নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

৩২ পৃষ্ঠায় খড়, ৩৩ পৃষ্ঠায় অাগুন

টোকন ঠাকুর

কবিতা গল্প লিখি, ছবি আঁকি-বানাই, একাএকা গান গাই...

টোকন ঠাকুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

সে রহে বিরহে

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:১৯

সে রহে বিরহে, হাহাকারে, ভালোবাসায়
টোকন ঠাকুর


ইচ্ছে পেতে রেখে অপেক্ষায় ছিল পথ, সেই পথে ভালোবাসা অাসবে, এরকমই মনে হচ্ছিল। তাই তরুণ কবি দূরের কাশবন হয়ে ছিল। কবি কি কাশবন হতে পারে? হেমন্তের নৈশ-হাওয়ায় যে ছাতিমের ঘ্রাণ ছড়িয়ে থাকে, তরুণ কবি ছাতিমগাছ হয়ে একা দাঁড়িয়েছিল, ফাঁকা মাঠের মধ্যে। নদীপাড়ে তার যেতেই হবে, নদী তাকে ডাকবেই। বালুচরের সঙ্গে তার কিছু কথা অাছেই, কার? কার অাবার, তরুণ কবির। শ্রাবণে যে বৃষ্টি এলো, একথা সয়ং রাষ্ট্রই জানে না যে, প্রতিটি বৃষ্টিকণা পতনের ফোটা ফোটা ইতিহাস অাছে, সেই ইতিহাসের করুণ দর্শক তরুণ কবি। অাদতেই? এ কথা সত্য যে, সন্ধ্যার জোনাকি সবার কাছেই একটি পোকামাত্র কিন্তু সে শুধু পোকাই নয়, সে বিন্দু বিন্দু অাগুনের পাখি এবং যে অাগুনের সঙ্গে তরুণ কবির অালাপ করিয়ে দিয়ে থাকতে পারে একটি মুহূর্ত। কবি সেই মুহূর্তের সন্ধানে অপেক্ষায় ছিল বারোটি বছর। তাই দুপুর রোদের ঘূর্ণিতে যে ধুলো-কুটো-ছিন্নপত্র উড়ে যায়, কবি সেই ছিন্নপত্রের সন্ধানে চরৈবেতি ছিল। ছিন্নপত্রে কার নাম লেখা? উড়ে যাওয়া ছিন্নপত্রটি ধরতে ঘূর্ণির পেছনে দৌড়ুচ্ছে পাড়ার মোড়ের পাগলা হরেন। হরেন রণজিৎ দাশকে বলেছে, ছিন্নপত্রে লেখা অাছে একটি নাম, মালতী বসু। অামরাও দেখেছি দুপুরবেলায় ঘূর্ণির পেছন-পেছন দৌড়ে গেছে তরুণ কবি। ঘূর্ণির মধ্যে ছিন্নপত্র উড়ছে...

