নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ওয়াসি আহমেদ

ওয়াসি আহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

কাফকা অন দ্য শোর : প্রথম পর্ব

০১ লা জুন, ২০১৮ রাত ২:৪৬

#ক্রো নামের ছেলেটা

“টাকা পয়সা গোছানো শেষ তো, নাকি?” নির্লিপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ক্রো নামের ছেলেটা। ঘুম ভাঙার পর আমাদের মুখের ভেতরটা বেশ কিছুক্ষণের জন্য নিস্তেজ আর ভারি হয়ে থাকে, তখন কণ্ঠস্বরও গম্ভীর শোনায়। ওর কথা শুনে সেরকম মনে হচ্ছে। এ অবশ্য ভান ছাড়া কিছু নয়। পুরোপুরি জেগে আছে ও, সবসময় যেমনটা থাকে।
মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
“কত?”
সংখ্যাগুলোকে মাথার ভেতর খেলিয়ে নিলাম আমি। “নগদ আছে প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো, এটিএম থেকে আরও কিছু তোলা যাবে। টাকার পরিমাণটা খুব বেশি নয় জানি, তবে কাজ চালানো যাবে। অন্তত এখনকার মতো আর কি।”
“খারাপ না,” বললো ক্রো নামের ছেলেটা।
আবারও মাথা নাড়লাম।
“আশা করি টাকাটা বড়দিন উপলক্ষে সান্তা ক্লজের থেকে পাওয়া নয়।”
“হুম, ঠিক বলেছো।”
ক্রো’র ঠোঁটের কোনায় একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। চারপাশে একটু চোখ ঘুরিয়ে বললো, “শুরুটা বোধহয় ড্রয়ার ঘাটাঘাটি করে, তাই না?”
উত্তর দিলাম না। ও ভালো করেই জানে, আমরা কার টাকা নিয়ে কথা বলছি। অযথা এতো প্যাঁচানোর কোন কারণ নেই।
“ব্যাপার না,” ক্রো বললো। “টাকাটা তোমার দরকার, ব্যবস্থাও হয়ে যাচ্ছে- হাত পেতে, ধার নিয়ে অথবা চুরি করে- যেভাবেই হোক। তোমার বাবার টাকা তুমি নিচ্ছ, তাতে কার কী আসে যায়? ঠিকমতো তুলে নাও, কাজ হয়ে যাবে। অন্তত এখনকার মতো কাজ চললেই হলো। তবে আরেকটা কথা, এই টাকা খরচ হয়ে যাবার পর কী হবে, ভেবে দেখেছো? টাকা কিন্তু বনে-বাদাড়ে জন্মানো ব্যাঙের ছাতা নয়, আপনা আপনি গজায় না। সেটা তুমি নিজেও জানো। খেতে হবে, থাকার জন্য জায়গা লাগবে। তারপর হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করবে, পকেট ফাঁকা হয়ে গেছে!”
“সময় আসুক, তখন ভাবা যাবে।”
“সময় আসুক,” বিড়বিড় করে আমার কথার পুনরাবৃত্তি করলো ক্রো। যেন শব্দগুলোকে হাতের তালুতে বসিয়ে ওজন মাপার চেষ্টা করছে।
মাথা নাড়লাম।
“কাজে ঢুকবে? চাকরী বা অন্য কিছু?”
“হয়তো।”
ক্রো মাথা ঝাঁকালো। “একটা কথা বলি, শোনো। দুনিয়ার হালচাল সম্পর্কে তোমার অনেক কিছু শেখার আছে। বলো তো, পনেরো বছরের একটা ছেলে কী ধরণের চাকরী পাবে? তাও আবার এমন এক দূর দেশে, যেখানে আগে কোনদিন তার পা-ই পড়েনি! জুনিয়র হাই স্কুলের গণ্ডি পেরোওনি এখনও, কে কাজ দেবে তোমাকে?”
আমার গালে লালচে আভা ফুটে উঠলো। অল্পতেই লজ্জা পাই আমি।
“বাদ দাও। যাত্রার শুরুতে এমন হতাশাজনক কথা বলা উচিত নয়। কী করবে, সেই সিদ্ধান্ত তুমি নিয়ে ফেলেছো। এখন শুধু চাকা ঘোরার অপেক্ষা। হাজার হোক, জীবনটা তোমার। নিজে যেটা ভালো বুঝবে, সেই পথেই এগোতে হবে।”
ঠিক। জীবনটা তো আমারই।
“তবে হ্যাঁ, এ কথাটাও মাথায় রেখো। লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে হলে তোমাকে আরও স্বাবলম্বী হতে হবে।”
“আমি চেষ্টা করছি, যতটুকু সম্ভব।”
“জানি,” ক্রো বললো। গত কয়েক বছরে তুমি যথেষ্ট শক্ত-সমর্থ হয়েছো। কথাটা অস্বীকার করার উপায় নেই।”
আবারও মাথা নাড়লাম আমি।
“তবে এটাও মানতে হবে, তোমার বয়স মাত্র পনেরো,” ক্রো বলতে লাগলো। “জীবন শুরু হয়েছে মাত্র। এমন অসংখ্য জিনিস আছে যা তুমি চোখেও দেখনি, কল্পনা করা তো দূরে থাক!”
