নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

৩২ পৃষ্ঠায় খড়, ৩৩ পৃষ্ঠায় অাগুন

টোকন ঠাকুর

কবিতা গল্প লিখি, ছবি আঁকি-বানাই, একাএকা গান গাই...

টোকন ঠাকুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

রফিক আজাদকে ভালোবাসি

২১ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:১৪


রফিক আজাদকে ভালোবাসি
-------------------------------------------------
যে অসুখ কবিতা, যে অসুখ বালকবেলার, সেই অসুখের ডাক্তার খুঁজে বেড়াতাম। আমার সেই অসুখের সে রকম ডাক্তার পেলেই তাকে কী কারণে জানি না, মনে হতো আপন মানুষ, আপন দলের মানুষ। সেটা ঘটেছে, যখন আমি মধুপুর-গাড়াগঞ্জ এলাকার পৈতৃক বাড়িতে বড় হচ্ছিলাম। গাড়াগঞ্জ বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে থাকাকালেই কবিতা যে দারুণ অসুখ, আমি সেই অসুেখ পড়ে গেলাম। এবং দেখলাম, বাল্যবেলার সেই অসুখ কীভাবে সারা জীবন অসুস্থ করে রাখে কবিতা মুড়িয়ে।

তো যখন ঝিনেদা সরকারি কেশবচন্দ্র কলেজে ইন্টারমিডিয়েট মার্কা একাডেমিক বাধ্যবাধকতায় উত্তীর্ণ হলাম, কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শহীদুর রহমানকে আমার খুব বেশি পছন্দ হয়ে গেল। এই শহীদুর রহমান যে একজন নতুন ধারার গল্পলেখক, আমি জানলাম। শহীদ স্যার তাঁর প্রথম ও শেষ গল্পের বই ‘বিড়াল’ দিলেন আমাকে পড়তে। আমি ‘বিড়াল’ পড়তে পড়তেই টের পেলাম, শহীদুর রহমান একজন কবি, গল্পলেখক তো বটেই। একদা সাংবাদিকতা করতেন ঢাকায়, জগন্নাথ কলেজেও অধ্যাপনায় ছিলেন, পরে তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দিবারাত্রির কাব্য’-বিষয়ক উচ্চতর গবেষণার জন্য কলকাতায় গেলেন। কলকাতায় ‘দিবারাত্রির কাব্য’ গবেষণা শেষ না করেই ঢাকায় ফিরলেন। ঢাকাতে তাঁর স্ত্রী একটি কলেজের অধ্যক্ষ, ছেলেমেয়ে দুটিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে; কিন্তু অধ্যাপক শহীদুর রহমান ঢাকায় পোস্টিংটা ফেরত পেলেন না। নিজের জন্মভূমি ঝিনেদার সরকারি কলেজে চলে গেলেন এবং প্রায় এক দশক কেশবচন্দ্র কলেজে অধ্যাপনায় থেকে ঝিনেদাতেই মারা গেলেন। আমিও ঝিনেদায় বসে ঢাকার সব দৈনিক কিনলাম সেদিন, ১৯৯২ সালে। ছবিসহ সংবাদ বেরুল ঢাকার সব দৈনিকেই। আমি দৈনিক কাগজগুলো কিনেছিলাম শুধু ওই একটা নিউজের জন্যই। ‘অধ্যাপক শহীদুর আর নেই’ এবং সংবাদের মধ্যে লেখা, ‘উন্মাতাল ষাটের দশকের নিভৃতচারী কবি ও গল্পকার অধ্যাপক শহীদুর রহমান ‘বিড়াল’ নামে একটি গল্প লিখে সবার তীব্র মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিলেন। তিনি সমকাল, পূর্বমেঘ, কণ্ঠস্বর, পলাশ ফোটার দিনে, সাম্প্রতিক ইত্যাদি কাগজে লিখতেন। পরে তিনি ঢাকা ছেড়ে মৃত্যু পর্যন্ত তার নিজের জেলা ঝিনেদা সরকারি কেশবচন্দ্র কলেজের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করতেন।

