নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

\'আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের\'

যাযাবর জোনাকি

‘আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানে একটা দেয়াল আছে, এর একদিকে থাকে চাওয়া,আর একদিকে পাওয়া। মুখ্য সমস্যা হল দেয়ালটা স্বচ্ছ কাঁচের’

যাযাবর জোনাকি › বিস্তারিত পোস্টঃ

শাপ (গল্প)

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:১০


১৩৫৭সালে যখন ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রথম ব্যাধি হিসাবে চিহ্নিত হল,তখন ভারতের মারওয়ারে, রাথোরদের রাজা হলেন 'রাও কানাহদেব'। সে বছর ছিলো বাংলার স্বাধীন শাসনকর্তা শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ'র শাসনকালের শেষ বছর। আর সেই বছরেই শীতকালে গঙ্গার বুকে নেমেছিল ঘন কুয়াশার সাদা চাদর। একটা ভাড়াটে ঘাসিনৌকা এক পাল তুলে তীর বেগে,গঙ্গার বুক চিরে ছুটে চলে ছিলো 'লখনৈতি' থেকে 'সোনার গাঁ'র উদ্দেশ্যে। যাত্রী একটা গানেরদল আর মাঝিমাল্লা সমেত মোট ১৪জন। মাঝপথে 'ঝাড়খণ্ডে'র কাছাকাছি একটা জঙ্গলের কাছে এসে নৌকার গতি একটু কমে গেল। গানেরদল সারাদিন গানবাজনা করে ক্লান্ত। তখন গোধূলি বেলা,হাল হাতে মাঝি করুণ সুরে একটা গেঁয়ো গান ধরেছে। গানের মাঝে রাধাকৃষ্ণ বিচ্ছেদের জ্বালা। গানের মাঝখানে হঠাৎ সে মাঝি বৈঠা দিয়ে তিনবার টোকা দিল নৌকার পাটাতনের ওপর। এরপর মূহুর্তের মধ্যে ভোজবাজীর মত যাত্রী সমেত নৌকা যেন ঘন কুয়াশার সাদা চাদরের মাঝে মিলিয়ে গেল,আর দেখা গেল না কোথাও।

১৮০৫ সালের ডিসেম্বর মাস। যখন নেপোলিয়ন বাহিনীর কাছে রুশো-অস্ট্রিয়ান বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় হল, তখন গঙ্গার তীরে নিমতিতা ঘাটে শীত একেবারে জেঁকে বসেছে। সকালবেলা কালীচরণ একটা লাল চাদর মুড়ি দিয়ে দাওয়ায় বসে আছে। কাল রাতের স্বপ্নটা তাকে এখনো আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার বৌ ছেলেমেয়ে দুটিকে খাওয়ার দিচ্ছে,সে শূন্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে । কাল রাতে মা তার স্বপ্নে এসেছিলেন প্রথমে একটা বাচ্চা মেয়ের রুপ ধরে। কি সে তার রুপ, মিশমিশে কালো গায়ের রঙ, ডাগরডাগর তার চোখ, পাতলা চিকন তার ঠোঁট। কাছে এসে বলে, "কি রে! এত বেলা করে শুয়ে আছিস, ওঠ, আমায় খেতে দিবি না?" কালীচরণ চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, "কে রে মা তুই?" অমনি মা স্বরূপে ফিরে তার লকলকে রক্ত মাখা জিহ্বা বের করে হাসতে হাসতে বলল, "দেখ আমার অবুঝ ছেলের কাণ্ড! এই মা বলে ডাকলি আবার জিজ্ঞেস করছিস আমি কে?"। কালীচরণ কান্নায় ভেঙে পড়ল, "আমার ভুল হয়ে গেছে মা, মা গো, আমায় তুই ক্ষ্যামা কর মা, আমায় তুই ক্ষ্যামা কর!" মা স্নেহভরে তার মাথায় হাত দিয়ে বলল, "হয়েছে, নে এবার ওঠ দেখিনি , আমায় খেতে দিবি চ।অনেক দেরি হয়ে গেল যে!"। স্বপ্নের কথা ভেবে কালীচরণ আবারও ডুকরে কেঁদে উঠল। তার বৌ,ছেলেমেয়ে তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। সত্যিই অনেক দেরি হয়ে গেছে। অগ্রহায়ণমাস শেষ হতে চলছে অথচ কালীচরণ এখনো ঘরে বসে আছে, পিঠেপুলি খাচ্ছে। আর ঐদিকে মায়ের ভোগে কিচ্ছু নেই।
নারায়ণগঞ্জ থেকে কানপুর পর্যন্ত কালীচরণের বাগ,গেল বছর পুরা বাগে কিছুই মেলেনি, একেবারে কানপুর অবদি গিয়েছে সে। শীত শেষে খালি হাতে ফিরেছে কালীচরণ। এবার আর তেমন হবে না, এবার বর্ষায় কালীচরণ নদীর ওপারের ঘন জঙ্গলটায় গিয়েছিল তার ঘাসিনৌকাটা লুকানোর জন্য একটা জায়গা দেখতে। নদী থেকে একটা খাঁড়ি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেছে। কালীচরণ আগে কোনদিন এদিকটায় আসেনি, সাধারণত এদিকে মানুষ খুব একটা আসেনা।জঙ্গলের একটু ভিতরে যেতেই কালীচরণ খেয়াল করল একটা জায়গায় অনেক গুলি রক্ত জবার গাছ,গাছে গাছে ফুল ধরে জায়গাটা লাল হয়ে আছে। যেন অযত্নে পড়ে থাকা একটা ফুলের বাগান ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়েছে।একটু কৌতূহলী হয়ে কালীচরণ ঝোপঝাড় সরিয়ে আরও ভেতরে যেতেই দেখতে পেল ঝোপঝাড়ের মধ্যে অতিপ্রাচীন কালো পাথরের তৈরি সিদ্ধকালীর মূর্তি, দক্ষিণহস্তে ধৃত খড়্গের আঘাতে চন্দ্রমণ্ডল থেকে নিঃসৃত অমৃত রসে প্লাবিত হয়ে বামহস্তে ধৃত একটি কপালপাত্রে সেই অমৃত ধারণ করে পরমানন্দে পানরতা। তার বামপদ শিবের বুকে ও ডানপদ শিবের উরুদ্বয়ের মধ্যস্থলে সংস্থাপিত আর সামনে একটা হাঁড়িকাট । দীর্ঘ সময়ের অযত্নে আর অবহেলায় জীর্ণদশা তার। অবাক কালীচরণ এক মূহূর্ত দেরি না করে ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল মা কে,তারপর লেপেপুছে পরিষ্কার করলো বেদী খানা। রক্ত জবা ফুলের মালা পরিয়ে দিল মার গলায়। তারপর থেকে এখানে কালীচরণ নিজেই প্রতি অমাবস্যায় এবং প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবারে পূজা দেয়। কালী মায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত সে। মা তার ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে আশীর্বাদ করেছে, তার কাছে চলে এসেছে। আর সে কিনা মায়ের ভোগ দিতে দেরি করছে! আজ অমাবস্যাতিথি, আর দেরি না করে কালীচরণ চোখমুছে ঘরের ভেতরে গেল,টাকাকড়ি যা ছিলো তাই নিয়ে সে না খেয়েই বেরিয়ে গেল হাটের উদ্দেশ্যে। সে মনেমনে ঠিক করল এবার মায়ের ভোগে কিছু না দেয়া পর্যন্ত , মুখে কোন খাবার তুলবে না।

সন্ধ্যার দিকে সুবল হাট থেকে কিছু বেচাকেনা করে বাড়ির দিকে ফিরছিল। সে দেখল তার বড়দা কালীচরণ একটা কালো পাঁঠা ঘাড়ে করে নিয়ে ঘাটের দিকে হনহনিয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখে কালীচরণ দূর থেকেই বলল,
"সুবল! জলদি বাড়ি যা, সিঁদুর আর খাঁড়াটা নিয়ে আয়। আমি নাওয়ে আছি, জলদি আয়। "
সুবলের বুঝতে আর কিছু বাকি রইলো না। সে এক দৌড়ে বাড়িতে গেল, বাজার সদাই কোনরকমে বৌদির হাতে দিয়েই, খাঁড়া আর সিঁদুর নিয়ে ঘাটের দিকে দৌড় দিল। ঘাটে কালীচরণ তার ডিঙিতে পাঁঠা নিয়ে বসে অপেক্ষা করছিল সুবলের জন্য।সে আসতেই, তারা তাড়াতাড়ি ডিঙি নিয়ে রওনা হল নদীর ওপারে জঙ্গলের দিকে। খাঁড়ির ভেতর ঢুকে ডিঙি সোজা চলল আরও ভেতরের দিকে। অন্ধকার নেমে এসেছে, একটা পেঁচা ডান থেকে বাম দিকে উড়ে যেতে দেখে সুবল দাদার দিকে ইশারা করে বলল,"লক্ষণ শুভ দেখা যায় দাদা!"। কালীচরণ নৌকা বাইতে বাইতে বলল, "শুধু ফাঁকা ডালে কাক না ডাকলেই হয়!"। প্রচণ্ড ঠান্ডা আর কুয়াশা নামতে শুরু করল, শুন্য ডালে কোন কাক আর ডাকলো না। জায়গা মত এসে তারা দুইজনেই নামলো ডিঙি থেকে। সুবল একটা গাছের সাথে ডিঙিটা বেঁধে, খাঁড়ায় শান দিতে লাগলো। কালীচরণ চাদর,জামা,ধুতি খুলে, শুধু একটা গামছা পরে নিল, পাঁঠাটা কে খাঁড়ির পানিতে ভালভাবে স্নান করালো। তারপর ওটাকে পাঁজাকোলা করে চালান দিলো সুবলের হাতে। এরপর নিজে সাতবার ডুব দিয়ে স্নান করে ভিজা গায়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠল ডিঙিতে, ডিঙিতে রাখা নতুন সাদা ধুতিটা একবার ঝেড়ে নিয়ে পরে ফেলল সে,ভিজে গামছাটা ভালভাবে চিপে নিয়ে ফটফট করে ঝেড়ে গা মুছে নিল। ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে সে। ভিজে গামছাটা গায়ে জড়িয়ে খাঁড়া আর সিঁদুর হাতে কালীচরণ এগিয়ে গেল হাঁড়িকাটের দিকে। সুবল পাঁঠাটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে হাঁড়িকাটের সাথে, গলায় একটা রক্তজবার মালা পরিয়েছে। কালীচরণ এসে পাঁঠার মাথায় সিঁদুর লেপ্টে দিল। তারপর ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল মা কে,
"জয়ন্তী মঙ্গলা কালী সিদ্ধ কালী কপালিনী দূর্গা শিবা সমাধ্যার্তী সাহা সুধা নমস্তুতে।।"
এবার অপেক্ষার পালা, পাঁঠা যখন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকবে তখন মোক্ষম সময় বলি দেওয়ার।কালীচরণ খাঁড়া হাতে বিড়বিড় করে কালী মন্ত্র জপতে থাকলো আর সুবল উবু হয়ে বসে অপেক্ষা করতে থাকলো।

কয়েক ঘন্টা পার হয়ে গেল, পাঁঠাটা দুইবার গা ঝাড়া দিয়ে, গায়ের পশম ফুলিয়ে হাঁটু ভাজ করে দিব্যি বসে আছে। সুবল বলল,
"দাদা,গেরস্থালী পাঁঠা, মানুষ কাছে থাকলে ভয় পাবে না, চল আমরা নাওয়ের দিকে গিয়ে বসি। "
কালীচরণ সুবলের কথায় শুধু মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল,তারপর দুজন মিলে ডিঙির দিকে গিয়ে বসল। সুবল পুরা ব্যাপারটায় বেশ উত্তেজিত, সে এ বছর তুপোনির গুড় মুখে তুলেছে। সব ঠিকঠাক থাকলে মার কৃপায় এবার হবে তার প্রথম বাগে বের হওয়া। কালীচরণ মন্ত্রজপে যাচ্ছে। দূর থেকে পাঁঠার চেঁচান শোনা যাচ্ছে। ঝিরিঝিরি নীহার পড়তে শুরু করেছে, ঠান্ডা বাড়ছে। সুবল হাত দিয়ে কালীচরণ কে ইশারা করল। দুজনেই উঠে গেল পাঁঠার কাছে, পাঁঠা জোরে চেঁচাচ্ছে আর ঠকঠক করে কাঁপছে। কালীচরণ সুবলকে ইশারা করতেই সুবল "জয় মা কালী " বলে পাঁঠাটাকে হাঁড়িকাটে ঢুকিয়ে দিল। কালীচরণ গা থেকে গামছাটা গলায় ঝুলিয়ে, খাঁড়া হাতে প্রস্তুত হল। এরপর খাঁড়া উঁচিয়ে, চোখবন্ধ করে উচ্চস্বরে মন্ত্র পড়তে লাগল,
" ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ হূঁ হূঁ হ্রীঁ হ্রীঁ দক্ষিণে কালিকে ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ হূঁ হূঁ হ্রীঁ হ্রীঁ স্বাহা,
ক্রীঁ,
হ্রীঁ,
ওঁ হ্রীঁ হ্রীঁ হূঁ হূঁ ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ দক্ষিণে কালিকে ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ হূঁ হূঁ হ্রীঁ হ্রীঁ,
ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ স্বাহা
ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ ফট্‌ স্বাহা,
ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ হূঁ হ্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ হূঁ হ্রীঁ স্বাহা,
ঐঁ নমঃ ক্রীঁ ঐঁ নমঃ ক্রীঁ কালিকায়ৈ স্বাহা,
ক্রীঁ ক্রীঁ হ্রীঁ হ্রীঁ দক্ষিণকালিকে স্বাহা।
গায়েত্রী ওঁ কালিকায়ৈ বিদ্মহে শ্মশানবাসিন্যৈ ধীমহি। তন্নো ঘোরে প্রচোদয়াৎ ওঁ।"
পাঁঠাটি এবার তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, ওটা এতক্ষনে বুঝে গেছে কি হতে যাচ্ছে। মন্ত্র শেষ হতেই কালীচরণ গায়ের সব শক্তিদিয়ে দিলো এক কোপ। পাঁঠার ধর থেকে মাথা আলাদা হয়ে গেল,আর তৎক্ষণাৎ সহস্র বছরের আদিম এক নিস্তব্ধতা যেন জঙ্গলটার টুঁটি চেপে ধরল।
কালীচরণ হাতে কিছু রক্ত মেখে সেটা মায়ের পায়ে ছোঁয়াল, তারপর নিজের এবং সুবলের মাথায় তিলক কাটল, গামছা দিয়ে একবার মাথা আর মুখ মুছে নিল। সারাদিন না খেয়ে ক্ষুধায় ক্লান্ত সে। ক্ষুধার্ত কালীচরণ সুবল কে বলল,
"যা, নাও থেকে কাসসিটা নিয়ে আয়, মুণ্ডুটা মাটিতে এক হাত গব্বা করে পুঁতে দে, ওটা কুকুর শেয়ালের মুখে গেলে অমঙ্গল হবে। " সুবল ডিঙি থেকে একটা ছোট কোদাল নিয়ে এসে মাটিতে একটা গোলাকার একহাত গভীর গর্ত করলো, তারপর তাতে পাঁঠার মাথাটা রেখে ভালভাবে মাটিচাপা দিয়ে দিল। কালীচরণের মাথা ঝিমঝিম করছে। সুবল পাঁঠার মুণ্ডুহীন দেহটা কাঁধে নিয়ে ডিঙিতে গিয়ে উঠল। পাঁঠার নিথর দেহটা ডিঙিতে নামিয়ে রেখে, সেই ডিঙি বাইতে শুরু করল। কালীচরণ ঝিম মেরে ডিঙিতে বসে রইল,দলের সবাইকে খবর দিয়েছে সে। আজ রাতেই ভোজ হবে।

