নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

Wasiful Gofur Abir\n\nFacebook ID: Wasif Abir

দ্যা বান্দর

দ্যা বান্দর › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইন্টারডিমেনশনাল শ্রদ্ধাঞ্জলি

২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৫

লাঞ্চের পর পরই সিঁড়ি ভাঙ্গা যথেষ্টই ফাপড়দায়ক কাজ। বিশেষ করে যখন পাহাড়ের গা কেটে বানানো সিঁড়িটা হয় স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা খাড়া। বিশেষ করে যখন তার আগের দিন রামেক্রি থেকে নিয়ে নাফাখুম জলপ্রপাতে পায়ে হাঁটা আপ-ডাউন জার্নি দুপুরের মধ্যেই শেষ করতে হয়। এবং বিশেষ করে যখন পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির শরীরটা ৯৩.৩ কেজি ওজন ধারণ করে থাকে।

স্থান হল রুমাবাজার, বান্দরবান। সিঁড়ি ভেঙ্গে আর্মি ক্যাম্পে নামধাম, ঠিকুজি লিখতে হল। এই পিপে টাইপের শরীরটাকে নিয়ে বহু যন্ত্রণায় আছি। হাঁটাহাঁটিজনিত ব্যথা আর ক্লান্তি শরীরের পেশীতে পেশীতে গেঁথে বসে আছে। উঠার সময় চার হাতে পায়ে জন্তুর মতো উঠলাম। নামার সময় দেখি মাথা ঘুরায়,একজন বন্ধুর কাঁধে হাত দিয়ে নামলাম। বাঙালির মনে মোটা মানুষদের জন্যে কোনো সফট কর্ণার নাই। মোটা মানুষ দেখলেই এমন ভাব করে যেন তার ভাগের খাবারটা খেয়ে সে মোটা হয়ে গেছে। মোটা মানুষ দেখলেই শ্রেণী সংগ্রাম চাগিয়ে উঠে, মোটা মানুষ তাদের কাছে পুঁজিবাদী রক্তচোষাদের প্রতিনিধি। একদিনের মধ্যে নাফাখুম বেড়িয়ে আসার প্ল্যান আছে শুনে সেখানকার গাইড আমার দিকে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিলো যেন আমি এক মহা অচ্ছূৎ তার সাথে যোগ দিচ্ছি। উপজাতিরাও কম যায় না,আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন একটা বিচিত্র প্রাণী তাদের মাঝে হাজির হয়েছে। রুমাবাজার আসার পথে যখন বাসের ছাদে উঠার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলাম তখন কয়েকটার সে কি আনন্দ! মোটা মানুষদের সামাজিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন শুরু করবো ভাবছি ’স্হুলকায়দের মোটকু নয়, ওজন প্রতিবন্ধি বলুন’ এই টাইপের কয়েকটা স্লোগান্ও ঠিক করে রেখেছি।

যাত্রায় আমরা মোটমাট নয় জন- ছয় জন আমরা ইউনিভারর্সিটির ফ্রেন্ড, সাথে তিনজনের একটা ছোট দলের সাথে যুক্ত হয়েছি, তিনজনই বয়সে বড়। ইনাদের সাথে পরিচয় রুমাবাজার আসার পথে। এই তিনজনের মধ্যে শাহীরান ভাই আর রেজ্ওয়ান ভাই দুজন মেরিনের জ্ওয়ান। তৃতীয়জন হলেন জনি ভাই দাড়িওয়ালা মানুষ।অনেকের ধারণা সাথে দাড়িওয়ালা মানুষ থাকলে সবসময় এটা করবা না, সেটা করবা না বলতে থাকবেন, তার সামনে ওজু করে আদবের সাথে পেশ হতে হবে। কিন্তু সফরের সময় এ ধরণের মানুষ হাতে থাকা খুব জরুরি, রাস্তাঘাটে কতো বিপদ-আপদ,একজনের উসিলায় আল্লাহর রহমত পা্ওয়া গেলে তো বর্তে গেলাম। অবশ্য ‍রুমা বাজারে নামার পর যখন দেখলাম তিনি সাথের দুইজনকে বলছেন, ‘এই গোল্ডলিফ কই পা্ওয়া যায় দেখো তো, যে কয় প্যাকেট লাগে কিনে ফেলো।’ তখনই বুঝলাম এই লোক চিজ বারি হ্যায় মাসত মাস্ত। অবশ্য বন্ধদের মধ্যেও একজন দাড়িওয়ালা আছে, নাম তানভির। আমার বন্ধুদের পরিচয় আস্তে আস্তে দিচ্ছি। অবরোধের সময় ঘুরতে বেরিয়েছি, তাই বাড়িতে আশস্ত করার জন্য নয়জনের ছোটোমোটো দলের জার্নিটাকেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ইউনিভার্সিটির শিক্ষা সফর বানিয়ে দিয়ে এসেছি। সব মানুষেরই মিথ্যা বলার একটা ঢাকনি থাকে,প্রয়োজনের সময় যেটা অল্প অল্প ফাঁক করে মানুষ কাজ চালায়। এই মিথ্যার সাথে তাল মিলাতে মোবাইলে যে কয়শ মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে, তারপর সেই ঢাকনি আদৌ জায়গামতো আছে কিনা আমি সন্দিহান। প্ল্যান হচ্ছে চান্দের গাড়িতে করে বগালেক যাবো, সেখান থেকে ক্রেওক্রাডং, জাদিপাই ঘুরে ফেরত আসবো।

