নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ওয়াসি আহমেদ

ওয়াসি আহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ

২৩ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ১১:২৪

ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকে। মাথার ওপর ছাদ থাকলে বৃষ্টিকে হয়তো বেশ কাব্যিক বলে মনে হতে পারে, তবে খোলা আকাশের নিচে প্যাচপেচে কাদা মাড়ানো কাকভেজা পথিকের কাছে সেই একই বৃষ্টি অশ্লীল হিসেবে ধরা দেয়। টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ যেমন রোমান্টিক, ঝড়ে উড়ে যাওয়া ছাদ আবার তেমনই অভিশাপ। জগতের সকল ক্ষেত্রে, বিলাসিতা অথবা সুখ বোধহয় এমন আপেক্ষিক-ই; পরিস্থিতির ভিন্নতার প্রেক্ষাপটে তা রুপ বদলাতে বাধ্য।
অনেকক্ষন যাবত ভিজতে ভিজতে জয়ন্তের মাথায় দার্শনিকের মতো চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। আশ্বিনের দিনে এতো ভারীবর্ষণ কল্পনাও করা যায় না! আগে বুঝলে অন্তত একটা ছাতা নিয়ে বেরোনো যেত। রাস্তায় নেমে সবে একটু হাঁটতে শুরু করেছে, আর ব্যস, গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা! বাধ্য হয়ে ভিজতে ভিজতে বাসস্টপ পর্যন্ত এগোতে হলো।
ওদিকে বৃষ্টির কারণে বাস-ও লেট। আর কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো শরীরে ডালপালা গজিয়ে যাবে! বাড়ি ফিরে যাবে কিনা ভাবতেই, বাস এসে থামল জয়ন্তের সামনে। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে উঠে পড়ল ও। যাক, জানালার পাশে একটা সিট খালি পাওয়া গেছে।
সকাল হতেই সূর্যটা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে, হয়তো প্রতিদিন আলো দিতে দিতে সে খানিকটা ক্লান্ত। ভার্সিটি যাবার পথে জয়ন্ত বাসের জানালা দিয়ে দেখতে পেল, নাগরিক জীবনে অভ্যস্থ সাধারণ মানুষের মন হঠাৎ আজ বৃষ্টিবিলাসের আমেজে মেতে উঠেছে। এক একটা ব্যস্ত গলি পরিণত হয়েছে এক একটা ফুটবল খেলার মাঠে, মন খারাপ করা কংক্রিটের বাড়ির সাদাকালো ছাদগুলো রঙিন হয়ে উঠেছে বৃষ্টিস্নাত তরুণ তরুণীর আনন্দের রঙে। যা হয় হোক, জয়ন্তের কাছে এই বৃষ্টি জিনিসটা কখনোই সুখকর বলে মনে হয় না।
প্রচণ্ড শব্দে ব্রেক কষল বাসটা। ওইতো দূরে কাজল আর কেয়াকে দেখা যাচ্ছে। মাঠের ওপাশটা পুরোপুরি ফাঁকা, কেমন যেন ঘোরলাগা মুগ্ধতা নিয়ে হাত ধরাধরি করে হাঁটছে দুজন। দূর থেকে কেয়ার খিলখিল হাসির শব্দ কানে ভেসে আসছে। আচ্ছা, কীসের এত আনন্দ ওদের? মানবিক আবেগঘটিত বিষয়গুলোকে চিরদিন এক ধরনের আদিখ্যেতা বলে মনে হয়ে এসেছে জয়ন্তের কাছে। মনে মনে দুজনকে বিশ্রী একটা গালি দিয়ে ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছিল ও, ঠিক তখনই কাজল একটা চিৎকার দিল,
‘আরে আর্টিস্ট... বৃষ্টির ভেতর কোনদিকে চললে?’
‘এইতো, একটু কাজ ছিল।’
‘ও, নতুন ছবি এনেছ বোধহয়? আজ সবার কপালে শনি আছে! হায়রে কলিকালের ভিঞ্চি, মোনালিসার খবর কী?’