বাড়ি ফিরে কালীচরণ দেখলো বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরে উঠানে উবু হয়ে বসে আছে বখতিয়ার। গুরু কে দেখে বখতিয়ার দুহাত জোড় করে প্রানাম করল,"জয় মা কালী", তারপর সে সুবলের কাঁধ থেকে পাঁঠাটা নামিয়ে রাখলো একটা বড় কলা পাতার ওপর। ওদিকে ধলাকে দেখা গেল চুলো জ্বালতে, আর বলরাম চাল ধুয়ে ভাতের হাড়িতে দিচ্ছে। রাত ধীরেধীরে বাড়ছে, এক এক করে দলের সবাই আসতে শুরু করেছে। কালীচরণ দাওয়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে , এখনো অনেক কাজ বাকি। পাঁঠাটা কেটেকুটে পরিষ্কার করে কালীচরণকেই রান্না করতে হবে নিজ হাতে,সাথে রান্না করবে আতপচালের ভাত। দলের সবার পাতে সে ভোগ তুলে দিবে নিজ হাতে, তারপর সে খেতে বসবে।
পাত পেড়ে কালীচরণ সহ দলের আর সবাই যখন খেতে বসেছে তখন মধ্যরাত। কালীচরণ খেতে খেতে দলের সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। সুবল, ধলা, বলরাম, বখতিয়ার, রমা, উমানাথ, রাখাল, দেবু সবাই আছে। প্রত্যেকের কাজ ভাগ করা আছে। এদের মধ্যে ধলা আর রমা সোথার, ওরা নৌকায় থাকে যাত্রীবেশে, যাত্রীদের বিশ্বাস অর্জন করাই ওদের কাজ। বলরাম লুগহা, সে বাহরাদের জন্য নিসার খোঁড়ে। বখতিয়ার কুযাওয়া, সে বাহরাদের পেটে,বুকে ছুড়ি চালিয়ে নিসার পাকা করে, যাতে বাহরা ফুলে উঠে নিসার ভেঙে না বের হয়। সুবল,উমানাথ, রাখাল,দেবু এরা ভুকোত মাঝী। কালীচরণ দলের সর্দার। সাবার গুরু সে।খাওয়া শেষ করে সবাইকে নিয়ে রীতি অনুযায়ী একটা আগুনের চারদিকে গোল হয়ে বসলো কালীচরণ,
"এই ভোগ মুখে তোলার পর সাত দিন কেউ আমিষ খাবে না, চুল দাড়ি কাটবে না। আর বাজিত খান না হওয়া পর্যন্ত কেউ কোন প্রকার রক্তপাত করবে না।এই মায়ের আদেশ। সাতদিন পর পাঁঠার মুণ্ডু তুলে তবে যাত্রা শুরু করব। এর মাঝে মা আমাকে বিয়াল বলে দেবে। এবার সুবলের পয়লা,ওই শুধু পেলহু দিবে। আর সবকিছু ভাল করে লক্ষ করবে। উমানাথ তুই তিলহাই কে খবর দিয়ে রাখিস।আর পরশু একবার সুবল,রাখাল,দেবু কে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যেই ঘাসিনৌকাটা ঠিকঠাক করবি, কেউ যেন দেখতে না পায়। " উমানাথ কেবল মাথা নাড়ল।কালীচরণ সভা ছেড়ে উঠে গিয়ে দাওয়ায় চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।বাকিরা হাত সেকে, তামুক খেয়ে গল্প করতে লাগলো,আজ রাতে সবাইকে সর্দারের বাড়িতেই থাকতে হবে। শীতের রাত, চারিদিকে পিনপতন নিরবতা ভেঙে শেয়াল ডাকছে।এর মধ্যে গুনগুন করে গল্প ধরল উমানাথ, নিবিষ্ট শ্রোতা সুবল আর দেবু। দলে এরা নবীন।কিন্তু উমানাথের গল্প অতি প্রাচীন,
"তখন ঘোর কলিকাল, চারদিকে অসুরদের রাজত্ব চলছে, অনাচার চলছে, এমন সময় মা কালী স্বরুপে ধরায় এল। অসুরদের সাথে মা কালীর তুমুলযুদ্ধ শুরু হল , মা যতবার খাঁড়া চালাচ্ছে ততবার অসুরদের প্রতি ফোঁটা রক্ত থেকে জন্ম নিচ্ছে আরও সহস্র অসুর। তখন মা খাঁড়া চালানো বন্ধ করে,তার ঘাম থেকে জন্ম দিল ঠগীদের, আর তার সন্তানদের হাতে তুলে দিল নিজের পেলহু। পেলহু হাতে ঠগীরা অসুরদের গলায় ফাঁস দিয়ে, দম বন্ধ করে মারা শুরু করল। কোন রক্তপাত হল না। চোখের নিমিষে সব অসুর শেষ। সেই যে মার পেলহু ঠগীরা হাতে নিয়ে খুন করতে নামল, আজও তারা সেই কাজ চালিয়েই যাচ্ছে। ঠগীরা মা কালীর সন্তান। মা কালীর সন্তুষ্টির জন্যই তারা খুন করে। "

কালীচরণ কাশির দশাশ্বমেধ ঘাটে ঘুমিয়ে আছে।গঙ্গার ঠান্ডা বাতাসে তার শীত শীত করছে। তার পুরোপুরি ঘুম যখন ভাঙল,তখন ভোররাত। ঘাট কেন জানি সম্পূর্ণ ফাঁকা। কালীচরণ উঠে বসে গায়ে চাদরটা ভালভাবে জড়িয়ে নিলো। এরপর হাত মুখ ধুতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। দুইহাতে পানি সরিয়ে পানি পরিষ্কার করে যেই সে মাথা নিচু করে আঁজলা ভরা পানি তুলতে যাবে, অমনি নদীর তলা থেকে তার মুখ বরাবর একটা কাগজের মত সাদা রক্তশূন্য মৃত চেহারা ভেসে উঠল। একজন বিধবা যুবতীর লাশ।পরনের সাদা থানের আচল, মাথার এলোকেশ ঘাটের পানিতে পদ্মফুলের মত ভেসে আছে। কালীচরণ চমকে উঠে "মা গো!" বলে পেছনে দুইধাপ উপরে উঠে এলো। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন তার গলায় গামছার ফাঁস পড়িয়ে , কাঁধে পা চাপা দিয়ে, শক্তি দিয়ে গামছা টেনে ধরল। কালীচরণের চোখ, জিহ্বা দুটোয় ঠিকরে বের হয়ে আসছে। সে মুখ দিয়ে গোগো শব্দ করছে। এমন সময় তার পাশে স্বয়ং মা কালী এসে বসল,মুখ গোমরা করে বলল, "এবার আর বর্ধমান যাসনে, পিছে ডনকি-রনকি লেগেছে! সাবধানে বিয়াল দিবি ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে, আর ফিরে এসে আমার মাথার উপর চালা দিস , শীতে-গরমে অনেক কষ্ট হয়। " কালীচরণ কথা বলতে পারছে না, দুইহাতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে ফাঁস ছাড়ানোর, সেটা খুলছে না, পাকা ঠগির ফাঁস,পেছন থেকে আওয়াজ এল "বাজিত খান!"। কালীচরণের ঘুম ভেঙে গেল। শেষরাত, উমানাথ সুবল কে হাতে কলমে শিখাচ্ছে কি করে গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে শ্বাসরোধ করতে হয়,উদাহরণ দেবু "পয়লায় পেলহুর একপাশে ছোট পাথর নিয়ে গিঁট দিবি শক্ত করে, পেলহু তৈরি। এরপরে এটা মাজায় এভাবে বেঁধে রাখবি, যাতে ঝিরনী উঠলে একটানে খুলে যায়। এবার পেলহু হাতে নিয়ে নিশানার গলা বরাবর তাক করে এইভাবে চালাবি, ফাঁস লেগে গেল!এখন সাথে সাথে দেরি না করে এইভাবে এক হেঁচকা টান পেছনের দিকে, খবরদার, টান দেয়ার সময় খেয়াল রাখবি গলা যাতে মটকে না যায় আবার ফাঁসও যাতে হালকা না হয়। এবার ডান পা জয় মা কালী বলে নিশানার ডান ঘাড়ে রেখে সামনের দিকে ঠেলা দিবি,খেয়াল রাখবি ঘাড় যাতে মটকে না যায়। এই একভাবে ধরে রাখবি, হাত একটুও নড়বে না, যতক্ষণ না প্রান পাখি বের হয়ে যায়, খবরদার ধস্তাধস্তি করবি না,মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হবেনা। তারপর সর্দার যখন বলবে 'বাজিত খান'! তখন ফাঁস খুলে নিবি। কাজ হবে বিজলীর ঝলকের মত। " কালীচরণ একটু নড়েচড়ে বসল। সে ঘুম থেকে উঠেছে দেখে সবাই তার দিকে তাকাল।
"এবার সরাসরি কাশি যাব,মা স্বপনে এসেছিল, বর্ধমান যেতে বারণ করেছে।ফিরে এসে মায়ের মন্দির গড়ে দিতে হবে। " কালীচরণ বাদবাকি টা আর সবাই কে বলল না। উমানাথ আনন্দের সাথে বলল,"জয় মা কালী! পথের দিশা তো দিলি, মা!" ভোরের আলো ফোটবার আগেই সবাই এক এক করে বের হয়ে গেল,থেকে গেল শুধু সুবল আর কালীচরণ।

নদীর ওপারে জঙ্গলের ভেতর, সকাল থেকে গুড় মুড়ি আর খেজুরের রস খেয়ে ঘাসিনৌকা মেরামতের কাজে নেমেছে সুবল,দেবু, রাখাল, উমানাথ। কালীচরণ কাজ তদারকি করছে।যাত্রা শুরুর আগে সে নিজে নৌকার সবকিছু পরীক্ষা করে দেখতে চায়, পাল সেলাই,হাল মেরামত, আলকাতরা দেয়া, পাটাতন মেরামত, ছৈ এর ফুটো আছে কিনা, নতুন বইঠা বানানো। উমানাথ গুনগুন করে গান গাইছে আর হাত চালাচ্ছে,
"আরে ও কলসি কাঁখের নারী
সোনার যৌবন হেইলে পড়ে
বদন ভিজা শাড়ি
একা কেন এইলে ঘাটে নবীন কিশোরী
যদি কোনো সওদাগরে
তোমায় করে চুরি।"
সুবল জঙ্গল থেকে খড়িপাতা কুড়িয়ে নিয়ে এসে চুলা জ্বেলেছে, দুপুরের খাবার ব্যাবস্থা করছে,খাবার ভাত,ডাল, আলুভর্তা। উমানাথের গান শুনে সুবল মুচকি মুচকি হাসছে আর রান্না করছে। কালীচরণ দড়ি পাকাতে পাকাতে ব্যাপারটা লক্ষ করলো। তারপর মশকরার সুরে বলল,
"ও সুবল! এবার বাগ থেকে ফিরে, একখানা কচি মেয়ে দেখে তোর বিয়ে দিলে কেমন হয় রে? "
সবাই একসাথে জোড়ে হেসে উঠল, উমানাথ এবার সুবলের সামনে এসে ঠুমকা নেচে আরও জোড়ে গান করতে লাগলো,
" বাঁশি বাজে বাজে রইয়া রইয়া
গৃহে যাইতে মন চলে না প্রাণ বন্ধুরে থইয়া....আহা!"
পাশ থেকে রাখাল হেসে বলল, " অসব কথা বলে লাভ নেই, ঠগি ফাঁসুড়ে কে কেউ মেয়ে দিবে না গো!"
উমানাথ কপট ধমকে বলল,"আরে ওই...ঢেমনা! আমাদের কে কেউ মেয়ে দেয়নি? আমরা কি তোর ঢেমনির সাথে ঘর করছি রে ! " এবার সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিল,কারন সবাই জানে রাখালের গ্যাঞ্জেল ঘাটে কসবীর কথা।

অমাবস্যাতিথির সাতদিন পর, এক শীতের দুপুরবেলা কালীচরণ, সুবল আর উমানাথ নদীর ওপারে জঙ্গলে গেল। কালীচরন প্রথমে কালী মা কে ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল,
"জয়ন্তী মঙ্গলা কালী সিদ্ধ কালী কপালিনী দূর্গা শিবা সমাধ্যার্তী সাহা সুধা নমস্তুতে।।" এরপর সুবলকে নির্দেশ দিল পাঁঠার মাথাটা মাটি খুঁড়ে বের করে দেখার জন্য যে ওটা যায়গা মত আছে কি না। সুবল কাসসি দিয়ে খুঁড়ে পাঁঠার মাথার কংকালটা বের করে আনল। সব ঠিকঠাক আছে, এখন পর্যন্ত যাত্রা শুভ। কালীচরণ একটা লাল কাপড়ে পাঁঠার মাথাটাকে মুড়িয়ে নিয়ে ঘাসিনৌকার দিকে এগোল।শেষবারের মত কালীচরণ নৌকার সব কিছু পরীক্ষা করে দেখতে চায়।সব ঠিকঠাক আছে, কালীচরণ কে দেখে তবুও উদাস মনে হল। উমানাথ ব্যাপারটা লক্ষ করে কালীচরণ কে বলল,
"সব ঠিক আছে তো সর্দার? "
কালীচরণ উমানাথের কাঁধে হাত রেখে বলল,
"কাল খুব ভোরে, আলো ফোটার আগেই গঙ্গায় নামবে ঘাসিনৌকা, তারপর আলো উঠলে যাত্রা শুরু। জয় মা কালী!" সুবল, উমানাথ একসাথে বলে উঠলো
"জয় মা কালী!"