নিচে নেমেই পেলাম দুঃসংবাদ। চিকন হাসি দিয়ে নতুন গাইড জানালো ড্রাইভারদের ধর্মঘট চলছে, পুরো বাইশ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বগালেক যেতে হবে। এখন দুপুরে রওনা দিলে রাতে পৌঁছাতে পারব। রাগের চোটে মন চাচ্ছে সামনের সব চান্দের গাড়িগুলোকে লাত্থিলুত্থি মেরে উড়িয়ে দেই।ভেবেছিলাম গাড়িতে বসে রেস্ট নিয়ে নিবো, তা আর হলো কই! শুনে আশস্ত হলাম এই রাস্তা গাড়ি চলার রাস্তা। কমসে কম নাফাখুমের যাত্রাপথের মত জায়গায় জায়গায় পাহাড়ের গা ঘেষে চিকন রাস্তা, পিছলা রাস্তা ইত্যাদি ফ্যাসাদের মোকাবিলা করতে হবে না।

শুরুতেই পরনের গেঞ্জি খুলে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললাম, গায়ে থাকলো কেবল স্যান্ডো গেঞ্জি। নিজেকে রুপা চাড্ডি আউর বানিয়ার টিভি কর্মাশিয়ালের গোবিন্দের মতো লাগছিলো। এই জায়গায় অতো লজ্জার কি আছে- লজ্জা দেয়ারই তো লোক নাই। আবার আরেক জায়গায় নাম-ধাম লিখতে হল। এখানে বড় ভাইরা আমাকে একটা লাঠি যোগাড় করে দিলেন। আবার তানভীর এগিয়ে এসে জোর করে আমার সাথে ব্যাগ বদল করে আমার ভারি ব্যাগটা থেকে রেহাই দিয়ে দিল আমাকে। জার্নি নিয়ে আমার শিক্ষা হল, জার্নি এমন একটা বিষয়, যেখানে বেশি জিনিস নিলেও ফাপড়, কম জিনিস নিলেও ফাপড়। আমি ছিলাম বেশি জিনিসের ফাপড়ে। তানভীরের ব্যাগটা অনেক হালকা ছিল। আমার সেজন্য অপরাধবোধ হতে লাগল। কিন্তু জান বাঁচানো ফরজ। তাছাড়া বন্ধুদের মধ্যে পালের গোদা লম্বু হিমেল বলে, তানভীরের শরীরে নাকি মহিষের শক্তি। এত শক্তি শরীরে জমা রেখে কী লাভ- তার চেয়ে আমার খেদমতেই কিছু নাহয় ব্যয় হোক।