কাজলের দিকে একটা শীতল দৃষ্টি দিয়ে জয়ন্ত দ্রুত সরে গেল ওখান থেকে। গত চার বছরে এই কাজল ছেলেটা ওকে যথেষ্ট যন্ত্রণা দিয়েছে। এমনিতে অবশ্য বন্ধুমহলে ছেলেটার বেশ সুনাম; হাসিখুশি, স্মার্ট, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। কিন্তু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবার সময় কোন না কোনভাবে ও জয়ন্তকে ঠাট্টার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসবেই। সেটা জয়ন্তের আকা ছবি, স্বভাব অথবা চিরপরিচিত অপ্রস্তুত ভঙ্গি নিয়েই হোক অথবা পরনের সস্তা জামাকাপড় নিয়েই হোক।
জয়ন্ত কিছুটা রগচটা স্বভাবের। ওর সম্পর্কে কেউ তেমন কিছু জানেনা। নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই পছন্দ করে ও, আর পছন্দ করে ছবি আঁকতে। নিজের মেসের ছোট রুমটাকে একটা স্টুডিও হিসেবে কল্পনা করতে পছন্দ করে সবসময়। অগোছালো, নোংরা ঘরটার ভেতর দিনরাত শুধু একটাই কাজ, ছবি আঁকা। এমনিতে জয়ন্ত কারো সাথে তেমন কথাবার্তা বলেনা, কিন্তু কোন কোনদিন দেখা যায় খুব আগ্রহ নিয়ে সবাইকে ডেকে ডেকে কী যেন দেখানোর চেষ্টা করছে। শুরুর দিকে অনেকে অজ্ঞাত থাকলেও, একসময় সবাই বুঝে ফেলল যে নতুন ছবি আঁকলে ছেলেটা কেমন যেন পাগলাটে হয়ে যায়। এমনিতে যার পেটে বোমা মারলেও মুখ খোলানো যায় না, ছবি হাতে সেই ছেলেটাই হয়ে ওঠে অসম্ভব বাঁচাল। সামান্য একটূ প্রশংসা পাবার জন্য ভিখারীর মতো করত জয়ন্ত, অথচ কমবেশি সবাই ঠাট্টা করতো ওর আঁকা ছবি নিয়ে। তবে সত্যি বলতে কী, জয়ন্তের ছবিগুলোকে আর যাই হোক, শিল্পকর্ম কোনভাবেই বলা যায়না। যদিও বরাবরই জয়ন্তের ধারণা ছিল সবাই ওকে হিংসে করে।
না, সবাই বলাটা আবার ঠিক হচ্ছে না। একটা মেয়ে ওকে কিছুটা হলেও বুঝতো, সেঁজুতি, মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত জয়ন্তের আঁকা ছবিগুলোর দিকে ।
ক্যান্টিনের বাইরের বেঞ্চে বসে একটা সিগারেট ধরাতেই দূরে কোথাও বজ্রপাত হল। কড়কড় শব্দে কানে তালা লাগার উপক্রম। আকাশে ঝলসে ওঠা বিদ্যুতের ঝিলিক এক মুহূর্তে জয়ন্তকে বারো বছর আগের এক তুমুল ঝড়বৃষ্টির রাতের কথা মনে করিয়ে দিল।
পাঁচ বছর বয়সে যখন জয়ন্তের মা মারা গেলেন, জয়ন্তের চিরচেনা পৃথিবীটা যেন রাতারাতি বদলে গেল তখন। কিছুদিন যেতেই জয়ন্তের দেখাশোনা করার কথা ভেবে বাবা আরেকটা বিয়ে করে ফেললেন! ছোট্ট জয়ন্তের কাছে মনে হয়েছিল, নতুন মা হয়তো ওকে আগের মা’র চাইতেও বেশি আদর করবেন। আপন মা যদি সত্যিই ওকে আদর করতেন, তবে নিশ্চয়ই জয়ন্তকে একা রেখে এভাবে মরে যেতেন না!