শেষরাত, বাচ্চাকাচ্চা ঘুমে ক্যাদা। কালীচরণ তার বৌয়ের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে, ঘরের বাইরে সুবল অপেক্ষা করছে। প্রথম কয়েক দিনের রসদ বস্তায় ভরে নিয়েছে সে। কালীচরণ বৌয়ের হাতে কিছু পয়সা দিয়ে বলল,"বিপদে খরচ করিস " বৌয়ের কাছে বিদায় নিয়ে কালীচরণ ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল,তার হাতে লাল কাপড়ে মোড়ানো বলির পাঁঠার মাথা। সুবল আর কালীচরণ দুজনে তাদের ডিঙিতে করে ওপারের জঙ্গলে ঘাসিনৌকাটার কাছে পৌছাল। উমানাথ, রাখাল, বলরাম, বখতিয়ার আর দেবু সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলো। কালীচরণ মায়ের পূজো দিয়ে ঘাসিনৌকাটায় উঠলো, লাল কাপড় মোড়া পাঁঠার মাথাটা নৌকার হালের কাছে রখে, করজোড়ে হালকে প্রণাম করলো, তারপর শক্তকরে হাল ধরে চিৎকার করে বলল,"জয় মা কালী!" সাথেসাথে বাকি সবাই "বদর বদর " বলে ঘাসিনৌকাটাকে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলতে লাগলো। ঘাসিনৌকাটা একটা অলস সরীসৃপের মত যেন শীতনিদ্রা ভেঙে দুলকি চালে এগোতে থাকলো গঙ্গার দিকে।
ভোরের প্রথম আলোয় গঙ্গার বুকে আগুন জ্বলেছে। খাঁড়ি পার হয়ে ঘাসিনৌকাটা গঙ্গায় নেমেছে। উত্তরা বাতাসে নৌকার পাল ফুলে উঠেছে, নৌকা গঙ্গা নদীর বুক চিরে এগিয়ে চলেছে ঝাড়খণ্ডের দিকে। নৌকায় বৈঠা বাইছে, সুবল,রাখাল, দেবু, বলরাম। বখতিয়ার পালের দায়িত্বে, উমানাথ, কালীচরণ হাত বদল করছে হালে। রমার যাত্রী বেশে নৌকায় ওঠবার কথা মুঙ্গের থেকে, আর ধলা দুদিন আগেই কাশি চলে গেছে, সে উঠবে কাশি থেকে। কাশি থেকে যাত্রী বাগানোর দায়িত্ব ধলার।

ঘাসিনৌকাটি একটানা চলল ঘন্টা তিনেক। ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলটা হাতের ডানে রেখে নৌকা এগোচ্ছে । হালে বসে আছে কালীচরণ, জঙ্গল দেখে একটা যায়গা তার পছন্দ হল। সে হাক ছেড়ে মাঝীদের উদ্দেশ্যে বলল, "রোখকে! রোখকে!"। মাঝীরা থেমে গেল। কালীচরন হাল উমানাথের হাতে দিয়ে উঠে এল। তারপর সবাইকে বলল,"মা বলেছে বিয়াল হবে ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে। বলরাম আর বখতিয়ার তোরা গিয়ে নিসারের যায়গা পাকা করে আয়। যাহ্‌। " বলরাম, বখতিয়ার দেরী না করে নদীতে ঝাপ দিল। ঘাসিনৌকাটা ধীরেধীরে মাঝ নদীতে ভেসে বেড়াতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ পর বখতিয়ার, বলরাম দুইজন সাঁতরে গিয়ে জঙ্গলে উঠলো।আবার কিছুক্ষণ পর দুইজন জঙ্গল থেকে বের হয়ে এল। বখতিয়ার নদীর ধার ঘেঁষে একটা লম্বা অর্জুন গাছ দেখে তাতে বানরের মত পাইপাই করে উঠে একটা উঁচু ডালে তিন টুকরা লাল কাপড় বেধে দিল।এর মানেই নিসার অর্থাৎ কবরের যায়গা পাকা হয়েছে, এর আশেপাশেই ঠিক করতে হবে বিয়াল অর্থাৎ খুনের যায়গা।

তখন মধ্য দুপুরবেলা, ঘন্টা চারেক পর ঘাসিনৌকাটা কেবল ভাগলপুর পৌঁছেছে। কালীচরণ নৌকা ঘাটে ভিড়ানোর আদেশ দিল। একটু ফাঁকা যায়গা দেখে নোঙর ফেলে নৌকা ঘাটে বাধা হল। সুবল ঘাটে একটা গাছতলা দেখে সেখানে চুলা জ্বালিয়ে রান্নার ব্যাবস্থা করছে। আসার পথে বখতিয়ার কিছু মাছ মেরেছে, পাবদামাছ । দুপুরের খাবার হবে পাবদামাছের ঝোল আর ভাত। বখতিয়ার মাছ কেটে ধুয়ে পরিষ্কার করছে। বাকি সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে। উমানাথ আর কালীচরণ নৌকার পাটাতনের ওপর গায়ে সরিষার তেল মেখে বসে রোদ পোহাচ্ছে আর বাঘবন্দি খেলছে,আসলে তারা চারিদিকে নজর রাখছে। বর্ধমানের দল অথবা ডনকি-রনকি অর্থাৎ পুলিশের ফেউ তাদের পিছু নিয়েছে কিনা সে ব্যাপারে তারা খুব সাবধান। বেলা পড়ে এলে সুবলের রান্না হয়ে গেল। সবাই নদীতে স্নান সেরে নৌকার ভেতরেই খেতে বসলো। কালীচরণ খেতে খেতে বলল, "জলদি করার দরকার নেই, আজরাত আমরা মুঙ্গেরেই নোঙর ফেলব। খাওয়া শেষ করে বিশ্রাম নিয়ে, বিকেলের আগ দিয়ে নাও ছাড়লেই হবে, সন্ধ্যে নাগাদ মুঙ্গের।" সবাই একসাথে ঘাড় কাত করে খাবার গতি বাড়িয়ে দিল। দুপুরের খাওয়া শেষে কালীচরণ পান মুখে দিয়ে, সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে, গায়ে চাদর মুড়ি দিলো । মাঝিরা সবাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। উমানাথ হালের কাছে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে রোদ পোহাচ্ছে আর গুণগুণ করে গান গাইছে। তার হাতে একটা পাখির পালক, সেটা দিয়ে সে মনের সুখে চোখ বুজে কান চুলকাচ্ছে। কালীচরণের চোখের পাতা ভারী হয়ে এল। একসময় সে ঘুমিয়েও গেল, ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে সে দেখল, মা কালী একটা ফুলোডরে বাধা দোলনায় বাচ্চাদের মত হেসে হেসে দোল খাচ্ছে, কালীচরণ দোল দিচ্ছে। বিকালবেলা নৌকা ছেড়ে গেল মুঙ্গেরের উদ্দেশ্যে। কালীচরণের মনে খুশিখুশি ভাব। উমানাথ হাল হাতে গান ধরেছে,
‘নাওরে শূন্যের ভরে উড়াল দিয়ে যাও’।

মুঙ্গের পৌঁছাতে পৌঁছাতে অন্ধকার হয়ে গেল। শীতের দাপটে আর নদীর ঠান্ডা বাতাসে হাত-পা জমে আসছে সকলের। নৌকা নোঙর ফেলল কাস্টারনি ঘাটে। সবাই ঘাটে উঠে গেল, সুবল থেকে গেল রান্নার ব্যাবস্থা করতে। সে নৌকার পাশেই একটা পরিষ্কার জায়গা দেখে চুলা জ্বালাল।কাস্টারনি ঘাটে সবাই আলাদাভাবে ঘোরাঘুরি করতে থাকলো। দোকানপাট প্রায় সব বন্ধ। সীতা মন্দিরের পাশে এক যায়গায় কিছু লোক গোল হয়ে বসে গাঁজা টানছে আর গল্পগুজব করছে। উমানাথ আর কালীচরণ তাদের সাথে যোগ দিল। তারা গল্প করছিল কয়েক মাস আগে নিজের দেশে ফেরার পথে, গাজীপুরে লাট সাহেব কিভাবে মারা গেল তাই নিয়ে। কালীচরণ, উমানাথ গাঁজায় দুই দম দিয়ে উঠে গেল একটা দোকানের দিকে। তারা দুধ,মুড়ি, বাতাসা এইসব কিছুকিছু করে কিনে নৌকার কাছে ফিরে এল। কিছুক্ষণ পরে সবাই একে একে এসে নৌকার পাশে চুলার কাছে গোল হয়ে বসলো। রান্না শেষ হতে এখনো অনেক দেরি। উমানাথ চুলার পাড়ে জমিয়ে গল্প জুড়ে দিলো। সবাই গরম দুধ আর মুড়ি খেতে খেতে সে গল্পে বিভোর হয়ে গেল। সে গল্প, অতিপ্রাচীন গল্প, এই কাস্টারনি ঘাটের গল্প।
"আসলে এই ঘাটের নাম ছিল কষ্টহারিনী,লোকে বলে শ্রী রাম চন্দ্র যখন হরধনু ভেঙে মা সীতাকে বিয়ে করে অযোধ্যা থেকে ফিরছিলেন, তখন ফেরার পথে তাঁরা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েন।ক্লান্তি দূর করতে এখানেই, এই ঘাটে শ্রী রাম এবং মা সীতা একইসঙ্গে চান করেন । এক ডুবেই তেনাদের সব কষ্ট দূর, ব্যাস ঘাটেরও নাম হয়ে গেল কষ্টহারিনী।সেখান থেকেই কাস্টারনি।" সবাই হা করে গল্প শুনছে, মাঝখানে দেবু অবাক হয়ে বলল,"এই ঘাটেই! "
"হ্যাঁ রে পাগলা, তা আর বলছি কি রে, মহাভারতেও এই জায়গার নাম ছিল মোদাগিরি। এখানেই মুদ্গল মুনির আশ্রম ছিল তাই এ জায়গার নাম প্রথমে মোদাগিরি ছিল পরে মুঙ্গের হয়েছে। এখানেই ভীম কর্ণকে হারিয়ে দেয়।" তাদের গল্প চলতে থাকে, নদীর বুকে দূরে থেকে আসা দূর্গের আলোর নাচও চলতে থাকে।


রাতের বেলার খাবার খিচুড়ি , বেগুন ভাজা। তাদের নৌকার পাশে বেশ কিছু ছোট ছোট জেলে নৌকাও আছে। খাওয়া শেষ করে সবাই ঘুমাতে গেল। উমানাথ তামুক খেতে খেতে আশেপাশের নৌকার মাঝিদের সাথে তাদের ভাষায় ভাঙা ভাঙা আলাপ পরিচয় করল। শীতের রাত মাঝে মাঝে শেয়াল কুকুর ডেকে উঠছে , দূর মন্দির থেকে ভেসে আসা সীতারাম ভজন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

পরেরদিন ভোরবেলা, নদীরধারে জেলেদের হৈচৈ, বাজারে দোকানপাট খোলা মেলার শব্দ, মন্দিরের ঘন্টা, পূজাপাঠ, তীর্থযাত্রীদের মন্ত্রপাঠ আর ধূপ ধুনো র ঘন্ধে সকলের ঘুম ভাঙল। সকালবেলা একজন বাঙালী ব্যবসায়ী এসে ডাকাডাকি করতে লাগল। তার সাথে একটা পোটলা। সবার বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা রমাকান্ত, তাদের সোথার রমা। রমা কে নিয়ে সকাল সকাল নৌকা রওনা হল একেবারে পাটনার উদ্দেশ্যে। আজকের যাত্রাটা একটু ধকলের যাবে। এখান থেকে প্রায় মাঝ বেলায় নৌকা গিয়ে পড়বে পাটনা, পাটনাতে বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে নৌকা সোজা যাবে কাশি। সেখানে একদিনের বিরতি।

শীতের তাজা রোদে উজ্জ্বল দিন। ঘাসিনৌকাটা চলেছে বিরতিহীন। ফুরফুরে হিমেল হাওয়ায় নৌকার পাল ফুলে ফেঁপে ঢোল। মাঝিদের বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে না। মাঝপথে উমানাথ জেলেদের নৌকা থেকে মোটামুটি বড় দেখে একটা রুইমাছ কিনে নিলো। রাখাল মহাউৎসাহে নৌকায় বসেই সেটাকে কাটাকাটি করছে। সুবল মুঙ্গের থেকে বাজার করে আনা সবজি কাটছে। দুপুরবেলার দিকে পাটনার কাছাকাছি, মাঝ নদীর একটা ফাকা চর দেখে নৌকা ভেড়ান হল। কাশি যেতে এখনো অনেক দেরি, তাই সময় নষ্ট না করে চরেই দুপুরের খাবার ব্যাবস্থা করা হল। সুবলের হাতের রান্না ভাল, কিন্তু আজকে রান্না করবে উমানাথ নিজে হাতে। উমানাথ মশলা দিয়ে, শিম, ছোট আলু দিয়ে, কষিয়ে রুইমাছটা বেশ কায়দা করে রান্না করল। দুপুরের খাবার সবাই চেটেপুটে খেল। কালীচরণ তাগাদা দিতে থাকলো সবাইকে নৌকা ছাড়বার জন্য । বেলাগড়িয়ে বিকেলবেলা নৌকা পাটনা পৌছুলো। ঘাটের দিকে নৌকো এগোবার সময় সুবল লক্ষ করলো,ঘাট থেকে বড় গোঁফওয়ালা এক বিহারি অনেক্ষন ধরে নৌকার দিকে তাকিয়ে আছে, নৌকা কাছে আসতেই সে মাথার ওপর দুইহাত জোড় করে প্রণাম করল কালীচরণ কে,"আউলে ভাইয়া! জ্যায় মা কালী কলকাত্তে ওয়ালী! " কালীচরণ উত্তরে শুধু বলল, "আউলে ভাইয়া! " মুখের বুলি শুনে সুবল বুঝে গেল এই হলো তাদের তিলহাই অর্থাৎ গুপ্তচর। বর্ধমানের দল অথবা ডনকি-রনকি অর্থাৎ পুলিশের ফেউ তাদের পিছু নিয়েছে কিনা সে ব্যাপারে তিলহাই পাকা খবর দিবে। এছাড়া যাত্রী কারা কারা নারায়ণগঞ্জ যেতে চায় বা কাদের আর্থিক অবস্থা কেমন সে ব্যাপারেও রমা আর ধলাকে খবর দিবে এই তিলহাই। ঘাটে নৌকা লাগার পর রমা আবার আগের মত যাত্রী বেশে পাটনা নেমে গেল। কালীচরণ তিলহাইয়ের সাথে কথা বলতে নৌকা থেকে নামলো। তিলহাই হাত নেড়ে নেড়ে অনেকক্ষণ কথা বলল। সব খবরাখবর নেওয়ার পর কালীচরণ তিলহাইয়ের হাতে কিছু পয়সা গুঁজে দিয়ে বিদায় নিলো। নৌকা যখন পাটনা ছাড়ল তখন সন্ধ্যা হবহব করছে। অন্ধকারে নৌকা চালানো খুবই কষ্টকর, তবুও গঙ্গার বিভিন্ন ঘাট গুলি একপাশে রেখে রাতের বেলাতে চোখবন্ধ করেও কাশি চলে যাওয়া যায়। নৌকা ধীরগতিতে কাশির দিকে এগোতে থাকলো।