এরপরের সেই চলার পথের বর্ণনায় আমি আর যাচ্ছি না। একই ফুল থেকে মৌমাছি নেয় মধু, মাকড়সা নেয় বিষ। আমার সহযাত্রীরা পথ চলতে চলতে উপভোগ করল চারপাশের সিন-সিনারি, আর আমি নিলাম কষ্ট। সে কারণে সেই পথটা বলতে গেলে ’সবুজাভ’, ’শ্যামলিমা’, ’ভয়ংকর সুন্দর’, ‘প্রকৃতি দুই হাতে ভরে দিয়েছে’- এই জাতীয় কয়েকটা ক্লিশে শব্দ আর উপমা ছাড়া আর কিছুই বের হবে না, আর এগুলো দিয়ে পাঠকদের মানসপটেও কোন ছবি আঁকা হবে না।

আরেকটা কারণ হল এই অল্প কয়টা দিনেই আমার মধ্যে এক ধরণের অভ্যস্ততা গড়ে উঠেছে, কোন অজ্ঞাত কারণে বান্দরবানের নভেলটি খসে পড়েছে। আমার কাছে সবই পাহাড় আর সবুজ, সবুজ আর পাহাড়। আমার অবজার্ভেশনে, প্রত্যেক জায়গারই সৌন্দর্য বা যে ব্যাপারটা আপনি উপভোগ করবেন- সেটার একটা প্যাটার্ন থাকে একেকটা ঋতুর জন্য। একবার সেটার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সর্বনাশ, মনে হবে আপনি বারবার সেই প্যাটার্নটার পারমিউটেশন-কম্বিনেশনের রিপিটেশন দেখছেন। বান্দরবানের রাস্তাগুলোর সেই প্যাটার্নটা হল বড় বড় সবুজ পাহাড়, নিচে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে জঙ্গল, অনেক দূরে দিগন্তরেখার উপর নীল নীল পাহাড়। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময় সেই জঙ্গলগুলোর উপর পাহাড়ের ছায়া পড়ে। বিশাল জঙ্গলে না জানি কত অনাবিষ্কৃত জায়গা। আপনার মনে হবে, যদি পাখির মত জঙ্গলগুলোর উপর দিয়ে উড়াল দিয়ে যেতে পারতাম ঐ নীল নীল পাহাড়গুলোর দিকে! সময়টা শীতকাল। শীতকালে বান্দরবানের এটাই কমন সীন। তারপর জায়গাভেদে বিশেষ বিশেষ সাইট তো আছেই। আমার মনে পড়ছিল ছোটবেলায় নানার সাথে মর্নিং ওয়াকে লালবাগ কেল্লায় যেতাম। ওখানে ছোট একটা টিলামতন ছিল। ঐ বয়সে সেই টিলাটা নিয়েই কত আহ্লাদ! আর এখন ডজন ডজন উঁচু উঁচু পাহাড় পেয়েও আমি নির্বিকার। হয়তবা আরও অল্প বয়সে আসলে ভালমত উপভোগ করতে পারতাম।

রাস্তাটা নাফাখুমের মত বিপজ্জনক না হলেও এর যন্ত্রণা অন্যখানে। রাস্তা কখনও প্রায় খাড়া উপরে উঠে গেছে, কখনও খাড়া নেমে গেছে। নাফাখুম যাত্রা আমাকে দিয়েছে ক্লান্তি, কিন্তু আমার বন্ধুদের করেছে হাঁটাহাঁটির সাথে অভ্যস্ত। তারা দেখা গেল নিচে নামার সময় দৌড় দিচ্ছে, আর গতির মোমেন্টামটাকে কাজে লাগিয়ে সামনের খাড়াটাতে উঠে যাচ্ছে। আমি নামার সময় নিজের পতন ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে নামছি, সেজন্য পায়ের পেশীতে চাপ পড়ছে, উঠার সময় হাপাতে হাপাতে উঠছি। মন চাচ্ছে ওদের মাথাগুলো হাতের লাঠিটা দিয়ে ফাটিয়ে দেই।

