্দেশ্যে এক দুধর্ষ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেন গানশ্রোতাদের মাধ্যমে, বললেন, 'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা, ভয় নেই, এমন দিন এনে দেব, সেনাবাহিনী বন্দুক নয়, গোলাপের তোড়া হাতে কুচকাওয়াজ করবে শুধু তোমারই সামনে, প্রিয়তমা।'

২০১২ সালে কক্সবাজারে গিছলাম কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার জন্মদিনের একটি অনুষ্টানে। একটি বাসভর্তি ঢাকা-চট্টগ্রামের লেখক-সম্পাদক-সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগীগণ। তো কক্সবাজার থেকে বেশ কিছু দূরে হিমছড়ি যাওয়ার রাস্তার ধারেই দরিয়ানগর। দরিয়ানগরে হুদা ভাইয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। সমুদ্রের ধারেই অনুষ্ঠান মঞ্চ। দুষ্টুরা তো বেশিক্ষণ মঞ্চসভা ঘিরে থাকতে পারে না, অামিও তাই। অামি সব দুষ্টুর ভাই, সব দুষ্টুর বন্ধু। তাই দুই পা হাঁটলেই যখন সমুদ্র, বঙ্গোপসাগর, তো হাঁটি না কেন? না, হাঁটতে তো কোনো বাঁধা নেই। হঠাৎ দেখি, সমুদ্রের ধারে হেঁটে বেড়াচ্ছেন এক নারী, বয়স পালিয়ে অাছে যার প্রবাসী ছটায়। পাশে ছিলেন কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদক অাবুল হাসনাত বা কবি-গল্পকার মাহমুদ অাল জামান। হাসনাত ভাই বললেন, 'টোকন, এখানে, ওই যে একটা টিনের ঘর দেখছেন, ওখানে বিয়ার পাওয়া যাচ্ছে। দুটো মেরে দিতে পারেন। হাসনাত ভাইয়ের মতো গম্ভীর ব্যক্তিত্বের মানুষও সমুদ্রের ইশারায় 'দুটো বিয়ার মেরে দেওয়ার কথা বলতেই পারেন, বুঝলাম। ফলে, তার একটু পরই দুটো নয়, চারটে বিয়ার মেরেছি। তখন হাসনাত ভাইই পরিচয় করিয়ে দিলেন, 'ইনার সঙ্গে অাপনার অালাপ অাছে?'
'না'
'ইনি নাজমুননেছা পিয়ারি'
বললাম,'অাপনি কি জার্মানিতে থাকেন?'
সেই নারী হ্যা বললেন। অামি বললাম, 'শহীদ কাদরীর কবিতা পড়ি অার অাপনাকে চিনব না? সুমনের গানও একসময় ঘোরগ্রস্থ হয়ে শুনেছি।'
তারপর, ওই যে বললাম, সমুদ্র। সমুদ্রের নিজস্ব উস্কানি অাছে, কবিতার মতো। অামি ও পিয়ারি পরষ্পর শরীরে শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালাম। দেবু দা ক্যামেরায় পটাপট কয়েকটা ফটো তুললেন। দেবু দা হচ্ছেন দেবাশীষ গুপ্ত। গুপ্ত দা রসিক কাম ফটোগ্রাফার। জানাশোনায় পণ্ডিত। শহীদ কাদরীর এককালের সঙ্গী, সুমন চট্টোপাধ্যায় বা পরবর্তীকালে ধর্মান্তরিত কবীর সুমনের এককালের সহকর্মী-মর্মী পিয়ারির শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার কার্যকারণের ক্ষণমুহূর্তে অামার শরীরে একরকম শিহরণ হচ্ছিল। অামি টের পাচ্ছিলাম। অামি জানি, পিয়ারির শরীরও টের পাচ্ছিল। কি টের পাচ্ছিল? টের পাচ্ছিল, অামাদের মানবশরীরের তাপমাত্রা। অামাদের জ্বর-টর ছিল না, নাকি তাৎক্ষণিক জ্বর এসে পড়েছিল? সেই জ্বরের জন্যে কি শহীদ কাদরীই দায়ী নন? শহীদ কাদরী যদি কবিতা না লিখতেন, অামিও যদি কবিতা না পড়তাম, না লিখতাম, তাহলে পিয়ারি অাপার সঙ্গেও তো দেখা হবার কারণ ছিল না। তাকেও অামার বইপত্রে পড়ে জানার সুযোগ ঘটত না। জগৎ বড় লীলাময়। লীলাময়ী, অামারে অার মারিসনে এভাবে। পারিনে। সেটা বুঝিস? বুঝিসনে। তাতে অামি মরি। মরলে তুই খুশি হবি? যদি হোস, একদিন মরে দেখাব, দেখিস।
রচনা তো মৃত্যুর দিকে যাবে না, সে যতই শহীদ কাদরীর শারীরিক প্রস্থান হয়ে যাক না কেন। তো পরে সমুদ্রের স্বাদে ভিজে ঢাকায় ফিরলাম, নাজমুননেছা পিয়ারির সঙ্গে অামার অার কখনো দেখা হয়নি। নারী পিয়ারির সঙ্গে ঘেঁষে দাঁড়ানো সেই ছবিও ফেসবুক-টুকে অাপলোড দিইনি।