বাবার স্টাডি রুমের পুরনো সোফায় বসে আছি আমরা দু’জন। ওর সাথে এভাবেই বসা হয় সবসময়।
এই ঘরটা ক্রো খুব পছন্দ করে। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জিনিসগুলোর ব্যাপারে ওর বেশ আগ্রহ। এই মুহূর্তে মৌমাছি আকৃতির একটা কাঁচের পেপারওয়েট নাড়াচাড়া করছে সে। বাবা বাড়িতে থাকলে অবশ্য ওটার ধারে-কাছেও যাওয়ার সাহস পেতো না।
“কিন্তু আমাকে এখান থেকে বেরোতে হবে,” বললাম আমি। “আর কোন উপায় নেই।”
“ধরে নিলাম, তোমার কথাটা ঠিক।” পেপারওয়েটটা টেবিলে নামিয়ে রেখে মাথার পেছনে হাত দিয়ে বসলো ক্রো। “পালিয়ে যাওয়া কিন্তু সবকিছুর সমাধান নয়। আমি তোমার সিদ্ধান্তে নাক গলাতে চাইছি না, তবু বলছি, তোমার জায়গায় আমি থাকলে এখন পালানোর কথা চিন্তা করতাম না। যতো দূরেই যাও না কেন, পালিয়ে হয়তো পার পাওয়া যাবে না। ব্যবধান সবক্ষেত্রে সমাধান নয়!”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো ক্রো নামের ছেলেটা। তারপর বন্ধ চোখের পাতায় আঙুল রেখে কথা বলতে লাগলো আমার সাথে। দু’চোখ জুড়ে নেমে আসা অন্ধকার ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে আসছে ওর কথাগুলোঃ
“এবার তাহলে খেলাটা শুরু করা যাক?”
“ঠিক আছে,” চোখ বন্ধ অবস্থায় বুক ভরে শ্বাস টেনে নিলাম আমি।
“আচ্ছা, এবার একটা ভয়ঙ্কর বালুঝড়ের কথা কল্পনা করো,” বললো ক্রো। “মাথা থেকে অন্য সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দাও।”
আদেশ মান্য করলাম আমি। মাথা থেকে সবকিছু ঝেড়ে ফেললাম, এমনকি ভুলে গেলাম নিজের পরিচয়টাও।
মাথার ভেতরটা একদম ফাঁকা এখন। হঠাৎ একটু একটু করে ফুটে উঠতে লাগলো কল্পনার দৃশ্য। বাবার স্টাডি রুমের সোফায় বসে দু’জনই সেই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি।
“কখনও কখনও আমাদের ভাগ্যটা বালুঝড়ের মতো অবিরাম দিক বদলাতে থাকে।” বলতে লাগলো ক্রো।
“কখনও কখনও আমাদের ভাগ্যটা ক্ষণিকের বালুঝড়ের মতো অবিরাম দিক বদলাতে থাকে। তুমি হয়তো দিক পাল্টাবে, কিন্তু বালুঝড় তোমার পিছু ছাড়বে না। তুমি আরেকদিকে ঘুরলে, সে-ও ঘুরে গিয়ে গতিপথ ঠিক করে নেবে।
এরকম চলতে থাকবে বারবার, বারবার। ভোরের আলো ফোটার আগে যেন মৃত্যুর সাথে পাল্লা দিয়ে অশুভ নৃত্যের আয়োজন করেছে কেউ।
কেন এমন হয়? কারণ, এই ঝড়টা আসলে দূর থেকে উড়ে আসেনি। ভেবো না এর সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই। এই ঝড়টা তুমি নিজেই, তোমার ভেতরেই তার বসবাস। আর তাই, ঝড়ের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ভেতরে প্রবেশ করো, চোখ-কান ভালো করে বন্ধ করে নাও, যাতে বালু না ঢুকতে পারে। তারপর এক পা-এক পা করে এগোতে থাকো। সেখানে সূর্যের কোন অস্তিত্ব নেই, নেই চাঁদের উপস্থিতি। দিক নির্দেশনা নেই, এমনকি সময়ের ধারণাও অবিদিত। শুধু চূর্ণ-বিচূর্ণ হাড়ের মতো শ্বেত-শুভ্র, সূক্ষ্ম বালুকণা কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। এমন একটা বালুঝড়ের কথা কল্পনা করো।”
আমি ঠিক সেটাই ভাবার চেষ্টা করি। মাথার ভেতর ফুটিয়ে তুলি, সাদা রঙের প্রকাণ্ড এক ঘূর্ণিঝড় পাকানো দড়ির মতো প্যাঁচ খেয়ে সোজা ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। আমার চোখ দুটো শক্ত করে বুঁজে রেখেছি, হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছি কানগুলো। সূক্ষ্ম বালুকণা কিছুতেই নিজের ভেতরে ঢুকতে দেবো না। বালুঝড় ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। দূরে দাঁড়িয়েও আমি বাতাসের চাপ অনুভব করতে পারছি। চামড়ার ওপর জোর করে চেপে বসছে দাম্ভিক বাতাস, আমাকে পুরোপুরি গিলে ফেলতে এগিয়ে আসছে।
আলতো করে আমার কাঁধে একটা হাত রাখলো ক্রো। ঝড়টাও বেমালুম ঊবে গেলো তখনই।
“আজ থেকে তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত-সমর্থ পনেরো বছরের ছেলে হতে হবে। এছাড়া তোমার টিকে থাকার কোন উপায় নেই। আর সেটা করতে হলে আগে বুঝতে হবে, শক্ত-সমর্থ হওয়ার প্রকৃত মানে কী। আমার কথা বুঝতে পারছো?”