সন্ধ্যা হয়েছে অনেক্ষন হল। আজকে আকাশ পরিষ্কার,চাঁদনী রাত। কুয়াশার একটা পাতলা চাদর শুধু শোন নদীর ওপরে পড়ে আছে। থেকে থেকে দমকা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে সেই চাদর ফালাফালি করে দিচ্ছে। চাঁদের আলোয় নদীর বুক ঝিলমিল করছে। আর সেই ঝিলমিল নদীর ঢেউয়ের তালে ঘাসিনৌকাটা যেন নাচতে নাচতে এগোচ্ছে কাশির দিকে। বহুদুর থেকে দুইএকটা মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি কানে আসছে। বাতাসে পাওয়া যাচ্ছে চন্দন কাঠ, কর্পূর আর ধুপের গন্ধ। চারিদিকে একটা ভক্তি মিশ্রিত শান্তিময় বাতাবরণ। কালীচরনের নৌকায় টুঁ শব্দটি নেই,শুধুই একটানা নৌকা বাওয়ার ছন্দময় শব্দ। এমন সময় ভক্তিভাবে উমানাথ দরাজ কণ্ঠে গান ধরল,
"মাই হে ,ও তুই আর কেহ না
তুই দূর্গা, তুই কালি মা
তুই জগদম্বা, জগৎধাত্রী মা
তোর এত রূপেও পড়ে না কালিমা।
মা তোর না হয় তুলনা
কত সৃষ্টি সৃজন করলেন ঈশ্বর
তবুও পূর্ণ হলনা তাঁর লীলা
নিজে সাঁজলেন মাতা রূপে,
জগৎপতি বর্ষালেন তাঁর কৃপা
এ জগতে, সবই ঈশ্বরের মহিমা....।"
রাত অনেক হয়েছে, কিন্তু দশাশ্বমেধ ঘাট এখনো জাগ্রত।

পরদিন সকালে উমানাথ ধলা কে খুঁজে বের করল। ধলাকে প্রায় চেনায় যাচ্ছে না, সে তীর্থযাত্রীর বেশ ধরেছে। তার সাথে দেখা যাচ্ছে আরও তিনজন তীর্থযাত্রী। তারা সবাই গোল হয়ে বসে গল্প করছে। উমানাথ তাদের কাছে গিয়ে বলল,
"আজ্ঞে, ঘাট থেকে বলল আপনারা নারায়ণগঞ্জ যাবেন, আমাদের ভাড়াটে ঘাসিনৌকা নারায়ণগঞ্জ যাবে।"
সবাই সবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বৃদ্ধ জন ধলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,"ও মশাই, আপনিই তো নারায়ণগঞ্জ।" ধলা যে ছোট এই তীর্থযাত্রী দলের নেতা হয়ে গেছে তাতে কোন সন্দেহ নাই। গলাতে একটা ফাকা ভারিক্কী এনে সে উমানাথ কে জিজ্ঞাস করল,"কি নাম তোর?"
"আজ্ঞে উমানাথ। "
"দেখ বাপু, ভাড়াটা পরের কথা আগে আমি নৌকা দেখবো। খাবার ব্যবস্থার আমাদের দরকার নেই, ওটা আমরা নিজেরাই ব্যবস্থা করব। আমি যাবো নারায়ণগঞ্জ, এঁরা যাবেন বোয়ালিয়া। কাজেই এঁদের ভাড়া কম ধরতে হবে। রাজি থাকলে বল। অনেক নৌকা দেখেছি, হয়নি। রাজি থাকলে গিয়ে নৌকা দেখি।আমরা যাত্রী মোট পাঁচজন। "
উমানাথ মাথা চুলকে খানিক চিন্তা করে বলল,
"আজ্ঞে রাজি আছি, তবে পাটনা থেকে আমরা নারায়ণগঞ্জের যাত্রী নেব। নৌকায় যায়গা হবে, কোন সমস্যা হবে না। "
ধলা সবার দিকে একবার তাকিয়ে মৌনসম্মতি পেয়ে বলল,
"ভাড়ায় পোষালে কেন নয়? আগে নৌকা দেখি চল।"
সবার সাথে নৌকা দেখার পর ধলা অনেক মুলামুলি করে ভাড়া ঠিক করল। এতে তীর্থযাত্রী দলের সবাই ধলার ওপর খুবই খুশি হয়ে গেল। ঠিক হল পরদিন ভোরে তারা রওনা দিবে। কালীচরণ ধলার কাজে মনেমনে গর্ববোধ করতে লাগলো। ঐ দিন দলের সবাই কাশি ঘুরে বেরাল যে যার মত। আর তাদের রাত গেল পরদিন ভোরের অপেক্ষায়।
পরদিন ভোরবেলা সবাই আলুসিদ্ধ ভাত খেতে বসেছে। ধলা তার পাঁচজনের দল নিয়ে এসে হাঁকডাক শুরু করে দিলো। পাকা বাবুয়ানি গলায় বলতে থাকলো,
"জলদি কর, জলদি কর।"
সবাই তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে, ঘাসিনৌকা ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলো। নৌকায় যাত্রীরা এক এক করে উঠে বসলো। কালিচরণের নজর প্রত্যেকের দিকে। দুজন তীর্থযাত্রী প্রায় একই বয়সী, বয়সে তারা পৌড়, দেখে মনেহয় বন্ধু। তাদের সাথে একই আকারের পোটলা। অন্য দুজনের একজন বৃদ্ধ, একজন বিধবা।বিধবা দেখে তার বুকের ভেতর কেমন ছ্যাঁত করে উঠলো। বৃদ্ধর হাতে একটা পোটলা। বিধবাটি মাথার ওপরে লম্বা একটা ঘোমটা টেনে আছে, সম্ভবত তার কোলে একটা ছোট পোটলা আছে। বৃদ্ধ সম্ভবত বিধবার বাবা। কালীচরণ চঞ্চলচিত্তে নৌকা ছাড়ার আদেশ দিলো।

ঘাসিনৌকাটি শোন নদী পার হয়ে এগিয়ে চলল পাটনার দিকে। আজকে আকাশ একটু মেঘলা। ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে চলেছে সমানে। ধলা তার তীর্থযাত্রীর দল কে নিয়ে বসে আছে নৌকার ভেতরে, তাদের সবাইকে সে ধর্মকথা শুনাচ্ছে।

"কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন|
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি||

অর্থাৎ কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মফলে কখনও তোমার অধিকার নাই। কর্মফল যেন তোমার কর্মপ্রবৃত্তির হেতু না হয়, কর্মত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, জ্ঞানযোগ এবং রাজযোগ, এই চারটি যোগ মুক্তি বা মোক্ষ লাভের পৃথক পৃথক পথ হলেও শেষে সব পথই এক তত্ত্বে মিলিত হয়।...... "
ধলা বলে চলেছে , সবাই মনযোগী হয়ে শুনছে। বখতিয়ার অবাক হয়ে ধলার এই নতুন রুপ দেখছে।

বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল তাও রোদের কোন দেখা নাই। চারিদিক কেমন আবছা আলোয় ঘেরা,গুরুগম্ভীর প্রকৃতি। একটানা নৌকা চলে, দুপুরবেলা পাটনা পাওয়া গেল। ঘাটে নৌকা আর বারোয়ারি মানুষের ভীড়। এদিকে নৌকার সবাই ক্ষুধায় ক্লান্ত। তীর্থযাত্রীর দল নৌকা থেকে নেমে গেল। সবাই মিলে একটা বটগাছের নিচে বসে সাথে নিয়ে আসা চিড়া আর কলা খেতে লাগলো। কালীচরণ নৌকা থেকে নামার সময় তাদের উদ্দেশ্য করে জোর গলায় বলল,
"বেশী দূরে কোথাও যাবেন না, রান্না-খাওয়া হয়ে গেলেই নৌকা ছাড়বে। "
ধলাকে বৃদ্ধ তীর্থযাত্রী ফিসফিস করে কি যেন বলল। এরপর ধলা খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে কালীচরণ কে বলল, "নৌকায় যেন রান্না খাওয়া না হয়,খবরদার! "
কালীচরণ শুধু ঘাড় কাত করে বাজারের দিকে গেল। রমাকে খুঁজে বের করতে হবে। সুবল আর দেবু ঘাটের পাশের একটা ঝোপ থেকে এক কাঁদি পাকা কলা, কলা গাছ,কলার মোচা নিয়ে বের হয়ে এল। দুপুরে খাবার রান্না হল ঘাটের একপাশে, মোচার ঘন্ট আর থোড় ভাজি। খাবার পর্ব শেষ হলে সবাই যখন বসে একটু পান তামুক খাচ্ছিল, তখন রমা একটা পোটলা কাঁধে এসে হাজির হল। তার সাথে আরও দুইজন ব্যবসায়ী তাদের সাথেও একটা করে বড় পোটলা। কথা শুনে বোঝা গেল এরা বিহারি তামাক ব্যবসায়ী, রমা এদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে যাবে বলে। রমা কালীচরণের সাথে ভাড়া সংক্রান্ত কথা পাকাপাকি করে ফেললো। কালীচরণ নৌকা ছাড়ার আদেশ দিবে, এমন সময় রমা কালীচরনের কানেকানে বলল,
"দাঁড়াও! আসল মক্কেল তো এখনো আসেনি। "
কিছুক্ষণ নৌকা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল। এরমধ্যে তামাকের পোটলা গুলি একদিকে রেখে রমা আর দুইজন বিহারি নৌকার ভেতর একপাশে বসে তামুক খেতে লাগলো। তীর্থযাত্রীর দল সমেত ধলা বসলো অন্যপাশটায়।বিকেল গড়াল টিপটিপ বৃষ্টি দিয়ে, ঘাটে দেখা গেল বেশ মোটাসোটা এক মারোয়াড়ীকে, তার সাথে বল্লম হাতে একজন প্রহরী, পেছনে ঠেলা গাড়ি ভর্তি বাক্স,কাপড়ের পোটলা। মারোয়াড়ী এক দলা পানের পিক ফেলে তার প্রহরীকে কি যেন বলল,প্রহরী নৌকার কাছে এসে জেরা করলো,
"ইখানে রমা কে আছে? তাম্বাকু বেওসা করে? মালিক বুলাইছে। "
রমা জ্বলজ্বলে মুখে নৌকা থেকে বেরিয়ে মারোয়াড়ীর কাছে গিয়ে হাত জোড় করে প্রণাম করল, তারপর নৌকার দিকে হাক ছেড়ে ডাক দিল,
"এই তোরা সবাই জলদি আয়, মাল গুলি নৌকায় তোল! " কালীচরণের চক্ষুছানাবড়া। সে বুঝতে পারল এই পক্ষ মালদার, রেশমি কাপড় ব্যবসায়ী। মালামালের বহর দেখে মনে হচ্ছে , সে অনেক যায়গায় ব্যবসা করে এসেছে, এখন নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছে। মালামাল নৌকায় তোলা হল। প্রহরী একফাকে এসে তার মালিকের বসার জায়গাটায় বিছানা পেড়ে দিল। মারোয়াড়ী ছোটখাটো হাতির মত হেলেদুলে নৌকায় উঠলো। নৌকায় উঠে সে তীর্থযাত্রীদের হাসিমুখে প্রণাম করল। তারপর নিজের জায়গায় আরাম করে বসে, প্রহরীর দিকে পা টা এগিয়ে দিল,প্রহরী তার মালিকের পা টিপে দিতে লাগলো। মোট যাত্রী আট জন,সানন্দে নৌকাছাড়ার আদেশ দিল কালীচরন।

সন্ধ্যে নগাদ ঘাসিনৌকাটি মুঙ্গের পৌছাল। এবারও জনবহুল কষ্টহারিণী ঘাটে , মন্দিরের কাছে নৌকা বাঁধা হল। এখান থেকে দূর্গটাও বেশ কাছে। ঠিক করা হল তীর্থযাত্রীর দল মন্দির চত্বরে রাত কাটাবে, তাদের পাহারায় থাকবে বখতিয়ার। তামুক ব্যবসায়ীরা রমার সাথে গেল এক সরাইখানাতে। মারোয়াড়ী আর তার প্রহরী নৌকায় থাকবে,যেহেতু তাদের মালামাল অনেক তাই বাকি সবাই নৌকায় থেকে পাহাড়া দেবে। রাতে পড়লো কনকনে ঠান্ডা। সুবল পাটনা থেকে আনা পাকা কলা সবাইকে দিল। মুড়ি, কলা,গরম দুধ দিয়ে প্রাথমিক ক্ষুধানিবৃত্তি করা হল। উমানাথ সন্ধ্যায় ঘাটের জেলেদের কাছে পুঁটিমাছ কিনে ছিল, সেটা সরিষার তেলে ভাজার আয়োজন করতে লাগলো দেবু,সুবল চুলা জ্বালাল। রাতের খাবার পুঁটিমাছ ভাজা, সোনামুগ ডাল আর ভাত। নৌকার কাছাকাছি মারোয়াড়ীর প্রহরীকে দেখা গেল চুলা জ্বালাতে, ওরা নিজেদের খাবার নিজেরাই করে নিচ্ছে। খাবার পর রাতে ঠান্ডায় আর চিন্তায় কালীচরণ ঘুমাতে পারলো না, শিকার জ্বালে বসেছে, এখন সাবধানে জাল টেনে তোলার পালা। একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলেই সর্বনাশ।মাঝরাত, বাইরে উমা নাথ গুনগুন করে গান গাইছিল। হঠাৎ তার গান থেমে গেল, কালীচরণ কান খাঁড়া করে শুনতে চেষ্টা করল বাইরে কি হচ্ছে, কেউ জোরে জোরে মৈথিলী ভাষায় উমানাথ কে প্রশ্ন করছে, এই নৌকা কার, কে আছে নৌকার ভেতর? উমনাথ ভাঙা ভাঙা বিহারি ভাষায় জবাব দিচ্ছে।মারোয়াড়ী মরার মত নাকডেকে ঘুমাচ্ছে। কালীচরণ একটা লাগি হাতে নৌকার বাইরে বেরিয়ে এল, পাঁচ ছয়টা ছিপ নৌকা তার ঘাসিনৌকাটা ঘিরে ধরেছে। প্রতি নৌকায় তিনজন, প্রত্যেকের পরণে সাদা মালকোঁচা মারা ধুতি আর মাথায় পাগড়ী,হাতে বল্লম। ঘাসিনৌকায় সবাই তটস্থ বিশেষ করে প্রহরী ,উমানাথ ঠান্ডা গলায় কথা বলে চলেছে। কালীচরণ কথার মধ্য এসে পড়লো।
"আউলে ভাইয়া!" তার এক কথায় চারিদিকে পিনপতন নিরবতা নেমে এল,যেন কালীচরণ কোন মন্ত্র উচ্চারণ করেছে। কালীচরণ এবার উচ্চস্বরে হাক ছাড়লো,
"জ্যয় মা কালী! সর্দারজী জারা বাত করনি হ্যা, আয়িয়ে।"
বলে কালীচরণ ঘাটে নেমে অপেক্ষা করতে লাগলো, একজন বৃদ্ধ নেমে এল ছিপ নৌকা থেকে। কালীচরণের কাছে এসে হাতজোর করে কুশল বিনিময় করল। তারপর ফিসফিস করে অনেকক্ষণ কথা হল তাদের দুইজনের মধ্যে। জানা গেল তারা ডাকাত দল, মারোয়াড়ীর মালের খবর পেয়ে এসেছে লুট করতে, কিন্তু সত্যি তাদের জানা ছিলোনা যে এটা ভাঙ্গুয়া অর্থাৎ ঠগি নৌকা, জানলে তারা ধর্ম বিরোধী এই কাজ কখনোই করতো না। তারাও ভবানী তথা মা কালীর ভক্ত। কালীচরণ বলল তাদের চলে যেতে, কাজ হয়ে গেলে মালামালের একটা ভাগ সর্দারের সম্মানী হিসাবে সে তিলহাই মাধ্যমে পাঠিয়ে দেবে। দুজনের মধ্যে দফারফা হয়ে গেলে যে যার নৌকায় চলে গেল।
আস্তে আস্তে সব ছিপ নৌকাগুলি রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। কালীচরণ ফিরে এসে প্রহরীকে বুঝ দেওয়ার জন্য সবাই কে বলল,
"ভয়ের কিছু নেই, ওরা দূর্গের লোক, পাহারাদারের হাতে বল্লম দেখে জেরা করতে এসেছিল। "
প্রহরীর মন থেকে ভয় এবং সন্দেহ কোনটাই দূর হল না।

পরদিন ভোরবেলা সব যাত্রী নৌকার কাছে উপস্থিত হল। মারোয়াড়ী রাতের ঘটনা শুনে কালীচরণের ওপর অনেক খুশি। কিন্তু প্রহরীর মনে যে সন্দেহ গত রাতে ঢুকেছে তা আর কিছুতেই বের হল না। সে বেশ সাবধানী নজরে কালীচরণকে লক্ষ করতে লাগলো। সকালে খাওয়া শেষ করে নৌকা ছাড়া হল। ঠিক হল এবার নৌকা কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজাসুজি যাবে লালগোলা। মাঝখানে কোথাও দুপুরের খাওয়া খেলেই হবে। আজকে নদীরবুকে ঘন কুয়াশা। একহাত দুরেও দেখা যায় না। কালীচরন মনে মনে কালী মন্ত্র জপছে। সকলের চোখেই উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট, শুধু উমানাথ ছাড়া। উমানাথ গলাছেড়ে গান ধরেছে,

"কাল জলে উছলা তলে ডুবল সনাতন
আজ চারানা কাল চারানা পাই যে দরশন।

লদীর ধারে চাষে বধু মিছাই কর আশ
ঝিরি হিরি বাকা লদী বইছে বার মাস।

কাল জলে উছলা তলে ঢুবল সনাতন
আজ চারানা কাল চারানা পাই যে দরশন।

চিংড়ি মাছের ভিতর কড়া তায় ঢালেছি ঘী
নিজের হাতে ভাব ছাড়েছি ভাবলে হবে কি?