অবশ্য জয়ন্তের শিশুমনের কল্পনাটা পাতায় লেগে থাকা শিশিরের মতোই ঝরে গেল। বিয়ের পর কয়েকদিন একটু লোক দেখানো আদর করলেন নতুন মা। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের ভেতর জয়ন্ত আবিষ্কার করল যে, কোন একটা বিচিত্র কারণে নতুন মা ওকে সহ্যই করতে পারছেন না। উঠতে বসতে খোঁটা দেওয়া, মারধর করা-এগুলোই ছিল নতুন মায়ের মমতার বহিঃপ্রকাশ! এভাবেই কেটে গেল ছয় ছয়টা দীর্ঘ বছর, গর্ভবতী হলেন নতুন মা। জয়ন্তের ওপর অত্যাচার আরও বেড়ে গেল। ওদিকে বাবাও যেন ভুলতে বসেছেন যে জয়ন্ত পরিবারের একজন সদস্য, তার নিজের ছেলে।
সেদিন রাতেও ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। ব্যবসার কাজ সেরে খানিকটা রাত করেই বাড়ি ফেরার কথা জয়ন্তের বাবার। মা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, সকাল সকাল উঠতে হবে। কিন্তু মানুষের আশার সাথে বাস্তবতার মিল সবসময় থাকে না। জয়ন্ত চায়নি যে নতুন মা’র আর কোনদিন ঘুম ভাঙ্গুক। প্রচণ্ড আক্রোশে জয়ন্ত বালিশ চেপে ধরেছিল মা’র ঘুমন্ত মুখে। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে হয়তো তার ঘুম ভেঙ্গেছিল, হয়তো বেঁচে থাকার জন্য কিছুক্ষন ছটফটও করেছিলেন। কিন্তু জয়ন্ত তাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়নি। জয়ন্ত এখনও মনে করতে পারে, বালিশটা সরিয়ে নিতেই বিদ্যুৎ চমকে উঠেছিল আকাশে, অন্ধকার ঘরটা কিছুক্ষনের জন্য আলোকিত হয়ে উঠেছিল। আর সেই আলোতেই জয়ন্ত দেখতে পেয়েছিল ওর নতুন মায়ের প্রাণহীন চোখগুলো অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ক্লান্ত শরীরে নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। হয়তো শেষরাতের দিকে বাবা বাড়ি ফিরেছিলেন। তারপরের ঘটনাগুলো জয়ন্তের ঠিক মনে পড়েনা। শুধু মনে পড়ে যে, পরদিন সকালে অনেক লোক জড়ো হয়েছিল ওদের বাড়িতে। আর মনে পড়ে বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
গ্রামের লোকেরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘আহারে... একা হয়ে গেল ছেলেটা।’
দু’দিন পর কাকার সাথে ঢাকায় চলে এসেছিল জয়ন্ত। কয়েক বছর পর খবর পেয়েছিল স্ত্রী খুনের দায়ে বাবার ফাঁসি হয়েছে। মাতাল অবস্থায় প্রায়ই ওর মাকে মারধোর করত লোকটা। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সামান্য কিছু আবাদী জমি ছিল ওর সৎ মায়ের নামে, সেগুলোর লোভেই হয়তো স্ত্রীকে খুন করেছে-আদালতে সেটাই প্রমাণিত হয়েছিল। কাকার খরচে এস.এস.সি. পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর নিজেই খোঁজখবর করে একটা কলেজে ভর্তি হয়েছিল জয়ন্ত। মেসে থাকতো, আর নিজের খরচ চালাত টিউশ্যনি করিয়ে।
উল্টোদিকের বাড়িতে এক ভবঘুরে আর্টিস্ট থাকতো। যতক্ষণ ঘরে থাকতো, গাজা টানত আর ছবি আঁকত লোকটা। জানালা দিয়ে তাকে দেখতে পেত জয়ন্ত। একসময় ওর মনে হলো ইচ্ছে করলে ও নিজেও দারুণ ছবি আঁকতে পারবে। জমানো টাকা দিয়ে রঙতুলি, ইজেল আর ক্যানভাস কিনে আনল একদিন। কাগজে আঁচড় কাটতেই সেদিন মনে হয়েছিল ওর, বিধাতা জন্মসূত্রে ওকে প্রতিভাবান করে পাঠিয়েছেন। সেই যে ছবি আঁকার নেশা পেয়ে বসল, আজ অবধি তা চলছেই। অন্যেরা হিংসে করে যতই বাজে বকুক, জয়ন্ত নিজে জানে ও কী। ভ্যানগঁগকে পর্যন্ত জীবদ্দশায় লোকে খাটো করে দেখত, প্রেমিকার মন জোগাতে নিজের কান কেটে উপহার পাঠাতে হয়েছিল তাকে! মহান শিল্পীদের জীবন এমন দুঃখেরই হয়!