আমি এখনও চোখ বন্ধ করে বসে আছি। ওর কথার উত্তর দিলাম না। কাঁধের ওপর ক্রো’র হাতটা অনুভব করতে করতে আমি ঘুমের জগতে হারিয়ে যেতে চাই। কোত্থেকে যেন ডানা ঝাপটানোর মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে।
“তুমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত-সমর্থ পনেরো বছরের ছেলে হতে যাচ্ছো,” ক্রো ফিসফিস করলো। ঘুমের অতল জগতে হারিয়ে যাচ্ছি আমি। ওর কথাগুলো যেন গাঢ় নীল বর্ণের উল্কি হয়ে গেঁথে যাচ্ছে আমার হৃৎপিণ্ডে।
তোমাকে সেই প্রচণ্ড শক্তিশালী ঝড় পেরিয়েই এগোতে হবে। আধ্যাত্মিক কিংবা সাংকেতিক, ঝড়টাকে যেভাবেই দেখো না কেন, তোমার কোন ভুল করা চলবে না। একটু ভুল হলেই সেটা হাজারো ক্ষুরের মতো মাংস ভেদ করে ঢুকে যাবে তোমার শরীরের ভেতর। অন্যদের রক্ত ঝরিয়েছে সেই ঝড়, ঝরাবে তোমার গা থেকেও। গরম, টকটকে লাল রক্ত। রক্তে মেখে যাবে দু’হাত; নিজের কী অন্যের রক্ত তখন আলাদা করে চিনতে পারবে না।
তারপর যখন ঝড় থেমে যাবে, তুমি নিজেও আর মনে করতে পারবে না কীভাবে এগিয়েছো। আদৌ ঝড় শেষ হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারেও হয়তো নিশ্চয়তা পাবে না। তবে একটা কথা নিশ্চিত, ঝড় থেকে বেরিয়ে আসার পর, তুমি আর সেই ভেতরে ঢোকা আগের মানুষটা থাকবে না। এটাই বালুঝড়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য।
পনেরোতম জন্মদিনে আমি ঘর ছেড়ে পালাবো। পাড়ি জমাবো অচেনা কোন দূরের শহরের উদ্দেশ্যে। আশ্রয় খুঁজে নেবো ছোট্ট এক লাইব্রেরির কোণায়।
পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে গেলে হয়তো সপ্তাহখানেক লাগবে। তার চেয়ে বরং মূল কথায় আসি। পনেরোতম জন্মদিনে আমি ঘর ছেড়ে পালাবো। পাড়ি জমাবো অচেনা কোন দূরের শহরের উদ্দেশ্যে। আশ্রয় খুঁজে নেবো ছোট্ট এক লাইব্রেরির কোণায়।
শুনতে হয়তো রূপকথার গল্পের মতো শোনাচ্ছে। তবে বিশ্বাস করুন, আমি কোন রূপকথার গল্প বলছি না। যতো মাল-মসলাই ঢালুন, বাস্তবতাকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।

---



#অধ্যায় ১

বাড়ি ছাড়ার সময় বাবার স্টাডি রুম থেকে আমি শুধু টাকাই নেইনি। পুরনো একটা ছোট্ট সোনার লাইটার নিলাম, জিনিসটা আমার খুব পছন্দের। সাথে নিলাম ভাঁজ করা যায় এমন একটা ধারালো চাকু। পাঁচ ইঞ্চি ফলাবিশিষ্ট সেই চাকুটা দিয়ে হরিণের চামড়া ছাড়ানো যায়। বাবা প্রায়ই বিভিন্ন কাজে বিদেশ যান, জিনিসটা বোধহয় সেরকম কোনবার কেনা। ড্রয়ার থেকে একটা উজ্জ্বল আলোর পকেট ফ্ল্যাশলাইট বের করে নিলাম আমি। আকাশী রঙের রেভো সানগ্লাসটাও নিতে ভুলিনি, বয়স লুকাতে হবে তো!