চালর চুলা লম্বা কচা খুলি খুলি যায়
দেখি শামের বিবেচনা কার ঘরে সামায়।

মেদনী পুরের আয়না চিড়ন বাকুরার ঐ ফিতা
যতন করে বাধলি মাথা তাও যে বাকা সিথা।

মেদনী পুরের আয়না চিড়ন বাকুরার ঐ ফিতা
যতন করে বাধলি মাথা তাও যে বাকা সিথা।

পেচ পারিয়া রাজকুমারীর গলায় চন্দ্র হাড়
দিনে দিনে বারছে তোমার চুলেরই বাহার।

কলি কলি ফুল ফুটেছে নীল কাল আর সাদা
কোন ফুলেতে কৃষ্ণ আছেন কোন ফুলেতে রাধা।"

দুপুরবেলা নৌকা দাঁড়ালো একটা চরে। তখনো চারিদিকের কুয়াশা কাটেনি। ঠান্ডা পড়েছে অনেক বেশি। নদীতে নৌকা জোড়ে চালানো সম্ভব হচ্ছে না। চরে নেমে সবাই রান্নার তোড়জোড় করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। রান্নার আয়োজন অতি সামান্য, মাঝিরা রান্না করছে গুড়া চিংড়ি আর লাউয়ের ঘ্যাট, প্রহরী তার মালিকের জন্য রান্না করছে রুটি আর ল্যাবড়া। তীর্থযাত্রীরা একটা জায়গায় গোল হয়ে বসে চিড়ে, গুড় আর কলা খাচ্ছে। ধলা তাদের খেতে খেতেও জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে,
"গীতায় বলা হয়েছে আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, আত্মা অমর| মানবদেহের জন্ম হয় এবং মৃত্যু হয়।মৃত্যু আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না।মৃত্যুতে স্থূল দেহের বিনাশ হয় মাত্র।বস্ত্র জীর্ণ হলে তা পরিত্যাগ করে যেমন আমরা নূতন বস্ত্র পরিধান করি তেমনি আত্মা জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নূতন দেহ গ্রহণ করে।মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম হয় অর্থাৎ পুনর্জন্ম হল দেহান্তর মাত্র।শৈশব, বাল্য, যৌবন ও জরার ন্যায় মৃত্যুও দেহের একটি অবস্থা মাত্র।আত্মাকে মৃত্যু বিনাশ করতে পারে না, অস্ত্র ছেদন করতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করতে পারে না, জল সিক্ত করতে পারে এবং বায়ু শুষ্ক করতে পারে না।"
আর সকলে মাথা দুলিয়ে তার কথা শুনে যাচ্ছে। কালীচরণের চোখ একবার গেল তীর্থযাত্রী বিধবার দিকে। সেই যে মাথা থেকে পা পর্যন্ত সাদা কাপড়ে ঢেকে, একটা ছোট পোটলা জাতীয় কিছু কোলের মধ্যে চেপে ধরে নৌকায় চেপেছে, এখন পর্যন্ত ঐ একইভাবে বসে আছে। ঘোমটার তল দিয়ে অল্প অল্প খাবার মূখে তুলছে। খাবার পালা শেষ করে আবার সবাই নৌকায় চেপে বসলো। লালগোলা যেতে এখনো অনেক দেরী। কুয়াশা আগের মতই আছে। নৌকা ধীরেধীরে ঝাড়খণ্ডের দিকে এগোতে থাকলো।

ঘাসিনৌকাটা ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলের পাশদিয়ে ধীরগতি নিয়ে এগোচ্ছে। কুয়াশায় প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। কালীচরণ অনেক দূরে গাছে বাধা তিনটা লাল কাপড়ের নিশান দেখতে পেল। নৌকার যাত্রীরা সবাই খোশ মেজাজে যে যার মত গল্প করে যাচ্ছে। মারোয়াড়ী নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে, কিন্তু তার প্রহরীটি কুকুরের মত চোখকান খাঁড়া করে সব দিকে নজর রেখেছে। রমা প্রহরীর দিকে তামুক আগিয়ে দিয়ে বলল,
"লাহো ভাইয়া লাহো!"
প্রহরী লোভ সামলাতে না পেরে তামুক নিলো। রমা কিছুক্ষণ বিধবার দিকে তাকিয়ে থেকে তার বৃদ্ধ বাবাকে বলল,
"কি হয়েছিলো?"
"কলেরা! একমাসের মাথায় পুরো পরিবারটা শেষ! ওকে অপয়া বলে তড়িয়ে দিলো শশুড়বাড়ি থেকে।"
সবাই শুনে বলল,
"আহা....!"
"কি আর করবো বাপু! সবই আমার কম্মের ফল, নইলে কি মেয়ে বিয়ের দুইমাস পরে বিধবা হয়ে ঘরে ফেরে!"
এই বলে বৃদ্ধ চোখমুছতে লাগলো। ধলা বৃদ্ধের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
"সবই অন্তরালের খেলা গো! শ্লোকে আছে :
মুখ না থাকায় প্রেতাত্মা ব্রাহ্মণের মুখে করে যে ভোজন।
ব্রাহ্মণ ভোজন না করালে প্রেতাত্মা করে যে রোদন।
এইসব কিছুই তেনাদের অসন্তুষ্টির ফল, তেনাদের তো মুখ নেই, তেনারা ব্রাহ্মণের মুখেই ভোজন করেন। ভোজনে তাঁরা তুষ্ট হয়। নইলে তাঁরা শাপ দেন, অনিষ্ট করেন।"
ধলার কথায় সকলের কেমন গা ছমছম করতে লাগলো। নদীর ধারে ধরে জঙ্গলের দিকে চেয়ে সকলেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এমন সময় নৌকার পাটাতনে তিনটা টোকা দিয়ে কালীচরণ ঝিড়নী দিলো। বিদ্যুতের ঝলকের মত চলল ঠগির গামছা, দলের সকলে চিতা বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়লো যাত্রীদের ওপর। কয়েক মূহুর্তের মামলা। এক এক করে সব দেহগুলি নিথর হয়ে আসলো আর চোখগুলি ঠিকরে বের হয়ে আসতে লাগলো । ঠগিরা সবাই গামছা টেনে যাত্রীদের কাঁধে পা চাপা দিয়ে রেখেছে। চারিদিকে শুধু ঝিঁঝিঁ ডাকার শব্দ। কালীচরণ চিৎকার করে বলল "বাজিত খান"। খেলখতম। আটটি দেহ লুটিয়ে পড়ল নৌকার পাটাতনের ওপর। সুবলের সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে। কালীচরণ নৌকা দ্রুত জঙ্গলের দিকে নিতে বলল। সুবলের গা এখনো কেঁপেই চলেছে। ধলা সুবলের বদলে নৌকা বাইতে লাগলো। নৌকা জঙ্গলের ধারে পৌঁছালে, সবাই সাবধানে নিজেদের বহরাগুলি অর্থাৎ খুন করা লাশগুলি নিজেরাই কাঁধে নিয়ে জঙ্গলে নেমে গেল। কালীচরণ সুবলের কাঁধে হাত রেখে বলল,
"তোর বহরা নেয়ার দরকার নেই,তুই নৌকায় থাক।" বলে কালীচরণে বিধবার লাশটা কাঁধে নিয়ে জঙ্গলে চলে গেল। সুবল এখনো ম্যালেরিয়া রোগীর মত কাঁপছে।
জঙ্গলের ভেতরে বখতিয়ার ও বলরামের আগে থেকে ঠিক করে রাখা যায়গায়, সবাই লাশ নিয়ে সমাবেত হল। বলরাম লুগহা অর্থাৎ গোড় খুঁড়ে। সে কাসসি অর্থাৎ একটা ছোট কোদাল নিয়ে নিসার অর্থাৎ কবর খুঁড়তে লাগলো, উমানাথ, দেবু, রাখাল মিলে সব লাশের গায়ে যেসব মূল্যবান জিনিষ ছিলো সেগুলি খুলে নিতে লাগলো। কালীচরণ বলরাম কে হুকুম দিল,
"কুরওয়া না করে নিসার গব্বা কর। আরো বড় করে কর।"
বলরাম চারকোনা কবর খুঁড়ছিল, ওস্তাদের কথায় সে বড় গোলাকার কবর খুঁড়তে লাগলো। অনেক্ষন একটানা হাত চালিয়ে বলরাম বড় গোলাকার একটা কবর খুঁড়ে ফেলল।অনেক ক্লান্ত সে কোনরকম কোদালটা মাটিতে রেখ চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়লো। লাশগুলিকে এক এক করে নামানো হল কবরে। এরপর ‘দ’ এরমত করে বসিয়ে দেয়া হল। বখতিয়ার কু্যাওয়া অর্থাৎ লাশের বুকে পেটে ছুড়ি চালিয়ে কবর পাকা করা তার কাজ। এবার বখতিয়ার একটা একহাত লম্বা চিকন ছুড়ি আর দড়ি নিয়ে কবরে নামলো। প্রত্যেকটা লাশের দুই পায়ের গিরা, হাঁটু,হাত আলাদা আলাদা করে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেধে দিলো। তারপর তার চিকন লম্বা ছুড়ি দিয়ে লাশ গুলির বুক, পেট ফাঁসিয়ে দিতে লাগলো যাতে করে পানি জমে লাশ ফুলে কবর থেকে বেড়িয়ে না আসে। বিধবার লাশের পেটে একবার ছুড়ি চালিয়ে সে থমকে গেল,আবার ছুড়ি চালাল, তারপর সে কবর থেকে উঠে এল।বখতিয়ার কালীচরণ কে ফিসফিস করে বলল,
" সর্দার! বিধবা পোয়াতি ছিলো!"
সবাই শুনে অবাক হল, কালীচরণ আফসোসে মাথায় হাত দিলো,বখতিয়ারে কাঁধ ধরে সে ঝাঁকিয়ে বলল,
"এ কথা যেন আমাদের বাইরে কেউ না জানে। মা ক্ষমা কর মা! "
কবরে ভালোভাবে মাটিচাপা দেওয়ার পর তার ওপর ময়লা, পাতা, ঘাস ইত্যাদি দিয়ে কায়দা করে একেবারে মিলিয়ে দেয়া হল। কেউ দেখে বুঝতেই পারবেনা এখানে কিছুক্ষণ আগে আটজনের এক সঙ্গে কবর দেয়া হয়েছে।সবশেষে লাল কাপড়ে মোড়া পাঁঠার মাথাটা কবরের ওপর রাখলো কালীচরণ।

রাতেরবেলা সুবলের প্রচণ্ড জ্বর এলো, সে কিছুই মুখে তুলতে পারলো না। কোনরকমভাবে ভাত,আলু ভর্তা, ডাল খেয়ে সকলে মালামালের হিসেব করতে বসেছে।।চারিদিকে ঘন অন্ধকার।নৌকা মাঝ নদীতে স্থির হয়ে আছে। মারোয়াড়ীর বক্স, পোটলা ভর্তি দামি রেশমি কাপড় আর রাজস্থানি কাপড়।একটা ছোট পোটলাতে বেশকিছু পয়সা পাওয়া গেল। তামাক ব্যাবসায়ীদের কাছথেকে মোট ২ টা বড় পোটলা তামাক,কিছু পয়সা, ২টা সোনার, ৪টা চাঁদির আংটি পাওয়া গেল। তীর্থযাত্রীদের কাছথেকে পাওয়া গেল বেশ মোটা অংকের পয়সা আর বিধবার কোলের সেই ছোট পোটলা ভর্তি সোনার গয়না পাওয়া গেল। ঠিক করা হল নৌকা যেমন নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিল তেমনি যাবে। শুধু বহরাদের ব্যক্তিগত জিনিষগুলি উমানাথ গ্যঞ্জেল ঘাটের চোর বাজারে বিক্রি করে আসবে তার সাথে কালীচরণ নিজে থাকবে।তার চেনাজানা আছে সেখানে। মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে নৌকা ছাড়া হল আবার ।

লালগোলা যেতে যেতে রাত হয়ে গেল অনেক। নৌকা বাধা হল জেলেদের একটা ঘাটে। উমানাথ কোথাও থেকে একটু গরম দুধ জোগাড় করে নিয়ে এল। সে দুধে হলুদ গুলে সুবলকে খেতে দিলো। দুধ খেয়ে সুবল মরার মত ঘুম দিলো। বলরাম আর বখতিয়ার দুধের সাথে আফিম খেয়ে ঘুমাতে গেল। রমা, ধলা নৌকা পাহাড়ায় থাকলো। উমানাথ গাঁজা দিয়ে কল্কী সাজাচ্ছে আর গুণগুণ করে গান গাইছে,
"দেখ্যে বাড়ালি তকে
তুঁই না দিলি হামাকে
বুকের মাঝে শিমল কঁড়ি দলকে
সেই দেখে মন ললকে।"
রখাল,দেবু ঘুমিয়েছে দেখে কালীচরণও ঘুমাতে গেল, শুয়ে শুয়ে সে চিন্তা করলো মোট কত টাকা সে ভাগে পেতে পারে, মায়ের মন্দিরটা কিভাবে গড়ে দিবে, সুবলের বিয়ে দিবে কবে, আসছে বছর ক্ষেতে কি বুনবে, এইসব চিন্তা করতে করতে সেও ঘুমিয়ে গেল।