অার ইদানিং ফেসবুক এসে পেলাম নীরা কাদরীকে। শহীদ কাদরীর তৃতীয় স্ত্রী। জীবনে নিজের একজন নারী পেতে কত কী যে করতে হয়। তারপরও কি মেলে? তবে নীরা কাদরীর সঙ্গে অামার ফেসবুকে কথা হয়েছে। উনি প্রায়ই শহীদ কাদরীকে ঘিরে ঘরোয়া-অাধাঘরোয়া অনুষ্টানাদির ছবি পোস্ট দেন। সেসব ছবিতে দেখি, কাদরী হয়তো কবিতা পড়ছেন, অ্যামেরিকায় থাকা তার বাঙালি কবিতাপাঠক ভক্তকুল তাকে ঘিরে বসে অাছে। এইসব অাপলাড করা ছবি দেখে অামার মনে হয়েছে, এই নারী, নীরা, সুনীলের কবিতার প্রহেলিকাময়ী নীরা নয়, বাস্তবিক বাঙালি বউ নীরা। কবি শহীদ কাদরীর স্ত্রী নীরা। নীরা নিজেও কবিতার সমঝদার, ছবি দেখে, ছবির নিচের ক্যাপশন-ছবির অভিব্যক্তিই তা বলে দেয়। দীর্ঘদিন ধরেই কাদরী অসুস্থ্য। অামরা জানি। শুনি। শহীদ কাদরী অামাদের কাছে মিথ। মিথকে দেখিনি এই কখনো, স্বচক্ষে।

কবির দ্বিতীয় স্ত্রী সম্পর্কে ১৯৯৮ সালের দিকে কিছু কথা প্রতিকৃতি-ফটোগ্রাফার নাসির অালী মামুনের কাছে শুনেছি। মামুন ভাই তার কয়েকবছর অাগেই অামেরিকার ট্যাক্সি চালানো জীবন অার ফাঁকে ফাঁকে বিখ্যাত মানুষ যেমন গিন্সবার্গ-কেরুয়াক-ব্রদস্কি মার্কাদের ছবি তুলে বেড়ান। সেরকমই একদিনে মামুন ভাই গেছেন বোস্টনে, কাদরীর বাসায়, ছবি তুলবেন, ইন্টাভিউ নিতে। তো তখন কাদরীর সংসারে তার দ্বিতীয় স্ত্রী, অ্যান অামেরিকান ক্রেইজি-ক্রুয়েল ফিমেল। নাম, দ্রামা কাদরী। মামুন ভাইকে ঢুকতে দেখেই সেই নারী বিরক্ত। তিনি নাকি কোনো বাঙালিকে কাদরীর বাসায় রিসিভ করতেন না। এটা তো কবির উপরে বৈবাহিক-পৈচাশিক পানিশমেন্ট। তো মামুন ভা্ইকে ঢুকতে দিতে চাননি দ্রামা কাদরী। শেষপর্যন্ত নাসির অালী মামুন কাদরীর বাসায় ঢুকতে পেরেছেন। তবে তার সঙ্গে মামুন ভাইয়ের যেটুকু হাই-হ্যালো হয়েছিল শুরুতেই, ইংরেজিতে। কাদরীর অামেরিকান বউটি নাকি কিছুতেই মামুন ভাইয়ের কথামতো মানতে রাজি হচ্ছিলেন না যে, তার স্বামী কালো চামড়ার এশিয়ান লোকটি বাংলাদেশের বা বাংলাভাষার একজন শক্তিশালী কবি। যাই হোক, মামুন ভাইয়ের কাছে অামার এসব কথা শোনা, অাড্ডায় বসে। মামুন ভাই সেদিন বোস্টনের বাসায় কাদরীর ছবি তুলছেন। তাতেও মহিলা বিরক্ত। সেই অবস্থায় মামুন ভাই মনে করেছেন মহিলা যেহেতু অ্যামেরিকান, বাংলাভাষাও বোঝে না, তাই কাদরীকে উদ্দেশ্য করে নাসির অালী মামুন বলে দিলেন, 'কাদরী ভাই, এই মাতারিরে পাইছেন কই?'
কাদরী অাঁৎকে ওঠেন, 'চুপ চুপ চুপ'।
মামুন ভাই বললেন, ' ভাবি বাংলা বোঝে?
শহীদ কাদরী বলেন, 'না, তা বোঝে না। কিন্তু হইছে কি মামুন, কোনো এক দুর্বল সময়ে সে অামার কাছে শুনতে চেয়েছিল, তোমাদের ভাষায় মেয়েদের কি কি গালি দেওয়া হয়, শেখাবে? অামি তো কিছু শিখাইছি। এর মধ্যে ধরো তুমি যে শব্দটা বললে, ওটাও ও জানে, অামিই তো একদিন শেখাইছি। তাই কথাবার্তা যা বলার, হিসেব করে বলবা।' ভাগ্য ভালো, মামুন ভাই ' কাদরী ভাই, এই মাতারিরে অাপনি পাইছেন কই' বলার মুহূর্তে দ্রামা কাদরী অন্যঘরে ছিলেন। বাঁচা।