এই পর্যন্ত লিখে কি একটু থামা যায়? এই পর্যন্ত পাঠ করে কি কেউ ভাববেন, তরুণ কবি এবধরনের বিপদজনক পোকা! পোকাদের কথা কেন জানবে মানুষ? পোকারা তো খুব বোকা, অাগুনে লাফিয়ে পড়ে। বোকাদের কথা কেন পড়বে বুদ্ধিমান মানুষ? কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষমাত্রই তো চালাক মানুষ। চালাক মানুষ কি চালাক মানুষের কথা পড়ে মজা পাবে? মজাই তো সব। মজা পেতেই তো মানুষ একটা জীবন পার করার কথা ভাবে। মানুষ মজার সন্ধানে অর্থ খরচ করে সমুদ্রে যায়, পাহাড়ে যায়, জঙ্গলে যায়। কি পেতে যায়? মজা পেতে যায়। সেই মজা দেয় সমুদ্রের ঢেউ, পাহাড়ের কথা না বলা, অাদিম জঙ্গলের পাতার মর্মরতা! অার সেই পোকারা-বোকারা মজা দিয়ে যায়_গর্জিত ঢেউ হয়ে বালুতটে, শান্ত মৌন হয়ে পাহাড়ে, অচেনা একটি পাখির ডাক হয়ে জঙ্গলে। তরুণ কবিরাই সেই বালুতট, চুপচাপ পাহাড়ের গান কিম্বা তরুণ কবি অনেক গাছের ভিড়ে জঙ্গলের একটি গাছ কিম্বা পাতা কিম্বা পাখি কিম্বা পাখির ডাক। মানুষ ভ্রমণে যায় বটে, জীবনের ক্লান্তি ঢেলে অাসতে, কারণ মানুষ জানে, সমুদ্র, পাহাড় বা সেই জঙ্গল ক্লান্তিটুকু নেবে। মানুষের ক্লান্তি নেবে তরুণ কবি, এই হচ্ছে সারকথা। কারণ, পোশাকি নাগরিক মানুষের প্রেম নেই, তাকে দ্বারস্থ হতেই হবে কবিতার কাছে। ঝিনুকে যেমন দিনে দিনে মুক্তো জমে, অনেক জন্মের প্রেম জমিয়ে একজন কেউ তরুণ কবি হয়। তারপর তরুণ কবি তার বুকের সব প্রেম ঢেলে চলে যায়। কোথায় চলে যায়? অাবার সে মুক্তো জমাতে যায়, অনেক জন্ম পার হয়ে হয়ে, অনেক রক্ত ক্ষরণ করে করে সে বুকে অাবার প্রেম জমিয়ে চলে। তারপর জনপদে অাবার একদিন অামরা দেখতে পাই, একজন তরুণ কবি হেঁটে যাচ্ছে দুপুর রোদে, ওর বুকের মধ্যে ঘনজঙ্গল। অাবার অামরা দেখতে পাই, তরুণ কবি সারারাত বাড়ি ফিরছে না, ওর বুকের মধ্যে অর্থ-কীর্তি-স্বচ্ছলতাকে পাত্তা না দেওয়া পঞ্চমীর চাঁদ। নির্ঘুম সমুদ্রের গান বাজছে তরুণ কবির পাঁজরে। অামরা দেখতে বা শুনতেও পাই, বিগতকালের সব ব্যথাহত প্রেমিকের দীর্ঘশ্বাসই পাতার মর্মর হয়ে বেজে বেজে উঠছে বনভূমিতে। অাজকের বনভোজনপ্রিয় মানুষ দল বেঁধে যাচ্ছে সেই প্রেমিককুলের মর্মর দীর্ঘশ্বাস শুনতে। কেউ কেউ রেকর্ড করে অানছে দীর্ঘশ্বাসপুঞ্জ। সেই দীর্ঘশ্বাসই তো ভালোবাসা, যা তরুণ কবি চলে গিয়ে রেখে যায়। তাই জগতে তরুণ কবিকে মানুষের কাতারে ফেলে বিচার করাটা সংসারের দোষে দূষণীয় হবে, স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।

এবং এও স্মরণে রাখার বিষয় যে, দেশের সংবিধানে যেমন তরুণ কবির চিন্তা-জীবনযাপনকে শনাক্ত করে একটি শব্দও লেখা নেই, তরুণ কবিও বিচরণ করে এই সংবিধানের বাইরে দিয়েই। ফলে, তরুণ কবি রাষ্ট্র-সীমানার কাঁটাতার-পাঁচিলের মধ্যে বসবাস করে না। সে থাকে ভালোবাসায়, 'সে রহে বিরহে'। দেশের সংবিধান অনুযায়ী 'সংসার সীমানা'য় তরুণ কবি থাকে না। অাবার বয়সে তরুণ এবং কবিতা লিখছে_এমন সবাইকেই তরুণ কবি বলে চালিয়ে দেওয়া ঘোরতর অন্যায় হবে। যে তরুণ কবি, সে সমুদ্রের গান। যে তরুণ কবি, সে পাহাড়ের একাকীত্ব। সে বনের গভীর থেকে অাসা পাতা কিম্বা হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকদের শ্বাসপ্রশ্বাস, লোকে যাকে বলে দীর্ঘশ্বাস, যাই হোক।