কিছুক্ষণ পরেই হাঁটার গতির তারতম্যে সবাই দুইটা দলে ভাগ হয়ে গেল। গাইডসহ আমার চারজন বন্ধু সামনের দলে। পেছনের দলে তিন বড় ভাইসহ আমি আর আরেক বন্ধু অনিক। এই অনিক ছেলেটা জয়েন করেছে রুমাবাজারে। সে নাকি আসার আগে ঢাকায় কয়েকদিন সকালে দৌড়াদৌড়ি করে প্র্যাকটিস করেছে। কিন্তু এখানে বেচারার সকল প্র্যাকটিস মুখ থুবড়ে পড়ল। আধাঘন্টা পরেই দেখা গেল সে রাস্তায় ভিক্ষুকের মত বসে পড়েছে, ভেটকি মাছের মত বিশাল হা করে শ্বাস নিচ্ছে, বড় ভাইরা তাকে বলছে, মুখ বন্ধ করে শ্বাস নাও, মুখ বন্ধ করে শ্বাস নাও। আমি তাকে বললাম, উঠ হারামজাদা, উঠ।
-দোস্তো রে, আমি মইরাই যামু দোস্ত।
-আরে মইরা যাওন মুখের কথা! তুই হালায় এখন মরলে, তোর লাশ কান্ধে কইরা লয়া যাইব কে? আমরা তো নিজেরে লয়াই পারি না।

বেচারার জন্য মায়া লাগল, আবার আনন্দও হল। যাক, পেরেশানিতে তাহলে আমি একাই নাই। হাত দিয়ে তুলে দেখলাম ওর ব্যাগটা মোটামুটি ভারি, সেই তুলনায় তানভীরের ব্যাগটা হালকা, যেটা এখন আমার কাঁধে আছে। তাই আমি ওর সাথে ব্যাগ বদল করে নিলাম। আমি চেষ্টা করতে থাকলাম যেন পেছনের দলের আগে থাকা যায়। এর কারণটা হল, আমি যেটা বুঝলাম, বড় ভাইরা এর আগ পর্যন্ত বাসেই ট্রাভেল করেছেন, হাঁটাহাঁটি পড়েনি। তাই এখন হাঁটার গতি কম, কিন্তু কিছুক্ষণ পরই হয়তবা অভ্যস্ত হয়ে যাবেন আর গতি যাবে বেড়ে, তখন দেখা যাবে পিছনে পড়ে গেছি। তাই এখন থেকেই ব্যালেন্স করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

এরপরের কাহিনী আর কী বলব? সূর্য ডুবল, চাঁদ উঠল। পথ যত যায়, কষ্টও তত বাড়ে। আমি পিছাতে পিছাতে পেছনের দলটারও পিছনে পড়ে গেলাম। আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য কখনও হিমেল গতি কমায়, কখনও বড় ভাইরা গতি কমায়। আমার মনে হচ্ছিল, এতদিন বেহিসাবী খাওয়াদাওয়া আর আলসেমি করে যে পাপ করেছি, তার খেসারত দিতে হচ্ছে। নিজের উপর এত রাগ হচ্ছিল যে, মন চাচ্ছিল যে বাকি রাস্তা নাকে খত দিতে দিতে যাই। মাঝে মাঝে টাইগার এনার্জি ড্রিংক খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিচ্ছিলাম। বান্দরবানে এই জিনিস আবার চালু আইটেম। সেটা দেখে বড় ভাইরা আমার নাম দিয়ে দিল টাইগার, আর বাকি জার্নিতে তারা আমাকে এই নামেই ডেকেছেন। পাহাড়ের রাস্তা বলতে মাটির রাস্তার ওপর ইট বিছিয়ে গাড়ি চলার উপযোগী করা। সেই ইট কোথাও কোথাও উঠে গিয়ে রাস্তা ভেঙ্গে গেছে, কোন কোন জায়গায় বৃষ্টির জন্য কাদা জমেছে- নানা রকম আপদ। সামনের দল চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পেছনের আমাদেরকে বলে দিচ্ছিল কোথায় কাদা, কোথায় ভাঙ্গা।

