নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

\'আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের\'

যাযাবর জোনাকি

‘আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের’

যাযাবর জোনাকি › বিস্তারিত পোস্টঃ

গপ্পো

০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:১৩

কালো একটা বড় নিশান গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বিশাল নিমগাছটার নিচে। গ্রামের বাচ্চারা উৎসুক হয়ে দেখছে গাড়িটা ,সাহসী কেউ কেউ হাত দেয়ার চেষ্টা করছে ,গাড়ির ড্রাইভার বার বার ধমকে উঠছে,হাত তুলে মারতেও তেড়ে আসছে ,বাচ্চাগুলি অনেক মজা পাচ্ছে এই কর্মকান্ডে। নিমগাছটা থেকে ৩০ ফিট দূরে একটা টিউবওয়েল ওয়ালা ঝুপড়ী বাড়ী।বাড়ীর বাইরের উঠানে বড় একটা বাঁশ পোঁতা, বাঁশের মাথায় লাল কাপড় বাঁধা, বাঁশের গায়ে একটা ঢেউটিনে লাল রং দিয়ে কাঁচা হাতে লেখা “হুজুর খানা” । টিউবওয়েলের সামনে লম্বা লাইন, সবাই হাঁটু ভাঁজ করে পায়খানা করার ভঙ্গিতে বসে আছে, এক এক করে সবাই টিউবওয়েলে ওযু করছেন,একজন বলিষ্ঠ যুবক রবোটের মত একহাতে টিউবওয়েল চেপেই যাচ্ছে। জব্বার সাহেব লাইনে অনেক পেছনে , এইভাবে বসে থাকতে তাঁর অনেক কষ্ট হচ্ছে ,হাঁটু,কোমর ব্যাথায় মূখ কুঁচকে যাচ্ছে। তাঁর জন্যে তাঁর ড্রাইভার টুলের ব্যাবস্থা করেছিলেন, কিন্তু হুজুর খানার খাদেম বারবার কড়া ভাবে নিষেধ করেছেন “কেউ নিয়মের বরখেলাপ করবেন না, সবাই একইভাবে বসবেন, আল্লাহ্‌র চোখখে সবাই সমান,এখানে সবাই বিপদে আছেন, বিপদের সামনে ধনী গরীবের ভেদাভেদ নাই!” জব্বার সাহেবের ড্রাইভার ‘দিলু’ অনেক চেষ্টা করেছে টাকা পয়সা দিয়ে তার স্যারের সিরিয়াল এগিয়ে নেওয়ার জন্য লাভ হয়নি। জব্বার সাহেব ব্যাবসায়ী মানুষ,তাঁর অনেক ধরনের ব্যাবসা, খাবার হোটেল থেকে শুরু করে, সোনা,জমি সব ধরনের ব্যাবসাই তিনি করেন। তিনি জীবনে অনেক কষ্ট করে এত বড় ব্যাবসার মালিক হয়েছেন। ইদানিং তাঁর দৈনন্দিন সমস্যার সাথে যোগ হয়েছে কঠিন এক শারীরিক অস্বাভাবিকতা ,কোন এক অজ্ঞাত কারনে তাঁর পায়খানা দিয়ে বেগুনী একধরনের পদার্থ বের হচ্ছে, কিন্তু এতে তাঁর কোন শারীরিক সমস্যাও হচ্ছে না। ইন্ডিয়া-সিঙ্গাপুর তিনি করেছেন অনেক কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি , কেউ কিছুই বলতে পারছেনা,উল্টা তাঁরা জব্বার সাহেবকে নিয়ে গবেষণা করতে চেয়েছেন,তিনি রাজী হননি। এক কাছের বন্ধুর পরামর্শে তিনি এখানে এসেছেন, এখানকার যে পীর সাহেব আছেন তাঁর নাম নেয়া নিষেধ, সবাই তাকে “আব্বাজান” বলেই ডাকেন।জব্বার সাহেব শুনেছেন তিনি অলৌকিক ক্ষমতার আধার যা বলেন তাই ফলে যায়,জব্বার সাহেব ভক্ত গোছের লোক না, তাঁর টাকার কারবার, তিনি টাকায় বিশ্বাস করেছেন আজীবন, এখনও তাই করেন, তবুও টাকার বিনিময়ে যদি কেউ তাঁর এই অদ্ভূত সমস্যা দূর করে দিতে পারেন তবে তিনি রাজী আছেন। জব্বার সাহেবের পেছন থেকে তাঁর শার্টের হাতা কেউ একজন টানছে খেয়াল করে তিনি পিছনে তাকিয়ে দেখেন, একজন বাবরী চুল-দাড়িওয়ালা যুবক,গায়ে সাদা আল্লাখাল্লা, কালো ঠোট ,সাদা দাঁত। অমায়িক একটা হাসি দিয়ে বলল,