শহীদ কাদরীর সঙ্গে অামাদের তো দেখা হয়নি। অামেরিকায় গেলাম না, উনিও দেশে ফিরলেন না জীবদ্দশায়, অাফসোস রয়ে গেল
অামার। অামাদের প্রজন্মেরও। দুতিন বছর অামাকে একজন ফোন করে বললেন, তিনি অামেরিকায় থাকেন। শাহবাগ অাজিজ মার্কেটে বইয়ের দোকানে বা কাঁটাবন কনকর্ড অ্যাম্পোরিয়াম বুক মার্কেটে তিনি থাকবেন, অামি যেন অামার সময় মতো ওই দিন ওখানে থাকি।

ব্যাপার কি?

ব্যাপার হচ্ছে, সেই লোকটা অ্যামেরিকায় থাকেন, ঢাকায় এসেছেন, অাবার অ্যামেরিকায় ফিরে যাবেন। তার উপর অর্পিত দায়িত্ব মোতাবেক তিনি কিছু কবিতার বই কিনেছেন। অামার কবিতার বই 'ঘামসূত্র' 'রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন অ্যা ডে' তার দুটো। অামাকে বই দুটোতে অটোগ্রাফ দিতে হবে, অটোগ্রাফ দিতে হবে শহীদ কাদরীর নামে, কারণ, তিনিই এই লোকটিকে কিছু বইয়ের বা লেখকের নাম বলে দিয়েছেন, যেন তিনি অটোগ্রাফসহ বইগুলো ঢাকা থেকে কিনে অ্যামেরিকায় নিয়ে যান। অাবার বিমানে খুব বেশি ওজনের কিছু নেওয়ার ঝামেলা অাছে, অতিরিক্ত শুল্ক দিতে হয়, তিনি তাই করবেন বললেন। অামার কবিতার বইতে শহীদ কাদরীর নামে অটোগ্রাফ দিতে হলো, দিয়েছি, কাদরীর ইচ্ছায়, এক অদ্ভুত অানন্দ পেয়েছি শরমে-মরমে। পরে অামাদের বন্ধু অালফ্রেড খোকন অ্যামেরিকায় গিয়ে শহীদ কাদরীর সঙ্গে অাড্ডা দিতে গিয়ে টের পেল, তিনদশকের বেশি দেশের বাইরে থেকেও কাদরী অামাদের কবিতার খবরাখবর রাখেন।
খোকন ঢাকায় ফিরে ফোনে সব বলল। সেই উপলক্ষেও অামাদের জল ভরা দুটো বোতল খালি হয়ে গেল। উপলক্ষ না!