গাইড ব্যাটা মহা ত্যাঁদড়। এটাই শেষ খাড়া, এটা শেষ খাড়া, বলে কতগুলো খাড়া আমাদের দিয়ে ডিঙ্গিয়েছে, তার ইয়ত্তা নাই। শোনা গেল সবচেয়ে শেষে এক কিলোমিটার লম্বা একটা খাড়া পড়বে। তারপরেই বগা লেক। মাঝখানে দুইটা স্টপ আছে। প্রথম স্টপের আগে একটা বিশাল ঢাল পড়ল, নামছে তো নামছেই। সেখানে মেরিনের বড় ভাই দুজন পুরোটা রাস্তা আমাকে ধরে ধরে নামালেন। এর আগে কোন অপরিচিত মানুষ এই মোটা মানুষটাকে এত বড় দয়া দেখায়নি। এটা কখনই ভুলার মত না।
প্রথম স্টপটা একটা গ্রাম। সেখানে খাওয়া দাওয়া করে আবার চলতে শুরু করলাম। শীত নামতে শুরু করেছে। জ্যাকেটা পড়ে গলা পর্যন্ত চেইন টেনে দিলাম। এর পরের রাস্তা পুরোটাই মাটির। আর এই মাটির রাস্তা থেকেই শুরু হল মূল ঘটনা। (তার মানে এতক্ষণ আপনারা হুদাই ভ্যাজর ভ্যাজর শুনছিলেন)

দূরে পাহাড়ের উপর আলোর মত দেখা যাচ্ছিল। এক জন বলে ওটাই বগালেক, আরেকজন বলে ওটা আসলে একটা তারা। যাই হোক, হাঁটতে হাঁটতে একসময় সবার পিছনে পড়ে গেলাম। বলা হয়েছিল রাতে সবাই একসাথে চলতে। চাইলেই ডাক দিয়ে সামনের যারা যাচ্ছে তাদের থামানো যায়, কিন্তু একা একা হাঁটতেই ভালো লাগছিল। তার আগে অনেকেই আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য গতি কমিয়েছে। সঙ্গ দেবার সময় হিমেল হারামিটা আমাকে বলে গিয়েছে, ’জলদি চল, জঙ্গলে ভিতর দিয়া কী জানি আমাগো লগে লগে চলতেসে। পাতার শব্দ পাইতেসি, বুঝসই তো।’ বজ্জাতটা ভালো করেই জানে আমার ভুতের ভয়। এখন সেটার চাল চালছে।

মাটির রাস্তায় কিছু দূর পর পর কাদা। এই কাদা নিয়ে আচ্ছা মুসিবতে পড়লাম। চাঁদের আলোয় কোনটা কাদা, কোনটা শক্ত বোঝার উপায় নাই। লাঠি ফেলে ফেলে ঠাহর করে চলতে হচ্ছে। অনেক দূর একা একা যাওয়ার পর দেখি তানভীর যাচ্ছে। ও মনে হয় আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। ও আমাকে বলল ও যেভাবে যেভাবে হেঁটে যাচ্ছে, সেভাবে পা ফেলে ফেলে যেতে। আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে তার অনুসরণ করলাম। কষ্ট অনেক কমল। এক সময় কাদার রাস্তা শেষ হল। আমি বললাম, বুঝলা দোস্তো, এই কাদা আর পিছলার যন্ত্রণা নাফখুম থেকা সহ্য করতেসি। নাফাখুমে কয়েকবার পিছলা খায়া পড়লাম। সেখান থেকা ভয়টা মাথায় গাইথা গেসে। যখন থানচিতে থাকার জায়গায় ফেরত আসলাম, তখন দেখি বারান্দার ফ্লোরে কে জানি পানি ঢাইলা রাখসে। ভয় তখনও এমনভাবে কাজ করতেসিল যে, সেই জায়গার উপর দিয়াও হাঁটতে পারি না। বুঝ অবস্থাটা…

মাথা তুলে দেখলাম সামনে কেউ নাই। তানভীর তো এই মাত্রই সামনে ছিল। হঠাৎ করে টান দিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেল নাকি? পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দেখলাম সামনে রাস্তায় অনেক দূর পর্যন্ত কেউ নাই। ভাবলাম, রাস্তার পাশের ঢালে পড়ে গেল না তো? তাকিয়ে দেখলাম চাঁদের আলোতে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। চেঁচিয়ে বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম তানভীর তাদের সাথে নাকি। তারাও চেঁচিয়ে উত্তর দিল তানভীর তাদেরও সামনে। অবাক ব্যাপার! যাই হোক, অত মাথা না ঘামিয়ে পা চালাতে থাকলাম।

অনেকক্ষণ পর দ্বিতীয় স্টপে পৌঁছালাম। এই জায়গার নাম রুমাবাজার। এরপরেই সেই বহুল আলোচিত খাড়া ঢালটা। তারপরেই বগালেক। মন শক্ত করলাম। এটাই শেষ কষ্ট। তারপর বগালেক পৌঁছালে পেইন কিলার খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দেয়া যাবে।