ভেবেছিলাম, বাবার প্রিয় ওয়েস্টার রোলেক্স ঘড়িটাও নিয়ে নেই। খুব সুন্দর ঘড়ি, কিন্তু চকচকে জিনিস হাতে থাকলে মানুষের চোখে পড়বে। আমার সস্তা প্লাস্টিকের ক্যাসিও হাতঘড়ি দিয়েই কাজ চালানো যাক। অ্যালার্ম আর স্টপ ওয়াচ আছে এটায়, বরং আরও বেশি কাজে লাগবে।
একরকম ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলাম ঘড়িটা।
আরেকটা ড্রয়ারের ভেতর, একদম পেছনদিকে পড়ে ছিল আমার আর আমার বোনের একটা ছবি। অনেক ছোটবেলায় তোলা; সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছি দু’জন। পাশ ফিরে তাকিয়ে আছে আমার বোন, দীর্ঘ ছায়ায় ঢাকা পড়েছে ওর মুখের অর্ধেকটা অংশ। হাসিটাও যেন আধাআধি কাটা পড়ে গেছে ঠিক মাঝ বরাবর। অনেকটা পাঠ্যবইয়ে আঁকা সেই গ্রীক ট্র্যাজেডির মুখোশগুলোর মতো, চেহারার দুই অংশে যেখানে দু’ধরণের অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। আলো আর অন্ধকার। আশা আর নিরাশা। আনন্দ আর বিষাদ। বিশ্বাস আর একাকীত্ব।
আমি অবশ্য ছবিটায় সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছি। সৈকতে আর কেউ নেই। আমাদের দুই ভাইবোনের গায়ে সাঁতারের পোশাক-ও পরে আছে লালরঙের ফুল আঁকা ওয়ান পিস, আর আমি নীলরঙের ঢোলাঢালা পুরনো ট্র্যাঙ্কস। হাতে একটা প্লাস্টিকের লাঠি ধরে রেখেছি।
সফেদ ফেনা হয়ে এসে আমাদের পা ধুয়ে দিচ্ছে সাগরের ঢেউ।
ছবিটা কে তুলেছে, কখন তুলেছে-সেই বিষয়ে আমার কোন ধারণা নেই। আমাকে এতো খুশি দেখাচ্ছে কেন? আর বাবা এই একটা মাত্র ছবিই বা রাখতে গেলেন কী মনে করে? পুরো ব্যাপারটা যেন আগাগোড়া রহস্যে ঘেরা। আমার বয়স তখন বড়জোর তিন হবে, আপুর হবে নয়। আচ্ছা, আমাদের দু’জনের এতো মিল ছিল নাকি? পরিবারের সাথে সমুদ্র দেখতে যাওয়ার কোন স্মৃতি আমার মাথায় নেই। শুধু সমুদ্র কেন, কোথাও গিয়েছি বলেই মনে পড়ে না। যাই হোক-এই ছবিটা বাবার ড্রয়ারে ফেলে রাখার মানে হয় না। যত্ন করে ওয়ালেটে ঢুকিয়ে নিলাম। আমার কাছে মা’র কোন ছবি নেই। বাবা সব ফেলে দিয়েছেন।
একটু ভেবেচিন্তে মোবাইল ফোনটা সাথে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। টের পাওয়ার সাথে সাথে হয়তো বাবা কোম্পানির সাথে আলাপ করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন।
পরেরটা পরে দেখা যাবে। আপাতত ওটাকে অ্যাডাপ্টারের সাথে ব্যাগের ভেতর চালান করে দিলাম। কতোই বা আর ওজন! কাজ না করলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া যাবে।
দরকারি জিনিস ছাড়া আর কিছু নেয়ার মানে হয় না। তবে কাপড়-চোপড় বাছাই করাটা ঝামেলার কাজ। কয়েকটা সোয়েটার আর আন্ডারওয়্যার নিয়ে নেব। কিন্তু শার্ট আর ট্রাউজার্সের কী হবে? হাতমোজা, মাফলার, হাফপ্যান্ট, কোট? এতকিছুর হিসাব করারই তোঁ সময় নেই। অবশ্য একটা ব্যাপারে আমার ধারণা পরিষ্কারঃ অচেনা কোন শহরে আমি বিশাল ভারি বোঝা বইতে রাজি নই। এত বড় একটা ব্যাকপ্যাক পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানে লোকজনকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া, দেখো সবাই! আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছি! কেউ না কেউ তো বুঝবেই। তারপর কী হবে? কিছু বোঝার আগেই আবিষ্কার করব ঘাড় ধরে পুলিশ আমাকে বাড়িতে ফেরত পাঠিয়েছে। অবশ্য স্থানীয় কোন গ্যাংয়ের পাল্লায় পড়াটাও অস্বাভাবিক নয়।
