নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ওয়াসি আহমেদ

ওয়াসি আহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অবান্তর অথচ অকাট্য

২৯ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ৮:৫৪

ঠিক ভোর ছয়টা পঁচিশে, রডবোঝাই ‘সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন গোত্রীয়’ একটা হলুদ ট্রাক জহিরের একশ বিলিয়ন নিউরনসমেত মগজকে থেতলে টাঙ্গাইলের রাস্তা ধরে এগিয়ে যায় চিতাবাঘের গতিতে। জহিরের চূর্ণবিচূর্ণ খুলি অথবা ঢেঁড়সের তরকারির মতো লেপ্টে যাওয়া মাথাটা রাস্তার কালো পিচের পটভূমিতে হলুদ লাল মেশানো অদ্ভুত এক মডার্ন আর্টের নমুনা সৃষ্টি করলেও, মৃত্যুর সময় লণ্ডভণ্ড শ্রবণস্নায়ুর সাহায্যে নিজের করোটিফাটা মড়মড়, ইঞ্জিনের ফোসফোস আর ইট সুরকির রাস্তায় ঘষা খাওয়া খসখস শব্দের কতটুকু সে উপলব্ধি করতে পেরেছিল- তা অবান্তর অথচ অকাট্য এক প্রশ্ন হয়ে থেকে যায়।

তবে জানামতে, জহিরের মাথাফাটা মৃত্যু আর্তনাদ- কবিরা যাকে ‘আকাশ ফাটানো’ উপমায় অভিষিক্ত করতে পারে- শুনতে পেয়েছিল হাতে গোনা কয়েকজন। চিৎকার শুনেছিল সুনসান গলির টং দোকানের একপাশে থামানো রিকশার প্যাসেঞ্জার সিটে গা এলিয়ে বসা সানোয়ার, আরোহীর অনুপস্থিতিতে যে নিজের তিনকোনা কালো রঙের চালকের আসনটাকে প্রায় পর করে দিচ্ছিল; চিৎকার শুনেছিল টং দোকানের মালিক জয়নাল, সন্ধ্যায় বউ পিটিয়ে যে কিনা রাতটা কাটিয়েছে মরিচা পড়া টিনের টং দোকানে বিছানো তৈলাক্ত চটচটে তোষকে; চিৎকার শুনেছিল সুপারি গাছের ডালপালায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা একদল কাক, অবশ্য ওদেরকে ‘জনের’ আওতায় আনাটা যুক্তিযুক্ত না-ও হতে পারে। চিৎকার শুনেছিল আরও একজন, আব্দুল মোত্তালেব, ভোর ছয়টা পঁচিশে সিলিং ফ্যানের আংটার সাথে ফাঁসবাঁধা গোলাপি ওড়না ঝোলানোর সময় জহিরের কণ্ঠস্বর তাকে কিছুটা হলেও বিচলিত করেছিল।
ছয়টা পঁচিশে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা আব্দুল মোত্তালেব সাতটা নাগাদ নিজের লাশ হয়ে যাবার সংবাদ আগে থেকেই মনের ভেতর পুনঃ পুনঃপ্রচার করে রেখেছিল। পনের বছর যাবত জনতা ব্যাংকের ক্যাশিয়ার পোস্টে চাকরীর সুবাদে পরের টাকা গুনে বৃদ্ধাঙ্গুলে কড়া পড়েছে, তবে সেই বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনীর অবাধ মিলনস্থলে চায়ের কাপ আঁটকে রেখে বড় বড় চুমুক দেয়ার অভ্যাসে ছেদ পড়েনি কোনদিন। লাইলি নামের যে মেয়েটা খুব বেশি কাজ না করেও মাতৃসূত্রে ‘কাজের মেয়ে’ তকমা ধারণ করেছে, সকালবেলা এদিক সেদিক তাকিয়ে কন্ডেনসড মিল্ক চাটার সময় চামচের আন্দাজে নয়-ছয় হলেও ঠিক সোয়া সাতটায় মোত্তালেব খালুর ঘরে এক কাপ চা রেখে আসতে কখনও ভুল হয় না ওর। মৃত মানুষের চা খাবার প্রয়োজন হয় না এই সত্য উপলব্ধি করে নাকি ফাঁসিতে ঝুলে থাকা বিকৃত চেহারা সহ্য করতে না পেরে আজ লাইলির হাত থেকে নীল রঙের ফুল আঁকা সাদা চায়ের কাপ মাটিতে পড়ে যায়- এই প্রশ্নটাও আমাদের অবান্তর অথচ অকাট্য প্রশ্নের তালিকায় যুক্ত হতে পারে।