এই রাস্তাটা সবচেয়ে খারাপ। পাহাড়ের গায়ে চিকন একটা পায়ে হাঁটার পথ, দুইপাশে খাদ। আমি একটা ট্র্যান্স স্টেটে চলে গেলাম। দুনিয়ার সব মনোযোগ ঢেলে দিলাম আমার পা আর রাস্তার উপর। নিচে খাদের দিকে তাকিয়ে একবার ভয় পেয়ে গেলেই সব শেষ। অনেক কষ্ট করে লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে উঠতে লাগলাম। আমি যতদূর জানি আমিই সবার পেছনে। মাঝে মাঝে থেমে দম নিয়ে নিচ্ছি। একসময় দেখলাম একটা জায়গায় আমার বন্ধু ফারহান দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, কি বন্ধু, হাপায় গেসো?

ও বলল, তোমার জন্য দাঁড়ায় আছি। গাইড বলসে এখান থেকে ডানপাশ ধরে নিচে নামতে হবে।

তারপর আমাকে কথা বলার কোন সুযোগ না দিয়েই ফারহান লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে নেমে গাছপালার মধ্যে কোথায় যেন চলে গেল। আমি তো পড়লাম মহা মুসিবতে। এখন এই খাদের মধ্যে নামি কীভাবে! ইশশিরে! হাতে ধরে নামানোরও কেউ নাই আশেপাশে। এক পায়ের উপর ভর দিয়ে বসে লতাপাতা ধরে আরেক পা নিচে নামানোর চেষ্টা করতে থাকলাম, কিন্তু মাথা বনচক্কর দেয়।

”এ্যাই ছেলে, কী করো?”

চমকিয়ে উঠলাম। দেখলাম নিচ থেকে জনি ভাই উঠে আসছে। মনটা ভালো হয়ে গেল। যাক, তাহলে আমার পিছনেও কেউ আছে। আমি বললাম, গাইড বলসে এদিক দিয়ে নিচে নামতে হবে।
-কী বলো না বলো! হাঁটা পথ গেসে উপরে, তুমি নামবা নিচে! সোজা রাস্তায় যাও। গাইডের সাথে আমার কথা হইসে।

জনি ভাই এরকম ধমক দিয়ে কথা বলছেন কেন বুঝলাম না। কমলাবাজারে কোন ঘটনা ঘটেছে নাকি? চাঁদের আলোয় চেহারা দেখলাম থমথমে।
আমি বললাম, ’আচ্ছা দাঁড়ান। একটু জিরায়ে নেই।’
-কোন থামাথামি নাই। সোজা উপরে উঠতে থাকো। তাড়াতাড়ি যাও। জায়গা ভালো না।

জায়গা তো অবশ্যই ভালো না। একবার পিছলে পড়লে তো খবর! কিছুটা উঠে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকালাম।

”সোজা উইঠা যাও। পেছনে তাকাবা না।”

কী আর করা! তাড়াতাড়ি উঠতে থাকলাম। উঠছি তো উঠছি। পেছনে জনি ভাইয়ের হাঁটার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। উনার সাথে আর কোন কথা হল না। আর এক সময় দেখলাম উঁচুতে বন্ধুদের দুইজন বসে আছে। ওরা বলল, ঐ দ্যাখ বগা লেক।

দেখলাম চাঁদের আলোয় বহু আকাঙ্ক্ষিত বগা লেক। কিন্তু এই মুহূর্তে সৌন্দর্য-টৌন্দর্য মাথায় ঢুকছে না। চিন্তা একটাই, শরীরটা এলাতে হবে। বন্ধুরা বলল আর্মি ক্যাম্পে নাম লেখাতে হবে। তারা হাঁটতে শুরু করল। আমি বললাম পিছনে জনি ভাই আসছে। ওরা অবাক হল। ’ধুর কী কস না কস!’- বলে আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। শুনলাম জনি ভাইসহ বড় ভাইরা ইতোমধ্যে ক্যাম্পে পৌঁছে গেছেন। তাদের সাথে ফারহানও গেছে।