ভেবে দেখলাম, খুব ঠাণ্ডা পড়ে এমন কোথাও যাওয়ার মানে হয় না। বেছে নেয়ার সহজ বুদ্ধি, একেবারে উল্টোটা চিন্তা করা যাক-উষ্ণ কোন স্থান ভালো হবে আমার জন্য। তাহলে কোট আর হাতমোজাও নিতে হবে না, কাপড়-চোপড়ের পরিমাণ প্রায় অর্ধেকের মতো কমে যাবে। ধোয়ার পর তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে এমন কয়েকটা হালকা-পাতলা পোশাক বেছে নিয়ে সযত্নে ভাজ করে ব্যাকপ্যাকে ঢোকালাম আমি। ভাঁজ করা যায় এমন একটা থ্রি-সিজন স্লিপিং ব্যাগ, টয়েলেটে ব্যবহারের সামগ্রী, রেইনকোট, নোটবুক, কলম, একটা ওয়াকম্যান, দশটা ডিস্ক (গান না শুনে থাকতে পারবো না) আর কিছু রিচার্জেবল ব্যাটারি নিলাম সাথে। অনেক হয়েছে। রান্নার জন্য হাঁড়ি-পাতিল নেয়ার কোন মানে হয় না। একে তো জিনিসগুলো ভারি, তার ওপর আবার অনেক জায়গা দখল করবে। স্থানীয় দোকান থেকে তো খাবার কিনে খেতেই পারবো।
অনেকক্ষণ গুঁতোগুঁতি করে আমি লিস্ট থেকে জিনিস কমানোর চেষ্টা করে গেলাম। একবার কয়েকটা জিনিসের নাম লিখি, তারপর কেটে দেই। কিছুক্ষণ পর আরও একগাদা নতুন জিনিসের নাম লিখে সেগুলোও কেটে দেই।
বাড়ি ছেড়ে পালানোর জন্য পনেরোতম জন্মদিন আদর্শ সময়। এর আগে হলে বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে যেতো, আর পরে হলে দেরির কারণে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারতো সুযোগটা।
জুনিয়র হাই স্কুলে ভর্তি হবার পর, প্রথম দুই বছর আমি একটু একটু করে নিজেকে আজকের দিনের জন্য প্রস্তুত করেছি। প্রাইমারি স্কুলের শুরু থেকে আমি জুডো প্র্যাকটিস করতাম, জুনিয়র হাইস্কুলেও সেই ধারা বজায় রেখেছি মাঝে মাঝে। তবে স্কুলের টিমে যোগ দেইনি। একটু সময় পেলেই স্কুলের মাঠে দৌড়েছি, সাঁতার কেটেছি অথবা স্থানীয় জিমে ঢুঁ মেরেছি। তরুণ প্রশিক্ষকেরা আমাকে মাগনাই শেখাতেন। তাদের কাছেই আমি সবচেয়ে বেশি কার্যকর স্ট্রেচিং এক্সারসাইজগুলো শিখেছি। ফিটনেস মেশিন ব্যবহার করে কীভাবে পেশি ফোলানো যায়, সে ব্যাপারেও আমাকে ধারণা দিয়েছেন তারা। শিখিয়েছেন, শরীরের কোন পেশিগুলো প্রতিদিন ব্যবহৃত হয়, আর কোনগুলোকে শুধুমাত্র মেশিন ব্যবহার করে ফোলাতে হয়। সেই সাথে শিখিয়েছেন বেঞ্চপ্রেসের সঠিক কায়দাও। এমনিতেই বেশ লম্বা আমি, তার ওপর এসব ব্যায়াম করে কাঁধ আরও চওড়া হলো। বুকের পেশিগুলোও স্ফীত হলো অনেক বেশি। অপরিচিত কেউ দেখলে ভাববে, আমার বয়স সতেরো। একদিক থেকে ভালো হয়েছে। বাড়ি থেকে পালানোর সময় কেউ আমার আসল বয়সটা ধরতে পারলে, বিরাট ঝামেলা হয়ে যেতো।
জিম ট্রেইনার আর একদিন পরপর আমাদের বাড়িতে কাজ করতে আসা হাউজকিপার ছাড়া অন্য কারও সাথে আমি খুব একটা কথা বলতাম না। স্কুলে যেটুকু দিয়ে কাজ চালানো যায়, তার বাইরে মুখ খুলতাম না বললেই চলে। দীর্ঘদিন বাবা আর আমি একজন আরেকজনের মুখ দেখিনি। একই ছাদের নিচে থেকেও আমাদের সময় মিলতো না। বাবার বেশিরভাগ সময় কাটতো স্টুডিওতে। আমিও যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতাম।