সোয়া সাতটা থেকে ঘড়ির কাটা বিশ-ত্রিশ মিনিট পিছিয়ে সাতটার আগে ফিরে গেলে আমরা আব্দুল মোত্তালেবের ফাঁসির কিছু চিত্রগল্পের আন্দাজ পেলেও পেতে পারি। সরঞ্জাম প্রস্তুত করার সময় কী ভেবে যেন ওয়াড্রব থেকে পাঁচ বছর আগে বন্ধুর হাত ধরে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া নিজের স্ত্রী সুলতানার একটা গোলাপি ওড়না বের করে নেয় লোকটা, যদিও পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আসন্ন কুরবানির ঈদে গরু বাঁধার জন্য কেনা দড়ির গাছি বের করে রাখা হয়েছিল। পরিষ্কার সাদা পাঞ্জাবি আর নীল লুঙ্গি পরে ফ্যানের সাথে গোলাপি ওড়না বেঁধে একটা সবুজ প্লাস্টিকের চেয়ারের ওপর উঠে দাঁড়ায় আব্দুল মোত্তালেব, ঠিক যখন জহিরের করোটিফাটা মড়মড়, ইঞ্জিনের ফোসফোস আর ইট সুরকির রাস্তায় ঘষা খাওয়া খসখস শব্দের সাথে গগনবিদারী চিৎকারটাও তার কানে ভেসে আসে। পঁয়তাল্লিশ বছরের শরীরটা একবারের জন্য কেঁপে উঠলেও, মৃত্যুকে স্বান্তনা এবং পরিত্রানের উপায় মেনে গলার বামপাশে ওড়না দিয়ে ফাঁসের গিট বাঁধে নিপুণ হাতে। মৃত্যুর পরের জগত কেমন- প্রশ্নটা সাড়ে চারশ কোটি বছরের পুরনো বলে আপাতত বাদ থাক; তবে গত সন্ধ্যায় বুড়ো রিকশাওয়ালাকে থাপ্পড় মারার পর আব্দুল মোত্তালেবের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত ‘হালায় মরে না ক্যান’ বাক্যটা আত্মহননের চিন্তাকে কতটুকু তরান্বিত করেছিল সে প্রশ্নটাকেও অবান্তর অথচ অকাট্য প্রশ্নের তালিকাভুক্ত করা হলো।
সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সবুজ প্লাস্টিকের চেয়ারটা লাথি মেরে পায়ের নীচে থেকে সরিয়ে দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কী মনে যেন একবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ইলেকট্রিক তারে একজোড়া দাঁড়কাক দেখতে পায় আব্দুল মোত্তালেব। সবুজ চেয়ার ছিটকে সরে যায়, গোলাপী ওড়না টানটান হয়ে যায় আটষট্টি কেজির দেহের ভারে। কট করে ভেঙ্গে যাওয়া গ্রীবাদেশের কশেরুকা, ঠাস করে ঊল্টে পড়া প্লাস্টিক চেয়ার অথবা স্বভাবসিদ্ধ অর্থবহ ভাষার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ গোঁ গোঁ শব্দ শুনে কা কা করে উড়ে যায় কাক কপোত- কপোতী। ছয়টা ছাপ্পান্ন মিনিটে বাবার ঘাড় ভেঙ্গে যাবার মুহূর্তে ডাইনিং টেবিলে বসে ডিমপোচ আর মুরগীর গিলা-কলিজা-হাড় দিয়ে বানানো লটপটি থেকে সরু দেখে একটা গলার হাড় বের করে নিয়ে মনের সুখে চাবাতে থাকে স্কুল পড়ুয়া জাহিদ, আর ঠিক উনিশ মিনিট পর লাইলির চিৎকার শুনে যার ‘এতিম যুগের’ সূত্রপাত ঘটতে যাচ্ছে।
ফাঁসের দড়ি গলায় এটে বসতেই দুই কানে অথবা মাথার ভেতর হিসহিস-ফিসফিস শব্দ শুনতে পেয়েছিল আব্দুল মোত্তালেব, বহু বছর আগে গ্রাম্য মেলায় বেদেনীর খেলায় দেখা সাপের ভাষা আর প্রেশার কুকারে রান্না শেষে বেরিয়ে যাওয়া বাতাসের সুরের সাথে তার অদ্ভুত মিল। প্রথমে উধাও হয়ে যায় দৃষ্টিশক্তি, তারপর বাকশক্তি, চিন্তাশক্তি, চেতনাশক্তি- আর শ্বসনশক্তির সমাপ্তি তো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটানো হয়েছে শুরুতেই। বর্ষীয়ান বটগাছের ঝুরির মতো অগণিত লাল-কমলা শিরা উপশিরা ফুটে উঠে আব্দুল মোত্তালেবের দুচোখে আর কৃষ্ণগহ্বরের অসীমতার মতো সম্প্রসারিত হয় কুচকুচে কালো চোখের তারা। মুষ্টিযুদ্ধের কিংবদন্তী মোহাম্মদ আলীর মতো সুদৃঢ় মুঠো পাকিয়ে ওঠে হাত, চোখজোড়া ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায় কোটরের কারাগার ভেঙ্গে আর তারই ডাকে বিদ্রোহ ঘোষণা গলা অবধি বেরিয়ে আসে আব্দুল মোত্তালেবের পান-চুন-জর্দা খাওয়া রণক্লান্ত জিহ্বা। টেরিগয়েড গ্যাংলিয়ন উত্তেজিত হয়ে ঠোঁটের দুই কেনা বেয়ে প্রবাহিত করে রক্তমাখা ফেনিল লালার স্রোত, মধ্যবয়স্ক আব্দুল মোত্তালেবের সাদা পাঞ্জাবির পাশাপাশি ছোপছোপ লালচে বর্ণ ধারণ করে সাদাকালো পশমাবৃত বুক। শ্বাস থেমে গেলেও প্রায় মিনিট পাঁচেক ধড়ফড় করতে থাকে সংশয়-আতঙ্ক-হাহাকার-শূন্যতা মেশানো হৃৎপিণ্ড...নেমে আসে শীতল নীরবতা।
এক সপ্তাহের ভেতর আব্দুল মোত্তালেবকে হারিয়ে যাওয়া দশ লাখ টাকার হিসাব দিতে হবে এই শর্ত আরোপে ক্যাশিয়ারের রাত ঘুম হারাম হলেও ব্যাংকের বড়সাহেবের সুখনিদ্রায় কোন ব্যাঘাত ঘটায়নি, এমনকি কিছুক্ষণ পর কর্মচারীর মৃত্যু সংবাদ শুনেও তেমন কোন প্রভাব পড়বে না তার ওপর। লস এঞ্জেলসে নতুন সংসার পাতানো সুলতানা তার গোলাপি ওড়নার এহেন অপপ্রয়োগ অথবা পাঁচ বচর আগে ছেড়ে আসা স্বামীর আত্মহননের সম্ভাবনার কথা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি। মালয়েশিয়ার নামকরা ম্যাসাজ পার্লারে স্বল্পবসনা রমণীর ছোঁয়ায় নিজের পা দলাই মালাই করিয়ে আহ-উহ করতে থাকা আব্দুল মোত্তালেবের ছোট ভাই আবু তালেবও চিন্তা করেনি যে ঠিক এই মুহূর্তে শূন্যে ঝুলে আছে আব্দুল মোত্তালেবের রোমশ দুই পা!
দায়িত্ব, বিবেক, সংসার নামক ভারী ভারী শব্দকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঝুলতে থাকে সদ্য পরিচয়বিহীন, লুপ্তপ্রাণ, মৃতদেহ। রহস্যময় কোন এক স্নায়বিক প্রক্রিয়ায় নীল লুঙ্গির আড়ালে উত্থিত হয়ে থাকে আব্দুল মোত্তালেবের শিশ্ন, অগ্রভাগে মুক্তার মতো দু এক ফোঁটা বীর্য জমে থাকে সদর্পে; জীবদ্দশায় যার অনুপ্রবেশ তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা করে তুলেছিল বোকাসোকা লাইলিকে।
জানালার পাশে ইলেকট্রিক তারে আবার হাজির হয় দাঁড়কাক যুগল, কোত্থেকে না কোত্থেকে টুকিয়ে আনা মরা মুরগীর ঠ্যাং নিয়ে ঠোকরাঠুকরির প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। মৃতদেহের এই ঠ্যাং তাদের খাদ্যরূপে আবির্ভূত হয়ে জীবন বাঁচানোর অবলম্বন হিসেবে ধরা দেয় আমাদের চোখে
ঘরের ভেতর শূন্যে ঝুলে থাকে আব্দুল মোত্তালেবের রোমশ ঠ্যাং! মৃতের এই ঠ্যাং জীবনের অবসানকালে নিঃসাড় নির্জীব নিষ্প্রয়োজন প্রত্যঙ্গ হিসেবে ধরা দেয় আমাদের চোখে।
অবশ্য আব্দুল মোত্তালেবের মৃত্যুর সুস্পষ্ট কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে অবান্তর অথচ অকাট্য প্রশ্নের সংখ্যা আরো একটা বেড়ে যাবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.