কলেজ জীবনের বিমল স্যারের কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে জয়ন্তের। কথা বলার সময় খানিকটা তোতলানোর স্বভাব আছে ওর। বিমল স্যার লোকটা ভালোই পড়াতেন, কিন্তু জয়ন্তের তোতলানো স্বভাব নিয়ে ক্লাসের সবার সামনে প্রায় প্রতিদিনই ওকে অপমান আর হাসাহাসি করতে কখনও পিছপা হতেন না। বাড়ি ফিরে একা একা কাঁদত জয়ন্ত, আর ভাবত কেন ওর দুর্বলতা নিয়ে সবার সামনে লজ্জা দেয়া হয়। স্যার কিন্তু ব্যপারটাতে বিচিত্র এক ধরনের আনন্দ পেতেন। স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন লোকটা, প্রতিদিন সকালে স্থানীয় একটা পার্কে হাঁটতে যেতেন। একদিন সকালে হঠাৎ পার্কের লেকে তার লাশ ভেসে উঠেছিল। বয়স হয়েছিল লোকটার, এক চোখে কম দেখতেন একটু। হয়তো পা পিছলে লেকের পানিতে পড়ে গিয়েছিলেন। কলেজের সবাই কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল সেদিন। কেন যেন সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিল জয়ন্ত।
হ্যাঁ...সেদিনও ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল।
ভার্সিটি জীবনের প্রথম বছরগুলোর কথা মনে করতে গেলে সেঁজুতি মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায় জয়ন্তের। পৃথিবীতে একমাত্র কাছের মানুষ বলতে সেঁজুতিকেই মনে হতো ওর। মেয়েটা বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করতো খুব। ভেজা চুলে ওকে পৃথিবীর বিশুদ্ধতম মানবী বলে মনে হতো জয়ন্তের কাছে। বিড়বিড় করে বলে উঠত নিজের অজান্তেই-

‘আগে কে জানিত বলো কত কী লুকানো ছিল
হৃদয় নিভৃতে-
তোমার নয়ন দিয়া আমার নিজের হিয়া
পাইনু দেখিতে।'

জয়ন্তের আঁকা ছবিগুলো নিয়ে যখন সবাই হাসাহাসি করতো তখন একমাত্র সেঁজুতিই ওকে উৎসাহ দিত, প্রশংসা করতো। একনাগাড়ে গল্প করতে পারত মেয়েটা, খুব সুন্দর করে কথা বলতো। অবাক হয়ে শুনত জয়ন্ত, হারিয়ে যেত অপরিচিত এক মায়াবী জগতে।
খুব একটা স্বচ্ছল পরিবারের ছিল না মেয়েটা, একই ভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিভাগে পড়ত। দুজনের ডিপার্টমেন্ট আলাদা, কিন্তু খুব সহজ স্বাভাবিক একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ওদের ভেতর। নিজের জীবনের অনেক ঘটনাই সেঁজুতিকে খুলে বলেছিল জয়ন্ত; শৈশবের কথা, একাকীত্বের কথা। সেঁজুতির কাছ থেকেই একদিন জানতে পেরেছিল যে, ওর কিছু কিছু লক্ষনের সাথে “নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার”, “গ্র্যান্ডিওজ ডিল্যুশন”- এসব কিছু মানসিক ব্যাধির লক্ষণের মিল পাওয়া যায়। হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল জয়ন্ত ব্যাপারটাকে।
দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছিল দুজনের। সেঁজুতির সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত ছিল স্বপ্নরাজ্যে ঘুরে বেড়ানোর মতো। আর রাতের স্বপ্নে সে দেখা দিত অন্নপূর্ণা রূপে! কতোই না অদ্ভুত ছিল দিনগুলো!