“স্যার ১০০টাকা ধার হবে?”
“না”
“স্যার আমি আপনাদের আব্বাজানের ভাতিজা।আচ্ছা ২০টা টাকাই দেন, আর বিরক্ত করব না।”
“বললাম তো হবে না” জব্বার সাহেব এবার কড়া চোখে দিলুর দিকে তাকালো, দিলু তেড়ে এসে লোকটাকে মারার ভঙ্গী করে বলল,
“এই দাড়িয়াল সর কইতেছি এইখান থিকা , দাড়ি রাইখা আবার ধান্দাবাজি!” লোকটা উঠতে উঠতে বলল,
“ক্যান! দাড়ি দেখলে কি আপনাগো চুলকায়? দাড়িওয়ালারা মানুষ না?”
প্রায় তিন ঘন্টা পর জব্বার সাহেব ওযু করার জন্য টিউবওয়েলের সামনে পৌছালেন,বলিষ্ঠ যুবক হাতটা বদল করে নিয়ে নির্বিকার মুখে টিউবওয়েল চেপে যেতে থাকল।জব্বার সাহেব ওযু করছেন, এমন সময় হুজুর খানার খাদেম এসে বললেন, “জনাব আপনার ওযু ভুল হয়েছে, আপনি বাম হাত আগে ধুয়েছেন ,আপনি ওযু আবার দোহরান, আমি দেখতেছি, ভুল করবেন না!” ওযু শেষ করে জব্বার সাহেব গেলেন হুজুর খানার ভেতরে, ভেতরে ঢুকে তিনি একটু অবাক হলেন, আব্বাজানের বয়স খুব বেশী না ১৭-১৮ বছর হবে, মূখে হালকা দাড়ি, দুধ সাদা গায়ের রং।সাদা পাঞ্জাবী পড়ে লুঙ্গির সামনের অংশ পোঁটলার মত করে নিয়ে বসে আছেন, পোঁটলার মধ্যে নতুন কচকচে টাকার নোট অনেক গুলি। আব্বাজান কে দেখে জব্বার সাহেবের কোনদিক থেকেই স্বাভাবিক বলে মনে হল না,তাঁর আচার- আচারন অনেকটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধি শিশুদের মত। আব্বাজান মাথাটা খনিকটা ঝাড়া দেয়ার মত করে জব্বার সাহেব কে জিজ্ঞেস করলেন “কি সমিস্যা? নুতুন নোট না পুরান নোট?পুরান নোট আমি লই না,ঘিন্না লাগে, ঘিন্না... ঘি...ন্না হাহাহাহাহ!” পাশ থেকে হুজুর খানার খাদেম বললেন, “কি সমিস্যা বলেন জনাব, আব্বাজানের কাছে কোন লজ্জা নাই,বলে ফেলেন।” জব্বার সাহেব লাজুক মূখে তাঁর সমস্যা বললেন, আব্বাজান শুনলেন বলে মনে হল না, আব্বাজান আবার বললেন, “নতুন নোট দিবি কিন্তু, পুরান নোট আমি লই না ঘিন্না লাগে।” পাশ থেকে হুজুরখানার খাদেম বললেন, “দেন নতুন নোট দেন ,পকেটে কিছু বাকী রাখবেন না, সব দিবেন।”
জব্বার সাহেব ১০০টাকার এক বান্ডেল নতুন নোট দিলেন, আব্বাজান খুশী হয়ে বললেন, “ভাল হবি যাহ্‌!”। জব্বার সাহেব হুজুর খানা থেকে বের হয়ে উঠানে দাঁড়ালেন একটা সিগারেট ধরাতে, অবাক হয়ে তিনি দেখলেন উঠান আর রাস্তাটা একটা বড় বিলের পাশে,যেটা তিনি এখানে আসার সময় খেয়াল করেননি। তিনি অনেকটা প্রশান্তি নিয়ে গোধূলি আলোয় লাল হয়ে যাওয়া বিলটা দেখতে থাকলেন,পেছনে থেকে হুজুরখানার খাদেম আজান দিচ্ছেন। গাড়ির দিকে চোখ দিতেই জব্বার সাহেব দেখলেন, আব্বাজান তাঁর লুঙ্গির পোঁটলা থেকে নতুন নোটগুলি বের করে ছোট বাচ্চাগুলির মাঝে বিলিয়ে দিচ্ছেন আর হা হা করে হাসছেন।