বন্ধু মারজুক রাসেলের সঙ্গেও কাদরীকে নিয়ে বোতল খালির শূন্যতায় কত কথা শেয়ার করেছি অামরা। কতকতরাত? কতকতদিন? অমলিন অামাদের সোনাঝরা দুপুরের ডিং ডিং ডিং। টেলিভিশন নাটক নির্মাতা মাসুদ সেজানের একটি অাবৃত্তির দল ও অাবৃত্তি বিষয়ক ত্রৈমাসিক জার্নাল ছিল। সেই জার্নালের প্রত্যেক সংখ্যার প্রধান রচনাটি অামাকে দিয়ে লেখাত সেজান। অামরা বন্ধু, অকৃত্রিম, সেইসব দিনের, যখন রাতে খুব কম টাকায় খাওয়ার জন্যে অামি অার সেজান জগন্নাথ হলে শাকসবজি দিয়ে রাতের ভাত খেয়ে নিতাম। প্রথ্যেকরাতেই বেইলি রোড থেকে নাটকের দল 'নাট্যকেন্দ্র' করা দিনগুলেতে অামি সেজান এরকম করে খেয়েছি, চলেছি। কবিতার মধ্যে ডুব মেরেছি। অার সেজানের অাবৃত্তিগ্রুপ একক কবির কবিতা দিয়ে, মমতা দিয়ে সুন্দর করে অাবৃত্তির অনুষ্ঠান করত। কয়েকটি অনুষ্ঠান করেছিল ব্রিটিশ কাউন্সিল অডিটোরিয়ামে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, অাবুজাফর ওবায়দুল্লাহ, অাবুল হাসান, শহীদ কাদরী_অার যেন কোন কবির কবিতা নিয়ে অাবৃত্তি-অনুষ্ঠান করেছিল, এখন মনে নেই। প্রত্যেক অনুষ্ঠানে যে স্যুভেনিরটা বের করত সেজান, স্যুভেরিরের মূখ্য লেখাটি অামাকে দিয়ে লেখাত। লিখে অামারও ভালো লাগত। সেদিন, গতশতাব্দির '৯৭/৯৮ সালে সেজানদের একটি অনুষ্ঠানে শহীদ কাদরীর কবিতা থেকেই শিরোনাম করে অামি লিখেছিলাম, শহীদ কাদরী বাড়ি নেই।

দেশভাগের ফলে কোলকাতা থেকে ঢাকা অাগত শহীদ কাদরীর পরিবার পুরানা পল্টনে বসবাস শুরু করে। কিন্তু তার কবি জীবন তাকে ঢাকাতেই অাটকে রাখতে পারেনি। প্রয়াণের ৩ দিন পর, অাজ অাবার লিখছি শহীদ কাদরীকে নিয়ে, এ লেখারও নাম, শহীদ কাদরী বাড়ি নেই। বাড়ি নেই? কোথায় গেছেন? বিউটি বোর্ডিং? বাংলাবাজার? রেকস রেস্তোরায়? নাকি শাহবাগের দিকে, অামাদের সঙ্গে অাড্ডায় বসবেন বলে?

কবি শহীদ কাদরীর হিমায়িত শরীর অামেরিকা থেকে ঢাকায় অাসছে অাগামীকাল, ৩১ অাগষ্ট। যদিও, অমৃতের পুত্রকন্যারা মরে না কখনো।

৩০ অাগষ্ট ২০১৬
রাত ৪.২৪ মিনিট

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৫:০১

নুরুন নাহার লিলিয়ান বলেছেন: অনেক কিছুই জানলাম। তবে দু:খজনক অনেকেই ওনাকে চেনে না এই প্রজন্ম বাংলা কবিতা, সাহিত্য,গল্পের কারিগরদের বুঝতে চায় না। ওনাকে নিয়ে একটা অধ্যায় বাদ মনে হলো। সেটা তার প্রথম জীবন। দুজন নারীর আগের জন। তিনি কে ভাই?

২| ৩১ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:৫১

রায়হানুল এফ রাজ বলেছেন: অনেক বড় লেখা। তবে অনেক কিছু জানলাম। আমার অনেক প্রিয় একজন কবি ছিলেন।

৩| ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ২:২৬

সাদিক তাজিন বলেছেন: বেশ কিছু জানা হলো প্রিয় কবি সম্পর্কে। আপনাকে ধন্যবাদ কবি বিশদ লেখাটির জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.