হঠাৎ একদিন জয়ন্ত উপলব্ধি করল যে সেঁজুতির সাথে ওর কিছুটা দূরত্বের মতো সৃষ্টি হয়েছে। আগের মতো আর হেসে কথা বলে না, খোঁজখবর নেয় না ঠিকমতো। ধীরে ধীরে এমন অবস্থা দাঁড়াল যে, প্রতিদিন আর দেখাও হয় না। স্বপ্নের জগত থেকে একটু একটু করে বাস্তবে ফিরে এল জয়ন্ত, ওর কাছে মনে হলো সেঁজুতি এতদিন যে বন্ধুত্বটা দেখিয়েছে, সেটা আসলে বন্ধুত্ব না। হয়তো জয়ন্তকে শুধু একটা “সাবজেক্ট” হিসেবে খেলিয়ে এসেছে এতদিন মেয়েটা!
মাসখানেক পর একদিন সরাসরি একটা কথা জিজ্ঞেস করে বসল জয়ন্ত। শুনে খুব একটা অবাক হলো না যে, একটা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে অনেক আগে থেকেই সম্পর্ক আছে সেঁজুতির। মাস্টার্স করতে দেশের বাইরে গিয়েছিল ছেলেটা, দু’মাস আগে আবার ফিরে এসেছে। খুব শীঘ্রই বিয়ে করতে যাচ্ছে ওরা।
এরপর কয়েকদিন জয়ন্তকে ভার্সিটিতে দেখা গেলনা। হঠাৎ একদিন সেঁজুতির বৃদ্ধ বাবা কাঁদতে কাঁদতে হাজির হলেন ভার্সিটির ক্যাম্পাসে-
‘আমার মেয়েটা গত তিন দিন হলে বাসায় ফিরেনি গো বাবারা... কেঊ কী বলতে পারো, মেয়েটা কোথায় গেল? কেউ কী বলতে পারো?’
সেদিন সেঁজুতির বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছিল জয়ন্ত। ওদেরর সাথে তাল মিলিয়ে অশ্রু বর্ষণ করেছিল মধ্যদুপুরের আকাশ। ক’দিন পর দেশের একটা অখ্যাত দৈনিক পত্রিকায় কোন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনৈক তরুণীর গলিত মৃতদেহের অংশবিশেষ উদ্ধারের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তরুণীর পরিচয় জানা যায়নি, হয়তো কারও চোখেই পড়েনি খবরটা!

চিন্তাভাবনা অনেক হয়েছে, উঠে দাঁড়ালো জয়ন্ত। জরুরী কাজে দেরি করলে চলবে না। আজ সকাল সকাল শুধু একটা কাজেই ভার্সিটিতে এসেছে ও।
চারপাশটা একবার ভালো করে দেখে নিল জয়ন্ত। কেয়াকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। পরিত্যাক্ত ক্লাবঘরের পেছনে শিমুল গাছটার নীচে একা বসে গুনগুন করে কী যেন একটা গান গাওয়ার চেষ্টা করছে কাজল।
জয়ন্ত ওদিকটাতেই এগোল। ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে জয়ন্তের ডান হাতে একটা ছোট অথচ ধারালো ছুরি ধরা। ওর দৃষ্টি খানিকটা উদভ্রান্ত। হয়তো কিছুক্ষণ পরেই বৃষ্টিভেজা কাজলের নিষ্প্রাণ নিথর শরীর থেকে রক্তের ধারা প্রবাহিত হবে শিমুল গাছটার শিকড়ের দিকে। সেই রক্ত শুষে নিয়ে হয়তো কিছুদিন পর গাছটা অসহ্য সুন্দর রক্তিম শিমুল ফুলে ছেয়ে যাবে।
কিংবা হয়তো “নার্সিসিস্টিক সিরিয়াল কিলার” নামক পাশ্চাত্যঘেষা কাঠখোট্টা শব্দটা আসলে জয়ন্তের সাথে খাপ খায় না। হয়তো সে কারণেই শেষমুহূর্তে আজ কাজলের সামনে বসে, নিজের গলায় ছুরি ধরে কান্নায় ভেঙে পড়বে ও-
‘কাজল...আমি একজন ব্যাধিগ্রস্থ মানুষ। বিশ্বাস কর, আমি এরকম হতে চাইনি....আমি-’
হয়তো আজ মেঘেঢাকা আকাশ আর জয়ন্তের কান্না একাকার হয়ে ভিজিয়ে দেবে কাজলের হৃদয়কে।
একমাত্র একজন মানুষই তো পারে আরেকজন মানুষকে আপন করে নিতে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.