আমি যে স্কুলে পড়ি, সেটা উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য। অনেক বেশি ধনী পরিবারের না হলে এখানে আসা সম্ভব নয়। এধরণের স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা এমনি-এমনি একই ক্যাম্পাসের আওতাভুক্ত হাইস্কুলে উঠে যায়। কেউ যদি ইচ্ছা করে বাগড়া দেয়, সেটা অবশ্য আলাদা কথা। সবার পরিষ্কার ইউনিফর্ম, ঝকঝকে সুন্দর দাঁত; তবে প্রত্যেকেই ভীষণ বিরক্তিকর। সঙ্গত কারণেই আমার কোন বন্ধু হয়নি। নিজের চারপাশে এক অভেদ্য দেয়াল গড়ে তুলেছিলাম। কাউকে ভেতরে আসতে দেইনি, নিজেকেও আটকে রেখেছি জোর করে। এমন ছেলেকে কেউ পছন্দ করে? দূর থেকে আমার ওপর নজর রাখে সবাই। হয়তো ঘৃণা করে, ভয় পায়; তবে ওরা যে আমাকে বিরক্ত করে না তাতেই আমি খুশি। মাথায় এমনিতেই হাজার রকমের বোঝা, নতুন কোন দুশ্চিন্তা ঢোকানোর জায়গা নেই। একটু ফাঁক পেলেই স্কুলের লাইব্রেরিতে ঢুকে বইয়ের জগতে হারিয়ে যেতাম আমি।
অবশ্য ক্লাসে যখন যা পড়ানো হতো, গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। ক্রো নামের ছেলেটা আমাকে তাই করতে বলেছিল।
ক্লাসে যেসব তত্ত্ব আর পদ্ধতি শেখানো হয়, বাস্তব জীবনে সেগুলো খুব একটা কাজে আসবে না। কথাটা মানতে হবে, শিক্ষক মানেই নির্বোধের দল। কিন্তু তোমাকে মাথায় রাখতে হবেঃ কিছুদিন পর বাড়ি থেকে পালাতে যাচ্ছো। আর কখনও হয়তো স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাবে না। তাই সুযোগ থাকা অবস্থায় যতটুকু পাচ্ছো, নিজের ভেতরে ধারণ করে নাও; ভালো লাগুক আর নাই লাগুক। ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নাও সবটুকু জ্ঞান। কোনটা রাখতে হবে আর কোনটা ঝেড়ে ফেলতে হবে, তা একসময় নিজেই বুঝতে পারবে।
ওর কথাগুলো বরাবরের মতোই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। মস্তিষ্ককে পরিণত করেছি স্পঞ্জের টুকরোয়; ক্লাসে যা কিছু শুনতাম, এক নিমিষে শুষে নিতাম সবটুকু। তারপর অর্থ বুঝে নিয়ে গেঁথে ফেলতাম স্মৃতির জালে। বাসায় খুব একটা পড়তে হতো না আর, কিন্তু পরীক্ষায় খুব ভালো করতাম।
একদিকে যেমন অসামাজিক আর চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিলাম, তারই সাথে পাল্লা দিয়ে ইস্পাতের মতো শক্ত হয়ে উঠছিল আমার পেশি। আবেগ-অনুভূতি যাতে কিছুতেই প্রকাশ না পায়, সে ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকতাম। টিচার অথবা ক্লাসের অন্য কাউকে আমার চিন্তাভাবনা বুঝতে দেয়া যাবে না। কিছুদিন পরেই প্রাপ্তবয়স্কদের নির্মম জগতে পা পড়তে যাচ্ছে। জানতাম, টিকে থাকতে হলে অন্য যে কোন মানুষের চেয়ে শক্ত-সমর্থ হতে হবে আমাকে।
আয়নায় তাকালে নিজের চোখদুটোকে গিরগিটির মতো শীতল বলে মনে হয়। থমকে গেছে আমার সব অভিব্যক্তি, কারও পক্ষে তার মর্ম উদ্ধার কড়া সম্ভব নয়। মনে পড়ে না শেষ কবে হেসেছি। কারও দিকে তাকিয়ে হাসির ভঙ্গিতে ঠোঁট পর্যন্ত বাঁকাইনি বহুদিন।
নিজ মনে হাসা তো দূরেই থাক!