পরদিন ভোরবেলা সবার খাওয়াদাওয়া শেষহলে নৌকা রওনা হল।এখানে গঙ্গা পদ্মা হয়েছে। আজকে কুয়াশা আগের চেয়ে কম, ঢিমাতালে সূর্যের আলো দেখা যাচ্ছে। নৌকার পালে হাওয়া নেই এ বেলা। নৌকা বাইতে কষ্ট হচ্ছে।আজকে সুবল কিছুটা সুস্থ। তার বদলে নাও বাইছে বখতিয়ার। উমানাথ সুবলের সাথে বসলো,
‎"কি রে সুবলা, এখন কেমন লাগছে এখন? আরে পয়লা পয়লা এমন হয়,পরে সব ঠিক হয়ে যায়,মা নিজেই হিম্মত দিয়ে দেয় । কত দেখলাম। আরে আমি আগে যে দলে ছিলাম, ভবানী বুড়োর দলে, সেখানে একজন ছিলো, নাম তার মহাদেব তার ছেলে কাত্তিক। মাত্র ১৪ বছর বয়স। তোপানির গুড় মুখে তুলে নৌকায় চেপেছে। বিয়ালের জায়গায় সর্দার ঝিড়নী দিলো। ছেলে ঐ খুনখারাবি দেখে ঐখানেই হেগে,মুতে একবারে অক্কা! কি বুঝলি? "
‎সুবল মাথা নেড়ে সায় দেয়। সে হিম্মত পেয়ে গেছে গতকালই, তার মন শুধু ভড়কে গেছে খানিকটা। সে জানে পরের বার সে ব্যাপারটাকে ঠিক সামলে নিবে।

দুপুরবেলা নৌকা পৌছাল বহরমপুর আর বোয়ালিয়ার মাঝামাঝি একটা চরে। এখন মালামাল সহ লোকালয় ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলছে কালীচরণ। চরে হালকা রোদে, তপ্ত বালিতে সকলেই আরাম করে নিচ্ছে। রাখাল, দেবু রান্নার ব্যবস্থা করতে শুরু করেছে। উমানাথ জেলে নৌকা থেকে পিউলি মাছ কিনল।
"মোওয়ার মাছ কে এরা বলে পিউলি! দেখিস সুবল! বহরমপুর থেকে বিলাইতি বেগুন কিনেছি আর ধনেপাতা, এমন অমৃত রান্না করবো না খেলেই একেবারে চাঙ্গা! "
যেদিন সকলের মন ভালো থাকে সেদিন উমানাথ রান্না করে। সে দুপুরে টমেটো আর ধনেপাতা দিয়ে পিউলি মাছের ঝোল রান্না করল। যেটা ছিলো সত্যিই অমৃত। সুবল জ্বরের মুখে স্বাদ ফিরে পেল। চেটেপুটে সবটুকু ভাত সে খেয়ে ফেললো। সকলে খাওয়াদাওয়া করে একটু গড়িয়ে নিলো চরের বালুতে। বিকেল শুরু হতে হতেই ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করলো। সবাই তাড়াতাড়ি নৌকা ছেড়ে দিলো।

সন্ধ্যে গড়িয়ে নৌকা এসে পৌছল ঈশ্বরদী। ঘাটে অনেক নৌকার সাথে ঘাসিনৌকাটা বাঁধা হল ব্যবসায়ী নৌকার বেশে। নদীর ঘাটে একটা বটগাছের নিচে কুপি জ্বালিয়ে একজন সাধু বসে একতারা বাজাচ্ছে আর গান গাইছে।

জেলে নৌকাগুলিতে আলো জ্বলছে। তাদের রান্নার খাওয়ার সাধারণ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। নৌকার পাশেই চুলা জ্বালতে শুরু করল দেবু, কিছু সবজি ছিলো নৌকায়,সেগুলো কাটাকাটি করে ধুয়ে রান্নার প্রস্তুতি নিতে লাগলো সুবল।বটগাছ তলা থেকে করুন সুরের গান ভেসে আসছে,

"বলো স্বরূপ কোথায় আমার সাধের প্যারি।

যার জন্য হয়েছি রে দণ্ডধারী।।

কোথা সে নিকুঞ্জ বন
কোথা যমুনা উজান।
কোথা সেই গোপ গোপিনীগণ আহা মরি।।

রামানন্দের দরশনে
পূর্বভাব উদয় মনে।
যাবো আমি কার বা সনে সেই পুরী।।

আর কি রে সেই সঙ্গ পাবো
মনের সাধ মিটাইবো।
পরম আনন্দে রবো ঐ রূপ হেরি।।

গোরাঙ্গ এই দিনে বলে
আকুল হলাম তিলে তিলে।
লালন বলে ব্রজলীলে কী মাধুরী।। "

গান শুনে সবাই যেন কেমন উদাস হয়ে যায়, রাখাল উমানাথের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"এরা তো বৈষ্ণবীও না আবার গায়েনও না, তবে এরা কারা গো?"
"এরা বাউল সাধক। ছেউড়িয়ার ফকির লালন সাঁইয়ের অনুসারী। কি মধুর গান, আহা! "
রাতে সকলে নৌকায় খেতে বসলো। রাতের খাবার ল্যাবড়া আর ডাল-ভাত। খেতে খেতে কালীচরণ বলল,
"কাল সকাল সকাল গ্যাঞ্জেল ঘাট যেতে পারলে, সেখানে সোনাদানা গুলো ভালো দামে বেচে দেয়া যাবে। গ্যাঞ্জেল ঘাটে কাজ সেরে দুপুরবেলা বেরিয়ে পড়তে পারলেই রাতের বেলা নারায়ণগঞ্জ। কাল উমানাথ আর আমি যাব চোর বাজারে। উমানাথ আমার থেকে ভাল চেনে ঐ গ্যাঞ্জেল ঘাট। "
উমানাথ খাওয়া শেষ করে একটা পান মুখে দিয়ে মিচকি হেসে তার গল্পের ঝুড়ি খুলে বসলো,সাবাই চাদর দিয়ে মাথা মুখ ঢেকে উন্মুখ শ্রোতা,
"এই গ্যাঞ্জেল ঘাটের নাম এক সাহেব ডাকাত গনজালেসের নাম থেকে হয়েছে। সে তার সময়কার সবচেয়ে নামী ডাকাত ছিল। গনজালেস সাহেব বাংলায় আসে সাধারন সিপাই হয়ে, এরপরে সে লবণ ব্যবসা় শুরু করে। ব্যবসায় কানাকড়ি সব হারিয়ে সে ডাকাত বনে যায়, তার জাহাজ ছিল অনেক। বাংলার প্রতিটা নদীতে সে ডাকাতি করতো।সুন্দরবন থেকে আরাকান পর্যন্ত সে লুটতরাজ করতো। সে থাকতো সন্দ্বীপে। তার কথাই ছিলো সন্দ্বীপের শেষ আইন। তার ধনরত্ন কোন রাজাগজার চেয়ে কম ছিলোনা। কামান বসানো আশীখানা জাহাজ ছিলো তার।
গনজালেসের ভোল পাল্টাতে সময় লাগতো না। মোগল বাহিনীর আক্রমনের ভয়ে সে আরাকান রাজার সাথে দোস্তি করত আবার মোগল বাহিনীর পয়সা খেয়ে সে উলটো আরাকানরাজের শত্রু সেজে বসতো।
এরপর আরাকানের রাজা একবার সন্দ্বীপ দখল করে নেয়, তারপর থেকে গনজালেসের কথা আর কখনো শোনা যায়নি।"
রাত বাড়ছে। শেয়াল কুকুরের ডাকের মাঝেমাঝে বাউলের একতারার টুংটাং ও শোনা যাচ্ছে। আগামীকালের উত্তেজনা নিয়ে সবাই চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে গেল। উমানাথ কল্কীতে গাঁজা সাজাতে সাজাতে বাউলের দিকে এগোল।

পরদিন খুব ভোরবেলা নৌকা ঈশ্বরদী ছাড়লো। সকালবেলা গ্যাঞ্জেল ঘাট। এই ঘাটে জাহাজও থামে। বড় জাহাজে মালামাল তোলা হচ্ছে, খালাসীরা মালামাল খালাস করছে। দেখে সুবলের চক্ষুছানাবড়া। গ্যাঞ্জেল ঘাট বারোয়ারি লোকের বাজার। সাহেব, ফিরিঙ্গী, ওলন্দাজ, পর্তুগীজ, মগ,বিহারী, মারোয়াড়ী, মারাঠি সব জাতির আনাগোনা এখানে। নৌকা ঘাটে রেখে কালীচরণ আর উমানাথ নামলো নৌকা থেকে। কালীচরণ সবাইকে বারবার বলল নৌকা খালি রেখে যেন কেউ না যায়। রাখাল একটু উশখুশ করছে দেখে, কালীচরণ তাকে ছেড়ে দেয়। রাখাল উমানাথের ইশারায় সুবলকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে, কালীচরণ কোন উত্তর না দিয়ে গয়নাগাটির পোটলা নিয়ে রওনা দেয় চোর বাজারের দিকে। বখতিয়ার, বলরাম, দেবু, নৌকায় থেকে গেল। রমা আর ধলা আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগলো। রাখাল সুবলকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে লাগলো। ছোট বড় নানান ধরনের দোকানপাট, জুয়ার আসর,বড় বড় গুদাম। সবশেষে রাখাল এসে পৌঁছাল গণিকালয়ে। রাখাল মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
"এবার যে তোকে একা ছাড়তেই হবে রে!" সুবল শুধু হাসে। রাখাল কিছু পয়সা সুবলের হাতে দিয়ে বলল,
"তুই আশেপাশে ঘোরাঘুরি কর। আমি খানিক বাদেই আসছি।" সুবল আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে, কিছু বাতাসা কিনে খেতে খেতে একটা গোল জটলা দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল। সেখানে এক সাহেব তুসমাবাজ তুসমাবাজী দেখাচ্ছে। দড়ির এক মাথায় ফাঁস তৈরি করে মাটিতে রাখছে সে, তারপর দর্শকদদের দিয়ে সেখানে লাঠি ধরাচ্ছে, বাজি ধরা হচ্ছে।এরপর সে দড়ির অন্য মাথা ধরে টান দিচ্ছে।এই তুসমাবাজী সুবল জানে। এখানে লাঠি যদি ফাঁসে আটকাল তো পাঁচ রুপেয়া,তুসমাবাজ হারল,যদি ফাঁস ফাঁকি দেয়, খুলে যায় তো দর্শক ঠকল, এবার কত দেবে বল। একেকজন তুসমাবাজের দলে পঞ্চাশ -ষাট জন লোক থাকে। এরা দর্শক সেজে থাকে, এরা যখন লাঠি ফাঁসে ধরবে তখন ফাঁস আটকাবেই। তাদেখে অন্য দর্শকরা আগ্রহী হবে অথবা দলের লোকজন একজন কে লক্ষ করে ফুসলিয়ে রাজি করবে লাঠি ধরার জন্য। সাহেব তুসমাবাজের চোখে চোখ পড়তেই সুবল সটকে পড়ল।

দুপুরবেলা কাজ শেষ করে কালীচরণ আর উমানাথ ফিরে এলো। রাখাল ফিরে এলো তার কিছুক্ষণ পরেই। সুবল একা একা পথ চিনে আগেই চলে এসেছিল।এদিকে ঘাটে মানুষজনে গিজগিজ করছে, পা ফেলার জায়গা নেই। সেখানে রান্না কিভাবে করবে আর জিরাবে কী। এদিকে বখতিয়ার বড় দেখে একটা পদ্মার পাঙাশ মাছ কিনে বসে আছে, সেটাই বা কাটবে কোথায়। এই নিয়ে আলোচনা চলছিল। এমন সময় কালীচরণ বলল,
"এখানে কাজ শেষ আর থাকার দরকার নেই। কাছেই কোন চর দেখে নৌকা থামালেই হবে।সেখানে একটু থিরিয়ে নিলেই চলবে। নারায়ণগঞ্জ পৌঁছাতে রাত হবে।" তার কথামতই কাজ হল। গাঞ্জেল ঘাট থেকে একেবারে কাছেই নতুন চর জেগেছে। সেখানে নৌকার নোঙর ফেলা হল। অনেক আয়োজন করে সুবল আর দেবু মিলে পাঙাশ মাছ রান্না করল। দুপুরবেলা খাবার পর সকলে নৌকায় জিরিয়ে নিতে নিতে, কত টাকার মাল বিক্রি হল, লাভ হল না, লোকসান হল আর আনুমানিক কত টাকায় বাকি মালামাল বিক্রি হবে তা হিসাব করতে থাকলো। উমানাথ গ্যাঞ্জেল ঘাটের চোরাবাজারের কথা তুলে বলল,
"এখানে দাম একটু কম হলেও, খাজনা দিতে হয় না, কাল দেখ কত ঘুস আর খাজনা দেয়া লাগে! "
রোদের তেজ একটু ম্লান হয়ে এলে নৌকা ছাড়া হল নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে। বেশ ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়ায় নৌকা দুলে দুলে এগোতে থাকলো। মাঝিদের বেশি কষ্ট করতে হল না।
ঘাসিনৌকাটা পদ্মা থেকে মেঘনা হয়ে শিতলক্ষা নদী দিয়ে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছাল। তখন মধ্যরাত । এই মধ্যরাতে নৌকা ঘাটে না লাগিয়ে মাঝ নদীতেই থাকা বেশি নিরাপদ মনেকরল কালীচরণ।
"আজ রাতটা একটু কষ্টকরে কাটিয়ে দে সকলে, কাল সারাদিন নারায়ণগঞ্জেই থাকা। সব ঠিকঠাক থাকলে পরদিন ভোরেই রওনা দিব নিমতিতা ঘাট।আজকে খই বাতাসা যা আছে তাই খেয়ে কাটিয়ে দে কোন রকম। "
কালীচরণের কথার ওপর কেউ কোনদিন কথা বলেনি। সবাই তার ওপর ভরসা করে। নৌকা মাঝনদীতে স্থির রেখে, সবাই একসাথে খৈ, বাতাসা আর পানি খেয়ে শুয়ে পড়লো। পাহারা দেয়ার জন্য দেবু আর রাখাল জেগে রইলো। উমানাথ গাঁজা খেতে খেতে চুপচাপ, নৌকার হাল ধরে, মধ্যরাতে মাঝনদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকলো। এই সৌন্দর্য নদী সবার সামনে উন্মোচন করে না।

পরদিন ভোরবেলা নৌকা ঘাটে বাধা হল। ঘাটে একটা ফাঁকা জায়গায় সুবল আলুসিদ্ধ ভাত বসিয়ে দিল। রান্না হয়ে গেলে সবাই গোগ্রাসে গিলে কাজে লেগে গেল। নৌকার মালামাল গুলি খুলে ছোট, মাঝারি পোটলায় ভাগ করে নিলো। তারপর কেউ কাঁধে কেউ মাথায় করে সেই মালামালগুলি নিয়ে বড়বাজারের দিকে হাঁটা দিলো। নৌকা পাহারায় থেকে গেল শুধু সুবল।