সে, সে অাবার কে? সে হচ্ছে সেই তরুণ কবি, যাকে অামরা কয়েকজন্মের ভালোবাসা জমিয়ে জন্মাতে দেখেছি লোকালয়ে। সে সেই, তরুণ কবি, যাকে অামরা দেখতে পাই ভালোবাসার জন্যে নিজেকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে। বেশির ভাগ তরুণ এবং কবিতা লিখিয়েরাই যেটা পারে না। বেশির ভাগ তরুণ এবং কবিতা চর্চাকারীরাই যেটা পারে, সেটা হচ্ছে দিনে দিনে নিজের বয়স, কবিতার বই, সংসারে বাচ্চা-কাচ্চা বাড়িয়ে যাওয়া, যেটা অার দশজন কেরানিও করে বেঁচে থাকে। তারা সমুদ্র হতে পারে না, তারা কেরানি হয়; তারা পাহাড়ের ডাক শুনতে পায় না, তারা সারাজীবন পারিবারিক কথাবার্তার ধর্মাচার, ডাক্তারের দেওয়া স্বাস্থ্য-পরামর্শ্ব, কখনো রবীন্দ্রসঙ্গীত, খেলাধুলা বা দূরদেশের যুদ্ধের খবর এবং নিজেদের দেশাত্ববোধক গান শুনতে শুনতে বাঁচতে চায়। বাঁচেই বা অার কয়দিন! তবু বাঁচার সাধ মানুষের। প্রজননে পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর দিয়ে তারা বাঁচতে চায়, যেমন প্রোমোটার বাঁচে, সচিব বাঁচে, শ্রমিক বাঁচে, অাদম পাচারের দালাল বাচেঁ, সাংবাদিক বাঁচে, শিক্ষক বাঁচে, পুলিশ বাঁচে, পাদ্রি বাঁচে। সংসারের পাপ কুড়োতে কুড়োতে তীর্থে গিয়ে পাপ কমিয়ে এনে তারা বেশ বাঁচে। এই কি বেঁচে থাকা?

শুধু ভালোবাসার জন্যে বেঁচে থাকব, না হয় চলে যাব_এই অনুভূতি নিয়ে তরুণ কবি এক অশ্ব, ছুটে যায়। যেভাবে পোকা ছুটে যায় অাগুনের কাছে। স্ফুলিঙ্গের ক্ষণকালের পাখায় সে বাঁচে। খুব সঙ্গততকারণেই, 'মেইনস্ট্রিম সোসাইটি' তরুণ কবিকে ধরতে পারে না কারণ প্রেমিককে বুঝবার শক্তি এই মাটামোটা মানুষের মিলিত প্রবাহ যে 'সমাজ'_ তা এই সমাজের নেই। তাই এই সমাজের মানুষ মদ্যপায়ীকে চিনতে পারে, দূর থেকে কটাক্ষ করে, গালিও দেয় কিন্তু ঘুঁষখোর-সুদখোরকে তারা চিনতে পারে না। নাকি চেনে এবং ঘুঁষখোরের টাকা থাকার জন্যে তাকে সমীহই করে? মানুষ বড় অভাবী এবং এটা কিছু মানুষের তৈরি রাজনীতি যে, অন্যান্য বেশিরভাগ মানুষই চিরকাল গরিব। তাই মানুষ বড় লোভী। অভাবী-লোভী মানুষ সেই ঘূর্ণির মধ্যে ছিন্নপত্র খুঁজতে চাওয়া প্রেমিক এবং পাগলা হরেনকে কোনোভাবেই বুঝতে পারে না, পারবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কয়েকজন্মের প্রেম যে প্রেমিক বুকের মধ্যে জমিয়ে কবিজন্মের শাপ নিয়ে মর্তে অাগত, সে তো লোভী হতে পারে না। সে ব্যথা পেতে পারে। সে ব্যথা পায়। ভালোবাসাই তাকে ব্যথা দেয়। যে ভালোবাসার জন্যেই তার জন্ম ও জীবন, সেই ভালোবাসা দেয় ব্যথা? এই নিয়তি নিয়ে তরুণ কবি ঘুরে বেড়ায়। ফলে, অামাদের হয়তো মনে হয় যে, অামরা তাকে চিনি, অাসলে তাকে চিনি নিা। অামরা তরুণ কবি বা প্রেমিককে চিনতে পারি না। কারণ, অামরা তো কোনোমতে বেঁচে থাকতে চাই। অামাদের কাছে এই টিমটিমে জীবনই অনেক বড়, একে টেনে হিঁচড়ে ষাট-সত্তুর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার একটা অাকাঙ্খা নিয়ে ফেলেছি। অামরা তাই অাবুল হাসানকে বুঝতে পারিনি। অাবুল হাসান তরুণ কবি। অামরা তাই অাপন মাহমুদকে চিনতে পারিনি, অাপন অামাদের হারিয়ে যাওয়া তরুণ কবি।