তবে হ্যাঁ, সবসময় এই নীরবতা বজায় রাখা, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘুরে বেড়ানো আমার জন্য যথেষ্ট কঠিন ছিল। মাঝে মাঝে মনে হতো, নিজের চারপাশে গড়ে তোলা দেয়ালটা ভেঙে পড়ছে। ব্যাপারটা যে প্রায়ই ঘটতো তা না, তবে যখন ঘটতো তার আগে আমি টেরও পেতাম না। হঠাৎ আবিষ্কার করতাম সম্পূর্ণ অরক্ষিত, নগ্ন অবস্থায় হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এই সময়গুলোতে মনে হতো, দূর থেকে ভেসে আসছে অশনি সংকেত। কালো পানিতে ভরা পুকুরের মতো রহস্যময়।
সেই পূর্বাভাসের অস্তিত্ব হয়তো আগেও ছিল, আত্মগোপন করে ছিল চোখের অন্তরালে। সময় হলেই সেটা নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে, প্রতিটা কোষের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে দেয় শীতল অনুভূতি। নির্মম প্লাবনে ডুবিয়ে দেয় তোমাকে, জোর করে আটকে দেয় নিশ্বাস। ছাদ সংলগ্ন ভেন্টিলেটরের কাছাকাছি থাকার জন্য তুমি আপ্রাণ চেষ্টা করো, কিন্তু যে শুকনো বাতাস তোমার শরীরে প্রবেশ করে তা আগুনের মতো জ্বালিয়ে দেয় গলার ভেতরটা। পানি আর তৃষ্ণা, ঠাণ্ডা আর উষ্ণতা-আপাতদৃষ্টিতে বিপরীতধর্মী এই উপাদানগুলো একত্রিত হয়ে আক্রমণ চালায় তোমার ওপর।
পৃথিবী অনেক বড় একটা জায়গা। তোমাকে ধারণ করার জন্য যেটুকু পরিসর দরকার, তা খুব বেশি বড় না হলেও চলে। তবু দেখবে, সেই জায়গাটুকু কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোন এক কণ্ঠ শোনার আশায় তুমি হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু পাবে কী? নৈঃশব্দ!
আবার যখন তুমি নৈঃশব্দের খোঁজে দিশেহারা, তখন চারদিক থেকে তোমার কানে শুধু সেই অশনি সঙ্কেতই ভেসে আসবে। কখনও কখনও তোমার মাথার ভেতর লুকিয়ে থাকা গোপন সুইচ টিপে দেবে সেই দৈববাণী।
তোমার হৃদয় আসলে বহতা নদীর মতো। প্রচণ্ড বৃষ্টির ফলে যে নদীর জন্ম হয়, কূল ছাপিয়ে ভেসে আসে পানির তোড়। সেই ঢেউয়ের স্রোতে উপড়ে যায় মাটিতে গেঁথে থাকা সব নিদর্শন। তবুও নদীর ওপর ভারী বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়তে থাকে। যখনই খবরে এমন কোন বন্যার দৃশ্য দেখবে, ভাববে, আরে, এটা তো আমার হৃদয়ের ছবি!
বাড়ি থেকে পালানোর আগে ভালোভাবে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। নখ কেটে, কান পরিষ্কার করে, দাঁত মাজলাম তারপর। অনেকটা সময় ধরে গা পরিষ্কার করলাম। ঠিকভাবে পরিচ্ছন্ন হওয়াটা মাঝে মাঝে খুব জরুরি হয়ে পড়ে। আয়নায় ভালোভাবে তাকালাম আমার মুখের দিকে। বাবা আর মায়ের জিনের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে আমার এই চেহারা- অবশ্য মায়ের চেহারা আমার এক ফোঁটাও মনে নেই। আবেগ লুকিয়ে রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি আমি। চোখে কোন অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে দেই না, পেশি ফোলানোর চেষ্টায় মত্ত থাকি। তবে চেহারার ওপর আমার কোন হাত নেই। বাবার দীর্ঘ, পুরু ভ্রুজোড়া আর তার মাঝখানে পড়ে থাকা গাঢ় রেখাগুলো আমার চেহারায় জায়গা করে নিয়েছে। চাইলেই লোকটাকে খুন করতে পারি, আমার গায়ে সেই শক্তি আছে। মায়ের স্মৃতিগুলোকেও মাথা থেকে গায়েব করে দেয়া যায়। কিন্তু তাদের ডিএনএ মুছে ফেলব কীভাবে? সেগুলোকে তাড়াতে হলে তো নিজের কাছ থেকেই মুক্তি পেতে হবে আগে!