শহীদুর রহমান জীবনের প্রায় শেষ বয়সে গিয়ে বন্ধুবান্ধবদের এক রকম চাপে পড়েই প্রকাশ করেন তাঁর একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘বিড়াল’ ও একমাত্র কবিতার বই ‘শিল্পের ফলকে যন্ত্রণা’। আমাকে দিলেন। ‘বিড়াল’ গ্রন্থের ১০/১২টা গল্পের প্রায় সবগুলোই প্রকাশিত ষাটের দশকে, সিকান্দার আবু জাফর, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বা আহসান হাবীবের সম্পাদনায় প্রকাশিত। দেখলাম, ‘বিড়াল’-এর ব্যাক কভারে শহীদুর রহমানকে নিয়ে একটি স্মৃতিধর্মী এবং গল্পগুলোর মূল্যায়ন নিয়ে একটি ভূমিকা লেখা। লিখেছেন, কবি রফিক আজাদ। তার আগে আমি রফিক আজাদের কবিতা তেমন পড়ার সুযোগ না পেলেও শহীদ স্যারের সঙ্গে খুব সময় কাটাতাম তো, তাই স্যারের মুখেই খুব শুনতাম, ‘রফিক আর আমি তো এক রুমে থাকতাম। আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলাম। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও আমরা হলে থাকতাম একসঙ্গে। তবে ঢাকা কলেজের ইন্টারে আমি পরীক্ষা ড্রপ করেছিলাম বলেই কলেজের পেছনে একটি রুম ভাড়া নিয়ে থাকতাম। সেই রুমের নাম দিয়েছিলাম, ‘নষ্ট নীড়’। রফিক থাকত আমার সঙ্গে, নষ্টনীড়ে। রফিক শুধু কবিতার সঙ্গেই ঘুমোত, শুতো। আমাদের আর বন্ধুরা কেউ গল্প, কেউ কবিতা, কেউ অন্যান্যতে ছিল। বন্ধুদের মধ্যে ইলিয়াস, আমি আর অশোক সৈয়দ পরে আবদুল মান্নান সৈয়দ ছোটগল্পের নতুন ভাষাকাঠামো-গঠনকাঠামো নিয়ে বেশি বেশি মনোযোগ দিতে চেয়েছি। ইমরুল, আসাদ, ফারুক আলমগীর, আবু জাফর, আবুল কাশেম ফজলুল হক, আহমদ ছফা, বুলবুল খান মাহবুব, শাহজাহান হাফিজ, রশীদ হায়দার, মনসুর মুসা, ...আরো যে আমার বন্ধু ছিল। কিন্তু রফিক আর আমার তুইতুকারি সম্পর্কের বন্ধুত্ব হয়েছিল ৬১তেই, যখন রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী আয়োজনের ওপর পাকিস্তানি জেনারেল আয়ুব খান সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিল। সে কারণেই সে বছরই ঢাকায় আয়ুব সরকারের নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে গড়ে উঠল গানের প্রতিবাদ ‘ছায়ানট’।

ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময়ই আমি রফিক আজাদের কবিতা-জীবন খানিকটা জেনে ফেলি আমার শিক্ষক এবং রফিক আজাদের বন্ধু গল্পকার শহীদুর রহমানের কাছে, মুখে মুখে গল্পে, আড্ডায়। ঠিক শহীদ স্যারই আমার ইন্টার লাইফে বুঝতে সুবিধা করে দিলেন, কলেজে ক্লাস করার চেয়ে আড্ডা কত গুরুত্বপূর্ণ। সেই আমার রফিক আজাদকে চিনে উঠতে পারার শুরু। চিনতে চিনতে কত দূর চলেছি, তবু স্বীকার করব, কবিকে ঠিক চেনা যায় না। কবিকে ঠিক ধরা যায় না। কবিতা হয়তো পড়ি আমরা, কবিকে ঠিক পড়া যায় না।

ঝিনেদায় বসে ঢাকার পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠাতাম ডাকযোগে। প্রচুর পাঠাতাম। দু-তিন মাস পর হঠাত্ একটি কবিতা হয়তো ছাপা হতো ঢাকার কোনো কাগজে। তাতেই যে কী আনন্দ। মন খুশিতে নেচে নেচে যেত বিকেলবেলায়, নবগঙ্গা নদীর ধারে বাইসাইকেল নিয়ে কত দূর চলে যেতাম, সেই কাগজে কবিতা ছাপা হওয়ার অলৌকিক আনন্দের ভারে। তো ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাস থেকে মাসিক তখন ত্রৈমাসিক জার্নাল প্রকাশ হতো। কবিতা ছাপা হতো দুই বাংলার বড় বড় কবিদের। আমিও লেখা পাঠাতাম, যদি ছাপা হয়, আশায় আশায়। ছাপা তো আর সহজে হয় না। এমনিতেই তখন ‘ভারত বিচিত্রা’ ত্রৈমাসিক। সম্পাদক ছিলেন একদা কৃত্তিবাসী সুনীল-শক্তির সহচর কবি বেলাল চৌধুরী। বর্তমানে মাসিক, সম্পাদক, নান্টু রায়। তো একদিন ঝিনেদায় বসে ‘ভারত বিচিত্রা’ সম্পাদকের পক্ষ থেকে হাতে লেখা একটি চিঠি পেলাম ডাকযোগে। খুলে দেখি, ‘ভারত বিচিত্রা’র সম্পাদক আমাকে জানাচ্ছেন, ‘অধৈর্য হয়ো না, আগামী সংখ্যা ‘ভারত বিচিত্রা’য় তোমার কবিতা ছাপা হবে।’

একটি চিঠিও কত আনন্দ, আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিতে পারে, আমার তা হলো। আমি উচ্ছ্বসিত হলাম খুব। আমি পড়ি ইন্টারে, ঝিনেদার মতো হত্যা-আত্মহত্যাপ্রবণ এলাকায়, তখন ঢাকায় যেতে সময় লাগত ১০/১২ ঘণ্টা। ঢাকা! সে তো মহানগরী। সে তো রাজধানী। সে তো দূরের শহর। সে তো আর নবগঙ্গা পাড়ের ঝিনেদার মতো ছোট্ট শহর নয়, বড় শহর।