শিতলক্ষা নদীর ধারে বিশাল বড় বাজার। অনেক দোকানপাঠ, হরেকরকমের ব্যবসায়ী। উমানাথ, কালীচরণ আগে আগে হাটে, পিছনে লটবহর। এখানে সরকারি লোকজনের দহরমমহরম বেশি। ধলা আর রমা তামাকের আড়তের দিকে গেল তামাকগুলি খালাস করতে।এ দোকান, ওদোকান ঘুরে, অনেকক্ষণ হাঁটার পর কালীচরণ দলবল সমেত এগিয়ে গেল বড় দেখে এক কাপড়ের দোকানে। দোকানের মালিক চুনিলাল পান্ডে। চুনিলাল ভালভাবে উমানাথ আর কালীচরণ দুজন কে দেখল। তারপর তার কর্মচারী কে বলল,
"এই জগা! ওগো থিইকা মালগুলান নে। ভিত্রে লইয়া আন। ওগো জল দে।"
মালামাল সব দোকানের গদির ওপর ফেলা হল।উমানাথ লক্ষ করল, দলের বাকি কয়জনকে পানির সাথে মুড়ি, গুড় দেয়া হয়েছে। সে বুঝতে পারলো এখানে যে দামেই হোক মাল দিয়ে যেতে হবে, এই ব্যাপারী ছাড়ার পাত্র না। চুনিলাল তার গায়ের সুতির চাদরটা একপাশে খুলে রাখতে রাখতে তার কর্মচারী কে বলল,
"এই জগা! এইহানে বাবুদের জল দে!" তারপর সে একমনে খুটিয়ে খুটিয়ে সব রেশমি কাপড় আর রাজস্থানি কাজ করা কাপড় দেখতে লাগলো।কাপড় থেকে মাথা না তুলে সে বলল,
"তা কোন হানে থাকা হয়?কলিকাতা? " কালীচরণ উত্তর দিলো,
"আজ্ঞে না বর্ধমান। "
"ও বর্দমান! ওইহানে তো আমার খুড়তুতো ভাই থাহে,কবিরাজ।নাম লক্ষীনারায়ণ ঠাকুর। তা বর্দমানে এই মাল পাইলেন ক্যামনে? " এবার উমানাথ বলল,
"আজ্ঞে পাটনা থেকে কিনেছি। "
"কিছু মনে নিয়েন না,আসলে মালগুলান কার?"
এবার কালীচরণের বুক একটু ধক করে উঠল। সে একটু গলা খ্যাঁকারি দিয়ে বলল,
"কার মানে?"
"না মানে কইতে ছিলাম, আপনাগো দুইজনের মাঝে কার লগে কতা কমু, যার মাল তার লগে কথা কমু, অন্যজনের লগে প্যাচাল পাইরা তো লাব নাই, কি কন?"
জগা এক গামলা মুড়ি, কিছু বাতাসা আর দুই গেলাস লেবুর সরবত দিয়ে গেল। কালীচরণ সরবত নিতে নিতে বলল,
"মালামাল যা আছে তা আমরা দুজনে মিলেই কিনেছি। আপনি যা বলার বলুন"
"ও আইচ্ছা! তা সকাল থিইকা তো বহু গুরতাসেন দেহি । বাজার দ্যাখছেন,এই মাল এই হানে নাই। এইহানে সব শালা তাঁতি, আপনার মাল কিনবো কেডায়? হেহ হেহ হে" চুনিলাল ফিচেল হাসি দিলো। কালীচরণ উমানাথের দিকে তাকালো। উমানাথ অমায়িক ভাবে হেসে বলল,
"আমরা সওদাগর মানুষ। এখানে বিক্রি না হলে ঢাকায় যাব।"
"হ তাতো তো যাইবার পারেনই। ঢাকা বড়লোকগো জায়গা,সরকারি লোকে বরা।ওইহানে কাগজপত্তর লইয়া যে জামেলা হয়! সব খালি ট্যাকা খাওনের ধান্দা।তা আপনাগো লগে তো পাটনা বাজারের ছাড়পত্তর আছে, দেহি।"
আবার উমানাথ আর কালীচরণ একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। ছাড়পত্র আছে ঠিকই কিন্তু সেটা মারোয়াড়ীর নামে। উমানাথ একটু নিচু গলায় বলল,
"আজ্ঞে, আপনি ব্যাপারী মানুষ, ব্যাবসার তো সাতপাঁচ সবই বোঝেন। ছাড়পত্র নিতে গেলে কয়েক জায়গায় টাকা দিতে হয়, আর শুধু ঘাটে টাকা দিলে...মানে। "
"হ, সবই বুঝচ্ছি। তয় আপনাগো ব্যবসা সাত না পাঁচ এইডা বুঝি নাই। দ্যাহেন এই বাজার হইল দেবোত্তর সম্পত্তি। মানে এই বাজারের মালিক ভগবান, বাজার থিইকা যা আয় হইবো সব যাইবো তেনার ঘরে। সরকার বেণু ঠাকুরে এই ব্যবস্থা কইরা রাখছে। মিছা কথা কমু না এইহানে সরকার আমগো বাড়ির লোকই। নিয়ম-কানুন সব তাগো হাতেই। আমার কাছে মাল ব্যাছলে ভগবানরেও ট্যাকা দেওন লাগবো না।তাছাড়া ব্যাজাইল্লা মাল লইয়া এইহানে ওইহানে যাওনো ঠিক হইবো না। সরকারি লোকগো কাম, একবার হেই প্যাঁচে পড়লে...এতগুলান ট্যাকার মাল!"
এবার উমানাথ কালীচরণ দুজনেই বুঝতে পেরেছে, তারা জিম্মি। এইখানে মাল বিক্রি না করলে নৌকায় ফের মাল উঠার আগেই ধরা পরবে তারা। কালীচরণ বলল,
"আমরা অনেক দূর থেকে আসছি, কলকাতায় এইমালের দাম অনেকই পাওয়া যেত। নারায়ণগঞ্জ আসা শুধু একটু বেশি লাভের আশায়।আপনি বিবেচনা করে দাম বলুন। দুকথা হবে না।"
"আহা! তা কলিকাতায় ব্যছলেন না ক্যান!কলিকাতার থিইকা বেশিই পাইবেন চিন্তা নাই। আরে! যাওন আনোনের একটা খরচা আছে না। এই নারায়ণগঞ্জে একলগে নগদে আপনাগো সব মাল নেওনের মত ব্যাপারী এই চুনী লাল পান্ডে ছাড়া আর কেউ নাই কইলাম। "

দুপুর নগাদ কালীচরণ তার দলবল নিয়ে নৌকায় ফিরে এলো। ধলা আর রমা তামাক বেচে বেশ লাভ করেছে। চুনিলাল পান্ডে সব মালামাল অর্ধেকের একটু বেশি দামে কিনেছে নগদ টাকায়। সব মিলিয়ে কালীচরণের হাতে এখন মোটা টাকা। সবার আসতে দেরি দেখে সুবল রান্না শুরু করেছে একটু দেরিতে।দুপুরের খাবার সরিষার তেলে ভাজা পুঁটিমাছ,ডাল আর বেগুন ভর্তা। খাবার খেতে খেতে কালীচরণ বলল,
" তামাক বেচে তো রমা আর ধলা ভালই লাভ করেছে,মোট ২৫ রুপেয়া।আর অত দামী কাপড় সব অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হল। সব মিলিয়ে ১০০ বাংলা রুপেয়া,৩টা মোহর পাওয়া গেছে।বাংলা রুপেয়া তো গ্যাছে! কমদামে কাপড় পাচ্ছে দেখে চুনিলাল তাও ৩টা মোহর দিল। "
‎উমানাথ পাশ থেকে বলল,
‎"তা যা বলেছ সর্দার। বাংলা রুপেয়া ৩০-৩৫ টা দিলে একটা মোহর মেলে। তাও কি দিতে চায়! এখন ১ রুপেয়ায় ২ বস্তা চাল, ঐ ব্যাস! আহা! তুমি দেখে নিও এই রুপেয়া ‎আর টিকবে না গো।কোম্পানি নতুন রুপেয়া ছাড়বে বাজারে এ আমি কয়ে দিলাম। "
‎"এখান থেকে সবাই সমান ভাগ পাবে। তারপর মা'র মন্দিরের জন্য সমান পয়সা দেবে। এখানে থাকাটা মনেহয় আর ঠিক হবেনা বুঝলি! এখান থেকে কাছেই কোন চরে রাতটা থেকে, পরদিন খুব ভোরে, অন্ধকার থাকতে থাকতে রওনা করবো। "
মাঝখানে ঝকঝকে হাসিমূখ নিয়ে দেবু বলল,
"সর্দার, বাজার থেকে ছোট একটা পাঁঠা কিনে নিলে কেমন হয়। ওইখানে ১২ আনায় করে বিক্রি করছে। সাথে চিকণ চাল আর তাড়ি! "
কালীচরণ হাসি মূখে বলল,
"তুই আর রাখাল যা, একেবারে সব বাজার সদাই করে নিয়ে আয়।"
শেষ বিকেলে রাখাল আর দেবু সব বাজার সদাই করে নৌকায় ফিরে এল। একটা কচি পাঁঠা, এক পোটলা চাল,মশলাপাতি আর এক হাড়ি তাড়ি। নৌকা ছাড়া হল সূর্য ডোবার আগেই।

কাছাকাছি একটা ফাকা চরে নৌকা নোঙর করল। শীত যা পড়েছে তাতে চরের ঠান্ডা বাতাসে জমে যেতে হয়। তার মধ্যেই সুবল, রাখাল আর দেবুর যেন আনন্দের শেষ নেই।তারা হৈচৈ করে রান্নার ব্যবস্থা করতে লাগলো। বখতিয়ার আর বলরাম মিলে পাঁঠাকে নিমিষেই তৈরি করে ফেলল।কালীচরণ, রমা আর ধলা তার কাছেই এক যায়গায় আগুন জ্বেলে গোল হয়ে বসে তামুক টানতে লাগলো। উমানাথ রাখাল কে বলল,
"মরিচ বেশী করে বাট, অনেক ঝাল করে মাংস রান্না হবে আজকে! " মাঝখানে রমা আর ধলার ডাক পড়লো মাংস কাটার জন্যে।উমানাথ তাদের দেখিয়ে দিচ্ছে মাংসের টুকরা কত বড় রাখতে হবে। বখতিয়ার আর বলরাম স্নান করতে গেল।মাংস কাটা হয়ে গেলে তা বেশী মশলা দিয়ে মাখিয়ে চুলায় তুলে দেয়া হল। রাতে রান্না হয়ে গেলে খাওয়াদাওয়া, তাড়ি, আনন্দ ফূর্তি চলল মধ্যরাত পর্যন্ত। পরদিন ভোরবেলা আলো না ফুটতেই নৌকা ছাড়া হল নিমতিতা ঘাটের উদ্দেশ্যে।

১ দিন পর যখন কালীচরণ দলবল সমেত নিমতিতা ঘাট পৌঁছাল তখন প্রায় সন্ধ্যা। তারা মাঝনদীতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল অন্ধকার হওয়ার জন্য। অন্ধকার নামলে ঘাসিনৌকাটা চুপিচুপি নদীর ওপারে খাঁড়ি দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল। মা কালীর পায়ে লুটের টাকা সব ঠেকিয়ে নিয়ে, মা কালীর সামনেই টাকাকড়ি সব সমানে ভাগ করা হল।তারপর সবাই সেখান থেকে মায়ের মন্দিরের জন্য টাকা দিল কালীচরণের হাতে। কালীচরণ টাকা নিয়ে বলল,"সামনের মঙ্গলবার থেকে কাজ শুরু হবে।জয় মা কালী!"

রাতে বাড়ি ফিরে কুয়োর জলে স্নান করে অনেকটাই ঝরঝরে অনুভব করছে কালীচরণ , রাতের খাবার পর একটা পান মুখে দিয়ে চোখ বুঝল সে।পাশে তার বৌ গুণগুণ করে গান করছে আর তার বুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তার ছেলেমেয়েরা নিচে মেঝেতে বিছানা করে ঘুমাচ্ছে। কালীচরণের দুই চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। তার মনে হচ্ছে যেন সে উঁচু কোন যায়গা থেকে পড়ে যাচ্ছে।শীতের রাত, আখ ক্ষেতে শেয়ালরা হানা দিয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর দলবেঁধে ডেকে উঠছে। সাথেসাথে পাড়ার কুকুর গুলি ঘেউঘেউ করে উঠছে। এমন ঝিঁঝিঁ ডাকা রাতে দশঘর দূরে কেউ হাঁচি দিলেও শোনা যায়। হঠাৎ কালীচরণের পাতলা ঘুম ভেঙে গেল একটা শব্দে। কেউ বাড়ির পেছনের দিকটায় কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। কালীচরণ একবার তার বৌয়ের দিকে তাকালো, সে বেঘোর ঘুমে। কালীচরণ উঠে ঘরের কোন থেকে কুপিটা নিয়ে বাইরে এল। এখনো ক্রমাগত কোদালের কোপ পড়ছে। কালীচরণ দুবার সুবল কে ডাকলো। সুবল বারান্দার ঘেরা দিকটায় চৌকির ওপর কাঁথাকম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। সুবলের সাড়া না পেয়ে কালীচরণ একটা বাঁশের লাঠি নিয়ে ঘরের পেছন দিকটায় এগিয়ে গেল। বাড়ির পেছনে যেতেই কালীচরণ কুপির আবছা আলোয় দেখতে পেল একজন বিধবা কোদাল দিয়ে একটা ছোট গোল গর্ত করছে। গর্তের পাশে মাটিতে ছোট একটা সাদা কাপড়ের পোঁটলা রাখা। কালীচরণ কাঁপা গলায় চিৎকার করে বলল,
"কে রে ওখানে? কি করা হচ্ছে? "
"আজ্ঞে আমি।"
"আমি কে? "
"আজ্ঞে এটা একটা বামুনের সন্তান, পেটে থাকতেই মারা গিয়েছে। তাই পুঁতে রাখছি।"
"তা এখানে কেন? যাও অন্য কোন জায়গায় পোঁত। এখানে নয়.. "
"আজ্ঞে কোথায় যাব? কোথায় পুঁতবো...? "
"যেখানে খুশি যাও, অন্য জায়গা যাও, এখানে হবেনা।"
"এখানেই তো হবে, ওরা বলেছে... এখানেই পুঁততে হবে।"
"ওরা? ওরা কারা? "
"ঐ যে ওরা, যারা বলে বামুন মারলে ঝাড়েবংশে নিপাত হয়, তারা"
"কারা? কি বলছো এইসব? কে? কে মেরেছে? "
কালীচরণের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। বিধবা আবার যন্ত্রের মত কোদাল দিয়ে গর্ত খুঁড়েই যাচ্ছে। কালীচরণ একদৌড়ে বাড়ির সামনে এসে সুবল কে ডাকতে লাগলো। সুবলের কোন সাড়াশব্দ নেই দেখে সে ঘরে ঢুকে তার বৌকে ডাকতে লাগলো।
"ও বৌ, বৌ ওঠ, ও বৌ..."
পাশথেকে কালীচরণের বৌ লাফিয়ে উঠে তার স্বামী কে ধরে ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
"ও গো, শুনছো কি হয়েছে তোমার? অমন কচ্চো কেন? ও গো? হায় হায় গা তো ঘামে ভিজে যাচ্চে, জয় মা কালী, জয় মা কালী, মা গো রক্ষে কর মা! ও গো... "
কালীচরণ ঘুমের মধ্যে গোঁগোঁ করছিল, ঝাঁকি খেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলো।
"জল, জল, একটু জল খাবো, মা গো মা একটু জল...আহ!"
কালীচরণের বৌ কলস থেকে ঘটিতে করে জল নিয়ে এল এবং পাখা দিয়ে স্বামীকে বাতাস করতে লাগলো।