এর ভেতরেও আছে এক অশনি সঙ্কেত। সযত্নে বাস করছে আমার মনের গহীনে লুকায়িত অবস্থায়।
বাস করছে তোমার মনেও।
বাতি নিভিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। ভারী, স্যাঁতসেঁতে এক নীরবতা চারপাশ জুড়ে। বাতাসে মিশে আছে অস্তিত্বহীন মানুষদের ফিসফিস, মৃতদের দীর্ঘশ্বাস। চারদিক দেখে স্থির হয়ে দাঁড়ালাম আমি, লম্বা একটা শ্বাস নিলাম তারপর। ঘড়ির কাঁটা টিনের ঘর ছুঁইছুঁই করছে। তাদের মাঝে কেমন যেন শীতল দূরত্ব। নিরপেক্ষতার ভান এসব, আমি জানি। ওরা কেউই আমার পক্ষে নয়য়। বিদায় জানানোর সময় হয়েছে এবার। ব্যাগটা কাঁধে চাপিয়ে নিলাম। আগেও অনেকবার নিয়েছি, কিন্তু এবারের মতো ভারি মনে হয়নি কখনও।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, শিকোকু যাব। এই জায়গাটা বেছে নেয়ার কোন নির্দিষ্ট কারণ নেই। এমনি ম্যাপ দেখে মনে হলো, ওখানেই যাওয়া উচিত। যতবার ম্যাপের দিকে দেখি, যাচাই-বাছাই করার চেষ্টা করি, ততবারই মনে হয়- শিকোকু আমাকে নিজের দিকে টানছে। জায়গাটা টোকিও থেকে অনেকটা দক্ষিণে, সমুদ্রের কারণে মূলখণ্ড থেকে আলাদা হয়ে পড়েছে। শুনেছি অনেক গরম সেখানে। আগে কখনও শিকোকুতে পা পড়েনি আমার, বন্ধু অথবা আত্মীয় থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। কেউ যদি আমার খোঁজ করে (যদিও জানি করবে না), তবে শিকোকুর কথা তার মাথাতেই আসবে না।
কাউন্টার থেকে টিকেট নিলাম, তারপর উঠে পড়লাম নাইট বাসে। টিকেট অবশ্য আগেই রিজার্ভ করা ছিল। তাকামাতসু যেতে হলে এর চেয়ে সস্তা কোন উপায় নেই। কেউ আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। বয়স জিজ্ঞেস করা তো দূরে থাক, দ্বিতীয়বার নজর দেয়ারই সময় নেই কারও। ড্রাইভার যান্ত্রিক পদ্ধতিতে টিকেট চেক করলো।
বাসের মাত্র এক তৃতীয়াংশ সিটে যাত্রী আছে। বেশিরভাগ লোকই আমার মতো একা। বাসের ভেতর অদ্ভুত এক নীরবতা। তাকামাতসু অনেক দূরের পথ, শিডিউল অনুযায়ী প্রায় দশ ঘণ্টার যাত্রা। পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভোর হয়ে যাবে। আমার কোন সমস্যা নেই, হাতে এখন অঢেল সময়।
ঘড়িতে ঠিক আটটা বাজে, এমন সময় বাসটা স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লো। সিটটাকে পিছে ঠেলে আরাম করে বসলাম আমি। চার্জ ফুরিয়ে আসা ব্যাটারির মতো একটু একটু করে স্তিমিত হয়ে আসতে লাগলো আমার চেতনাবোধ। ঘুমিয়ে গেলাম নিজের অজান্তেই।
মাঝরাতে কখন যেন তুমুল বর্ষণ শুরু হলো। একটু পর পর ঘুম ভেঙে যাচ্ছিলো আমার। জানালার পর্দা সরিয়ে ধেয়ে যাওয়া হাইওয়ের দিকে দেখছিলাম। বৃষ্টির ফোঁটা প্রবল বেগে কাঁচের ওপর আছড়ে পড়ছিল, ঝাপসা হয়ে আসছিল রাস্তার দু’ধারের স্ট্রিটলাইট। নির্দিষ্ট দূরত্বে যেন পৃথিবীকে মাপার জন্য বসানো হয়েছে ওগুলো। হঠাৎ এক ঝলক আলোর দেখা পাই, আবার এক মুহূর্তেই তা দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়।
ঘড়ি দেখলাম, মাঝরাত পার হয়ে গেছে। আপনা-আপনি যেন সামনে ঠেলে দিচ্ছে কেউ আমাকে। পনেরোতে পা পড়লো।
“শুভ জন্মদিন,” বললো ক্রো নামের ছেলেটা।
“ধন্যবাদ।”
ছায়ার মতো আমার শরীরের সাথে জুড়ে আছে অশনি সঙ্কেত। আমার চারপাশের দেয়ালটা জায়গামতো আছে কিনা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিলাম। তারপর জানালার পর্দা টেনে হারিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।




(চলবে)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা জুন, ২০১৮ রাত ২:৫৬

মনিরা সুলতানা বলেছেন: বাহ!!!

২| ০১ লা জুন, ২০১৮ দুপুর ১:২১

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর এবং ভালো।
চলুক।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.