বাসায় ফিরে জব্বার সাহেব খাওয়া-দাওয়া করলেন।তিনি বাসায় একা থাকেন, দিলু থাকে নিচে ড্রাইভারদের রুমে। তাঁর খাবার আসে তাঁর নিজেস্ব হোটেল থেকে,বিগত নয় বছর তাঁর স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে এইভাবেই চলছে। খাবার শেষ হয়ে গেলে এক গ্লাস মদ আর একটা সিগারেট নিয়ে তিনি বারান্দায় আরাম করে বসলেন। আরাম চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে তিনি ছেলেমেয়ের চিন্তায় মগ্ন হলেন,কারন অবস্য তাঁর অসুস্থতা। তাঁর ছেলে লেখাপড়ায় ছোটবেলা থেকেই অনেক ভাল ছিল, বিয়ের পর বৌ নিয়ে সে বিদেশে চলে যায়, শ্বশুরবাড়ির লোকজন সবাই শিক্ষিত দেখে তাঁদের সাথেই তাঁর বেশী খাতির , আর ছেলের বৌ এবং তার বাড়ির লোকজন জব্বার সাহেবের সাথে বেশী মেলামেশা করেন না। জব্বার সাহেবের শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই দেখে তাঁরা তাকে এড়িয়ে চলেন। ছোট মেয়েকে তিনি খুব ভালবাসতেন,সেই মেয়ে তার প্রাইভেট টিউটর কে ভালবেসে বিয়ে করে। জব্বার সাহেবের সেই জামাই খাটাশ মার্কা, তাঁর মেয়েকে অনেক অত্যাচার করে , জব্বার সাহেবের কাছে আসতে দেয় না, মারধর করে,এমন কি নাতি-নাতনিদেরও তাঁর সাথে বছরে একবার-দুবার দেখা করতে দেয়। তাঁর মেয়েকে সে বহুবার বলেছেন তালাক দেবার কথা, মেয়ে রাজী হয়নি। জব্বার সাহেব প্রতিমাসে তাঁর মেয়ে কে টাকা পাঠায়,মাঝে মাঝে তাঁর মেয়ে নিজে আসে বড় অংকের টাকা নিতে,তার জামাই ব্যাবসা করবে বলে, জব্বার সাহেব প্রতিবারই বলেন এভাবে টাকা না নিয়ে তাঁর যেকোন একটা ব্যাবসা নিয়ে নিতে,জামাই রাজী হয় না , তাঁর মেয়ে একই ভাবে প্রতিবার এসে চোখের পানি ফেলে টাকা নিয়ে যায়। হঠাত লোডশেডিং হল, জেনেরেটর চালু হয়েছে,দিলু খাবার তুলে নিচে চলে গেছে অনেক আগে, বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে, জব্বার সাহেবের উঠে গিয়ে চেঞ্জ ওভার সুইচ চেঞ্জ করতে ইচ্ছা করছে না। তিনি বসে থাকলেন চুপচাপ।কিছুক্ষন কেটে যাওয়ার পর জব্বার সাহেব দেখেলেন তাঁর পাশের দরজা দিয়ে কেউ একজন বারান্দায় ঢুকে এক কোনায় গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসল। এই সময় বাসায় কারও থাকার কথা না,জব্বার সাহেব একটু ঘাবড়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন,
“কে ?”
“স্যার আমি, আপনাদের আব্বাজানের ভাতিজা, ২০টা টাকাই দেন আর বিরক্ত করব না।”
জব্বার সাহেবের গায়ের রক্ত হিম হয়ে এল, পেটের মধ্যে একটা হালকা পাক দিয়ে তাঁর পায়খানার বেগ চাপল।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.