পরদিন কালীচরণ নদীর ওপারে জঙ্গলে গেল। কালী মায়ের চরণে পড়ে অনেক কান্নাকাটি করল সারাদিন। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে এসে কালীচরণ দেখল তার বৌ ছেলের মাথায় জল ঢালছে । তার ছেলের প্রচণ্ড জ্বর,থেকে থেকে বমি করছে, মাথা ব্যাথায় কাতরাচ্ছে,সারা শরীর ব্যথা আর জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকছে। সুবল বাড়ি নেই কবিরাজ ডাকতে গেছে।
কবিরাজের নাম কাশিনাথ, বয়স বুড়ো বটগাছের মত। আজকাল চোখে ভাল দেখতে পায় না।সুবল তার হাত ধরে তাদের বাড়িতে নিয়ে এল। কবিরাজ এসে ছেলের নাড়ি টিপে দেখে মাথা নাড়ল। নিজের ঝোলার ভেতর থেকে কিছু শুকনো পাতা গুরা করে দুধে ভিজিয়ে দিল।
"এই দুধ গরম করে সকালবেলা খালি পেটে খাবে। এখন একটা গোলী দিচ্ছি এটা গরম জলের সাথে খায়িয়ে দিতে হবে। আমি কাল আবার আসবো। " ঘরথেকে বের হয়ে কবিরাজ কালীচরণের কানে ফিসফিস করে বলল,
"মনেহয় কালা জ্বর! "
সুবল আবার কবিরাজের হাত ধরে বেরিয়ে গেল তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে।

কবিরাজের যাওয়াআসা চলতে থাকলো,কিন্তু ঔষধে তেমন একটা লাভ হল না।কালীচরণের ছেলের শরীর দিন দিন খারাপ হতে থাকে। কালীচরণ ছেলের জন্য মায়ের উদ্দেশ্যে পাঁঠা বলি দেয়, মন্দিরের কাজ নিজে গতরখেটে তাড়াতাড়ি করে দেয়, বাহ্মন ভোজন করায়,কালীঘাটে পূজো দিয়ে আসে। সারাদিন রাত মায়ের চরণতলে পড়ে থাকে, তবুও মায়ের দেখা মেলেনা। মায়ের কৃপা হয় না। এভাবে এক মাস চলে যায়। একরাতে কালীচরণ স্বপ্নে দেখল, সে বৃন্দাবনে ছাগল চরাচ্ছে। অনেকগুলি ছাগলের মধ্যে একটা কালো পাঠী কালীচরণের দিকে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছে। কালীচরণ সেটার দিকে এগিয়ে যেতেই, সেটা দৌড় দিল। কিছুদূর গিয়ে আবার সে কালীচরণের দিকে তাকিয়ে থাকলো আগের মত করে। এভাবে এক সময় কালীচরণ হাল ছেড়ে দিয়ে মাটিতে বসে কাঁদতে লাগলো। সকালে ঘুম থেকে উঠার পরও কালীচরণের চোখ ভেজাই ছিল। সেদিন থেকে কালীচরণের ছেলের আর জ্বর এলো না, বমি হল না,শুধু সারা শরীর ব্যাথা করতে থাকলো। এভাবে এক সময় কালীচরণের ছেলে প্রানে বেঁচে গেল ঠিকই, কিন্তু তার মূখে আর কোনদিন কথা ফুটলো না।

১৮১৭ সালের ১৫ মে, কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে, শিল্পপতি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ঘরে জন্ম নিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।সে সময় মুর্শিদাবাদের মাজিস্ট্রেট ছিলেন ডাব্লিউ.লক। এক জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুরবেলা। কাঁঠাল পাকা আঠালো গরমে মাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছারিঘরের দরজায় হেলান দিয়ে বসে কালীচরণ তার সম্পূর্ণ বয়ান দিলো। সবশুনে মাজিস্ট্রেট সাহেব টানা পাখার বাতাসেও ঘামছিলেন।যুবক একজন পুলিশ অফিসার তাঁর সামনে মেরুদণ্ড সোজা করে বসে আছেন। পুলিশ অফিসারটি ঠিক বুঝতে পারছে না কি করা উচিৎ। মাজিস্ট্রেট সাহেব শার্টের কলার অঙুল দিয়ে কিছুটা হালকা করে অবাক হয়ে বাইরে আমগাছ তলার দিকে তাকালেন, সাতজন লোক বসে আছে, বসে বসে গল্প, হালকা হাসি তামাশা করছে। দেখলে যেন মনেহয় সাধারণ গ্রাম্য মাঝী। অথচ কে বলবে এরা এক একজন খুনি, ঠগী, মানুষ খুন করা যাদের ধর্ম। যারা নিজেদের সর্দারের হুকুমে হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে চলে এসেছে। মাজিস্ট্রেট সাহেব একগ্লাস জল খেয়ে দোভাষী কে জিজ্ঞাস করল,
"আরেকজন লোক কোথায়? " দোভাষী বাংলায় কালীচরণ কে জিজ্ঞেস করল, কালীচরণ আফসোসের সাথে বলল,
"ও বখতিয়ার! সাহেব,গেল বছর যক্ষ্মায় মরে গেছে।" সাহেব এবার চোখ দুটি সরু করে দোভাষীর মাধ্যমে জিজ্ঞেস করল,
" এতদিন পরে কেন?" দোভাষী কালীচরণকে জিজ্ঞেস করাতে সে উত্তর দিলো,
"কি আর বলবো সাহেব,ঐ ঘটনার পর ছেলেটা বোবা হয়ে গেল! সুবলের বিয়ে হল, কোন ছেলেপুলে হল না! আমার ছেলেটার বিয়ে সামনে, যদি তারও ছেলেপুলে না হয় তো এই শাপে আমার বংশ এখানেই শেষ। সেদিন প্রায় ১২বছর পর মা আবার স্বপ্নে এল, বললে পাপ বাপকেও ছাড়ে না বাপু, বাহ্মন সন্তান মারার শাপ, একি যে সে শাপ! একমাত্র প্রান দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলে তবেই মুক্তি। যাহ সবাই মিলে থানাদারের কাছে যাহ, ধরা দে।তারপরই তো আমার কোলে,সুখই সুখ! থানাদারের কাছে গেলাম তো আপনার কাছে নিয়ে এলেন হুজুর।"
মাজিস্ট্রেট সাহেব শুনে তাজ্জব বনে গেলেন। তিনি একবার তাঁর কলমচির দিকে তাকালেন।বয়স্ক কলমচি মোটা কাঁচের চশমার উপর দিয়ে নির্বিকার মুখে একবার সাহেবের দিকে তাকাল আরেকবার কালীচরণের দিকে,তারপর কলম উঁচিয়ে বসে রইল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব চিন্তা করতে থাকলেন। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন,
"কবরের জায়গায় চিনে নিয়ে যেতে পারবে? "
"অবশ্যই হুজুর! "
ম্যাজিস্ট্রেট ডাব্লিউ.লক অবাক হয়ে চিন্তা করলেন, এই অদ্ভুত দেশে কোনটা যে শাপ আর কোনটা যে আশির্বাদ সেটা বুঝতে তাঁর আরও সময়ের প্রয়োজন। বাইরে আকাশ কালো করে ঝড় আসছিল, মূহুর্তের মধ্যে কাছারিঘর ঠান্ডা বাতাসে ভরে গেল। মাজিস্ট্রেট সাহেব হাঁক ছেড়ে চাপরাশি কে বলল,
"উনলোগকো আন্ডার বুলাও!"

মন্তব্য ১৫ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ২:৩১

প্রামানিক বলেছেন: "জয়ন্তী মঙ্গলা কালী সিদ্ধ কালী কপালিনী দূর্গা শিবা সমাধ্যার্তী সাহা সুধা নমস্তুতে।।"

পরদিন খুব ভোরবেলা নৌকা ঈশ্বরদী ছাড়লো। সকালবেলা গ্যাঞ্জেল ঘাট।

পুরোটাই পড়লাম। ডাকাতের ভয়ঙ্কর কাহিনী। কালীর সাধন করে আগে ডাকতরা ডাকাতি করতো-- এরকম গল্প আগে বুড়োদের কাছে অনেক শুনেছি। আপনার গল্পে সংস্কৃত শ্লোকসহ সেসব ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। গল্প পড়তে গিয়ে মনে হলো আমি সেই ব্রিটিশ আমলেই চলে গিয়েছি।
তবে প্রশ্ন হলো ঈশ্বরদীর পরে গ্যাঞ্জেল ঘাট এইটা কোন ঘাটের কথা বলেছেন?

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ ভোর ৬:৪০

যাযাবর জোনাকি বলেছেন: জনাব প্রামাণিক আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার মত পাঠকই আমার গল্প বলার অনুপ্রেরণা। নিম্নক্ত লিংকটি তে আপনি ঈশ্বরদীর পরের গ্যাঞ্জেল ঘাটের সন্ধান পাবেন।

https://bn.m.wikipedia.org/wiki/গোয়ালন্দ_উপজেলা

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:০৫

যাযাবর জোনাকি বলেছেন: Click This Link

২| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ৯:৫১

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: যেন পুরনো আমলে চলে গেলাম। দারুণ বর্ণনা।

৩| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:৪২

রাজীব নুর বলেছেন: এত বড়??!!

তারপরও অনেক সময় নিয়ে পড়লাম।
ভালো লাগলো।

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:০৮

যাযাবর জোনাকি বলেছেন: জনাব ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
"আসলে, কেউ বড়ো হয় না, বড়োর মত দেখায়,
নকলে আর আসলে তাকে বড়োর মত দেখায়"- শক্তি
আমার গল্পও তাই...

৪| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৪৩

নীল আকাশ বলেছেন: অনেক সময় নিয়ে পড়লাম । অসাধারন। খুব ভালো লাগলো । পড়তে পড়তে সেই ব্রিটিশ আমলেই চলে গিয়েছিলাম। আপনার লেখার ধরন ভালো। শুভ কামনা রইল। আরো কিছু ভালো গল্প পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম। ধন্যবাদ।

৫| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:৫৮

রক বেনন বলেছেন: একটানে পড়ে ফেললাম! অসাধারণ কাহিনী!!!

৬| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:২০

প্রামানিক বলেছেন: তাহলে কি গোয়ালন্দই গ্যাঞ্জেলা ঘাট?
তবে আপনার লেখা গল্প "শাপ" এবং "কুফরি কালাম" কালাম পড়ে বুঝতে পারলাম আপনে অনেক স্ট্যাডি করেন। শাপ পড়তে গিয়ে মনে হলো আপনি ভালো হিন্দু আবার "কুফরি কালাম" পড়তে গিয়ে মনে হলো আপনি ভালো মুসলমান। তবে হিন্দু মুসলমান যাই হোক আপনার লেখার মান অনেক ভালো। লেখার মান ভালো এই সার্টিফিকেট এই ব্লগে খুব কম লোকের আছে আর এই কমের মধ্যে আপনি একজন। হুমায়ুন আহমেদ যেদিন মারা যায় সেদিন আপনি বিয়ের বাজার করেন, সেই হিসেবে মনে হলো বয়স খুব বেশি না, তবে বয়স বেশি না হলেও লেখার কোয়ালিটি অনেকের চেয়ে বেশিই মনে হলো। রাত বারোটায় যখন শাপ গল্পটি পড়তে শুরু করেছিলাম তখন মনে হয়েছিল একজন বয়স্ক ঝানু লোকের লেখা পড়ছি। ব্লগে আপনার লেখা পড়তে গিয়ে আমার নিজের লেখা আর হলো না। পড়তে পড়তে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত সাড়ে তিনটা বাজে। যাইহোক-- আপনি লেখা লিখতে থাকেন পাঠক হিসাবে সাথে আছি।

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৩৪

যাযাবর জোনাকি বলেছেন: জনাব প্রামাণিক, শ্রীচরণকমলেষু,
লালন সাঁইজির গানে আছে,“ সব লোকে কয়, লালন ফকির হিন্দু কি যবন। লালন বলে, আমার আমি না জানি সন্ধান।” আমারও সেই দশা । প্রথমেই আবারও ধন্যবাদ দিতে চাই আমার লেখা গুলি পড়ার জন্য। আপনার মত পাঠাক পেয়ে আমি যারপরনাই আনন্দিত! এ যেন সহস্র অচেনা মানুষের ঢেউএ ভেসে যাওয়া এই 'আমি' এর হাত ধরে সেই 'আমি' বলছে "এই যে! আমাকেই খুঁজছিস তো? "। আপনার লেখা না হাওয়ায় আমি দুঃখিত। বয়স ধরে ফেলার যুক্তিতে আমি আপনাকে ৭০/১০০ দেব। কারন আমিতো বুড়ো বয়সেও বিয়ে করতে পারি! অথবা ওটা আমার ২য় বিয়ে। কোথাও পড়েছিলাম একজন লেখকের কাছে পাঠক ভগবান। আর ভক্ত তো শুধু ভগবানের কাছে নিজের আর্জিই পেশ করে যায় সারাজীবন, ভগবানের কোন কথা শোনার চেষ্টাটিও করে কখনো! তাই আমার ভগবানের কাছে আর্জি, একটু সময় করে আমার লেখা:মায়া(প্রথম দিকের লেখা),উনজন(আমার সবচেয়ে প্রিয়) এবং আষাঢ়ের অন্তরালবর্তী গল্পগুলি পড়ে দেখবেন।আপনার সৃজনশীল মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম। আমায় আশীর্বাদ করবেন।

৭| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৬

আমিন রবিন বলেছেন: অসাধারণ! এটা কি মৌলিক গল্প, নাকি এরকম কোন সত্য ঘটনার রেফারেন্স পাওয়া গেছে?

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৪৪

যাযাবর জোনাকি বলেছেন: মূল ঘটনা মৌলিক, কিন্তু কিছুকিছু ছোট ঘটনা এবং তথ্য একেবারে সত্যি। যেমন: ১৮১৭ সালে সত্যিই মুর্শিদাবাদের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ছিলেন ডাব্লিউ. লক। কিন্তু তাঁর জীবনে এইরকম কেস এসেছে কিনা তা কেউ বলতে পারবেনা। এটা গল্প। ইতিহাস নয়।

৮| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৪৬

আমিন রবিন বলেছেন: ব্লগে এই প্রথম কারো লেখনীতে মুগ্ধ হলাম। আমার অভিনন্দন রইল।

৯| ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:১৩

শামচুল হক বলেছেন: এক কথায় দারুণ।

১০| ১৩ ই জুন, ২০১৮ সকাল ৭:১০

অক্পটে বলেছেন: আপনার লেখা পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উঠা যায়না। ব্লগে এই প্রথম একজনকে পাওয়া গেল যার লেখায় একটা মোহনীয় ভাব থাকে। কি বলবো শুধুই মুগ্ধ হয়ে পড়ে গেলাম। আপনি ভালো থাকুন আমাদের সবার মাঝে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.