এদিকে আমার মাথায় লেগে গেল গিট্টু। জনি ভাই কীভাবে আগে আগে পৌঁছে গেছেন? রাস্তা এতই সরু যে আমাকে পাশ কাটিয়ে উঠে যাবেন- এরকম কিছু হবার সম্ভাবনা শূন্য। ফারহানই বা খাদ দিয়ে নেমে এখানে আসল কীভাবে? আমি জিজ্ঞেস করলাম, অল্টারনেটিভ কোন রাস্তা আছে নাকি। ওরা বলল এদিক দিয়ে উপরে উঠার এই একটাই রাস্তা। রাস্তা দিয়ে উঠার পর আমারও এমনটাই মনে হয়েছে। দুই পাশে খাড়া গভীর খাদ। রাস্তাটার কোন শাখা নাই। আমার চোখে সামনেই সবাই এই রাস্তাটা ধরেই উঠেছে। আমি তো কিছুই বুঝছি না। দূর থেকে মনে হল বাকি বন্ধুরা কোরাস করে গান গাচ্ছে। ধুর ব্যাটা, আল্লাহ-রাসূলের নাম নে। জান নিয়ে এখানে আসতে পেরেছি কত বড় রহমত!

বগা লেক এসে দেখলাম জমজমাট অবস্থা। অনেকগুলো গ্রুপ এসে বসে আছে, একদল গান গাচ্ছে, একদল খাওয়াদাওয়া করছে। গাইড কটেজ ঠিক করে রেখেছে। এটা বম উপজাতিদের গ্রাম। বাড়িগুলো কাঠের তৈরী, দুই তলা করে। নিচের তলায় নিজেরা থাকে আর ডাইনিং স্পেস, উপরের তলায় গেস্টরুম হিসেবে ভাড়া দেয়। আমাদের জন্য ঠিক করা বাড়িটার বারান্দায় বেঞ্চের উপর বসলাম। সেখানে ফারহান আর স্বাক্ষর বসে ছিল। এই স্বাক্ষর ছেলেটা সবার আগে আগে হেঁটেছে। এখন দেখছি বিধ্বস্ত অবস্থা।

ফারহানকে জিজ্ঞেস করলাম, ঐ সময় খাদ দিয়া নাইমা কই গেসিলি?
-কখন খাদ দিয়া নামলাম?
-ঐ যে তুই দাঁড়ায়া ছিলি। আমার লগে কথা কইলি…
-কী কস তুই? তোর লগে আবার কখন কথা হইল?

তব্দা খেয়ে বসে থাকলাম। ফারহান জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে। আমি মনে মনে বলি, কী হইসে সেটা শুনলে তো আজকে রাইতে আর টয়লেটে যাইতে পারবা না। পেটের মধ্যে বোমা চেপে বসে থাকলাম।

আস্তে আস্তে ধাতস্থ হবার চেষ্টা করলাম। সবার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বুঝলাম, কেউই ফাজলামি করার মুডে ছিল না। আর ফাজলামির ইচ্ছা থাকলেও, পুরো রাস্তাটার যে চেহারা দেখলাম, সেরকম কোন সুযোগও ছিল না। যেটা আন্দাজ করলাম, তেনাদের মধ্যে কেউ আমাকে একা পেয়ে বিপদে ফেলার চেষ্টা করেছেন। তেনাদের মধ্যেই আরেকজন আবার আমাকে সাহায্য করেছেন- দুই বার। এক জায়গায় শুনেছিলাম তেনারা যে জগতের বাসিন্দা সেটা আমাদের মত ত্রি-মাত্রিক না, সেখানে নাকি মাত্রা আরও বেশি। তাই আমরা সবসময় তাদের দেখতে না পেলেও তারা আমাদের ঠিকই দেখতে পান। আজকের দিনটায় কতজনের কাছ থেকেই না উপকার পেলাম, ত্রি-মাত্রা থেকে নিয়ে বহু মাত্রা। ঠিক করলাম আল্লাহর কাছে সেই এনটিটির জন্য জন্য দোয়া করব। মনে পড়ে গেল এই কয়দিনে কাজা নামাজের বিশাল পাহাড় গড়েছি। চোখ বুজে ভিন্নমাত্রার সেই বাসিন্দাটার জন্য অনুভব করলাম গভীর আন্তর্মাত্রিক কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.