ঝিনেদা থেকে চলে গেলাম খুলনায়, আরেকটু বড়, বিভাগীয় শহর। ওখানে আর্ট কলেজে কয়েক বছর কাটিয়ে চলে এলাম ঢাকায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র হয়ে পেইন্টিং করা শিখতে লাগলাম, ওই ঔপনিবেশিক— একাডেমিক ঘরানায়। যার কোনো মানে আমার কাছে খুব একটা নেই। কিন্তু কবিতা তো অসুখ। সে অসুখ তো সারে না। অবশ্য ঢাকার কাগজে লেখা ছাপা হওয়া আর না হওয়ার মানে থাকে আমার কাছে। কত ছাপা হবে। অত লেখাই নেই, যত প্রেস, যত ছাপাখানা, যত কাগজকল বা আজকের অনলাইন স্পেস। একদিন বেলাল চৌধুরীর কাছে গেলাম ধানমন্ডি ৩ নম্বর রোডে, ভারত বিচিত্রা অফিসে। বেলাল ভাইকে বললাম, সেই চিঠি আমি পেয়েছিলাম, ঝিনেদায় বসে।

বেলাল ভাই বললেন, ‘তোমার পাঠানো কবিতাভরা খাম খুলে আমার হয়ে তোমাকে চিঠি লিখেছিল রফিক। রফিক আজাদ।’ এ কথা আমি পরে একদিন রফিক ভাইকে বললাম, ‘আপনিই আমাকে চিঠি লিখেছিলেন, ভারত বিচিত্রা’র প্যাডে?’

রফিক আজাদ বললেন, ‘আমি জানতাম, তুই একদিন ঢাকায় চলে আসবি। তোর হাতে কবিতা ফোটে। তুই তো আমার পুত্র। চল, সাকুরায় যাব। বাপ-বেটা মদ খাব, মুখোমুখি টেবিলে বসে।’

১৯৯৮ সালে রফিক আজাদ নেত্রকোনার কবি খালেকদাদ চৌধুরী পুরস্কার পেলেন। ঢাকা থেকে মাইক্রোবাস ভর্তি আমরা ক’জন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (রফিক আজাদের সরাসরি শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, ঢা.বি.) নাসির আহমেদ, আবু হাসান শাহরিয়ার, নাসির আলী মামুন, শহীদুল ইসলাম রিপন, আমি আর কে যে ...মনে নেই। নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজ রফিক আজাদকে খালেকদাদ চৌধুরী পুরস্কার দিল অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের হাত থেকে। আনিস স্যারের পা ছুঁয়ে রফিক ভাই যখন পুরস্কার নিচ্ছেন, তখন কবির চোখ দিয়ে অবিরল অশ্রু তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেখলাম। রাতে নেত্রকোনা সার্কিট হাউজে পূর্ব-সংগৃহীত পানীয় এক পর্যায়ে শেষ হয়ে গেল। সবাই ঘুমুবে, সকালেই ঢাকা ফিরতে হবে। কিন্তু রফিক ভাই আমাকে ও রিপনকে নিয়ে মধ্যরাতে বেরুলেন মগরা নদীর পারে নেত্রকোনা শহরে, কোথায় বাংলা মেলে! মিললও। এক মেথরের বাড়িতে। রফিক ভাইয়ের চোখে শিশুর সাফল্য, ‘আমি কি জানি না নেত্রকোণায় কোথায় বাংলা পাওয়া যায়?’

কিন্তু বিখ্যাত সাকুরাতে আমার সুযোগ হয়নি রফিক ভাইয়ের টেবিলের ওপারে বসার। কারণ, সাকুরাতেই আমি কম গিয়েছি। অন্যশালায় গেছি। গেছিই তো। যাইই তো। যাবই তো। পৃথিবীর পানশালা আমাকে নিয়ে যায়, সন্ধ্যায়, অামি কী করব?

এর মধ্যেই কবি রফিক আজাদের মদ্যপ হওয়া আর শক্তিশালী কবিতা লিখে যাওয়া, দুটোই মিথ। মিখ যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এর পর আমরা কবিতা, মদ ও মিথের মধ্যে বসবাস করব। কারণ, রফিক আজাদ চলে গেছেন। আমি শোক পেয়েছি, কাউকে বলিনি। শহীদ মিনারে বা মিরপুর গোরস্তানেও তার লাশ দেখতে যাইনি। বরং রফিক ভাইয়ের স্মরণে এক রাতেই তিনটা ভরা বোতল দুই বন্ধু খালি করে বোতলগুলো আকাশের দিকে ছুড়ে মেরেছি। কাচের বোতল কি আকাশের দিকে উড়তে উড়তে বুদবুদ হয়ে গেল? এ প্রশ্ন তো কবিকেই করা যায়, কিন্তু কবি নেই।

কবি রফিক অাজাদ বলতেন, কবি ছাড়া জয় বৃথা। এ কথা অাবার মনে পড়ল।











মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.