অাবুল হাসানের কবিতার দুটো লাইন অাছে না_ঝিনুক নিরবে সহো, ঝিনুক নিরবে সহে যাও/ ভেতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তো ফলাও'_তরুণ কবি চিরকাল তাই। এখন পর্যন্ত কতজন তরুণ কবি অামাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে? গত সপ্তাহে চলে গেলেন মাহবুবুল হক শাকিল। প্রেম থৈ থৈ করছিল তার বুকের ভেতর। কবিতা টগবগ করছিল তার মাথায়, '...খেরোখাতায়' বা 'মনখারাপের গাড়ি'তে। সব রেখে শাকিল চলে গেলেন। ব্যথা রেখে গেলেন। হাহাকার রেখে গেলেন। ভালোবাসা রেখে গেলেন। এখনো ভালোবাসার জন্যে কবিতার খাতা বা জীবন উৎসর্গ হতে পারে, সেই যে চিরকালের অগ্নিদাহের তরুণ কবি যা পারে, তা পেরে গেলেন। কবি মাহবুবুল হক শাকিল এরপর সারাজীবন অামাদের কাছে একজন প্রেমিক ও তরুণ কবি হয়েই বেঁচে থাকবেন। সমুদ্রে গেলে তাকে ফের পাব, স্তব্ধতা অনুবাদ করতে পাহাড়ে গেলে তাকে পাব, শাকিলকে পাব। বনভূমিতে গেলে, উৎকর্ণ হতে পারলে যে পাতার মর্মর শুনতে পাব, জানিই যে, সেই মর্মরে কবি শাহবুবুল হক শাকিলের দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে অাছে।

যে-দেশে মেয়ে শিশু-বালিকা, কিশোরী-নারী অপহরণ করে ধর্ষণ করে হত্যা করে ফেলে যাওয়া দৈনন্দিন খবর, সেইদেশেই শাকিল একজন নারীকে ভালোবেসে নিজেই চলে গেলেন, এটাই তো সত্য। ভালোবাসার পাগল এই তরুণ কবির জন্যে অাজ বাতাসের কানে কানে হাহাকার ছড়িয়ে পড়েছে। ভেতরে ভেতরে ভালোবাসার পিপাসায় কে অার্ত নয়?


মাহবুবুল হক শাকিলের অকাল প্রস্থানে তার বাবা-মা যেমন সন্তান হারালেন, মৌপী, তার মেয়েটা বাবা হারাল, স্ত্রী হারালেন স্বামী। বাংলা কবিতা হারাল একজন তরুণ কবিকে। অামরা হারালাম অামাদের প্রজন্মের এক ঈর্ষণীয় বন্ধুকে। এই ব্যথা, হাহাকারের মধ্যে তবু প্রতিষ্ঠা হলো কি জানেন? সেই সত্য, এখনো ভালোবাসার জন্যে নিজেকে বিলীন করে দেওয়া যায়। চিরকালের অভিমানী কিশোর হয়ে থাকলেন শাকিল। শেকসপিয়রের নাটকের যে-চরিত্র অল্প বয়সে মারা মারা যায়, সেই নাটক যে দেশেই মঞ্চস্থ হোক, সেই চরিত্র সে-দেশেও সেই অল্প বয়সেই মারা যায়। কারণ, এটা ঐ চরিত্রের নিয়তি। মাহবুবুল হক শাকিলও তার নিজের চরিত্রের নিয়তিতে থেকে গেলেন অামাদের চেতনায়, অাড্ডায়-অালাপে, যে শাকিল তরুণ কবি, যে শাকিল প্রেমিক।

কোলকাতায় দেখা হলো, ওটাই জীবনের প্রথম ও শেষ দেখা, অনলাইনের বাইরে, সেদিন হালকা অাড্ডাও হলো। এবং কথা হলো, ঢাকায় অামাদের অারো অাড্ডা হবে। কথা ছিল। কথা থাকল না। সেই অাড্ডা অার হবে না এ জীবনে, কারণ, অাপনি চলে গেলেন শাকিল, অামাদের কবিবংশের জাতক, ভাই। অাপনার বিদায়ে হাহাকারের বিষাদ পেয়েছি, পাচ্ছি।

একজন অাপনাকে পুড়িয়েছে, ঠিক, অাজ তো লক্ষজন অাপনাকে তাদের হৃদয়ে গ্রহণ করে নিয়েছে, এটাই তো তরুণ কবির প্রাপ‌্য। অাপনি পেয়েছেন, শাকিল।

লাভু হে লাভার।

১১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ঢাকা

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:৪৭

নীলপরি বলেছেন: খুবই মায়াময় আর বেদনাদা্য়ক লাইনগুলো ।
বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই কবি মাহবুবুল হক শাকিলকে ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.